০৫. সোফিয়ায় রবিন ও রহস্যময় প্রফেসর
বয়ানা থেকে বিকেলের আগেই সোফিয়ায় ফিরে এসেছিলো নীল। ঘরে ফেরার পর থেকে ওর মন খারাপ। বাস থেকে নামতে যাবে–হন্তদন্ত হয়ে এক বেয়াক্কেল বুড়ো ওকে একরকম ধাক্কা দিয়েই নেমে গেলেন, যেন আগের ষ্টপেজে নামার কথা ছিলো, ভুলে এখানে চলে এসেছেন। নামার সময় নীলের হাতে ছোট্ট এক টুকরো কাগজ খুঁজে দিয়ে ফিস ফিশ করে বললেন, সাবধান, পেছনে গোয়েন্দা।
চমকে উঠে কাগজের পুটলিটা তখন পকেটে রেখে দিলো নীল। বুড়োর পেছন পেছন হন্তদন্ত হয়ে সেও নেমে গেলো। ঠিক তখনই একটা বাস ছাড়লো বুলেভার্ড দিমিত্রভের রুটে। চলতি বাসে লাফ দিয়ে উঠে পড়লো নীল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো ওর পেছন পেছন আসছিলো সেই মহিলা, যাকে ও প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারনি ভেবেছিলো, বাসে উঠতে না পেরে কটমট করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
নীলের তখনই মনে হয়েছে ওকে ওরা চিনে ফেলেছে। দুবার বাস বদল করে বাড়ি ফেরার পথে সন্দেহজনক আর কাউকে ওর চোখে পড়লো না। তবু মনে হলো, আড়াল থেকে কেউ ওর গতিবিধি লক্ষ্য করেছে। নিজের বোকামির কথা ভেবে সারা বিকেল মন খারাপ করে বসে রইলো। বাবার কাছে কথাটা কিভাবে পড়বে তাও ভেবে পেলো না। কথাটা মা কিম্বা রীনের সামনে বলা যাবে না। এম্ব্যাসি থেকে ফেরার পর বাবাকে একা পাওয়াও কঠিন। বাবা এ সময়টা সবার সঙ্গে কাটাতে পছন্দ করেন। সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করতে নীলেরও খুব ভালো লাগে। সেদিন মনে হচ্ছিলো অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলেও বাবাকে একা পাওয়া দরকার। রিস্টোরদের বিপদের চিন্তায় সারাক্ষণ আচ্ছন্ন হয়েছিলো সে।
বাবা এলেন সাড়ে পাঁচটার দিকে। সবার সঙ্গে বসে চা খেলেন। রীন কদিন ধরে খুব ব্যস্তা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান নিয়ে। বুলগেরিয়ায় বাংলাদেশী ছাত্রদের সমিতির সভাপতি সুভাষদা ওকে বলেছেন কারার ওই লৌহ কপাট-এর সঙ্গে নাচটা তিন দিনে কাউন্সিলার গিন্নি নাজমা খালার কাছ থেকে ভালোভাবে শিখে নিতে। চা খেয়েই রীন উঠে চলে গেলো নিজের ঘরে। মা বাবাকে বললেন, তোবারককে বলেছে আটটার ভেতরই যেন চলে আসে?
বাবা বললেন, ও সাতটার ভেতরই আসবে। ফ্লাইট তো দশটায়। মা নীলকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি রবিনকে আনতে এয়ারপোর্ট যাবে?
মার কথা শুনে নীলের মনে পড়লো রাতের ফ্লাইটে রবিনদার আসার কথা। ব্যস্ত হয়ে বললো, হ্যাঁ মা। নিশ্চয়ই যাবো।
রবিন নার্গিসি কোফতা খেতে পছন্দ করে। যাই, ওর জন্য কটা কোফতা বানাই। মা মরা ছেলেটা, যা একটু আবদার সেই ছোটবেলা থেকে আমার কাছেই করে। এই বলে মা উঠে পড়লেন।
বাবা গম্ভীর হওয়ার ভান করে বললেন, মা আমারও নেই। আমি যেন কোফতার ভাগ পাই।
মার সঙ্গে বাবাকে রসিকতা করতে দেখে মজা পেলো নীল, বললো, বা রে! মা আছে বলে কি আমি আর রীন কোফতার ভাগ পাবো না?
মা হাসতে হাসতে বললেন, বলেছি নাকি তোমাদের দেবো না!
বাবার মন এখন ভালো আছে। মা রান্নাঘরে যাওয়ার পর নীল বললো, বাবা তোমাকে একটা অনুরোধ করবো, বলো রাখবে?
হাসি চেপে গম্ভীর গলায় বাবা বললেন, নিশ্চয় রাষ্ট্রের কোনও অতি গোপনীয় তথ্য ফঁস করতে বলবি না।
না বাবা। আমার এক বন্ধু খুব বিপদে পড়েছে। তোমাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলছি। এই বলে নীল রিস্টো আর রিস্টোর বাবার বিপদের কথা যা শুনেছে সব বাবাকে বললো। ওর মার সঙ্গে দেখা করতে গোপনে বয়ানা গিয়েছিলো সে কথাও বললো। শেষে বললো রিস্টোর মার অনুরোধের কথা।
সব কথা শুনে বাবার কপালে ভাঁজ পড়লো। গম্ভীর গলায় বললেন, বুড়ো, তুমি এমন একটা কাজে জড়িয়েছো–এসব দেশে যা খুবই বিপদজনক। আমার ছেলে হয়ে এ ধরনের রাজনৈতিক ব্যাপারে তোমার জড়ানো মোটেই উচিত হয় নি।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো নীল। তারপর আস্তে আস্তে বললো, বাবা, এদের রাজনীতির ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই। রিস্টো আমার খুবই কাছের বন্ধু। ওর এত বড় একটা বিপদ আমি কিছু করবো না, এ কথা ভাবতে খুব খারাপ লাগছে।
বুঝতে পেরেছি। বলে বাবা কোন কথা না বলে চুপচাপ বসে রইলেন।
কিছুক্ষণ পর নীল বললো, বাবা, তুমি অন্তত ওদের কথাটুকু শোনো। আমি বলেছি কথা শুনতে তুমি আপত্তি করবে না।
ঠিক আছে, কাল বিকেলে ওদের কাউকে দেখা করতে বলল। একজনের বেশি নয়, পরিচয় দেবে ব্যবসায়ী হিসেবে। আমার ধারণা এম্ব্যাসির বুলগেরিয়ান ষ্টাফদের কেউ গোয়েন্দা বিভাগের হতে পারে।
সোফিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসে বুলগেরিয়ান স্টাফ তিনজন। একজন রাষ্ট্রদূতের একান্ত সচিব ইলিনা মিরকোভা, একজন দোভাষী, আরেকজন রিসেপশনিস্ট। নীল ভেবে পেলো না এদের ভেতর কে সরকারী গুপ্তচর হতে পারে। তবু বাবার কথা শুনে নীল আশ্বস্ত হলো–যাক রিস্টোর জন্য একটা কাজ অন্তত করতে পেরেছে।
সারাদিন উত্তেজনা আর উদ্বেগের ভেতর কাটানোর পর নিজেকে ভারমুক্ত মনে হলো নীলের। তোবারক আসার পর ওর সঙ্গে ঘন্টা দেড়েক ব্যাডমিন্টন খেললো। খেলার শেষে বুড়ো ওক গাছের নিচে রাখা পাথরের হেলান দেয়া বেঞ্চে বসে তোবারক জিজ্ঞেস করলো, সকালে যে কোন জায়গায় গেলেন, কাজ হইছে?
হয়েছে। মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে নীল প্রসঙ্গ পাল্টালো–আমাদের এম্বাসিতে যে বুলগেরিয়ান ষ্টাফরা আছে, এদের তোমার কেমন লাগে তোবারক ভাই?
কেন, ভালোই তো লাগে। ইলিনা মিরকোভা আমারে বেশ কয়েকদিন বাড়িতে নিয়া খাওয়াইছে। বলে হঠাৎ লজ্জা পেলো তোবারক। ওর টকটকে ফর্শা গালে লাল রঙের ছায়া নীলের চোখ এড়ালো না।
এদের মধ্যে কাউকে সন্দেহজনক কিছু করতে দেখেছো? সাবধানে জানতে চাইলো নীল।
কিছুক্ষণ ভেবে তোবারক বললো, গত দুই তিন মাস যাবৎ ইলিনা ছুটির পরও এক দেড় ঘন্টা অফিসে থাকে। আমারে একদিন জিজ্ঞাসা কইলো, স্যারের বাসার পার্টিতে কারা আসে। বিশেষ করি অন্য এ্যাসি আর ফরেন অফিসের বাইরে বুলগেরিয়ান কারা আসে জানতে চাইছিলো। এ কথা কেন জিজ্ঞাসা কইরলেন নীল বাই?
কারণ আছে, পরে বলবো। ইলিনা ছাড়া অন্য দুজন?
ইন্টারপ্রিন্টার দিমিত্রি কারো সাথে ফঁচে থাকে না। ঘড়ি ধরি অফিসে আসে, ছুটির পর এক মিনিটও থাকে না। রাইতে স্যারের লগে ডিউটি থাইকলে আলাদা কথা। রিসিফশনিস্ট নাইকোভা একটু দেমাগী টাইফের। কারো লগে বেশি কথাবার্তা কয় না। তবে ইলিনারে দুই চোখে দেখতে ফারে না।
তোবারকের কথা শুনে ইলিনার আচরণই মনে হলো সন্দেহজনক। সেদিন ইলিনা নিজেকে সিটিযেন কমিটির লোক বললো। সত্যি যদি তাই হয় তাহলে এই গোপন পরিচয় ওদের জানাবার প্রয়োজন ছিলো না। নীলের মনে হলো নিজের আসল পরিচয় গোপন করার জন্য ইলিনা মিথ্যে বলেছে। কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ও ঠিক করলো সন্দেহের কথাটা বাবাকে এক ফাঁকে জানিয়ে দিতে হবে।
রোম থেকে নাফিসা দুপুরে ফোন করে দূতাবাসে জানিয়ে দিয়েছিলেন রবিন কখন সোফিয়া পৌঁছবে। নীল আর তোবারক প্লেন আসার দশ মিনিট আগে এয়ারপোর্ট পৌঁছলো। নীলকে লাউঞ্জে দাঁড় করিয়ে রেখে তোবারক ভেতরে ঢুকে গেলো। দূতাবাসে যারা কাজ করে তাদের সবার ভেতরে যাওয়ার পাশ আছে।
ঠিক দশটায় বলকান এয়ার-এর রোম–বুখারেস্ট–সোফিয়া ফ্লাইট এসে ল্যাণ্ড করলো। রবিন প্লেন থেকে নেমে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে ইমিগ্রেশন কাউন্টারের লাইনে এসে দাঁড়ালো। ভেবেছিলো কাস্টমস সেরে লাউঞ্জে গেলে নিশ্চয় নীল রীনদের দেখা পাবে। এমন সময় স্মার্ট, সুন্দর দেখতে এক যুবককে দেখলো ওর দিকে আসতে। চেহারা দেখে মনে হয় গ্রীক কিম্বা ইটালিয়ান কাছে এসে নির্ভেজাল বাংলায় বললো, আপনি কি স্যার রবিন?
রবিন বুঝলো এম্বাসির কোন ষ্টাফ হবে। ওর কথার ধরনে রবিন হেসে ফেললো–আমি স্যার রবিন নই, শুধু রবিন।
তোবারক হাত বাড়িয়ে বললো, আমার নাম তোবারক আলী, বাংলাদেশ এম্ব্যাসি থেকে আসছি। ওয়েলকাম টু সোফিয়া স্যার। আপনার পাসপোর্টটা আমারে দেন।
স্মার্ট তোবারককে ভালো লেগে গেলো রবিনের। হাত মিলিয়ে মৃদু হাসলো–আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে খুবই খুশি হলাম তোবারক সাহেব। এই বলে টিকেট আর পাসপোর্ট তোবারককে দিলো।
তোবারককে সাহেব বলাতে ও লাজুক হাসলো। রবিনের টিকেট আর পাসপোর্ট নিয়ে ডিপ্লোম্যাট লেখা খালি কাউন্টারে চলে গেলো। নিজের পরিচয়পত্র দেখিয়ে বুলগেরিয়ান ভাষায় কি যেন বললো। সঙ্গে সঙ্গে কাউন্টার থেকে রবিনের পাসপোর্টে সিল মেরে ফেরত দিলো। তোবারক ওকে নিয়ে গেলো লাগেজ আসার জায়গায়।
টিকেটের সঙ্গে রবিনের স্যুটকেসের ট্যাগ নম্বর লাগানো ছিলো। কনভেয়ার বেল্টে রবিন ওর স্যুটকেসটা দেখে হাত বাড়াতে যাবে ওকে–সরিয়ে তোবারকই ওটা তুলে নিলো। তারপর বেরিয়ে এলো লাউঞ্জে।
ওদের দেখে–রবিনদা, বলে ছুটে এলো নীল। রবিন ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, তুই কত লম্বা হয়েছিস নীল। মনে হয় সামনের বছর আমাকে ছুঁয়ে ফেলবি।
নীল হেসে বললো, তুমি আগের চেয়ে অনেক হ্যাঁণ্ডসাম হয়েছে। এখনও কি আগের মত ফুটবল খেলো?।
কবে ছেড়ে দিয়েছি। ইউনিভার্সিটিতে ঢোকার পর আর বলের সঙ্গে পা ছোঁয়াই নি। তুই খেলিস এখনো?
রবিনের প্রশ্নের জবাব দিলো তোবারক। গর্বিত গলায় বললো, নীল বাই স্কুল টিমের ক্যাপ্টেন।
মৃদু হেসে নীলের পিঠ চাপড়ে দিলো রবিন। ওরা বাইরে এসে গাড়িতে উঠলো। ফাঁকা রাস্তা পেয়ে ষাট মাইল স্পীডে গাড়ি চালালো তোবারক। নীলের কানের কাছে মুখ নিয়ে রবিন ফিশ ফিশ করে বললো, তোবারক কি এম্ব্যাসির ড্রাইভার?
নীল মাথা নেড়ে সায় জানালো। ওর দুচোখে প্রশ্ন। রবিন আগের মত চাপা গলায় বললো, যে রকম চেহারা ভেবেছিলাম কোনও ডিপ্লোম্যাট হবে।
নীল কোন কথা না বলে মুখ টিপে হাসলো শুধু। পনেরো মিনিটের ভেতর ওরা বাড়ি পৌঁছে গেলো।
গাড়ির শব্দ শুনে রীন ছুটে বেরিয়ে এলো। পেছনে ওদের বাবা মাও এলেন। রবিন গাড়ি থেকে নেমে ওর চাচাকে পা ধরে সালাম করতে যাবে–তিনি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। চাচী ওর কপালে চুমো খেলেন। বললেন, মুখখানা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। নীল ওকে নিয়ে ওপরে যা। মুখ হাত ধুয়ে খেতে আয় তোরা।
রীনকে দেখে অবাক হলো রবিন–আরো, একি! রীন কত বড় হয়ে গেছে। তিন বছর আগে ললিপপ খাওয়া ছোট্ট মেয়েটিকে একজন গর্জিয়াস প্রিন্সেস মনে হচ্ছে।
রীন লজ্জায় লাল হলো। নীল–বললো, মাথায় বাড়লে কি হবে রবিনদা! রীন এখনো চুইংগাম আর ললিপপ খায়।
রাগতে গিয়ে হেসে ফেললো রীন–ঠিক আছে দাদা, মনে থাকবে কথাটা। আরেকদিন আসিস চকলেটের ভাগ চাইতে।
রবিন ভুরু কুঁচকে হাসি চেপে বললো, তাই নাকি নীল?
ওর যেমন কথা! এবার লজ্জা পেলো নীল–চলো ওপরে যাই।
তোবারক এসেই রবিনের স্যুটকেসটা নীলের ঘরে রেখে এসেছিলো। ওখানেই রবিনের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। নিচের তলায় অবশ্য দুটো গেষ্ট রুম ছিলো। একটা সাজানো গোছানো, বেশ বড়। কোন অফিসিয়াল গেস্ট এলে ওখানে থাকেন। আরেকটা ছোট, সাদামাটা–তোবারক বা অফিসের কেউ দরকার হলে থাকে। নীলের মা অবশ্য প্রথমে বড় গেষ্ট রুমে রবিনের থাকার কথা বলেছিলেন, বাবা মানা করেছেন–হঠাৎ যদি হোমরা চোমরা কেউ এসে পড়ে। তাছাড়া নীলও বলেছে, একটা এক্সট্রা খাট দিয়ে দাও, রবিনদা আমার ঘরে থাকবে।
রবিন যে ছাত্র রাজনীতির সাথে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত এ কথা নীলের অজানা নয়। ও ঠিক করেছে বুলগেরিয়ার পরিস্থিতি সম্পর্কে রবিনের সঙ্গে কথা বলবে।
অন্যদিন নটার ভেতর সবার রাতের খাওয়া হয়ে যায়। সেদিন রবিনের জন্য সবাই দশটা চল্লিশ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলো। খেতে বসে রবিন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো–সেই কবে নার্গিসি কোফতা খেয়েছিলাম। চাচী কী করে বুঝলেন, এটা আমার প্রিয় খাবার?
স্নেহভরা চোখে রবিনকে দেখলেন ওর চাচী। বললেন, ছেলেদের পছন্দ অপছন্দের কথা কোনও মা ভুলে থাকতে পারেন না।
খেতে খেতে রবিন বললো, রোজ এরকম খেলে দশদিনে কম করে হলেও পাঁচ পাউণ্ড ওজন বাড়বে।
তোমার এমন কি ওজন হলো যে ও নিয়ে ভাবতে হবে! চাচী বললেন, পাঁচ কেন, দশ পাউণ্ড বাড়লেও ক্ষতি হবে না।
নীল মুখ টিপে হেসে বললো, ভয় কি রবিনদা। খেলা তো ছেড়েই দিয়েছে।
তোবারক মন্তব্য করলো, খেলা ছাড়লে কি হইবো। রবিনদার বডি স্টাকচার খুব সোন্দর।
ওদের সবার কথা শুনে রবিন হাল ছেড়ে দিলো। ওর চাচী ওকে প্রাণভরে খাওয়ালেন।
খাওয়া শেষ করে হাঁসফাস করতে করতে নীলের সঙ্গে দোতালায় এলো রবিন। বললো, সত্যি বলছি, নীল, এভাবে খেলে আমাকে অকালে পটল তুলতে হবে।
কোত্থেকে তুলবে রবিনদা? নিরীহ গলায় নীল বললো, এসব দেশে পটল কী জিনিস কেউ চোখে দেখে নি।
দেবো এক থাপ্পড়! হেসে ফেললো রবিন। সঙ্গে নীলও।
রোমের চেয়ে সোফিয়ায় শীত অনেক বেশি মনে হলো। বিছানায় উঠে বসে গায়ে কম্বল জড়িয়েও পুরোপুরি শীত তাড়াতে পারলো না রবিন। এমন সময় রীন এলো আরেকটা কম্বল হাতে। বললো, রবিনদা, এটাও গায়ে দিও। সোফিয়ার শীত টের পাবে আর কদিন পর। আমাদের হিটিং সিস্টেম কাজ করছে না।
দুটো কম্বল গায়ে দিয়ে আরাম হলো রবিনের। নীল বললো, ওয়েদার অফিস বলেছে, শীত এবার বেশি পড়বে।
তার আগেই আমি কেটে পড়তে চাই। রবিন বললো, কড়া শীত আমি খুবই অপছন্দ করি।
রীন বললো, রবিনদা, রাতে তুমি চা, কফি কিছু খাও?
এরকম শীতে মনে হয় গরম এক কাপ কফি ভালোই লাগবে। কি বলিস নীল?
নীল হাসলোতুমি খাও। আমার পোষাবে না।
আমি এক্ষুণি আনছি। বলে রীন চলে গেলো।
তুমি সোফিয়ায় কত দিন থাকবে রবিনদা? জানতে চাইলো নীল।
সপ্তাহ খানেকের বেশি নয়।
টিকেট কি কনফার্মড?
না, কাল পরশু করে ফেলবো। চিনিস বলকান এয়ার-এর অফিস?
তা চিনি। তবে আরও কিছুদিন থেকে যাও রবিনদা। দারুণ এক সময়ে তুমি সোফিয়া এসেছে।
শুনলাম রোমে এসে। আমারও জানার ইচ্ছে আছে অনেক কিছু।
রীন কফি বানিয়ে আনলো। ঘরে ঢুকেই নীলকে বললো, দাদা, তোর টেলিফোন।
এত রাতে টেলিফোন। রবিন রসিকতা করে বললো, কোন বান্ধবী নয় তো!
নীল টেলিফোন ধরতে গেলো। রীন হেসে বললো, ও কোত্থেকে বান্ধবী পাবে? আমার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই ও টমাটোর মত লাল হয়ে যায়।
নীলের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার সময় তোর বুঝি কান লাল হয় না।
বয়ে গেছে। উঠে পড়লো রীন–শুতে যাচ্ছি রবিনদা। কাল ভোরে উঠতে হবে। গুড নাইট। বলে রীন চলে গেলো।
নীলকে ফোন করেছিলেন রিস্টোর মা। হ্যালো বলতেই একজন মহিলার গলা শুনলো–আমি ইরিনা। ইংরেজিতে বললেও রীন বুঝলো বুলগেরিয়ান কেউ হবে।
নীল মনে করতে পারলো না ইরিনা কে। বললো, আমি নীল বলছি, আপনি কি আমাকে চাইছেন?
হ্যাঁ, বাছা, তোমাকেই চাইছি। তুমি কি ভুলে গেলে অভাগী মাকে!
সঙ্গে সঙ্গে নীলের মনে পড়লো রিস্টোর মার কথা। সকালে তিনিই তো বলেছিলেন ফোনে ইরিনা বলবেন। নীল বিব্রত হয়ে বললো, আমি দুঃখিত। এবার চিনতে পেরেছি। কাল বিকেল চারটায় একজন ব্যবসায়ী দেখা করতে পারেন।
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে গেলো। নীল একটু অবাক হলো। এভাবে হঠাৎ লাইন কাটলো কেন? ওদের টেলিফোন কি ট্যাপ করা হচ্ছে?
চিন্তিত মুখে ওপরে উঠে এলো নীল। রবিন বললো, কার টেলিফোন নীল? কোন খারাপ খবর?
কাষ্ঠ হেসে নীল বললো, আমার পরিচিত একজন। না, কোন খারাপ খবর নয়।
বারোটা বাজতে আর বেশি দেরি নেই। তুই কটায় ঘুমাস?
বারোটা, সাড়ে বারোটা। কেন তোমার ঘুম পাচ্ছে?
আরে না। ভাবছি তোর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করবো।
তোমাদের মার্কোসের খবর কি বলো। হটাচ্ছো কবে?
বেশি দেরি নেই। মুশকিল হলো দুই কোরাজন নিয়ে। নইলে কবেই ফেলে দিতাম।
খালেদা জিয়া আর শেখ হাসিনার ভেতর তুমি কাকে সাপোর্ট করো?
আমি কাউকেই করি না। ওদের পার্টি তো আগে ক্ষমতায় ছিলো। তখন তারা কী করেছে কারো জানতে বাকি নেই।
তবু নেতা বলতে ওরাই তো। আমাদের বাড়িতে খুব মজা। বাবা খালেদাকে সাপোর্ট করেন, মা হাসিনাকে।
আর তুই?
আমি পলিটিক্স নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে চাই না। আমার এক বুলগেরিয়ান বন্ধু আছে–রিস্টো নাম। ও খুব পলিটিক্স করে।
কী পলিটিক্স করে তোর বন্ধু?
ঝিভকভকে হটাবার জন্য সিটিযেন কমিটি হয়েছে একটা। রিস্টো ওদের সঙ্গে আছে। ওর বাবা কমিটির একজন নেতা।
আলাপ করা যায় না ওদের সঙ্গে?
তুমি আলাপ করবে ওদের সঙ্গে? ভীষণ অবাক হলো নীল–ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করা খুব কঠিন। নেতারা সব লুকিয়ে আছে।
তোর বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে বলিস, আমি ওদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। জানতে চাই ওরা আসলে কী চায়।
যদি দেখা হয় বলবো। হঠাৎ ওদের জানতে চাইছো কেন?
রবিন গম্ভীর হয়ে বললো, আমার জানা দরকার পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্র কেন মার খাচ্ছে। এতদিন সমাজতন্ত্রের কথা বলে এসেছি–সবই কি মিথ্যে?
বাবার সঙ্গেও এ নিয়ে কথা বলতে পারো। এখানকার রাজনীতির অবস্থা বাবা ভালো জানেন।
তাহলে তো ভালোই হয়। চাচা নিশ্চয় কমিউনিস্ট পার্টির কোন নেতার সঙ্গেও দেখা করিয়ে দিতে পারবেন?
হয়তো পারবেন। সত্যি করে বল তো রবিনদা, আমাদের দেশে কমিউনিস্টরা কিছু করতে পারবে?
পারলে কমিউনিস্টরাই পারবে। তোর কেন মনে হচ্ছে পারবে না?
এখানকার অবস্থা দেখে। এখানে এমন লোক খুব কমই পাবে, যারা কমিউনিস্টদের সাপোর্ট করে।
বুলগেরিয়ার অবস্থা নিয়ে নীলের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললো রবিন। নীল যদিও বলেছে রাজনীতি বোঝে না, তবে ও যেসব কথা বললো সেগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে খুবই ভাববার কথা। নীল ঘুমিয়ে যাওয়ার পরও রবিন এ নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবলো।
রিস্টোদের বিপদের বোঝা বাবার ঘাড়ে চাপানোর পর থেকে নিজেকে বেশ হালকা মনে হচ্ছিলো নীলের। সকালে নাশতার টেবিলে রবিনকে বললো, চলো তোমাকে মাউন্ট ভিতুশা ঘুরিয়ে আনি। ভিতুশার চূড়া থেকে সোফিয়া শহরটাকে দারুণ দেখায়?
রবিন আঁতকে উঠলো–তুই কি আমাকে মাউন্টেন ক্লাইম্বার ভেবেছিস?
রবিনের কথার ধরনে রীন হেসে গড়িয়ে পড়লো। নীলও হেসে ফেললো–তোমার ক্লাইম্বার হওয়ার কোনো দরকার নেই। আমরা কেবল কার-এ চেপে পাহাড়ের চূড়ায় উঠবে।
তাহলে যাওয়া যেতে পারে। রবিন হাঁপ ছেড়ে বললো, রীনও যাবে নিশ্চয়ই।
না রবিনদা। ওপর নিচে মাথা নাড়লো রীন–আমার নাচের রিহার্সেল আছে।
রীনের মাথা দোলানো দেখে অবাক হলো রবিন রিহার্সেল আছে ভালো কথা। মুখে বলছিস না, মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলছিস, এ আবার কেমনতরো কথা।
নীল আর রীন একসঙ্গে হেসে উঠলো–তোমাকে বলা হয় নি রবিনদা। আমরা যেভাবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ না বলি, বুলগেরিয়ানরা ঠিক উল্টোভাবে মাথা নাড়ে। যে কদিন এখানে আছে কথাটা মনে রেখো।
ঠিক আছে, মনে রাখবো, বলে দুদিকে মাথা নাড়লো রবিন।
রীন বললো, হ্যাঁ, ঠিক হয়েছে।
ওরা যখন নাশতার টেবিল ছেড়ে উঠলো নীলের বাবার তখন অফিসে যাওয়ার সময় হয়েছে। রবিনরা ভিতুশার দিকে যাচ্ছে শুনে বললেন, তোদের বাস স্টপেজ পর্যন্ত লিফট দিতে পারি।
নীল মানা করলো–থাক বাবা, আমরা হেঁটেই যাবো। এইটুকুই তো পথ।
রীন চলে গেলো বাবার সঙ্গে। কালকের মধ্যে ওর নাচ শেখা শেষ করতে হবে। তারপর শুরু হবে নাটকের রিহার্সেল। ওরা চলে যাওয়ার একটু পরে নীল আর রবিন বেরিয়ে পড়লো। বেরুবার সময় রবিনকে ওর বাবার একটা ভিজিটিং কার্ড দিলো, বুলগেরিয়ান ভাষায় লেখা। বললো, কখনো কোন দরকার হলে ট্যাক্সিতে উঠে এই কার্ড দেখালে তোমাকে সোজা এম্ব্যাসি নিয়ে যাবে।
সোফিয়ার বাসগুলো রবিনের কাছে মনে হলো রোমের চেয়ে কম আরামের নয়। ঢাকার মতো পাদানিতে ঝুলেও কেউ যাচ্ছে না। বাস ছাড়া রাস্তায় ট্রামও আছে অনেক। শুধু পাতাল রেলটা নেই। নীল শুনে বললো, ছোট শহর, লোকজনও বেশি নয়, পাতাল রেল দিয়ে কী হবে।
জীবনে প্রথম কেবল কার-এ চড়লো রবিন। ভিতুশা পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে নানা রঙের গাছের সমারোহ দেখে ও মুগ্ধ হয়ে গেলো। নীলকে বললো, এই বনে যত রকমের গাছ আছে, সবগুলো একটা করে পাতা দিবি আমাকে, গাছের নাম লিখে।
তোমাকে একদিন ফ্রিডম পার্কে নিয়ে যাবো। গাছ আর ফুল দেখে তোমার মন ভরে যাবে।
ফুল দেখে সময় কাটালে হবে না। মানুষও দেখতে চাই আমি, খুব কাছে থেকে।
ঠিক আছে। মৃদু হেসে নীল বললো, মানুষও দেখাবো তোমাকে।
ভিতুশা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সোফিয়ার দৃশ্য দেখার আগে আরেকটি দৃশ্য দেখে রবিনের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। ঢাকা থেকে রোমে আসার সময় প্লেনে পরিচয় হওয়া বুড়ো প্রফেসর বরিস–যিনি ওর সঙ্গে অদ্ভুত আচরণ করেছিলেন রোমের পালাতিনোয়, তিনি এখানে! রবিন দেখলো দুপাশে দুজন দশাসই চেহারার লোক প্রফেসরের কনুই চেপে ধরেছে। প্রফেসর যে ওদের সঙ্গে অনিচ্ছার সঙ্গে যাচ্ছেন, সেটা ওঁর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। সরল ছেলেমানুষি ভরা চোখে ভয় আর উদ্বেগ মেশানো, উদভ্রান্ত দেখাচ্ছিলো তাকে। রবিনদের তিনি দেখতে পান নি। পাহাড়ের চূড়ায় অনেক বিদেশী পর্যটক ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। ওদের অসহায়ভাবে দেখছিলেন প্রফেসর। রবিন চাপা গলায় নীলকে বললো, চলতো ওদিকে। মনে হচ্ছে প্রফেসর বিপদে পড়েছেন।
নীল অবাক হয়ে কোন প্রফেসর, কার প্রফেসর, বলতে বলতে রবিনের পেছন পেছন এলো। রবিন দ্রুত পা চালিয়ে প্রফেসরের কাছে এসে বললো, সুপ্রভাত প্রফেসর বরিস। আপনাকেই আমি খুঁজছিলাম। বেড়াতে এসেছেন বুঝি ভিতুশায়?
রবিনকে দেখে দুপাশের লোক দুটো ভুরু কুঁচকে প্রফেসরের হাত ছেড়ে দিয়েছে। প্রফেসর যেন গভীর পানিতে ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে একটা বড় অবলম্বন খুঁজে পেলেন। শক্ত করে রবিনের হাত চেপে ধরে বললেন, সুপ্রভাত বাছা, আমিও যে তোমাকে খুঁজছিলাম। এরপর পাশের লোকদের বললেন, এ ছেলে আমার পুরোনো ছাত্র। এখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের অতিথি হয়ে এসেছে। আমি আপনাদের সঙ্গে পরে দেখা করবো। এর সঙ্গে আমাকে এখনই এক জায়গায় যেতে হবে।
ওদের সঙ্গে প্রফেসর বুলগেরিয়ান ভাষায় কথা বলছিলেন। রবিন না বুঝলেও নীল বুঝে ফেললো, প্রফেসর গুপ্ত পুলিশের পাল্লায় পড়েছেন। পুলিশদের একজন প্রফেসরকে বললো, আমাদের সঙ্গে যাওয়াটা আপনার জন্য বেশি জরুরি।
রবিনের হাত আঁকড়ে ধরে প্রফেসর ভীত গলায় বললেন, না আমি তোমাদের সঙ্গে এখন যাবো না।
আপনাকে আমাদের সঙ্গেই যেতে হবে। বলে ওরা শক্ত হাতে প্রফেসরের কনুই চেপে ধরলো আগের মত।
তখনই চিৎকার করে উঠলো নীল–খবরদার বলছি, হাত ছাড়ুন প্রফেসরের। তিনি না গেলে কি জোর করে নেবেন? আপনারা কী পুলিশের লোক? ওয়ারেন্ট আছে আপনাদের? দিনের আলোয় একজনকে কিডন্যাপ করতে এসেছেন, সাহস তো কম নয়! এক্ষুণি চিৎকার করে লোক জড় করবো আমি।
নীলের চিৎকার শুনে কয়েকজন টুরিষ্ট কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এলো। লোক দুটো প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলো। তারপর কটমট করে তাকালো নীলের দিকে পারলে ওকে ভষ্ম করে দেয়। তারপর নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে চাপা গলায়–ঠিক আছে দেখে নেবব, বলে ধুপধাপ করে হেঁটে চলে গেলো।
একজন আমেরিকান বুড়ো বললেন, আমি কি তোমাদের কোন সাহায্য করতে পারি?
নীল হেসে বললো, না, ধন্যবাদ। তারপর প্রফেসরকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললো, চলুন, এখানে একটা চমৎকার কাফে আছে, আমরা ওখানে গিয়ে বসি।
প্রফেসর নীলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হয়েছি বাছা। তোমরা না এলে ওরা আমাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলতো।
রবিন এতক্ষণ পর কথা বলার সুযোগ পেলো–আমি কিছুই বুঝতে পারছি না প্রফেসর। আপনি কী করেছেন? কেন এরা আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে চায়?
বুড়ো প্রফেসর কাষ্ঠ হেসে বললেন, আরেকদিন বলবো। তোমরা আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছো। তোমাদের কথা আমি সব সময় মনে রাখবো। এখন আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে। আমার কিছু বন্ধুর ভারি বিপদ।
নীল বললো, আমরা কি আপনাকে কোনো সাহায্য করতে পারি?
আমাকে তোমরা আমার ট্যাক্সিটা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারো। পাজি দুটো কোথায় লুকিয়ে আছে কে জানে।
ট্যাক্সির ড্রাইভার কি আপনার চেনা?
হ্যাঁ চেনা। মুচকি হেসে প্রফেসর নীলকে বললেন, তুমি শুধু সাহসী নও, দারুণ বুদ্ধিমানও।
সেদিন রবিনের ভিতুশা পাহাড় দেখা হলো না। প্রফেসরকে ট্যাক্সিতে তুলে দিতে এসে দেখে লোক দুটো অল্প দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা আশা করেছিলো প্রফেসরকে একা পাবে। ওদের দেখে রবিন আর নীলও প্রফেসরের সঙ্গে ট্যাক্সিতে উঠে বসলো। প্রফেসর ড্রাইভারকে চাপা গলায় বললেন, আমেরিকান এম্ব্যাসি।
দক্ষ ড্রাইভার পাহাড়ের চক্রপথে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে পাঁচ মিনিটে নিচে নেমে এলো। স্ট্যামবুলেস্কি বুলেভার্ডে আমেরিকান এম্ব্যাসি আসতে ওদের মাত্র দশ মিনিট লাগলো।
.
০৬. সোফিয়ায় চমকপ্রদ দিন
প্রফেসর বরিস সম্পর্কে তুমি কি জানো? রাকৌস্কি স্ট্রিটের বিখ্যাত চাইকা কাফের বাইরে ফুটপাতের ওপর সাজানো ফাঁইবার গ্লাসের চেয়ার টেবিলে বসে কফি খেতে খেতে জানতে চাইলো নীল।
রবিন যতটুকু জানতো পুরোটাই নীলকে বললো। রোমের পালাতিনোতে প্রফেসরের রহস্যময় আচরণের কথাও বললো। সব শুনে নীল বললো, কী মনে হয় তোমার?
আজকের আগে তেমন কিছু ভাবি নি। পালাতিনোতেও প্রফেসরের সঙ্গে অন্য লোক ছিলো। তবে আজকের ঘটনা একেবারে অন্যরকম। মনে হয় সোফিয়া এসে প্রফেসর বিপদে পড়েছেন। অথচ আমি সোফিয়া আসছি জেনে তিনি একবারও বলেন নি যে এখানে আসবেন। ব্যাপারটা খুব গোলমেলে মনে হচ্ছে।
আমার কাছে বেশি গোলমেলে মনে হচ্ছে না। প্রফেসর তোমাকে বলেছেন লণ্ডনে থাকেন। থাকতে পারেন, তবে অরিজিনালি তিনি বুলগেরিয়ান। সম্ভবত পালিয়ে গিয়েছেন এখান থেকে। আমার মনে হচ্ছে এখানকার সরকার বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। এ আন্দোলনে অনেক প্রফেসরও আছেন। হয়তো তারাই প্রফেসর বরিসকে আসতে বলেছেন হতে পারে এমন কিছু তিনি জানেন আন্দোলন যারা করছেন তাদের কাজে লাগবে, ঝিভকভের জন্য যা বিপদজনক হবে।
নীলের কথা শুনে চমৎকৃত হলো রবিন। প্রফেসর বরিসও নীলকে বুদ্ধিমান বলেছেন। ও যে এতটা গভীর ভাবে ভাবতে পারে রবিন কল্পনা করে নি। বললো,
দারুণ বলেছিস তুই! আমি তোর মত এতটা ভাবি নি।
নীল লাজুক হাসলো–এটা শুধু আমার ধারণা। ঘটনা অন্যরকমও হতে পারে। প্রফেসর কোন ক্রিমিনাল গ্রুপের সঙ্গেও জড়িত হতে পারেন। আজকাল প্রচুর পুরোনো জিনিস এখান থেকে বাইরে পাচার হচ্ছে। এখানকার অনেক গীর্জায় এক দেড় হাজার বছরের পুরোনো সব আইকন আছে। চুরিও হচ্ছে প্রচুর। গত মাসে একটা গ্যাং ধরা পড়েছে নকল আইকন বানিয়ে পুরোনো বলে বিক্রি করতে গিয়েছিলো। এসব বুলগেরিয়ান ভাষার প্রফেসররা আসেন কোনটা আসল সেটা বাছাই করার জন্য।
রবিনের কপালে ভাঁজ পড়লো–নাহ্ তোর এ ব্যাখ্যাও ফেলে দেয়ার মত নয়। এই বলে কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবলো। তারপর বললো, প্রফেসর যদি স্মাগলার হন, তোর ধমকে সিক্রেট পুলিশের তো এভাবে ছেড়ে দেয়ার কথা নয়!
হয়তো সন্দেহ করে ধরেছে, হাতে কোন প্রমাণ নেই, জেরা করতে চাইছে।
রবিন হাল ছেড়ে দিলো নারে, তোর মতো মাথা খাটাতে পারছি না। মনে হচ্ছে তোর দুটো ব্যাখ্যাই ঠিক। নীল হেসে বললো, দুটো একসঙ্গে ঠিক হতে পারে না। জানতে হবে কোনটা ঠিক।
কাল রাতেই জানতে পারবি।
আমেরিকান এম্ব্যাসিতে নামার আগে প্রফেসর বলেছিলেন, কাল সাতটায় ওঁর সঙ্গে ওরা যেন ডিনার করে।
কফি শেষ করে নীল বললো, এখন কোথায় যাবে বলল। এগারোটা বাজে। আরও দুঘন্টা ঘুরতে পারি।
নীলকে কফির বিল দিতে দেখে রবিন বললো, কোথাও যাওয়ার আগে কিছু ডলার ভাঙাতে চাই। কাছে কোথায় মানি এক্সচেঞ্জ আছে সেখানে চল।
মানি এক্সচেঞ্জে এক ডলার ভাঙালে পুরো এক লেভাও পাবে না। তোবারককে দিও। ওর কিছু ভিয়েতনামী বন্ধু আছে। ওরা ডলারের ব্যবসা করে। এক ডলারের বদলে তোমাকে সাত আট লেভা দেবে।
বলিস কি! এ যে চোরাকারবারি। ভিয়েতনামীরা এসব নোংরা কাজ করে? একটি সমাজতান্ত্রিক দেশের নাগরিকদের এ ধরণের আচরণের কথা জেনে আহত বোধ করলো রবিন।
কাজটা বেআইনি হলেও ভিয়েতনামীরা খুবই ভালো মানুষ। ওরা প্রতিটি ডলার ওদের দেশে পাঠায়। বুলগেরিয়ান গভমেন্টও এটা জানে।
তাহলে চল, এম্বাসিতে গিয়ে তোবারককে ধরি।
অফিস টাইমে তোবারককে এসব কাজে পাবে না। এত ব্যস্ত হচ্ছে কেন? আজ আমার কাছ থেকে ধারই না হয় নাও। বুঝতে পেরেছি, ছোট বলে আমাকে খরচ করতে দেখে তোমার ইগোতে লাগছে।
রবিন হেসে বললো, নারে নীল। তোকে আমি সব সময় আমার বন্ধুর মত ভাবি, কখনো ছোট ভাবি না। অনেক জিনিস তুই আমার চেয়ে বেশি জানিস।
রবিনের কথা শুনে নীলের বুকটা ফুলে উঠলো। ওর কল্পনার নায়ক যদি ওকে বন্ধু ভাবে এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কি হতে পারে। লাজুক হেসে বললো, চলো, তোমাকে এদের রেভল্যুশনের মিউজিয়ামটা দেখাই।
এখান থেকে কত দূরে?
বুলেভার্ড রুসকি, বেশি দূর নয়, হেঁটে যাওয়া যাবে।
হাঁটতে রবিনের ভালো লাগে। তবে রাকৌস্কি স্ট্রিটের পাথর বাঁধানো মসৃণ রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দুবার হোঁচট খেলো। আক্ষরিক অর্থে নয়, চমকানোর মতো দৃশ্য দেখে। মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর রাস্তার ধারে এক জীর্ণ পোষাকের মহিলাকে দেখলো ভিক্ষে করতে। রবিনের চেহারা দেখে মহিলা ভাবলো ধনী কোনও পর্যটক, কাছে এসে হাত পেতে বললো, ওয়ান ডলার প্লিজ। তারপর ইশারায় দেখালো খিদে পেয়েছে।
কোন কথা না বলে রবিন এক ডলারের নোট পকেট থেকে বের করে মহিলাকে দিলো। ডলার পেয়ে মহিলার বিষণ্ণ চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। মাথা ঝুঁকে অভিবাদন জানিয়ে উল্টো দিকে হাঁটা দিলো।
রবিন দুঃখভরা গলায় বললো, ধনীদের শহর রোমেও ভিখিরি দেখে আমি এত চমকাই নি। সোফিয়াতে মানুষ কেন ভিক্ষে করে?
নীল বললো, এ মহিলা সোফিয়ার নয়, জিপসী, বাইরে থেকে এসেছে। তবে বাবা বলেন, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর কথা ছবিতে দেখে বইয়ে পড়ে যত সুন্দর মনে হয়, কাছে থেকে দেখলে, এদেশে থাকতে গেলে তত সুন্দর মনে হয় না।
রবিন কোনও কথা না বলে চুপচাপ হাঁটতে লাগলো। কিছুদূর যাওয়ার পর এক গির্জার সিঁড়িতে আরো একজন ভিখিরি দেখলো। বুড়ো, পরনের কাপড় তালিমারা, পায়ে শতচ্ছিন্ন জুতো। নীল বললো, যতই বলল, আমাদের দেশের মত কোন দেশেই রাস্তায় ভিখিরি গিসগিস করে না।
দেশের কথা মনে হতে রবিনের খারাপ লাগলো। নীলের কথার কোন জবাব দিলো না।
বুলগেরিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনের জাদুঘর দেখতে গিয়ে রবিন কখনো উদ্দীপ্ত হলো, কখনো হতাশ হলো নিজেদের কথা ভেবে। নীলকে দুঃখ করে বললো, এখন মুক্তিযুদ্ধের একটা জাদুঘরও আমরা বানাতে পারি নি। আমাদের বয়সী বহু ছেলেই জানে না একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধটা আসলে কী ছিলো।
নীল বললো, বাবা প্রায়ই দুঃখ করেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা আমাদের শত্রু ছিলো, যারা লাখ লাখ মানুষ মেরেছে, তারাই নাকি এখন সব বড় বড় নেতা হয়ে বসেছে।
আমার কি মনে হয় জানিস? একাত্তরের চেয়ে অনেক বড় একটা মুক্তিযুদ্ধ এখনো আমাদের করা বাকি রয়েছে।
জাদুঘর থেকে বেরিয়ে ওরা বাসে চেপে বাড়ি ফিরে এলো। একটু পরে বাবাও খেতে এলেন। খাবার টেবিলে নীল বললো, বাবা, এখানকার পার্টির কারো সঙ্গে তোমার আলাপ আছে?
আলাপ তো অনেকের সঙ্গে আছে। বাবা জানতে চাইলেন, কেন?
রবিনদা এখানকার অবস্থা বুঝতে চান। ওকে পার্টির কারো সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দাও।
দেয়া যাবে। তবে পার্টির কারো সঙ্গে কথা বললেই যে রবিন সবকিছু বুঝবে তা তো মনে হয় না।
অন্যদের সঙ্গে আমি আলাপ করিয়ে দেবো।
খাওয়ার পর ছেলেদের ন্যাশনাল গ্যালারিতে নামিয়ে দিয়ে নীলের বাবা সোজা দূতাবাসে গেলেন। নিজের কামরায় বসে নীলের কথা ভাবছিলেন। যতটা স্বাধীনতা দেয়ার সবটুকুই তিনি ওকে দিয়েছেন। আমেরিকান স্কুলে পড়েও অন্য সব কূটনীতিকদের ছেলের মত হয় নি। ছুটির দিনে অন্য ছেলেরা যখন সুইমিং কিম্বা রাইডিং-এ যায়, নীল সময় কাটায় লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ে। স্কুলে কিছুটা খেলাধূলা করে বটে, তবু সেদিকে তেমন কোনও ঝোঁক নেই। এখন আবার বন্ধুর পাল্লায় পড়ে সিভিক মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িয়েছে। ফরেন অফিস টের পেলে মোটেই খুশি হবে না। তবু নীলকে তিনি কথা দিয়েছেন ওদের সঙ্গে আলাপ করবেন।
ঠিক চারটায় ইন্টারকমে ইলিনা মিরকোভা বললো, স্যার, আমি কি কিছুক্ষণের জন্য আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি?
চারটায় একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
এই এ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যাপারেই আলাপ করবো।
ঠিক আছে, কফি নিয়ে চলে এসো।
পাঁচ মিনিট পর ট্রেতে করে দু কাপ কফি নিয়ে নীলের বাবার ঘরে ঢুকলো ইলিনা। কফির পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে বিব্রত গলায় বললো, স্যার, আমিই সেই ব্যবসায়ী।
তার মানে?
একজন ব্যবসায়ী আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলো। আপনি আজ বিকেলে তাকে সময় দিয়েছেন।
তুমি কেন সেই ব্যবসায়ী হতে যাবে?
আমি ব্যবসায়ী নই। সিভিক মুভমেন্টের একজন। আপনি বলেছিলেন ব্যবসায়ীর পরিচয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে।
তুমি কিভাবে জানলে?
আপনার সঙ্গে আমাকে কথা বলতে পাঠিয়েছেন লিলিয়া গিয়র্গিয়েভা। নীলের বন্ধু রিস্টোর মা।
তাই বলো। হাঁপ ছাড়লেন রাষ্ট্রদূত। বললেন, আমি সন্দেহ করতাম তোমাদের। কেউ বুঝি ঝিভকভের গুপ্ত পুলিশের গোয়েন্দা। এখানে যে সিভিক মুভমেন্টের কেউ থাকবে কখনো ভাবি নি।
গোয়েন্দা বিভাগের লোকও আছে। রিসেপশনিস্ট সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন। বেশির ভাগ দূতাবাসের রিসেপশনিস্টরাই গোয়েন্দা বিভাগের। কারা যাওয়া আসা করে তার হিসেব রাখে।
ওকে আগামী মাসেই বিদায় করবো।
ইলিনা মৃদু হেসে বললো, জানার পর বিদায় করাই উচিৎ। তবে নতুন যে আসবে–সেও যে একই পদের হবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
পরে দেখা যাবে। এখন বলল, দেখা করতে চেয়েছিলে কেন? তোমার জানা থাকার কথা আমরা কী করতে পারি।
আপনি কি আমাদের ফ্যাক্স মেশিন ব্যবহারের সুযোগ দিতে পারেন?
অফিসিয়ালি অবশ্যই না। কেউ যদি লুকিয়ে ব্যবহার করে সেটা আমি জানবো কি ভাবে?
বুঝেছি। ম্লান হেসে ইলিনা বললো, মাঝে মাঝে দেরিতে বাড়ি ফিরি। আমি যতক্ষণ অফিস ছেড়ে না যাই ততক্ষণ রিসেপশনিস্ট বসে থাকে।
তাহলে তো এখানে তোমার পক্ষে কাজ করা খুবই বিপদজনক। তুমি আমেরিকান এম্বাসিতে কাউন্সিলার উইলিয়ামের সঙ্গে কথা বলো। ও তোমাকে ফ্যাক্স, টেলিফোন সবই ব্যবহার করতে দেবে।
তিনি যে দেবেন–আপনি কি ঠিক জানেন?
না জানলে তোমাকে বলবো কেন?
আমি কি তাকে আপনার নাম বলবো?
না। একজন কূটনীতিক হিসেবে আমি ওকে তোমাদের ব্যাপারে কিছু বলতে পারি না। সেটা আমার দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে না।
আমি দুঃখিত।
তোমাকে আমি একটা ব্যাপারে অনুরোধ করতে চাই।
নিশ্চয়ই। বলুন কি করতে পারি?
রিস্টোর মাকে বলবে, নীলকে যেন এসব কাজে না জড়ায়। আমার ছেলে হিসেবে কিম্বা একজন বিদেশী হিসেবেও এসব কাজে নীলের জড়ানো উচিত নয়।
ঠিক আছে বলবো। তবে নীল শুনলে নিশ্চয় মনক্ষুণ্ণ হবে।
হয়তো হবে। ওকে যা বলার আমিই বুঝিয়ে বলবো। তোমরা দয়া করে ওকে এড়িয়ে যেও, বিশেষ কোনও দায়িত্ব দিও না।
লিলিয়া গিয়র্গিয়েভাকে আপনার কথা বলবো।
ধন্যবাদ ইলিনা।
নীলের বাবার জানার ইচ্ছা ছিলো সিটিযেন কমিটির কাজকর্ম সম্পর্কে। ইলিনাকে আগ্রহ দেখালেন না, পাছে ও কোন বিশেষ ধরনের সুবিধা চেয়ে বসে।
গ্যালারি দেখা শেষ করে রবিনকে নিয়ে নীল বেরিয়েছিলো শহরে ঘুরে বেড়াতে। রবিনের ভালো লাগলো সারা শহরে ছড়িয়ে থাকা ছোট বড় নানা ধরনের পার্কগুলো। মজা পেলো সিক্সথ সেপ্টেম্বর পার্কে ছবি আঁকিয়েদের বাজারে। নানা বয়সী শিল্পী নিজেদের শিল্পকর্ম সাজিয়ে বসেছে বিক্রির জন্য। বেশির ভাগ শিল্পীই তরুণ, তাপ্লিমারা জিন্স-এর প্যান্ট আর জ্যাকেট পরা, রাগী প্রতিবাদী চেহারা, তরুণীও আছে কয়েকজন। ছবির দাম খুবই সস্তা কিন্তু ক্রেতা নেই তেমন। দুএকটা যা কিনছে বিদেশী পর্যটকরা। একজন মাঝবয়সী মহিলার চারপাশে ভিড় জমেছে। পোট্রট আঁকছেন তিনি, মাথা পিছু দশ লেভা। ডলারের আনঅফিসিয়াল রেট-এ চল্লিশ টাকার মত। দেড়শ দুশ লেভায় বিক্রি হচ্ছে চমৎকার সব তেল রঙের ছবি। ওর কাছে মজা লাগছিলো পোর্টেট আঁকিয়ে মহিলাকে। কি দ্রুতই না আঁকতে পারেন। প্রথমে পেন্সিলে ড্রইংটা বের করে নিয়ে রঙ চাপাচ্ছেন। অয়েল প্যাস্টেলেই বেশি আঁকছেন, অনুরোধ করলে ওয়াটার কালারও আঁকছেন।
রবিন যখন তন্ময় হয়ে পোটে আঁকা দেখছিলো তখন অল্প দূরে নীলের সঙ্গে বলছিলেন এক বুড়ো।
নীল খুব অবাক হয়ে গেলো যখন অচেনা বুড়ো যেচে এসে নিচু গলায় ওকে বললেন, তোমার সঙ্গে দু মিনিট কথা বলতে চাই। লাইম গাছের নিচে এসো।
এক মিনিট। বলে নীল রবিনের কাছে এসে বললো, তুমি এখানে থাকো। আমি একটু টয়লেট সেরে আসি।
রবিন সায় জানাতেই ও বুড়োকে এসে বললো, চলুন।
খানিকটা ঘাসজমি পেরিয়ে পুরোনো একটা লাইম গাছ, লোকজন কেউ নেই সেখানে। নীল কিছুটা অবাক হয়ে বুড়োর সঙ্গে হাঁটলো, দু বার পেছনে তাকিয়ে রবিনকে দেখলো।
গাছের নিচে রুমাল পেতে বসলেন বুড়ো। নীলকেও বসতে হলো তাঁর পাশে, রবিনের দিকে চোখ রেখে বুড়ো বললেন, তোমাকে আমি অনেকক্ষণ ধরে অনুসরণ করছি দুটো কথা বলবো বলে। আমার নাম ইভান ইভানভ, রিস্টোর দাদু হই আমি। ওর মা লিলিয়া আমার ভাইঝি।
নীল বুড়োর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললো, আপনার সঙ্গে পরিচিতি হয়ে আনন্দিত হলাম ইভান ইভানভ। আপনি কি রিস্টোর কোনও খবর এনেছেন?
ঠিক ধরেছো বাছা। মুচকি হাসলেন রিস্টোর দাদু। রিস্টো তোমাকে দেখা করতে বলেছে।
কখন, কোথায়? ব্যস্ত গলায় জানতে চাইলো নীল।
কাল সকালে যেতে পারো। বয়ানায় আমার এক ভাইপো আছে, রিস্টোর মামা হয়, ওর বাড়িতেই আছে। এই বলে বুড়ো ইভানভ ওর হাতে ছোট্ট একটা চিরকুট খুঁজে দিলেন–রিস্টো চিঠি দিয়েছে তোমাকে, পকেটে রেখে দাও। বাড়িতে গিয়ে পড়বে। কথাটা গোপন রেখো৷ যাবে খুব সাবধানে। পেছনে যেন কেউ না লাগে।
ঠিক আছে। দু পাশে মাথা নেড়ে সায় জানালো নীল। তখনই নজর পড়লো রবিনের ওপর ওকে খুঁজছে। উঠে দাঁড়িয়ে নীল বললো, আমার ভাই খুঁজছে আমাকে। রিস্টোকে বলবেন কাল নিশ্চয়ই যাবো।
বুড়ো মৃদু হেসে বললেন, বেঁচে থাকো বাছা! ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।
নীল কাছে আসতেই রবিন উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, কী দারুণ পোর্ট্রেট আঁকে, দেখেছিস?
নীল হেসে বললো, তোমার একটা আঁকাবে নাকি। যে রকম হিরোর মত চেহারা তোমার, দেখ না পাঁচ লেভাতেই এঁকে দেবে।
ধ্যাত, কি যে বলিস!
তুমি তো রীনের ঘরে যাও নি। ওর একটা সুন্দর পোর্ট্রেট এঁকে দিয়েছেন এই মহিলা। ঠাট্টা নয় রবিনদা, ইচ্ছে করলে তোমার একখানা করিয়ে নাও।
ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রবিন বললো, আরে না আমি পোর্টেট আঁকিয়ে কি করবো?
কেন, তোমার বান্ধবীকে উপহার দেবে!
দেবো এক থাপ্পড়, বেআদব ছেলে। বড়দের সঙ্গে বুঝি এভাবে কথা বলে! হাসি চেপে গম্ভীর হওয়ার ভান করলো রবিন।
নীল নিরীহ গলায় বললো, বারে আজই তো তুমি বললে, আমাকে ছোট ভাবো না, সব সময় বন্ধুর মতো ভাবো।
রবিন এবার হেসে ফেললো–ঠিক আছে, বন্ধু। তোমার অবগতির জন্য জানাচ্ছি ঢাকায় আমার অন্তত এক ডজন বান্ধবী আছে। তাদের সবার জন্য পোর্ট্রেটের পেছনে একশ বিশ লেভা খরচ করতে আমি রাজী নই।
তা কেন করবে। আগের মতো নিরীহ গলায় নীল বললো, আসল বান্ধবীকে অরিজিনালটা দিও, বাকিদের ফটোকপি করে দিও।
নীলের কথার ধরন দেখে হাসতে গিয়ে বিষম খেলো রবিনকে যে আসল আমি নিজেই জানি না।
ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীল বললো, তাহলে থাক।
পার্কের এক কোণে কফি কর্ণার। লাইন দিয়ে কফি কিনতে হয়। নীল লাইনে দাঁড়িয়ে পাঁচ মিনিট পর দুটো কাগজের গ্লাসে কফি আনলো। লাল উইলো গাছের নিচে বসে দুজনে আরাম করে কফি খেলো। তারপর অনেকটা পথ হেঁটে সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরলোলা। তোবারক বাইরের গেট-এর পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলো। নীল বললো, বাবা এসে গেছেন।
ওরা কাছে আসতেই তোবারক হাত পেছনে নিয়ে সিগারেট লুকিয়ে বিব্রত হেসে বললো, রবিন তাই বুঝি শহরে বেড়াতে গেছিলেন?
রবিন হেসে সায় জানালো। নীল বললো, রবিনদা আমার বন্ধু। ওর সামনে তুমি সিগারেট খেতে পারো তোবারক ভাই।
রবিনও ব্যস্ত হয়ে বললো, আপনিও আমাকে বন্ধু ভাবতে পারেন। সিগারেট খাবেন এতে লজ্জার কি আছে!
তোবারক লাজুক হেসে পেছনে লুকানো হাত সামনে আনলো–স্যারে ফছন্দ করে, সেই জন্য লুকাই খাই। এই বলে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে রবিনকে অফার করলো–বুলগেরিয়ান সিগারেট, টেস্ট করি দেখতে ফারেন।
রবিন প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে বললো, আমার অভ্যাস নেই, বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাঝে মাঝে এক আধটু টানি।
তোবারক লাইটার বের করে রবিনের সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দিলো। রবিনকে প্রথম সিগারেট টানতে দেখলো নীল। এক টান দিয়েই কেশে ফেললে। রবিন। তোবারক অপ্রস্তুত হয়ে বললো, এদেশী সিগারেট একটু বেশি কড়া।
রবিন আরেকবার টেনে ওটা তোবারককে দিয়ে দিলো–তুমিই খাও তোবারক। এত কড়া আমার পোষাবে না।
নীল তোবারককে জিজ্ঞেস করলো–তুমি কি কোথাও বেরুবে?
না, কোনও কাজ আছে?
আমরা ব্যাডমিন্টন খেলব। কোর্ট রেডি করো।
একগাল হেসে তোবারক বললো, ঠিক আছে নীল বাই।
চায়ের টেবিলে বাবা রবিনকে বললেন, কাল সাড়ে নটায় তোর এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে পার্টির একজন সেন্ট্রাল কমিটির মেম্বারের সঙ্গে। বারোটায় আমি এদের একটা কেমিক্যাল প্ল্যান্ট দেখতে যাবো। ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে যেতে পারিস।
নিশ্চয়ই যাবো। রবিন উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, নীল যাবি তো?
নীল একটু হেসে বললো, না রবিনদা। পলিটিক্স-এর কচকচানি আমার ভালো লাগে না। সকালে আমি আমার এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যাবো।
চা শেষ করে রবিন ওপরে গেলো কাপড় বদলাতে। নীলের ব্যাডমিন্টন খেলার আইডিয়াটা ওর পছন্দ হয়েছে। রীনও চলে গেলো ওর ঘরে। মা বললেন, রবিনের জন্য আজ ফুলকপির রোস্ট করবো। পোলিশ এ্যাম্বাসাডরের গিন্নির কাছে সেদিন শিখেছি।
নীল নিরীহ গলায় জানতে চাইলো, খাওয়া যাবে তো মা।
মা হেসে বললেন, তোকে কে সেধেছে খেতে?
বাবা নীলকে বললেন, তোর মা মাঝে মাঝে আমাদের গিনিপিগ বানাতে পছন্দ করেন।
আমার তো আর কাজ নেই! বলে হাসতে হাসতে মা রান্নাঘরের দিকে গেলেন।
বাবা নীলকে একা পেয়ে বললেন, তোর বন্ধুর মা আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য কাকে পাঠিয়েছে বলতো?
আমি কী করে জানবো? অবাক হয়ে বললো নীল।
অনুমান করতে পারিস?
রিস্টোর বাবাকে? না, না, ওর ওপর তো হুলিয়া নীল ভেবে পেলো না কে হতে পারে।
বাবা থেমে থেমে বললেন, আমাদের অফিসের ইলিনা মিরকোভাকে।
বলো কি বাবা!
হ্যাঁ, তাই। আমিও খুব অবাক হয়েছিলাম। পরে রিস্টোর মার নাম বললো–তবেই না বিশ্বাস করলাম।
ঠিকই আছে বাবা। সেদিন ওকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। বললো সিটিযেন কমিটির সাপোর্টার। ও এত এ্যাকটিভ ওয়ার্কার তখন বুঝি নি। কী বললো তোমাকে?
ইলিনার সঙ্গে সাহায্যের বিষয়ে যেসব কথা হয়েছে সবই নীলকে বললেন ওর বাবা। শুধু নীলের ব্যাপারে যে কথা হয়েছে সেটা বললেন না। ভাবলেন, পরে এক সময় বুঝিয়ে বলবেন।
ব্যাডমিন্টন খেলার জন্য তৈরি হয়ে নিচে নামলো রবিন আর রীন। ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। ব্যাডমিন্টন কোর্টে আলো জ্বালিয়ে নেট ঝুলিয়ে তোবারক তৈরি। নীল–তোবারক আর রবিন-রীন পার্টনার হয়ে তিন গেম খেললো। প্রথম দুটো জিতলে নীলরা, পরেরটা রবিনরা। তিন গেম খেলেই ক্লান্ত হয়ে পড়লো রবিন।
সবাই মিলে চেস্টনাট গাছের নিচে পাথরের বেঞ্চে বসলো। তোবারক দারুণ হাসাতে পারে। বুলগেরিয়ান জোক বলে রবিনের পেটে খিল ধরিয়ে দিলো। জোক শুনে নীল আর রীনও হাসলো, যদিও অনেকগুলো ওদের জানা ছিলো।
রাত হওয়ার পর সবাই মিলে রিডিং রুমে বসে অনেকক্ষণ গল্প করলো। তোবারকের সেদিনও বাড়ি যাওয়া হয় নি। ওকে থাকতে না বললে কখনো থাকে না। তবে এখানে থাকাটা বলা বাহুল্য খুবই আনন্দের ব্যাপার। বিশেষ করে বেগম সাহেবের রান্না একদিন খেলে সাতদিন জিভে স্বাদ লেগে থাকে। নইলে বাড়ি গিয়ে তো জোটে কড়কড়ে ঠাণ্ডা ভাত আর বাধা কপি দিয়ে মাংশ রান্না। ডেসপাঁচ ক্লার্ক নইমউদ্দিনের প্রায় অসুস্থ থাকা গিন্নি একপদের বেশি দুপদ কখনো রাধে না।
ঢাকা থেকে রবিন যে সব উপহার এনেছে কাল বের করে নি। খাওয়ার পর এক ফাঁকে উঠে গিয়ে সেগুলো স্যুটকেস থেকে বের করে আনলো। উপহার পেয়ে সবাই দারুণ খুশি। নীলের মার জন্য এনেছে জামদানি শাড়ি, বাবার জন্য এনেছে গরদের পাঞ্জাবী, নীলের জন্য জিনস্-এর প্যান্ট আর শার্ট, ও আগেই চিঠিতে লিখেছিলো পাঠাতে। রীনের জন্য সালোয়ার কামিজ, সঙ্গে রোম থেকে আনা স্যুভেনির। এ ছাড়া মুসুরির ডাল এনেছে দুকেজি আর চানাচুর এক কেজি। নীলের মা দামী জামদানি শাড়ির চেয়ে বেশি খুশি হলেন ডাল আর চানাচুর পেয়ে। বললেন, ভাইয়ার কাণ্ড দেখ। কবে বলেছিলাম এখানে ডাল পাওয়া যায় না, মনে করে ঠিক পাঠিয়ে দিয়েছেন।
রীন বললো, তোমার জামদানি শাড়িটা কী চমৎকার হয়েছে মা! বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে তুমি এটাই পরবে। রবিনদা তুমি কিন্তু আমাদের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান দেখে যাবে।
রবিন আঁতকে উঠলো–পাগল হয়েছিস! বাবা শুনলে হার্টফেল করবেন।
মা বললেন, কী ভালোই না হতো ভাইয়াও যদি আসতেন। রবিন ওর বাবাকে আনার জন্য রোম থেকে সোফিয়া আসার পথে মনে মনে একটা প্ল্যান এঁটেছিলো। সে কথা এখন আর কাউকে বললো না।