সকালে দিব্যি ঝকঝকে ছিল দিনটা। টুপুররা যখন হোটেল থেকে বেরোল, লিটল ইন্ডিয়ার রাস্তায় তখনও ঝাঁ-ঝাঁ রোদ্দুর। অথচ ট্যাক্সি যেই না ব্রিজ পেরিয়ে সেন্টোসা দ্বীপে ঢুকেছে, অমনই ঝুপঝুপ বৃষ্টি। একটানা নয়, এই ঝরছে, এই থামছে। বৃষ্টি হয়ে গরম কিন্তু কমার লক্ষণ নেই। বরং বিশ্রী এক আর্দ্রতায় চিটপিট করছে গা-হাত-পা। সিঙ্গাপুর নিরক্ষরেখার খুব কাছে বলেই নাকি এখানকার আবহাওয়া এরকম বিটকেল। এখানে নাকি তিনটে ঋতু। গরম, আরও গরম, আরও আরও গরম। সঙ্গে যখন-তখন বারিধারা। বারো মাস। শীত শব্দটার নাকি অস্তিত্বই নেই সিঙ্গাপুরে।
তা বৃষ্টি হোক, কি রোদ্দুর, টুপুরদের বেড়ানোর উৎসাহে কিন্তু ভাটা পড়েনি। গাছপালায় ছাওয়া সবুজ দ্বীপটায় পা রাখার পর থেকেই চলছে ছোটাছুটি। লাল-নীল-হলুদ-সবুজ দাগটানা দেখনবাহার বাস ঘুরপাক খাচ্ছে দ্বীপময়, টিকিট-ফিকিটের বালাই নেই, চেপে বসলেই হল। তারপর পছন্দমতো জায়গায় নেমে, খানিক ঘুরেফিরে, আবার ওঠো আর-এক বাসে। চলো, যেখানে প্রাণ চায়। চারদিক খোলা ছোট-ছোট ট্রামও চলছে দিব্যি। তাতে চড়ে ঘোরার মজাও নেহাত কম নয়।
প্রথমে যাওয়া হল আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডে। সমুদ্রের তলার দুনিয়াটা কী নিপুণ দক্ষতায় প্রকাণ্ড এক অ্যাকোয়ারিয়ামে বন্দি। চলন্ত পাটাতনে দাঁড়িয়ে অ্যাকোয়ারিয়াম পরিক্রমা করতে করতে টুপুরের তো মনে হচ্ছিল তারা যেন সত্যি সত্যি সমুদ্রের নীচে চলে গিয়েছে। পথের দু ধারে, মাথার উপর, অজস্র সামুদ্রিক প্রাণী। নানান জাতের নাম না জানা মাছ, শুঁড় কিলবিল অক্টোপাস, স্কুয়িড, কাঁকড়া, স্টারফিশ, জেলিফিশ, ঈল…ভয়ংকর চেহারার হাঙরও রয়েছে অনেক। কী শীতল তাদের দৃষ্টি, দেখলেই গা ছমছম করে। মাথায় লম্বা বেয়নেট নিয়ে একটা বিশাল মাছ সাঁইসাঁই ধেয়ে এল বুমবুমের দিকে। মোটা কাচের এপারে দাঁড়িয়েও ভয়ে কেঁপে উঠল বুমবুম।
পার্থ মন দিয়ে হ্যান্ডিক্যামে ছবি তুলছিল। খোলা মনিটরে চোখ রেখে বলল, মাছটাকে চিনে রাখ টুপুর। এ হচ্ছে স্টিং রে। ওই শক্ত হুল পেটে ঢুকিয়ে ওরা মানুষের নাড়িড়ুড়ি পর্যন্ত বের করে আনে।
টুপুর বলল, কিছুদিন আগে এই স্টিং রে-র আক্রমণেই স্টিভ আরউইন মারা গেলেন না?
হ্যাঁ, কী মর্মান্তিক মৃত্যু! হাঙর, কুমির কত কী নিয়ে উনি খেলা করেছেন, কিন্তু স্টিং রে-র কাছে হেরে গেলেন। আর ওই ঝাঁকটা দ্যাখ। ওগুলো হল পিরানহা। ওদের মতো নিষ্ঠুর প্রাণী রোধ হয় আর দুটো নেই। দল বেঁধে যখন অ্যাটাক করে, তিমিমাছও রক্ষা পায় না।
বুমবুম বলল, আমি পিরানহা দেখেছি। অ্যানিম্যাল প্ল্যানেটে। শার্কও।
পাৰ্থ হেসে বলল, হাঙর দেখার জন্য অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট খোলার কী দরকার। তোকে একদিন মাছের বাজারে নিয়ে যাব। দেখবি, ঢেলে হাঙর বিক্রি হচ্ছে।
বুমবুম অবাক মুখে বলল, সত্যি?
একটা নয়, তিনটে সত্যি। আজকাল বেশিরভাগ বিয়েবাড়িতে তো হাঙরেরই ফিশফ্রাই খাওয়ায়। একটু আঁশটে-আঁশটে গন্ধ থাকে, তবে টেস্ট মন্দ নয়।
মজা করতে করতেই মাটির নীচ থেকে বেরিয়ে এল সকলে। বাইরে এসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল টুপুর। ইস, আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ডে তিমিমাছটা থাকলেই ষোলো কলা পূর্ণ হত।
এর পর সিলোসো বিচ। ঢেউবিহীন সমুদ্রের ধারে ঝলমলে বালুকাবেলা। বেড়াতে আসা লোকজন মহা আনন্দে ভলিবল খেলছে। কেউ বা মেতেছে জলক্রীড়ায়। জোরকদমে স্কিয়িং চলছে। ওয়াটার স্কুটার। বিচে হোটেল রেস্টুরেন্টও আছে খানকতক, সেখানেও জমজমাট ভিড়।
সুখাদ্যের গন্ধ পেয়েই পাৰ্থর পেট চুঁইচুঁই। এক ইতালিয়ান রেস্তরায় ঢুকে আস্ত একখানা পিৎজা সাঁটিয়ে ফেলল বাপ-ছেলে। টুপুর মিতিনমাসির দলে, তারা খেল পাস্তা।
খেতে-খেতে টুপুর জিজ্ঞেস করল, এই সমুদ্রটার নাম কী গো, মিতিনমাসি?
সিঙ্গাপুর প্রণালী। দক্ষিণ চিন সাগর আর জাভা উপসাগরকে জয়েন করেছে এই ষ্ট্ৰেট অফ সিঙ্গাপুর।
ও। সমুদ্র নয় বলেই বুঝি ঢেউ কম?
হুঁ। কিন্তু যথেষ্ট গভীর। সেই জন্যই তো এখানে এত বড় বন্দর গড়ে উঠেছে।
পার্থ মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, গড়ে উঠেছে নয়, বলল, গড়ে তোলা হয়েছে। দুশো বছর আগেও সিঙ্গাপুরে কিসসু ছিল না। এখানে থাকত মাত্ৰ হাজারখানেক লোক। বেশিরভাগই মালয়ী। ভারতে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মালয়ের সুলতান হুসেন শার সঙ্গে চুক্তি করে সিঙ্গাপুরের দখল পায়। এখান থেকে জাভা, বোর্নিও, সুমাত্রা, চিন, থাইল্যান্ড, সর্বত্র যাওয়ার সুবিধে আছে বলে ব্রিটিশরা এখানেই বন্দর বানায়। বন্দরটাকে রক্ষা করার জন্য একটা দুৰ্গ বানিয়েছিল। ফোর্ট সিলোসো। এখানেই আছে দুর্গটা। ওওওই টঙে। যাবে দেখতে?
টিলায় উঠে ফোর্ট সিলোসো দেখার ব্যাপারে কারওরই বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল না। একে ফের ঝিরঝির বৃষ্টি নেমেছে, তার উপর গত বছর মহারাষ্ট্রে এককাঁড়ি দুর্গ দেখে দেখে চোখ হেজে গিয়েছে। অতএব এককথায় প্রস্তাব বাতিল। তার চেয়ে বরং আবার একখানা বাস ধরে মেরলিয়ন চলে যাওয়াই ভাল।
মেরলিয়ন এক বিশাল উঁচু মূর্তি। নীচের দিকটা তার জলকন্যার মতে, মুখ সিংহের। এই মূর্তি সিঙ্গাপুরের প্রতীকও বটে। মূর্তির পেটের ভিতর লিফট চলছে। লিফটে চড়ে সিংহের মুখ পর্যন্ত চলে গেল টুপুররা। ন’তলায় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, থুড়ি সিংহের মুখগহ্বরে দাঁড়িয়ে, গোটা সেন্টোসা দ্বীপটাকে দেখল ভাল করে। দূরে, সিঙ্গাপুরের আকাশছোঁয়া বাড়িগুলোও চোখে পড়ল আবছা আবছা।
নেমে ফের ব্লু লাইন বাস। সোজা ডলফিন লেগুন। সেখানে তখন শুরু হচ্ছে বৈকালিক ডলফিন শো। টিকিট আগেই কাটা ছিল, সুশৃঙ্খল লাইন দিয়ে একে-একে ঢুকে পড়ল সকলে। ভিতরে বেজায় ভিড়। নীল জলের হ্রদখানা ঘিরে সারি দিয়ে পাতা চেয়ারগুলো ভর্তি, দাঁড়িয়ে আছে থরে থরে মানুষ। ঠেলেঠুলে সামনে গেল টুপুর বুমবুমের হাত ধরে।
মিনিটপাঁচেকের মধ্যেই শুরু হল খেলা। বাজনার তালে-তালে হ্রদের জলে নাচছে দুটো ডলফিন। তড়াং-তড়াং লাফাচ্ছে, ট্রেনারের নির্দেশে রিংয়ের ভিতর দিয়ে গলে যাচ্ছে অবলীলায়। একজোড়া উদবিড়ালও খেলা দেখাল ডাঙায়। দর্শকদের শেখাল, কীভাবে প্লাস্টিকের খালি বোতল আর এঁটো কাগজের কাপপ্লেট যত্রতত্র না ছড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলতে হয়। বুমবুম তো দেখে মহা খুশি। দর্শকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চটাস চটাস তালি বাজাচ্ছে।
শো যখন ভাঙল, বিকেল প্রায় শেষ। ঘেরা জায়গাটা থেকে বেরিয়ে টুপুররা এসে বসল পাশের পালাওয়ান বিচে। এখানে সমুদ্রতট অনেকটাই চওড়া। ছোট-ছোট ঢেউ পারে পৌঁছে ভাঙছে ছলাৎ-ছলাৎ। এই বিকেলেও স্নান করতে সমুদ্রে নেমেছে এক দল চিনা ছেলেমেয়ে, উল্লসিত হয়ে এ ওর গায়ে জল ছিটোচ্ছে। অদূরে এক সেতু দেখা যায়। পর্যটকরা অনেকেই সেতু পার হয়ে চলেছে আর-একটা ছোট্ট দ্বীপে।
টুপুর জিজ্ঞেস করল, ওই দ্বীপটায় কী আছে গো?
পার্থ লিফলেট খুলে জায়গাটা সম্পর্কে পড়ে নিচ্ছিল। ঝট করে চোখ তুলে বলল, ওই ছোট্ট দ্বীপটা হচ্ছে এশিয়ার দক্ষিণতম বিন্দু।
মিতিন মুখ কুঁচকে বলল, তা কী করে হয়? সিঙ্গাপুরের নীচে তো জাভা সুমাত্ৰা আছে, বোর্নিও আছে..
আহাহা, ওগুলো তো আলাদা-আলাদা দ্বীপ। আসলে এশিয়া মহাদেশের স্থলভূমি এখানকার এই দ্বীপটাতেই শেষ হয়েছে। দ্যাখো না, লেখাটা পড়ো।
পড়ল মিতিন, তবে খুব একটা অভিভূত হল না। বলল, যাও, তোমরা ঘুরে এসো। আমি এখানেই আছি।
বুমবুম বলল, আমিও যাব না। টায়ার্ড লাগছে।
শেষ পর্যন্ত যাওয়াই হল না। প্রত্যেকেই খুব ক্লান্ত, এবার মানে-মানে হোটেলে ফিরতে চায়। ত্যানজং বিচ, প্রজাপতি উদ্যান, মশলার বাগান, মিউজিক্যাল ফাউন্টেন সবই বাকি রয়ে গেল। যাক গে, কাল প্রায় সারা রাত জেগে আজই কি এত ধকল নেওয়া সম্ভব।
ট্যাক্সি ছেড়ে হোটেলের লাউঞ্জে ঢুকতে না-ঢুকতেই সামনে নারায়ণ। টুপুরদের দেখেই হাঁকপাঁক করে দৌড়ে এসেছেন ভদ্রলোক। হাত কচলে পার্থকে বললেন, একটা সমস্যা হয়েছে স্যার।
পার্থ হতভম্ব মুখে বলল, কী সমস্যা?
আপনি পেঙ্গুইন ইন্টারন্যাশনালের যে চিঠিটা আমায় দিয়েছিলেন, সেটা তো আসল নয়।
মানে?
ওটা ড়ুপ্লিকেট স্যার। অরিজিনালটা বোধ হয় আপনার কাছে রয়ে গিয়েছে।
তাই কি?
হ্যাঁ স্যার। আমাদের অফিসে অরিজিনালটা দিতে হয়।
ওহো, ওটা তা হলে বোধ হয় সুটকেসে। গোছগাছের সময় ভুল করে ঢুকিয়ে ফেলেছি। আর আপনার কাছে স্ক্যান করা কপিটা চলে গিয়েছে। পার্থ দুএক সেকেন্ড ভাবল কী যেন। তারপর বলল, কিন্তু এতে অসুবিধের কী আছে? স্ক্যান করা কপি তো আসলেরই সমতুল।
জানি স্যার। তবে আমাদের অরিজিনালটাই দরকার।
ঠিক আছে, রুমে গিয়ে খুঁজে দেখছি।
আমি কি এখানে অপেক্ষা করব?
না না, আপনি কেন মিছিমিছি… পেলে ফোন করে দেব। সকালে এসে নিয়ে যাবেন।
এখনই পেলে ভাল হত স্যার।
সারাদিন ঘুরে এইমাত্র ফিরলাম… বড্ড টায়ার্ড। কালই আসুন, প্লিজ।
কাল কখন আসব? আপনারা তো নিশ্চয়ই সকালে আবার বেরোবেন…
বলছি তো, বেরনোর আগে পেয়ে যাবেন। রাতে আপনাকে ফোন করে দেব।
অরিজিনালটা না পেলে কিন্তু প্রবলেম হয়ে যাবে স্যার।
কীসের প্রবলেম? এতক্ষণে পাৰ্থর ভুরুতে ভাঁজ, আপনাদের কি সন্দেহ, আমরা আসল লোক নই?
ছি ছি স্যার, এ কথা কখন বললাম? নারায়ণ জিভ কাটলেন, আমাদের অফিসে অরিজিনালটাই জমা দেওয়ার নিয়ম। তাই আপনাদের..
বোর করছেন। তাই তো? পার্থ এবার একটু তেরিয়া হয়েছে, ধরুন, আসল চিঠিটা সঙ্গে আনতে ভুলে গিয়েছি। যদিও তার আশঙ্কা কম। আমার ধারণা, ব্যাগ সুটকেসেই কোথাও আছে। তবু যদি খুঁজে দিতে না পারি, আপনার অফিস কী করবে? আমাদের তাড়িয়ে দেবে? হোটেলের বিল মেটাবে না?
সে তো অনেক কিছুই করতে পারে। আপনাদের ফেরার টিকিট ক্যানসেল করাও তো খুব কঠিন কাজ নয়, পলকের জন্য নারায়ণের চোয়াল যেন একটু শক্ত হল। পরক্ষণে গলায় মোলায়েম সুর, কিন্তু পেঙ্গুইন রিসর্টস ইন্টারন্যাশনাল অতিথিদের সম্মান করে। আমাদের একটা গুডউইল আছে। আশা করব, আমাদের মাননীয় অতিথিরাও সেই গুডউইলটা বজায় রাখতে সাহায্য করবেন।
ঠিক আছে, পার্থ আরও গম্ভীর, আমি এখনই খুঁজে দেখছি।
থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। আমি আপনার ফোনের প্রতীক্ষায় রইলাম।
রুমে ফিরেই ঝপাঝপ ব্যাগ সুটকেস টেনে নামাল পার্থ। শুরু হয়ে গিয়েছে অনুসন্ধান পর্ব। প্রথমে ব্যাগ সুটকেসের পকেটগুলো হাতড়াল। নেই। একটা একটা করে জামাকাপড় বের করে রাখছে বিছানায়। আঙুল চালিয়ে দেখছে চিঠিটা কোনও ভাঁজে ঢুকে আছে কিনা।
পাৰ্থর কাণ্ডকারখানা দেখছিল মিতিন। নারায়ণের সঙ্গে কথোপকথনের সময় সে টুঁ শব্দটি করেনি। ঘরে এসেও চুপচাপ ছিল। জামাকাপড় ঘাঁটাঘাঁটি দেখে মুখ খুলেছে। চোখ পাকিয়ে বলল, করছটা কী, অ্যাঁ? সুটকেসটা কী সুন্দর গোছগাছ করে এনেছিলাম, পুরা ছত্ৰখান করে দিলে তো?
নিকুচি করেছে গোছানোর, পার্থ গজগজ করে উঠল, ওই চিঠি না পেলে কী হবে ভেবে দেখেছ?
কী হবে? হবেটা কী?
সাড়ে সব্বোনাশ। শুনলে না, লোকটা কেমন মিষ্টি করে ভয় দেখিয়ে গেল? সত্যি যদি প্লেনের টিকিট ক্যানসেল করে দেয়?
ইল্লি রে, টুপুর ফোঁস করে উঠল, টিকিট তো তোমার কাছে।
তাতে কী? টিকিটের নম্বর নিশ্চয়ই পেঙ্গুইনের কাছে আছে। ইন্টারনেট থেকে যদি বাতিল করে দেয়, এয়ারপোর্টে আমাদের কী ঝামেলায় পড়তে হবে বুঝতে পারছিস?
মনে হয় না অতটা করবে, মিতিন মাথা দোলাল, আর তেমন কিছু যদি ঘটেও, আমাদের তো ক্রেডিট কার্ড আছে। দরকার হলে থাকার মেয়াদ এক-দুদিন বাড়িয়ে আমরাই টিকিট কেটে ফিরব।
হোটেলের বিলও তো গুনতে হবে।
হলে হবে। এত নার্ভাস হচ্ছ কেন? মিতিনের কোনও কিছুতেই হেলদোল নেই। উলটে ঠোঁটে এক মুচকি হাসি ঝুলছে, তোমাকে একটা ব্যাপারে আমি গ্যারান্টি দিতে পারি। চিঠিটা তুমি ব্যাগ কিংবা সুটকেসে ঢোকাওনি।
তা হলে? পার্থ ঢোক গিলল, তা হলে কি কলকাতাতেই ফেলে এলাম?
হতে পারে। তুমি যা কেয়ারলেস।
পার্থ গুম হয়ে গেল। সুটকেস ফেলে উঠে দাঁড়াল। অস্থিরভাবে পায়চারি করছে ঘরে। হঠাৎ স্ট্যাচু হয়ে বলল, নারায়ণকে তা হলে কী জবাব দেব?
কিছু বলতে হবে না। স্রেফ চেপে যাও।
কিন্তু কাল তো আবার হানা দেবে!
তখন আমি ফেস করব। বুঝিয়ে দেব, বেড়ানোর সুযোগ দিয়ে ওরা আমাদের মাথা কিনে নেয়নি।
এতক্ষণে পার্থর মুখে হাসি দেখা দিয়েছে। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, বটেই তো। ফালতু-ফালতু লোকটাকে বেশি পাত্তা দিচ্ছিলাম।
লোকটা কিন্তু বেশ ঢ্যাঁটা আছে। টুপুর না বলে পারল না, সকালে দেখে একদম বোঝা যায়নি।
ঢ্যাঁটা তো ঢ্যাঁটা, মিতিন বুড়ো আঙুল দেখাল, তাতে আমাদের ঘেঁচু। যা যা, আর-এক দফা স্নান সেরে ফ্রেশ হয়ে নে। একটু জিরিয়ে আবার বেরোতে হবে তো, নাকি?
.
০৬.
প্ল্যান তো অনেকই ছিল। তবে রাতের সিঙ্গাপুরদর্শন যেন জমল না সেভাবে। গায়ে জল ঢালার পরই বুমবুমের এমন তেড়ে ঘুম এল, কোনওক্রমে এক গ্লাস দুধ খেয়ে সে ঢলে পড়ল বিছানায়। শত ঠেলাঠেলিতেও চোখ খুলল না। অগত্যা কাউকে না কাউকে তো হোটেলে থাকতেই হয়। পার্থ আয়েশি মানুষ, হুড়ুদ্দুম ছোটাছুটি তার বেশিক্ষণ পোষায় না। মাসি বোনঝিকে বেরোতে বলে সে রয়ে গেল হোটেলে। তা বেড়াতে এসে দলের অর্ধেক লোকই যদি সঙ্গে না থাকে, ভ্ৰমণটা কেমন ছানা কেটে যায় না?
তবু মিতিনমাসির সঙ্গে শহরের অনেকটাই ঘুরল টুপুর। আলোয়-আশোয় দারুণ সেজে আছে রাতের সিঙ্গাপুর। উঁচু-উঁচু বাড়িগুলো থেকে দ্যুতি ঠিকরোচ্ছে যেন। পার্কের উজ্জ্বল আলো, দোকানপাটের আলো, ব্রিজের আলো, বিজ্ঞাপনের আলো, বাহারি পথবাতির আলো… এত আলোর ঝালকানিতে কেমন যেন দিশেহারা লাগে।
মাসি বোনঝি প্রথমে গেল শহরের দক্ষিণে। সিঙ্গাপুর নদীর দিকটায়া নদীর পারে মেরলিয়ন পার্কে বসে রইল একটুক্ষণ। এখানেও মেরলিয়নের মূর্তি আছে একখানা। ছোটখাটো। মুখ দিয়ে ফোয়ারার মতো জল বেরোচ্ছে। এই নদীর ধারেই নাকি দুশো বছর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির র্যাফল সাহেব পত্তন করেছিলেন শহরটার। এখন এ জায়গা সিঙ্গাপুরের ডালহৌসি পাড়া। এসপ্ল্যানেডও বটে। কাছেই পাঁচ-পাঁচখানা গগনচুম্বী অট্টালিকা নিয়ে সানটেক সিটি অফিসের আড়ত। সেদিকে যাব-যাব করেও যাওয়া হল না শেষ পর্যন্ত। লম্বা ব্রিজ পেরিয়ে উলটো দিকের ভিক্টোরিয়া কনসার্ট হলে এল মিতিন আর টুপুর। সেখানে সবুজ লনে উদ্দাম নাচগানের আসর বসেছে। দুপাঁচ মিনিট বাজনার ঝংকার শুনেই টুপুরের মাথা ঝিমঝিম। কনসার্ট হলের সামনে থেকে ফের ট্যাক্সি। রঙে চায়না টাউনে চরকি মেরে সোজা অৰ্চাড রোডে। এ পাড়াটা যেন আরও ঝলমলে। রয়েছে নানান দেশের দূতাবাস, চক্ষু চড়কগাছ। করে দেওয়া পেল্লায় সব জমকালো দোকান। গাছে ছাওয়া বুলেভার্ডটিও ভারী মনোরম। গাছতলায় এক বৃদ্ধ আইসক্রিম স্যান্ডউইচ বিক্রি করছিল, মিতিনমাসি সাধাসাধি করলেও টুপুরের মোটেই খেতে ইচ্ছে হল না। বুমবুমকে বাদ দিয়ে সে একা-একা খাবে? তাই কি হয়?
কাছেই একটা ফুডকোর্টে রাতের খাওয়া সেরে ফের ট্যাক্সি। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ির আরামে গল্প করতে করতে ফিরছে মাসি বোনঝি।
মিতিন জিজ্ঞেস করল, কী রে, জায়গাটা কেমন লাগছে?
ভাল। খুব ভাল। আমাদের কলকাতাকেও যদি এমন বানিয়ে ফেলা যেত।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কথা বলছিস? না রাস্তাঘাটের প্রশংসা করছিস? নাকি উচু-উঁচু বাড়ি আর আলোর বাহারে মন ভরেছে?
ডিসিপ্লিনের কথাও বলো।
আমার তো বাপু বড় বেশি কৃত্রিম লাগছে। বড় বেশি সাজানো। মাপামাপা। এমনকী মানুষগুলোও।
তবু… সাজানোটাকেও তো বাহবা দিতে হয়।
তাও… কেমন যেন প্রাণের অভাব রে। এই যে সেন্টোসায় আজ দু-দুখানা সি-বিচে গেলাম, ওখানকার বালিগুলো হাতে নিয়ে দেখেছিলি কি?
হ্যাঁ। মোটা-মোটা দানা।
প্রায় সরষের সাইজ। বাজি রেখে বলতে পারি, ওই বিচগুলো মোটেই ন্যাচারাল নয়। পর্যটক টানার জন্য বালি ফেলে তৈরি করা হয়েছে, বলতে বলতে হেসে ফেলল মিতিন, অবশ্য শহরের নামটাই তো একটা বড়সড় ফাঁকি।
কীরকম?
ওমা, গল্পটা জানিস না? অনেক-অনেক বছর আগে প্যালেমবাং… মানে এখন যার নাম ইন্দোনেশিয়া… সেখানকার রাজা জাহাজে চড়ে সমুদ্রপথে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ঝড় আসে, রাজা আশ্ৰয় নেন এই দ্বীপে। তখন এখানকার এক জন্তুকে দেখে তাঁর সিংহ মনে হয়েছিল। ব্যস, অমনই দ্বীপটার নাম দিয়ে ফেললেন সিঙ্গাপুরা। লায়নস সিটি। অথচ এই দ্বীপের হাজার মাইলের মধ্যে কোনও সিংহ নেই।
ভারী অদ্ভুত তো!
কথায় কথায় হোটেল এসে গিয়েছে। মধ্যবয়সি চিনা চালককে ভাড়া মিটিয়ে ট্যাক্সি থেকে নামল মিতিন আর টুপুর। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা, হোটেলের লাউঞ্জ শুনশান। শুধু শ্যামলা রং এক মালয়ী কন্যা বসে আছে রিসেপশন কাউন্টারে। মন দিয়ে ফ্যাশন শো দেখছে টিভিতে। সকালে বা সন্ধ্যায় এই মেয়েটি ছিল না। আজ বোধ হয় ওর নাইট ডিউটি।
মেয়েটির সঙ্গে মধুর হাসি বিনিময় করে মিতিন-টুপুর পায়ে পায়ে ১০৪-এর দরজায় পৌঁছে গেল। একবার টোকা দিতেই ভিতর থেকে পার্থর গলা, খোলা আছে। চলে এসো।
আশ্চর্য, দরজাটা লাগিয়ে রাখোনি কেন? ঘরে ঢুকে বিরক্ত স্বরে বলল মিতিন।
পার্থর হেলদোল নেই। টিভি চালিয়ে এক ইংরেজি সিনেমায় মগ্ন। পরদা থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, এই তো, একটু আগে উনি গেলেন।
কে?
সুজিত দত্ত।
তাই নাকি?
অনেকক্ষণ আজ্ঞা দিয়ে গেলেন। ঘণ্টাখানেক ছিলেন প্রায়।
অ। তা কী গপ্পো হল?
ওই কুম্ভকৰ্ণ নারায়ণ…উনিই তো অর্ধেক টাইম খেয়ে নিলেন।
কুম্ভকৰ্ণ নয়, কুম্ভকনম। ড্রেসিংটেবিলে ভ্যানিটিব্যাগ রাখতে রাখতে মিতিন বলল, কুম্ভকনম একটা জায়গার নাম।
জানি রে বাবা, জানি। কলকাতায় আমার গুচ্ছের তামিল বন্ধু আছে। ওরা নামের আগে বাবার নাম আর আদি বাসস্থানের নাম জুড়ে রাখে। প্র্যাকটিসটা ইন্ডিয়ার অনেক স্টেটেই চালু। কারও শুধু বাবার নাম থাকে, কারও দেশের নাম। যেমন ধরো…
লেকচার স্টপ, মিতিন ঘুরে তাকাল, হঠাৎ মিস্টার নারায়ণের প্রসঙ্গ এল কেন?
আমি তুলিনি। সুজিতবাবু থাকাকালীনই নারায়ণ ফোন করলেন..
আবার ফোন করেছিলেন?
তা হলে আর বলছি কী, ঘুমন্ত বুমবুমের পাশে আধশোওয়া ছিল পাৰ্থ, উঠে সোজা হয়ে বসল, এবার অবশ্য আর রেয়াত করিনি। দুমদাম পাঞ্চ ঝেড়েছি।
কী রকম?
স্ট্রেট বলে দিয়েছি, এভাবে বারবার জ্বালাতন করার জন্য চিঠিটা আর খুঁজবই না। স্ক্যান কপি দিয়েই কাজ চালিয়ে নিন, নইলে গোল্লায় যান। সকালে আসতেও বারণ করে দিয়েছি।
শুনে নারায়ণের কী রিঅ্যাকশান?
খুব হাউমাউ করছিল। বোধ হয় বার চল্লিশ প্লিজ-প্লিজ বলল, পার্থ চোখ টিপল, আমি আর ওই মক্কেলকে কেন পাত্তা দেব, বলো? ওর আর আমাদের হ্যারাস করার ক্ষমতাই নেই। অন্তত এই হোটেলে। রিসেপশন থেকে জেনে নিয়েছি, রুমভাড়া আগাম দেওয়া আছে। ইন ফ্যাক্ট, পেঙ্গুইন এখানে একটা রুম পার্মানেন্টলি বুক করে রাখে। রেগুলার ক্লায়েন্ট আসে ওদের। তিন দিন, দু রাতের প্যাকেজ এনজয় করে যায়।
অর্থাৎ কোম্পানিটা জেনুইন। টুপুর ফুট কাটল, প্রতি সপ্তাহেই সুডোকুর জন্য কাউকে না কাউকে প্রাইজ দেয়।
থাম তো! টুপুরকে মৃদু ধমক দিয়ে মিতিন ফের জেরা শুরু করল, তোমার ওই চোটপাট শুনে সুজিত দত্ত কী বললেন?
কী আর বলবেন। জানতে চাইলেন ঘটনাটা কী।
তুমিও ব্যাকব্যাক করে সব উগরে দিলে?
আমার মনে কোনও প্যাঁচ নেই। তোমার মতে ঢাকঢ়াক গুড়গুড় আমার আসে না, পার্থ ঈষৎ অপ্রসন্ন। গজগজ করতে করতে বলল, ওরা যেচে বেড়াতে নিয়ে এল, আবার ওরাই অযথা ঝামেলা করছে. এমন বিদঘুটে খবরটা গোপন রাখতে যাবই বা কেন?
হুম। টুল টেনে বসল মিতিন, বলল, তা সুজিতবাবুর সঙ্গে আর কী কী গপ্পো হল?
বললাম তো, ওই নারায়ণকে নিয়েই..উনি তো চিঠি এপিসোড শুনে স্তম্ভিত। বললেন, এরকম আবার হয় নাকি? এমন কী মহামূল্যবান চিঠি, যার অরিজিনাল না হলে চলবে না?
সুজিতবাবু চিঠিটা দেখার বাসনা প্রকাশ করেননি?
একবার ক্যাজুয়ালি বলেছিলেন। আমি খোঁজাখুঁজিতে যাইনি। বলেছি, ছাড়ুন তো মশাই, ওই চিঠি নিয়ে আমি আর মাথা ঘামাবই না। থাকলে আছে, না থাকলে নেই। ব্যস।
হুম! মিতিন চুপ করে রইল একটুক্ষণ। তারপর আবার জেরা শুরু, আর কী কথা হল সুজিত দত্তর সঙ্গে?
এমনিই, এতাল-বেতাল। আমার প্রেস, ওঁর ব্যাবসা…
আমার প্রফেশনের গল্পও নিশ্চয়ই করেছ?
ওটা আমি ইচ্ছে করেই চেপে গিয়েছি। ভাবলাম, তুমি পছন্দ করবে কি করবে না…
যাক, একটাই বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছ তা হলে।
বলেই মিতিন উঠে গেছে। বাথরুম থেকে জিনস-টি শার্ট বদলে নাইটি পরে এল। দেখাদেখি টুপুরও। এবার শোওয়ার আয়োজন করার পালা। টুপুরের জন্য বিকেলেই একটা নেয়ারের খাট দিয়ে গিয়েছে হোটেলের কর্মচারী। ভাঁজ করে রাখা ছিল খাটটা, খুলে বিছানা পাতল টুপুর। মিতিনও ভাল করে বিছানা ঝেড়ে নিল।
টিভি বন্ধ করল পার্থ। সোফায় গিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা তুলেও রেখে দিল। এখানে এসে ভারী জব্দ হয়েছে সে। রুমে সিগারেট ধরাতে পারছে না। স্মোক অ্যালার্ম লাগানো আছে যে! ছোট্ট একখানা আড়মোড়া ভেঙে টুপুরকে জিজ্ঞেস করল, তোরা বাইরে কী খেলি রে?
হাফ মালয়েশিয়ান, হাফ জাপানি। নাসি গোরেং, আর সুশি।
ওগুলো কী দ্রব্য?
নাসি গোরেং নুডলের মতোই। সঙ্গে সবজি, মাংসটাংস মেশানো থাকে। তবে টেস্ট চাইনিজের মতো নয়, অন্যরকম। আর শুশি তোমার ভাল লাগত না, একটু কাঁচা মাছের গন্ধ আছে।
ভালই হয়েছে তোদের সঙ্গে বেরোইনি। আমি বাবা এখানে পাতি ইন্ডিয়ান ডিশ খেয়েছি। পরোটা মাংস উইথ স্যালাড।
আর বুমবুম?
ও ব্যাটা তো জাগলই না। সেন্টোসায় যা হাঁটাহাঁটি করেছে।
মিতিন বিছানায় বাবু হয়ে বসেছে। আপন মনেই বলল, সেন্টোসার ছবিগুলো একবার দেখলে হয়।
এত রাত্তিরে? পাৰ্থ চোখ কুঁচকোল, পুরো একটা ক্যাসেট আছে কিন্তু এক ঘণ্টার।
আহা, চলুক না খানিকক্ষণ। তোমার ব্যাটারিটাও মোটামুটি চার্জড হয়ে যাবে।
প্লাগ গুঁজে টিভির সঙ্গে যুক্ত হল হ্যান্ডিক্যাম। পরদায় ফুটে উঠল ছবি। গোড়ার দিকে নেহাতই হাবিজাবি। সেন্টোসা যাওয়ার পথে বড় উলটোপালটা ক্যামেরা চালিয়েছে পার্থ। অকারণে। ফার্স্ট ফরোয়াড করে ঢোকা হল সেন্টো পর্বে। প্রথমেই আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ড। হাঙর, অক্টোপাস, স্টিং রে, পিরানহা, রাক্ষুসে কাঁকড়া। বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সিলোসো বিচ। ইতালিয়ান রেস্তরার অভ্যন্তর, বুমবুমের বৃষ্টিতে ছোটাছুটি, জলে গিয়ে পা ডোবানো, টুপুরের সঙ্গে খুনসুটি। ব্লু-লাইন, না রেডলাইন, কোনও একটা ভিড়-ভিড় বাসের অন্দরেও ঘোরানো হয়েছে হ্যান্ডিক্যাম। বাইরে থেকে মেরলিয়ন, সিংহের মুখে দাঁড়িয়ে সেন্টোসার নিসর্গ, দুরে সিঙ্গাপুরের উঁচু-উঁচু বাড়ি, জাহাজ, সবই ধরা আছে লেন্সে। আছে সেন্টোসার ট্রাম, রঙিন ডাস্টবিন, সাইনবোর্ড, ছবির মতো পাকখাওয়া পথঘাট, গাছপালা। ডলফিন শো তে প্রায় পুরোটাই তুলেছে পার্থ। বাজনার তালে নাচ, উদবিড়ালের কেরামতি…
আচমকাই ডলফিননৃত্য স্থির করে দিয়েছে মিতিন। কী যেন দেখছে এক দৃষ্টে।
পার্থ জিজ্ঞেস করল, কী হল?
ওই লোকটাকে মার্ক করো, টিভির পরদায় ফুটে থাকা ছবির বাঁ কোণটায় আঙুল দেখাল মিতিন, ওই যে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, মাথায় টুপি, চোখে চশমা!
টুপুর চোখ কুঁচকে বলল, স্টিল কালারের সুট?
হ্যাঁ। লোকটাকে মেরলিয়নেও দেখলাম না?
ছিল নাকি?
মনে হচ্ছে। দাঁড়াও, রিওয়াইন্ড করি।
ভুল বলেনি মিতিন। মেরলিয়নেও দেখা গেল লোকটাকে। আটদশ জন টুরিস্টের মধ্যে মিশে রয়েছে। আরও পিছনো হল ক্যাসেট। কী কাণ্ড, সিলোসোতেও ফ্রেঞ্চকাট। এক জাপানি দলের পাশে দাঁড়িয়ে! আবার পিছোল ছবি। আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ড ঢোকার মুখে, স্ন্যাক বারে বসে আছে লোকটা। ক্যামেরার দিকে পিঠ, তবে সুট আর টুপি দেখে চেনা যায়।
মিতিন টানটান হল, ব্যাপারটা যেন কেমন-কেমন ঠেকছে না?
পার্থ হাই তুলে বলল, অমনই রহস্যের গন্ধ পেয়ে গেলে তো? আরে বাবা, আমাদের সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা তো ঘুরতেই পারে।
এবং আমরা যেখানে যতক্ষণ কাটিয়েছি, লোকটাও ঠিক ততক্ষণই সেখানে কাটাতে পারে?
তাতেই বা কী আসে যায়?
যায়। যায়। আমার স্মৃতি যদি বিট্রে না করে, আমরা যখন যে বাসে উঠেছি, লোকটাও ঠিক সেই বাসই ধরেছে।
স্বাভাবিক। একই জায়গায়, একই সময়ে যেতে গেলে এক বাস তো ধরতেই হবে।
কিন্তু ওরকম দ্বিতীয় একটা লোককে পাচ্ছি না কেন? …তোমার বাসের সিনটা দ্যাখো। টুপিওয়ালা লাস্ট সিটে বসে, খোলা ম্যাপে। মুখের অনেকটাই ঢাকা। শুধু টুপি দেখা যাচ্ছে।
আশ্চর্য, বাসে তোমার কোনও সন্দেহ হল না? এখন বলছ?
শোনো, বাসে আমরা উঠেছি এক-দেড় ঘণ্টা পর পর। মাত্র তিনবার। লোকটাকে তখন খেয়াল করলেও আলাদা ভাবে চিহ্নিত করার মতো কোনও পরিস্থিতি হয়নি। তবু মনে একটা খচখচানি ছিল বলেই না রাতদুপুরে ক্যামেরা চালিয়ে বসলাম।
অর্থাৎ তোমার ধারণা, লোকটা আমাদের ফলো করছিল?
একটু একটু ধারণা তখন জন্মেছিল বটে। এখন ছবি দেখে নিশ্চিত হলাম। আড়ালে থাকার চেষ্টা করেও ঠিক কোনও না কোনও ভাবে ক্যামেরায় এসে গিয়েছে লোকটা।
কিন্তু ফলো করার একটা কারণ থাকবে তো? একটা অচেনা লোক কেন হঠাৎ…?
সেটা তো আমিও ভাবছি। যাক গে, মরুক গে, কাল সকালে আবার ঘর বদলানো আছে। তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। এখন চলো, শুয়ে পড়া যাক।
শোওয়াই সার। টুপুরের ঘুম আসছিল না। মস্তিষ্কে এক আজব উত্তেজনা। সিঙ্গাপুরেও একটা রহস্য এসে গেল তা হলে? কিন্তু সারা সন্ধে সে মিতিনমাসির সঙ্গে ছিল, তখন মিতিনমাসি কোনও আলোচনাই করল না কেন?
তবে কি রহস্য এখনও যথেষ্ট পাকেনি? হবেও বা।