০৫. উড়ো চিঠি
বাড়ি বানাতে গিয়ে বাবার হিসেবে গণ্ডগোল হয়ে গেলো। ভেবেছিলেন দশ দিনের ভেতর বাড়ির পুরো কাজ শেষ করবেন, তা আর হলো না। বলু ধলু সবকিছু হিসেব মতোই জোগাড় করেছিলো, তবে মিস্ত্রিদের ভেতর যে গোটা চব্বিশেক মগ থাকবে, এ কথা কে জানতো! আর জানলেও তারা যে কাজের মাঝপথে এসে হঠাৎ ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে, সেটাও তো হিসেবের মধ্যে ছিলো না। যাবার আগে অবশ্য পাওনা-গণ্ডা বুঝে নিয়েছে। দিদা ওদের চলে যাবার সময় রেগেমেগে একবার বলেছিলেন, মাঝপথে কাজ ফেলে গেলেই হলো বুঝি! মগের মুলুক পেয়েছে নাকি! শুনে ওদের ভেতর বয়স্ক যে, দিদা যাকে বলেন মেনিমুখো শয়তান এসে শুধু বললো, আমরা মগ, এ মুকটা আমাদেরই, আপনাদের নয়। ওর ঠাণ্ডা ধারালো চাউনি দেখে দিদা একপা-দুপা পিছিয়ে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিয়েছেন। ফিফিস্ করে বলেছেন, শোন বৌমা, প্রথম থেকেই আমার সন্দেহ হয়েছিলো এগুলো সব খুনে ডাকাত, মিস্ত্রি সেজে এসেছে। দেখলে তো কেমন করে তাকায়!
অর্ধেক মিস্ত্রি চলে যাবার পর কাজ শেষ হতে পুরো দু সপ্তাহ সময় লাগলো। সময় লাগলেও বাড়িটা যে দেখার মতো হয়েছে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। চমৎকার জায়গা বাছা হয়েছিলো। করমালির পাথরের বাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। দুদিকে পাহাড়, ঠিক যেমনটি বাবা চেয়েছিলেন। সামনে বড় এক টুকরো ঘাসের জমি, একেবারে সমান নয়, খানিকটা ঢালু হয়ে তিরিশ ফুটের মতো নেমে গিয়ে করমালির সবজির ক্ষেতের সঙ্গে মিশেছে। টুটুলের ব্যাগে ওর ক্যামেরা ছিলো। পুরো ফিল্মই প্রায় নতুন। নতুন বাড়ির সামনে সবাইকে নিয়ে ছবি তুললো।
যে-দিদা সবকিছুতে খুঁত ধরেন, তিনি পর্যন্ত বললেন, না গো বৌমা, দিব্যি বাড়ি বানিয়েছে হাবু! আমি তো এতকাল জানতাম ও খালি রাস্তা আর পুল বানায়, যা কিনা কদিন পর ভেঙে যায়।
বাবা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, কি যে বলো মা! তাই যদি হতো তবে কবে আমার চাকরি যেতো! এত বুক ফুলিয়ে রিজাইন দিতে হতো না।
কি জানি বাছা, বুক ফুলিয়ে না মুখ শুকিয়ে রিজাইন দিয়েছিস, তোর আপিসে কেউ তো দেখতে যায় নি। বাড়িতে কোনো খুঁত না পেয়ে দিদা অন্য জায়গায় গেলেন বাবাকে ধরতে।
সবচেয়ে খুশি হয়েছে মিতুল, ঝুমা–সবার মাথার ওপর দেড় তলার ঘরটা পেয়ে। সারা দিন ওরা ছোট্ট সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করলো, মেঝের ওপর মনের সুখে গড়াগড়ি খেলো। আর বড়িবি আহ্লাদে আটখানা হলেও ওদের সামলাতে গিয়ে হিমসিম খেলো।
মিস্ত্রি বিদায়ের পর মা বাবাকে বললেন, গত কদিন তো নাওয়া-খাওয়া কারোই ঠিকমতো হয় নি। আজও ঘর-দোর গোছাতে ব্যস্ত থাকবো। ভাবছি আগামী কাল গৃহপ্রবেশটা সেলিব্রেট করলে কেমন হয়। বিদ্যুত্রা সবাই এসে এই সুযোগে দুদিন বেড়িয়ে যাক। যাই বলো, হেডমাস্টার দ্রলোক অনেক করছেন।
বাবা হেসে বললেন, যাক, কথাটা তুমিই কিন্তু বললে। আমি বলবো ভেবেছিলাম, তবে তোমাদের এ কদিনের খাটুনি দেখে বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। চমৎকার প্রস্তাব। কাল সকালে গিয়েই ওদের আমি নিয়ে আসবো।
হেডমাস্টারের কথা মিথ্যে বলেন নি মা। এ কদিন যখনই সময় পেয়েছেন এসে খবর নিয়েছেন, জিজ্ঞেস করেছেন কিছু দরকার কি না। চরদিন আগে এসে বলেছেন মিস্ত্রিদের কারা ভয় দেখিয়েছে, খোঁজ নিয়ে বলবেন। সেদিন বিদ্যুও ওর বাবার সঙ্গে চলে গেছে। টুটুলকে বলেছে, ফণী সাধারণত এ রকম সময় আসে। আমার মনে হয় মিস্ত্রিদের ব্যাপারে ও বলতে পারবে।
টুটুলের বাবা অবশ্য ওটাকে খুব একটা গুরুত্ব দেন নি। বাড়ির কাজ শেষ করতে একটু দেরি হলেও আটকে তো থাকে নি। যাবার সময় বিদ্যুৎকে আদর করে হেডমাস্টারকে বলেছেন, এ কদিন আপনার ছেলে ভীষণ খেটেছে। গর্ব করার মতো ছেলে বটে বিদ্যুৎ! ||||||||||
গাছ কাটা হয়েছিলো সব মিলিয়ে বাহান্নটা। কয়েকটা শাল, আর সব চাপালিস, গর্জন, তেলসুর এইসব। গাছের গুঁড়ি আর মোটা ডালগুলো কেটে ট্রাকে করে খাগড়াছড়ি নিয়ে চেরাই করে আনা হয়েছিলো। সরু ডালগুলো ছোট-ছোট করে কেটে লাকড়ি বানানো হয়েছে। মা টুটুলকে বললেন, করমালিকে নিয়ে লাকড়িগুলো সব বেড়ার ঘরে নিয়ে তোেল। করমালিরা পাথরের ঘরে থাকবে।
বিকেল থেকেই ঘর গোছানোর কাজ শুরু হলো। বসার ঘর আর শোয়ার ঘরে শুধু। কয়েকটা তক্তা দিয়ে শোয়া আর বসার চমৎকার জায়গা করে দিয়েছেন। সবই দেয়াল আর মেঝের সঙ্গে আটকানো। বাবা বললেন, এগুলো বক্স প্যাটার্নের ফার্নিচার। ইউরোপীয়ানরা আজকাল এই প্যাটার্নটা বেশি পছন্দ করছে, খুব সিম্পল বলে। বার্নিশ করলে দারুণ দেখাবে।
মা মুখ টিপে হেসে বললেন, নবী ভাইর বাড়িতেও আমি বক্স প্যাটার্নের শোয়া-বসার জায়গা দেখেছি। তবে সেগুলো ইচ্ছেমতো সরানো যায়, এ রকম দেয়ালের সঙ্গে গাঁথা নয়।
কেন, দেয়ালের সঙ্গে ফিক্সড থাকলে অসুবিধে কি?
ওটা হচ্ছে ইনটেরিয়ার ডেকোরেশনের ব্যাপার। আমার সাবজেক্ট। ঘরের ফার্নিচার মাঝে-মাঝে সরিয়ে না সাজালে একঘেয়ে মনে হয়।
বাবা একটু অপ্রস্তুত হলেন–ঠিক আছে, তোমার যখন একঘেয়ে মনে হবে তখন না হয় কাঠ খুলে আলগা করে বানিয়ে দেবো। এখন কমপ্লিট বানাতে গেলে ডবল সময় লাগতো। এই বলে দিদাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার খাট আর সোফা পছন্দ হয় নি মা?
দিদা অবাক হয়ে বললেন, খাট কোথায় হাবু, এ যে তক্তপোষ! আর সোফাই-বা কাকে বলছিস? বসার ঘরে ওগুলো তো গবদা-গবদা টুলের মতো মনে হলো!
বাবা আরো অপ্রস্তুত হলেন–ঠিক আছে মা, ওগুলোর ওপর যখন জাজিম আর ফোমের কুশন বসিয়ে দেবো তখন দেখো কেমন লাগে!
টুটুল তখন বাবাকে উদ্ধার করলো–ঘরের ভেতরটা মেয়েরা গোছাক বাবা, চলো আমরা বাইরের কাজ করি।
বাইরে অনেক কাজ পড়ে ছিলো। গাছের ডালের খুঁটি দিয়ে বেড়া দিতে হবে। ধানের সময় পেরিয়ে গেছে, সবজির জন্য জমি তৈরি করতে হবে। সবার আগে মা যে বলেছেন, লাকড়িগুলো ঘরে তুলে বাড়ির সামনের জায়গাটা পরিষ্কার করতে হবে।
লাকড়ি সরানোর কাজে মিতুলও এসে যোগ দিয়েছে। বাবা একবার ওকে বলেছিলেন, এখানে রোদ বেশি মিতুল বাবা। তুমি ঘরে গিয়ে মার সঙ্গে কাজ করো।
মিতুল ঘরে যায় নি। গম্ভীর হয়ে বলেছে, দাদা যে বললো ঘরের কাজ মেয়েরা করবে!
টুটুল বললো, অনেক লাকড়ি হয়েছে বাবা। মনে হয় সারা বছর চলে যাবে।
বেড়ার জন্য করমালি সোজা আর লম্বা ডালগুলো আলাদা করে রাখছিলো। টুটুলের কথা শুনে বললো, সামনে বর্ষা আইয়ের ছোড সাব। বর্ষাকালে খড়ির লাই আমগো কম গদ্দিশ অয় না।
বাবা বললেন, ঘরে এত লাকড়ি রাখা যাবে না। গোয়ালঘরের পাশে একটা চালা তুলে সেখানে রাখবো।
করমালি বাবাকে বললো, আমাগো অন খালি দুগা গাইগরু আছে। আর দুগা বলদ কিনেন হুজুর। আল চইবার সময় আর মাইনষের কাছে যঅন লাইগতো ন।
বাবা বললেন, সব হবে করমালি। মা ধরেছেন হাঁস-মুরগি পুষবেন। সবার আগে এর ব্যবস্থা করতে হবে।
আঁশ-মুরগি এই জায়গায় বালা হাইতেন ন। রামগড়ে খামার আছে। হেই জায়গাতুন চাঁটগার ইয়াছিন মুরগি আর খাকি আঁশ কিনে আনুম। হের আগে শক্ত করি খোয়াড় বানান লাইগবো। হিয়াল, বড়বাল (বনবেড়াল) জংলী কুত্তা ব্যাক আছে এই জঙ্গলে।
টুটুল বললো, ভালো দেখে একজোড়া কুকুর কিনতে হবে বাবা।
বাবা মৃদু হেসে বললেন, আগামী মাসে যখন ঢাকা যাব তখন কামালের কাছ থেকে নিয়ে আসবো। ওর অ্যালসেশিয়ান বাচ্চা দিয়েছে, দেখে এসেছি।
সেদিন ছিলো পূর্ণিমার রাত। চাঁদের আলোয় সব ভেসে যাচ্ছিলো। অনেক রাত অব্দি কাজ করলো টুটুলরা। রাতে ঘুমও হলো তেমনি।
পরদিন সকালে টুটুলের ঘুম ভাঙার আগেই বাবা করমালিকে নিয়ে গোলাবাড়ি চলে গেলেন। কাঠের মেঝেতে মিতুল-ঝুমার দাপাদাপিতে টুটুলের ঘুম ভাঙলো। তখনই শুনলো দিদা পাশের ঘরে মাকে বলছেন, বৌমা, ক্ষুদে শয়তান দুটোকে বাইরে পাঠিয়ে দাও তো। টুটুলটা কত রাত অব্দি কাজ করলো, ছোঁড়াটা কি শান্তিতে ঘুমাতেও পারবে না!
টুটুল ওর ঘর থেকে বললো, আমার ঘুম ভেঙে গেছে দিদা।
দিদা একটু অপ্রসন্ন গলায় বললেন, ঘুমই যদি ভেঙেছে–মটকা মেরে শুয়ে থাকা কেন? মাটা কতক্ষণ নাশতা আগলে বসে থাকবে!
দিদার বাঁকা কথা শুনেও টুটুল মনে মনে হাসলো। কে বলবে এই দিদাই একটু আগে ওর ঘুম নিয়ে চিন্তিত ছিলেন! উঠে পড়ে ঝটপট মুখহাত ধুয়ে নিলো। কমলছড়িতে আসার পর যে খাটুনি যাচ্ছে,সকাল-বিকাল ব্যায়াম করা বাদ দিয়েছে। তা ছাড়া দুপুরে পুকুরে আধঘণ্টা সাঁতার কেটেও কম ব্যায়াম হচ্ছে না।
কাল রাতে পুকুরে চার ফেলেছিলো। নাশতা খেয়েই টুটুল বড়শি নিয়ে বসলো। মার কথামতো মাঠ পরিষ্কারের কাজ আগের দিন শেষ হয়ে গেছে। বেড়ার কাজ একা ও পারবে না।
করমালি মিথ্যে বলে নি। তিন ঘণ্টার ভেতর আড়াই-তিনসেরি দুটো রুই আর গোটা তিরিশেক তেলাপিয়া ধরলো। রুই মাছের সাইজ ওর পছন্দ না হলেও তেলাপিয়াগুলো দেখার মতো। কোনোটাই এক বিঘতের কম নয়। আসলে তেলাপিয়ার উৎপাতে বড় মাছ কাছে আসতে পারছিলো না।
মাছ দেখে মিতুল আর ঝুমার সে কী উত্তেজনা! গত কদিন কেউ মাছের চেহারা দেখে নি। অন্য ঝামেলায় রান্নার কাজ মা একেবারেই সংক্ষেপ করে ফেলেছিলেন। দিদা একগাল হেসে বললেন, তোদের বংশে কেউ মেছো ছিলো বলে তো শুনি নি। এত মাছ কি করে ধরলি?
টুটুল বললো, তুমি বড়শি বাইলে এর চেয়ে বেশি পেতে দিদা।
দিদা ওর কথায় কান না দিয়ে মাকে বললেন, বৌমা, আদ্দেক তেলাপিয়া ভেজো, বাকি আদ্দেক শুধু সরষে বাটা, কাঁচা লঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে ঝোল বেঁধ্যে। আর কোনো মশলা দিও না। তাজা মাছ বেশ লাগবে খেতে। রুই মাছ ওবেলার জন্য থাক। তোমার বাপু মুড়িঘণ্ট ঠিক হয় না। ওটা আমি বেঁধে দেবো।
বাইরে বাবার গাড়ির হর্ন শোনা গেলো। মেজাজ ফুর্তিতে থাকলে বাবা দূর থেকে হর্ন দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেন যে তিনি আসছেন। সবাই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে বিদ্যুৎকে নামতে দেখে টুটুল দৌড়ে গেলো ওর কাছে।
বিদ্যুৎ যেদিন গোলাবাড়ি ফিরে গেছে সেদিনও বাড়ির কাঠামো দেখে বোঝা যায় নি শেষ পর্যন্ত কি দাঁড়াবে। অবাক হয়ে সে তাকিয়ে রইলো কাঠের বাড়িটার দিকে। হেডমাস্টার আর তার গিন্নির চোখেও বিস্ময় আর প্রশংসা। বিদ্যুৎ বললো, ঠিক ভিউ কার্ডের ছবির মতো মনে হচ্ছে, তাই না বাবা?
হেডমাস্টার প্রশংসার হাসিতে বললেন, ভালো বলেছিস। আমি আসলে কি বলবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
টুটুল বিদ্যুৎকে জড়িয়ে ধরে বললো, আমরা মানুষগুলো শুধু ভিউ কার্ডের মতো সুন্দর না।
বললেই হলো! বিদ্যুৎ নিচু গলায় বললো, আমাদের গোটা স্কুলে তোমার মতো হ্যাঁণ্ডসাম ছেলে পাওয়া যাবে না। আর মিতুল ঝুমাকে তো দুটো পুতুল মনে হয়।
টুটুল লজ্জা পেয়ে প্রসঙ্গ পাল্টালো ফণীর দেখা পেয়েছো?
না, এখনো আসে নি। বিদ্যুৎকে চিন্তিত মনে হলো–আমি চিঠি রেখে এসেছি। গিয়ে আবার খোঁজ নেবো। ওকে না পেলে মগদের চলে যাওয়ার রহস্যটা বোঝা যাচ্ছে না।
রহস্যের কি আছে? টুটুল স্বাভাবিক গলায় বললো, শান্তিবাহিনীর কেউ হয়তো ভয় দেখিয়েছে।
তুমি যতটা সহজ ভাবছো, ব্যাপারটা আমাদের কাছে তত সহজ মনে হচ্ছে না। এর একটা উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে। ফণী এলে সব জানা যাবে।
এদিকের জঙ্গলের কথা জানি না। তবে ফণীর কাছে শুনেছি, জঙ্গলের ভেতরে বেশ কিছু নিষিদ্ধ এলাকা আছে, যেখানে বাইরের লোক, বিশেষ করে বাঙালিদের ঢোকা বারণ। ঢুকলে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না।
টুটুল বিরক্ত হয়ে বললো, আসলেই মগের মুল্লুক।
দিদা ওদের চেঁচিয়ে বললেন, জানি তো সারা দিন তোমাদের কথা ফুরোবে না। দয়া করে চান করতে যাও। পুকুরে গেলেতো বাবুদের একঘণ্টার আগে আসা হয় না।
টুটুল বিদ্যুৎকে ওর ঘরে নিয়ে গেলো। বিদ্যুৎ বললো, তোমার বাবা যে কত বড় ইঞ্জিনিয়ার,এ বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। এত সামান্য জিনিস দিয়ে এত সুন্দর কিছু হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাসই হতো না।
টুটুল বললো, কাজ কিন্তু এখনো অনেক বাকি। জানালায় কাঁচের পাল্লা বসানো হবে।ভেতরে-বাইরে পেইন্ট করা হবে। শুধু বসার ঘরের ভেতরটা বাবা বার্নিশ করবেন বলেছেন। তা ছাড়া সামনে একটা রক গার্ডেনও হবে।
বিদ্যুৎকে নিয়ে টুটুল পুকুরে গেলো গোসল করতে। বিদ্যুৎ ভালো সাঁতার কাটতে পারে না। টুটুলের মতো স্বাস্থ্যও ওর ভালো নয়। টুটুল অবশ্য বলেছে, শরীরটা আরও মজবুত করতে হবে বিদ্যুৎ। রোজ ব্যায়াম করার অভ্যেস করো। আমার মতো হতে ছমাসও লাগবে না। তোমার বডি স্ট্রাকচার তো ভালো।
টুটুলের মাছ ধরার আগে দুপুরের জন্য মা শুধু ঘন মুগডাল, বেগুন ভাজি আর মুরগি রান্না করেছিলেন। তার সঙ্গে দিদার ফরমাশমতো টুটুলের ধরা তেলাপিয়ার দুরকমের রান্না দেখে হেডমাস্টার চোখ কপালে তুললেন–এ যে রীতিমতো রাজসিক ব্যাপার দেখছি! এত খাবো কি করে?
দিদা বললেন, ওভাবে বলছো কেন বাছা হেডমাস্টার? নতুন বাড়িতে ওঠা উপলক্ষ করে একদিন কি ভালো খাবে না? তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো, গত কদিন কী খেয়েছে।
খাওয়ার পর বাবা হেডমাস্টারকে বললেন, আপনারা এবার একটু বিশ্রাম নিন। করমালির বাড়ির সীমানায় বেড়া বাঁধছে। ওকে একটু সাহায্য করবো আমি।
হেডমাস্টার মাথা নাড়লেন–সেটি হচ্ছে না হাবিব সাহেব। বেড়া আমরাও বাঁধতে জানি। হাতে-কলমে করতে হয়, আপনার চেয়ে ভালোই বাঁধবো। চলুন, আমিও যাই।
বাবা অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, বুঝেছি, মার বকুনি খাওয়াবেন। মেহমানদের দাওয়াত করে এনে কাজ করিয়ে নিচ্ছি …।
বাবা কথা শেষ করতে পারলেন না, পাশের ঘর থেকে দিদা বেরিয়ে এলেন–কাকে দিয়ে তুই কাজ করিয়ে নিচ্ছিস হাবু?
বাবা অপ্রস্তুত হলেন–না মা, আমি করিয়ে নিচ্ছি না, উনি জোর করে করতে চাচ্ছেন।
হেডমাস্টার বিনয় করে বললেন, আপনিই বলুন না, আমি যদি আপনার ছেলের মতো হই, কাজ করতে চাওয়াটা অন্যায় কি না।
দিদা একগাল হাসলেন–আমার ছেলে হিসেবে যখন তোকে সাহায্য করতে চাইছে, তুই কেন বাধা দিচ্ছিস হাবু?
বাধা দিচ্ছি তো তোমার বকুনির ভয়ে।
শোন কথা! আমি বকতাম, ও আমার ছেলে না হয়ে মেহমান হলে। এই বলে দিদা হেডমাস্টারকে বললেন, যাও বাছা, কেউ তোমাকে বকবে না।
দিদার কথা শুনে মনে হলো হেডমাস্টার বুঝি মিতুলের বয়সী কেউ। বাবা আর হেডমাস্টার হাসতে-হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গে টুটুল আর বিদ্যুৎ। মিতুলও পিছু নিয়েছিলো। তুই ছোঁড়া কোথায় যাচ্ছিস? –বলে দিদা ওকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলেন।
করমালি চার হাত পরপর খুঁটি পুঁতে যাচ্ছিলো। টুটুলরা সেগুলোর ওপর মাটির সঙ্গে সমান্তরাল করে একটা ডাল বাঁধলো। দুই খুঁটোর মাঝখানে গুণ চিহ্নের মতো করে আরো দুটো ডাল বাঁধলো। বাবা বললেন, আপাতত এভাবেই বাঁধা যাক, পরে আড়াআড়ি আরো দুটো করে বাঁধবো। . ..
হেডমাস্টার বললেন, নারকেলের দড়ির বদলে নাইলনের দড়ি দিয়ে বাঁধলে আরো মজবুত হতো।
তা হতো। তবে এটা সাময়িক। করমালি বলছিলো মাঝে-মাঝে জংলী কুকুর এসে, যা অত্যাচার করে তার জন্য কাঁটা তারের বেড়া লাগবে। পাঁচ-ছমাস এ ব্যবস্থাই চলুক।
বেড়া বাঁধার কাজ শেষ করতে করতে সন্ধ্যে পেরিয়ে গেলো। মাঝখানে মা এসে সবাইকে চা আর নারকেল কোরা দিয়ে চিড়ে ভাজি খাইয়ে গেছেন। কাজ শেষ হলে টুটুল বললো, যাই বলো বাবা, বেড়াটা কিন্তু বাড়ির মতো সুন্দর হলো না।
আমি কি বলেছি? বাবা হাসলেন–সামনের বছর এই কাঠ দিয়েই বানিয়ে দেবো, দেখিস কেমন হয়।
গোলাবাড়ি থেকে বাবা কদিনের জন্য প্রচুর কাঁচা বাজার করে এনেছিলেন। মা রাতেও সেসব ধরলেন না। যেদিন শুনেছেন বাবার চাকরি নেই, তখনই ঠিক করেছিলেন সব কিছু হিসেব করে খরচ করবেন। সামান্য উপকরণ দিয়েও যে ভালো রান্না করা যায় এটা তাকে দিদার কাছ থেকে শিখতে হয়েছে। সেদিন রাতে টুটুলের ধরা রুই মাছ দিয়ে চার রকম রান্না করলেন। দিদা বেঁধেছেন মুড়িঘণ্ট। মা একপদ ভাজি করলেন, হাল্কা ঝোল রাঁধলেন. আর দোপেঁয়াজা করলেন। খেতে গিয়ে মনে হলো অমৃত। অন্তত হেডমাস্টার বারবার তাই বললেন।
খাওয়ার পর সবাই মাদুর পেতে মাঠে বসলো। আকাশ উজাড়-করা চাঁদের আলো জঙ্গলের গাছ বেয়ে, টুটুলদের কাঠের বাড়ির ছাদের ওপর দিয়ে গড়িয়ে সারা মাঠ ধুয়ে দিচ্ছিলো। বসন্ত ফুরিয়ে এলেও রাতের মৃদু বাতাসে তখনো আমেজ লেগে আছে। মাঝে-মাঝে সেই বাতাস বন থেকে স্বর্ণচাপার গন্ধ বয়ে আনছে। হেডমাস্টার তার গিন্নিকে বললেন, একটা গান গাও না শানু, টুটুলদের গৃহপ্রবেশ সেলিব্রেট করি!
বাবা-মা দুজন একসঙ্গে বললেন, চমৎকার হবে।
খালি গলায় কি ভালো লাগবে! লজ্জায় লাল হয়ে বললেন হেডমাস্টার-গিন্নি।
বিদ্যুৎ বললো, খালি গলায়ই গাও। তোমার খালি গলার গানও কম সুন্দর নয়।
একটু ইতস্তত করলেন হেডমাস্টার-গিন্নি। তারপর পরিষ্কার গলায় গাইলেন, চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙ্গেছে উছলে পড়ে আলো, ও রজনীগন্ধা তোমার গন্ধসুধা ঢালো।
পুরো গানটা খুব দরদ দিয়ে গাইলেন তিনি। সবাই অভিভূত হয়ে শুনলো। গান শেষ হবার পর বিদ্যুৎ আস্তে-আস্তে বললো, আরেকটা গাও না মা।..
হেডমাস্টার-গিন্নি টুটুলের বাবা-মার দিকে তাকলেন। তাঁদের চোখেও ছিলো অনুরোধের মিনতি। এবার তিনি গাইলেন, যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙ্গলো ঝড়ে। এবারও বিদ্যুৎ বললো, মা, আর শুধু দুটো গান। মৃদু হেসে ওর মা গাইলেন, পান্থ তুমি পান্থজনের সখা। শেষে গাইলেন আমায় বোলো না, গাহিতে বোলো না।
গান থামার পর দিদা ভারী গলায় বললেন, কি গান গাইলে বাছা, বুকের ভেতর কেমন করছে! মাঝে-মাঝে টেলিভিশনও তো দেখি। তোমার মতো এত দরদ দিয়ে গাইতে কাউকে দেখি নি।
বিদ্যুৎ বললো, মা আগে রেডিওতে গাইতেন।
হঠাৎ এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে গেলো। পশ্চিমের আকাশে বাবা তাকিয়ে দেখলেন মেঘের গায়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এদিকে তখনো পরিপূর্ণ জ্যোৎস্না। বাবা বললেন, ঘরে যাওয়া যাক। বৃষ্টি আসবে মনে হচ্ছে।
আরেক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস এলো বৃষ্টির বার্তা নিয়ে। টুটুলরা উঠে ঘরে গেলো, যদিও কারোই উঠতে ইচ্ছে করছিলো না।
বিছানায় শোয়ার একটু পরেই বৃষ্টি নামলো। টুটুলের জানালার ওপাশে বারান্দা থাকাতে বৃষ্টির ছাঁট ভেতরে আসতে পারলো না। ঠাণ্ডা বাতাসে গা জুড়িয়ে গেলো। চালের ওপর বৃষ্টির একটানা শব্দ শুনতে-শুনতে টুটুলের চোখ ঘুমে ভারী হয়ে এলো। বিদ্যুৎ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
তন্দ্রার ঘোরে হঠাৎ টুটুল বারান্দায় পায়ের শব্দ শুনলো। ততক্ষণে বৃষ্টি ধরে এসেছে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো অন্ধকার গাঢ় না হলেও চাঁদের আলো মেঘের ভেতর হারিয়ে গেছে। টুটুল জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। হেডমাস্টার কাকা কি বাইরে গেছেন? অন্য কেউও হতে পারে। এ বাড়িতে তো আর ঘরের সাথে লাগোয়া কোনো বাথরুম নেই। কাউকে বাথরুমে যেতে হলে বাইরে আসতে হবে। টুটুল চোখ বুজতে যাবে, ঠিক তখনি মনে হলো একটা ছায়ামূর্তি জানালার সামনে দিয়ে দ্রুত সরে গেলো। চোখ কচলে আবার তাকালো। কেউ কোথাও নেই। সাবধানে উঠে জানালার কাছে গেলো। চারপাশে তাকালো, হঠাৎ দেখলো সাদা মতো কি যেন একটা দ্রুত জঙ্গলের অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রইলো টুটুল। কোথাও আর কিছু দেখা গেলো না।
বিছানায় এসে শুয়ে-শুয়ে টুটুল ভাবলো কেউ একজন এসেছিলো উদ্দেশ্য কি আসার? ছিঁচকে চোর নয় তো? আবার মনে হলো, চোখের ভুলও হতে পারে। শেষ পর্যন্ত তাই মনে করে টুটুল ঘুমিয়ে পড়লো।
বিদ্যুতের ভোরে ওঠার অভ্যাস। ওর ডাকে টুটুলের ঘুম ভাঙলো। বিদ্যুৎ বললো, টুটুলদা ওঠো, কাকা তোমাকে ডাকছেন।
টুটুল উঠে বাবার ঘরে গেলো। বাবা বললেন, হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা খেয়ে আয় বিদ্যুৎকে নিয়ে। কথা আছে।
বসার ঘরের মেঝের ওপর সবাই মাদুর পেতে খেতে বসলো। বাবা এখনো ডাইনিং টেবিল বানান নি। বসার জায়গার পাশে ডাইনিং স্পেস রয়েছে।
আটা রুটি, ডিম আর আলু ভাজি দিয়ে ও নাশতা সারলো। নাশতার প্লেট সরিয়ে মা চা দিলেন সবাইকে। চা খেতে-খেতে বাবা বললেন, আজ ভোরে একটি চিঠি পেয়েছি।
হেডমাস্টার অবাক হয়ে বললেন, কার চিঠি? ভোরে কি করে চিঠি পেলেন?
কাষ্ঠ হেসে বাবা বললেন, চিঠি না বলে চরমপত্র বলা ভালো। আমাদের এক মাসের মধ্যে এ এলাকা ছেড়ে যেতে বলা হয়েছে।
হেডমাস্টারের মুখ শুকিয়ে গেলো। সেই সঙ্গে বিদ্যুতেরও। টুটুল অধৈর্য হয়ে বললো, চিঠিটা পড় না বাবা!
বাবা পকেট থেকে চিঠিটা বের করে পড়লেন, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, আপনি ভাবিয়াছেন চাকরি ছাড়িয়া এইখানে থাকার কথা বলিয়া সবাইকে ভুলাইতে পারিবেন। আমরা আপনার উদ্দেশ্য জানি। আপনাদের সরকারের পক্ষ হইতে গুপ্তচরগিরি করিবার জন্য আপনি এইখানে আসিয়াছেন। আমরা তাহা হইতে দিব না। আপনাকে আমরা দশ দিন সময় দিলাম। এই সময়ের ভিতর আমাদের এই এলাকা ছাড়িয়া চলিয়া না গেলে, আমাদের চরম শাস্তি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকিবেন। আপনার বংশধররাও রক্ষা পাইবে না। ইতি জনসংহতি সমিতি।
চিঠির ভাষা শুনে দিদা হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন–ও হাবু, কোথায় এলি বাপ! সবাইকে যে বেঘোরে মরতে হবে!
বাবা একটু বিরক্ত হলেন–আহ্ মা, থামো তো! জরুরি একটা আলোচনায় বসেছি–তুমি মড়াকান্না শুরু করলে!
হেডমাস্টার চিন্তিত গলায় বললেন, আমার সন্দেহ হচ্ছে হাবিব সাহেব। জনসংহতির কাজ আমি যতটা জানি, এ ধরনের চিঠি ওরা লিখবে না। ওরা বড় জোর চাঁদা চাইতে পারে।
দিদা কান্না চেপে বললেন, চাঁদা দেবো না বলেছি নাকি! ঢাকায় থাকতে পাড়া-বেপাড়ায় হাজারটা ফাংশানে চাঁদা দিই নি? ছোঁড়াগুলো সোজাসাপ্টা এসে চাইলেই তো পারে।
হেডমাস্টার বললেন, এরা ওরা নয় মা। চিঠি অন্য কেউ লিখেছে।
বাবা বললেন, মনে হচ্ছে আজেবাজে লোক ভয় দেখিয়ে আমাদের তাড়াতে চাইছে।
লাভটা কী? জানতে চাইলো টুটুল।
সেটাই তো ভাবছি, উদ্দেশ্যটা কী এ ধরনের চিঠি লেখার?
হেডমাস্টার বললেন, আমার স্কুলের দুজন টীচার আছেন শান্তিবাহিনীতে। ওদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারি।
মা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন। বললেন, হুমকি যারাই দিক, উদ্দেশ্য যাই হোক, তারা যে লোক ভালো নয় এটা তো বোঝা যায়। থানায় আর আর্মি ক্যাম্পে খবর দিয়ে রাখলে হয় না?
বাবা শক্ত গলায় বললেন, ওদের কারো সাহায্য চাইতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। তা ছাড়া ওর এখানে যা করছে, আমি নিজেও তা পছন্দ করি না।
হেডমাস্টার বললেন, আচ্ছা হাবিব সাহেব, চিঠিটা এখানে এলো কীভাবে বলুন তো!
ভোরবেলা বাইরের দরজা খুলতে যাবো, দেখি নিচে পড়ে আছে। রাতে নিশ্চয়ই কেউ এসে দিয়ে গেছে।
টুটুলের মনে হলো, রাতে ও যা দেখেছিলো সেটা মিথ্যে নয়। পায়ের শব্দ শোনা থেকে সাদা ছায়ামূর্তি বনের ভেতর মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত যা দেখেছে সব খুলে বললো।
হেডমাস্টার বললেন, এ ধরনের ছিঁচকে চোরের কাজ শান্তিবাহিনীর লোকেরা করবে না। ওরা কোনো চিঠি দিতে চাইলে দিনেই দেবে, রাতের অন্ধকারে নয়।
টুটুল বললো, আমাদের পাহারার জন্য ভালো জাতের কুকুর দরকার বাবা।
বাবা টুটুলকে বললেন, তোমাকে তো বলেছি, কামালের কাছ থেকে আনবো। আমি ভাবছি, আমাদের আরো একটা রাইফেল থাকা দরকার।
বাবা ঠিক করলেন, বেড়াটা আরো শক্ত আর উঁচু করে বাঁধতে হবে। হেডমাস্টারকে বললেন, এদিকে কাঁটাতারে কোথায় পাওয়া যায়?
খাগড়াছড়িতে পেতে পারেন। নাহলে সেই চিটাগাং।
ঠিক আছে, কাঁটাতার এনে আজ থেকেই কাজ শুরু করে দি। বেড়ার কাজ শেষ হলে দুদিনের জন্য ঢাকা গিয়ে বাকি ব্যবস্থা করে ফেলবো।
বাবার সাথে হেডমাস্টারও গেলেন খাগড়াছড়ি। টুটুল আর বিদ্যুৎ করমালির সাথে বেড়ার জন্য খুঁটি তৈরি করতে বসলো। মিতুল, ঝুমা অবশ্য এসব কিছুই জানে না। বড়িবি আর গরুর বাছুরের সাথে সারা দিন ছুটোছুটি করে কাটালো।
.
০৬. গভীর বনের অতিথি
বাবা আর হেডমাস্টারের ফিরতে রাত হয়ে গেলো। দুপুরের পর থেকেই দিদা তসবি জপা আর মানত করা শুরু করে দিয়েছিলেন। বার বার বলছিলেন, অ বৌমা, হাবুদের কি হলো! এ কোন দেশে এলাম! একটা টেলিফোন করে খবর নেববা তারও উপায় নেই।
মা অবশ্য বলেছেন, ওরা খাগড়াছড়িতে কাঁটাতার না পেলে চিটাগাং যাবে, বলেই তো গেছে মা। আর চিটাগাং থেকে ফিরতে তো রাত হবেই।
মা যতটা রাত হবে ভেবেছিলেন ততুটা অবশ্য হয় নি। বাবারা এলেন সাড়ে আটটার দিকে। ততক্ষণে দিদার মানত পাঁচসিকে থেকে আস্ত খাসিতে উঠেছে।
মা বললেন, আমি ভেবেছিলাম তোমাদের আরো রাত হবে।
বাবা বললেন, আমরা খাগড়াছড়ি না গিয়ে সোজা চিটাগাং গিয়েছিলাম। ওখানে ব্যাংকেও কিছু কাজ ছিলো।
চিটাগাং থেকে বাবা শুধু কাঁটাতারই আনেন নি–তিনটে শক্ত তালা, দুটো হ্যাঁজাক বাতি, একটা আট-ব্যাটারির বড় জাপানি টর্চ আর দশ বস্তা সিমেন্ট এনেছেন। বললেন, শুধু কাঠের খুঁটির বেড়া বেশি মজবুত হবে না, মাঝে-মাঝে কংক্রিটের পিলার দেবো।
টুটুল বললো, বাবা, একটা হ্যাঁজাক জ্বালাবো?
বাবা হাসলেন–জ্বালাবার জন্যই তো এনেছি।
বাবাকে হাসতে দেখে টুটুল সাহস ফিরে পেলো। সকালে বাবার মন খারাপ দেখে ও খুব চিন্তিত ছিলো। বিদ্যুৎকে বলেছে, জানো, বাবাকে নার্ভাস দেখলে আমি নিজেও ভীষণ নার্ভাস ফিল করি। উড়ো চিঠি পেয়ে প্রথম দিকে বাবা সত্যিই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন।
বিদ্যুৎ বলেছে, ঘাবড়াবারই তো কথা টুটুলদা। তবু দেখো তিনি থানাতেও গেলেন, আর্মি ক্যাম্পেও গেলেন না। নিজেই লড়বেন বলে ঠিক করেছেন। এ কি কম সাহসের কথা!
রাতে মা মুরগি রান্না করেছিলেন। খেয়ে উঠে বাবা বিদ্যুতের মাকে বললেন, বাইরে আজও চমৎকার জ্যোৎস্না ভাবী। কালকের মতো কিছু গান হলে মন্দ হতো না।
হেডমাস্টার-গিন্নি হেসে বললেন, ঘরেও কম জ্যোৎস্না নয়। হ্যাঁজাকের আলোয় মনে হচ্ছে একেবারে শহরে আছি।
টুটুল বললো, হ্যাঁজাক নিভিয়ে দিচ্ছি কাকিমা, বাইরে চলুন। রোজ তো আর আপনার গান শুনতে পাবো না।
বড়িবি বাইরে মাদুর বিছিয়ে দিলো। দিদা বললেন, মন-খারাপ-করা গান গেয়ো না বাছা। এমনিতেই মেজাজ ভালো নেই।
মৃদু হেসে হেডমাস্টার-গিন্নি গাইলেন–আমি ভয় করবো না ভয় করবো না।
টুটুলরা স্কুলে ক্লাস টুতে এ গান গাইতো। নিখিল স্যার সারা বছর দুটো গানই শিখিয়েছিলেন। এটা ছাড়া অন্যটা ছিলো, খরবায়ু বয় বেগে। হেডমাস্টার-গিন্নির সাথে টুটুলও গলা মেলালো। তিনি উৎসাহিত হয়ে বিদ্যুৎকেও ইশারা করলেন। বিদ্যুৎ কোরাসে গলা মেলালো। সেই সঙ্গে হেডমাস্টারও। পুরো গান সবাই দুবার গাইলো। গান শেষ হলে টুটুল বললো, এরকম গান হলে চলবে দিদা?
দিদা এক গাল হেসে বললেন, একটা গানে কি আর মন ভালো হয়! ওকে এবার একা গাইতে দাও বাছা। এটা তোমাদের পাড়ার ভ্যারাইটি শো নয়।
ঠিক আছে মা, একাই গাইছি। বলে হেডমাস্টার-গিন্নি গাইলেন, বসন্তে ফুল গাঁথলো আমার জয়ের মালা, বইলো প্রাণে দখিন হাওয়া, আগুন জ্বালা। এরপর তিনি দিদার ভালো লাগার জন্য পুরনো দিনের গান গাইলেন কয়েকটা। গান শেষ হলে দিদা তাকে আদর করে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, সত্যিই মা, মনটা জুড়িয়ে দিয়েছো তুমি। কত দিন এসব গান শুনি না!
পরদিন ভোরে উঠে, বাবা কংক্রিটের পিলার ঢালাই-এর কাজে লাগলেন। পাথর আর পাথরগুঁড়ো বালি টুটুলদের জমিতেই ছিলো। জানালার জন্য যে রড কেনা হয়েছিলো সেখানেও কিছু বেঁচে গিয়েছিলো। সিমেন্ট, বালি আর ছোট নুড়ি পানি মিশিয়ে পাতলা দু টুকরো কাঠ চার ইঞ্চি ফাঁক করে মাঝখানে লোহার রড দিয়ে বানানো মশলা ঢেলে দিলেন। নিচে সামান্য অ্যাঙ্গেল বের করলেন। বললেন, শুকোলে চমৎকার পিলার হবে।
বাবার সাথে ছেলেরা সবাই কাজে লেগেছিলো। একবেলার মধ্যেই আশিটি পিলার বানানো হলো। দুপুরে খাওয়া সেরে কাঠের বেড়ার সাথে কাঁটাতার বাঁধার কাজ অর্ধেক না সারতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।
পরদিন বাবা বললেন, আজ আর কোনো কাজ নয়। আজ আমরা শিকারে বেরুবো।
মা রসিকতা করে বললেন, আমরা তাহলে মশলাটশলা বেটে রেডি হয়ে থাকি।
বাবা একটু অপ্রস্তুত হলেন–এ বেলার রান্না সেরে রাখো। পেলে ও বেলা দেখা যাবে।
হেডমাস্টার, টুটুল আর বিদ্যুৎ বাবার সাথী হলো। করমালি যেতে চেয়েছিলো। দিদা বারণ করলেন না বাছা, তুমি থাকো। কথা বললে জানি আদ্দেক বুঝবো না, তবু পুরুষমানুষ তো!
করমালি হেসে বাবাকে সাবধান করে দিয়েছে–বেশি ভিতরে যাইয়েন ন, ইথ আরাই হালাইবেন।
টুটুলদের জমি থেকেই জঙ্গল শুরু হয়েছে। প্রথম দিকে গাছপালা একটু ফাঁকা-ফাঁকা, তারপর ঘন বন। নানা রকমের গাছের ভেতরে বেগুনি রং-এর ফুলে ভরা প্রচুর জারুল গাছ দেখতে পেলো টুটুল। চাপা তো আছেই। তবে বনমোরগের দেখা ওদের পেতে দু ঘণ্টা লাগলো। একসাথে বেশ কয়েকটা ছিলো। পরপর দুটোকে গুলী করে ফেলতেই বাকিগুলো গাছের ডাল থেকে ডালে উড়ে আরো গভীর বনে চলে গেলো। জঙ্গলের ভেতর বনমোরগ ছাড়া ওরা প্রচুর কাঠবেড়ালী আর খরগোশ দেখলো, আর দেখলো নানা রঙের প্রজাপতি। এমনকি বনের একটু গভীরে যেখানে রোদের আলো পৌঁছোয় না, উড়ন্ত কাঠবেড়ালী আর লেমুরের মতো সাদা-সাদা বানরের দেখা পেলো ওরা। টুটুল আর বিদ্যুৎ দুজনেরই মহাউত্তেজনা। হেডমাস্টার সবাইকে সাবধানে হাঁটতে বললেন। নাকি যে কোনো সময় গাছ থেকে ঝুলে থাকা সাপের ছোবল খেতে হতে পারে। একটা-দুটো অজগরের দেখা পাওয়াও নাকি বিচিত্র নয়।
এদিকের জঙ্গলের চেহারা দেখে মনে হয় কোনোকালে মানুষ ঢোকেনি। বিচিত্র ধরনের লতা বড়-বড় গাছ পেঁচিয়ে উঠে গেছে। কোথাও বুনো বেতের ঝোঁপ। কাঁটার খোঁচা কম-বেশি সবাই খেয়েছে। মশার কামড় তো লেগেই আছে। পুরনো গাছ থেকে লাল, হলুদ, বেগুনি আর সাদা রঙের ফুলওয়ালা কয়েকটা অর্কিড তুলে নিলো টুটুল। বললো, আমাদের করুই গাছে চমৎকার হবে।
বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর আরো এক ঝাঁক বনমোরগের দেখা পেলো ওরা। বাবা ঠিক করেছিলেন, খাবার জন্য বনমোরগ ছাড়া আর কিছু মারবেন না। এবার তিনটা পড়লো। টুটুল বললো, অনেক হয়েছে বাবা, ফিরে চলল। দেরি করলে আমার অর্কিডগুলো মরে যাবে।
হেডমাস্টার বললেন, শেকড়সুদ্ধ তুলেছে, দু-এক দিনে কিছু হবে না।
বিদ্যুৎ বললো, তবু যাওয়া দরকার, বারটা বাজতে আর দশ মিনিট।
ঘড়ি দেখার কথা এতক্ষণ কারো মনেই ছিলো না। বিদ্যুতের কথায় সবাই বাড়ির পথ ধরলো। বেশ কিছু দূর আসার পর একটা পাহাড়ী ঝরনা দেখে বাবাই প্রথম বললেন, আমরা তো এ পথে আসি নি! ঝরনাটা যে নতুন দেখছি!
হেডমাস্টার হেসে বললেন, জঙ্গলে পথ চিনতে আমার অসুবিধে হয় না, যদি মাথার ওপর সূর্য থাকে। এটা শর্টকাট রাস্তা।
ভিন্ন পথে ফিরতে গিয়েই অচেনা এক যুবকের দেখা পেলো ওরা একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে। গাছে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসেছিলো ক্লান্ত ভঙ্গিতে।
পরনে প্যান্ট আর শার্ট–তিন জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। সমতলের ছেলে, বয়স তেইশ-চব্বিশের বেশি হবে না, দেখে ছাত্র মনে হয়। ধারালো চেহারা, মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। গায়ের রং এককালে ফর্সা ছিলো–রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে।
বাবা প্রথম দেখতে পেয়ে ওদের থামালেন। ইশারায় ওদের দেখালেন। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো আর্মি ক্যাম্প আছে কি না। নিশ্চিত হয়ে এগিয়ে গেলো।
পাতার ওপর কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ শুনে চমকে তাকালো সেই যুবক। দু চোখে ভয়ের ছায়া। বাবা বললেন, ভয় নেই। তুমি কে?
যুবকটি তাকিয়ে দেখলো। দুজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক আর দুজন কিশোর। একজনের হাতে বন্দুক আর ছেলে দুটোর হাতে ঝোলানো বনমোরগ দেখে বুঝলো এরা শিকারে বেরিয়েছে। হঠাৎ মনে হলো এরা আর্মি ক্যাম্পের কেউ নয়তো? সচকিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো–আপনারা কারা?
বাবা শান্ত গলায় বললেন, বলেছি তো আমাদের দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ইনি গোলাবাড়ি স্কুলের হেডমাস্টার, আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার, চাকরি ছেড়ে কমলছড়িতে অবসর জীবন কাটাচ্ছি। এরা আমাদের ছেলে বিদ্যুৎ আর টুটুল। এবার তোমার পরিচয় বলো। এখানে এলে কীভাবে?
এখানে কীভাবে এলো ভাবতে গিয়ে স্নান এক টুকরো হাসির রেখা ফুটে উঠলো যুবকের ঠোঁটের ফাঁকে। নিজের কি পরিচয় দেবে এদের? সত্যি কথা বলা কি উচিত হবে?
হেডমাস্টার বললেন, আমার অনুমান যদি মিথ্যে না হয় তুমি সিরাজ সিকদার না হলে আবদুল হকের দলের ছেলে। ওদের কিছু ছেলেকে আমি চিনি।
চোখ তুলে তাকালো যুবক। আস্তে-আস্তে বললো, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন। আমি সর্বহারা পার্টির কর্মী। আমার নাম আসিফ।
তুমি এখানে এলে কীভাবে?
কোনো বিপদে পড়ে নি তো?
কোথাও জখমটখম হয়েছে নাকি?
পরপর প্রশ্ন করলেন বাবা আর হেডমাস্টার। আসিফ নামের যুবকটি এবার বিদ্যুৎ আর টুটুলের দিকে তাকালো। একটু ইতস্তত করে বললো, একটা পুলিশ ফাঁড়ি অ্যাটাক করতে গিয়ে আমরা ট্রাপে পড়ে গিয়েছিলাম। আমরা তিনজন ছিলাম। দুজন আর্মির গুলিতে মারা গেছে। আমি কোনোরকমে পালিয়েছি। আমার পায়েও গুলি লেগেছে।
কখন গুলি খেয়েছো?
শেষ রাতে!
হাঁটতে পারবে?
এক পা হাঁটতে গিয়ে যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেলো আসিফের মুখ। বললো, সকাল থেকে এ পর্যন্ত হেঁটেছি। এখানে এসে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম।
বাবা বললেন, আমার বাড়ি বেশি দূর নয়। তুমি কি আসবে আমাদের সাথে?
আসিফ শক্তভাবে বললো, না।
হেডমাস্টার বললেন, তুমি আপত্তি করো না বাবা। তোমার চিকিৎসা দরকার। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বাসায় তুমি নিরাপদে থাকবে। কাউকে খবর পাঠাতে হলে আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারবো।
বিষণ্ণ গলায় আসিফ বললো, আমার জন্য আপনাদের বিপদ হতে পারে।
এবার বাবা দৃঢ় গলায় বললেন, ওসব বিপদকে আমি পরোয়া করি না আসিফ। তুমি নিঃসঙ্কোচে আসতে পারো।
গভীর কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে আসিফ বাবার মুখের দিকে তাকালো। বাবা হাত বাড়িয়ে দিলেন। সেই হাত ধরে আসিফের মনে হলো নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে সে। হেডমাস্টার আর বাবা দুপাশ থেকে ওকে ধরলেন। আহত পায়ে যেন ব্যাথা না লাগে এমনভাবে এঁদের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটতে লাগলো। হেডমাস্টার বাবাকে বললেন, শর্টকাটের এই রাস্তাটা না ধরলে আসিফের সঙ্গে দেখাই হতো না।
টুটুল বললো, আপনি আমাদের বন্দুকের শব্দ শুনেছিলেন আসিফ ভাই?
ম্লান হেসে মাথা নাড়লো আসিফ, বললো, শুনে আরও ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। বাবা বললেন, টুটুল, এখন কোনো কথা নয়, আসিফের শরীর ভীষণ দুর্বল।
বাড়িতে আসার পর মা নিজ হাতে আসিফের পায়ে ড্রেসিং করে দিলেন। বাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন ডাক্তার ডাকতে হবে কি না। মা বারণ করলেন। গুলী ভেতরে ঢোকে নি, চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে। টুটুলের ঘরেই বিছানা পাতা হলো। ওর কাপড়ও দিব্যি লেগে গেলো আসিফের গায়ে। টুটুলের কথায় আসিফ বাবার রেজার দিয়ে দাড়ি কামালো। টুটুল বললো, এবার আপনাকে দারুণ হ্যাঁণ্ডসাম আর ম্যানলি লাগছে আসিফ ভাই।
আসিফ মৃদু হেসে বললো, ধন্যবাদ টুটুল, তবে আমাদের জন্য এটা কম্পলিমেন্ট নয়।
আসিফের জন্য এক গ্লাস দুধ আর দুটো মুরগির ডিম হাফ বয়েল করে আনলেন মা। মৃদু অভিযোগের গলায় টুটুলকে বললেন, ওকে একটু বিশ্রাম নিতে দাও টুটুল।
বিদ্যুৎকে নিয়ে টুটুল পুকুরে গেলো। বিদ্যুৎ বললো, দারুণ সাহস দেখিয়েছেন তোমার বাবা! একজন ফেরারিকে এভাবে শেল্টার দেয়া কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
টুটুলও বাবার কথাই ভাবছিলো। আস্তে-আস্তে বললো, বাবার জন্য এটা কোনো সাহসের ব্যাপার নয়।
দুপুরে খাওয়ার সময় বাবা বললেন, বাইরের কেউ অবশ্য এখানে আসবে না। তবু সবাই শুনে রাখো, আসিফের কথা কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, ও আমাদের বড় ছেলে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পল সায়েন্সের ছাত্র। আমরা এখানে একেবারে নতুন। কারো নিশ্চয়ই জানার কথা নয় আমার কয় ছেলে। মা বুঝলে তো, এ তোমার বড় নাতি।
শুনে দিদা ফোঁঁত-ফোঁত্ করে কেঁদে বললেন, বুঝবো না কেন হাবু! জানুর বড় খোকা বেঁচে থাকলে যে এমনটি হতো।
টুটুলের জানু ফুপির বড় ছেলেটি দেড় বছর বয়সে টাইফয়েড হয়ে মারা গিয়েছিলো। এরপর বহু বছর জানু ফুপির ছেলেমেয়ে হয় নি। সেই কথা ভেবে দিদা কাঁদতে বসলেন।
আসিফ মাথা নিচু করে খাচ্ছিলো। স্নেহপরায়ণ এই পরিবারটির জন্য গভীর ভালবাসায় ওর বুকটা ভরে গেলো। মা ওর পাতে মাংস তুলে দিয়ে বললেন, তুমি কিছুই খাচ্ছো না আসিফ।
টুটুল হাসতে-হাসতে বিদ্যুৎকে বললো, আমার আর মনোপলি থাকলো না বিদ্যুৎ।
দিদা বিরক্ত হয়ে বললেন, ভারি হিংসুটে হয়েছিস তো তুই! কতদিন ছেলেটার ঠিকমতো নাওয়া-খাওয়া জোটে নি কে জানে!
মিতুল আর ঝুমা আগে খেয়ে নিয়েছিলো। খাওয়া শেষ করে টুটুল আসিফকে নিয়ে ওর ঘরে এলো। পেছন-পেছন মিতুল আর ঝুমাও ঢুকলো। মিতুল অবাক হয়ে বললো, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে বড়দা?
বড়দা কিরে! অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো টুটুল।
আসিফ ঝুমাকে আদর করে নি বলে ও গাল ফুলিয়েছিলো। বললো, মা বলেছে ও বড়দা!
আসিফ ঝুমার গলায় অভিমান আঁচ পেয়ে আদর করে কাছে এনে বসালো। বললো, আমি যে হলে থেকে পড়াশোনা করতাম মিতুল।
বডিবি এসে–তোমাদের নিদ যাবার টাইম হোয়েছে। হামি কতো বোসে থাকবো –বলে জোর করে মিতুল-ঝুমাকে নিয়ে গেলো।
টুটুল মুখ টিপে হাসলো–আমাকেও তাহলে বড়দা বলে ডাকতে হবে, তাই না?
আসিফ কোনো কথা না বলে শুধু হাসলো। বাইরে থেকে বাবা ডাকলেন, টুটুল, বেড়ার কাজ এখনো শেষ হয় নি। আমি আর তোর কাকু যাচ্ছি।
টুটুল অসহায় ভঙ্গিতে বিদ্যুৎকে বললো, বাবা আমাদের কিছুতেই বড়দার সঙ্গে কথা বলতে দেবেন না। চলো বিদ্যুৎ! আর বড়দা, ভালো করে ঘুমিয়ে নাও। রাতে কিন্তু তোমাকে ছাড়ছি না।
আসিফকে ঘুমোনোর কথা বলে টুটুলরা চলে গেলেও ওর তখনি ঘুম এলো না, যদিও গত দুরাত সে এক ফোঁটাও ঘুমোয় নি। তারেক আর অনুপমের সঙ্গে কাল রাতে অ্যাকশনে যাবার পথে আসিফ বলেছিলো, কালও ঘুমোই নি, আজ রাতের ঘুমও গেছে। ভোরে ডেনে ফিরে সারা দিন ঘুমোবো। অনুপম হেসে বলেছিলো, আমরা নিশ্চয়ই জেগে মাছি তাড়াবো না! তারেক বলেছিলেন, একবার বাড়ি যেতে হবে। খবর পেয়েছি মার ভীষণ অসুখ। আমাকে দেখতে চেয়েছেন। ভাবছি কালই রওনা হবো। করিম ভাইকে বলে রেখেছি। অনুপম বললো, বাড়ি আমাকেও যেতে হবে তারেক। তবে কাল না ঘুমালে আমি পাথর হয়ে যাবো।
আসিফদের দুই কমরেডের কোনো দিন আর বাড়ি ফেরা হবে না। চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে গেছে ওরা। পার্টিতে জয়েন করেছে দুবছরও হয় নি। দুজনই বরিশালের মেডিক্যাল কলেজে থার্ড ইয়ারে পড়তো। এখনো পুরোপুরি আণ্ডারগ্রাউণ্ড হয় নি। তবে হওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিলো। প্রাণবন্ত এই বন্ধু দুটিকে আসিফের খুব ভালো লাগতো। ওরা এসেছিলো ওদের এলাকার রিপোের্ট করতে। গ্রুপ লীডার করিম ভাই দুদিন আগে যখন বললেন, এসেছো যখন অ্যাকশনের কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়ে যাও। শুনে ওরা দারুণ উৎসাহ দেখিয়েছিলো। আসিফের কাছ থেকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছিলো ফাঁড়ি আক্রমণের ধরনটা কীরকম হবে।
নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হলো আসিফের। যদিও এর জন্য দায়ী যে রেকি করতে এসেছিলো সে। তবু আসিফের মনে হলো, ওদের দুজনকে এভাবে না আনলেও চলতো। করিম ভাইকে সে বলেও ছিলো। করিম ভাই বললেন, এ তো ছোট্ট একটা অপারেশন! ফাঁড়িতে পুলিশের ভেতর আমাদের লোক রয়েছে। দশ-বারো জন পুলিশ ওদের পক্ষে সামলানো কিছুই নয়। জানো তো কীরকম ভিতুর ডিম এই পুলিশগুলো। করিম ভাইর ধারণাকে মিথ্যে করে দিয়ে পুলিশের সেই লোকই বিট্রে করে আর্মি ক্যাম্পে খবর দিয়েছে।
পায়ে আবার টনটনে ব্যথা অনুভব করলো আসিফ। তিন ঘণ্টা আগে ড্রেসিং শেষ করে টুটুলের মা দুটো পেইন কিলার ট্যাবলেট দিয়েছিলেন। এতক্ষণ ব্যথা ছিলো না। এখন আবার ব্যথা লাগছে। উঠে আরেকটা ট্যাবলেট খেলো। এই পরিবারটির কথা টুটুল দুপুরে খাবার আগে কিছুটা বলেছে। ওরা কেন এখানে থাকতে এসেছে, কীভাবে হেডমাস্টারের পরিবারের সঙ্গে ওদের আলাপ–এইসব। হেডমাস্টার পার্টির অনেক খোঁজখবর রাখেন। মনে হয় কাগজপত্র পান। অচেনা এক জায়গায় দয়ালু এই মানুষদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায় আসিফের মন ভরে গেলো।
সন্ধ্যেবেলা টুটুলদের জন্য চা পাঠিয়ে দিয়ে আসিফের জন্য দুধ আনলেন মা। আসিফ তখন ঘুমোচ্ছিলো। মা ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বর এসেছে কি না। এই অবস্থায় জ্বর আসা মানে ইনফেকশন হওয়া। কপালে নরম হাতের স্পর্শে আসিফের ঘুম ভাঙলো। মা বললেন, দুধটুকু খেয়ে নাও বাবা।
আসিফ উঠে বসে মৃদু হেসে বললো, দুধের বদলে চা পেলে বেশি ভালো লাগতো মা।
ঠিক তখনই দিদা এসে ঘরে ঢুকলেন–তোমারও বুঝি চায়ের বাতিক বাছা! না বৌমা, লাই দিও না। ও দুধ খাবে। গুলী খেয়ে কম রক্ত বেরোয় নি। এই বলে দিদা চলে গেলেন।
মা হেসে বললেন, ওঁর কথায় কিছু মনে কোরো না আসিফ। নিজের ছেলের চা খাওয়াও উনি পছন্দ করেন না। তুমি এখন দুধটা খেয়ে টুটুলদের কাজের জায়গায় ঘুরে এসো। আমি মাকে লুকিয়ে চা পাঠিয়ে দেবো।
আসিফকে দেখে হইচই করে উঠলো টুটুল–পাটা তাড়াতাড়ি ভালো করে নাও বড়দা, অনেক কাজ পড়ে আছে।
করমালি বললো, বদ্দারে দেইখলে মনে অয় মিন্নত কইরবার ওইব্যাস নাই।
টুটুল বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, মিন্নত কি বাবা?
বাবা হেসে বললেন, মেহনত।
আসিফ লজ্জা পেলো। ওর অবশ্য টুটুলের মতো ব্যায়াম-করা পেটা শরীর নয়, তার মানে এই নয় যে, ও কাজ করতে পারবে না। বললো, করমালি কথাটা ঠিক বলে নি টুটুল। কাল থেকে আমি কাজে লাগবো।
একটু পরে মা শুধু আসিফের জন্য চা আনলেন, টুটুল গম্ভীর হওয়ার ভান করে বললো, এ নিয়ে ককাপ হলো বড়দা?
ওর কথার ধরন দেখে হেসে ফেললো আসিফ–ঘরে দিদা থাকতে তুমি কি করে আশা করো এক কাপের বেশি চা জুটবে!
ধারেকাছে রেস্টুরেন্টও নেই যে, খেয়ে আসবে। জানো বড়দা, ঢাকায় থাকতে আমি, বাবা আর মা দিদাকে লুকিয়ে রেস্টুরেন্টে গিয়ে চা খেতাম।
কাজের ফাঁকে-ফাঁকে ছেলে দুটোর কথা শুনে বাবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আসিফ ওদের পরিবারের সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পেরেছে দেখে মনে-মনে তিনি ভীষণ খুশি হলেন। মানুষের চেহারা দেখে তিনি বুঝতে পারেন কে সৎ আর কে সৎ নয়। আসিফকে প্রথম দেখেই তার মনে হয়েছিলো ভীষণ তেজী আর আদর্শবাদী ছেলে। টুটুলকে তিনি এভাবেই মানুষ করতে চান।