হান্নান গালে বসে থাকা একটা মশাকে থাবা দিয়ে মেরে চটকে ফেলল, জায়গাটা অন্ধকার বলে দেখতে পেল না মশাটা তার রক্ত খেয়ে পুরুষ্ট হয়েছিল, গালে সেই রক্তের দাগ লেগেছে। হান্নানের শরীরে অনুভূতি সেরকম তীক্ষ্ণ নয়, মশা কামড়ালে প্রায় সময়েই টের পায় না; গালের চামড়া নরম বলে মাঝে মাঝে বুঝতে পারে। হান্নান একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আছে গত আধঘণ্টা থেকে, আরো কতক্ষণ বসে থাকতে হবে জানে না। তাকে সাড়ে তিন হাজার টাকার চুক্তিতে ঠিক করা হয়েছে রমিজ মাস্টারকে খুন করার জন্য। রমিজ মাস্টার রাত্রিবেলা বাজারে চায়ের দোকানে চা খেতে যায়, সেখানে একটা ছোট টেলিভিশন আছে, টেলিভিশনে বাংলা খবর শুনে বাড়িতে ফিরে আসে। মোটামুটি রুটিনমাফিক–কাজেই হান্নানের সুবিধে হল। একজন মানুষকে নিরিবিলি পাওয়াটাই কঠিন, খুন করাটা পানির মতো সোজা। আজকাল হান্নানের একটা গুলিতেই কাজ হয়ে যায়। সে অবশ্য তবু আরো দুইটা গুলি খরচ করে। গুলির দাম আছে বাজে খরচ করা ঠিক না। রিভলবারটা অবশ্য তার নিজের, অনেক কষ্ট করে যোগাড় করেছে। হান্নান এক ধরনের স্নেহ নিয়ে কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবারটার গায়ে হাত বুলিয়ে দেখল, চাইনিজ রিভলবার খুব বিশ্বস্ত জিনিস, তার রুজি–রোজগারের এক নম্বর অবলম্বন। এই লাইনে কাজ অনেক বেড়েছে কিন্তু উপার্জন সেরকম বাড়ে নি। আগে হলে এই রকম একটা খুন করার জন্য সে চোখ বুজে দশ হাজার টাকা চাইতে পারত, এখন পুঁচকে পুঁচকে মস্তানে দেশ ভরে গেছে। দুই শ টাকাতেই কাজ সেরে ফেলতে চায়–অভিজ্ঞতা নাই, লোভ বেশি। তবে নূতন মস্তানরা কাজকর্ম গুছিয়ে করতে পারে না বলে লোকজন এখনো তার কাছে আসে। আগে। বেশিরভাগ কেস ছিল জমি নিয়ে শত্রুতা, আজকাল সেটা হয়েছে রাজনীতি। রমিজ মাস্টারও রাজনীতির কেস–মনে হয় ইউনিয়ন ইলেকশনের ব্যাপার, হান্নান অবশ্য মাথা ঘামায় না, তার টাকা পেলেই হল!
হান্নান পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে এদিক–সেদিক তাকিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। হাত দিয়ে সিগারেটের আগুন ঢেকে সে একটা লম্বা টান দিল, সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে, রমিজ মাস্টার দশ–পনের মিনিটের মাঝেই এসে যাবে। হান্নান নিজের ভিতরে কোনো উত্তেজনা অনুভব করে না। মানুষ তো আর সারা জীবন বেঁচে থাকে না, আগে হোক পরে হোক মারা যাবেই। গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়, রোগশোকে মারা যায় না হয় তার হাতেই মারা গেল। হান্নান আজকাল আর ঠিক করে হিসাব রাখে না– তার হাতে কত জন মারা গেল। হিসাব রেখে কী হবে?
গলায় বসে থাকা পুরুষ্ট আরো একটা মশাকে থাবা দিয়ে চটকে দিতেই হান্নানের মনে হল সে কারো পায়ের শব্দ শুনতে পেল। হান্নান সিগারেটটা হাতে আড়াল করে রেখে উঠে দাঁড়াল, ডান হাতে কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবারটা বের করে নেয়। রমিজ মাস্টার কি না সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি, ভুলে অন্য কাউকে খুন করে ফেলা মানে অহেতুক কয়টা গুলি খরচ। আজকাল গুলির অনেক দাম।
একজন মানুষ লম্বা পা ফেলে হেঁটে আসছে, হান্নান রমিজ মাস্টারকে কয়েকদিন থেকে লক্ষ করে আসছে, সে প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে গেল যে এটাই রমিজ মাস্টার। কাছাকাছি এলে একবার জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাবে। হান্নান সিগারেটটা ফেলে দিল। গুলি করার সময় রিভলবারটা দুই হাতে ধরলে নিশানা ভালো হয়।
রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে থাকা হান্নানকে দেখে রমিজ মাস্টার যেরকম অবাক হবে ভেবেছিল সে কিন্তু সেরকম অবাক হল না। বেশ সহজ গলাতে বলল, কে? মাকসুদ আলী নাকি?
না। আমার নাম হান্নান।
ও।
আপনি কি রমিজ মাস্টার?
জি। আমি রমিজ মাস্টার। কেন?
হান্নান তখন দুই হাতে রিভলবারটা ধরে উঁচু করল। এ রকম সময় মানুষ ভয় পেয়ে দৌড় দেয়, তখন নিশানা ঠিক করে গুলি করতে হয়। যারা এই লাইনে নতুন তারা শরীরে গুলি করে, শরীর বড় তাই গুলি করা সোজা। কিন্তু শরীরে গুলি করলে মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি নেই, মাথায় গুলি লাগাতে পারলে এক শ ভাগ গ্যারান্টি। মানুষের শরীরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে মাথা।
রমিজ মাস্টার কিন্তু দৌড় দিল না, অবাক হয়ে হান্নানের দিকে তাকাল। হান্নান ট্রিগার টানতে গিয়ে থেমে গেল কারণ রমিজ মাস্টার আসলে হান্নানের দিকে তাকায় নি, হান্নানের। পিছন দিকে তাকিয়েছে। সেখানে কিছু একটা দেখে সে খুব অবাক হয়েছে। হান্নান খসখস করে কিছু একটা শব্দ শুনল, শব্দটা ভালো না। এই প্রথমবার তার বুকের মাঝে ধক করে। উঠল–এতদিন ধরে সে এই লাইনে কাজ করে আসছে কখনো এ রকম কিছু হয় নাই। রিভলবারটা দুই হাতে ধরে রেখে সে পিছনে ফিরে তাকাল এবং হঠাৎ করে তার সমস্ত শরীর পাথরের মতো জমে গেল।
তার থেকে চার–পাঁচ হাত দূরে বিচিত্র একটা মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, মূর্তিটি মানুষের না দানবের বোঝা যায় না। মূর্তিটির হাত পা মাথা নাক চোখ মুখ সবকিছুই আছে, কাজেই নিশ্চয়ই মানুষই হবে, কিন্তু দেখে মানুষ মনে হয় না। শরীরটি ধাতব, চোখ দুটি থেকে লাল আলো বের হচ্ছে। মাথাটুকু কেমন যেন ফুলে গিয়েছে, তার ভিতর থেকে কিলবিলে এক ধরনের অনেকগুলো ঔড় বের হয়ে এসেছে; সেগুলো আস্তে আস্তে নড়ছে। একটা হাত কাটা, সেখান থেকে এক ধরনের যন্ত্রপাতি বের হয়ে এসেছে। হান্নান আতঙ্কে চিৎকার করে বলল, কে? কে এটা?
সেই বিচিত্র মূর্তি কোনো শব্দ করল না, হান্নানের দিকে এক পা এগিয়ে এল। হান্নান তখন লক্ষ করল মূর্তিটির শরীরের ভিতরে কিছু একটা নড়ছে এবং গলার কাছাকাছি এসে হঠাৎ করে চামড়া ফুটো করে জীবন্ত কিছু বের হয়ে এল। প্রাণীটি একটা সরীসৃপের আকারের, কিন্তু পৃথিবীর কোনো পরিচিত প্রাণীর সাথে তার মিল নেই।
রাতজাগা পাখির মতো কর্কশ শব্দ করে সেই জীবন্ত প্রাণীটি ক্ষিপ্র পশুর মতো হান্নানের ওপর লাফিয়ে পড়ল। হান্নান তার রিভলবার দিয়ে প্রাণীটাকে গুলি করে, বুলেটের আঘাতে সেটি থমকে দাঁড়ায় কিন্তু থেমে যায় না। প্রাণীটি হান্নানের বুকের ওপর চেপে বসে এবং কিছু বোঝার আগেই তার শরীর ফুটো করে ভিতরে ঢুকে যেতে শুরু করে। প্রচণ্ড আতঙ্কে হান্নান চিৎকার করতে থাকে কিন্তু কেউ তার চিৎকার শুনে এগিয়ে আসে না।
রমিজ মাস্টার হঠাৎ করে সংবিৎ ফিরে পেল। সে ভয় পেয়ে পিছনে দুই পা সরে আসে তারপর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে। হান্নানের চিৎকার ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হতে থাকে, কিন্তু রমিজ মাস্টার তবুও থামার সাহস পায় না।
.
ক্যাপ্টেন মারুফ জিপ থেকে নেমে তার সাথে আসা মিলিটারি জওয়ানদের রাস্তাটি ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলল। একটু আগে তার কাছে নির্দেশ এসেছে এই এলাকাটা ঘিরে ফেলতে। এখানে একটা খুব খারাপ ভাইরাসের আউটব্রেক হয়েছে, সব মানুষকে সরিয়ে নিতে হবে। তার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, যতক্ষণ পুরোপুরি কাজ শুরু করা না হয় তাকে এই এলাকাটি চোখে চোখে রাখতে বলা হয়েছে। ভাইরাসটি এবোলা ভাইরাসের মতো, তবে সংক্রমণ শুরু হয় মস্তিষ্ক থেকে। যাদের সংক্রমণ হয় তারা এক ধরনের আতঙ্কে অস্থির হয়ে যায়, ভূত দানব দেখেছে বলে দাবি করতে থাকে। ক্যাপ্টেন মারুফকে বিশেষ করে বলে দেওয়া হয়েছে সেরকম মানুষ দেখলে তাকে যেন আলাদা করে আটকে রাখা হয়।
ক্যাপ্টেন মারুফ তার নির্দেশমতো রাতের অন্ধকারে রাস্তাটি ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সে কিছু হিসাব মিলাতে পারছে না। সে বইপত্র পড়ে, এবোলা ভাইরাস নিয়েও পড়াশোনা করেছে–এই ভাইরাসের সংক্রমণ হলে মানুষের মস্তিষ্ক থেকে সংক্রমণ হয় না। পুরো শরীরে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যায়। এবোলা ভাইরাস আফ্রিকায় শুরু হয়েছে, বাংলাদেশে নয়। তা ছাড়া ভাইরাসের সংক্রমণ হলে খবরের কাগজে তার খবর ছাপা হত, এখানকার। হাসপাতালে রোগী যেত, ডাক্তারেরা বলত কিন্তু সেরকম কিছু হয় নি। সামরিক বাহিনী হিসেবে তারা আলাদা থাকে কিন্তু এখন হঠাৎ মনে হচ্ছে কিছু বিদেশী এই পুরো ব্যাপারটি নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমেরিকার বড় বড় কিছু হারকিউলেস পরিবহন বিমান এসেছে ভিতর থেকে বিদঘুঁটে হেলিকপ্টার নামানো হচ্ছে। বিচিত্র যন্ত্রপাতি নিয়ে আসা হচ্ছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্য আমেরিকার মানুষের এত দরদ কেন? আগে তো কখনো হয় নি।
ক্যাপ্টেন মারুফ অন্যমনস্কভাবে হেঁটে একটু সামনে এগিয়ে যায়, ঠিক তখন দেখতে পায় একজন মানুষ পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে আসছে। দুই জন জওয়ান মানুষটিকে থামানোর জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল, ক্যাপ্টেন মারুফ হাত তুলে তাদের থামাল।
রমিজ মাস্টার ছুটতে ছুটতে ক্যাপ্টেন মারুফের কাছে এসে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে কিন্তু সে এত ভয় পেয়েছে এবং ছুটে এসে এমনভাবে হাঁপিয়ে উঠেছে যে তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয় না। ক্যাপ্টেন মারুফ ভুরু কুঁচকে বলল, কী হয়েছে আপনার?
রমিজ মাস্টার একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, স্যার, ঐখানে একটা দানব। একটা রাক্ষস।
রাক্ষস?
জি স্যার। শরীরের ভিতর থেকে একটা জন্তু বের হয়ে এসে একজন মানুষের শরীরে ঢুকে গেছে। মানুষটাকে মেরে ফেলছে স্যার আপনারা তাড়াতাড়ি যান।
মেরে ফেলছে?
জি স্যার। আপনি চিন্তা করতে পারবেন না কী ভয়ানক। রমিজ মাষ্টার প্রচণ্ড আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকে। ক্যাপ্টেন মারুফ রমিজ মাস্টারের দিকে খানিকটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে, তাকে উপর থেকে বলা হয়েছে ভাইরাসটি মস্তিষ্ককে আক্রান্ত করে, যারা আক্রান্ত হয় তারা অমানুষিক ভয় পেয়ে বিচিত্র কথা বলতে শুরু করে, এই মানুষটির ঠিক তাই হচ্ছে, নিশ্চয়ই সেই বিচিত্র ভাইরাসের কারণে। ক্যাপ্টেন মারুফ মানুষটির দিকে তাকিয়ে তবু পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারে না, তার কেন জানি মনে হতে থাকে মানুষের এই ভয়টি মস্তিষ্কের রোগ নয়। মনে হয় এটি সত্যি।
রমিজ মাস্টার ক্যাপ্টেন মারুফের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আপনারা যাবেন না? দেখতে যাবেন না? লোকটাকে বাঁচাতে যাবেন না?
ক্যাপ্টেন মারুফ প্রশ্নটি এড়িয়ে গিয়ে বলল, বাপ্যারটা আগে আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে। আপনি এখন আমাদের ঐ ভ্যানটার পিছনে গিয়ে বসেন।
জি না। আমি বসব না। আমার বাড়ি যেতে হবে।
আপনি এখন বাড়ি যেতে পারবেন না।
রমিজ মাস্টার অবাক হয়ে বলল কেন?
এই পুরো এলাকার সব মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
কেন?
একটা খুব খারাপ অসুখ ছড়িয়ে পড়ছে। একটা খারাপ ভাইরাস।
অসুখ? রমিজ মাস্টার মাথা নাড়ল, বলল, জি না স্যার। আমি এই এলাকার সব খবর জানি। এইখানে কোনো অসুখ নাই। কয়দিন থেকে আজব সব ব্যাপার হচ্ছে, কিন্তু কোনো অসুখ নাই।
ক্যাপ্টেন মারুফ ভুরু কুঁচকে বলল, আজব ব্যাপার?
জি। আজব ব্যাপার। একদিন এলাকার সব জন্তু–জানোয়ার খেপে গেল। একদিন কয়েকটা গাছের সব পাতা ঝরে গেল। এলাকার কিছু মানুষজন একেবারে নিখোঁজ হয়ে গেল। বিলের কাছে কী যেন হয় কেউ বুঝতে পারে না। রাত্রিবেলা চিকন একরকম শব্দ শোনা যায়। মানুষজন ভয় পায়–আজকে আমি দেখলাম ভয় পাওয়ার কারণটা কী।
ক্যাপ্টেন মারুফ মানুষটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, এবারে তার কথাবার্তাকে সত্যিই অসংলগ্ন মনে হচ্ছে। সে মোটামুটি শীতল গলায় বলল, আপনি ভ্যানটার পিছনে বসুন। এখন আপনি কোথাও যেতে পারবেন না।
কেন যেতে পারব না?
আপনাকে ভাইরাসে ধরেছে কি না আমাদের দেখতে হবে।
রমিজ মাস্টার ক্রুদ্ধ চোখে ক্যাপ্টেন মারুফের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি বসব না।
ক্যাপ্টেন মারুফ কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা দুই জন জওয়ানকে ইঙ্গিত করতেই তারা রমিজ মাস্টারকে ধরে জোর করে টেনে নিয়ে গেল। রমিজ মাস্টার চিৎকার করে বলল, আমি একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, পাকিস্তান মিলিটারি পর্যন্ত আমার গায়ে হাত দিতে সাহস পায় নাই, আর আপনাদের এতবড় সাহস
ক্যাপ্টেন মারুফ রমিজ মাস্টারের কথা শুনে কেমন জানি লজ্জিত বোধ করল–সত্যিই তো তার কী অধিকার আছে একজন মানুষকে এভাবে হেনস্থা করার? সে লম্বা পায়ে এগিয়ে গেল, কাছাকাছি একটা সেন্ট্রাল কমান্ড বসানো হয়েছে, সেখানে যোগাযোগ করে উপরের লোকজনের সাথে একটু কথা বলা যেতে পারে।
ওয়াকিটকি দিয়ে ক্যাপ্টেন মারুফ যোগাযোগ করল, কমান্ডিং অফিসার রমিজ মাস্টারের কথা শুনেই শিস দেওয়ার মতো একটা শব্দ করে বলল, মানুষটাকে আটকে রাখ, আমরা আসছি।
ক্যাপ্টেন মারুফ একটু ইতস্তত করে বলল, স্যার, ইনি থাকতে চাইছেন না।
জোর করে আটকে রাখ। এটা খুব জরুরি।
সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মাঝে একটা জিপের হেডলাইট দেখা গেল এবং জিপ থামার আগেই সেখান থেকে কমান্ডিং অফিসার লাফিয়ে নেমে এলেন। পিছন থেকে একজন বিদেশী মানুষ নেমে এল, ক্যাপ্টেন মারুফ মানুষটিকে আগে দেখে নি, সে ফ্রেড লিস্টার।
ক্যাপ্টেন মারুফের পিছু পিছু ফ্রেড লিস্টার এবং কমান্ডিং অফিসার ভ্যানের পিছনে রমিজ মাস্টারের কাছে হাজির হল। রমিজ মাস্টার চুপচাপ বসে আছে, তার মুখে এক ধরনের হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি। কমান্ডিং অফিসারকে দেখে কিছু একটা বলতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত থেমে গেল হঠাৎ করে বুঝতে পারল এখানে এদের সাথে কথা বলে কোনো লাভ নেই।
ফ্রেন্ড লিস্টার নিচু গলায় ইংরেজিতে কমান্ডিং অফিসারকে বলল, জিজ্ঞেস কর সে যে মূর্তিটা দেখেছে সেটি দেখতে কী রকম।
ক্যাপ্টেন মারুফ অবাক হয়ে ফ্রেন্ড লিস্টারের দিকে তাকাল, এটা যদি ভাইরাসের আক্রমণ হয়ে থাকে তা হলে কেন সে মূর্তির বর্ণনা জানতে চাইছে? রমিজ মাস্টারকে বাংলায় প্রশ্নটা করা হলে এক ধরনের অনিচ্ছা নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। কমান্ডিং অফিসারকে প্রত্যেকটা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিতে হল এবং ফ্রেড লিস্টার খুব গম্ভীর মুখে পুরোটা শুনে গেল। মৃর্তির শরীর থেকে একটা বিচিত্র জন্তু লাফিয়ে বের হওয়ার কথা বলতেই ফ্রেড লিস্টার হাত তুলে বলল, আর শোনার প্রয়োজন নেই একে এক্ষুনি কোয়ারেন্টাইন করতে হবে।
ক্যাপ্টেন মারুফ জিজ্ঞেস করল, কোথায় কোয়ারেন্টাইন করা হবে?
মাইলখানেক দূরে একটা স্কুল রয়েছে। সেটাকে কোয়ারেন্টাইন হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে।
স্যার, আপনারা কি সত্যিই এটাকে ভাইরাসের সংক্রমণ বলে সন্দেহ করছেন?
হ্যাঁ। অবশ্যই।
ক্যাপ্টেন মারুফ আপত্তি করে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল–সেনাবাহিনীতে নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়, সব সময় নিজের কথা বলার পরিবেশ থাকে না। কমান্ডিং অফিসার বলল, আমি একে নিয়ে যাচ্ছি।
ঠিক আছে স্যার।
আর কয়েক ঘণ্টার মাঝে বিশাল টুপ নামানো হবে। এখানে প্রায় দশ স্কয়ার কিলোমিটার এলাকা পুরোপুরি ঘিরে ফেলা হবে, ভিতরে কেউ যেতে পারবে না।
কীভাবে ঘিরে ফেলা হবে?
কাঁটাতার, ইলেকট্রিক লাইন এবং লেজার সারভেলেন্স।
ক্যাপ্টেন মারুফ হতবাক হয়ে কমান্ডিং অফিসারের দিকে তাকিয়ে রইল, লেজার সারভেলেন্স?
হ্যাঁ। কমান্ডিং অফিসার দাঁত বের করে হেসে বলল, আমেরিকান গভর্নমেন্ট সাহায্য করছে। আজ রাতের মাঝে কমপ্লিট হয়ে যাবে।
আর এই এলাকার মানুষগুলো?
ট্রাকে করে সরিয়ে নেওয়া হবে। ঐ দেখ ট্রাক আসছে।
ক্যাপ্টেন মারুফ তাকিয়ে দেখল সত্যি সত্যি দৈত্যের মতো বড় বড় অনেকগুলো ট্রাক আসছে। মানুষজনের ভয়ার্ত কথাবার্তা, ছোট শিশু এবং মেয়েদের কান্না শোনা যাচ্ছে। মানুষজন ছোটাছুটি করছে, একজন আরেকজনকে ডাকাডাকি করছে। এত অল্প সময়ের নোটিশে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। সবকিছু নিয়ে একটা ভয়াবহ আতঙ্ক।
ঠিক কী কারণ জানা নেই কিন্তু ক্যাপ্টেন মারুফের হঠাৎ মনে হল পুরো ব্যাপারটি একটি বড় ধরনের ষড়যন্ত্র। এর মাঝে অন্য কিছু রয়েছে–ভাইরাস নয়, রোগশোক নয়, অন্য কিছু। ব্যাপারটি কী সে জানে না কিন্তু সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাপ্টেন মারুফ কেমন করে জানি বুঝতে পারে একটা ভয়ঙ্কর বিপদ এগিয়েছে।