আমাদের স্কুলে যে একটা ল্যাবরেটরি ক্লাশ আছে আমরা সেটা জানতাম না, মিঠুন ঠিকই এটা আবিষ্কার করেছে। তবে এর তালা কোনোদিন খোলা হয়নি। কালাপাহাড় স্যারের কাছ থেকে চাবি নিয়েও কোনো লাভ হল না, তালাটা ভেতরে এমনভাবে জং ধরেছে যে চাবিটা ঘোরানোই গেল না। আমরা হাল ছেড়েই দিচ্ছিলাম, কিন্তু মিঠুন হাল ছাড়ল না। বোতলে করে কেরোসিন তেল নিয়ে এসে তালাটাকে চুবিয়ে রাখল। তারপর চাবিটা নড়াচাড়া করতে লাগল এবং শেষ পর্যন্ত তালাটা আমরা খুলতে পারলাম।
দরজাটা ধাক্কা দেবার পর সেটা কঁাচ ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল, আমরা আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলাম। ভেতরে আবছা অন্ধকার তার মাঝে কয়েকটা পাখী কিংবা বাদুর ডানা ঝাপটিয়ে উড়তে লাগল। মাঝখানে কয়েকটা টেবিল, সেই টেবিলের ওপর ধূলার স্তর। দেয়ালের সাথে লাগানো কয়েকটা আলমারী; তার উপরে এতো পুরু হয়ে ধূলা জমেছে যে ভিতরে কি আছে দেখাই যাচ্ছে না।
ল্যাবরেটরি ঘরের এক কোনায় কিছু একটা কাপড় দিয়ে ঢাকা। ফারা সেখানে উঁকি দিয়ে ভয়ে চিৎকার করতে করতে ছুটে এল। ঝুম্পা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
ফারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “ভূত।”
ঝুম্পার পিছু পিছু আমরাও ভূত দেখতে গেলাম, কাছে গিয়ে কাপড়টা তুলে দেখা গেল এটা নর কংকাল ঝুলছে। দেখে আমরাও ভয় পেয়ে চিৎকার করতে যাচ্ছিলাম। ভূত না হোক কাউকে নিশ্চয়ই মার্ডার করে এখনে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। তখন মিঠুন বলল, “এইটা বায়োলজি ক্লাশের জন্যে।”
ফারা জানতে চাইল, “ভূত না?”
“না।”
বগা বলল, “আসল কংকাল। তাই এইটার ভূত তো আসতেও পারে।”
মিঠুন বলল, “আসলে ভালো, আমরা বোতলে ভরে ফেলব।”
মিঠুন কংকালটাকে দেখে টেখে বলল, “এইটা মেয়ের কংকাল।”
ঝুম্পা ভুরু কুঁচকে বলল, “তুই কেমন করে জানিস?”
অক্সব্রীজ স্কুলে একটা ছিল তখন স্যার আমাদের শিখিয়েছিলেন। “এই যে দেখ” বলে মিঠুন কংকাল দেখে কেমন করে ছেলে আর মেয়ে বোঝা যায় সেটা বোঝানো শুরু করল।
আমরা কিছুক্ষণ ধূলায় টাকা ল্যাবরেটরিতে ঘুরে বেড়ালাম। ভেতরে অনেক ইদুর আছে সেগুলো আমাদের দেখে মনে হয় খুব বিরক্ত হয়ে ছোটাছুটি শুরু করল। ইঁদুর ছাড়াও ড্রয়ারের ভেতর রয়েছে তেলাপোকা আর পুরো ল্যাবরেটরিতে মাকড়শার জাল।
আমি মিঠুনকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই কালাপাহাড় স্যারকে কেমন করে দেখাবি ভারী জিনিষ আর হালকা জিনিষ এক সাথে পড়ে? এক্সপেরিমেন্ট কীভাবে করবি? এই ল্যাবরেটরিতে তো খালি ধূলা আর ইঁদুর!”
মিঠুন হাসল, বলল “এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে কিছু লাগবে না। আমি ইচ্ছে করলে ক্লাশেই দেখাতে পারতাম।”
“তাহলে?”
“মার থেকে বাঁচার জন্যে বলছিলাম। তাছাড়া—”
“তাছাড়া কী?”
“আস্ত একটা ল্যাবরেটরি এখানে পড়ে আছে। এইখানে নিশ্চয়ই অনৈক কিছু আছে। ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা পরীক্ষা করার সময় কাজে লাগবে।”
ধূলায় ঢাকা এই ঘরটা পরিষ্কার করার আমাদের কোনো ইচ্ছা ছিল না, কি মিঠুনের উৎসাহের কারণে স্কুলের ঝাড়ুদারকে ডাকিয়ে আমরা সত্যি সত্যি এটাকে পরিষ্কার করে ফেললাম। মিঠুনের কথা সত্যি, ল্যাবরেটরির ভেতরে অনেক কিছু আছে, মহব্বতজান স্কুলের স্যার ম্যাড়মেরা কেন কোনোদিন আমাদের সেগুলো ব্যবহার করতে দেন নাই কে জানে! ল্যাবরেটরির জিনিষগুলো দেখে আমাদের সেরকম কিছু হল না কিন্তু মিঠুন উৎসাহে টগবগ করতে লাগল। আমাকে গলা নামিয়ে বলল, “অক্সব্রীজ স্কুলে তো আমি খালি ব্ল্যাক হোলের বাচ্চা বানিয়েছিলাম, এখানে দেখিস আমি সত্যি সত্যি ব্ল্যাক হোল বানিয়ে ফেলব।”
ঠিক এরকম সময় কালাপাহাড় স্যার ল্যাবরেটরিতে ঢুকলেন, পরিষ্কার ল্যাবরেটরিটা দেখে স্যার নিশ্চয়ই অবাক হয়ে গেলেন কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করলেন না। ভুরু কুঁচকে এদিক সেদিক তাকালেন তারপর মিঠুনের দিকে তাকালেন। বললেন, “দেখি তোর এক্সপেরিমেন্ট, ভারী জিনিষ আর হালকা জিনিষ নাকী একসাথে পড়ে। দেখা-”
মিঠুন মাথা চুলকে বলল, “স্যার সত্যি সত্যি দেখাতে হলে একটা পাম্প লাগবে এখানে তো পাম্প নাই
“আমি আগেই বলেছিলাম, কেউ এটা দেখাতে পারবে না।”
“অন্যভাবে দেখাব স্যার?”
কালাপাহাড় স্যার নাক দিয়ে ঘেঁৎ করে খানিকটা বাতাস বের করলেন, বললেন, “দেখা, ঠিক করে না দেখালে পিটিয়ে তোর ছাল তুলে ফেলব।”
মিঠুন পকেট থেকে একটা এক টাকার কয়েন বের করল তারপর খাতা থেকে কয়েনের সাইজের ছোট একটা কাগজ ছিড়ে বলল, “স্যার, এমনি যদি ছাড়ি তাহলে কয়েনটা আগে পড়বে কাগজটা পরে। এই যে স্যার”
মিঠুন একসাথে কয়েন আর কাগজটা ছেড়ে দিল। কয়েনটা টুং শব্দ করে নিচে পড়ল কাগজটা ভাসতে ভাসতে নিচে পড়ল। মিঠুন তখন কয়েন আর কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, “এইবার আবার ফেলব। কিন্তু স্যার কাগজটাকে মুচড়ে ছোট করে নেব” বলে মিঠুন কাগজের টুকরাটাকে কুঁচকে মুচকে পিষে ছোট একটা গুটলি করে নিল। বলল, “আগের কাগজটাই আছে কিন্তু এখন সাইজ খুব ছোট। এখন স্যরি কয়েন আর কাগজের গুটলিটা ফেলি, দেখবেন এক সাথে পড়বে।”
মিঠুন কয়েন আর কাগজের গুটলিটা একসাথে ফেলল আর সত্যি সত্যি এক সাথে দুটো নিচে পড়ল। মিঠুন বলল, “দেখলেন স্যার?”
কালাপাহাড় স্যার চোখ পাকিয়ে বললেন, “আমার সাথে রংবাজি? এইট: প্রমাণ হল? কাগজটাকে গুটলি করবি কেন? কাগজটাকে কাগজের মত করে আমাকে দেখা—”।
মিঠুন মাথা চুলকালো তারপর বলল, “ঠিক আছে স্যার। তারপর খাত। থেকে ছোট একটা কাগজ ছিড়ে কয়েনটার ওপরে রাখল। বলল, “স্যার এই যে কাগজটা কয়েনের ওপর রেখেছি। আঠা দিয়ে লাগানো নাই স্যার শুধু উপরে রাখা আছে।”
কালাপাহাড় স্যার ভুরু কুঁচকে তাকালেন, বললেন, “তাতে কী হল?”
“এখন স্যার এই কয়েনটা ছেড়ে দিব। যদি ভারী জিনিষ আগে পড়ার কথা তাহলে কয়েনটা আগে পড়বে কাগজটা পরে। কিন্তু দেখেন”।
মিঠুন কয়েনটা ছাড়ল সেটা নিচে পড়ল, কয়েনটার ঘাড়ে চেপে কাগজের টুকরাটা একই সাথে নিচে পড়ল। দেখে মনে হল কাগজটা বুঝি আঠা দিয়ে কয়েনের গায়ে লাগানো। মিঠুন বলল, “কাগজটা কয়েনের সাথে পড়েছে তার কারণ কয়েন এটাকে বাতাসের ঘর্ষণ দেখতে দেয়নি কয়েনটা বাতাসের পুরো ঘর্ষণটুকু সহ্য করেছে।”
কালাপাহাড় স্যার হুংকার দিলেন, “তোর মুণ্ডু। খালি দুই নম্বুরী কাজ কাম। আলাদা করে ফেলে দেখা। যদি না পারিস তাহলে তোর একদিন কী আমার একদিন অক্সব্রীজ স্কুলের যত অপদার্থ সব এই স্কুলে জায়গা নিবি? ফাজলেমী পেয়েছিস?”
মিঠুন শুকনো মুখে বলল, “স্যার আলাদা করে ফেলে দেখাতে হলে একটা পাম্প লাগবে স্যার।”
“এখন লাট সাহেবের জন্যে পাম্প কিনতে হবে? আর কী কিনতে হবে? রকেট ইঞ্জিন?”
মিঠুন বলল, “স্যার আপনাকে একটা জিনিষ জিজ্ঞেস করব স্যার?”
“আমাকে?”
“জী স্যার।”
কালাপাহাড় স্যার সন্দেহের চোখে মিঠুনের দিকে তাকালেন তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক আছে। জিজ্ঞেস কর।”
“স্যার আপনি বলেছেন একটা হালকা জিনিষ আস্তে পড়ে?”
“অবশ্যই আস্তে পড়ে। সবাই জানে।”
“তাহলে একটা ভারী জিনিষকে যদি আস্তে ফেলতে চাই তাহলে তার সাথে কয়েকটা হালকা জিনিষ বেঁধে দিতে পারব স্যার। হালকাগুলো আস্তে পড়বে তাই ভারী জিনিষটা তাড়াতাড়ি পড়তে পারবে না।”
কালাপাহাড় স্যার কিছু একটা চিন্তা করলেন তারপর বললেন, “সেটাই তো হবে। এটা কেন জিজ্ঞেস করছিস?”
মিঠুনের মুখে হঠাৎ একটা ফিচলে হাসি ফুটে উঠল, “কিন্তু স্যার ভারী জিনিষটার সাথে হালকা জিনিষগুলো বেঁধে দেয়ার জন্যে সব মিলিয়ে ওজন আগের থেকে বেশি হয়ে গেল না?”
“হয়েছে। তাতে সমস্যা কী?”
“আগের থেকে ভারী হবার কারণে এখন কী আগের থেকে তাড়াতাড়ি পড়বে না? ভারী জিনিষ তো তাড়াতাড়ি পড়ে।“
কালাপাহাড় স্যারকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখাল। বললেন, “কী বললি?”
“বলেছি ভারী জিনিষটাকে আস্তে ফেলার জন্যে তার সাথে হালকা জিনিষ বেঁধেছি–কিন্তু এখন পড়ছে তাড়াতাড়ি—”
কালাপাহাড় স্যারের মুখ থমথম করতে লাগল, হুংকার দিয়ে বললেন, “তুই কী বলতে চাস?”
মিঠুন বলল, “আমি কিছু বলতে চাই না শুধু জিজ্ঞেস করছি। এক ভাবে চিন্তা করলে আস্তে পড়বে, অন্যভাবে চিন্তা করলে তাড়াতাড়ি পড়বে, কোনটা সত্যি? দুইটাই তো সত্যি হতে পারে না। এটাকে সমাধান করার একটা মাত্র উপায়। সেটা হচ্ছে যদি আমরা মেনে নেই ভারী আর হালকা জিনিষ যদি এক সাথে পড়ে। তার মানে স্যার কোনো এক্সপেরিমেন্ট করার দরকার নাই শুধু যুক্তি দিয়ে দেখানো যায় ভারী আর হালকা জিনিষ এক সাথে নিচে পড়ে।”
কালাপাহাড় স্যারকে কেমন বিভ্রান্ত দেখাল, খানিকক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “এটা তোর যুক্তি হল? এটা হচ্ছে কুযুক্তি। যতো রকম কুযুক্তি। বদযুক্তি।”
আমরা বুঝতে পারলাম মিঠুন শেষ পর্যন্ত স্যারকে যুক্তি দিয়ে আটকে ফেলেছে। মিঠুন মিন মিন করে বলল, “না স্যার এইটা কুযুক্তি না। এইটা আমি এক বইয়ে পড়েছি।”
“যত্তোসব। আউটবই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। ঐগুলো পড়ে ব্রেন নষ্ট।”
বলে স্যার আপ থপ করে, বের হয়ে গেলেন। অমর চাপা গলায় আনন্দের মত শব্দ করলাম।
মিঠুন বলল, “যাক বাবা বাঁচা গেল।”
আমি বললাম, “আরেকটু হলে কিলিয়ে স্যার তোকেই ব্ল্যাক হোল বানিয়ে দিত।”
মিঠুন মুখ শক্ত করে বলল, “কিলিয়ে ব্ল্যাক হোল তৈরী করা যায় না। ব্ল্যাক হোল তৈরী হওয়ার নিয়ম আছে। বৈজ্ঞানিক জিনিষ নিয়ে ভুল কথা বললে মিঠুন খুব বিরক্ত হয়।
আসল ব্ল্যাক হোল কী জিনিষ সেটা কেমন করে তৈরি করতে হয়, সেটা তৈরী হলে কী হয় আমি কিছুই জানি না কিন্তু মিঠুনের ব্ল্যাক হোলের বাচ্চাটা কী করতে পারে সেটা আমি সেদিন সন্ধেবেলা টের পেলাম।
সারাটাদিন গুমোট গরম ছিল, সন্ধেবেলা আকাশ কালো করে মেঘ জমা হতে শুরু করল। মেঘ আমার খুব ভালো লাগে, আকাশে কতো রকম মেঘ থাকে ভালো করে লক্ষ্য না করলে কেউ সেটা দেখতেও পাবে না। আমি তাই মেঘ দেখার জন্যে বাসায় ছাদে উঠে গেলাম।
মনে হতে লাগল মেঘগুলো বুঝি জীবন্ত কোনো প্রাণী, আকাশের এক কোণা থেকে পাক খেয়ে খেয়ে আসতে থাকে, আসতে আসতে এটা পাল্টে যেতে থাকে, কখনো এক জায়গায় জড়ো হয় আবার কখনো ছড়িয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে কালো মেঘের ভিতর বিদ্যুতের ঝলকানি হতে থাকে। মনে হয় দূরে কোথাও বুঝি মেঘের ভেতর আলো আটকে রেখেছে, মেঘটা টুকরো করে সেই আলো বের হয়ে আসবে। অনেক দূরে বিজলী চমকাতে থাকে আর একটু পর মেঘের গুড়গুড় শব্দ শুনতে পেলাম আমার এটা শুনতে কী যে ভালো লাগে!
আমি সার্টের বোতাম খুলে ছাদে হাঁটতে থাকি, যখন প্রথম বৃষ্টির ফোটা পড়বে সেই বৃষ্টিতে ভিজতে কী যে মজা সেটা যারা বৃষ্টিতে ভিজে শুধু তারাই জানে। আকাশে ঠিক আমার মাথার উপর বিজলী চমকাতে থাকে আর ঠিক তখন খুব বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল। ছাদে চিলেকোঠায় আমার যে ঘরটা আমি মিঠুনকে তার ল্যাবরেটরি তৈরী করতে দিয়েছি সেই ঘরটার ভিতরে খুট খুট করে একটা শব্দ হল। আমার মনে হল ঘরের ভেতরে কেউ একজন আছে, আমি চমকে উঠলাম আর ভয়ে আমার বুকটা কেঁপে উঠল।
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম বুঝি শুনতে ভুল করেছি, মেঘের সাথে স:থে একটু ঝড়ো বাতাস দিচ্ছে, এই বাতাসের জন্যে হয়তো দরজা কিংবা জানালা কেঁপে শব্দ হচ্ছে। একটু পর বুঝতে পারলাম আসলে এটা দরজা জানালার শব্দ না, ঘরের ভিতরে কিছু একটা নড়ছে। আমার ভয়টুকু বাড়তে লাগল, শুনতে পেলাম ভেতরে খট খট শব্দটাও আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে কোনো একটা জীবন্ত প্রাণী ঘরের ভেতরে ছোটাছুটি করছে।
তখন হঠাৎ করে আরো বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটতে শুরু করল। আমি দেখলাম দরজার নিচ দিয়ে নীল একটা আলো বের হতে শুরু করছে। খট খট শব্দের সাথে সাথে আলোটা বাড়ছে আর কমছে।
প্রথমে আমার ইচ্ছে হল এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যাই, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করলাম তারপর অনেক সাহস করে আমি আস্তে আস্তে চিলেকোঠার ছিটকানী খুলে দরজাটা খুললাম, তখন ভেতরে যে দৃশ্যটি দেখলাম তাতে আমার হার্টফেল করার অবস্থা।
মিঠুনের ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা আমরা যে বাক্সটার মাঝে রেখেছিলাম সেখান থেকে নীল রংয়ের একটা আলো বের হচ্ছে, শুধু তাই না সেখানে থেকে শুড়ের মতো আলোর ঝলকানি বের হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে, জীবন্ত প্রাণীর মত সেটা নড়ছে। শুধু তাই না মনে হচ্ছে বাক্সটা জীবন্ত, ভোঁতা একটা শব্দ করে সেটা নড়ছে, কাপছে, লাফাচ্ছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরে যাচ্ছে। স্পষ্ট মনে হতে থাকে এই বাক্সটার ভিতরে আমরা জীন ভূত কিছু একটা ঢুকিয়ে রেখেছি, সেটা এখন বের হতে চেষ্টা করছে।
ভয় পেয়ে আমি একটা চিৎকার করে দৌড় দিলাম কিন্তু ঠিক তখন খুব কাছাকাছি কোথাও একটা বাজ পড়ল, আর সাথে সাথে বাক্সটা থেমে গেল, আলো নিভে গেল, বাক্স থেকে বের হয়ে আসা আলোর শুড়গুলো অদৃশ্য হয়ে গেল। দেখে কে বুঝবে একটু আগে এই বাক্স থেকে এরকম বিচিত্র একটা জিনিষ বের হচ্ছিল।
আমি ঘরের লাইট জ্বালিয়ে বাক্সটার কাছে গেলাম, ঘরে একটা পোড়া গন্ধ। বাক্সটা গরম এবং দেখে মনে হল এটা রীতিমত ঝলসে গেছে। বাকুটার ভেতর যে শিশিটাতে ব্লাকহোলের বাচ্চাকে রাখা হয়েছিল সেই শিশিটার মুখটা খোলা। আমি খুব সাবধানে শিশিটা হাতে নিলাম, শিশিটা বেশ ভারী। নাড়তেই মনে হল ভিতরে কিছু একটা নড়ল। আমি শিশির ছিপিটা খুঁজে বের করে শিশিটার ছিপি আটকে দিলাম। বাক্সের ভেতর শিশিটা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে দিয়েছিলাম দেখলাম কাপড়টা জায়গায়
জায়গায় পুড়ে গিয়েছে।
আমি কী করব বুঝতে না পেরে যেভাবে শিশিটা আগে রেখেছিলাম ঠিক সেভাবে রেখে দিলাম। আবার সেটা নড়তে শুরু করে কী না, আলো বের হতে থাকে কী না দেখার জন্যে আমি বেশ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম কিন্তু কিছু হল না।
ঠিক তখন বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে, আমি তখন দরজা বন্ধ করে বের হয়ে ছাদে হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করলাম। চিলেকোঠায় ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাটা যে সব কাণ্ড কারখানা করেছে আমি তার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। মিঠুন কী বুঝবে?”
পরদিন ক্লাশে মিঠুনকে যখন এটা বললাম সে জিজ্ঞেস করল,“যখন বাজ পড়েছে তখন ব্ল্যাকহোলের বাচ্চার কাজকর্ম থেমে গেল?”
“হ্যা”।
“বাজ পড়ার আগে পর্যন্ত সেটা নড়াচড়া করছিল? আলো বের হচ্ছিল?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক তো?”
“ঠিক।
মিঠুন তখন বুঝে ফেলার মত ভাব করে মাথা নাড়ল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
“যেটা ভাবছিলাম তাই।”
“কী ভাবছিলি?”
“আমি তো ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাটা এখনো টেস্ট করি নাই। আমার একটা টেস্ট করার কথা ছিল ইলেকট্রিক ফিল্ড আর ম্যাগনেটিক ফিল্ড দিয়ে। সেটা আর করা লাগবে না। টেস্ট হয়ে গেছে।”
“মানে?”
“কাছাকাছি যখন বাজ পড়ে তার আগে আগে সেই জায়গায় এক ধরণের ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরি হয়। তোর বাসায় সেই ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরী হয়েছিল, ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাট; সেই ইলেকট্রিক ফিল্ডের মাঝে যখন ঢুকেছে তখন নিশ্চয়ই এনার্জি রিলিজ করতে শুরু করেছে।”
আমি মিঠুনের কোনো কথাই বুঝতে পারলাম না, তাই বোকার মতন মাথা নাড়লাম। মিঠুন জোরে জোরে চিন্তা করতে লাগল, “কিন্তু এনার্জিটা আসে কোথা থেকে?”
আমিও ভান করলাম এনার্জিটা কোথা থেকে আসে সেটা নিয়ে আমারও খুব চিন্তা হচ্ছে। মিঠুন বিড় বিড় করতে করতে বলল, “এক হতে পারে ই ইকুয়েলস টু এমসি স্কয়ার। তুই তাহলে এর অর্থ চিন্তা করতে পারিস?”
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না তারপরও জিনিষটা নিয়ে ভাবছি এরকম ভাণ করে মাথা নাড়লাম।
মিঠুন বলল, “তার অর্থ এমন একটা জিনিস পেয়েছি সেটা দিয়ে সাংঘাতিক সব কাজ করে ফেলা যাবে। পৃথিবীর মানুষ চিন্তাও করতে পারবে আমাদের কাছে কী আছে।”
আমি বললাম, “তোর কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এর কথা এখন কাউকে বলা যাবে না।”
“হ্যাঁ। এখন আমাদের কয়েকজন ছাড়া আর কাউকে এর কথা বলা যাবে না। তার আগে পুরোটা আমাদের এক্সপেরিমেন্টটা করে দেখতে হবে।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কখন করবি?”
“আজকেই।”
আমি মাথা নাড়লাম, “মিঠুন বলল, দেরী করতে পারব না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে।”
সত্যিকারের স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীরা যখন ইচ্ছে বের হতে পারে না কিন্তু আমাদের মহব্বতজান স্কুলে এটা কোনো ব্যাপারই না। আমি আর মিঠুন স্কুল ছুটির দুই পিরিওড আগে ফুড়ত করে বের হয়ে গেলাম কেউ লক্ষও করল না।
আমাদের বাসায় যাবার আগে মিঠুন আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তোর বাসায় ব্যাটারী আছে?”
আমি মাথা চুলকালাম, বললাম “থাকলেও এখন তো খুঁজে পাব না।”
“টেলিভিশনের রিমোট আছে?”
“আছে।”
“তাহলেই ব্যাটারী পেয়ে যাব। এখন দরকার দুই টুকরা তার।”
“পুরানো একটা টেবিল ল্যাম্প আছে।”
মিঠুন হাতে কিল দিয়ে বলল, “গুড়! এখন দরকার এলুমিনিয়াম ফয়েল। পান বিড়ি সিগারেটের দোকানে পেয়ে যাব।”
রাস্তার পাশে ছোট একটা পান, বিড়ি সিগারটের দোকান থেকে একটা খালি সিগারেটের প্যাকেট চেয়ে নিলাম তার ভেতরে খানিকটা রাংতা পাওয়া গেল। মিঠুন খুশি হয়ে মাথা নাড়ল, এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য তার যা কিছু দরকার তার সবকিছু হয়ে গেছে।
হেঁটে হেঁটে বাসায় এসে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। মিঠুনের এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে রিমোটের ব্যাটারি দুটো খুলে নিলাম। ভালই হয়েছে আন্তু এখন বাসায় নেই, যতক্ষণ বাসায় থাকেন সোফায় আশায়া হয়ে টিভি দেখেন তখন রিমোট খুলে ব্যাটারি নেয়া এতো সোজা হত না। পড়ার ঘর থেকে আমার পুরানো টেবিলে ল্যাম্পটা নিয়ে নিলাম তারপর মিঠুনকে নিয়ে ছাদে আমার চিলেকোঠায় হাজির হলাম।
মিঠুন ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা রাখা বাক্সটা নিয়ে সাবধানে সেটা খুলল, ভেতরে জায়গায় জায়গায় পুড়ে গেছে, একদিকে পুড়ে একটা বড় গর্ত পর্যন্ত হয়ে গেছে। মিঠুন সাবধানে শিশিটা বের করে একবার নেড়ে দেখল, ভেতরে কিছু দেখা যায় না কিন্তু বোঝা যায় শিশিটাতে কিছু একটা আছে।
মিঠুন শিশিটার দুই পাশে দুই টুকরা রাংতা ল্যাপ্টে লাগিয়ে নেয়। তারপর টেবিল ল্যাম্প থেকে দুই টুকরা তার ছিড়ে নিয়ে উপরের প্লাস্টিক সরিয়ে ভেতরের তার বের করে নেয়। দুইটা তার শিশির দুই পাশের রাংতার সাথে প্যাচিয়ে নিয়ে সে শিশিটা মেঝেতে রাখল। তারপর আমাকে বলল, রিমোটের ব্যাটারিগুলো বের করতে। আমি ব্যাটারি দুটো বের করার পর মিঠুন সাবধানে তারের দুই মাথা ব্যাটারির দুই পাশে লাগাতেই তুলকালাম একটা কাণ্ড ঘটল। শিশিটার ছিপিটা গুলির মতো উপরে ছুটে গেল আর শিশির ভেতর থেকে জ্বলন্ত নীলাভ আলোয় একটা শিখার মতো লকলকে কিছু একটা বের হয়ে ছাদে আঘাত করল। পুরো ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটল যে আমরা রেডি হবার সময় পর্যন্ত পেলাম না কোনোমতে তার ব্যাটারি খুলে ছিটকে সরে গেলাম। কানেকশন ছুটে যেতেই সেই লকলকে শিখাটা সুড়ৎ করে শিশির ভেতরে ঢুকে গেল।
মিঠুনের চোখ চকচক করতে থাকে। কোনোমতে নিশ্বাস আটকে বলল, “প্লাজমা!”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “প্লাজমা কী?”
“ কোনো গ্যাস যখন আয়োনাইজ হয়, সেটাকে বলে পাজমা।”
“আয়োনাইজ মানে কী?”
“গ্যাসের ইলেকট্রনকে যখন ছুটিয়ে নেয় তখন বলে আয়োনাইজ হওয়া।
“ইলেকট্রন কেন ছুটে যাচ্ছে?”
“কোনো এক ধরনের শক্তি বের হচ্ছে সেই শক্তি ছুটিয়ে দিচ্ছে।”
মিঠুন জ্বলজ্বলে চোখে বলল, “সাধারণত লো প্রেসারে জমা তৈরী হয়। এখানে গ্যাসের স্বাভাবিক চাপেই হয়ে যাচ্ছে।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তার মানে কী?”
“তার মানে প্রচণ্ড এনার্জি বের হচ্ছে।”
“সেটা ভালো না খারাপ?”
“সেটা ফ্যান্টাস্টিক।” মিঠুন চোখ বড় বড় করে বলল, “সেটা অসাধারণ।”
ব্যাটারি লাগালে কী হতে পারে সেটা যেহেতু জেনে গেছি তাই এর পরে আরেকটু সাবধানে কানেকশন দেয়া হলো, আবার শিশির ভেতর থেকে জীবন্ত প্রাণীর মত লকলকে প্লাজমা ভয়ঙ্কর শব্দ করে বের হয়ে আসে, সারা ঘরে ওষুধের মতো একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। প্লাজমাটা ছাদে যেখানে গিয়ে ধাক্কা খেল সেখান থেকে প্যালেস্তারা খসে পড়ল। মিঠুন সেটা দেখে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে।
কয়েকবার এক্সপেরিমেন্ট করে মিঠুন সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়ল। তারপর শিশিটা আবার বন্ধ করে বাক্স রেখে দেয়। বাক্সে রাখার আশা এবার সে রাংতা দিয়ে ভালো করে মুড়ে নেয় তাহলে লাল ইলেকট্রিক ফিল্ড ঢুকতে পারবে না। আশপাশে বাজ পড়লেও সমস্যা নেই।