গান্ডীব ধরিয়া পার্থ যুঝেন তখন।
ছিন্ন ভিন্ন করিলেন কুরুসেনাগণ।।
কেহ ডাকে মাতাপিতা কেহ চাহে জল।
সাহসে শকুনি যুঝে বাহিনী সকল।।
ধৃষ্টদ্যুন্ন সহ যুঝে রাজা দুর্য্যোধন।
মহাঘোর যুদ্ধ হয় ঘোর দরশন।।
বাণে কাটি পাড়ে তাহা রাজা দুর্য্যোধন।
করিলেন সৈন্যোপরি বাণ বরিষণ।।
সন্ধান পূরিয়া আইল ধৃষ্টদ্যুন্ন বীর।
অর্দ্ধচন্দ্র দিয়া কাটে সারথির শির।।
পঞ্চ বাণে ধনু কাটে ধ্বজ ছত্র আর।
বাণে খন্ড খন্ড রথ করিল রাজার।।
সহিতে না পারি ভঙ্গ দিল দুর্য্যোধন।
লাফ দিয়া সৈন্যমধ্যে পড়িল তখন।।
অপমান পেয়ে রাজা ধায় দুর্য্যোধন।
শকুনির কাছে আসি দিল দরশন।।
তবে রাজা কৃতবর্ম্মা মহাবলবান।
ভীমসেন সহ যুঝে হয়ে সাবধান।।
ক্ষণেক রহিয়া তবে ভীম মহাবীর।
বাণেতে বিন্ধিল যোদ্ধাগণের শরীর।।
বাণে বাণে কাটে কৃতবর্ম্মা ক্রোধমন।
মহাকোপে এল বীর পবননন্দন।।
যুদ্ধ করে কৃতবর্ম্মা করিয়া বিক্রম।
মহাযুদ্ধ করে দোঁহে নাহি পরিশ্রম।।
দুইজনে মহাযুদ্ধ করে বার বার।
তাহা দেখি যোদ্ধাগণ হৈল অগ্রসর।।
ভীমসেন করে রণ অনেক বিশেষ।
নির্ম্মূল হইল সেনা অল্প অবশেষ।।
একা ভীম সর্ব্ব সৈন্য করিল বিনাশ।
দেখিয়া কৌরবগণ পাইল তরাস।।
সঞ্জয় বলেন রাজা শুন নিবেদন।
অশ্ব আরোহণে আছে রাজা দুর্য্যোধন।।
যোদ্ধাগণ কতগুলি আছয়ে সংহতি।
দেখিয়া কহেন পার্থ গোবিন্দের প্রতি।।
হের দেখ নির্লজ্জ পামর দুর্য্যোধন।
তবু ক্ষমা নাহি রণে বিনাশ কারণ।।
গোবিন্দ বলেন শুন পার্থ ধনুর্দ্ধর।
আগু হয়ে মার পাপিষ্ঠ কুরুবর।।
অর্জ্জুন দেখহ সেনা প্রায় ভঙ্গিয়ান।
ক্ষণেক করহ রণ হয়ে সাবধাণ।।
সঞ্জয় বলিল রাজা কি কব বিশেষ।
সকল হইল নষ্ট কিছু মাত্র শেষ।।
অবশেষ আছে তব দুই শত রথ।
ত্রিশ সহস্র পদাতি অশ্ব পঞ্চশত।।
কৌরব বাহিনী রাজা এই মাত্র শেষ।
জানিয়া অর্জ্জুন প্রতি কন হৃষীকেশ।।
মহাধনুর্দ্ধর পার্থ রণে অনিবার।
তোমা হতে শত্রু সব হইল সংহার।।
আজি ভুজবলে যুধিষ্ঠির অধিকারী।
রহিল তোমার যশ ত্রিভুবন ভরি।।
আজি যুধিষ্ঠিরের উপরে রাজ্যভার।
আজি হৈল ক্রুর কুরুবংশের সংহার।।
অর্জ্জুন বলিল প্রভু তব প্রসাদাৎ।
সমরে বিজয়ী আমি জগতে বিখ্যাত।।
কহিতে কহিতে যুদ্ধস্থলে ধনঞ্জয়।
বাণে বাণে করিলেন অন্ধকারময়।।
মহাপরাক্রম পার্থ যেন ধনুর্ব্বেদ।
পঞ্চবাণে করে সুশর্ম্মার শিরচ্ছেদ।।
তাহার তনয় কোপে রণে প্রবেশিল।
পার্থের নারাচ বাণে সেও কাটা গেল।।
তবে কোপে বীরবর ছাড়ে সিংহনাদ।
যুঝহ সমরে বীর নাহিক বিষাদ।।
দক্ষসেন বীর গেল সমরের মুখে।
তাহারে বনিল ভীম পরম কৌতুকে।।
তাহার অনুজ ছিল সমরে দুর্জ্জয়।
তাহারে মারিল বীর পবন তনয়।।
শকুনি সহিত যুঝে সহদেব বীর।
দোঁহাকার বাণে দোঁহে জর্জ্জর শরীর।।
শকুনিনিকটে এল সহদেব বীর।
বাণেতে জর্জ্জর কৈল শকুনি শরীর।।
সন্বিত পাইয়া উঠে হইয়া চেতনা।
সিংহনাদ করে বীর পড়য়ে ঝন্ ঝনা।।
ভয়ে ভীত ভঙ্গিয়ান দেখি কুরুবল।
দুর্য্যোধন আশ্বাসিয়া রাখে সে সকল।।
দেব অবতার বীর সহদেব রোষে।
অবিশ্রাস্ত ক্ষান্ত নহে বিশিখ বরিষে।।
শকুনির ধনু কাটি ফেলে অবহেলে।
অন্য ধনু লয়ে যুদ্ধ করে সেই বলে।।
শকুনির নন্দন উলূক নাম ধরে।
পিতার সাহায্য হেতু আইল সমরে।।
ভীমের সহিত রণ করে অনিবার।
ক্ষুরবাণে ভীম তারে করিল সংহার।।
পুত্রশোকে যুঝে বীর মরণ ভাবিয়া।
নির্ভয়েতে ধনুগুণ সন্ধান পুরিয়া।।
বাণে আচ্ছাদন কৈল মাদ্রীর নন্দনে।
গলিত রুধির অঙ্গ ভয় নাহি মনে।।
মাদ্রীপুত্র মহাবীর মহাকোপভরে।
বাণে শকুনির তনু খান খান করে।।
কোপে শক্তি লয় তুলি গান্ধার কুমার।
নিক্ষেপ করিল তারে করিতে সংহার।।
দৃষ্টিমাত্রে শক্তি কাটে সহদেব বীর।
শক্তি ব্যর্থ গেল দেখি শকুনি অস্থির।।
ভিন্দিপাল শক্তি ভল্ল পরশু তোমর।
শেল শূল জাঠি জাঠা যতেক অপার।।
সন্ধান পুরিয়া বাণ শকুনি মারিল।
মাদ্রীসুত সহদেব সকল কাটিল।।
কাটিল সারথি রথ করি লন্ড ভন্ড।
তীক্ষ্মবাণে কাটি পাড়ে তুরঙ্গের মুন্ড।।
বিরথী হইয়া বীর রহে দান্ডাইয়া।
পরাক্রম গেল সব আতঙ্ক পাইয়া।।
রথ হৈতে লম্ফ দিয়া পড়ে ভূমিতলে।
বিমুখ সংগ্রামে বীর পিঠ দিয়া চলে।।
চঞ্চল চরণগতি নাহি বুদ্ধিবল।
করতালি দিয়া পাছু খেদাড়ে সকল।।
ধিক্ ধিক্ ক্ষত্র হয়ে পলাইস্ কেনে।
ইহার অধিক ভাল সংগ্রামে মরণে।।
অবলার প্রায় যাস ছাড়িবীরপণা।
মরণ এড়িলহেন না কর ভাবনা।।
অপমান বাক্য শুনি পুনঃ নেউটিল।
মরণ ভাবিয়া রণে আসিয়া পশিল।।
রণভূমে পড়েছিল যত অস্ত্র তাই।
প্রাণপণে করে যুদ্ধ লইয়া সবাই।।
যত অস্ত্র ফেলি মারে কাটে মহাবীর।
অবসন্ন হয়ে পড়ে গান্ধার সুধীর।।
আগু হয়ে মাদ্রীপুত্র চুলে ধরি আনে।
শকুনি দুঃখের মূল সর্ব্বালোকে জানে।।
পশুর সদৃশ করি শকুনিরে আনে।
কম্পমান কলেবর হৈল হতজ্ঞানে।।
সহদেব বলে তুমি দুষ্টের প্রধান।
এই হেতু তোমা প্রতি নাহি ক্ষমাবান।।
পাশায় যতেক দুঃখ দিলা দুষ্টমতি।
উপহাস করিলেক রাজার সংহতি।।
ভুঞ্জাব তাহার সুখ আজিকার রণে।
যে হাতে ধরিলে পাশা কপট বিধানে।।
সেই হাত অগ্রে কাটি অন্য তার পরে।
আজি রণ শিখাইব নরাধম তোরে।।
শকুনি বলিল মোরে মার দিব্যবাণ।
কধ কর কিন্ত না করিও অপমান।।
বিধির নির্ব্বন্ধ কভু খন্ডন না যায়।
কাটি পাড় মুন্ড যদি ক্ষমা নাহি হয়।।
এত শুনি দর্প করি সহদেব বীর।
পূর্ব্ব দুঃখ মনে করি হইল অস্থির।।
অঙ্গুলি পর্য্যন্ত কাটি পাড়ে বাহুমূল।
পূরিল প্রতিজ্ঞা আজি শুন রে মাতুল।।
কাতর শকুনি বীর করে ছটফটি।
ক্রোধে সহদেব বীর তার মুন্ড কাটি।।
কর্ম্ম অনুরূপ ফল বলে সর্ব্বলোকে।
পূর্ব্বের বিধান ফল পাইল প্রত্যেকে।।
সময় পাইলে কর্ম্ম অবশ্য সে ফলে।
ধর্ম্মাধর্ম্ম ফল সব ভূঞ্জ এতকালে।।
শকুনি পড়িল রণে হৈল সিংহনাদ।
কুরুসৈন্য ভঙ্গ দিল গণিয়া প্রমাদ।।
পলাইতে নারে সবে যে পড়ে সম্মূখে।
প্রাণের সহিত মারে যারে আগে দেখে।।
সেনাগণ ভঙ্গ দিল যেবা ছিল শেষ।
একা দুর্য্যোধন মাত্র আছে অবশেষ।।
একাদশ অক্ষৌহিনী সেনাগণ নাশি।
শোক অভিযানে দুর্য্যোধন ভয় বাসি।।
হইল পৃথিবীশূন্য জানি মহামতি।
অশ্ব ছাড়ি ভূমিতলে করিলেন গতি।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পূন্যবান।।