০৫. সমাজ
যজুর্বেদের মধ্যে উপযুক্ত উপাদানের অভাব থাকার ফলে এর থেকে সমসাময়িক ইতিহাস সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা করা অত্যন্ত কঠিন, যদিও এতে মাঝে মাঝে শুচিবৃক্ষ, গোপালায়ন বা ক্ষিপ্ৰতারীর মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের নাম উল্লিখিত। বাস্তব ও আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পরবর্তী বৈদিক যুগে কিছু কিছু মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা হওয়াতে সামাজিক জীবনের বহুদিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। কৃষিব্যবস্থার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে সমাজের পুরুষশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে এসে গিয়েছিল এবং এই সময় থেকেই যেহেতু সমাজে নারী অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পুরুষের উপর একান্ত নির্ভরশীল হতে শুরু করল, তাই সমাজে ক্রমশ তার মর্যাদা হ্রাস পেল। তাছাড়া, আৰ্য পুরুষেরা প্রায়ই অনার্য গোষ্ঠীভুক্ত যে সব নারীদের বিবাহ করত, সমাজে তাদের পরিপূর্ণ স্বীকৃতি না থাকার ফলেও সাধারণভাবে নারীর সামাজিক অবমূল্যায়ন শুরু হয়েছিল। বারাঙ্গনাদের সাহচৰ্যলাভে পুরুষেরা যেমন অভ্যন্ত ছিল, তেমনি পরস্ত্রীগমনেও কোনো বাধা ছিল না ; একমাত্র নির্দিষ্ট কিছু অনুষ্ঠানের দিনে এই ধরনের সম্পর্কে কিছু বাধা ও নিষেধ নির্দেশিত ছিল। যজ্ঞাগ্নি প্ৰজ্বলিত হওয়ার পর প্রথম দিবসে যজমানের পক্ষে বারবধুর সঙ্গ নিযিদ্ধ ছিল, দ্বিতীয় দিবসে পরস্ত্রী এবং তৃতীয়ে নিজের স্ত্রীর সাহচর্য নিষিদ্ধ ছিল। স্ত্রীকে যদিও অর্ধাঙ্গিনী বলা হয়েছে, তবুও বারে বারে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, পুরুষের তুলনায় নারী সমাজে সর্বপ্রকারে হীন ব’লেই বিবেচিত ; জনসমাবেশে যোগদানের কোনো অধিকার তার ছিল না, তেমনি সম্পত্তির অধিকারেও সে বঞ্চিত ছিল। পুরুষের বহুবিবাহকে সমর্থন করা হলেও নারীর বহু বিবাহের উপর কঠোর বাধা-নিষেধ নেমে এসেছিল।
যজুর্বেদের সময়েই জাতিভেদ প্ৰথা স্পষ্টভাবে নিরূপিত হয় ও চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ; বিভিন্ন বর্ণের দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ ধীরে ধীরে কঠোর ও অলঙ্ঘ্যভাবে নির্দিষ্ট হয়ে যায়। বুদ্ধি ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য ব্ৰাহ্মণরা সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার অর্জন করে ; এবং এই ব্ৰাহ্মাণ সম্প্রদায় ক্ৰমে জন্মগতভাবে এসব অধিকার আত্মসাৎ করে নেয়। আবার ব্ৰাহ্মণদের মধ্যেও পুরোহিতরা সমাজের কাছে সর্বাধিক সুবিধা লাভ বা আদায় করে নিয়েছিল, কেননা যজ্ঞনিষ্ঠ সমাজে যে সমস্ত অনুষ্ঠান অদীক্ষিত জনসাধারণের পক্ষে সর্বতোভাবে রহস্যাবৃত ছিল, সেইসব অনুষ্ঠানের পরিচালক ব্ৰাহ্মণরা ত স্বাভাবিকভাবেই সর্বাধিক সম্ভমের আসনে অধিষ্ঠিত হবে। পুরোহিতদের কর্তব্যের বিভাজন এবং যজ্ঞের সংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুরোহিতদেরও সংখ্যা চক্রবৃদ্ধিহারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। প্ৰত্যেক বেদের জন্য পৃথক ও সুনির্দিষ্ট পুরোহিত্য-মণ্ডলী বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ পেয়ে তখনকার সমাজে পুরোহিতের বৃত্তিকেই চূড়ান্ত মর্যাদা ও লাভের বৃত্তিতে পরিণত করে।
অধ্বর্যু-শ্রেণীর পুরোহিত যজুর্বেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যুদ্ধবিজয়ী রাজাদের হাতে সম্পদ যত পুঞ্জীভূত হতে লাগল ততই পুরোহিতরা নিত্য নুতন যজ্ঞ উদ্ভাবন করে ক্রমশ অধিক-সংখ্যক পুরোহিতের প্রয়োজনকে অনিবাৰ্য করে তুলল। যজুর্বেদে উল্লিখিত বহু-অনুপুঙ্খাযুক্ত শ্রৌত্যযজ্ঞাগুলির মধ্য দিয়ে নানা শুরুত্বপূর্ণ সমাজ সংস্থার সূচনা হয়েছিল, যা দুই সহস্রাব্দেরও অধিক সময় ধীরে ভারতীয় সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই সঙ্গে জাতিভেদ প্রথা যুক্ত হয়ে পরবর্তী বৈদিক যুগের ধর্মাচরণকে একটি নুতন চরিত্র দান করে। উল্লেখযোগ্য যে, প্ৰাগাৰ্য সিন্ধুসভ্যতায় আচরিত ধর্ম থেকেই সম্ভবত তিনটি ভিন্ন আকৃতির (গোলাকৃতি, ত্রিভূজ ও অর্ধচন্দ্রাকৃতি) যজ্ঞবেদীর ধারণারূপ লাভ করেছিল। অনুষ্ঠানের নির্দেশাবলী থেকে আমরা তখনকার সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। গায়ক এবং চিকিৎসকদের সেই সমাজে হীন বলে গণ্য করা হত। জাতিভেদজর্জরিত সমাজে ব্ৰাহ্মণদের অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত হওয়ার কারণ এই যে, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর্বশেষে আর্যরা বিজয়ীরূপে আর্যাবর্তে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে সামাজিক শ্রেণীরূপে যোদ্ধাদের গুরুত্ব স্বভাবতই খর্ব হয়ে যায়। সেই কৃষিজীবী ভূমিনিষ্ঠ স্থিতিশীল সমাজে ক্ষত্রিয়দের তুলনায় ব্রাহ্মণরা তখন যজ্ঞ অনুষ্ঠানের দ্বারা সমাজের মঙ্গলবিধান করার দাবিতে সামাজিক গৌরব অর্জন করে ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠে। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে জাতি-বিভাগের মধ্যে সামাজিক স্থিতিস্থাপকতা ও চলিষ্ণুতা অবশিষ্ট ছিল বেশ কিছুকাল পর্যন্ত এবং যে কোনও জাতিভুক্ত কর্মক্ষম সৎ বা বিদ্বান ব্যক্তি সমাজে তার প্রাপ্য সম্মান লাভ করত।
বেদ-রচনার এই পর্যায়েও শতায়ু হওয়াই ছিল মানুষের প্রত্যাশিত সার্থকতা। কৃষি-ব্যবস্থায় লব্ধ উদ্ধৃত্ত ধন, গোসম্পদ, কুটীর শিল্প, বাণিজ্য এবং সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত অধিকার সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি হয়ে উঠল। তৎকালীন, মানুষের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কেও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাচীন আৰ্যরা দিনে তিনবার আহার করতেন। কৃষির প্রসারের যুগে মাংস, দুধ ছাড়াও শস্যজাত ও দুগ্ধজাত খাদ্য, মধু, সুরা ও সোম আহার্য ও পানীয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছিল। তখনকার মানুষ জীবনযাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছিল, তারও বেশ কিছু প্ৰমাণ পাওয়া যায়। এই সময় থেকেই তপস্যার বিশেষ গুরুত্ব স্বীকৃত হতে থাকে। বৈদিক যুগের প্রথম পর্যায়ে যেমন যজ্ঞই ধর্মাচরণের ও প্রকৃতির ওপর জয়লাভ করার একমাত্র উপায় ছিল, এখন আর ঠিক তেমন নয় ; তপস্যাও একটি বিকল্প শক্তিরূপে পরিগণিত হতে শুরু করেছে উত্তর বৈদিক যুগের শুরু থেকেই, ঋগ্বেদের দশম মণ্ডল ও যজুর্বেদেই এই নূতন বোধের সূচনা। তপস্যা এখন একটি প্রবল সৃষ্টিশীল শক্তি, মহাবিশ্বে সৃষ্টির অন্তরালে নিহিত এ শক্তি।