সকালে ঘুম ভাঙামাত্র মনে পড়ল মেজরের কথা। কাল অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরেছিল অর্জুন। অবনীবাবু তাকে একা ছাড়েননি। সঙ্গে জিপ নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত এসেছিলেন। পুলিশের কিছু অফিসার অবনীবাবুর মতো ভদ্র, বিনয়ী এবং শিক্ষিত বলে মানুষ ভরসা পায়। অবনীবাবু চেয়েছিলেন কাল রাত্রেই সন্দীপদের বাড়িতে যেতে। সন্দীপ যে ওই ডাকাতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত এটা ওঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু অর্জুন আপত্তি করেছিল। প্রমাণ হাতে না আসা পর্যন্ত সন্দীপকে গ্রেফতার করলে ভুল করা হবে। লুঠ করা টাকাগুলো নিশ্চয়ই সন্দীপ বাড়িতে রাখেনি। বেড়ালটাকেও সে উধাও করে দিয়েছে। জামিন পেতে তার কোনও অসুবিধে হবে না। কোনও সাক্ষীকে হাজির করানো যাবে না ওকে শনাক্ত করতে।
ডায়েরির সূত্র ধরে অবনীবাবু নিশ্চয়ই ওর বাড়িতে যেতে পারেন। কিন্তু রাতদুপুরে যাওয়াটা অত্যন্ত অশোভন বলে উনি আজ সকালে যাবেন বলে ঠিক করেছেন।
বেরোবার আগে মা বললেন, হ্যাঁ রে, ওরা কি আজ দুপুরে এখানে খাবে?
বলতে পারছি না মা। যদি খেতে চায় তোমায় জানিয়ে দেব।
বেশি বেলা করিস না। অন্তত ঘণ্টা দুই আগে বলিস।
অর্জুন হেসে ফেলল। মেজরকে বেঁধে খাওয়াতে ইচ্ছে করছে, অথচ মা সরাসরি বলতে পারছে না।
সার্কিট হাউসে গিয়ে অর্জুন জানতে পারল মেজর এবং গোরান সুলম্যান বেরিয়ে গেছেন। ওঁরা গিয়েছেন একটা রিকশায়। রিকশাওলার সঙ্গে নাকি সারাদিনের চুক্তি হয়েছে। চৌকিদার জানাল, বলে গেছেন দুপুরে খাবেন না।
জলপাইগুড়ি শহরে সারাদিন ঘুরে দেখার মতো কিছু নেই। অর্জুন একটু ক্ষুণ্ণ হল এই ভেবে যে, মেজর তার জন্যে কোনও খবর রেখে যাননি। গতকাল ওঁরা সমস্ত জিনিসপত্র অমল সোমের বাড়িতে রেখে এসেছিলেন। কোনও কারণে যদি ওই বাড়িতে একবার ওঁদের যেতে হয় ভেবে অর্জুন বাইক ঘোরাল।
হাবু বাগান পরিষ্কার করছিল। অর্জুনকে দেখে দাঁত বের করে হেসে উঠে দাঁড়াল। অর্জুন হাত নেড়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল মেজর এসেছিলেন কিনা। এটা করতে গিয়ে তাকে দুহাতে মেজরের ভুড়ি এবং গালে হাত বুলিয়ে দাড়ি দেখাতে হল।
হাবু সঙ্গে সঙ্গে মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলল। তারপর আঙুলের মুদ্রায় জানাল ওঁরা চলে গিয়েছেন। কোথায় গিয়েছেন জিজ্ঞেস করার কোনও অর্থ হয় না ভেবে অর্জুন গেটের দিকে ফিরে যাচ্ছিল কিন্তু হাবু আঁ আঁ শব্দ করে পেছনে আসতে লাগল। অর্জুন অবাক হয়ে তাকাতে হাবু ইশারায় যা বোঝাতে চাইল তা প্রথমে বোধগম্য হল না। কেউ ওর ইশারায় না বুঝলে খুব চটে যায় হাবু, মুখের অভিব্যক্তি পালটে যায়। তখন থুতু ছিটোয় মুখ থেকে। একটু সরে ভাল করে বোঝার চেষ্টা করল অর্জুন। শেষ পর্যন্ত ধরতে পারল। কেউ শুয়ে আছে আর তার নীচে দেশলাই জ্বেলে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, এইরকম বোঝাতে চাইছে হাবু।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কেউ মারা গিয়েছে?
হাবু মাথা নাড়ল, না। তারপর হাত নেড়ে বোঝাতে চাইল সেখানেই গেছেন ওঁরা। অর্জুন খুব অবাক হল, শ্মশানে গেছেন?
এবার খুশিতে উজ্জ্বল হল হাবু। ঘন ঘন মাথা নাড়তে লাগল।
মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছিল না অর্জুন। জলপাইগুড়িতে এসে মেজর কেন গোরানসাহেবকে নিয়ে শ্মশানে যাবেন? বোঝাই যাচ্ছে ওঁদের কথাবার্তা হাবু শুনতে পেয়েছে। ও ভুল করতেই পারে তবু শ্মশানটা দেখে এলেই হয়।
জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি শহরে যাওয়ার পথে ডান দিকে যে শ্মশানটা রয়েছে সেটা একসময় শহরের বাইরে বুলে নির্জন ছিল। এখন শহর বাড়তে শুরু করার পর তার আশেপাশে বাড়িঘর হয়ে গেছে। পাশের যে সরু নদীটায় আগে জুল থাকত সেটাও শুকিয়ে গেছে। বাইক থেকে নেমে শ্মশানে ঢুকল অর্জুন। এই সকালে শহরের কাউকে দাহ করতে আনা হয়নি বলে কোনও চিতা জ্বলছে না। মেজর বা গোরানসাহেবকে কোথাও দেখল না সে। শুধু কয়েকটা অকেজো মানুষ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে আছে।
বাবু, ডেডবডি আসবে নাকি?
অর্জুন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল দড়ি পাকানো চেহারার একটি প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। সে মাথা নাড়ল। তারপর জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আজ সকালে রিকশায় দুই ভদ্রলোককে এখানে আসতে দেখেছেন? একজন খুব মোটা, গোঁফওয়ালা, আর দ্বিতীয়জন বিদেশি।
সাহেব?
হ্যাঁ। আমরা এককালে সাহেবই বলতাম।
এসেছিল। এই আমাকেই জিজ্ঞেস করল এই শ্মশানে কোনও সাধু আছে কিনা। এখানে সাধু থাকবে কী করে? ওদের বলে দিলাম অন্য শ্মশানের খোঁজ করতে।
কোথায় গেল ওরা?
দেবী চৌধুরানীর কালীমন্দিরের ওপাশে যে শ্মশান আছে, সেখানে চলে গেল। রিকশাওলাটা আজ ভাল কামাবে। লোকটা হাসল।
রিকশাওলাটাকে তুমি চেনো?
চিনব না? এখানে টান মারতে আসে। রিকশার হ্যান্ডেলে চাকা লাগিয়েছে, প্যাডল করলেই বনবন করে ঘোরে। লোকটা বলল।
শ্মশান থেকে বেরিয়ে এল অর্জুন। হঠাৎ মেজর কেন সাধুর খোঁজে শ্মশানে ঘুরছেন? কাল রাত্রে তো এসব কথা বলেননি। আর শ্মশানে তো শুধু সাধুসন্ন্যাসীরাই থাকেন না, বাজে লোকেরও তো এটা আস্তানা। বিপদে পড়ার সম্ভাবনা কম নয়।
এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের রাস্তা ছেড়ে খানিকটা দূরে যাওয়ার পর দ্বিতীয় শোনটা দেখতে পেল অর্জুন। বাইক থামিয়ে বুঝতে পারল এখানে ওরা নেই। রাস্তা থেকেই জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এটি এককালে শ্মশান ছিল কিন্তু এখন শহরের লোকজন এখানে মৃতদেহ দাহ করাতে আসে না। মিছিমিছি না ঘুরে রাজবাড়ির সামনে দিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে বলে অর্জুন এগোতেই দূর থেকে রিকশাটা দেখতে পেল। খালি রিকশা ছুটে আসছে। গলা খুলে হিন্দি সিনেমার গান গাইছে রিকশাওলা। আর একটু কাছাকাছি হতে দেখা গেল রিকশার হ্যান্ডেলে রঙিন গোলাকার কিছু বনবন করে ঘুরছে। মাথায় কথাটা আসামাত্র অর্জুন বাইক থামিয়ে লোকটাকে থামতে বলে। ব্রেক কষলেও খানিকটা এগিয়ে গেল লোকটা। তারপর চিৎকার করে বলল, আজকে আর রিকশা চালাব না বাবু, আপনি অন্য রিকশা দেখুন।
অর্জুন বাইক ঘুরিয়ে রিকশার পাশে চলে এল, অনেক রোজগার হয়ে গেছে?
হ্যাঁ বাবু। রিকশাওলা হাসল। ওদের দুজনকে কোথায় ছেড়ে এলে?
আপনি—।
আমি ওদের বন্ধু।
অ। ওঁরা গাড়ি ভাড়া করে চলে গেলেন। আমাকে কন্ট্রাক্টের টাকা দিয়ে দিয়েছেন। আপনি তো এখানেই থাকেন, না?
হ্যাঁ। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ওঁরা কোথায় গিয়েছেন?
শ্মশান ঘুরতে। বার্নিশের ওখানে প্রথমে গিয়েছেন।
অর্জুন দাঁড়াল না৷ তিস্তা ব্রিজ পার হয়ে বার্নিশে পৌঁছে খোঁজ করতে করতে শ্মশানে চলে এল। এসেই বুঝল ওঁরা এখানে নেই, থাকলে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত। এখানে শোন মাঠের ওপর। ছন্নছাড়া। কিছু খবর পাওয়ার আশায় সে বাইক থেকে নামতেই গলা শুনতে পেল, বাবু!
অর্জুন গোরক্ষনাথকে এখানে আশা করেনি। গোরক্ষনাথ ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে। আজ ওর পরনে গেরুয়া লুঙ্গি, গেরুয়া পাঞ্জাবি, কাঁধে বিশাল ঝোলা।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এখানে?
এই শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়ানোটাই তো আমার কাজ। আপনার তো এসবে ঠিক আস্থা নেই, আপনি কীসের সন্ধানে এলেন?
বিদেশ থেকে দুজন মানুষ এসেছেন। আমার বিশেষ পরিচিত। ওঁরাও শ্মশান ঘুরতে বেরিয়েছেন। ওঁদের খোঁজে এসেছি।
দুজনের একজন কি সাহেব?
হ্যাঁ। এখানে এসেছিলেন ওঁরা?
আমি দেখিনি। একটু আগে শুনলাম, এখানে তান্ত্রিকের খোঁজ করছিলেন। তা বাবু, জলপাইগুড়ির শ্মশানে তো তান্ত্রিকরা নিয়মিত থাকেন না, হঠাৎ হঠাৎ আসেন।
ওঁরা কোথায় গিয়েছেন?
ধুকুয়ামারির শ্মশানে একজন সাধু আছেন, তাঁর কাছে গিয়েছেন বলে অনুমান করি। ধুকুয়ামারির কথা এখান থেকেই ওঁরা জেনেছেন।
সেটা এখান থেকে কতদূরে?
দূর আছে। আপনি যাবেন?
হ্যাঁ।
গোরক্ষনাথ অর্জুনের বাইকের দিকে তাকাল, আমাকে যদি পেছনে বসতে দেন তা হলে সঙ্গে যেতে পারি। সাধুর কথা কদিন থেকে শুনছি, চোখে দেখে আসি৷
বেশ তো। অর্জুন বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল। ওটাকে ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে নিয়ে যেতে যেতে সে জিজ্ঞেস করল, কাক, শকুন আর বেড়ালের খবর কী?
আপনি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন বাবু?
আমি তো কিছুই করিনি, শুধু জানতে চাইছি ওদের পাওয়া গেল কিনা?
সহজে কি যায়? দুর্লভ বস্তু। উঠব?
হ্যাঁ।
গোরক্ষনাথ উঠে বসতে অর্জুন বলল, কালো বেড়াল, যার চোখ অন্ধকারে জ্বলে, তাকে পেতে তো তেমন অসুবিধে নেই। এই শহরেই আছে।
থাকলেই তো হল না, কোথাও না কোথাও খুঁত থাকবেই। হয় চেহারায়, নয় ব্যবহারে। এই তো হয় মুশকিল। গোরক্ষনাথ শক্ত করে হাতল ধরে বলল।
ব্যবহারের খুঁত কীরকম?
সে অনেক ব্যাপার। আমাদের চারপাশে অদৃশ্য হয়ে যাঁরা ঘুরে বেড়ান, তাঁদের জব্দ করা তো সোজা কথা নয়! একটু খুঁত থাকলেই সব শেষ।
অর্জুন বাইক চালু করল, তা তো বটেই। কাক বা শকুনের ব্যাপারটা সত্যি কঠিন, কিন্তু ওই ধরনের বেড়াল তো গতকালই পাওয়া গিয়েছে, তাই না?
মুখ না দেখতে পেলেও অর্জুন বুঝতে পারল গোরক্ষনাথ খুব অবাক হয়ে গিয়েছে। তার গলা বদলে গেল, আপনি কী করে জানতে পারলেন?
দেখুন, কোনও সাধারণ মানুষ, কালো বেড়াল মার চোখ অন্ধকারে জ্বলে তাকে বাড়িতে নিয়ে এসে পুষতে চাইবে না। কালো বেড়ালকে সবাই অমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে ভাবে। তার ওপর যদি ওটা বাচ্চা না হয় তা হলে তো কথাই নেই। অর্জুন বাইক চালাতে চালাতে বলছিল, গত রাত্রে রেসকোর্সের কাছে একটা বাড়ি থেকে কালো বেড়াল চুরি গিয়েছে, যার চোখ অন্ধকারে জ্বলে।
কী বলছেন বাবু, চুরি গিয়েছে?
হ্যাঁ। যাঁর বেড়াল তিনি ডায়েরি করেছেন থানায় এসে।
আপনার কি মনে হয় আমি ওটাকে চুরি করেছি?
আমি জানি না। তবে প্রয়োজন পড়লে তো মানুষ অনেক কিছু করে। সামনের রাস্তাটা দুদিকে ভাগ হয়েছে, কোনদিকে যাব?
ডান হাতের রাস্তা। কিন্তু বাবু, আমি চুরি করিনি।
তা হলে শহরে আর-একজন মানুষ আছে, যার কালো বেড়াল প্রয়োজন। অর্জুন বলল, সন্দীপ মিথ্যে ডায়েরি করবে কেন?
সন্দীপবাবুই ডায়েরি করেছেন?
বাঃ, ওর সঙ্গে চেনাশোনা আছে?
না, ঠিক চিনি না।
মিথ্যে বলা কি ঠিক হচ্ছে? গোরক্ষনাথ, ভূতপ্রেত হয়তো তেমন কিছু করলে ভয় পেতে পারে, পুলিশ কিন্তু পাবে না।
পুলিশ আমাকে ধরবে?
সন্দীপের বেড়াল চুরি করলে নিশ্চয়ই ধরবে।
কিন্তু আমি চুরি করিনি। খবর পেয়ে ওই বাড়িতে গিয়েছিলাম। চাকরের কাছে বেড়ালটার যা বর্ণনা পেলাম তাতে মনে হল ওইরকম একটাকেই আমি খুঁজছি। একদিন সন্দীপবাবুর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি তো আমাকে প্রায় মারতে বাকি রেখেছিলেন। কোথায় থাকি, কী করি, জেনে নিয়ে তাড়িয়ে দিলেন।
তারপর?
দুপাশে তখন জঙ্গল শুরু হয়ে গিয়েছে। কীরকম স্যাঁতসেঁতে গন্ধ বাতাসে। গোরক্ষনাথ বলল, কাল রাত্রে আমি অবাক। উনি, মানে সন্দীপবাবু আমার বাড়িতে আসবেন, আমি ভাবতে পারিনি। বললেন, আমি যেন কয়েকদিন বেড়ালটাকে আমার কাছে রেখে দেখি ও পোষ মানছে কিনা। দশদিন পরে এসে খোঁজ নেবেন। আর বেড়ালটার কোনও ক্ষতি হলে উনি সহ্য করবেন না। বলুন, আমি কি চুরি করেছি?
সন্দীপ যে গিয়েছিল, আপনার সঙ্গে এসব কথা হয়েছে, তার কোনও সাক্ষী আছে?
সাক্ষী? গোরনাথ যেন একটু ভাবল, তারপর বলল, ওই বেড়ালটাই তো আমার কাছে আছে। আমার তো সংসার নেই, যে বুড়িটা দুটো বেঁধে দেয়, সে সব শুনেছে।
বাঁক ঘুরতেই গাড়িটাকে দেখতে পেল। পুরনো অ্যাম্বাসাড়ার গাড়িটা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ড্রাইভার পেছনের সিটে শুয়ে আছে। জঙ্গলে ঘেরা কিছুটা খোলা জমি যে শ্মশান, তা বুঝতে অসুবিধে হল না। ওপাশে দুটো টিনের বাসাওয়ালা ঘর দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মেজরদের দেখতে পেল না অর্জুন।
এখানে তেনারা আছেন। গোরক্ষনাথ বাইক থেকে নেমে নাক টানল।
কারা?
তেনার। আমি ঘ্রাণ পাচ্ছি। হ্যাঁ, আছেন। ধুকুয়ামারির এই শ্মশানের নাম শুনেছিলাম। কিন্তু কখনও আসা হয়নি। দুটো হাত মাথার ওপরে তুলে তিন-চারবার কাউকে নমস্কার জানাল গোরক্ষনাথ। অর্জুনের হাসি পাচ্ছিল। গোরক্ষনাথ এমনভাবে কথা বলল, যেন সত্যি ভূতপ্রেতরা এই শ্মশানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে বলল, চলুন, একটু ঘুরে দেখা যাক। আর হ্যাঁ, সামনে যদি তেনাদের কেউ পড়েন তা হলে আমাকে সতর্ক করে দেবেন, যাতে ধাক্কা না লাগে। অর্জুন পা বাড়াল।
পেছন পেছন আসছিল গোরনাথ, আমি জানি আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, ঠাট্টা করছেন। কিন্তু আপনাকে আমি প্রমাণ দেবই।
ওদের কথা শুনেই হয়তো একটা ঘর থেকে রোগা লিকলিকে এবং খাটো শরীরের মানুষটি বেরিয়ে এল। ঊর্ধ্বাঙ্গে কিছু নেই, একটা হাফপ্যান্ট জাতীয় বস্তু পরনে। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী চাই?
অর্জুনের আগেই গোরক্ষনাথ জবাব দিল, সাধুদর্শনে এসেছি ভাই।
কোত্থেকে আসা হচ্ছে?
জলপাইগুড়ি শহর থেকে।
এখন তার দর্শন পাবেন না।
একটু যদি অনুগ্রহ করেন, অনেকদূর থেকে এলাম–।
ওই যে গাড়ি দেখছেন, এতে করে সেই আমেরিকা থেকে দুজন এসেছেন। বাবা তাঁদের সঙ্গে দেখা করেননি। শ্মশানে মড়া না এলে বাবা কাউকে দর্শন দেন না। মড়া নিয়ে আসুন, বাবাও দর্শন দেকেন। কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়াল লোকটাও।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, যাঁরা ওই গাড়িতে এসেছেন তাঁরা কোথায়?
লোকটা উলটোদিকের জঙ্গলটা হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। গোরক্ষনাথ বলল, কী সর্বনাশ। মড়া পাই কোথায়?
অর্জুন কোনও কথা না বলে সোজা এগিয়ে গেল। সরু পায়েচলা পথটায় পা দিতে মেজরের গলা শুনতে পেল। বেশ রেগে গিয়েছেন, তুমি তো হে চাণক্যের যমজ ভাই, পাজির পাঝাড়া। আমাকে তুমি চেনো না? আফ্রিকার কতবড় শয়তানকে এক ঘুসিতে শুইয়ে দিয়েছি আর তুমি তো তার তুলনায় একটা আস্ত ছারপোকা দাও, আসলি জিনিস চাই।
অর্জুন কয়েক পা এগোতেই ওদের দেখতে পেল। একটা ডোবার পাশে পাথরের ওপর বসে আছেন মেজর। তাঁর সামনে দুটো বড় মাটির হাঁড়ি নিয়ে বসে আছে একজন বৃদ্ধ আদিবাসী। মেজরের ধমক খেয়ে হাঁড়ি থেকে তরল পদার্থ মাটির গ্লাসে ঢেলে এগিয়ে ধরল সামনে। খপ করে সেটি নিয়ে মেজর একটু গলায় ঢাললেন। তারপর সোল্লাসে বলে উঠলেন, গ্রেট। এই তো, এই জিনিস চাই। সক্রেটিস যদি তোমাকে পেত তা হলে কক্ষনো ছাড়ত না। আঃ! পুরোটা গলায় চালান করে মাথা নাড়লেন মেজর।
আপনি হাঁড়িয়া খাচ্ছেন? অর্জুনের মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে এল।
মেজর মুখ ফেরালেন। চোখ ছোট করে দেখার চেষ্টা করলেন, হু আর ইউ? কে তুমি? কোন সেন্ট?
আমি অর্জুন।
ও, তৃতীয় পাণ্ডব। তাই বলো? এসো এসো। বুঝলে, আমি পৃথিবীর কত জায়গায় গিয়েছি, গিয়ে সেখানকার সেরা জিনিস পান করেছি। কিন্তু এর মতো ভাল পানীয় কোথাও পাইনি। শুধু এই বস্তু ভালভাবে বোতলে ভরে রফতানি করলে তুমি টাকার পাহাড়ের ওপর শুয়ে থাকতে পারবে।
আমি আপনাকে সকাল থেকে খুঁজছি।
হোয়াই? আমি যে তোমার মাকে বলে এলাম দুপুরে খাব, তুমি খবর পাওনি? মেজর চোখ বড় করলেন।
আপনি আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন?
ইয়েস। তারপর থেকে শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে বেড়াচ্ছি গোরানের সঙ্গে। সে ব্যাটা গেল কোথায়? মেজর উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে সফল হলেন।
এই সময় পাশের জঙ্গল থেকে গোরানসাহেব বেরিয়ে এলেন। তাঁর শার্ট ছিঁড়ে গেছে। ডান হাতে একটা পাখি ছটফট করছে। গোরক্ষনাথের দিকে গোরানসাহেব তাকাতেই সে শিউরে উঠল। অর্জুন শুনল, বাবু, ইনি কে?
কেন?
দেখছেন না শকুন ধরে এনেছেন। বাবু, সাবধান। গোরক্ষনাথ থরথর করে কাঁপছিল।