সকালবেলা হইচই-চেঁচামেচি শুনে তিতুনির ঘুম ভাঙল। সে ধড়মড় করে উঠে বসে এদিক-সেদিক তাকায়, মেয়েটা কোথাও নেই। তিতুনি বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে দেখল, বিছানার নিচে এবং ফ্যানের উপরেও দেখল। সেখানেও নাই, তখন দরজার দিকে তাকাল, দরজার ছিটকিনি খোলা, তার মানে মেয়েটা ঘর থেকে বের হয়েছে। এই মেয়েটার কারণেই কী হইচই? তিতুনি কান পেতে শোনার চেষ্টা করল, দরজা খোলাসংক্রান্ত একটা বিষয় নিয়ে আম্মু চিৎকার করছেন। তিতুনি তখন সাবধানে ঘর থেকে বের হলো, বাইরের ঘরে এসে উঁকি দিল।
আম্মু চিৎকার করে বলছেন, “এই বাসায় সব দায়িত্ব আমার? দরজা খোলা রেখে সব মানুষ ঘুমিয়ে গেল? এইটা কী একটা বাসা নাকি হোটেল?”
তিতুনি পরিষ্কার করে বুঝতে পারল না দরজা খোলার সাথে হোটেলের কী সম্পর্ক। এখন সেটা নিয়ে কথা বলাটাও অবশ্যি ঠিক হবে না। দরজাটা কেন খোলা সেটাও তিতুনি বুঝতে পারল। কেউ ঘুম থেকে ওঠার আগে তিতুনির মতো দেখতে এলিয়েন মেয়েটা দরজা খুলে বের হয়ে গেছে।
আম্মু বললেন, “কেন সবকিছু আমাকে দেখতে হবে? আমি একদিন দেখলাম না আর সবাই দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়ে গেল?”
আব্বুও ঘুম ঘুম চোখে উঠে এসেছেন, বললেন, “আমার স্পষ্ট মনে আছে দরজার ছিটকিনি লাগানো–”
আম্মু আব্বকে কথা শেষ করতে দিলেন না, বললেন, “তোমার মনে থাকলেই তো হবে না। দরজার ছিটকিনি লাগানো থাকলে সেটা খুলল কে? ভূত?”
আম্মু আরো কথা বলতে থাকলেন, তখন তিতুনি সরে এলো। হাত-মুখ ধুয়ে স্কুলের ড্রেস পরতে গিয়ে আবিষ্কার করল সেটা নাই। এলিয়েন মেয়েটি সকালবেলা তার স্কুলের পোশাক পরে বের হয়ে গেছে। কী সর্বনাশ! সে কী এখন তার স্কুলে হাজির হয়ে যাবে?
তিতুনি খুঁজে তার অন্য পোশাকটা বের করে সেটা পরল। একটু ময়লা হয়ে আছে, ধোয়া দরকার কিন্তু এখন সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করার সময় নেই।
খাবার টেবিলে সবাই যখন নাশতা খেতে বসেছে তখন আম্মু হঠাৎ করে একটুখানি হাসি এবং একটুখানি অবাক মুখ করে তিতুনিকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা! তোর গত রাতে হয়েছিলটা কী?”
তিতুনির কী হয়েছিল সে জানে না। ভেতরে ভেতরে সে ভয়ানক চমকে উঠল। নিশ্চয়ই গত রাতে এলিয়েন তিতুনি কিছু একটা করেছে, সেটা সে জানে না। এটা যদি সবাই বুঝে ফেলে তাহলে বিপদ, আবার আম্মুর প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে-না দিলে সেটাও বিপদ। কী করবে বুঝতে না পেরে সে মুখের মাঝে খানিকটা লজ্জা খানিকটা ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে বসে রইল।
টোটন ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছিল আম্মু? তিতুনি কী করেছিল?”
আম্মু একবার তিতুনির মুখের দিকে তাকালেন তারপর অন্যদের দিকে তাকালেন, বললেন, “রাত্রে হঠাৎ দেখি ঘরে আলো জ্বলছে, টুং টাং শব্দ। উঠে এসে দেখি ফ্রিজ খুলে খাবার বের করে তিতুনি খাচ্ছে।”
টোটন এমন একটা মুখের ভঙ্গি করল যেন খাওয়াটা একটা খুবই জঘন্য কাজ। মুখটা বিকৃত করে বলল, “খাচ্ছে?”
“হ্যাঁ। সে কী খাওয়া। আমি অবাক হয়ে গেলাম-তোর হয়েছিল কী? গভীর রাতে এত খিদে লেগে গেল?”
তিতুনি কোনোমতে মুখে একটা স্বাভাবিক ভাব ধরে রেখে বলল, “হ্যাঁ আম্মু, রাত্রে হঠাৎ কেন জানি খিদে লেগে গেল!”
“খিদে লেগেছে তো আমাকে ডেকে তুলে সেটা বল। খাবার গরম করে দিই। ঠাণ্ডা ভাত-তরকারি যেভাবে গপগপ করে খাওয়া শুরু করলি!”
তিতুনি কিছু বলল না। আব্বু বললেন, “গ্লোয়িং স্টেজ তো, এ রকম হয়। বাচ্চারা ধীরে ধীরে বড় হয় না-হঠাৎ হঠাৎ বড় হয়। তিতুনির নিশ্চয়ই সে রকম একটা স্টেজ যাচ্ছে–”
তিতুনি খুব সাবধানে বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিল। এলিয়েন মেয়েটা রাক্ষসের মতো খেয়ে তাকে আরেকটু হলে বিপদে ফেলে দিত।
.
তিতুনির স্কুলটা বাসা থেকে বেশ দূরে, বড় সড়কটা ধরে হেঁটে হেঁটে সে স্কুলে যায়। এটা মোটেও ঢাকা শহরের মতো না, বড় সড়কটায় বাস, টেম্পো, ট্রাক কিছু নেই। একটা-দুইটা রিকশা যায়, মাঝে মাঝে একটা মোটরসাইকেল। যদি কখনো একটা গাড়ি যায় তাহলে সবাই মাথা ঘুরিয়ে দেখে কার গাড়ি কোথায় যাচ্ছে।
তিতুনি সড়কটা ধরে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, একটু আগে বাসা থেকে বের হয়েছে, তাই সড়কটাতে স্কুলের ছেলে-মেয়ে বেশি নেই। একটু পরেই তাদের গার্লস স্কুলের মেয়ে আর সরকারি স্কুলের ছেলেদের দিয়ে সড়কটা ভরে যাবে। তিতুনি একটু অন্যমনস্কভাবে হাঁটছে, সে এমন একটা ঝামেলার মাঝে পড়েছে, যার থেকে বের হবার কোনো রাস্তাই খোলা নেই। ছোটখাটো ঝামেলা হলে সে তার ক্লাশের বন্ধু রিতু কিংবা মাইশা কিংবা ঝিনুর সাথে কথা বলতে পারত, একটু বুদ্ধি পরামর্শ নিতে পারত। কিন্তু এই সমস্যাটা এমনই জটিল যে কারো সাথে সেটা নিয়ে কথাও বলতে পারছে না। কাউকে বললে সে বিশ্বাসও করবে না। এলিয়েন মেয়েটি আজকে তার স্কুলের ড্রেস পরে বের হয়ে গেছে। এখন যদি স্কুলে এসে হাজির হয় তখন কী হবে? ব্যাপারটা চিন্তা করেই তার গায়ে কেমন জানি কাঁটা দিয়ে উঠল।
ঠিক তখন তিতুনির একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল। সড়কের পাশে একটা ডোবার মতো আছে, সেই ভোবার পাশে একটা বড় গাছ, গাছটা ডোবার দিকে হেলে পড়েছে। একটা বড় ডাল ডোবার মাঝামাঝি পর্যন্ত গিয়েছে, সেই ডালটা থেকে আরো ডাল এমনভাবে বের হয়েছে যে দেখে মনে হয় কেউ একজন খুব আরাম করে সেখানে হেলান দিয়ে বসতে পারবে। শুধু তা-ই না, সেখানে বসে ডালটাকে দুলিয়ে দিলে মনে হয় সেটা দোলনার মতো দুলতে থাকবে। তিতুনি যখনই সড়কের কাছে এই ডোবা আর এই গাছটার পাশে দিয়ে গেছে তখনই সে মনে মনে ভেবেছে, একদিন আমি ডালে বসে বসে দোল খাব। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনোদিনও তার এই ডালে উঠে দোল খাওয়া হয়নি। আজকে তিতুনি দেখল ডোবার ওপর হেলে পড়া গাছের ডালটাতে হেলান দিয়ে একটা মেয়ে বসে আছে, মেয়েটা তাদের স্কুলের ড্রেস পরে আছে, শুধু তা-ই না, তিতুনি যেভাবে ভেবেছিল ঠিক সেইভাবে গাছের ডালটাকে দোল দিচ্ছে।
এক মুহূর্ত পরে তিতুনি বুঝতে পারল গাছের ডালটাতে যে বসে আছে সে অন্য-তিতুনি! সে এত দিন ধরে যে কাজটা করবে বলে ঠিক করে রেখেছিল কিন্তু কোনোদিন করতে পারেনি আজকে এই মেয়েটা সেই কাজটাই করে ফেলছে। তিতুনি প্রথমে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ তাদের দেখছে কি না, তারপর গাছটার পাশে দাঁড়িয়ে ডাকল, “এই মেয়ে।”
মেয়েটা তার দিকে না তাকিয়ে উত্তর দিল, “আমার নাম তিতুনি।”
তিতুনি হিংস্র গলায় বলল, “ঠিক আছে। এই তিতুনি।”
মেয়েটা ঘুরে তিতুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হলো?”
“তুমি এখানে কী করছ?”
“গাছে দোল খাচ্ছি।”
“কেন?”
“তার কারণ হচ্ছ তুমি। তুমি সব সময় এই গাছে উঠে দোল খেতে চেয়েছ কিন্তু খাও নাই। আমার এত সময় নাই, যা করার করে ফেলতে হবে। তাই আজকেই দোল খাচ্ছি।”
“যদি কেউ দেখে ফেলে?”
“দেখলে দেখবে।”
তিতুনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি আসলে কী চাও, আমাকে বলবে?”
মেয়েটা কিছুক্ষণ গাছের ডালে বসে তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর গাছ থেকে নেমে আসতে শুরু করল। তিতুনি ভয়ে ভয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে থাকে, তার পরিচিত কেউ যদি এখন হঠাৎ করে চলে আসে তখন কী হবে?
মেয়েটা নিচে নেমে এসে বলল, “চলো।”
“কোথায়?”
“স্কুলে।”
তিতুনি ভয় পাওয়া গলায় বলল, “স্কুলে?”
“হ্যাঁ।”
“দুইজন একসাথে?”
মেয়েটা মাথা নাড়ল, “না, ঠিক একসাথে না, একটু আগে-পরে। তাহলে ঝামেলা কম হবে।”
“ঝামেলা কম হবে?” তিতুনি গরম হয়ে বলল, “একটা ক্লাশে দুইজন তিতুনি আর সেটা ঝামেলা কম?”
মেয়েটা ভালো মানুষের মতো হাসল, বলল, “তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন? আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি স্কুলের কেউ আমাদের দুইজনকে একসাথে দেখবে না। হয় তোমাকে দেখবে না হয় আমাকে দেখবে। কখনোই বুঝবে না আমরা দুইজন আলাদা মানুষ।”
“সেটা কেমন করে হবে?”
মেয়েটা বলল, “সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও।”
“তোমার উপর ছেড়ে দিলে কী হয় সেটা আমার খুব ভালো জানা আছে। টোটন আমাদের দুইজনকে একসাথে দেখার পর কি ঝামেলা হয়েছিল মনে আছে?”
মেয়েটা বলল, “মনে আছে। আর সেটা আমার জন্যে হয় নাই, সেটা হয়েছে তোমার মাতবরির জন্যে।”
তিতুনি চোখ পাকিয়ে বলল, “আমার মাতবরি? আমি কী মাতবরি করেছিলাম?”
“পুরো একটা নাটক করলে-আমাকে ফ্যানের উপর বসে থাকতে হলো।”
“তাহলে আমার কী করা উচিত ছিল?”
“আমার উপরে ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল।”
“তাহলে তুমি কী করতে?”
“আমি টোটনের মাথার ভেতরে ঢুকে তার নিউরন থেকে দুইজনকে একসাথে দেখার দৃশ্যটা মুছে দিতাম।”
তিতুনি মুখ হাঁ করে বলল, “তুমি কী করতে?”
“বললাম তো, যেসব নিউরনে দৃশ্যটা আছে সেটা মুছে দিতাম। দুইজনকে একসাথে দেখার কোনো স্মৃতি থাকত না। কেস কমপ্লিট।”
তিতুনি মুখ হাঁ করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী করতে?”
মেয়েটা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “এক কথা কয়বার বলব?”
তিতুনি রীতিমতো কষ্ট করে তার হাঁ হয়ে থাকা মুখটা বন্ধ করে বলল, “তুমি যখন ইচ্ছা যার মাথার ভেতরে ঢুকে যা খুশি তাই করতে পারো?”
মেয়েটা কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল, যেন এটা এমন কোনো ব্যাপারই না। তিতুনি আবার জিজ্ঞেস করল, “কীভাবে?”
মেয়েটা কেমন যেন হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “তুমি কেন ভুলে যাচ্ছ আমি তোমার মতো দেখতে হলেও তোমার মতো বোকাসোকা, সাদাসিধে মানুষ না। আমি অনেক দূর গ্যালাক্সি থেকে এসেছি; অনেক উন্নত, অনেক বুদ্ধিমান একটা প্রাণী-যার ক্ষমতা তুমি কিংবা তোমাদের মানুষের চৌদ্দ গুষ্টি কল্পনা করতে পারবে না।”
তিতুনি মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি যে মহাকাশের যত বড় লাট সাহেবই হও না কেন, তুমি কিন্তু খুবই খারাপ ভাষায় কথা বলছ।”
“সেটা আমার দোষ না, সেটা তোমার দোষ। তোমার সাথে কথা বলার জন্য আমি তোমার ব্রেন ব্যবহার করছি, তুমি যেভাবে কথা বলো আমি সেভাবে কথা বলছি। এইগুলি আমার কথা না, এইগুলি তোমার কথা, তুমি নিজে ভদ্রভাবে কথা বলা প্র্যাকটিস করে তারপর আমাকে উপদেশ দিও।”
তিতুনি বকুনিটা হজম করে বলল, “তোমরা কীভাবে কথা বলো?”
“আমরা কথা বলি না।”
“কথা বলো না? একজনের সামনে আরেকজন মুখ ভোঁতা করে বসে থাকো?”
মেয়েটা ফিক করে হেসে ফেলল, বলল, “আমাদের মুখ নাই, তাই মুখ ভোঁতা করার উপায় নাই।”
“মুখ নাই?” তিতুনি রীতিমতো চিৎকার করে বলল, “তাহলে খাও কোন দিক দিয়ে?”
মেয়েটা বলল, “তোমাকে এগুলো বোঝাতে সময় লাগবে। তুমি ধরেই নিয়েছ মহাজাগতিক প্রাণীদেরও তোমাদের মতো হাত, পা, মুখ থাকতে হবে, খেতে হবে, কথা বলতে হবে। সেটা সত্যি নয়। হাত, পা, মুখ ছাড়াও প্রাণী হওয়া সম্ভব। তোমাদের সাথে মহাজাগতিক প্রাণীর শুধু একটা জায়গায় মিল আছে।”
“সেটা কী?”
“তোমরা নূতন জিনিস জানতে চাও। আমরাও চাই।”
তিতুনি মুখ শক্ত করে বলল, “সরি।”
মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, “সরি?”
“হ্যাঁ, আমার নূতন জিনিস জানার কোনো ইচ্ছা নাই। কেন আমার এলজেবরা শিখতে হবে? বাংলা ব্যাকরণ শিখতে হবে? তেলাপোকা কীভাবে খাবার হজম করে জেনে আমার কী লাভ?”
মেয়েটা আবার হেসে ফেলল, বলল, “আমি জানি। কিন্তু তোমাদের পৃথিবীর বোকাসোকা মানুষেরা যে এ পর্যন্ত টিকে আছে তার কারণ হচ্ছে মানুষ সব সময় নূতন জিনিস জানতে চায়।”
“আমি চাই না।”
“চাও। তাই একটু পরে পরে আমার কাছে আমাদের সম্পর্কে জানতে চাইছ। আমরা কীভাবে কথা বলি। কীভাবে খাই।”
তিতুনি মুখ শক্ত করে বলল, “সেটা অন্য কথা।”
“অন্য কথা না, একই কথা।”
হঠাৎ করে তিতুনি কেমন যেন আতঙ্কে জমে গেল, বলল, “সর্বনাশ!”
“কী হয়েছে?”
“মাহতাব চাচা।”
মেয়েটা সামনে তাকাল, দেখল আব্বুর দূর সম্পর্কের ভাই মাহতাব চাচা বগলে একটা ছাতা আর হাতে একটা বাজারের ব্যাগ নিয়ে সড়ক ধরে আসছেন। তিতুনি শুকনো গলায় বলল, “এখন কী হবে?”
মেয়েটা বলল, “আমার উপর ছেড়ে দাও। আমি যা বলব তুমি ঠিক তাই করবে।”
“ঠিক আছে।”
দুজনে হেঁটে যেতে লাগল, মাহতাব চাচা আরেকটু কাছে আসার পর হঠাৎ মেয়েটা বলল, “এখন।”
“এখন কী?”
“তুমি নিচু হয়ে ভান করো তোমার জুতার ফিতে খুলে গেছে, সেটা বাঁধার চেষ্টা করো। মাথাটা নিচু করে রেখে যেন তোমার চেহারা দেখতে না পায়।”
তিতুনি মাথা নিচু করে জুতার ফিতা বাঁধার ভান করতে লাগল আর মাহতাব চাচা কাছে এসে দাঁড়ালেন। মেয়েটা বলল, “স্লামালেকুম চাচা।”
“ওয়ালাইকুম সালাম তিতুনি। স্কুলে যাচ্ছিস?”
“জি চাচা।”
“স্কুলে লেখাপড়া হয়?”
মেয়েটা তিতুনির মতো হি হি করে হাসল। বলল, “মাঝে মাঝে।”
“আজকালকার লেখাপড়ার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝি না। তোর বাবা ভালো আছে?”
“আছে।”
“মা? টোটন?”
“আছে। সবাই ভালো আছে।”
“ঠিক আছে। স্কুলে যা।” বলে মাহতাব চাচা তাদেরকে পিছনে ফেলে হেঁটে গেলেন।
তিতুনি তখন উঠে দাঁড়াল। মেয়েটা রাজ্য জয় করার ভঙ্গি করে তিতুনিকে বলল, “দেখলে, কোনো সমস্যা হয়েছে?”
তিতুনি চাপা গলায় বলল, “মাহতাব চাচা আমার চেহারা দেখেন নাই সে জন্যে সমস্যা হয় নাই। এখানে তোমার কোনো ক্রেডিট নাই।”
“দেখলেও কোনো সমস্যা ছিল না–”মেয়েটার কথা প্রমাণ করার জন্যেই কি না কে জানে হঠাৎ করে পিছন থেকে মাহতাব চাচা ডাকলেন, “এই তিতুনি। একটু দাঁড়া!”
তিতুনি এবং তিতুনির মতো দেখতে এলিয়েন মেয়ে দুজনেই দাঁড়াল। তিতুনি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “এখন? এখন কী করব?”
মেয়েটা বলল, “কিছুই করতে হবে না।”
মাহতাব চাচা লম্বা পা ফেলে এসে তিতুনিকে বললেন, “একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। তোর বাবাকে বলিস–”
মাহতাব চাচা হঠাৎ করে থেমে গেলেন, তিতুনির পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি তার চোখে পড়েছে আর কেমন যেন ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো তার সারা শরীর কেঁপে উঠল। আমতা আমতা করে বললেন, “এ-এ-এইটা কে?”
“কোনটা?” প্রশ্নটা খুবই বোকার মতো হয়ে গেল কিন্তু তিতুনি আর কী করবে বুঝতে পারল না।
মাহতাব চাচা তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “দু-দু-দু দুইটা তিতুনি?”
তিতুনি মাথা নাড়ল, “জি চাচা। দুইটা।”
“দুইটা কেমন করে হয়?” মাহতাব চাচার মুখটা কেমন যেন হাঁ হয়ে গেল। মাছের মতো কেমন যেন খাবি খেলেন।
তিতুনি মাথা চুলকে বলল, “আমিও ঠিক জানি না চাচা।”
মাহতাব চাচা হঠাৎ কেমন যেন মাথা ঘুরে পড়ে যেতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। তিতুনি খপ করে মাহতাব চাচার হাতটা ধরে ফেলল, ডাকল, “মাহতাব চাচা।”
মাহতাব চাচা কোনো উত্তর না দিয়ে কেমন যেন ঘোলা চোখে তিতুনির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিতুনির মতো দেখতে এলিয়েন মেয়েটি ফিসফিস করে বলল, “আমি সরে যাই। স্মৃতি মুছে দিয়েছি।”
মেয়েটি ঘুরে জোরে জোরে পা ফেলে স্কুলের দিকে যেতে শুরু করল আর মাহতাব চাচা হঠাৎ কেমন করে জানি জেগে উঠলেন, তিতুনির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তিতুনি? স্কুলে যাচ্ছিস?” বোঝাই যাচ্ছে তার আগের কথা কিছু মনে নাই।
তিতুনি শুকনো মুখে বলল, “জি চাচা।”
“স্কুলে লেখাপড়া হয়?” তিতুনি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “মাঝে মাঝে।”
মাহতাব চাচা মাথা নেড়ে বললেন, “আজকালকার লেখাপড়ার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝি না।”
তিতুনি মাথা নাড়ল, “আমিও বুঝি না।”
“তোর বাবা ভালো আছে?” “আছে।” “মা? টোটন?” “আছে। সবাই ভালো আছে।” তিতুনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। মাহতাব চাচা আব্বুকে কিছু একটা বলার জন্য ফিরে এসেছিলেন, সেটা শুনে নেয়া যাক। মাহতাব চাচা অবশ্যি কিছু বললেন না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তিতুনি জিজ্ঞেস করল, “মাহতাব চাচা, আব্বুকে কিছু একটা বলতে হবে?”
মাহতাব চাচা মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ। তোর বাবাকে বলবি–”, বলে মাহতাব চাচা দাঁড়িয়ে মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন। খানিকক্ষণ চেষ্টা করলেন কিন্তু মনে করতে পারলেন না। মেয়েটা মাহতাব চাচার স্মৃতি থেকে ওই কথাটাও মুছে দিয়েছে।
মাহতাব চাচা কেমন যেন বোকার মতো একটু হেসে বললেন, “কী আশ্চর্য। মনে করতে পারছি না।” তারপর তিতুনির দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিন্তু তুই কেমন করে বুঝতে পারলি তোর বাবাকে একটা কথা বলতে চাইছি?”
তিতুনি কাঁধ ঝাঁকাল, বলল, “জানি না। কেন জানি মনে হলো।” মাহতাব চাচা কথাটা শুনে খুব অবাক হলেন বলে মনে হলো না। হেঁটে হেঁটে চলে গেলেন। তিতুনিও একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে স্কুলের দিকে হাঁটতে লাগল। সে সামনে তাকাল, তিতুনির মতো দেখতে এলিয়েন মেয়েটি হনহন করে স্কুলের দিকে যাচ্ছে। মেয়েটা আসলেই একজনের মাথার ভেতরে ঢুকে তার স্মৃতি মুছে ফেলতে পারে। কী আশ্চর্য। মুছতে যখন পারে তাহলে কি উল্টোটা সম্ভব? কারো মস্তিষ্কে কি স্মৃতি লিখে দিতে পারবে? এলজেবরা কিংবা বাংলা ব্যাকরণ কিংবা তেলাপোকার পাঁচক প্রণালি কি মেয়েটা তার মগজে লিখে দিতে পারবে? তাহলে তাকে আর কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হবে না।