০৫.
ম্যাডক্স-এর অফিস-ঘরের বাইরেই একটি ছোট কামরায় বসে তার সেক্রেটারী মিস প্যাটি একমনে টাইপ করছিল। অ্যানসন-এর পায়ের শব্দে সে চোখ তুলে তাকালো, আরে মিঃ অ্যানসন! ওঃ কত দিন পর আপনার সঙ্গে দেখা। ভুলেও কি এপথ একবার মাড়াতে নেই। তারপর খবর টবর কি? কেমন আছেন, কাজকর্ম কেমন চলছে?
প্যাটিকে ন্যাশানাল ফাইডেলিটির সব সেলস্ম্যানই পছন্দ করে। রূপও যেমন, গুণও তেমনি, আচার-ব্যবহার ভদ্র বিনয়ী। হেসে ছাড়া কারো সঙ্গে কথা বলে না। কার কি অসুবিধা, কিভাবে তা মেটাতে হবে, ম্যাডক্স কিরকম কি করতে পারেন। কিরকম ভাবে কথা বললে তিনি চটবেন না, এ সব ব্যাপারে প্যাটির পরামর্শ এর সাহায্যে অপরিহার্য? সত্যিই মেয়েটা ভালো।
খবর সবই ভালো। অ্যানসন প্যাটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। কিন্তু ব্যাপারটা কি? এত জরুরী তলব কেন?
ওই যে সেই ভোদেক্স-এর গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট। ওর ইচ্ছে দাবীটা এড়ান। এ ব্যাপারে আপনার পরামর্শের জন্যই আপনাকে ডাকা।
এই তা হলে ব্যাপার? অ্যানসন বুক ভরে নিশ্বাস নিল, এতক্ষণে হাফ ছেড়ে গেল বাবা। এদিকে যে সাত-পাঁচ কত কি ভেবে কাল থেকে মাথা খারাপ করে মরছি।
দাবী মেটাবে না মানে কি, না মিটিয়ে কোথায় যাবে? ভোল্পে মাতাল হতে পারে, তা বলে তার স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে বলার কিছু নেই। টাকা আমাদের দিতেই হবে।
আপনি তো সবই জানেন, আপনাকে আর নতুন করে কি বলবো। টাকা না দিতে পারলেই উনি খুশী। টাকা ওর গায়ের মাংস। প্যাটি স্বয়ংক্রিয় টেলিফোনের বোতামে চাপ দিল, স্যার, মিঃ অ্যানসন এসেছে।
ভারী গলায় আদেশ এল–এখনি পাঠিয়ে দাও।
প্যাটি মিষ্টি করে হেসে বলল, যান ঢুকে পড়ুন। সিংহের খাঁচায় ড্যানিয়েলের গল্পটা সব সময় মনে রাখবেন। ড্যানিয়েল সিংহ দেখে কিন্তু এতোটুকু ঘাবড়ে যায়নি। সিংহ ও তাই তার গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত কাটেনি। ঘাবড়াবেন না। মিঃ ম্যাডক্স মানুষ, বাঘ ভাল্লুক না।
নিজে যা বোঝেন, ভাল ভাবেন, তাই নিয়ে নিঃসঙ্কোচে একচোট লড়ে যাবেন ব্যস্ আর কি?
অ্যানসন চেষ্টা করে একটু হাসল, তারপর এগিয়ে গিয়ে দরজা ঠেলে ঢুকলো ম্যাডক্স-এর ঘরে।
ম্যাডক্স বিরাট ডেস্কের ওপাশে বসে আছেন। চারপাশে তার স্তূপীকৃত ফাইলের রাশি। মেঝেয় চেয়ারের ওপর সব জায়গায় শুধু ফাইলের ছড়াছড়ি। দেখে মনে হয় পৃথিবীতে ফাইল ছাড়া এ লোকটা আর কিছুই জানে না।
মিঃ ম্যাডক্স একখানা পলিসি বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছিলেন। ডান হাতের মোটা দু আঙ্গুলের ফাঁকে ধরা জলন্ত সিগারেট। মাথার কাছাকাছি ধূসর চুল, লাল মুখে প্রছন্ন ভ্রূকুটি, মোটা সোটা চেহারা চওড়া কাধ, মর্মভেদী সজাগ দৃষ্টি, পরণে দামী পোশাক। লোকটা সব মিলিয়ে কিন্তু তেমন লম্বা চওড়া নয়। বরং কাঁধ বা চেহারার তুলনায় ছোট-খাট। একটু ঢিলেঢালা, অগোছালো স্বভাবের মানুষ,কথা বলতে বলতে মাথার অবশিষ্ট চুলকগাছিতে আঙুল চালানোতার বরাবরকার অভ্যাস।
অ্যানসনকে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিলেন ম্যাডক্স। বসুন, এই বদমাইস ভোদেল্পকে নিয়ে তো মহা মুশকিল হল দেখছি।ব্যাপারটা হলো,ব্যস্ শুরু হলো গাল-মন্দ, দেশের তাবৎ বীমাকারী ব্যক্তির আদ্যশ্রাদ্ধ শুরু করলেন তিনি। আনসন বসে বসে নীরবে সব শুনলো।
মিনিট কুড়ি ধরে একনাগাড়ে তার এই বকবকানি চলল। তারপর বক্তৃতা শেষ করে সিগারেটের প্যাকেট থেকে আর একটা সিগারেট তুলে নিয়ে অগ্নিসংযোগ করে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন। বললেন অবশ্য একটা ব্যাপার বুঝতে আমার কষ্ট হচ্ছে না যে টাকা আমাদের দিতেই হবে।
ওঃ চল্লিশ হাজার ডলার। আমার মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আপনারা সেলসম্যানরাই তো আমার সর্বনাশ করবেন দেখছি। ইনসিওর করার আগে একবারও ভেবে দেখলেন না যে লোকটা নেশারু, পাঁড়- মাতাল। মদে সবসময় চুর হয়ে থাকে। তা সেসব দেখবেনই বা কেন?
আপনাদের নজর কেবল কমিশনের দিকে।কমিশন পেলেই সবচুকেবুকে গেল। ছিছি সামান্য একটু ভুলের জন্য কোম্পানির নগদ চল্লিশটা হাজার ডলার একেবারে জলে গেল।
এতক্ষণে অ্যানসন মুখ খুলল। আমার দোষটা কোথায়। আমার কাজ ইনাসওর করানো। ভুল যদি কিছু হয়েই থাকে তাহলে ডাক্তার সিভেল গিয়ে ধরুণ। ভোদেক্সকে পরীক্ষা করে তিনি সার্টিফিকেট দেওয়ার পর আমি তাকে দিয়ে সই-সাবুদ করিয়েছি। এক পাও নিয়ম না মেনে এগোইনি। অবশ্য কোম্পানির প্রচলিত নিয়মকানুন সম্বন্ধে যদি কিছু বলার থাকে তাহলে–অ্যানসন আড়চোখে তাকাল তবে আমাকে নয়, আপনি বরং মিঃ বারোজকে গিয়ে বলুন নিয়ম-টিয়ম সব পাল্টে ফেলতে।
সে ইচ্ছে করেই মিঃ বারোজের নামটা বলল। ম্যাডক্স-এর মতো লোককে কাবু করতে হলে এরকম দু-চারটে নাম সব সময় ঠোঁটের গোড়ায় রাখতে হয়।
মিঃ বারোজ–ন্যাশনাল ফাইডেলিটির প্রেসিডেন্ট। এই বিরাট প্রতিষ্ঠানের ওই একটি মাত্র লোককে ম্যাডক্স সমীহ করে কথা বলেন।
ম্যাডক্স হাত তুলে বললেন, ব্যস্ ব্যস্ আমাকে জ্ঞান দিতে হবে না। কাকে কি বলা দরকার সেটা আপনার চেয়ে আমি কিছু মাত্র কম বুঝি না। আর স্টিভেলকেও বলিহারি যাই, এত বয়েস হল, এত রোগী ঘাটলো অথচ লোকটা যে একটা পাঁড় নেশারু সেটা একবারও তার মাথায় ঢুকল না।
অ্যানসন দৃঢ়তা সহকারে বলল যে ভোদেক্স মোটেই নেশারু নয়। অ্যাকসিডেন্টের দিন সে মদ খেয়েছিল ঠিকই, হয়তো একটু বেশী খেয়েছিল। তাই বলে আপনি তাকে নেশারু বলতে পারবেন না।
যাকগে ওসব বাদ দিন, এখন বলুন কাজ-কর্ম কেমন চলছে।
চলছে মোটামুটি। এ মাসটা তেমন সুবিধার নয়। টাকা অনেকেই দিয়ে রেখেছিল কিন্তু মুঠো খুলছে না কেউ।
খুলছে না বললে শুনবো না, হাত বাড়িয়ে টেবিলের স্তূপীকৃত পলিসির মধ্যে থেকে একখানা পলিসি তিনি তুলে নিলেন। কিসে যে আপনাদের আশ মিটবে স্বয়ং ভগবানও বোধহয় তা–ঠিক করে বলতে পারবেন না। এইতো ফিলিপ বারলোর এই পলিসিটা এটা তো আপনিই করিয়েছেন। জপিয়েছেন তো ভালই দেখছি, পাঁচ নয় দশ নয় একেবারে পঞ্চাশ হাজার ডলার।
ওঃ সেই বারলোর পলিসিটা, অ্যানসনের মুখের রেখা এতটুকু বদলালো না। যেহেতু ভাগ্যটা নেহাৎ ভালো তাই হয়েছে। একদিন চিঠি পাঠাল, দেখা করতে গেলাম; ব্যস্ মাছ চারে এলো।
চার মানে বেশ বড়সড় চার বলুন। একেবারে পঞ্চাশ হাজার। পলিসিটা টেবিলে রেখে তিনি অ্যানসনের দিকে তাকালেন তা আপনার এই বারলো মহাশয়টা কি করেন?
গেদো বাংলায় মালী, শুদ্ধ বাংলায় উদ্যানশিল্পী, সহজ-সরল ভঙ্গিতে অ্যানসন তার দিকে তাকান, সত্যি কথা বলতে কি, ওর মতো বাগানের কাজ জানা লোক আমি জীবনে দুটো দেখিনি মিঃ ম্যাডক্স। ফ্রামলের দোকানের পুষ্পবিভাগের উনিই সর্বেসর্বা, ওর বাড়ীতে যা একখানা বাগান আছে, দেখলে চোখ একেবারে জুড়িয়ে যায়। আহা কি একখানা নিপুণ হাতের কাজ–অনেক বাগান দেখেছি কিন্তু এত সুন্দর না।
ঠিক আছে, ঠিক আছে বাগানের আমি কিছু বুঝিও না, বুঝতে চাইও না। আমি শুধু বুঝি কাজকাজের পর কাজ ব্য। তা, যে লোকটা সামান্য একটা চাকরী করে সে হুট করে এত দামের বীমা করতে গেল কেন?
কেন আবার, টাকার জন্য। স্বাধীন ব্যবসা করবে, টাকা পয়সা তেমন নেই। পলিসি বন্ধক রেখে ব্যাঙ্ক থেকে ধার নেবে এই হচ্ছে উদ্দেশ্য। তা লোকটার মাথা আছে। বছর দুয়েকের মধ্যে ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে।
দাঁড়ালে তো ভালই, না দাঁড়িয়ে যদি শুয়ে পড়ে, হঠাৎ পটল তোলে, তাহলেই গেছি। আবার পঞ্চাশ হাজারের ধাক্কা।
ওর হঠাৎ পটল তোলার কোনও সম্ভাবনা নেই। স্টিভেল পরীক্ষা করে ওর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে ভাল রিপোর্ট দিয়েছেন।
স্টিভেন্সের কথা আর আমাকে বলবেননা। ও একটা আস্ত হাতুড়ে না হলে একটা লোক মাতাল ও কেন পরীক্ষা করে বুঝতে পারে না।
অ্যানসন কোনও জবাব না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরালে। ম্যাডক্স আর একটা নতুন সিগারেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তা মরলে টাকা পাবে মিসেস বারলো, জানতে পারি ইনি কে? ওঁর স্ত্রী নাকি?
হ্যাঁ। অ্যানসনের বুকের স্পন্দন বাড়লো।
তা ইনি কেমন?
কেমন মানে দেখতে কেমন?
হ্যাঁ সবাইকেই চিনে রাখা দরকার। এক দোকানের সামান্য মাইনের চাকুরে এত বড় টাকার বীমা করল দুম করে স্বভাবতই মনে নানারকম প্রশ্ন জাগে। কেমন তিনি?
ভালোই মানে মোটামুটি চলনসই।বছর সাতাশেক বয়েস।ওনার সঙ্গে বেশীকথাবার্তা বলার সুযোগ হয়নি। যতটুকু দেখেছি মনে হয় ওরা দুজনে সুখী।
পলিসিটা ম্যাডক্স আবার হাতে তুলে নিলেন। একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘাড় তুলে বললেন প্রিমিয়ামের এতগুলো টাকা উনি নগদে দিলেন?
হ্যাঁ দিলেন। ব্যাঙ্কে টাকা পয়সা রাখা উনি একেবারেই পছন্দ করেন না। বাড়িতেই রাখেন। কোন কিছু গণ্ডগোল হয়েছে নাকি?
না গণ্ডগোল নয়। তবে নগদে অতগুলো টাকা। মনটা একটু খুঁতখুঁত করছে।
অ্যানসন মাথা নীচু করে টাইটা ঠিক করল। ম্যাডক্স গলগল করে একমুখ ধোয়া ছাড়লেন। তাহলে ব্যবসার জন্য পলিসি বন্ধক রেখে উনি টাকা পেতে চান, এই তো?
আমাকে তো সেইরকমই বললেন?
কি যেন করবেন? বাগানের ব্যবসা। হ্যাঁ, বাগানের ব্যবসা মানে কিন্তু দু-চার পয়সার ব্যাপার নয়। দস্তুরমতো অনেক টাকার দরকার, জমি কেননা, চারা বড় করার জন্য বাড়ি বানাও, মেসিন কেননা, এটা কেননা ওটা কেননা সে একেবারে হাজারো বায়নাক্কা, আমার সব মনেও নেই।
তা–ওর মোট কত মূলধন দরকার?
কি জানি আমাকে যেচে কিছু বলেনি, আমিও জানতে চাইনি। আমাকে বললেন বীমা করাতে চাই আমিও কথা বাড়ালাম না। করিয়ে দিলাম, চুকে গেল ঝামেলা।
হ্যাঁ তা তো ঠিকই। আপনার আর কি? আপনার কাজ যেহেতু বীমা করানো সেহেতু বীমা করিয়ে দিয়েই আপনি খালাস।
অ্যানসন বলল, এটুকুর বেশী আমি করতে যাবোই বা কেন? যা মাইনে আপনারা দেন তাতে এর বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। যাই হোক এখন যেতে হবে আর কোন কথা আছে?
ম্যাডক্স অন্য দিকে তাকিয়ে বললেন না আর কোন কথা নেই। তাহলে আজ চলি। পরে আবার দেখা হবে।
ম্যাডক্স যন্ত্র চালিতের মতো ঘাড় নাড়ল। অ্যানসন গটগট করে বেরিয়ে গেল। তিনি চোখ ফেরালেন। চোখ গিয়ে পড়ল বারলোর পলিসিটার ওপর। তিনি সেদিকে একদৃষ্টে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তার কপালে একের পর এক চিন্তার রেখা ফুটে উঠল, হঠাৎ কি মনে হতে স্বয়ংক্রিয় টেলিফোনের বোতামে চাপ দিলেন, হারমাস কোথায়?
প্যাটি বললো, এখানেই আছেন। পাঠিয়ে দেব।
হ্যাঁ তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দাও।
ঠিক তিন মিনিট পর দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন, স্টিভ হারমাস, ম্যাডক্স-এর দাবী পূরণ দপ্তরের প্রধান তদন্তকারী। লম্বাশক্ত সমর্থ চেহারা। চওড়াকাধ।বছর তেত্রিশেক বয়েস। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। মুখখানা লম্বা ঘোড়ার মতো। দেখলেই বোঝা যায় হারমাস একটি পাকা ধুরন্ধর।
সবদিক থেকেই হারমাস ম্যাডক্স-এর ভারী প্রিয়, শুধুতাকে একটি মাত্র কারণে তিনি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারেন নি। হারমাস ম্যাডক্স-এর এক প্রিয় সেক্রেটারীকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন। এটা যে কতবড় অপরাধ তবুও তিনি হারমাসকে ভালবাসেন, নোকটার তদন্ত করার কায়দা আছে বটে।
হারমাস একটা চেয়ারে বসে ম্যাডক্স-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, কি ব্যাপার জরুরী তলব কেন?
বারলোর পলিসিটা তার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে মিঃ ম্যাডক্স বললেন, এই নাও এটা দেখো।
হারমাস ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পলিসিটা দেখলেন। তারপর চোখ তুলে বললেন, হুম্ একেবারে ছবির মতো, অ্যানসন জপিয়েছে বেশ।
ম্যাডক্স চেয়ারেশরীর এলিয়ে দিয়ে হাসলেন।ঠিক পুরোপুরি ছবির মতো নয় হারমাস। বারলো প্রু টাউনে ফ্রামলের দোকানের সামান্য মাইনের একজন চাকুরে। হঠাৎ দুম করে পঞ্চাশ হাজারী বীমা সে করতে যাবে কেন? পলিসিটা তুমি নিয়ে যাও। একবার এ বিষয়ে খোঁজখবর করো।
হু, ব্যাপারটা যেন একটু গোলমেলে ঠেকছে।
গোলমেলে তো বটেই তিনি যদি দয়া করে হঠাৎ একদিন পটল তোলেন। ব্যস সোজা পঞ্চাশ হাজারের ধাক্কা। অ্যানসনকে বেশ সুন্দর বুঝিয়েছে বাগানের ব্যবসা করার জন্য নাকি পলিসি বন্ধক রেখে ব্যাঙ্কের কাছ থেকে টাকা নেবে। বেশ সে না হয় মানলুম, যে, সে ব্যবসাই করবে কিন্তু বাগানের ব্যবসার জন্য পঞ্চাশ হাজার কিসে লাগবে?
টাইটা ঠিক করে হারমাস মাথা চুলকোলেন। কোন জবাব দিলেন না। ম্যাডক্সকে তিনি ভালভাবেই জানেন, তিনি এখন নিজের মনেই কথা বলছেন প্রশ্নের জবাব তিনি শুনতে চান না।
সুতরাং বুঝতেই পারছে যে সন্দেহের পোকা আমার মাথায় ঢুকেছে। কেমন যেন একটা জাল জোচ্চুরির গন্ধ পাচ্ছি। তুমি দেখো, যা করবার করো। সন্দেহ মোচনের ভার আমি তোমার হাতেই ছেড়ে দিলাম।
হারমাস মৃদু হেসে বললেন, আচ্ছা মিঃ মসডক্স আপনার সন্দেহের ছোঁয়া লাগেনি, এমন কোনো পলিসি আপনি কোনোদিনও চোখে দেখেছেন কি?
দেখেছি, নামমাত্র কয়েকটা, আঙুলে গুণে তার সংখ্যা বলে দেওয়া যায়। এখন শোনো এই পলিসিটার ব্যাপারে তোমাকে কি কি করতে হবে। প্রথমেই জানতে হবে বারলো কে, সে কিরকম লোক। টাকা পয়সা কেমন আছে ইত্যাদি।
এরপরেই আসছে তার স্ত্রী। এর সম্বন্ধে আমার আগাপালা রিপোর্ট চাই। তুমি বরং এক কাজ করো, তোমার সেই জানাশোনা ডিটেকটিভ এজেন্সিকে এদের পিছনে ভিড়িয়ে দাও। তুমি তোমার মতো করে অনুসন্ধান করো, তারা তাদের মতো করুক। যেমন যেমন করে আসবে সোজা আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে। হারমাস উঠে দাঁড়ালেন বললেন ঠিক আছে দেখি কতদূর কি করা যায়।
ম্যাডক্স আপন মনে বিড়বিড় করে বললেন–পঞ্চাশ হাজার। যার পাঁচ হাজার করার কথা সে করে পঞ্চাশ হাজার। প্রিমিয়ামের অতগুলো টাকাও নগদে দেয় কেন?
কেন তা এখনই কিভাবে বলবো। কটা দিন যাক খোঁজ খবর করি। তারপর আপনি আপনার কেনর জবাব পাবেন। চলি?
বড় বড় পা ফেলে হারমাস চলে গেল। তার চলে যাওয়ার দিকে ম্যাডক্স কিছুক্ষণ অন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে আর একখানা পলিসি তুলে নিলেন।
.
হেড-অফিস থেকে নিজের ফ্লাটে ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে গেল। খাওয়াদাওয়ার কাজ ওখানেই চুকিয়ে এসেছে। শরীর ভীষণ ক্লান্ত। এখন শুয়ে স্রেফ টেনে ঘুম। সুতরাং পোষাক ছেড়ে শোবার তোড়জোড় করছে অ্যানন এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল।
অ্যানসন একটু অবাক হল এত রাত্তিরে কে এল? সে গিয়ে দরজা খুলল। দরজার ওপাশে–এক মহিলা দাঁড়িয়ে। তাঁর পরনে কালো কোট সবুজের ওপর হলদে ডোরাকাটা একখানা ওড়নায় মুখ ঢাকা, অ্যানসন দরজা খুলতেই সে পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়লো ঘরে।
চাপা গলায় সে বলল, দরজা বন্ধ করে দাও।
মেগ তুমি! তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিলো অ্যানসন। মুখের ওড়না খুলে ফেলল মেগ। অ্যানসনের বিস্ময় তখনো কাটেনি। সে মেগ-এর দিকে অবাক চোখে তাকাল, তুমি এখন এখানে?
না এসে পারলাম না। সারাদিনে তোমাকে অনেকবার ফোন করেছি। একবারও পাইনি। তাই বাধ্য হয়ে চলে এলাম।
কেউ এখানে তোমাকে ঢুকতে দেখেনিতো? মেগ-এর হাত থেকে কোটটা নিয়ে সে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখলো। দেখো মেগ, আমাদেরদুজনকে এখন একসঙ্গে দেখার কিন্তুঅনেক বিপদ।
হাত তুলে তাকে থামিয়ে মেগবলল, আমি জানি তোমার কোন ভয় নেই কেউ আমাকে ঢুকতে দেখেনি। তাছাড়া দেখলেই চিনতে পারবে না। একপা এগিয়ে এসে অ্যানসনের একটা হাত ধরে মেগ বলল, জন তুমি কি আমাকে দেখে খুশী হওনি?
অ্যানসন নিবিড়ভাবে মেগকে বুকে টেনে নিলো। তার কপালে তপ্ত-চুম্বন এঁকে দিলো।
মেগ আস্তে আস্তে নিজেকে সরিয়ে নিল। তুমি সারাদিন কোথায় ছিলে অ্যানসন। অফিসে ফোন করে আমি একেবারে হয়রান।
অফিসে! তুমি করছো কি, অফিসে ফোন করতে তোমাকে আমি বার বার বারণ করেছি। আমাদের এখন সবদিক থেকে সতর্ক হতে হবে টাকা পাই না পাই আমরা যে পরিচিত একে অপরকে ভালবাসি, এখন কাউকেই বুঝতে দেওয়া চলবেনা। আর তুমি এদিকে এই কাণ্ড করেছে।
ওকথা বাদ দাও। এখন বলল কতদূর কি এগিয়েছে?
অ্যানসন সেদিনের ম্যাডক্স-এর সঙ্গে তার সাক্ষাৎকারের আগাগোড়া ঘটনাই বিবৃত করল, মেগ মন দিয়ে সব শুনল।
অ্যানসন কাহিনীর যবনিকা টানলো তবে হ্যাঁ, ভয়ের কোন কারণ নেই, আমি ম্যাডক্সকে মোটামুটি সন্তুষ্টি দিতে পেরেছি। ও আর এ নিয়ে জল ঘোলা করবে না।
মাথা নীচু করে দুহাতের দিকে তাকাল মেগ জন তুমি ফিলকে কবে—
এখন নয় মেগ। এত তাড়াতাড়ি নয়। এখনও চার-পাঁচ মাস আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। চার পাঁচ মাস। মেগ টেনে টেনে বলল।
তাতো বটেই একমাস ধৈর্য্য ধরে না থাকলে অসুবিধা আছে। বুঝতে পারছে না বীমা করার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বীমাকারীকে মরতে দেখলে স্বভাবতই সবার মনে সন্দেহ হবে। ম্যাডক্স এরও হবে। অবশ্য চার-পাঁচ মাসও অনেক কম সময়। তবু, কয়েক সপ্তাহের চেয়ে কয়েকটা মাস মন্দের ভালো তো বটেই।
তুমি ওকে কি ভাবে মাররে? স্থির দৃষ্টিতে মেগ যেন অ্যানসনের মনের কথাটা বুঝতে চাইল।
এখনও কিছু ভাবিনি। সেই পুকুরে ডুবিয়ে মারার মতলবটা তেমন কাজের হবেনা। ধরো আমি ওকে মেরে পুকুরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় বাড়ীর সামনের রাস্তায় কেউ না কেউ এসে পড়লো। ব্যস্ফাঁসির দড়ি বা গ্যাস চেম্বারের ব্যবস্থা একেবারে পাকাপাকি করে ফেলা। তাই যা করতে হবে বাড়ির মধ্যে, ভেতরে।
মেগ ভয়ে কেঁপে উঠল, বাড়ির মধ্যে!
হা। তবে কিভাবে কি করবো, এখনও ভাবিনি। ভেবে-চিন্তে একটা কিছু খাড়া করে নিই, তারপর তোমাকে জানাবো।
কিন্তু সত্যিই কি আমাদের অতদিন অপেক্ষা করতে হবে?
মেগ দেখো এটা তাড়াহুড়োর কাজ না। তড়িঘড়ি করতে গেলেই সব মাটি। অপেক্ষা আমাদের করতেই হবে পঞ্চাশ হাজার ডলারের জন্য, না হয় কিছুদিন অপেক্ষা করলাম।
হ্যাঁ তা ঠিক, কিন্তু কিভাবে কি করবো সে সম্বন্ধে সত্যিই কিছু ভাবোনি?
তোমার আজ কি হয়েছে বলো তো? বিরক্ত হয়ে অ্যানসনবলল, বারবার একথা বলছে।বলছি তো এখনও কিছু ভাবিনি। এত অধৈর্য হওয়ার কোন কারণ আছে কি? তুমি তো বলেছিলে যে ওকে দিয়ে ইনসিওর করাতে পারবো না। দেখলে তো বাজে কথা বলার লোক অ্যানসন নয়, সে নিজের ওজন বুঝে কথা বলে। সে ইনসিওর করল কিনা?
না না আমি সে কথা বলছিনা। সেদিক দিয়ে তো তোমার কেরামতি আছেই। যা হোক এবার আমাকে যেতে হবে।
অ্যানসন যেন আকাশ থেকে পড়লো, তার মানে চলে যাবে কেন? আজ তোমার স্বামীবাড়ীতে থাকবে না তাহলে এত তাড়াহুড়ো কেন, আজ রাতটুকু এখানে থেকে যাও। কোট খোল।
না জন প্লিজ আমাকে তুমি থাকতে অনুরোধ কোরনা। মেগ গলার স্বর জড়িয়ে বলল।ফিলকে আগে থেকেই কথা দিয়েছি আজ ওর স্কুল দেখতে যাবো। সকালবেলা ওর সঙ্গে এখানে এসেছি। তোমাকে ধরার জন্য সারাটা দিন ফোন করে করে মিথ্যে হয়রান হলাম। তুমি থাকলে কত ভাল হত। সারাদিন দুজনে একসঙ্গে থাকা যেত।
অ্যানসন উঠে এক পা এগোল। মেগ-এর হাত ধরে টানলো। মেগ হাত ছাড়িয়ে বলল না জন আজ আমাকে যেতেই হবে।
যেয়োনা মেগ, যেয়োনা। অ্যানসন অনুনয়ের সুরে বললো যে,হয়তো আর কোনদিন এইভাবে তোমাকে কাছে পাব না। এসো কাছে এসো।
জন অবুঝ হয়োনা। মেগ দরজার দিকে এগোল। এখানে আমার আসার কথা নয়। তবু এসেছি তোমাকে দেখতে, হচ্ছে হলো তাই। কিন্তু এখন না গিয়ে উপায় নেই।
এরপর মেগ আর দাঁড়াল না। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। উঁকি মেরে একবার চারিদিকে দেখলো। তারপর নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
বন্ধ দরজায় ওপাশ থেকে ভেসে এলো জুতোর শব্দ। অ্যানসন বিমূঢ়ের মতো একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো।
অ্যানসন-এর বাড়ির সামনে রাস্তার অন্ধকারে একপাশে একখানা কালো বুইক দাঁড়িয়ে আছে।
চালকের আসনে গেলার হেগান। ঠোঁটের কোণে তার জ্বলন্ত সিগারেট। হাঁটুর ওপর দুহাত রেখে সে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাড়িটার দিকে।
মেগকে বেরিয়ে আসতে দেখে চাবি ঘুরিয়ে সে ইঞ্জিন চালু করলো। বাঁদিকের দরজা খুলে গেল। মেগ এসে গাড়িতে উঠলো। দরজা বন্ধ করে গেলার গাড়ি ছাড়লো।
গেলার গিয়ার বদল করে বলল–তারপর অ্যানসন কি বললো?
বললো এখনও চার পাঁচ মাস অপেক্ষা করতে হবে।
চার পাঁচ মাস-তোমার মাথাটা একেবারেই গেছে। বলেছে সপ্তাহ, শুনেছ মাস।
জেরী, মাথা আমার ঠিকই আছে। সপ্তাহ বললে সপ্তাহই শুনতাম। বললো চার পাঁচ মাসের আগে কিছু করা সম্ভব নয়। করলে নাকি বীমা কোম্পানির সন্দেহ বদ্ধমূল হবে।
ওর মুণ্ডু। গেলার গর্জন করে উঠল। ওসবসন্দেহ-ফন্দেহ ছাড়ো। যা করবার তাড়াতাড়ি করতে হবে। অতোদিন বসে থাকা আমার চলবে না। এ মাসের মধ্যেই আমার টাকা চাই।
আড়চোখে মেগ গেলার-এর দিকে তাকালো, বেশ তো তুমি নিজেই বরং একদিন ওর সঙ্গে দেখা করে বলে এসো গিয়ে তোমার কথা।
গেলার তার দিকে কটমট করে তাকাল। মেগ মুখ ফিরিয়ে নিল। রাগে আর কিছু করতে না পেরে গেলার অ্যাকসিলেটরে চাপ দিল। স্পীডোমিটারের কাঁটাটা এক লাফে উঠে এলো একশোয়। গাড়ি তীরের বেগে ছুটে চললো।
রাস্তা ফাঁকা। চারপাশে চাপ চাপ অন্ধকার রাস্তার দুপাশের গাছগুলো যেন বাতাসে সাঁতার কাটতে কাটতে বিপরীত দিকে ছুটে চলেছে। কেউ কোন কথা বললোনা। বাকী পথটুকু নিঃশব্দেই কাটলো।
বারলো বাড়ির ফটকের সামনে গাড়ি এসে থামলো। গেলার সোজা গাড়ি নিয়ে গিয়ে গ্যারেজে তুললো।
মেগ চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলল। ঘরে ঢুকে আলো জ্বাললো। জানলার খড়খড়ি নামিয়ে দিলো। গেলার এলো একটু পরে।
দুজনে গেলো বসবার ঘরে। অগ্নিকুণ্ডে দু-খানা কাঠখুঁজে দিয়ে মেগ ভেতরে এলো। পোশাক পাল্টে একটু পরে এক বোতল হুইস্কি আর দুটো গ্লাস নিয়ে ফিরে এলো। গেলার একটা সিগারেট ধরালো। মেগ বোতল খুলে গ্লাস দুটো পূর্ণ করে একটা গেলারকে দিল আর একটা নিজে নিয়ে বসলো গিয়ে সোফায়।
গ্লাসে এক দীর্ঘ চুমুক দিয়ে গেলার মেগ-এর দিকে তাকাল। শোনো মেগ তোমাকে কায়দা, বদলাতে হবে। ওরকম পুতুপুতু করলে চলবে না। যেমন করেই হোক এক মাসের মধ্যেই আমার টাকা চাই। অ্যানসনকে এর মধ্যেই যা কিছু করার করতে বাধ্য করাই হবে তোমার কাজ। যদি তা করতে পারো তাহলে তোমার আমার সম্পর্ক থাকবে আর না হলে পায়ে মাথা খুঁড়ে মরলেও আর তুমি আমাকে পাবে না।
মেগ-এর মুখ বিবর্ণ হল। মুখ কালো হয়ে গেল। সে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল কোনো উপায় নেই জেরী। বিশ্বাস কর আমার অ্যানসনকে ভয় করে, ওকে সামলানো আমার পক্ষে মাঝে-মধ্যে অসম্ভব হয়ে ওঠে।
থামো থামো গেলার ধমকে উঠল। ওসব নাকী কান্না আমি শুনতে আসিনি, যা বললাম তাই করবে কোন ওজর-আপত্তি আমি শুনবো না।
মেগ চোখে-মুখে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালে গেলার-এর দিকে। বলল, তুমি জানো, সেই পেট্রোল-পাম্পের-পুলিস সেই যে গুলি খেয়ে মরলো, ওকে অ্যানসনই মেরেছে।
অ্যানসন মেরেছে! কে বললো তোমাকে? ওসব গল্প আমাকে বলতে এসো না।
মেগ প্রবল ভাবে মাথা নেড়ে বলল,নানা গল্প নয়। আমি একটুও বাড়িয়ে বলছিনা। পুলিসটাকে ও ফিলের রিভলবার দিয়ে গুলি করেছে।
গেলার অবাক চোখে ওর দিকে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো। তাহলে এতক্ষণে বুঝলাম এই ব্যাপার। দুয়ে দুয়ে চার, ওখান থেকে টাকা হাতিয়ে ওদের টাকা শোধ করেছে তাই তো ভাবি যে ও এত টাকা পেলো কোত্থেকে। আচ্ছা তাহলে হারামীটা এর মধ্যেই হাত পাকিয়ে ফেলেছে। পুলিস খুন করে ডাকাতি করেছে।
সেই জন্যই তো আমি বলছি মেগ গেলার-এর পাশে সরে এলো, ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বললো, অ্যানসন খুনী। ওকে দেখলেই আমার ভয় করে। উঃ ওর চোখের দৃষ্টি কি ভয়ঙ্কর। সবসময় যেন ঘুরছে। তুমি এখন থেকেই সাবধান হও জেরী। ওকে বিশ্বাস নেই কি করতে কি করে বসে। ওকে আমাদের কাজে লাগানোই ভুল হয়েছে।
কিছু ভুল হয়নি। হাতের পানীয় এক নিঃশ্বাসে গলাধঃকরণ করে গেলার বললো। ওকে দিয়েই আমাদের কাজ হবে। ও বারলোকে দিয়ে ইনসিওর করিয়ে তারপর ছাড়লো। ও কাজের লোক।
অবশ্য এছাড়া ওর উপায়ই বা কি? শ্যাম বার্নস্টেন এর অর্থ হাজার ডলার এদিক ওদিক খুচ খাচ আরো কতো ধার, টোপ না গিলে ও কোথায় যাবে। দাও বোতলটা এদিকে দাও।
মেগ বোতল এগিয়ে দিলো। গেলার গলায় উপুড় করে ঢাললো। বললেন, ওর কাছে এখনো রিভলবারটা আছে নাকি।
না, পরদিনই ফেরত দিয়ে গেছে। কতদিনে চেষ্টা করলাম তোমাকে ফোন করতে। রোজই শুনি তুমি নাকি কোথায় গেছ।
খুনে, পুলিস খুন করেছে। না, আগে জানলে ওর সঙ্গে সেদিন ওরকম ব্যবহার করতাম না।
খুনে, বলা যায় না, যাকগে ওসব কথা ছাড়ো এখন বলল টাকাটার ব্যাপারে কি ঠিক করলে। এ মাসের শেষেই আমার দরকার। জীবনে এই একটা সুযোগই এসেছে। সুযোগ বারবার আসে না। একটা এলে একবারেই কাজে লাগাতে হয়।
আজ সকালে জো আমাকে বলেছে যা করবার যেন তাড়াতাড়ি করি। আর এক হারামির বাচ্চা জোকে টাকা নিয়ে সাধাসাধি করছে। জো তাকে এ মাসটা অপেক্ষা করতে বলেছে। ওর একান্ত ইচ্ছে আমাকে পার্টনার করেই ব্যবসায় নামে। পঁচিশ হাজার ডলার আমার লাগবে। এ মাসের মধ্যে না দিতে পারলে ও সেই লোকটার সঙ্গেই ব্যবসা ফাঁদবে।
কিন্তু অপেক্ষা না করে আমাদের উপায় কি জেরী। তুমি একটু ভেবে দেখো প্লিজ।
গেলার কোন কথা বললো না। একদৃষ্টে সে আগুনের দিকে তাকিয়ে রইল।
হঠাৎ গেলার মুখ ফেরাল। তার চোখ যেন দ দ করে জ্বলে উঠল, হাঁ আমিই ফিলকে খুন করবো। এখন আর অসুবিধে কি। ইনসিওর হয়ে গেছে। সব চেয়ে ঝামেলার কাজটাই খতম। অ্যানসন-এর অপেক্ষায় হাঁ করে বসে না থেকে আমি নিজেই যা করার করবো। তারপর পরের কথা পরে।
মেগ–চিৎকার করে উঠলোনা, সে দুহাতে গেলারের হাত চেপে ধরলোনা, আমি তোমাকে কিছুতেই এ কাজ করতে দেবো না। তোমাকে হারিয়ে আমি বাঁচবো না জেরী। বিশ্বাস করো, তার চোখের কোণ বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
গেলার তাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিল। যাও যাও। ওসব মেকী কান্নায় কোনো ফল হবে না। হয় ঝেড়ে কাশো, নাহয় আমি যা বললাম মেনে নাও। পাঁচ মাস অপেক্ষা করা আমার পোষাবে না।
মেগ বলল, আচ্ছা বেশ, আমাকে কটা দিন ভাবতে সময় দাও। আমি…।
ভাবো আর না ভাবোবা, আমার কথা আমি বললাম। গেলার উঠে দাঁড়াল, অ্যানসন না করলে কাজটা আমাকেই করতে হবে, যদি তাও না পারি, তাহলে আমাকে অন্য কোথাও টাকার খোঁজ করতে হবে। তাহলে আমি আর নেই।
ওঃ তখন কত মেজাজ!কি একখানা কায়দা আমি আবিষ্কার করেছি। কত মুরোদ তাতো আমার বোঝা হল। তোমাকে চিনতে আমার আর বাকী নেই। একটা দেহ সর্বস্ব রাস্তার মেয়ে। তোমার চেয়ে হাজার গুণ সুন্দরী মেয়ে আমাকে পাবার জন্য ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে। শোন যা করবার তাড়াতাড়ি করো। এবার কিন্তু আর হাজার কান্নাকাটি করলেও আমাকে আর পাবে না। কথাটা মনে রেখো।
মেগ ডুকরে কেঁদে উঠল,নানা অমন বোলনা জেরী। আমি করবো করবোই। যেভাবে পারি, এ মাসের মধ্যেই করবো। তোমাকে ছাড়া আমার আর কিছু নেই তো।
আগে দেখা যাক কতদূর কি করতে পারো তারপর নয় আবার নতুন করে ভাবা যাবে, এই বলে গেলার দরজার দিকে এগোল চলে যাওয়ার জন্য।
মেগ অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকাল, তুমি চলে যাবে, কতদিন তোমাকে দেখিনি, এছাড়া ফিল আজ রাতে বাড়ী ফিরবে না।
না ফিরবে তো আমার কি। ভাবো কি তুমি। তোমার রূপ–এখনও ঝরে পড়ছে? তোমার জন্য গেলার হেগান হাঁ করে বসে আছে? ফুঃ আমার অন্য কাজ আছে। আমি চললাম। তুমি আগে অ্যানসনকে সামলাও। তারপর আমার দিকে নজর দিয়ো।
গেলার-এর বুকে মেগ হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লো। তাকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু গেলার তাকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মেগ সোফার ধার ধরে কোনরকমে নিজেকে সামলে নিল। গেলার-এর গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। সে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল। তারপর হঠাৎ সোফায় বসে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল। গেলার, গেলার আবার চলে যাবে।না না গেলার ছাড়া আমার জীবন বৃথা।
মেগ হুইস্কির বোতলটা তুলে উপুড় করে গলায় ঢাললো। প্রচণ্ড প্রদাহ তার কণ্ঠনালী ঘুরে ঘুরে নামতে লাগল। তারপর সে আক্রোশে খালি বোতলটা দেয়ালে ছুঁড়ে মারল।
গেলার হেগান-এর সঙ্গে যেদিন প্রথম সাক্ষাৎ, অনেক অনেক দিন আগে, হ্যাঁ মেগ স্মৃতির পাতা উল্টে চললো, হাঁ তিন বছরই তো কিন্তু ভাবলে মনে হয়, কত যুগ পার হয়ে গেল।
হলিউডের সেই ছোট্ট রেস্তোরাঁয় হেগানকে দেখে প্রথম দিনই তার রক্তে ঝড় বয়ে গেছিল। সেখানে তার সামান্য চাকরি। মালিক ইচ্ছে করেই ছেলে ওয়েটার রাখেনি। মেয়ে রাখলে দু-পয়সা বেশী রোজগার হয়-নেহাৎ কৌতূহলের বসেও দু-চারজন খদ্দের ঢুকে পড়ে। মেগ সেই রেস্তোরাঁর.মেয়ে ওয়েটার। সেখানে তার ম্যানেজার বেনি হার্তজ-এর সঙ্গে গেলার এসে ঢুকলো।
মেগ অবাক হল, লোকটা কে! এমন সুঠাম চেহারা এমন সবল পৌরুষ, এমন সুন্দর বন্যতা, লোকটা কে? মেগ চঞ্চল হল। মেনুকার্ড নিয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলো ওদের টেবিলের দিকে।
লোকটা খাবারের অর্ডার দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে অকারণে আবার তার দিকে চোখ তুলে দেখছিল। যে কবার চোখে চোখ পড়েছে মেগ-এর শরীরে বেশ শিহরণ ফেলে গেলো। পানীয়ের তালিকা সে সবে উল্টেছে, সঙ্গের লোকটা বলে উঠল, শুধু কফি আর কিছু না।
সে তার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল। কফিতে আমার চলবে না। আমার হুইস্কি চাই।
লোকটি বিদ্রুপের সুরে বলল, তা চলবে কেন, মেয়েমানুষ আর মদ তোমার এতবড় সর্বনাশ করলো, পাওনা খেতাব আর একজন ছিনিয়ে নিয়ে গেল, আর তুমি বসে এখানে হুইস্কির অর্ডার দিচ্ছো। কি আমার মুষ্টিযোদ্ধা রে!দাও ওকে, বোতল বোতল হুইস্কি দাও।ও এখন থেকে মানুষের বদলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বোতলের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। আহা আমার ক্যালিফোর্নিয়ার লাইট হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন, গেলার হেগান। সে উঠে দাঁড়াল, তার চোখের দৃষ্টিতে ঝরে পড়লো একরাশ ঘৃণা। শোনো গেলার, তোমাকে আমার আর দরকার নেই, ভেবেছিলাম যে সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠত্বের আসনে তোমাকে একদিন বসাবো। কিন্তু কাজ কিছু হল না। ভাবনাই সার। আজ থেকে তোমার পথ তুমি দেখো, আমার পথ আমি। তোমার মতন অমন বাহাদুর রাস্তা-ঘাটে গণ্ডায় গণ্ডায় মিলবে, তাদেরই একটাকে আবার শিখিয়ে পড়িয়ে নেবো। তোমার পেছনে অনর্থক ঘোরাঘুরি করে সময় কাটালে আমার চলবে না। আমাকে যে টাকা দেবে, আমি তার পোয্য কুকুর। আমি ব্যবসা করতে নেমেছি। চলি বলে সে গেলারকে রেখে চলে গেল। চোখ নামিয়ে গেলার মেগ এর দিকে তাকাল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, চোখে প্রজ্বলিত ক্রোধ, সব মিলিয়ে কেমন যেন একটা অসহায় অবস্থা। আহা এত শক্তসামর্থ্য লোকটাকে একটা রোগা টিঙটিঙে লোক যা নয় তাই অপমান করে গেল। এখন না হয় পারেই না, সব মানুষের শক্তি বা সামর্থ্য কি সবসময় একরকম থাকে, যখন পারতো তখন ক্যালিফোর্নিয়ার ভোজবাজি দেখিয়েছে। এখন পারে না কোত্থেকে আর দেখাবে।
মেগ-এর লোকটার ওপর কেমন যেন মায়া হলো। সে এগিয়ে গিয়ে গেলারের হাত ধরল, একটু বসতে বলে দৌড়ে নিজের ঘর থেকে এক বোতল হুইস্কি এনে দিল। ব্যস সেই থেকেই গেলার তার হল। রাতে নিজের ছোট্ট ফ্ল্যাটে গেলার-এর নির্দয় বন্য লালসার হাতে নিজেকে সমর্পণ করে সে সুখী হল।
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে পাশে মেগকে দেখে গেলার যার পর নাই অবাক হল। আস্তে আস্তে তার সব ঘটনা মনে পড়ল। সে খানিকটা নিশ্চিন্ত হল, যাক খাওয়া থাকার চিন্তাটা তো ঘুচলল। ঘুষোঘুষি করে প্রতিপক্ষকে হারাবার ক্ষমতা যে তার নেই একথা গেলার ভালমতোই জানতো। মেনি হাউজ কাল ওভাবে অপমান করাতে গেলার মনে মনে খুবই রেগে গেছিল। কিন্তু, মুখে কিছু বলতে পারেনি কারণ সে জানতো যে মেনি একটা কথাও মিথ্যে বলছে না। ক্যালিফোর্নিয়ার সেই মুষ্ঠিযোদ্ধা গেলার হেগান সরে গেছে, তার জায়গায় নতুন হেগান জন্ম নিয়েছে, যে জানে শুধু দুটো জিনিষ, মদ আর মেয়েমানুষ।
আপাততঃ দুটো চিন্তাই মিটলো। মদের খরচ জোগানোর জন্য আর চিন্তা করতে হবে না। অপরপক্ষে মেয়েটাও বেশ লড়িয়ে। দেখা যাক কটা দিন, অবস্থা কি দাঁড়ায়। মনে তো হচ্ছে মেয়েটা মজেছে। যার কাছে যার যার মজে, মন যে কদিন মজিয়ে রাখা যায় সে কদিনই লাভ।
এমনভাবে দু-সপ্তাহ কাটল। বাড়িতে যতটুকু সময় মেগ থাকে একেবারে আঠার মতো গেলার-এর দেহের সঙ্গে আটকে থাকে, গেলারও কোনো আপত্তি করে না। নিত্যনতুন কায়দায় একের পর এক স্বপ্নের জাল বুনে চলে সে। মেগ যেন সুখের সাগরে ভেসে যেতে লাগল।
দুসপ্তাহ পরে গেলার মুখ খুললো। সে মেগকে বোঝাল যে রেস্তোরাঁয় সামান্য চাকরীতে ক-পয়সাই বা আসে, তার চেয়ে স্বাধীনভাবে দুপয়সা বেশি রোজগারের ধান্দা দেখা ভালো।
স্বাধীনভাবে মানে হল মেগ-এর একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি দেহের বিনিময়ে অর্থোপার্জন। দেহ বিক্রীর প্রয়োজন নেই। শুধু মাছ জালে তোলা, তার কাছ থেকে তারপর যতদূর সম্ভব নিংড়ে নেওয়া। তারপর সে যখন মেগ-এর দিকে হাত বাড়াতে আসবে, তার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করবে তখন হেগান এগিয়ে আসবে। মারের ভয় দেখিয়ে, দরকার পড়লে দু-ঘা মেরে তাকে বিদেয় করবে। টাকায় টাকা আয় হবে, অথচ আসলে কিছুই যাবে না। এমন ব্যবসা কি দুনিয়ায় দুটো আছে?
মেগ-এর সঙ্গে সরল বিশ্বাসে কারচুপি খেললল। রেস্তোরাঁর চাকরি ছেড়ে সে পথে নামলো। খদ্দের ভালই পেলো। টাকাও আসতে লাগলো অনেক। সে যাবতীয় রোজগার গেলার-এর হাতে তুলে দিল। গেলার রোজই টাকা পয়সা নিয়ে জুয়োর আড্ডায় যেতো। মেগ প্রতিবাদ করতো না। গেলার বলতে যে টাকা দু-গুণ চারগুণ করার এমন উপায় নাকি দুনিয়ায় আর দুটো নেই।
কিন্তু দ্বিগুণ তো দূরের কথা সে যে টাকা সঙ্গে নিয়ে যেতো তা কোনদিনই ফিরতো না। একদিন, দু-দিন, পনেরোদিন, এবারে মেগ একটু চঞ্চল হলো।
তাইতো টাকার নামে টাকা যায়, খাটুনিও যায় প্রচুর, কিন্তু লাভ তো কিছুই হচ্ছে না। মেগ কোথায় নেমে এসেছে। গেলারের জন্য সে রক্তজল করে পয়সা রোজগার করছে কিন্তু গেলার তাকে কি দিলো, কতগুলো মিথ্যে আশা। নাঃ ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখতে হচ্ছে।
রাতে গেলার জুয়োর আড্ডায় বেরিয়ে যাবার পরে মেগ শুয়ে পড়তো। পরে গেলার কখন কি অবস্থায় ফিরতে সে জানতে পারতো না।
সেদিন সে আর ঘুমালো না। গেলার বেরিয়ে যাবার পর সে জেগে রইল। দেখা যাক আজ গেলার কি অবস্থায় ফেরে।
রাত তখন ভোর হয়ে এসেছে। জানলার কাছে বসে বসে একটু ঝিমুনির মতো এসেছে। হঠাৎ একটা গাড়ির শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। সে ধড়মড় করে উঠে বসলো।
একখানা গাড়ি এসে তার বাড়ির উল্টো দিকে থামলো। গেলার টলতে টলতে গাড়ি থেকে। নামলো। নেমে ফের গাড়ির জানলা পথে মাথা গলিয়ে অনেকক্ষণকার সঙ্গে কথা বললো। তারপর হাত নাড়তে নাড়তে হাঁটতে লাগলো। গাড়ি ছাড়লো।
ল্যাম্পপোস্টের ম্লান আলোয় মেগ দেখলো, গাড়ির পেছনের আসনে বসে একটা মেয়ে। ঘাড় ফিরিয়ে গেলার-এর দিকে তাকিয়ে সে হাত নাড়ছে।
মেগ স্থির হয়ে একইভাবে বসে রইল। দুফোঁটা জল মুক্তোবিন্দুর মতো তার চোখে চিকচিক করতে লাগল। সিঁড়িতে গেলার-এর পায়ের শব্দ শোনা গেল। মেগ হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছলো।
গেলার ঘরে এসে ঢুকলো। মেগকে জেগে থাকতে দেখে একটু অবাক হল। উঠে ঘরেব আলোটা জ্বেলে দিলো মেগ। দেখলো গেলার-এর জামার কলারের কাছে লিপস্টিকের দাগ, বুকের কাছে দুচারটে লম্বা চুল লেগে আছে।
এই তাহলে তোমার জুয়ো খেলা, মেগ স্থির দৃষ্টিতে তাকালো গেলার-এর দিকে। আমার সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে আমারই রোজগারের টাকায় তুমি ফুর্তি করছে। মদ, মেয়েমানুষ নিয়ে আনন্দ করছে। বাঃ এই না হলে পুরুষ মানুষ!
গেলার-এর নেশা ছুটে গেল। সে ধরা পড়ে গেছে দেখে প্রতিবাদ করলো না। বরং রাগে চীৎকার করে উঠল। বলল বেশ করেছি। আরো করবো। ডুবে ডুবে জল খাও, ভাবো তোমার মত কেউ টের পায় না। দ্যাখা কথাটা অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম তোমার মত মেয়েছেলের আমার আর দরকার নেই। জেগে যখন ছিলে, নিশ্চয়ই দেখেছো, ওই মেয়েটার গাড়ি আছে, বাড়ি আছে, অনেক টাকাও আছে। এরকম একটা দুটো নয় গণ্ডায় গণ্ডায় মেয়ে আমাকে পারার জন্য হাত বাড়িয়ে আছে। আমি চললাম। আমাকে আর পাবে না।
গেলার বেরিয়ে গেল। স্থির ভাবে মেগ দাঁড়িয়ে রইল। এরকম পরিণতির কথা সে ভাবেনি। এর জন্য সে তৈরীও ছিল না। দুঃখে-অভিমানে তার চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়তে লাগল। গেলার-এর প্রতি অভিমানে তার বুকটা ফেটে গেল।
মেগ আর কদিন বেরোল না। সে ভেবেছিল গেলার হয়তো ফিরে আসবে। মুহূর্তের উত্তেজনায় সে যা বলেছে, তার জন্য ক্ষমা চেয়ে আবার মেগ-এর সঙ্গে থাকবে, তার হৃদয় ভালবাসার রঙে পূর্ণ করে রাখবে।
কিন্তু না গেলার ফিরলো না, হতাশায় বেদনায় অপমানে অভিমানে মেগ মরমে মরে গেল। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, সে আর জীবনে গেলার-এর কাছে ফিরে যাবে না। সে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করবে।
সাতদিন পরে চোখের জল মুছে মেগ উঠল। সস্তা পাউডারে চোখের কালিটালি ঢাকলো। সস্তা ফিনফিনে পোষাক পরলো। তারপর হাত ব্যাগ নিয়ে সে পথে বেরোল।
এক টেলিফোন বুথে ঢুকে সে এক মক্কেলকে ফোন করল। সেই মক্কেলটা এক মধ্যবয়স্ক বিগতদার ব্যবসায়ী। সে এর আগে দুবার মেগ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। দুবারই গেলার এর তাড়নায় প্রচুর অর্থ খেসারত দিয়ে সে হতোদ্যম হয়ে ফিরে এসেছে। এবার মেগ নিজেই ফোন করে গেলার যে নেই একথা জানাতে সে নিশ্চিন্ত হল। বললো মেগ যেন অবিলম্বে তার হোটেলের নির্দিষ্ট কামরাটিতে চলে আসে।
হোটেলে পৌঁছে তার কামরায় যাবার আগে মেগ ঢুকলো মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট বাথরুমে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে পাউডারের তুলিটা বোলাতে বোলাতে হঠাৎ তার দৃষ্টি স্থির হল। সামনের টেবিলে একটা সুন্দর চামড়ার ব্যাগ। কে যেন ভুল করে ওখানে ফেলে রেখে গেছে।
মেগ ব্যাগটা তুলে নিলো। বোম টিপে খুললল। মুহূর্তে রুদ্ধ-বিস্ময়ে সে থরথর করে কাঁপতে লাগল। ব্যাগের মধ্যে এক তাড়া পঞ্চাশ ডলারের নোট। সব মিলিয়ে কম করে হাজার পাঁচেক তো হবেই।
ব্যাগটা বন্ধ করে সে ব্যাগটা নিজের হাতেই রাখলো। নিজের ব্যাগ রাখলো আয়নার সামনে। একটা শিহরণ তার শরীরে খেলে গেল। এবার এত টাকা দেখলে নিশ্চয়ই গেলার আর তাকে অপমান করতে পারবে না। সে তার সঙ্গে আবার এসে থাকবে।
সে দ্রুত পদক্ষেপে তাড়াতাড়ি দরজার দিকে এগোল। হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। এক সুবেশ মহিলা ও পাশে দাঁড়িয়ে। মেগ-এর হাতে ব্যাগটি দেখেই তিনি হাউমাউ করে চেঁচামেচি শুরু করলেন।
ব্যস তারপর যা হবার তাই হলো। লোকজন, হোটেলের ম্যানেজার, থানা পুলিস, বিচারে তিনশো ডলার জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের জেল হল মেগ-এর। আদালতের ভিড়ের মধ্যে সে বারবার একটা চেনা মুখ খুঁজলো। তার গেলার, কিন্তু না গেলার এল না। এ সময় তিনশো ডলার হাতে থাকলেও জেলটা এড়ানো যেত। কিন্তু সঞ্চয় হিসাবে গেলার তাকে একটা টাকাও রাখতে দেয়নি। সব কিছু উড়িয়ে দিয়ে গেছে দু-হাতে।
তিনমাস পর জেল থেকে বেরিয়ে সামান্য কিছু সম্বল করে সে লস এঞ্জেলস ছাড়লো। সোজা এল স্যান ফ্রান্সসিসকোর প্রু টাউনে। লস এঞ্জেলস-এ থাকতে সে শুনেছিল প্রু টাউন শহরটি বেশ বর্ধিষ্ণু। এখানে পয়সা নাকি উড়ে বেড়ায়।
মেগ অফিস পাড়ায় তিনতলার ওপর ছোট একখানা ঘর ভাড়া নিল। কিন্তু পর দিন থেকেই তার ভাগ্য খারাপ। শীত পড়লো সে বছর সবচেয়ে বেশি। খবরের কাগজে লিখলো, এমন শীত নাকি গত পঞ্চাশ বছরেও পড়েনি।
সুতরাং কাজকর্ম যথারীতি প্রায় বন্ধই রাখতে হলো। শীতে রাস্তার লোক পর্যন্ত বেরোয় না, খদ্দের জুটবে কোত্থেকে। সঞ্চয় প্রায় নিঃশেষ হয়ে এলো।
কিন্তু না, এভাবে তো পারা যায় না। শীত আছে, বরফ আছে, সব সত্যি। কিন্তু ক্ষিধেও তো আছে। আধপেটা খেয়ে কাহাতক আর থাকা যায়। একদিন তো তাই মরীয়া হয়ে সবকিছু অগ্রাহ্য করে মেগ বেরিয়ে পড়লো।
পথ জনমানবহীন। গুড়ো গুড়ো বরফ পড়ছে একটানা, উত্তরে বাতাস যেন মেরুদণ্ড অবধি হিম করে দিচ্ছে, রাস্তার বাতিগুলো ম্লান, নিষ্প্রভ, তেমন কিছু শীতের পোষাক মেগ পরেনি। সব শরীরটা তার মুহুর্মুহু কাঁপছে। এগোতে কষ্ট হচ্ছে।
সে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। একজন লোক এদিকে আসছে। মাথায় কান অবধি ঢাকা কালো টুপি, পরনে কালো ওভারকোট। পকেটে দু-হাত ঢুকিয়ে সে বড় বড় পা ফেলে এদিকে হেঁটে আসছে।
মেগ দাঁড়িয়ে পড়লো। বাতি স্তম্ভে হেলান দিয়ে দেহের প্রতিটা প্রত্যঙ্গে কামনার জোয়ার তুলে মনোহারী ভঙ্গিতে দাঁড়ালো। শীত, তুষার উত্তুরে হাওয়া সব সে মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল।
লোকটা তার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। চোখ তুলে তাকাল। মেগ মৃদু হেসে ফিসফিস করে বললো কি চাই নাকি?
একমুহূর্ত নীরব। লোকটা ভ্রু কোঁচকালো। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল চাই, চলো।
মেগ শিউরে উঠল। লোকটার চোখ দুটো যেন কেমন। কি অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ঐ ছোট দুটো চোখে। পাগল-টাগল নয়তো।
কিন্তু না এখন ওসব চিন্তা করার সময় নেই। একজন খদ্দের পাওয়া গেল। এই যথেষ্ঠ। দুজনে পাশাপাশি এগোতে লাগলো। নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো মেগ। মনোহারী ভঙ্গিতে আহ্বান জানাল এসো।
লোকটা নড়ল না। একইভাবে দাঁড়িয়ে রইল একপাশে। গায়ের কোটটাও খুললো না। স্থির দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল মেগ-এর চোখে।
কই, এসো। মেগ চঞ্চল হলো, দাঁড়িয়ে কেন? দাঁড়িয়েই ভালো। আমি চলে যাব। তবে যাবার আগে তোমার সঙ্গে কটা কথা বলে যেতে চাই।
কথা!
হা। কথা বলার মতো আমার কেউ নেই।
কিন্তু কথাই বলো আর যাই করো, টাকা না দিয়ে কিন্তু যেতে পারবে না।
সে কোটের পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করলো। তিনখানা করকরে দশ ডলারের নোট বিছানার উপর ছুঁড়ে দিল এই নাও তোমার টাকা আগামই দিলাম।
মেগ যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না। তিরিশ ডলার! নোট কখানা কুড়িয়ে সে পকেটে রাখলো। বললো বলো। কি বলবে?
কাঠের অভাবে ঘরের কোণে একটা তেলের স্টোভ জ্বলছে। দরজা-জানালা বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ঘর বেশ ঠাণ্ডা। বিবর্ণ ময়লা কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিলো মেগ। তারপর বালিশে কনুই রেখে অর্ধেক শুয়ে তার কথা শুনতে লাগল।
সে অনেক কথাই বললো। তার নাম নাকি ফিলিপ বারলো। এই পৃথিবীতে আপনার বলতে কেউ নেই। মা কদিন আগে মারা গেছে। সে নিঃসঙ্গ একলা। তার বাড়ি আছে। বাগান আছে। ছোট পুকুর আছে। সে ফ্রামলের দোকানে চাকরি করে, ইত্যাদি অজস্র কথা।
শুনতে শুনতে মেগ-এর চোখে তার ঘোর এল। বারলো আরো কি বললো, সে কিছু শুনলো, কিছু শুনলো না। কম্বলের গরমে আরামে আয়েশে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলল। মেগ ধড়মড় করে উঠে বসলো। স্টোভটা কখন যেন নিভে গেছে। ঘরে কুয়াশার মতো মান নিষ্প্রভ ভোরের আলো। বারলোকে সে দেখতে পেল না। তবে কি সেনা, পকেটে হাত দিয়ে মেগ নিশ্চিন্ত হল। তিরিশ ডলার পকেটে ঠিকই আছে। বারলো নিয়ে যায়নি।
মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। কপালের শিরা দুটো দপদপ করছে। গরম নিঃশাস পড়ছে নাক দিয়ে। জ্বর হল নাকি।কনকনে অমন ঠাণ্ডায় বাইরে বেরোনোটা ঠিক হয়নি। সমস্ত শরীর যেন জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। উঃ কি যন্ত্রণা। মেগ চোখ বুঝল।
সে একই ভাবে বিছানায় শুয়ে রইল। বেলা গড়িয়ে বিকেল হলো। সন্ধ্যা নামলো। উঠে আলো জ্বালবে, এমন ক্ষমতাও তার নেই। সে বেহঁশের মতো বিছানায় পড়ে রইল।
এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো মেগ, পারলোনা। কেমন যেন একটা আচ্ছন্ন ভাবতার শরীরে। সামান্য শক্তিও অবশিষ্ট নেই।
কে যেন তার মুখের ওপর ধুকে পড়ল। তার চেহারা ধোঁয়ার মত। এ তো বারলো। সে কি যেন বললো। মেগও কিছু বলতে গেল। তার ঠোঁট নড়ল কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। বারলোর শীতল একখানা হাত তার শরীরের ওপর এসে পড়ল। সে অবসাদে চোখ বুজল।
স্ট্রেচারে করে কে বা কারা যেন তাকে নিয়ে যাচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে নামছে, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, মেগ জ্ঞান হারাল।
দুদিন পর জ্ঞান ফিরল। সে শুয়ে আছে হাসপাতালের এক বিছানায়। নার্সকে জিজ্ঞেস করে জানলোবারলো তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে গেছেন। তিনি রোজ একবার করে এসে নিয়মিত খবর নিয়ে যান।
হাসপাতালে তার দশদিনকাটল।নানারকম ওষুধ, ইনজেকশন কত কি।বারলো রোজ নিয়মিত আসতেন। কোন কথা বলতেন না। বিছানার পাশের টুলটাতে বসে স্থির-অপলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকনে। তারপরে একসময় উঠে চলে যেতেন।
মেগ ভাবতো লোকটা যেন কেমন। আসলে যেচে দয়া দেখানো অনেকের স্বভাব থাকে, এরও বোধহয় তাই। তবে এটা ঠিক হাসপাতালে এনে সে মেগ-এর খুবই উপকার করেছে। এজন্য মেগ তার প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু ওটুকুই। তার পক্ষে ওকে ভালবাসা আদৌ সম্ভব নয়। একবার যে হৃদয়ের অর্ঘ্য সে গেলার-এর পদমূলে সমর্পণ করেছে, সে হৃদয়ে আর অন্য পুরুষের স্থান নেই। আচ্ছা গেলার এখন কোথায় আছে। কেমন আছে। যেখানেই সে থাকুক ভাল থাকুক। তাহলেই মেগ খুশি।
দশ দিনের দিন ঘুম ভেঙে উঠেই মেগ বুঝলো, তার রোগ মুক্তি হয়েছে, সে সুস্থ। খুশিতে উঠে বসলো সে বিছানার ওপর। সে সুস্থ সবল, আবার বাড়িতে ফিরে যাবে। কিন্তু বাড়ি বাড়ি মানে তো সেই অন্ধকুপ, আলো বাতাসহীন দমবন্ধ পরিবেশ, না, না এর চেয়ে সারাজীবন রোগী হয়ে এখানে পড়ে থাকা অনেক ভালো। সে বিষণ্ণমনে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লো।
দিনের আলো নিভে এলো, সন্ধ্যে হয় হয়, এমন সময় বারলো এলো। মেগ-এর আরোগ্যের খবর তিনি আগেই ডাক্তারের মুখে শুনে এসেছেন। মুখে তার আত্মপ্রসাদের হাসি, হাতে একগুচ্ছ জিনিয়া ফুল।
তিনি বিছানার পাশের টুলটাতে এসে বসলেন। মেগ-এর হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিলেন।
মেগ মাথা নীচু করল, ফুলের একটা পাপড়ি দু-আঙ্গুলে ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললো আপনি যা করলেন আমার জন্য, তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আপনার ঋণ আমি…।
হাত তুলে তাকে থামালেন বারলো। দাঁড়াও দাঁড়াও ওসব ঋণ টিনের কথা তুলছো কেন। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে, দেখার কেউ নেই। এনে তুললাম হাসপাতালে। কৃতজ্ঞতা দেখাতে হলে ডাক্তারকে দেখাও কারণ আমি তোমাকে সারিয়ে তুলিনি, যা করেছেন ডাক্তার করেছেন। একটু ইতস্ততঃ করে বললেন দেখো মেগ এই বিরাট পৃথিবীতে আমি একলা, তোমারও কেউ নেই, আমারও কেউ নেই, আমরা দুজন নিঃসঙ্গ মানুষ এবার থেকে একসঙ্গেও তো থাকতে পারি, বিয়ে করে সংসার পাততে পারি। কথাটা একটু ভেবে দেখো।
মনের এই অবস্থায় বারলোর এই অদ্ভুত প্রস্তাবটি মেগকে বড় বিচলিত করলো। একমুহূর্ত, সে ভাবলো, তারপর মুখ তুলে বলল আমি রাজি, চলো আমাকে নিয়ে চলল।
ফেরার পথে সেদিন আরও অনেক কথাই মেগ ভাবলো যে মুহূর্তের বিবেচনায় সে রাজি হয়েছে ঠিকই, তবু একেবারে অন্যায় কিছু একটা করেনি। কারণ সুস্থ স্বাভাবিক জীবন-যাপনের জন্য বিয়ে অতি আবশ্যক। বিয়ের পর যদি মতের মিল না হয় তাহলে দরজা তো ভোলাই আছে। ভাবনা কিসের। বিবাহ-বিচ্ছেদ করাটা আজকালকার দিনে এমন কিছু একটা কঠিন ব্যাপার নয়।
বারলো মাত্র সাতদিনের বিজ্ঞপ্তিতে বিয়ের এক বিশেষ অনুমতি পত্র জোগাড় করল। বিয়ে হয়ে গেলো, আড়ম্বর বা অনুষ্ঠান কিছুই হল না। মেগ খানিকটা নিশ্চিন্ত হল, সুখী হল।
বারলোর বাড়িটা প্রথম কদিন খুবই ভালো লাগলো মেগ-এর। অমন সুন্দর বাগান, শহরের এক প্রান্তে নির্জন-নিরালা পরিবেশে ছোট্ট দোতলা বাড়ি। সব মিলিয়ে তার বেশ ভালোই লাগল।
কিন্তু স্বপ্ন ভেঙে যেতে খুব একটা দেরী হল না। তার স্বপ্নের প্রাসাদ যেন একটা দমকা বাতাস এসে ভেঙে দিয়ে গেলো। বিয়ের পঞ্চম রাতেই ঘটনাটা ঘটলো। মেগ বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।
পঞ্চম রাতটি তাদের প্রথম মিলনের রাত। স্বপ্ন..না, স্বপ্ন তেমন কিছু নেই। মিলনের সব রকম আনন্দের সঙ্গেই মেগ পরিচিত। তাও বারলোকে নিবিড় করে জানার, পাবার কৌতূহল তো একটা আছেই।
মেগ সেকথা ভাবলে আজও শিউরে ওঠে। উঃ সে কি বীভৎস, কি ভয়াল-ভয়ঙ্কর। বারলো যেন একটা পশু, একটা দানব,….
মিলনের প্রথম রাত সেই পশুর হাতে সপে দিয়েই কাটলো। প্রথম দিকে যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত চেপে রইল মেগ। তারপর একসময় বারলোর অত্যাচার আর সহ্য করতে না পেরে তার কবল থেকে কোনোক্রমে নিজেকে মুক্ত করে পাশের ঘরে গেল। ভয়ে সে সারা রাত ঘুমাতে পারলো না।
শুরুতেই শেষ, সেই থেকেই এই ব্যবস্থা, দুজনের ঘর আলাদা, আলাদা। কেউ কারোর ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না। কেউ কারোর দিকে চোখ তুলে তাকায় না অবধি। দু-একটা কথাবার্তা বলার দরকার হলে আকারে ইঙ্গিতেই সারে।
কয়েকমাস এমনভাবেই কেটে গেলো। মেগ মনে মনে অধৈৰ্য্য হয়ে উঠল। একলা বাড়িতে বন্দী না থেকে মাঝে মাঝে বেরোতে শুরু করল।
এমনই একদিন সে কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস কিনতে ব্রেন্ট-এ গেছে। কেনাকাটা শেষে দোকান থেকে বেরিয়ে সে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে এসে দাঁড়াল গেলার হেগান।
গেলারকে দেখেই মেগ-এর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল। একরাশ কান্না এসে গলার কাছে দলা পাকিয়ে রইল। মেগ-এর চোখ ফেটে জল এল। সে চোখ তুলে তাকাল।
এই তো পুরুষ। অটুট স্বাস্থ্য। দেহের আনাচে-কানাচে যৌবন টগবগ করে ফুটছে। এই গেলার-এর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়ে কত না শান্তি পেয়েছে মেগ। গেলার তার প্রেমের পুরুষ।
একঘণ্টা পরে। দুজনে গেলার-এর খাটে পাশাপাশি শুয়ে আছে। গেলার তাকে এক হাতে জড়িয়ে আছে। সে গেলার-এর প্রশস্ত বুকে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে পরম শান্তিতে চোখ বুজে রয়েছে।
মেগ জেলে যাবার অভিজ্ঞতা থেকে বারলোর সঙ্গে প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা সব কথাই গেলারকে বলেছে। কিছু গোপন করেনি, একটুও বাড়িয়ে বলেনি। এখন সে আর বারলো কিভাবে থাকে তাও বলেছে।
সেদিন আরো অনেকক্ষণ পর আবার দেখা করার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্বে মেগ বিদায় নিল।
সেই শুরু। দুজনে আবার ঘনিষ্ঠ হলো। মনের কাছাকাছি এলো। মেগ গেলারকে পেয়ে নিশ্চিন্ত নির্ভয়। প্রায় রোজ দুজনের দেখা হতে লাগলো।
একদিন দুজনে পাশাপাশি শুয়ে আছে। মেগ আরামে-আয়েসে চোখ বুজে শুয়ে আছে। এমন সময় গেলারই কথাটা তুললো।
বারলোর জীবনের বিনিময়ে এক বীমা কোম্পানির সেলসম্যানকে দাবার খুঁটির মতো চালিয়ে কিভাবে অনেক টাকা রোজগার করা যেতে পারে, সে কথা সে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করলো। মেগ মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনলো। বারলোর প্রতি এখন তার দয়া মায়া চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট নেই। সুতরাং, রাজি হতে অসুবিধে কি? সে রাজি হল।
হুইস্কিটা এখনও জলন্ত আগুনের মতো শরীরের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাতের ওপর থুতনি রেখে মেগ ভাবলো, একটা কিছু এখন অবশ্যই করা দরকার। আবার যদি গেলারকে হারাই তাহলে আমি বাঁচবোনা। গেলার ছাড়া আমার জীবনের কোনো মানেই হয়না। অমন উদ্দাম প্রেম, না না একটা কিছু ফন্দী বের করতেই হবে। আমি গেলার-এর জন্য সব করতে পারি। হ্যাঁ দরকার হলে মরতেও পারি।
বারলো ঝোঁপের আড়ালে আড়ালে হেঁটে এগোলেন। সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশ জরীপ করতে করতে এগোচ্ছেন। হঠাৎ তার চোখ উজ্জ্বল হল। তিনি চমকে দাঁড়ালেন ঐ তো গাছের নীচে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিতীয় কোনো গাড়ি বা জনমানসের চিহ্নমাত্র নেই।
রাত সোয়া দশটা। ভিড়টা এখনো তেমন জমেনি। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গাড়ির পর গাড়ি আসতে শুরু করবে। প্রতিটা ঝোঁপের আড়ালে থাকবে একটা করে গাড়ি। আর একজোড়া তরুণ তরুণী। আর তারা চমকে উঠবে উল্লাসে। আমি তাদের উল্লাসের বারোটা বাজাবো।
গাড়িটা থেকে রেডিওর গান ভেসে আসছে। বারলো চারপাশে আর একবার সতর্ক দৃষ্টি ফেরালেন। নিঃশব্দে স্নানের টুপি মাথায় পরলেন, গালে রবারের গোলক দুটো চালান করে দিলেন, তারপর রিভলভারের ট্রিগারে হাত রেখে নিঃশব্দে এগোলেন।কাকড়ার মতো সতর্ক অথচ ভয়াল ভঙ্গিতে।
হাপরের মত বুকটা উঠানামা করছে। বারলো পায়ে পায়ে এগিয়ে চললেন। আজ একটা ফয়সালা অর্থাৎ হেস্তনেস্ত করতেই হবে।