মেতসিসের মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রটি বিশাল, সেখানে বুদ্ধিমান এনরয়েডরা থাকে বলে পুরো এলাকাটি সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে গড়ে উঠেছে। নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে যাতায়াতের জন্য বিশাল করিডোর রয়েছে, এই সকল করিডোরে চৌম্বক–ক্ষেত্র ব্যবহার করে ভাসমান অবস্থায় বুদ্ধিমান এনরয়েড কিংবা তাদের যন্ত্রপাতিগুলো আসা–যাওয়া করছে। রুখ অনুমান করল করিডোরের নিচে সম্ভবত সুপার কন্ডাক্টিং কয়েল রয়েছে, তাপ–নিরোধক ব্যবস্থা থাকার পরও সুপার কন্ডাক্টরগুলো পুরো করিডোরকে হিমশীতল করে রেখেছে। রুথ একটি ভাসমান প্ল্যাটফর্ম করে বুদ্ধিমান এনরয়েডটার সাথে সাথে মূল নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রের গভীরে এসে উপস্থিত হয়েছে। এই এলাকায় মানুষ সম্ভবত কখনোই আসে না, কোথাও খুব ঠাণ্ডা আবার কোথাও উষ্ণ। বাতাসের চাপেরও তারতম্য রয়েছে বলে মনে হল।
নানা করিডোর ধরে এগিয়ে গিয়ে বুদ্ধিমান এনরয়েডটি রুখকে নিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি বিশাল হলঘরের মতো জায়গায় হাজির হল। বোতাম চেপে ভারী দরজাটি সরিয়ে রুখ ভিতরে ঢুকে হঠাৎ করে আতঙ্কে শিউরে ওঠে। ভিতরে যতদূর দেখা যায় মানুষের দেহ। হিমশীতল ঘরটিতে হালকা নীল আলোতে সারি সারি মানুষের দেহগুলো দেখে রুখের প্রথমে মনে হল এগুলো মৃতদেহ। কিন্তু একটু ভালো করে তাকিয়েই বুঝতে পারল মানুষগুলো। জীবন্ত, নিশ্বাসের সাথে সাথে তাদের বুক ওঠা–নামা করছে। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয়। মানুষগুলো শূন্যে ভেসে আছে কিন্তু একটু ভালো করে দেখলেই টাইটেনিয়ামের সূক্ষ্ম তার, শিরায় প্রবাহিত পুষ্টিকর তরলের টিউব এবং অক্সিজেনের প্রবাহ চোখে পড়ে। মানুষগুলো পুরোপুরি নগ্ন এবং ঘুমন্ত। শূন্যে ঝুলে থাকা এই মানুষগুলোর মাঝে অল্প কয়েকজন শিশু এবং কিশোর–কিশোরী, তবে বেশিরভাগই তরুণ–তরুণী।
রুখ কিছুক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে থেকে ভয়–পাওয়া–গলায় বলল, এরা কারা?
এনরয়েডটি একটু রহস্যের মতো ভঙ্গি করে বলল, তুমিই বল।
আমি? আমি কেমন করে বলব?
তুমি পারবে। যাও, মানুষগুলোকে ভালো করে দেখে আস। চতুর্থ সারির তৃতীয় মানুষটি দেখ। সপ্তম সারির শেষ মানুষটিও দেখ। যাও।
রুখ হতচকিত হয়ে ঘুমন্ত মানুষগুলোর মাঝে দিয়ে হেঁটে যেতে থাকে, তার মনে হতে থাকে হঠাৎ করে বুঝি কেউ জেগে উঠে তার দিকে অবাক হয়ে তাকাবে। কিন্তু কেউ জেগে উঠল না, নিশ্বাসের সাথে খুব হালকাভাবে বুক ওঠা–নামা করা ছাড়া তাদের মাঝে জীবনের আর কোনো চিহ্ন নেই।
চতুর্থ সারির তৃতীয় মানুষটি একজন তরুণী। ঘুমন্ত একজনের নগ্ন দেহের দিকে তাকাতে রুখের সংকোচ হল কিন্তু মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে সে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। তরুণীটি ক্রীনা।
রুখ কয়েক মুহর্তে হতবাক হয়ে ক্রীনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে হঠাৎ করে অনেক কিছু তার কাছে স্পষ্ট হয়ে আসে। সে পাশের ঘুমন্ত মানুষটির দিকে তাকাল, এই মানুষটিও
সে চেনে, মানুষের বসতিতে সে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ করে। ওপরে যে ঝুলে। রয়েছে সে কমিউনির তথ্যকেন্দ্র–পরিচালক। পাশের সারিতে রুহান শান্ত চোখে ঘুমিয়ে আছে। সপ্তম সারির শেষ মানুষটি কে হবে সেটাও রুখ হঠাৎ করে বুঝে গেল, তবুও সে হেঁটে গেল নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য। রুখ অবাক হয়ে দেখল মানুষটি সে নিজে। টাইটেনিয়ামের সূক্ষ্ম তার দিয়ে তাকে ওপর থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। নাকের মাঝে সূক্ষ্ম অক্সিজেনের টিউব। হাতের শিরায় সূক্ষ্ম টিউবে করে পুষ্টিকর তরল প্রবাহিত হচ্ছে। মাথার মাঝে থেকে কিছু ইলেকট্রড বের হয়ে এসেছে।
রুখ কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর ক্লান্ত পায়ে বুদ্ধিমান এনরয়েডটির কাছে ফিরে এল। এনরয়েডটি হালকা গলায় বলল, তুমি নিশ্চয় এখন জান এরা কারা।
রুখ মাথা নাড়ল, জানি।
তুমি নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ কেন এদেরকে এখানে রাখা হয়েছে?
হ্যা পারছি।
তুমি কি এখনো বিশ্বাস কর মেতসিসে মানুষের বিবর্তন হবে?
রুখ মাথা নাড়ল, না।
বুদ্ধিমান এনরয়েডটি খলখল করে হেসে উঠল, বলল, জৈবিক পদ্ধতি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তোমরা নতুন মানুষের জন্ম দেবে সেই মানুষ মেতসিসে জৈবজগতের দায়িত্ব নেবে আমরা সেই ঝুঁকি নিতে পারি না। তাই মানুষের এক দল তার দায়িত্ব শেষ করার পর তাদের আমরা অপসারণ করে ফেলি, নতুন একটি দল এসে তার দায়িত্ব নেয়।
পুরোনো দলকে তোমরা কীভাবে অপসারণ কর?
বাতাসের প্রবাহে সঠিক পরিমাণ কার্বন মনোঅক্সাইড মিশিয়ে দিয়ে। তুমি জান মানুষ অত্যন্ত দুর্বল প্রাণী, তাদের হত্যা করা খুব সহজ।
মেতসিসে আমাদের মতো কয়টি দল এসেছে?
আজ থেকে সাড়ে সাত শ বছর আগে মেতসিস এই গ্যালাক্সির কেন্দ্রের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। প্রতি পনের বছরে আমরা একবার করে তোমাদের নতুন করে সৃষ্টি করেছি।
তার মানে এর আগে পঞ্চাশবার আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?
হ্যাঁ। পঞ্চাশবার সৃষ্টি করে পঞ্চাশবার ধ্বংস করা হয়েছে।
যখন এদের নতুন করে সৃষ্টি করা হয় তখন এদের স্মৃতিতে কী থাকে?
তুমি জান কী থাকে। তোমাকেও একদিন সৃষ্টি করা হয়েছিল।
রুখ হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল–তার শৈশব তার কৈশোর তার যৌবনের সকল স্মৃতি আসলে মিথ্যা? আসলে এইভাবে তার শীতল দেহকে ধীরে ধীরে বড় করা হয়েছে? এইভাবে তার মস্তিষ্কে মিথ্যা কাল্পনিক একটা স্মৃতি প্রবেশ করানো হয়েছে? মায়ের কোলে বসে বসে সে বাইরে তাকিয়ে আছে, মা মিষ্টি সুরে গান গাইছে–সব মিথ্যা?
রুখ একটি নিশ্বাস ফেলল, হঠাৎ করে তার কাছে তার পুরো জীবন, এই মহাকাশযান, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কদাকার এনরয়েড, বিশাল হলঘরে সারি সারি ঝুলে থাকা মানুষের দেহ সবকিছুকে কেমন জানি অর্থহীন বলে মনে হতে থাকে।
মানব–সদস্য এনরয়েডটি রুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি খুব বেশি জেনে গিয়েছ।
আমি জানতে চাই নি।
কিন্তু তুমি জেনেছ। এই তথ্য নিয়ে তুমি মানববসতিতে ফিরে যেতে পারবে না।
রুখ অন্যমনস্কভাবে এনরয়েডটির দিকে তাকাল, তাকে এখন মেরে ফেলা হবে ব্যাপারটিও কেন জানি আর সেরকম গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না।
মানব–সদস্য–আমি যতদূর জানি মৃত্যুকে তোমরা খুব ভয় পাও।
পাই।
তোমার স্মৃতিতে ক্রীনা নামের একটি মেয়ের রূপ অনেকবার এসেছে।
রুখ কোনো কথা না বলে কদাকার এনরয়েডটির দিকে তাকাল। এনরয়েডটি হাসির মতো শব্দ করে বলল, তোমার মৃত্যুর খবরে সে নিশ্চয়ই খুব বিচলিত হবে।
রুখ এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে রইল, মানুষ থেকে বুদ্ধিমত্তায় অনেক উন্নত হলেই কি তাদেরকে মানুষ থেকে অনেক বেশি নিষ্ঠুর হতে হবে?
তোমার মৃত্যুর খবরে তার মস্তিষ্কে কী ধরনের চাঞ্চল্য হয় দেখার একটু কৌতূহল হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কী যদি সুযোগ থাকত আমি ক্রীনাকে এনে তার সামনে তোমাকে হত্যা করতাম
হঠাৎ করে রুখের মনে হল তার মস্তিষ্কে একটি বিস্ফোরণ ঘটেছে। সে হিংস্র চোখে এনরয়েডটির দিকে তাকাল, দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, মহামান্য এনরয়েড, আপনি সম্ভবত বুদ্ধিমত্তায় আমার থেকে দুই মাত্রা উপরে কিন্তু আপনার কৌতূহলটুকু আমার কাছে দুই মাত্রা নিচের এক ধরনের অসুস্থতা বলে মনে হচ্ছে।
এনরয়েডটি রুখের দিকে ঘুরে তাকাল, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে এক ধরনের শীতল কণ্ঠে বলল, মানব–সদস্য, তুমি নিশ্চয়ই তোমার অবস্থানটুকু জান। আমি তোমার চোখের রেটিনার দিকে তাকিয়ে তোমার মস্তিষ্কের সকল নিউরনকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারি!
রুখ হঠাৎ চিৎকার করে বলল, আমি কি সেটাকে ভয় পাই?
পাও না?
না। বুদ্ধিমত্তার কোন স্তরে কে থাকে তাতে কিছু আসে–যায় না, যার বুকের ভিতরে কোনো ভালবাসা নেই তার সাথে দানবের কোনো পার্থক্য নেই। মানুষ দানবকে ঘেন্না করে, ভয় পায় না।
আহাম্মক! এনরয়েডটি চিৎকার করে বলল, তোমার মতো শত শত মানুষকে আমরা কীটপতঙ্গের মতো পিষে ফেলি
হঠাৎ করে রুখ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। মাথা ঘুরিয়ে দেয়ালের সাথে লাগানো একটি টাইটেনিয়াম রড হ্যাঁচকা টানে খুলে নেয়। তারপর দুই হাতে ধরে সে এনরয়েডটির দিকে এগিয়ে গেল। দাতে দাঁত ঘষে হিংস্র গলায় বলল, মানুষকে হত্যা করতে চাইলে করতে পার–কিন্তু তাকে তার প্রয়োজনীয় সম্মানটুকু দিতে হবে।
এনরয়েডটি এক পা পিছিয়ে বলল, খবরদার! তার শরীর থেকে হঠাৎ তীব্র অবলাল রশি এসে রুখকে আঘাত করল–রুখ প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠে অন্ধ আক্রোশে হাতের রডটি দিয়ে এনরয়েডটির মাথায় আঘাত করল। এনরয়েডটি সরে যাওয়ায় আঘাতটি লাগল মাথা থেকে বের হয়ে আসা একটি টিউবে। হঠাৎ করে টিউবটি মাথা থেকে খুলে আসে এবং তার ভেতর থেকে গলগল করে আঠালো সবুজ রঙের এক ধরনের তরল বের হতে থাকে। ঝাজালো গন্ধে হঠাৎ ঘরটা ভরে গেল।
এনরয়েডটি আর্তচিৎকার করে বলল, আমার তরল! আমার কপোট্রন শীতলকারী তরল!
রুখ হতচকিত হয়ে এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে থাকে। সে রাগে অন্ধ হয়ে এনরয়েডটিকে আঘাত করেছে সত্যি কিন্তু তার আঘাত যে সত্যি সত্যি মানুষের থেকে দুই মাত্রা বেশি বুদ্ধিমান একটি যন্ত্রের কোনো ক্ষতি করতে পারবে সেটি সে একবারও বিশ্বাস করে নি। এনরয়েডটি একবার দুলে উঠে পড়ে যেতে যেতে সেটি কোনোভাবে নিজেকে সামলে নেয়। এনরয়েডটির মাথার একটি অংশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, সেখান থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করে। উত্তপ্ত অংশটি হঠাৎ গনগনে লাল হয়ে ওঠে এবং এনরয়েডটি দুই হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে আর্তচিৎকার করে ওঠে, আমার স্মৃতি আমার স্মৃতি–আহা—হা-হা–আমার স্মৃতি
রুখ হতচকিত হয়ে তাকিয়ে রইল এবং হঠাৎ করে এনরয়েডটির পুরো মাথাটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। মাথার অংশটি থেকে কিছু পোড়া টিউব, তার এবং ফাইবার বের হয়ে ঝুলে থাকে, ফিনকি দিয়ে থিকথিকে এক ধরনের তরল বের হতে থাকে এবং এনরয়েডটির দুটি অপুষ্ট হাত কিলবিল করে নড়তে থাকে। সমস্ত ঘরটি এক ধরনের বিষাক্ত গন্ধে ভরে যায় এবং দূরে কোথাও তারস্বরে এলার্ম বাজতে শুরু করে। পুরো দৃশ্যটিকে রুখের কাছে একটি অতিপ্রাকৃতিক দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়।
কয়েক মুহূর্তের মাঝে ঘরটির মাঝে অসংখ্য রোবট এবং এনরয়েড এসে হাজির হল। যান্ত্রিক রোবটগুলো বিধ্বস্ত এনরয়েডকে সরিয়ে নিয়ে যায়, বিশেষ নিরাপত্তা রোবট ঘরটিকে পরিশোধন করতে থাকে। নিরাপত্তা রোবট রুখের খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়, দেখে বোঝা গেলেও এই রোবটগুলো নিশ্চয় সশস্ত্র, হাতে ধরে রাখা টাইটেনিয়াম রডটি একটু নাড়ালেই সম্ভবত তাকে বাষ্পীভূত করে ফেলবে।
মানব–সদস্য রুখের সামনে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বুদ্ধিমান এনরয়েড বলল, তুমি তোমার হাতে ধরে রাখা টাইটেনিয়াম রডটি নিচে ফেলে দাও।
কেন?
তুমি সম্ভবত এর আঘাতে আমাদের অন্য কোনো একজনকে বিধ্বস্ত করতে পারবে যদিও সেটি সেরকম গুরুত্বপূর্ণ নয় কারণ আমাদের সকলের সকল স্মৃতি মূল তথ্যকেন্দ্রে সংরক্ষিত থাকে এবং আমরা কিছুক্ষণের মাঝেই নিজেদের পুনর্বিন্যাস করতে পারি।
তার মানে তার মানে–
না। মানুষকে হত্যা করার মতো এটি অপরিবর্তনীয় ঘটনা নয়। কিন্তু তবুও সে ধরনের কাজে আমরা উৎসাহ দিই না। বিশেষ করে তোমার ঠিক পিছনে যে নিরাপত্তা রোবট দাঁড়িয়ে আছে সেটি অত্যন্ত ক্ষিপ্র। তোমার যে কোনো ধরনের নড়াচড়াকে সেটি বিপজ্জনক। মনে করে তোমাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে পারে।
রুখ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু আমাকে তো মেরেই ফেলবে। মানুষ কখনো মুখ বুজে অবিচার সহ্য করে না। শেষমুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করে। আমি এই টাইটেনিয়াম রডটি ফেলব না। কেউ আমার কাছে এলে এক আঘাতে–
বুদ্ধিমান এনরয়েডটি হঠাৎ হাসির মতো শব্দ করে বলল, তোমাদের কিছু কিছু মানবিক অনুভূতি অত্যন্ত ছেলেমানুষি। কাছে না এসেই তোমাদের ধ্বংস করে দেওয়া যায়। তুমি কী চাও?
আমি মানুষের বসতিতে ফিরে যেতে চাই।
ঠিক আছে তুমি ফিরে যাবে।
রুখ থতমত খেয়ে বলল, আমি জীবিত অবস্থায় ফিরে যেতে চাই।
ঠিক আছে তুমি জীবিত অবস্থায় ফিরে যাবে।
রুখ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বুদ্ধিমান এনরয়েডটির দিকে তাকিয়ে রইল–সেটি কি সত্যি কথা বলছে?
হ্যাঁ, আমি সত্যি কথা বলছি। তোমাদের কাছে জীবন–মৃত্যু খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের কাছে নয়। তুমি বেঁচে থাকলে বা মারা গেলে আমাদের কিছু আসে–যায় না। সত্যি কথা বলতে কী তুমি যে ঘটনাটি ঘটিয়েছ আমি সেটা একটু বিশ্লেষণ করতে চাই। সে জন্য আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। এর বেশি কিছু নয়।
কিন্তু—
হ্যাঁ। রুখ কথাটি বলার আগেই এনরয়েড প্রতিবার তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছে, এই ঘরের তথ্যটুকু তুমি নিতে পারবে না। তোমার স্মৃতি থেকে এই তথ্যটুকু আমরা মুছে দেব।
সেটি কি করা যায়? শুধুমাত্র একটি স্মৃতি একটি বিশেষ স্মৃতি?
হ্যাঁ। করা যায়। তুমি তোমার হাত থেকে টাইটেনিয়াম রডটি ফেলে আমার দিকে এগিয়ে আস।
রুখ বুদ্ধিমান এনরয়েডটির দিকে তাকাল, সেটি কি তার সাথে কোনো ধরনের প্রতারণা করার চেষ্টা করছে?
এনরয়েডটি আবার হেসে ফেলল, বলল, না। আমি তোমার সাথে প্রতারণা করব না। বিশ্বাস কর তোমার সাথে সাধারণ কথাবার্তা চালিয়ে যেতেই আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার কথা যদি বিশ্বাস না কর মানববসতিতে ফিরে গিয়ে একটা পোষা প্রাণীর সাথে ভাব বিনিময়ের চেষ্টা করে দেখ। বুদ্ধিমত্তা একপর্যায়ের না হলে ভাব বিনিময় করা যায় না।
রুখ হাত থেকে টাইটেনিয়াম রডটি ছুঁড়ে ফেলল। এনরয়েডটি বলল, চমৎকার। এবারে তুমি আরেকটু কাছে এগিয়ে এস। তোমার চোখের দিকে তাকাতে হবে–তুমি নিশ্চয়ই জান রেটিনা আসলে মস্তিষ্কের একটা অংশ। মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার জন্য এটি সবচেয়ে সহজ উপায়।
রুখ এনরয়েডটির কাছে এগিয়ে যায়, এনরয়েড তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই ঘরে কী দেখেছ মানব–সন্তান।
আমি দেখেছি মানববসতির সব মানুষকে তৈরি করে বড় করা হচ্ছে।
কেন?
আমরা যারা আছি তাদের যখন দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে তখন তাদের সবাইকে সরিয়ে দিয়ে
তুমি কথা বলতে থাক।
রুখ কথা বলতে থাকে কিন্তু তার অবচেতন মন হঠাৎ একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক খেলায় মেতে ওঠে। এই শীতল ঘরের তথ্যটি সে তার মস্তিষ্কে করে গোপনে নিয়ে যেতে চায়। কীভাবে নেবে সে জানে না, অন্য কোনো তথ্যের সাথে যদি মিশিয়ে দেওয়া যায়? যদি সে কল্পনা করে সে একটি শিশু সে তার মায়ের হাত ধরে ঘুরছে। মায়ের সাথে একটা বিশাল ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দরজ ধাক্কা দিতেই সেই দরজা খুলে গেল, তার মা চিৎকার। করে উঠল। রুখ ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা?
মা বলল, চোখ বন্ধ করে ফেল, রুখ। চোখ বন্ধ কর—
কেন মা? কী হয়েছে?
ভয় পাবি। তুই দেখলে ভয় পাবি।
কী দেখলে ভয় পাব?
মানুষ। শত শত মানুষকে ঝুলিয়ে রেখেছে।
কোন মানুষ এরা?
মানববসতির মানুষ।
মা, এরা কি মৃত?
না বাবা। এরা সব ঘুমিয়ে আছে।
কেন ঘুমিয়ে আছে?
জানি না। কিন্তু একদিন জেগে উঠবে–কিন্তু সেটি হবে খুব ভয়ঙ্কর
কেন ভয়ঙ্কর মা? কেন?
আমি জানি না জানি না
মা হঠাৎ আর্তচিৎকার করতে থাকে, রুখের চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তে নিরাপত্তা রোবটটি তাকে ধরে ফেলল।
বুদ্ধিমান এনরয়েডটি খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে রুখের অচেতন দেহের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মানুষের বুদ্ধিমত্তা সম্ভবত যথার্থ নিরূপণ করা হয় নি।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা অন্য একটি এনরয়েড বলল, তুমি কেন এই কথা বলছ?
জানি না। আমার স্পষ্ট মনে হল এই মানুষটি—
এই মানুষটি?
এই মানুষটি আমাকে লুকিয়ে কিছু একটা জিনিস করল।
তোমাকে লুকিয়ে?
হ্যাঁ। যখন তার স্মৃতি মুছে ফেলছি তার নিউরনকে মুক্ত করছি তখন মনে হল অন্য কোথাও সে নিউরনকে উজ্জীবিত করছে–
সেটি কীভাবে সম্ভব?
এনরয়েডটি হেসে ফেলল, বলল, জানি না।