মিত্রানীকে বেশী খুঁজতে হয়নি–
সুহাস যেখানে পড়ে ছিল–সেই ঝোপটারই অন্য দিকে একটা গাছের নীচে, মিত্রানীকে পাওয়া গেল–চিত হয়ে পড়ে আছে মিত্রানী। হাত দুটো ছড়ানো। বিদ্যুৎই প্রথমে দেখতে পায়।
তার পরনের নীল মুর্শিদাবাদী সিল্কের শাড়িটার আঁচল বুকের উপর থেকে সরে গিয়েছে আর শাড়ির প্রান্তভাগটা প্রসারিত হাঁটুর অনেকটা উপরে উঠে এসেছে। বাঁ দিককার জঙ্ঘা অনেকটা
গায়ের ব্লাউজের বোতামগুলো মনে হয় কেউ যেন হ্যাচকা টানে ছিড়ে ফেলেছে। তলার ব্রেসিয়ারটারও একই অবস্থা।
চোখ দুটো যেন মিত্রানীর ঠেলে বের হয়ে আসছে। যেন এক অসহ্য যন্ত্রণার স্পষ্ট চিহ্ন ওর সারা মুখে তখনো। মুখটা সামান্য হাঁ করা, উপরের পাটির দাঁতের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। বোবা—সবাই যেন বোরা হয়ে গিয়েছে।
বিদ্যুৎই সামনে মিত্রানীর মুখের উপরে ঝুঁকে পড়ে অর্ধস্ফুট একটা চিৎকার করে ওঠে।
মিত্রানী—মিত্রানী মরে গেছে—
হ্যাঁ–সত্যিই—মিত্রানী মৃত।
ঘটনার আকস্মিকতায় সকলেই যেন কেমন বোবা–বিমূঢ়।
সবাই একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। কেমন যেন বোবা অসহায় দৃষ্টিতে। সুহাস-বিদ্যুৎ-অমিয়-সতীন্দ্র-কাজল-পাপিয়া-মণি-ক্ষিতীশ–
ইতিমধ্যে আসন্ন সন্ধ্যায় ঝাপসা অন্ধকার কখন যেন আরো ঘন, আরো জমাট বেঁধে উঠেছে।
কেউ কাউকে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না, ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে কেবল আটটি মানুষের উপস্থিতি।
সামান্য কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়তেই বাতাসে একটা আলগা ঠাণ্ডার আমেজ তখন।
মিত্রানী মৃত।
নজন এসেছিল—তাদের মধ্যে একজন থেকেও নেই-পড়ে আছে ওদের সকলের। চোখের সামনেই তার প্রাণহীন দেহটা মাত্র। মিত্রানী আর কোন দিনই কথা বলবে না—-হাসবে না, সুললিত মধুর গলায় রবীন্দ্র বা অতুলপ্রসাদের গান গেয়ে উঠবে না।
ভারী জমাট প্রাণান্তকর স্তব্ধতাটা যেন বিদ্যুতের কণ্ঠস্বরে হঠাৎ তরঙ্গায়িত হয়ে উঠলো। সকলকেই যেন সে প্রশ্ন করলো, এখন কি করি আমরা?
বিদ্যুতের প্রশ্নে সকলেই নিঃশব্দে এ ওর মুখের দিকে তাকাল। তাই তো, কি এখন করবে ওরা—কি করতে পারে ওরা?
সুহাস জবাবটা যেন দিল, মিত্রানীকে তো এইভাবে এখানে ফেলে যেতে পারি না–
বিদ্যুৎ বললে, তবে কি করবো?
ওর মৃতদেহটা চল তোমার গাড়িতে করেই—
বিদ্যুৎ বললে নিয়ে যাবো?
হ্যাঁ—
কোথায়? কোথায় নিয়ে যাব। বললে আবার বিদ্যুৎ।
ক্ষিতীশ বললে, আচ্ছা বিদ্যুৎ, এমনও তো হতে পারে এখনো ও মরে যায়নি বেঁচে আছে। আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না, হয়ত ঝড়ের মধ্যে আচমকা পড়ে গিয়ে খুব বেশী আঘাত পেয়ে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।
তাহলে? কাজল বললে।
পাপিয়া বললে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয় না—
ক্ষিতীশ বললে, হ্যাঁ সেই ভাল। চ, আমরা ওকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলি–
বিদ্যুৎ মাথার দিকে ধরলো, ক্ষিতীশ আর অমিয় দুজন পায়ের দিকে। মিত্রানীর দেহটা তুলতে গিয়েই বিদ্যুৎ যেন হাতে কিসের স্পর্শ পেয়ে তাড়াতাড়ি বললে, এই, কারো টর্চ আছে—টর্চের আলোটা ফেল তে।
টর্চের আলো ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ বললে, নামাও–
ওরা আবার একটু যেন থতমত খেয়েই বিদ্যুতের কথায় মিত্রানীর মৃতদেহটা মাটির উপরে নামাল।
দেখি সতীন্দ্র, টর্চটা–
বিদ্যুৎ সতীন্দ্রের হাত থেকে টর্চটা নিয়ে মিত্রানীর গলার কাছে ফেলতেই সর্বপ্রথম ব্যাপারটা তার নজরে পড়লো, মিত্রানীর গলায় একটা সাদা সিল্কের রুমাল পেঁচিয়ে গলার পিছন দিকে শক্ত গিঁট দিয়ে বাঁধা। অন্যান্য সকলেরও ইতিমধ্যে ঐ দিকে দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে।
কি–কি ওটা মিত্রানীর গলায়! কাজল চেঁচিয়ে উঠল চাপা কণ্ঠে। তবে—তবে কি ওকে কেউ গলায় রুমালের ফাঁস দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে—
অমিয় তখনো তাকিয়ে ছিল, মিত্রানীর গলার দিকে। সে-ই বললে, হা-ওকে রুমালের ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করেই মেরেছে–
চিৎকার করে ওঠে কাজল, খুন!
অমিয় আবার বললে, হ্যাঁ—আমার তো তাই মনে হচ্ছে কাজল। সাম ওয়ান কিল্ড হার। শি হ্যাজ বীন ব্রুটালি মাড়ার্ড।
সুহাস বললে, কিন্তু কে? কে হত্যা করলে মিত্রানীকে ঐভাবে—
ক্ষিতীশ বললে, কে হত্যা করেছে এখনো জানি না বটে, তবে ওকে যে হত্যা করা হয়েছে—তাতে কোন ভুল নেই—
মিত্রানীকে হত্যা করা হয়েছে!
কথাটা যেন প্রচণ্ড একটা শব্দ তুলে সকলের কর্ণপটাহের উপর আছড়ে পড়লো একই সঙ্গে।
তাহলে এখন কি করবো? ক্ষিতীশের প্রশ্ন। তার গলার স্বরটা যেন কেঁপে গেল। মনে হলো সে যেন বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছে।
সন্ধ্যায় অন্ধকার আরো ঘন—আরো গাঢ় হয়েছে।
অস্বাভাবিক একটা স্তব্ধতা যেন চারিদিকে।
আবার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলো সুহাসই। বললে, এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলেই তো চলবে না। একটা কিছু তো আমাদের করতেই হবে মণি।
দলের মধ্যে মণিময়ই সব চাইতে বেশী প্র্যাকটিক্যাল। ভেবেচিন্তে কাজ করে এবং বরাবরই দলের সংকট-মুহূর্তে যা পরামর্শ দেবার সে-ই দেয়। এতক্ষণ সে একটি কথাও বলেনি—চুপচাপ এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, সুহাসের প্রশ্নে এতক্ষণে সে কথা বললো, আমার মনে হয় সুহাস এক্ষেত্রে আমাদের একটি মাত্রই কর্তব্য
মিনমিনে গলায় জবাব দিল অমিয়, কি?
আমাদের মধ্যে যে হোক একজন এখুনি শিবপুর থানায় চলে গিয়ে ব্যাপারটা তাদের বলুক
থানায়—থানায় কেন? সুহাস কাপা গলায় প্রশ্ন করে অন্ধকারেই মণিময়ের মুখের দিকে তাকাল।
বুঝতে পারছে না সুহাস, মিত্রানীর মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় যখন, তখন থানায় খবর একটা আমাদের দিতেই হবে। ধীরে ধীরে কথাগুলো বললে মণিময়।
কিন্তু থানায় খবর দিলে—
সুহাসকে থামিয়ে দিয়ে মণিময় বললে, তাছাড়া আমরা আর কি করতে পারি সুহাস? মৃতদেহটা এখান থেকে নিয়ে গেলে বা ফেলে রেখে গেলে এখানেই, আমরা সকলেই বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়বো—
বিপদ! বিপদে পড়বো কেন? সুহাস আবার বললো।
কি বলছো সুহাস! আমাদের সকলকে আজ এখানে সেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কতজনায় হয়ত হৈ চৈ করতে দেখেছে—তাদের মধ্যে কেউ যদি আমাদের কারোর পাড়ার লোক হয়, আমাদের কাউকে চিনে থাকে—ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে পুলিস যখন খোঁজখবর শুরু করবে সেই সময় যদি–
মণিময়কে থামিয়ে দিয়ে সতীন্দ্র এতক্ষণে কথা বললো, য়ু আর রাইট মণিময়, সঙ্গে করে নিয়ে গেলে ডেথ সার্টিফিকেট-এর হাঙ্গামা, তাছাড়া শুধু ডেথ সার্টিফিকেট হলেই হবে না—মিত্রানীর বাবা আছেন ডাক্তার দাদা আছেন, তাঁদেরই বা কি বলবো? আর তাদের অজ্ঞাতে ডেড বডি সকারই বা করবো কি করে—আর যদি এখানে ফেলে যাই, একটু আগে মণিময় যা বললো—আরো জটিলতার সৃষ্টি হবে। তার চাইতে আমিই না হয় যাচ্ছি থানায় সেখানে থেকে ডেকে নিয়ে আসি সব কথা বলে—তোমরা ততক্ষণ এখানে অপেক্ষা করো।
কথাগুলো বলে সতীন্দ্র অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
ওরা সাতজন অন্ধকারে ভূতের মত যেন দাঁড়িয়ে রইলো।
কেউ কারো মুখ ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না। আবছা-ঝাপসা অথচ অন্ধকার থাকার কথা নয়—চাদনী রাত—কিন্তু একটা হালকা মেঘের তলায় চাদ ঢাকা পড়ায় চাঁদের আলো প্রকাশ পায়নি।
ক্ষিতীশ, বিদ্যুৎ, অমিয়, সুহাস, মণিময়, কাজল, পাপিয়া অল্প অল্প ব্যবধানে সব দাঁড়িয়ে।
অমিয় ওদের মধ্যে চেইন স্মােকার। এতক্ষণ সে একটিও সিগারেট ধরায়নি। ক্ষিতীশ ঘন ঘন নস্য নেয়—সেও যেন নস্য নিতে ভুলে গিয়েছে।
আরো কিছুক্ষণ পরে চারিদিকে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়লো। অন্ধকার সরে গিয়ে সব যেন স্পষ্ট হয়ে উঠলো। সকলেই সকলকে এখন দেখতে পাচ্ছে। সকলেই দেখতে পাচ্ছে তাদের সামনে পড়ে আছে মিত্রানীর প্রাণহীন দেহটা।
ঘড়ির কাঁটা যেন আর ঘুরছেই না। থেমে গিয়েছে—সময় যেন হঠাৎ থমকে থেমে গিয়েছে। নিস্তব্ধতা যেন আরো কষ্টকর—আরো দুঃসহ।
অত বড় গার্ডেনটা একেবারে জনপ্ৰাণীহীন–একটা স্টীমারের ভো শোনা গেল। শব্দটা কাপতে কাপতে মিলিয়ে গেল।
আরো—আরো অনেক পরে। দূর থেকে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল—ঐ দিকেই আসছে আলোটা। দুটো প্রোজ্জ্বল অনুসন্ধানী চোখের মত একেবারে এগিয়ে আসে আর সেই সঙ্গে শোনা যায় দূরাগত একটা গাড়ির ইজিনের শব্দ। শব্দটা স্পষ্ট হতে
স্পষ্টতর হয়।
একটা জীপ গাড়ি এসে থামল ওদের সামনে।
প্রথমে থানা-অফিসার সুশীল নন্দী—দুজন কনস্টেবল—আর নামলো সতীন্দ্র।
কোথায় ডেডবডি? সুশীল নন্দী জিজ্ঞাসা করলেন।
ঐ যে, সতীন্দ্র দেখিয়ে দিল।
হাতে নন্দীর জোরালো টর্চ ছিল, সেই আলো ফেলে নন্দী মিত্রানীর মৃতদেহের সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন। নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করলেন মৃতদেহটা—গলার ফাসটা দেখলেন, তারপর উঠে দাঁড়ালেন। সকলের মুখের দিকে তাকালেন।
সুশীল নন্দী আগেই থানায় বসে সতীন্দ্রর কাছ থেকে ব্যাপারটা শুনেছিলেন—তাই বোধ হয় ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে আর গেলেন না। সোজাসুজিই একেবারে প্রশ্ন শুরু করলেন—আপনারা তা হলে কেউই কিছু জানেন না বা দেখেনও নি—কে ওর গলায় ফাঁস দিয়ে ওকে খুন করলো?
সবাই চুপ। কারো মুখে কোন কথা নেই।
হুঁ। আচ্ছা ভদ্রমহিলার কোন শত্রু বা ঐ ধরনের কিছু ছিল?
শত্রু! প্রশ্ন করলো সতীন্দ্র।
হ্যাঁ–শত্রু, বললেন নন্দী, যে হয়ত সুযোগের অপেক্ষায় ছিল—আজ সুযোগ পেয়ে—-থাক সে কথা, আচ্ছা একটা কথা বলুন তো–আজ সারাটা দিন আপনাদের আশেপাশে কাউকে ঘুর ঘুর করতে দেখেছেন–
মণিময় বললে, না—তাছাড়া আমরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম। কোন দিকে তাকাবার আমরা ফুরসৎ পাইনি–
কোয়াইট ন্যাচারাল–তবু–
না—অফিসার, মণিময় আবার বললে–সে-রকম কিছুই আমাদের কারো চোখে পড়েনি–
আপনারা কাউকে সন্দেহ করেন এ ব্যাপারে? আবার নন্দীর প্রশ্ন।
না—এবার সুহাস মণিময় একত্রেই জবাব দিল।
আপনাদের সঙ্গে তো গাড়ি আছে?
হ্যাঁ, বিদ্যুতের গাড়ি আছে, মণিময় বললে।
বিদ্যুতবাবু কে?
বিদ্যুৎ এগিয়ে এলো। বললে—আমিই বিদ্যুৎ সরকার।
আপনিই একা তাহলে গাড়িতে এসেছিলেন আজ? আর বাকী সব—
মণিময় জবাব দিল-ট্রামে বাসে।
বিদ্যুৎবাবু—
বলুন—
আপনাদের সকলকে একবার থানায় যেতে হবে—সুশীল নন্দী বললেন।
থানায় কেন? সুহাস বলল।
আপনাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা করে এক-একটা জবানবন্দি–আই মীন স্টেটমেন্ট চাই–
মণিময় বললে, বেশ, যাবো আমরা—
এক কাজ করুন, বিদ্যুৎবাবুর গাড়িতে যারা পারেন যান, বাদ বাকি সব জীপে উঠুন।