০৫. মিঃ ও মিসেস ক্রফট
সে রাতে হোটেলে নাচের আসর বসেছিল। নিক তার বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে রাতের খাওয়া সারতে এসেছিল। আমাদের দেখে আন্তরিক উষ্ণ ভঙ্গিতে হাত নাড়ল।
কাঁধখোলা বেগুনি রঙের পোষাক পরেছে সে। এক উজ্জ্বল, উচ্ছল মহিলা। আমি পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে মন্তব্য না করে পারি না। পোয়ারো আমার কথায় সমর্থনসূচক মাথা নাড়ে। সঙ্গীদের থেকে একেবারে বৈপরীত্যমূলক উদাহরণ। ফ্রেডেরিকা রাইস পরেছেন সাদা রঙের পোষাক। ওরা সবাই মহা উৎসাহে নাচানাচি করল। বেশ সুন্দরী মহিলা। পোয়ারোর কথায় আমি সোৎসাহে বলি–আমাদের নিক তো?
না হে, আমি অন্য মহিলাটির কথা বলছি।
একটু থেমে পোয়ারো কয়েকমুহূর্ত পর আবার বলে–উনি কি বিষণ্ণ? অসুখী? কেউ জানে না। আমি তোমায় বলতে পারি হেস্টিংস, উনি একটা চলমান রহস্যের খনি।
তুমি কি ঠিক বলতে চাইছ?
পোয়ারো মৃদু হাসে। তারপর এক সময়ে বলে-তুমি নিজেই এক সময় সব বুঝতে পারবে, শুধু আমার কথাটা মাথায় গেঁথে রাখ।
আমাকে অবাক করে দিয়ে পোয়ারো হঠাৎ উঠে দাঁড়ায়।
নিক আর শ্যালিঙ্গার তখনও নাচছে। ফ্রেডেরিকা এবং লাজারুম নাচ শেষ করে চেয়ারে এসে বসেছে। লাজারুম তারপর উঠে দাঁড়ায় এবং বাইরে বের হয়ে যায়। মিসেস রাইস তখন একা।
পোয়ারো তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আমিও তাকে অনুসরণ করি। ওর পদ্ধতিটাই হচ্ছে সরাসরি এবং মূল লক্ষ্যভিত্তিক।
মাদাম, যদি অনুমতি দেন, আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চাই।
মিসেস রাইস আঙুল দিয়ে তার সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বলেন–নিশ্চয়ই। বসুন।
শীতল, অনুত্তেজিত কণ্ঠস্বর।
মাদাম আমি জানি না আপনার প্রিয় বান্ধবী আপনাকে জানিয়েছেন কি না, আজ আবার ওর ওপর একটা প্রাণঘাতি হামলা হয়েছিল।
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ধূসর চোখ দুটোয় আতঙ্ক ভরে উঠল–তার মানে?
মাদাম জোয়েল বার্কলিকে আজ সকালে গুলি করে খুন করার চেষ্টা হয়েছিল।
সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভাব পাল্টে যায়। মৃদু হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটের কোণে–নিক বলেছে নিশ্চয়ই আপনাকে।
না মাদাম, আমি নিজের চোখে ঘটনাটা ঘটতে দেখেছি। এই যে বুলেটটা। পোয়ারোর মেলে ধরা হাতের তালুতে বুলেটটা।
বিস্ফারিত চোখে বুলেটটার দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে থাকে ফ্রেডেরিকা, কিন্তু…. কিন্তু…… তার মানে………
মানেটা হচ্ছে খুবই সহজ। ওটা মাদাম জোয়েল বার্কলির কল্পনা নয়। বাস্তবে গত কয়েকদিন ধরেই ওনাকে খুন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে পোয়ারো বলে–আচ্ছা মাদাম, এখানে আসবার আগে আপনি কোথায় ছিলেন?
টাকিস্টকে। বন্ধুদের সঙ্গে।
বেশ, আমি কি আপনার সেই বন্ধুদের নামগুলো জানতে পারি? নিমেষের মধ্যে মহিলার যুগল কুঞ্চিত হয়ে উঠল–সেকথা আপনাকে বলব এরকম কোনও কারণ আছে কি?
না না, সেরকম কিছু নয়। টাকিস্টকে আমারও বেশ কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব আছে। তাই জানতে চাইছিলাম আপনি তাদের চেনেন নাকি। যেমন, বুকানন, আমার একজন বন্ধু। চেনেন আপনি?
মিসেস রাইস উদাস ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন–না, আমি চিনি না। আচ্ছা আমরা অবান্তর প্রসঙ্গে সময় কেন নষ্ট করছি? আপনি বরং নিকের কথা বলুন। কে ওকে গুলি করেছে? কেন?
আমি তা জানি না, এখনও কিন্তু নিশ্চিত থাকতে পারেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমি সেটা খুঁজে বের করে ফেলব। আমার নাম এরকুল পোয়ারো। আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ।
অতি বিখ্যাত মানুষ। সে আপনার মহানুভবতা। এবার মিসেস রাইস খুব ধীরে ধীরে কেটে কেটে বললেন-আপনি আমাকে কি করতে বলেন এখন?
সত্যি কথা বলতে কি এবার আমরা দুজনেই যথেষ্ট অবাক হই। আমরা কেউই এমুহূর্তে ওনার মুখ থেকে এধরনের কথা আশা করি না।
আমি আপনাকে অনুরোধ করব আপনার বন্ধুর ওপর একটু নজর রাখতে। পোয়ারো শান্ত গলায় বলল।
ঠিক আছে। সেটাই যথেষ্ট।
পোয়ারো কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়ায়।
পোয়ারো আমি একটু দূরে সরে আসবার পর বললাম-তুমি কি আস্তিনের তাসগুলো সরাসরি দেখিয়ে দিলে না?
আবার আমরা আমাদের টেবিলে ফিরে এলাম।
পোয়ারো তার চেয়ারে বসতে বসতে বলল–তাছাড়া আমি আর কি করতে পারতাম। আমার কাছে প্রথম কাজ হল সবার আগে মিস বার্কলির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। আমি কোনও ঝুঁকি নিতে চাই না। তবে একটা কথা পরিষ্কার হয়ে গেছে।
কি? আমি সোৎসাহে প্রশ্ন করি।
মিসেস রাইস টাকিস্টকে ছিলেন না।
কোথায় ছিলেন তাহলে?
আঃ, এরকুল পোয়ারো ঠিকই সঠিক তথ্য খুঁজে বার করবে।
হান্ডসাম লাজারুম এতক্ষণে ফিরে এসেছেন। মহিলা তাকে সব বলছেন।
আহ–চমৎকার, লোকটা অতীব ধূর্ত হে। আমাদের দিকে সে তাকাচ্ছেই না।
আহ-হা, যদি আমার এখন জানা থাকত।
আমি অবাক গলায় প্রশ্ন করি কি?
সেটা সোমবারই জানতে পারবে।
একটু পরেই নিক ওর নাচের সঙ্গীর থেকে আলাদা হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। আমার উল্টো দিকের চেয়ারটায় আমার মুখোমুখি এসে বসল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল–এ যেন মৃত্যুর কিনারায় দাঁড়িয়ে নেচে চলা।
প্রসঙ্গ বদল করার জন্য পোয়ারো বলে–আপনি খুব সুন্দর নাচেন মাদাম জোয়েল।
লাজুক মুখে পোয়ারোর প্রশংসাটা গ্রহণ করে সে বলে–ধন্যবাদ।
এরপর আরও কিছু কথাবার্তার পর নিক উঠে চলে যায়।
কথাটা আমার মোটেই ভাল লাগল না। নিকের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে আমি পোয়ারোকে উদ্দেশ্য করে বলি–কিন্তু কথাটা সত্যের খুব কাছাকাছি। সেটা মানতেই হবে। আর গোটা ব্যাপারটা মেয়েটা যে খুব সাহসভাবে গ্রহণ করেছে সেটাও মানতেই হবে। পোয়ারো দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলে।
পরের দিন ছিল রবিবার। আমরা হোটেলের টেরেসে বসেছিলাম। সাড়ে এগারোটা। হঠাৎ পোয়ারো উঠে দাঁড়ায়। চল হেস্টিংস, আমরা এক্ষুনি একটা পরীক্ষা করব।
কি?
মাদাম ও তার দুই বন্ধু গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। রাস্তা পরিষ্কার। চল, চল উঠে পড়।
আমি অবাক গলায় বলি–কিসের রাস্তা……..
পোয়ারো আমার জামা ধরে টানে–গেলেই দেখতে পাবে। কথা বলে সময় নষ্ট করার মত সময় আমাদের হাতে নেই।
আমরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। ঘাস বিছানো সরু পথটা একেবারে সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে। সেখানে এখন কয়েকজন স্নানার্থী দেখা যাচ্ছে। আমরা সরু পথটা ধরে এবার ডাইনে মোড় নিলাম। কিছুটা হাঁটবার পরই আমরা সেই লোহার মরচে ধরা দরজাটার সামনে এসে পড়লাম যার মাথার ওপর লেখা আছে এন্ড হাউস, (ব্যক্তিগত সম্পত্তি)।
পোয়ারো সতর্ক চোখে চারপাশে তাকিয়ে দেখে। না, ধারে কাছে কেউই নেই। আমরা নিঃশব্দে এগিয়ে গেলাম। অবশেষে বাগান পেরিয়ে আমরা এসে দাঁড়ালাম ভোলা ফ্রেঞ্চ (গরাদহীন) জানালাগুলোর সামনে।
পোয়ারো আবার সতর্ক চোখে চারপাশ দেখে নেয় একবার।
না, আমাদের দেখার মত কেউ নেই এখানে। অনায়াসে জানালা টপকে আমরা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ি। সোজা এসে হাজির হলাম বাইরের বসার ঘরে। সময় নষ্ট না করে পোয়ারো ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। আমিও এর পিছু নিলাম। পোয়ারো সোজা নিকের ঘরে ঢুকে পড়ল এবং নিকের বিছানার উপর বসে পড়ল। আমাকেও ইশারায় বসতে বলল।
দেখলে তো, কিরকম সহজ কাজ? কেউ বাধা দেওয়া দূরে থাক, কেউ টের পর্যন্ত পেল না। আমরা এখন নিরাপদে যা খুশি করতে পারি। পোয়ারো চাপা গলায় বলল।
পোয়ারো তুমি বলছ যে কোনও অচেনা মানুষ ঘটনাগুলোর পেছনে আছে, সেই তত্ত্বটাকে বাদ দিতে চাইছ?
অবশ্যই হেস্টিংস, অবশ্যই। কোনও পাগল বা অচেনা ব্যক্তির কাজ এটা মোটেই নয়। এখানে কাজগুলো যে করছে সে অবশ্যই নিকের ঘনিষ্ট বৃত্তের মানুষ।
আমরা সিঁড়ি বেয়ে আবার নিচের দিকে নামতে শুরু করলাম, আর তখনই থমকে গেলাম।
যাকে দেখে আমরা থমকে গেলাম সেও আমাদের দেখে প্রথমটায় থতমত খেয়ে যায়, চড়া গলায় প্রশ্ন করে–কে আপনারা? এখানে কি করছেন?
আহ-হ, পোয়ারো হাসিমুখে বলে–আপনি মসিয় ক্রফট, তাই তো?
হ্যাঁ, কিন্তু এখানে আপনারা…….
পোয়ারো বিনীত ভঙ্গিতে বলে, নিচে গিয়ে বসে কথা বলা যায় না?
বেশ। আমরা দুজন ভদ্রলোকের পেছন আবার একতলায় নেমে এলাম।
আমি এরকুল পোয়ারো।
লোকটির মুখের কালো মেঘ এবার দ্রুত পরিষ্কার হয়ে যায়।
ওহ, আপনিই সেই বিখ্যাত গোয়েন্দা।
এবার পোয়ারো আমারও পরিচয় করিয়ে দেয়।
আমি এবং পোয়ারো দু’জনে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ভদ্রতাসূচক হাসি।
কিন্তু আপনি এখানে কেন? কোনও গণ্ডগোল ঘটেছে নাকি?
পোয়ারো গম্ভীর গলায় বলে-গণ্ডগোল? সেটা নির্ভর করে ঘটনাকে আপনি কোন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখবেন।
অস্ট্রেলীয় ভদ্রলোক টাক মাথা সত্ত্বেও বেশ সুপুরুষ। তার চেহারার গড়ন, মুখশ্রী বেশ আকর্ষক। সবচেয়ে বেশি যেটা নজর কাড়ে-ওর লাল চোখের তীক্ষ্ণ, হৃদয়ভেদী দৃষ্টিকা।
আসলে আমি বাগানের টমেটো আর নারকেল দিতে এসেছিলাম মিস বার্কলিকে। মাঝে মাঝেই এভাবে জানালা টপকে এ বাড়িতে ঢুকি আমি। ফলের ঝুড়িটা নামিয়ে রেখে ফিরে যাবার সময়ে ওপরের ঘরে পায়ের শব্দ এবং পুরুষের আওয়াজ পাই। যেহেতু এখানে চোর বা ডাকাতের উৎপাত নেই, তাই আমি একটু অবাকই হয়েছিলাম। দেখতে আসছিলাম ব্যাপারটা কি।
একটু থেমে মিঃ ক্রফট আবার বললেন–কিন্তু আপনি এখানে কেন? ব্যাপারটা কি?
খুব সামান্য ব্যাপার। মাদাম বার্কলির শোবার ঘরের একটা ভারি তৈলচিত্র তারের বাঁধন ছিঁড়ে পড়ে গিয়েছিল, উনি আপনাকে নিশ্চয়ই বলেছেন?
হ্যাঁ, ভাগ্যের জোরে উনি খুব বেঁচে গেছেন।
আমি মাদামকে কথা দিয়েছিলাম যে ছবিটা আটকাবার জন্যে একটা মোটা শিকল এনে দেব। হাতে এরকম বিপত্তি আর না ঘটে। মাদাম আমায় বলেছিলেন, আজ সকালে তিনি বন্ধুদের নিয়ে বেরোবেন। আমি এসেছিলাম কতটা শেকল ঠিক লাগবে প্রয়োজন যতটুকু সেই মাপটা নিতে। বালক সুলভ সরল মুখে পোয়ারো বলে।
ওহ, তাহলে এই ব্যাপার।ক্রফট একটা গভীর শ্বাস ছাড়ে। আবার পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে চকচকে চোখে বলে–আমার সৌভাগ্য যে বিখ্যাত এরকুল পোয়ারোর সঙ্গে আমার আলাপ হল। মিঃ পোয়ারো, আপনি কি এখন ব্যস্ত? যদি তা না হয় তাহলে আমার বাড়িতে এক কাপ চা খেয়ে যেতে অনুরোধ করব।
নিশ্চয়ই। আমার হাতে এখন সেরকম কোনও কাজ নেই।
বাহ, চমৎকার, পোয়ারো আমার দিকে তাকায়–তুমি মাপ ঠিকমত নিয়েছ তো হেস্টিংস? আমি পোয়ারোকে আশ্বস্থ করার ভান করি।
ক্রফট মানুষটি যে কথা বলতে ভালবাসেন অল্পক্ষণেই বুঝে যাই আমরা। ওর বাড়ি যে মেলবোর্নের কাছে ছোট্ট এক শহরে, ওর প্রথম জীবনের সংগ্রাম–সবই ওই সামান্য আলাপের মধ্যে জমিয়ে দেয়। এমন কি তার স্ত্রীর সঙ্গে তার আলাপ পরিচয় সবিস্তারে জানাতে ভুল করে না। আমরা বরাবরই ভেবেছি সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াব, আর এই দেশটাতে বেড়াতে আসা আমাদের সবসময়ই তীব্র ইচ্ছা দিল।ইতালিতে থাকার সময়েই ওর স্ত্রী মারাত্মকভাবে আহত হন ট্রেন দুর্ঘটনায়। মেরুদণ্ডে মারাত্মক আঘাত পেয়ে তিনি প্রায় পঙ্গু। ডাক্তারেরা সবাই একটা কথা বলেছেনবিশ্রাম, সময়ই ধীরে ধীরে সারিয়ে তুলবে চোটটা। কথা বলতে বলতেই আমরা ক্রফটের বাড়ি এসে পৌঁছলাম। বাড়িতে পা দিয়েই মিঃ ক্রফট উচ্চস্বরে ডাক দিলেন–কোয়ি, কোয়ি, দেখ কারা এসেছেন। তারপর আমাদের দিকে ফিরে বললেন-ভেতরে আসুন।
আমরা বাড়ির ভেতর ঢুকে এলাম। মিঃ ক্রফট আমাদের নিয়ে সোজা ওর শোবার ঘরে এসে হাজির হলেন। সোফা, বিছানা, আলমারি দিয়ে সাজানো সুন্দর একটা ঘর। রোগা ফ্যাকাশে চেহারার মাঝবয়সী এক মহিলা বিছানায় শুয়েছিলেন। মিঃ ক্রফট আমাদের সাথে ওর আলাপ করিয়ে দিলেন। পোয়ারোর নাম শুনে মহিলার দু’চোখ খুশিতে ঝিলিক মেরে উঠল। দেখা গেল তিনি পোয়ারোর কীর্তিগুলোর প্রায় সব খবরই রাখেন। পোয়ারো (এবং আমিও) সসম্ভ্রমে তাঁর সঙ্গে করমর্দন করলাম। মিসেস ক্রফট পোয়ারোর সঙ্গে তার কয়েকটা পূর্বতন সমাধান হওয়া মামলার বিষয়ে আলোচনা করতে লাগলেন। এমন কি তিনি এও জানালেন পোয়ারো যে গোয়েন্দাগিরি থেকে অবসর নিয়েছেন কাগজ পড়ে সেটাও জানেন। মিসেস ক্রফটের সঙ্গে কথায় কথায় এসে পড়ল নিকের প্রসঙ্গ। মিসেস মিলি ক্রফট দেখা গেল আমাদের বন্ধুর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত। মেয়েটি সত্যিই প্রাণবন্ত। আমাদের বাড়িতে যখন আসে যেন আনন্দে মাতিয়ে দিয়ে যায়। দুর্ভাগ্য নিক এখানে বেশিদিন এসে থাকে না। হয়তো ও সেটা করত যদি না ওর সব বিষয়ে নাক গলানো ওই তুতো ভাইটি তাতে সবসময় বাগড়া দিত। নিকের ইচ্ছে মত কোনও কাজ ও করতে দেয় না। ক্রমে মিলি ক্রফটের কথায় একটা আদল যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। শেষপর্যন্ত পোয়ারো প্রশ্নটা না করে থাকতে পারল না।
মাদাম, আহ-হ, তাহলে এম. চার্লস ভ্যাইস আমাদের সুন্দরী বন্ধুটিকে ভালবাসেন? বার্ট ক্রফট মৃদু আপত্তির গলায় বলেন–কি দরকার মিলি ওসব পরচর্চায়? তাতে অবশ্য কান দিলেন না মিলি।
আহ, আমাদের নিক এত বোকা নয়। একটা সামান্য উকিল। চালচুলো নেই। কোন দুঃখে ওকে বিয়ে করতে যাবে বলন তো? আমার মনে হয় কি ওই নাবিক ভদ্রলোক, শ্যালিঙ্গারকেই শেষপর্যন্ত বিয়ে করবে। আমি তাহলে খুশি হব। যদিও, ভদ্রলোকের বয়স নিকের তুলনায় একটু বেশি। আর নিকের বান্ধবী, রাইস। ওকেও আমার বেশ ভাললাগে। যদিও, সম্প্রতি ওকে খুবই দুঃখী দেখায়। বিষণ্ণ দেখায়। তবে মেয়েটার প্রতি আমার বিশেষ রকম আগ্রহ হবার কারণ আছে। তাই না বার্ট? আচমকাই মিঃ ক্রফট উঠে দাঁড়ালেন-ওসব কথা এখন থাকুক। মিলি ওসবে জড়াবার দরকার নেই। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে তারপর তিনি বলেন–আপনি কি অস্ট্রেলিয়ার নানা রকম সুন্দর সুন্দর ছবি দেখা পছন্দ করবেন? পোয়ারো এক কথায় রাজি হয়ে গেল।
এর মিনিটদশ পর আমরা ক্রফটের থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম। খুবই ভাল মানুষ। আমি রাস্তায় বের হয়ে বললাম। হুস, তোমার ওদের খুব পছন্দ হয়েছে তাই না।
পোয়ারোর কথায় আমি অবাক ভঙ্গিতে বললাম, কেন? তোমার পছন্দ হয়নি? পোয়ারো গভীর চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। শুধু কয়েকটা খটকা………
খটকা? আমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলি–পোয়ারো দিনে দিনেই তুমি সন্দেহ বাতিকগ্রস্থ হয়ে উঠছ।
তুমি কি বলছ হেস্টিংস। একেবারে ঠিক। আমি সবাইকে সন্দেহ করি হেস্টিংস। সব কিছুকে সন্দেহ করি।
.
০৬.
মিঃ ভাইস
সোমবার, সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই দেখলাম, পোয়ারো একটা সুন্দর ড্রেসিং গাউন পরে বিছানায় বসে আছে।
হেস্টিংস। তাড়াতাড়ি প্রাতরাশ সেরে নিয়ে তৈরি হয়ে নাও। তোমাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে।
বেশ খানিকটা বিস্ময় নিয়ে আমি বলি–কি কাজ?
আমি একটা ছোট্ট চিরকুট লিখে রেখেছি। সেটা মাদাম জোয়েলের হাতে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। আমি তৈরি হয়ে এসে যখন পোয়ারোর হাত থেকে চিরকুট নিতে যাব, ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে–হেস্টিংস, প্রিয় হেস্টিংস, কতদিন ধরে বলছি চেহারাটায় একটু গোয়েন্দাসুলভ গাম্ভীর্য যোগ কর। চুলের সিঁথিটা মাঝখান দিয়ে কর। একটুকরো দাড়ি রাখ থুতনিতে। আমার মত। একটু গোয়েন্দা সুলভ বানাও তোমার মধ্যবিত্ত চেহারাটাকে। আমার কথায় তো তুমি কান দেবার প্রয়োজনই মনে করও না। আমি গম্ভীর মুখে চিরকুটটা পোয়ারোর হাত থেকে নিলাম।
মিস বার্কলি এক তলায় বসবার ঘরে এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন। অন্য দিনের তুলনায় আজ তার চোখের কালি কিছুটা গাঢ় মনে হল। আমি পোয়ারোর চিরকুটটা তার হাতে তুলে দিলাম।
সকাল ১০টা নাগাদ মিস বার্কলি আমাদের হোটেলে এলেন। ওনার হাতে একটা টেলিগ্রাম। সেটা পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দেন-আশাকরি আপনি সন্তুষ্ট হবেন।
পোয়ারো টেলিগ্রামটা পড়ে। আমিও। পৌঁছচ্ছি। আজ ৫.৩০ বিকেলে। ম্যাগি। কিন্তু আপনি ভুল করছেন। ম্যাগির মস্তিষ্ক বলে কোনও বস্তুই নেই। কাজকর্মে খুব পটু ঠিকই। কিন্তু কোনও গুপ্তঘাতককে চিহ্নিত করতে পারবে, আমায় রক্ষা করবে, এটা ম্যাগির কাছে খুবই বেশি রকম দাবি করা হচ্ছে।
পোয়ারো উদাস ভঙ্গিতে বলে–আর কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার?
জর্জ?
এবার তীব্র বিদ্রূপ ভেসে ওঠে নিকের গলায়–জর্জ ওর নাকের ডগায় কিছু বসে থাকলেও তাকে দেখতে পায় না।
মিস বার্কলি এবার টুপিটাকে খুলে সোফার ওপরে ছুঁড়ে ফেলেন, আপনি যাকে ঢুকতে দেবার কথা চিরকুটে লিখেছেন, আমি বাড়িতে বলে এসেছি তাকে বিনা দ্বিধায় যেন ঢুকতে দেওয়া হয়। ব্যাপারটা কিন্তু বেশ রহস্যময় লাগছে আমার কাছে। আপনি কি গোপন মাইক্রোফোন জাতীয় কিছু বসাতে চাইছেন?
না, না, মাদাম, অত প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কোন ব্যাপার নয়। আমি খুব সামান্য একটা ব্যাপার শুধু জানতে চাই–ব্যাপারটা, বেশ মজার আর উত্তেজক।
হ্যাঁ, নিশ্চিতভাবে। মিস বার্কলি উদাস ভঙ্গিতে বলে। আমাদের দিকে পিঠ করে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকেন বেশ কিছুক্ষণ। তারপর যখন সে ঘুরে দাঁড়ায়, ওর মুখের বেপরোয়া ভাবটা সম্পূর্ণ উবে গেছে। অনেক কষ্টে চোখের জল ধরে রেখেছিল।
না, তা না। নিশ্চিতভাবেই নয়। আমার ভয় করছে। ভীষণ রকম ভয় করেছে। ওর মুখে এখন এক শিশুসুলভ অসহায়তা।
না, না, মাদাম, আপনি ভয় পাবার মতো মেয়েই নন। আমি এবং হেস্টিংস দুজনেই জানি সেটা।
না, এটা সাহস নয়। নিক সজোরে তার মাথা নাড়ে-বলতে পারেন এটা এক ধরনের শ্বাসরোধ অপেক্ষা কখন সেই অনিবার্যতাই ঘটবে তার প্রতীক্ষা করা এবং কিভাবে সেটা ঘটবে?
এটা পরিস্থিতির চাপ মাদাম। এসব নিয়ে অকারণ উত্তেজিত না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
ছোট্ট চেয়ারটায় প্রায় ঢুকে বসেছিল নিক। ওর সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট হাতের আঙুলগুলো প্রবলতর নার্ভাসভাবে উদ্দেশ্যহীন নড়ে বেড়াচ্ছিল। পোয়ারো কয়েক পলক ঠান্ডা চোখ ওর সেই অস্থিরতা লক্ষ্য করে। তারপর শান্ত গলায় বলে–মাদাম, আমার মনে হয় আপনি কিছু বলতে চাইছেন। দয়া করে আমাকে সব কথা খুলে বলুন।
না, তেমন কিছু নয়, সেরকম কিছু নেই।
পোয়ারো নিরুত্তেজক শান্ত গলায় বলে-আপনি আমাকে কিছু একটা বলেননি। তাই না?
নিক সন্ত্রস্থ চোখে তাকায়। আমি আপনাকে ছোটখাট সব ব্যাপারটাই বলেছি।
দুর্ঘটনাগুলো, আপনার ওপর হামলার ব্যাপারে নিশ্চয়ই বলেছেন।
নিক বিভ্রান্ত চোখে তাকায়।
কিন্তু আপনি আমায় আপনার হৃদয়ের-মনের সব কথা বলেননি। আপনার জীবনের সবকিছু………
সেক্ষেত্রে কেউ তাহলে এটা করতে পারে?
আহ আপনি তাহলে সেকথা মেনে নিচ্ছেন? পোয়ারো সোৎসাহে বলে।
মেয়েটি সম্মতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। পোয়ারো খুব গভীর মনযোগের সঙ্গে ওর অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করার পর বলে-হয়তো তাই।
তাহলে? আমাকে বলবার মত আপনার কোনও কথা আছে–গোপন কিছু?
আমি খুঁটিয়ে ওকে লক্ষ্য করছিলাম। এক পলকের জন্য ওর চোখের পাতায় বিদ্যুতের ঝলক খেলে যেতে লক্ষ্য করলাম। তারপর দ্রুতই আবার স্বাভাবিকতায় ফিরে এল নিক।
বিশ্বাস করুন, সত্যি সত্যি আমি আপনাকে সব কিছুই বলেছি–এই স্টুপিড় বিজনেসের সঙ্গে যা জড়িত। যদি আপনার মনে হয় আমি অন্য কারও বিষয়ে অন্য আরও কিছু জানি, তাহলে ভুল করছেন আপনি। আমার মনে কোন সন্দেহ নেই যা আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমি বোকা নই। আমি অবশ্যই বুঝতে পারছি, ওই দুর্ঘটনাগুলোর কোনটাই আসলে দুর্ঘটনা নয়। সেগুলো কারও দ্বারা ঘটানো হত্যার চেষ্টা এবং সেটা আমারই ঘনিষ্ঠতম কারও দ্বারা ঘটানো। আর সেটাই আমাকে কাঁটার মত বিধছে। কারণ আমার সামান্যতম ধারণাও নেই এটা কে হতে পারে অন্তত কে হওয়া সম্ভব, সেই ধারণাটুকুও নেই আমার।
মেয়েটি আবার একবার জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে একভাবে। পোয়ারো ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে ইঙ্গিত করে আমাকে চুপ করে থাকতে বলে। আমার মনে হয় ও আশা করছে কিছু একটা প্রতিক্রিয়া ঘটবে মেয়েটির মধ্যে। মেয়েটির আত্মনিয়ন্ত্রণ এবার হয়তো ভেঙে যাবে এবং সে এবার সত্যি কথা বলবে। কিন্তু তখনকার স্বর ও কথার ভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। যেন দূর থেকে স্বপ্নজড়ানো কোনও কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।
আপনি জানেন, সবসময় চিরদিন আমি কি ভাবতাম? এন্ড হাউসকে খুব ভালবাসতাম আমি। সেখানকার পারিপার্শ্বিকে আমি একটা নাটক করব ভেবে এসেছি চিরদিন। নানারকম বিষয়ও ভাবতাম। অবশেষে, যেখানে সত্যিই এক নাটক ঘটছে, যা নাকি আমি পরিচালনা করছি না। যদিও সেই নাটকের মুখ্য চরিত্রে আমি। অথচ প্রথম অঙ্কেই আমার মৃত্যু লেখা রয়েছে। বলতে বলতে ওর গলা ভেঙে যায়।
না, না, মাদাম জোয়েল…….. পোয়ারো ব্যস্ত গলায় বলে–এভাবে বলবেন না। এটা এক ধরনের হিস্টিরিয়া হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
নিমেষে, চকিতে ঘুরে ধারাল চোখে পোয়ারোর দিকে তাকায় সে–ফ্রেডি নিশ্চয়ই আপনাকে বলেছে, আমি হিস্টিরিয়াগ্রস্থ? তীক্ষ্ণ চোখে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে গলায় কাঠিন্য এনে বলে, ফ্রেডি যা বলে সবসময় তা সত্যি বলে বিশ্বাস করে নেবার কোনও কারণ নেই।
কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর পোয়ারো যে প্রশ্নটা করে সেটা সম্পূর্ণই অপ্রাসঙ্গিক। আমাকে একটা কথা বলুন তো মাদাম, আপনি কি কখনও এন্ড হাউস বিক্রি করার প্রস্তাব পেয়েছিলেন?
না।
আপনি যদি ভাল দাম পান, বাড়িটা কি বিক্রি করে দেবার চিন্তাভাবনা করেছেন?
কয়েকমুহূর্ত নীরবতা……… তারপর নিক আবার কথা বলে-না, কখনও না। অবশ্য প্রস্তাবটা যদি অবিশ্বাস্য রকমের আকর্ষণীয় হয়, সেক্ষেত্রে বিক্রি না করাটা তো চরম বোকামি হবে, তাই না?
যদিও, আমি এই বাড়িটাকে এত ভালবাসি সেহেতু এটাকে বিক্রি করার কথা ভাবিই না।
আমি বুঝতে পারছি। নিক দরজার দিকে এগোতে থাকে–আজ রাতে বাজি পোড়ানোর উৎসব হবে। আপনারাও আসুন না। তারপর আমাদের সঙ্গেই ডিনার করবেন।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। এত খুব আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা হবে। পোয়ারো এক কথায় রাজি হয়ে যায়। সামান্য হেসে নিক ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
পোয়ারো এবার ওর টুপির দিকে হাত বাড়ায়। আয়নায় নিজেকে দেখে ঠিকঠাক মত টুপিটাকে মাথায় বসায়। কোটের ওপর হাত বুলিয়ে সেটা যথাযথ নিভাজ আছে কিনা পরীক্ষা করে নেয়।
আমি কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করি–কি ব্যাপার হে? আমরা কি কোথাও বের হচ্ছি?
অবশ্যই।
কোথায়?
কিছু আইনগত ব্যাপার………
আমি মাথা নাড়ি–ওহ, তাই তো, বুঝেছি।
মেসার্স ভ্যাইস, ট্রেভরনিয়ন অ্যান্ড উইনার্ডের অফিসটা শহরের প্রধান রাস্তায় অবস্থিত। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে আমরা অফিসে প্রবেশ করলাম। তিনজন কেরানি সেই ঘরে কাজ ছিল। পোয়ারো তাদের একজনকে বলল যে মিঃ চার্লস ভ্যাইস-এর সঙ্গে দেখা করতে চায়। কেরানিটি পাশের একটা ফোন তুলে নিয়ে দু-চারটে কথা বলল, তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল-আমার সঙ্গে আসুন। তিনি আমাদের একটা দরজা পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। তারপর দরজাটা বাইরে থেকে টেনে খুলে এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে আমাদের ঢোকবার পথ করে দিলেন।
আমি সত্যিই আপনাকে ধন্যবাদ দেবার, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। আমার মত এক বিদেশী আপনার পরামর্শ এবং মূল্যবান সাহায্য না পেলে সত্যি সমস্যায় পড়ে যেতাম। আইনি জটিলতা সত্যি এক বিরাট সমস্যা আমাদের মত সাধারণ মানুষদের কাছে।
মিঃ চালর্স ভ্যাইস এই সময়েই জানতে চাইলেন তার কাছে আমাদের কে পাঠিয়েছেন?
মিস বার্কলি, পোয়ারো সময় নষ্ট না করে উত্তর দেয়–তিনি আপনার সম্পর্কিত তাই না? সামান্য থেমে পোয়ারো আবার যোগ করে–সত্যি, অসাধারণ সুন্দর, চার্মিং মহিলা উনি। উনিই আপনার কথা আমাকে বলেছেন। আমি শনিবার ১২.০০–১২.৩০ নাগাদ আপনার কাছে দেখা করার জন্য এসেছিলাম। কিন্তু শুনলাম আপনি বেরিয়ে গেছেন।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে, শনিবার আমি একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিলাম।
আপনার বোন একা থাকেন। তিনি এতবড় বাড়িতে নিশ্চয়ই নিঃসঙ্গ বোধ করেন?
খুবই স্বাভাবিক।
যদি কিছু মনে না করেন মিঃ ভ্যাইস, একটা কথা জানাবেন? বাড়িটা কি বিক্রি হবার কথা আছে?
আমি তো অন্তত সেরকম কিছু জানি না। পোয়ারো দু’হাতের আঙুলগুলো জড়ো করে কিছু একটা ভাববার ভান করে, তারপর বলে–আসলে, আমি একটা এই ধরনের সম্পতি কেনার খোঁজে রয়েছি। পারিবারিক সম্পত্তি। ভ্যাইস মাথা ঝাঁকায়–আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু ……… একটু থেমে সামান্য চিন্তা করে সে আবার বলে–আমার বোন তার এই পারিবারিক সম্পত্তির ওপর নিবেদিতপ্রাণ।
এর কয়েকমিনিট পর আমরা আবার রাস্তায় নেমে এলাম। তাহলে? প্রিয় বন্ধু, চার্লস ভ্যাইসকে দেখে তোমার কি মনে হল?
খুবই নেতিবাচক চরিত্র। তবে যথেষ্ট কৌতূহলজনক– আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বললাম। সেরকম শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বের মানুষ নয়, বলছো?
পোয়ারো প্রশ্রয়ের গলায় প্রশ্ন করে–না, অবশ্যই নয়। উনি হচ্ছেন সেই ধরনের মধ্যমেধার মানুষ, যার সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের ইচ্ছে হবে না কারও।
হুম। পোয়ারো গম্ভীর গলায় বলে–আমাদের কথপোকথনের মধ্যে তোমার ওনার কোন বিষয় অস্বাভাবিক বা মিথ্যাচার বলে মনে হয় নি? পোয়ারো আবার প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, অবশ্যই। এন্ড হাউস বিক্রির ব্যাপারটা।
একেবারে ঠিক ধরেছ। পোয়ারো সমর্থনের গলায় বলে–তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে-মাদাম জোয়েল বার্কলি-র এন্ড হাউসের ব্যাপারে মনোভাবটা তোমার ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর নিবেদিতপ্রাণ বলে মনে হয়েছে?
না, কখনওই ওনাকে এ বিষয়ে অতখানি অনড় মনে হয়নি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রীমান ভাইটি এভাবে বাড়িয়ে ব্যাপারটাকে বলছেন কেন? এর সহজ ব্যাখ্যা-ব্যাপারটা নিয়ে এদের দু’জনের কেউ একজন মিথ্যা বলছেন। এখন আমাদের যথাসম্ভব দ্রুত জানতে, খুঁজে বের করতে হবে সেটা কে? এবং কেন?
পোয়ারো আবার আমার দিকে কৌতুকের চোখে তাকায়–আরও একটা ব্যাপার তুমি লক্ষ্য করেছ কি হেস্টিংস?
সেটা কি?
শনিবার ১২.০০ টার পর উনি অফিসে হাজির ছিলেন না।
.
০৭.
ট্রাজেডি
সন্ধ্যাবেলা আমরা এন্ড হাউসে হাজির হলাম। নিক আমাদের দেখে বিস্ময়ের গলায় বলে–ওহ আপনারা?
পোয়ারো বিনীত গলায় প্রশ্ন করে-আপনি কি কারও অপেক্ষায় রয়েছেন মাদাম জোয়েল?
নিক একটা ড্রাগন-ছাপ সাদা কিমানো পরেছিল। কিছুটা বিরক্ত গলায় ও বলে–আসলে বিকেলের মধ্যে আমার পোষাকটা পৌঁছে দেবার কথা ছিল। সেটা এখনও এল না। কিছুক্ষণ পরই বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। নিক দরজা খুলে দিল। এই যে ম্যাগি তুমি এসে গেছ তাহলে। আলাপ করিয়ে দিই, ইনি হলেন সেই গোয়েন্দা এবং ওই ভদ্রলোক ওনার সহকারী। গোপন ঘাতকের হাত থেকে ওনারাই আমাকে সুরক্ষা দিচ্ছেন। চল, আমরা সবাই বসবার ঘরে গিয়ে বসি। তারপর ওনারাই পুরো ব্যাপারটা তোমাকে বলবেন।
ম্যাগি বার্কলি আমাদের দুজনের সঙ্গে করমর্দন করলেন। আমরা সবাই বাইরের ঘরে এসে বসলাম। প্রথম দর্শনেই মেয়েটির প্রতি আমার একটা বেশ ভাল মনোভাব জন্মাল। মেয়েটির চেহারায় ব্যক্তিত্ব এবং চালচলনে শান্ত ঠান্ডা আত্মবিশ্বাসের ছায়া আছে। এগুলোই আমাকে আকর্ষণ করল সম্ভবত। পুরানো সময়ের চোখে দেখলে নিঃসন্দেহে সুন্দরী বলা যায়। তবে–যদি আধুনিক সংজ্ঞা নিয়ে বিচার করা হয় তবে–না, মোটেই স্মার্ট বলা যাবে না মেয়েটিকে। কোনরকমে সাজসজ্জা, প্রসাধনের চড়া প্রলেপবিহীন একটি সরলতর মুখ। পোষাকও খুবই সাধারণ মানের। একটা কালো সান্ধ্য পোক।
গভীর নীল চোখ তুলে শান্ত গলায় ম্যাগি বলে–নিকের কাছে ঘটনার কথা সব জেনে আমি তো স্তম্ভিত হয়ে গেছি। একটু থেমে সে আবার বলে–সত্যি বলতে কি, ব্যাপারটা আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। কেউ কেন নিকের ক্ষতি করতে চাইবে? নিকের মত মেয়ের তো কোনও শত্রু থাকতে পারে না। মেয়েটির গলায় সত্যি সত্যি অবিশ্বাস ঝরে পড়ে। সেই অবিশ্বাস প্রতিফলিত হচ্ছিল পোয়ারোর দিকে মেয়েটির দৃষ্টিতেও স্বাভাবিক হয়তো। ম্যাগি বার্কলির মত সেকেলে ধারনার মেয়েদের কাছে। বিদেশী মানুষেরা সবসময়ই সন্দেহের বস্তু।
আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি মিস বার্কলি, ঘটনাগুলো সবই সত্যি বাস্তব। কোনও ভুল নেই–পোয়ারো শান্ত গলায় বলে। ম্যাগি কোন উত্তর দিল না বটে, কিন্তু ওর মুখের রেখায় অবিশ্বাসের ভাঁজগুলো সামান্যও পরিবর্তন হল না।
পোয়ারো এবার একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে–মিস বার্কলি, আপনি কি স্কটিশ?
আমার মা ছিলেন স্কটল্যান্ডে।
আপনার বোন সত্যিই খুব সাহসের সঙ্গে পুরো ব্যাপারটাকে সামলাচ্ছেন। উনি আমাদের কথা দিয়েছেন, একদম স্বাভাবিক থাকবেন।
এবার আমি বলি,–সেটাই তো একমাত্র পথ।
তাই নাকি? ম্যাগি তার শান্ত অথচ ধারাল গলায় বলে।
মানে আমি বলতে চাইছি–মনের ভেতর যাই হয়ে চলুক, ঘটুক, বাইরের লোকেদের কাছে সেটা প্রকাশ করে ফেলা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। সবার জন্যেই সেটা অস্বস্তিকর।
আমাদের কথা আরও কিছুটা এগোবার সময় ফ্রেডরিকা রাইস ঘরে ঢুকলেন এবং ওকে অনুসরণ করে একটু পরেই লাজারুমও চলে এল। এরপর নিকও সেজেগুজে এসে হাজির হল। কৃষ্ণকালো একটা হাঁটুঝুল দুর্দান্ত ফ্রক পরেছে সে। কাঁধে জড়িয়েছে চীনা মাল। ভারি চমৎকার দেখাচ্ছিল ওকে।
শুভ সন্ধ্যা এবং স্বাগতম কটেল। সহাস্যে, খুশির ভঙ্গিতে বলল নিক।
আমরা সবাই গ্লাস হাতে নিলাম। নিকের স্বাস্থ্য কামনা করে চুমুক দিলাম। লাজারুম তার হাতের গ্লাসটা উঁচিয়ে ধরল–নিক, চমৎকার শাল। নিশ্চয়ই খুব পুরানো জিনিসটা?
হ্যাঁ, এটা আমার প্রপিতামহের তম্য প্রপিতামহ ওদেশে ভ্রমণ সেরে ফেরার সময়ে নিয়ে এসেছিলেন।
জিনিসটা সত্যি চমৎকার। এরকম জিনিস আজকাল আর পাওয়া যায় না।
জিনিসটা খুবই গরম। যদিও কালো রং আমার একেবারেই পছন্দ নয়।
ঠিকই তো। তোমাকে আগে কখনও কালো রং পরতে দেখিনি। আজ হঠাৎ কেন এটা পরলে?
জানি না। নিক কাঁধ ঝাঁকায়। ব্যাপারটাকে কিছুটা উড়িয়ে দেবার বেপরোয়া ভঙ্গি করে।
কিন্তু আমি ওর দু’ঠোঁটের ভাঁজে, তীক্ষ্ণতর অভিব্যক্তিতে দেখলাম স্পষ্ট বেদনা, হতাশার ছায়া। মানুষ কেন কি করছে সবসময় কি তা বুঝতে পারে? দার্শনিকতা ছুঁয়ে যায় নিকের পরের কথাগুলোতে।
এরপর আমরা রাতের খাবার খেতে গেলাম। লক্ষ্য করলাম একটি পুরুষ চাকরকে এই অনুষ্ঠানের জন্যে ভাড়া করা হয়েছে। লোকটার চেহারাটা আমার কাছে বেশ রহস্যজনক মনে হল। খাবার তেমন আহামরি কিছু নয়। শ্যাম্পেনটি সে তুলনায় বেশ ভাল।
জর্জ এখনও এল না। চিন্তিত স্বরে কথাগুলো বলে আমাদের দিকে তাকায়–কাল রাতে ও প্লাইমাউথ গেছে। আজ সন্ধ্যাতে ফিরে আসবার কথা। যে কোনও সময় সে চলে আসবে। নাচ শুরু হবার আগেই সে এসে পড়বে আশা করা যায়।
ঠিক সেসময় জানালার বাইরে একটা টানা, তীক্ষ্ণ গর্জন শোনা গেল। টানা, চাপা গর্জন।
ওহ এই স্পিডবোটগুলো……. জ্বালিয়ে মারল– লাজারুম বিরক্তির গলায় বলে।
ওগুলো স্পিডবোটের শব্দ নয়। সি প্লেন-নিক ওর স্বভাবোচিত শান্ত গলায় বলে।
হ্যাঁ, আমার মনে হয় তুমি ঠিকই বলেছ– লাজারুম জবাব দেয়।
কথার প্রসঙ্গ এবার ধীরে ধীরে ক্রমে সেই দিকে ঘুরে যায়। কথা প্রসঙ্গেই লাজারুম একসময় বলে–মাইকেল স্যাটন যদি তার বিশ্ব পরিক্রমায় সফল হন, তাহলে সত্যি সেটা আমাদের দেশের পক্ষে ও স্যাটনের জন্যে তো অবশ্যই গৌরবজনক ঘটনা হবে। খুবই দুঃখের ব্যাপার যে ওনার সঙ্গে কি কি ঘটেছে তাই এখনও পর্যন্ত জানা গেল না।
আমার মনে হয় উনি এখনও ভাল আছেন, ঠিক আছেন। নিকের কথার জবাবে লাজারুম অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। ভগবান যেন তাই করেন। তোমার কথাই যেন সত্যি হয়।
সবাই ওনাকে পাগল স্যাটন বলে, তাই না?–এবার ফ্রেডরিকা রাইস বলে।
হ্যাঁ, ওদের বংশটাই একটু পাগলাটে। ওর এক কাকা গত সপ্তাহে মারা গেলেন। তিনি কোটিপতি ছিলেন। একটা বার্ড স্যাংচুয়ারি চালাতেন। তারও পাগলাটে বলে দুর্নাম ছিল।
লাজারুমের কথার প্রত্যুত্তরে ফ্রেডরিকা বলে–নারীবিদ্বেষী হিসাবেও উনি যথেষ্ট কুখ্যাত ছিলেন। আমার মনে হয়, তোমরা মিথ্যে ভয় পাচ্ছ, মাইকেল স্যাটন মোটেই মারা যাননি। ওনার কিছু হয়নি।
নিক এবার যেন কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে কথাটা বলে।
তোমার সাথে ওনার পরিচয় ছিল। তাই না?–লাজারুম প্রশ্ন করে।
গত বছর আমার আর ফেড্রির সঙ্গে লা টকিউটয়ে ওনার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। চমৎকার মানুষ উনি। তাই না ফ্রেডি?।
নিকের প্রশ্নে মিসেস রাইস কটাক্ষ হানলেন, আমাকে জিজ্ঞাসা কর না প্রিয়তমা। ওনার আগ্রহ তোমার বিষয়েই শুধুমাত্র ছিল। উনি তত একবার তোমাকে বাইরেও নিয়ে গিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, স্কারবরো। অসাধারণ অভিজ্ঞতা-কথা শেষ করে, সবার থেকে অনুমতি নিয়ে নিক উঠে দাঁড়াল নাহ, আর দেরি করার মানে হয় না। আমি ফোনটা করেই আসি। দেখি জর্জের আসতে আর কত দেরি হবে।
আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। ন’টা বেজে গেছে। ভেজাট এবং রাম দেওয়া হয়েছে যার যার পছন্দ মত। পোয়ারো লাজারুমের সঙ্গে শিল্প বিষয়ে কথাবার্তা বলতে লাগল। ফ্রেডরিকা রাইস দু’হাতের ওপর থুতনি ভর দিয়ে নিঃশব্দে, স্বাস্নালু ভঙ্গিতে বসে রইলেন। আমি ম্যাগি বার্কলির সঙ্গে নানা বিষয়ে গল্পগুজব করতে লাগলাম। এভাবে কেটে গেল বেশ কয়েকমিনিট। নটা বেজে কুড়ি মিনিট নাগাদ দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে নিক বার্কলি।
সবাই এবার বাইরে এস।
সবাই বাধ্য অনুগতভাবে উঠে দাঁড়াই। ইতিমধ্যে আরও কয়েকজন অতিথি এসে হাজির হয়েছেন। সব মিলিয়ে বারো জনের মত। নিক খুবই ভাল গৃহকর্ত্রী দেখা গেল। সবাইকে একই রকম উষ্ণতার সঙ্গে স্বাগত জানাল। অতিথিরা প্রায় কেউই তেমন আগ্রহী হবার মত নয়। তবে অতিথিরা একজন ছিলেন চার্লস ভ্যাইস।
আমরা সবাই বাইরে এসে দাঁড়ালাম। দূরে সমুদ্র ও বন্দর আবছাভাবে দেখা যাচ্ছিল। উপভোগ্য-এর মনোরম দৃশ্য। যেন একটা হীরের নেকলেশ, মনে হচ্ছে দূর থেকে বিদ্যুতের আলোয় সজ্জিত সেই জায়গাটাকে। বয়স্কদের জন্যে বাগানে কয়েকটা চেয়ারও পাতা রয়েছে। এবার বাজি পোড়ানো শুরু হল। প্রথমটা একটা রঙিন হাউস। নানা রঙের আগুনের তারা ছড়াতে ছড়াতে আকাশমুখী হয়ে ছুটতে ছুটতে একসময় সে বিস্ফোরিত হল।
রাতটা ছিল ঘন অন্ধকারে ঘেরা। নতুন চাঁদ দেখা দিতে আরও তিন দিন বাকি এবং এক আপাদমস্তক গ্রীষ্মরাতের আদর্শ উদাহরণ আজকের রাতটা। খুবই শীতলতম রাত। সমুদ্রের ঝড়ো হিমেল হাওয়ায় আমার পাশে দাঁড়ানো ম্যাগি বার্কলি কঁপছিল। একটা কোট গায়ে চড়িয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। এই সময় ফ্রেডরিকাও বলে উঠলেন–ম্যাগি, আমার ঘর থেকে আমার একটা কোট নিয়ে এস না।
ও শুনতে পাবে না। দাঁড়াও, আমি এনে দিচ্ছি।
নিক বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। আমার নিজের জন্যও দরকার গরম জামার। এই শালে এত ঠান্ডা মানছে না–হালকা গলায় বলে সে। ঠিক সেই মুহূর্তে তীক্ষ্ণ শিষ দিয়ে সমুদ্রের বুক থেকে একটা ঝোড়ো হাওয়া উঠে এল। বাজি পুড়েই চলেছে। চোখ ভরিয়ে দেবার মত দৃশ্য। দেখতে দেখতে আমি আমার পাশেই দাঁড়ানো এক বয়ষ্ক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ জমিয়ে গল্প শুরু করে দিয়েছিলাম।
বুম বুম বুম আকাশে একের পর এক বাজি বিস্ফোরিত হয়েই চলেছে এবং তারপর কোনটা সোনালি রাশি হয়ে ঝরে পড়ছে, কোনটা থেকে নীল হাউস আরও উপরের দিকে ছুটে যাচ্ছে। আবার কোনটা সবুজ বলের সারি হয়ে হাওয়ায় ভাসতে শুরু করেছে। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম এসব।
পোয়ারো এতক্ষণ কোথায় যেন উঠে গিয়েছিল। এবার আবির্ভাব ঘটল তার। আমার কানের কাছে মুখটা এনে বলল–বড্ড, একঘেঁয়ে ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত। আমি সবিস্ময়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। পায়ের তলায় মাটিটা পর্যন্ত সাতাত করছে। শীতে পা’দুটো অবশ হয়ে যাচ্ছে।
আমার বিস্ময় উত্তোরোত্তর বেড়ে চলে–শীত? এমন চমৎকার রাতে তোমার শীত লাগছে?
চমৎকার রাত? পোয়ারো গোঁফে হাত বুলোত বুলোতে বলে–হ্যাঁ, তা তুমি বলতে পারও বটে। যতক্ষণ না তোমার চাঁদিতে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে, তুমি কি বুঝতে পারও যে সত্যি বৃষ্টি পড়ছে? এখানেও যদি একটা থার্মোমিটার থাকত তুমি বুঝতে পারতে আমি কতটা সত্যি বলছি।
আমি প্রখর চোখে এবার পোয়ারোর দিকে তাকাই। তোমার মতলবটা কি বলত? আসল কথাটা এবার বল দেখি।
পোয়ারো এবার পরম মমতায় আমার কাঁধে হাত রাখে। প্রিয় বন্ধুবর, আমি বলতে চাইছি তুমি একটা গ্রীষ্মপ্রধান দেশ থেকে এসেছ। এদেশের শীত নিয়ে তোমার এভাবে ছেলেখেলা করা উচিত নয়।
আমি এবার মুচকি হেসে (কম দিন ওর সঙ্গে তো নেই। ওর ইশারা কোন দিকে চলেছে বুঝতে এখন আর দেরি হয় না, অসুবিধা হয় না) বলি–ঠিক আছে। আমার মত পা তুলে হাঁটতে হাঁটতে (মাটির ভিজে ভাব থেকে পা বাঁচানোর নাটক) আসতে থাকে সে।
আমরা বাড়ির একশো গজের মধ্যে চলে এসেছিলাম। বুঝলে হেস্টিংস, আমাদের সবারই হৃদয়ের মধ্যে একটা শিশু লুকিয়ে আছে।
আমি আচমকা পোয়ারোর হাতটাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। পোয়ারোর হাত আঁকড়ে ধরে মৃদু টান মারলাম। পোয়ারো মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি আঙুল দেখালাম। আমার অঙ্গুলি নির্দেশ লক্ষ্য করে পোয়ারো তাকায় সেদিকে। আমাদের সামনেই….. আমাদের আর ফ্রেঞ্চ উইন্ডোটার মাঝখানে…… আবছা একটা শরীর। কালো চীনা শাল জড়ান।
মন দেউই ডাই, স্পেনিশ ভাষায় পোয়ারো ফিস ফিস করে বলে ওঠে–হে ভগবান।
.
০৮.
ভয়ঙ্কর শাল
বোধহয় খুব বেশি হলে ৪০ সেকেন্ডের মত থমকে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। আতঙ্কহত। স্থানুবৎ। কিন্তু আমাদের কাছে সেটুকু সময়ই যেন দীর্ঘ এক যুগ মনে হল। তারপর, প্রায় যন্ত্রচালিতের মত পোয়ারো সেদিকে এগিয়ে গেল। শেষপর্যন্ত, ব্যাপারটা ঘটল।
পোয়ারো বলল, ওর স্বরে ঝরে পড়া রাগমেশানো তিক্ত হতাশার পরিমাপ করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
আহ-হ, সবকিছু সত্ত্বেও, আমার সবরকম সতর্কতা সত্ত্বেও, ব্যাপারটা ঘটলই, সখেদে বলে পোয়ারো।
আমি একজন উৎকৃষ্ট অপরাধী। আমি কেন ওকে আরও ভাল ভাবে পাহারা দিলাম না? আমার এক মুহূর্তের জন্যেও ওর পাশ থেকে সরে যাওয়া উচিত হয়নি।
তোমার নিজেকে এভাবে দোষী ভাববার কারণ নেই। আমি বলতে চাইলাম। কিন্তু আমার জিভে মুখের ওপরের অংশে আটকে গেল। শুকনো জিভ, গলা দিয়ে একরাশ ঘড়ঘড়ে শব্দ ছাড়া আর কিছু বের হল না।
পোয়ারো প্রত্যুত্তরে সখেদে, প্রবল তিক্ততাময় দুঃখিত ভঙ্গিতে আরও একবার সজোরে মাথা নাড়ল।
মৃতদেহের পাশে বসে পড়ে সে। আর তখনি আমাদের মধ্যে দ্বিতীয় ঝটকাটা এসে হাজির হল। বাড়ির ভেতর থেকে নিক বার্কলির গলা ভেসে এল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, ঘরের আলোকিত দরজায় আবছা ছায়া দেখা গেল।
ওহ, দুঃখিত ম্যাগি, আমি বোধহয় একটু বেশি সময় নিয়ে ফেললাম। দ্রুতপায় এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় নিক। তীব্র চোখে পরিস্থিতি নজর করে। তীক্ষ্ণ এক বিস্ময়ের অভিঘাতে পোয়ারো দ্রুত হাতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মৃত দেহটাকে দু’হাতে চিৎ করে শুইয়ে দেয়।
নিক ততক্ষণে আমাদের পাশে চলে এসেছে। নিমেষে চেরা গলায় আতঙ্ক ও শোকমহিত তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ওঠে নিক–ম্যাগি, হে ভগবান….. ম্যাগি, না এ হতে পারে না…….. পোয়ারো তখনও মেয়েটিকে পরীক্ষা করছিল হাঁটু মুড়ে বসে।
ও….. ও কি…..?–নিকের গলা ভেঙ্গে যায়
পোয়ারো দুঃখিত ভঙ্গিতে মাথা হেলায়–হ্যাঁ মাদাম জোয়েল, উনি মারা গিয়েছেন।
কিন্তু কেন? ম্যাগিকে কেন কেউ খুন করবে?
পোয়ারো চটজলদি উত্তর দেয়, দৃঢ় গলায় বলে–ওনাকে খুন করাটা উদ্দেশ্য ছিল না মাদাম জোয়েল। খুনীর লক্ষ্য ছিলেন আপনি, হ্যাঁ, আপনি ওই কালো শালটাই প্রধান লক্ষ্য নিশানা ছিল খুনীর। ভুলের কারণ ওই কালো শালটাই।
একটা তীব্রতর, বুক ফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে নিক–কেন, কেন আমার সঙ্গে এটা ঘটল না। তীক্ষ্ণ কান্নামাখা গলায় চিৎকার করে ওঠে সে–আমার সঙ্গে কেন এটা ঘটল না? হে ভগবান, আমি আর বাঁচতে চাই না। এখন, আমি মরতে পারলে খুশি হতাম।
পোয়ারো সান্ত্বনার ভঙ্গিতে নিকের কাঁধে হাত রাখে–মাদাম জোয়েল, শান্ত হন।
হেস্টিংস, তুমি পুলিসকে একটা ফোন করে দিও।
আমি নিকের হাত ধরে দাঁড় করাই। ওকে যখন বাড়ির ভিতর নিয়ে যাচ্ছি পোয়ারো তখন আমাকে প্রায় আদেশের সুরে বলে–সবসময় মাদাম জোয়েলের সঙ্গে থাকবে। হেস্টিংস, মনে রেখো, এক মুহূর্তের জন্যেও ওকে চোখের বাইরে যেতে দেবে না, ওর পাশ থেকে নড়বে না।
আমি পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সায় দিই। প্রায় অচেতন নিককে ঘরে এনে একটা সোফায় শুইয়ে দিলাম। মাথার নিচে একটা কুশন দিয়ে দিলাম। তারপর একটা টেলিফোনের খোঁজ করতে লাগলাম। ঠিক তখনই এলিন ঘরে ঢুকল প্রায় ছুটতে ছুটতে। আর একটু হলে আমার সাথে ওর ধাক্কা লাগছিল। আমাকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। আমি লক্ষ্য করি, ওর চোখে-মুখে আশ্চর্য রকমের একটা অভিব্যক্তির ছাপ। দু’চোখ যেন জ্বল জ্বল করছে কিছুর প্রত্যাশায়! বারবার দুই শুকনো ঠোঁটের ওপর সে জিভ বোলাচ্ছিল। ওর দু’হাত কাঁপছিল থরথর করে। মনে হচ্ছে সে যেন কোনও উত্তেজনা বা উদ্বেগে ভুগছে।
কিছু কি ঘটেছে? আমাকে দেখামাত্র সে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ–আমি এড়িয়ে যাওয়া গলায় উত্তর দিলাম। ফোনটা কোথায়?
খারাপ টারাপ কিছু ঘটেছে কি?
একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। একজন আহত হয়েছে। আমাকে ফোন করতেই হবে।
কে? কে আঘাত পেয়েছেন স্যার?
সেসময় আমি দেখি তার মুখে একটা তীব্র ব্যগ্রতা। সেটা খেয়াল করে আমি জবাব দিই–মিস ম্যাগি বার্কলি।
মিস ম্যাগি? মিস ম্যাগি কি আপনি নিশ্চিত স্যার? মানে, ইয়ে–আপনি কি নিশ্চিত যে মিস ম্যাগিই আহত হয়েছেন?
একশো ভাগ নিশ্চিত–কেন?
ওহ, না–না, সেরকম কিছু না। আমি ভাবলাম অন্য মেয়েদের কেউ……. হয়তো মিসেস রাইস আহত হয়েছেন।
দেখ এলিন যথেষ্ট হয়েছে। আমি এবার কড়া গলায় বলি–এবার টেলিফোনটা কোথায় আছে বলবে?
এবার মেয়েটা কিছুটা থমমত খেয়ে যায়-হা, হা, দুঃখিত স্যার, এই তো এই ঘরে।
সে পাশের ঘরটার দরজাটা খুলে ধরতেই যন্ত্রটার উপর আমার নজর পড়ে। আমি এগিয়ে যাই তার দিকে। এলিন তখনও সেখানে সটান দাঁড়িয়ে।
আপনি যদি ডাঃ গ্রাহামের নম্বর…….
ধন্যবাদ, আমার আপাতত আর কোন সাহায্য চাই না তোমার কাছে।
এবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রায় বাধ্য হয়েই ওকে ওখান থেকে চলে যেতে হয়। ওকে এত ধীরে ধীরে পা ফেলতে দেখে আমার সন্দেহ হয় সে নিশ্চয়ই আমার কথাগুলো আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করবে। কিন্তু আমাকে সেটা হতে দিলে চলবে না, কারণ ও হয়তো এমন কিছু জেনে যাবে যেটা ওর পক্ষে এই মুহূর্তে না জানাই বাঞ্ছনীয়–যদিও একটু পরেই তো সবাই এমন কি এলিনও সব কিছুই জানতে পারবে।
আমি প্রথমে পুলিস থানায় ফোন করে পুরো ঘটনাটা জানাই। তারপর আমি নিজ উদ্যোগে, এলিন যার নাম উল্লেখ করেছিল সেই ডাঃ গ্রাহামের নম্বরটা ফোনের ডাইরি থেকে খুঁজে বের করে তাকেও ফোন করে সব জানাই। উনি কয়েক মিনিটের মধ্যেই এখানে আসছেন বলে আমাকে জানালেন। আমি ফোন রেখে সেই ঘর থেকে বের হয়ে আবার নিকের ঘরে ফিরে এলাম। এলিনকে তখন কোথাও দেখতে পেলাম না। ভাবলাম দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে আমার সব কথাগুলো যদি সে শুনেও থাকে, আমার ঘর থেকে ফেরার মুহূর্তে খুব দ্রুততার সঙ্গে সেখান থেকে সরে পড়েছে সে।
ততক্ষণে নিক অনেকটা শক্ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। সোফায় উঠে বসেছে। আমাকে একটু ব্র্যান্ডি দিতে পারেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। আমি দ্রুত পায়ে ডাইনিং রুমে হাজির হই। সঙ্গে সঙ্গে ব্রান্ডিও পেয়ে যাই। নিককে এনে দিতে ও দু’ এক চুমুক পান করেই অনেকটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। ওর মুখের রঙ আস্তে আস্তে ফিরে আসে।
ওহ, কি ভয়ঙ্কর।
হ্যাঁ, নিঃসন্দেহে।
না, আপনি বুঝতে পারছেন না। এটা আমি হতে পারতাম। আমারই তো হবার কথা ছিল। সব শেষ হয়ে যেত।
আমি ওকে সাহস জোগানোর জন্য বলি–দয়া করে এভাবে বলবেন না। মনে সাহস আনুন।
সে বারবার মাথা বাঁকাতে বাঁকাতে বিড়বিড় করে বলে চলে–আপনি জানেন না–আপনি জানেন না। তারপর আচমকাই সে কাঁদতে শুরু করে। প্রায় নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে শিশুর মত।
আমার মনে হল এটাই এখন ওর জন্যে সবচেয়ে ভাল হবে। এতে মনের গ্লানি অনেকটাই হাল্কা হয়ে যাবে, তাই ওকে আর থামানোর কোনও চেষ্টাই করলাম না। কান্নার প্রথম তীব্রতা নিক সামলে ওঠার পর আমি ওর পাশ থেকে সরে গিয়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়ালাম, বাইরে নজর দিলাম, অনেকক্ষণ থেকেই সেখানে মানুষের গল্পর স্বর, হৈ-চৈ আওয়াজ, উত্তেজিতভাবে কথাবার্তা, চাপা আতঙ্কের চিৎকার সব শুনতে পাচ্ছিলাম। মৃতদেহটা ঘিরে ঘটনাস্থলে একটা ভিড় জমেছে। প্রায় সকালেই সেখানে জড়ো হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম উর্দি পরা দু’জন অবয়বধারী ঘাস মাড়িয়ে এগিয়ে এল। পুলিস এসে পৌঁছেছে।
আমি আবার পুরানো জায়গায় সোফায় গিয়ে বসলাম। কান্না ক্লিষ্ট মুখ তুলে তাকাল নিক আমার দিকে।
আমার কি এখন কিছু করা উচিত নয়?
না, একদম নয়। পোয়ারোর কড়া নির্দেশ রয়েছে এটা পুরোপুরি ওর ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তোমার বাড়ির বাইরে যাওয়া চলবে না।
দু’হাতের তালুতে মুখ ঢেকে কয়েকমুহূর্ত চুপ করে বসে থাকে নিক, তারপর আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে–বেচারা ম্যাগি, অভাগা ম্যাগি, এত ভাল মেয়ে ছিল যে জীবনে কারও কোনও ক্ষতি করেনি আর ওর ভাগ্যে কিনা এরকম একটা ঘটনা ঘটল। নিজেকেই আমার খুনী মনে হচ্ছে। ওকে এখানে ডেকে এনে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য আমিই ওর খুনের জন্য দায়ী।
আমি নীরবে মাথা ঝাঁকালাম। নিয়তির বিধান কেউ খণ্ডাতে পারে? যখন পোয়ারো নিককে বোঝাচ্ছিল, বুঝিয়ে রাজি করাল তার কোনও বন্ধু অথবা আত্মীয়কে এনে ওর সঙ্গে থাকবার জন্যে, তখন কি পোয়ারো জানতে, বুঝতে পেরেছিল, একটি নিষ্পাপ নিরপরাধ মেয়ের মৃত্যু পরোয়ানা সই করেছে সে।
আমরা নিঃশব্দে বসে রইলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম অনুমান করতে পারছিলাম, বাইরে কি ঘটে চলেছে। কিন্তু আমি অনুগতভাবে পোয়ারোর নির্দেশ মান্য করেই নিজের কর্তব্য দায়িত্বে বদ্ধ হয়ে রইলাম। হয়তো আধ ঘন্টা কি মিনিট কুড়ি পর হবে অথচ আমার মনে হল বেশ কয়েকঘণ্টা পর দরজা ঠেলে পোয়ারো ঘরে ঢুকল। সঙ্গে দু’জন পুলিশ কর্মীর একজন এবং আরও একজন। আমার বুঝতে অসুবিধা হল না অপর ব্যক্তি হলেন ডাঃ গ্রাহাম। ঘরে ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে নিকের কাছে চলে এলেন ওরা।
এখন আপনি কেমন বোধ করেছেন মিস বার্কলি?–নিকের নাড়ি চেক করতে করতে প্রশ্ন করলেন ডাঃ গ্রাহাম। অবশ্য এটা একটা খুব মর্মান্তিক আঘাত, সইতে একটু সময় লাগবে।
এখন ঠিকই আছি। মৃদু গলায় জবাব দেয় নিক।
ডাক্তার এবার আমার দিকে ফিরে বললেন-উনি কিছু খেয়েছেন?
অল্প একটু ব্রান্ডি।
আমি এখন ভাল আছি, ঠিক আছি। নিক জোর দিয়ে বলবার চেষ্টা করে।
কয়েকটা সামান্য উত্তর দিতে পারবেন ম্যাডাম?
পুলিস ইন্সপেক্টরের প্রশ্নে নিক দৃঢ় গলায় বলে-অবশ্যই পারব।
পুলিস অফিসারটি নিকের কাছে এগিয়ে আসেন, কথা শুরু করার আগে একটু কেশে নিয়ে কথা শুরু করলেন আর নিক সেই কাশির আপ্যায়নমূলক যে হাসিটা দিল, সেটা আমার কাছে মনে হল কোনও অশরীরী আত্মার অট্টহাসি বা ভৌতিক কোনও রহস্যে ঘেরা হাসি।
আমি দুঃখিত মিস বার্কলি, এই অবস্থায় আপনাকে বিরক্ত করবার জন্য। এটা একটা সত্যি এক ভয়ঙ্কর, মর্মান্তিক ঘটনা।
পুলিস ইন্সপেক্টর একটু থেমে আবার বলতে শুরু করেন–আমাদের সত্যিই পরম সৌভাগ্য যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা মিঃ এরকুল পোয়ারো আপনার এখানে হাজির হয়েছেন। উনি আমাকে সবকিছু বলেছেন, তবু আমি আপনার মুখ থেকে ঘটনাটি শুনতে চাই। আশাকরি ঘটনার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটনা ঘটেছে কোনও কিছু গোপন না করে তার সবটাই আমাকে বলেন তাহলে তদন্তের ক্ষেত্রে আমাদের খুবই সুবিধা হবে।
নিক এবার শুরু থেকে ঘটনাগুলো একের পর এক বিস্তারিতভাবে পুলিস ইন্সপেক্টরকে বলে শোনাল।
বেশ, আপনার সব কথা শুনলাম, কিন্তু মাদাম একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকছে না যে, আপনার গায়ে দেওয়া শালটা ওই মুহূর্তে আপনার দিদির গায়ে গেল কি করে?
আমরা দুজনে কোট নিতে এসেছিলাম বাড়িতে। আমি শালটাকে সোফার উপর খুলে রেখে দোতলার ঘরে যাই। আমার কোটটা বের করি, তারপর ম্যাগি আর আমার বান্ধবী মিসেস রাইসের জন্যে আরও একটা কোট নিয়ে বাড়ির বাইরে আসতেই মিঃ পোয়ারো আর মিঃ হেস্টিংসকে দেখতে পাই। ম্যাগি মাটিতে উপুড় হয়ে পড়েছিল। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে নিক। বেশ কয়েকটা মিনিট পর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সে আবার বলতে শুরু করে, ম্যাগি কখন আমার শালটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল বলতে পারব না। হয়তো ওর খুব শীত করছিল। আমার কোট নিয়ে ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে হয়তো হাতের কাছে শালটাকে পেয়ে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছিল। আবার কান্নায় নিকের গলা বুঁজে আসে।
কিন্তু, আপনি কোনও গুলির শব্দ শুনতে পাননি?
সে সজোরে মাথা নাড়ে–না, বাজির শব্দ ছাড়া আমি আর কিছু শুনিনি। শুনলেও বোঝা সম্ভব ছিল না, বাজির শব্দের সঙ্গে সেটা মিশে যেত।
হ্যাঁ, সেটা অবশ্যই সত্যি। ইন্সপেক্টর সায় দেয়। তারপর হঠাৎ কি যেন ভেবে নিয়ে প্রশ্ন করে–কে আপনার ওপর আঘাত হানার চেষ্টা করছে সে ব্যাপারে আপনার কোনও ধারণা আছে? কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?
না, এ ব্যাপারে আমার সামান্যতম ধারণাও নেই।
হুম,–গম্ভীর চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলেন ইন্সপেক্টর। যাক, এখন এ মুহূর্তে আপনাকে আর কোনও প্রশ্ন করার নেই আমার।
এবার পুলিস সাহেব সরে যেতেই ডাঃ গ্রাহাম এগিয়ে আসেন–মিস বার্কলি, আমার একটা কথা ছিল। আমার মনে হয় আপনার এখানে থাকাটা উচিত হবে না। মিঃ পোয়ারোর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমার জানা একটা ভাল নার্সিংহোম রয়েছে। আপনি যথেষ্ট শ পেয়েছেন। আপনার পূর্ণ বিশ্রামের প্রয়োজন এবং তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন একজন চিকিৎসকের নজরদারি।
নিক ডাক্তারের দিকে তাকায়ও না। ওর নজর তখন পোয়ারোর দিকে।
আপনি কি আমার শক পাওয়ার কথা ভেবে এ ব্যবস্থা করছেন?
পোয়ারো কয়েক পা এগিয়ে আসে–মাদাম জোয়েল আমি চাই আপনি নিরাপদে থাকুন, ওখানে থাকলে আপনি নিরাপদে থাকবেন এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত, কারণ ওখানে সবসময় একজন করে নার্স মজুত থাকবে সে সারাক্ষণ আপনার কাছে কাছে থাকবে। আপনি আমার বক্তব্য বুঝতে পারছেন আশা করি।
হ্যাঁ, আমি পারছি। কিন্তু আপনি ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না কারণ আমি আর ভয় পাচ্ছি না। আমি আর কোনও কিছুকেই পরোয়া করি না। যদি কেউ আমাকে খুন করতে চায় করুক।
আহ, তুমি এত মনোবল দেখাচ্ছ কেন?–আমি না বলে পারলাম না।
না, আপনারাও বুঝতে পারছেন না, আপনারা কেউই কিছু বুঝতে পারছেন না।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে মিঃ পোয়ারোর পরিকল্পনাটা ভুল নয়- ডাক্তার এবার মুখ খুললেন। আমি আমার গাড়িতেই আপনাকে নিয়ে যাব। আপনার এক রাত অন্তত ঠিকমত বিশ্রামের প্রয়োজন আছে এবং আমি সেইমত ব্যবস্থা করতে চাই। এখন আপনি কি বলেন?
ঠিক আছে, আপনারা যা ভাল বোঝেন তাই করুন, আমি আর আপত্তি করব না।
পোয়ারো নিকের হাতটা নিজের হাতের ওপর রাখে–আমি জানি মাদাম জোয়েল, এই মুহূর্তে আপনার অনুভূতিটা আমি বুঝতে পারছি। আমি বুঝতে পারি আপনি এই ঘটনার জন্যে নিজেকে অপরাধী ভাবছেন, লজ্জিত বোধ করছেন। আপনার এই অনুভূতিটাকে আমি শ্রদ্ধা করছি। আমারও একইরকম অনুভূতি হচ্ছে, যেহেতু আমি তো আপনাকে কথা দিয়েছিলাম যে আপনাদের সুরক্ষা দেব, আপনার এবং আপনার যিনি সঙ্গী হবেন। কিন্তু আমি তা পারলাম না। আমার মনের অবস্থা ব্যাখ্যা করতে পারব না। তবে আপনার মনের যা অবস্থা, তার থেকে আমার মন কোনও অংশে কম বিচলিত নয়। এবারে আপনাকে নিশ্চিত করতে পারি।
ঠিক আছে, বুঝেছি। সেই প্রাণহীনতাই এখনও বেজে চলেছে ওর গলায়।
আপনার নিজেকে দোষী ভাববার কোনও কারণ নেই। আমার মনে হয় আপনার পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল, সবকিছুই আপনি করেছেন। আমি নিশ্চিত। অন্য কেউ এর থেকে বেশি কিছু করতে পারত না। সুতরাং বিনা কারণে মন খারাপ করবেন না।
আপনি খুব সহৃদয় মাদাম জোয়েল। পোয়ারো বিনীত গলায় বলে।
না, আমি….. কথা শেষ হতে না হতেই দরজাটা প্রায় দড়াম করে খুলে যায়। শ্যালিঙ্গার ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢোকে–আমি এই মাত্র এসে পৌঁছলাম। সদর দরজায় একজন পুলিস কর্মীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার কাছ থেকেই পুরো ঘটনাটা জানতে পারি। নিক…….. নিক…….. তুমি এখন পুরোপুরি সুস্থ তো, তুমি ঠিক আছে তো?
ওর গলায় আতঙ্ক, রাগ মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছিল তার কণ্ঠস্বর। নিকের কোনও ক্ষতি হয়নি তো?
পোয়ারো এবং ডাক্তার কম্যান্ডার-এর দৃষ্টিপথ আটকে রেখেছিল। এবার তারা সরে যেতেই শ্যালিঙ্গার-এর নজর পড়ল মিস বার্কলির দিকে। কেমন একটা অদ্ভুত ঘঘারলাগা চোখে তিনি তাকিয়ে রইলেন কয়েকমুহূর্ত। আমার মনে হয় কেমন যেন নেশাতুর মদ্যপের দৃষ্টি। তারপর প্রায় ছুটে গিয়ে নিকের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন। হঠাৎ, আচমকা নিকের মুখটাকে নিজের দুহাতের মধ্যে তুলে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন কম্যাণ্ডার শ্যালিঙ্গার, নিক…. নিক…….. প্রিয়তমা আমার, আমি…… আমি ভেবেছিলাম তুমি মারা গেছ।
মিস বার্কলি ধীরে ধীরে সোফার ওপর উঠে বসলেন–সব ঠিক আছে জর্জ। বোকামি কর না। দেখছ আমি তো সুস্থ, ঠিক আছি।
শ্যালিঙ্গার মাথা তোলেন, উদভ্রান্তের মতো চারপাশে তাকান–কিন্তু, কেউ একজন মারা গেছে, কে? কে সে? পুলিশ কর্মীটি তো বলল-।
নিক এবার বিষণ্ণ, নিচু গলায় বলে–হ্যাঁ, ম্যাগি। বেচারা ম্যাগি…
ওঃ……… এক তীব্র দুঃখে, যন্ত্রণায় ওর মুখের রেখায় ভাঙ্গাচুর ঘটায়। ডাক্তার এবং পোয়ারো এগিয়ে আসেন। ডাক্তার ওর হাত ধরেন, ওকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেন। তারপর পোয়ারো এবং ডাক্তার দুপাশ থেকে দু’জনে ধরাধরি করে ওকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
আপনি ডাক্তারের গাড়িতে গিয়ে বসুন, আমি মিসেস রাইসকে বলছি আপনার জরুরী কিছু জিনিসপত্র গুছিয়ে দিতে।–পোয়ারো শান্ত গলায় বলে।
ওরা বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। শ্যালিঙ্গার এবার আমার কব্জি চেপে ধরেন হেস্টিংস, ওরা ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমি সংক্ষেপে পুরো ব্যাপারটা ওকে বললাম।
ওঃ, কি ভয়ঙ্কর ঘটনা। আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। কি ভয়ঙ্কর।
আসুন কম্যান্ডার একটা ড্রিঙ্ক নিন, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার মনে তখন আর কোনও দ্বিধা বা সংশয় নেই, থাকার কথাও নয়। নিক সম্পর্কে কম্যান্ডার জর্জ শ্যালিঙ্গারের মনোভাব বিষয়ে, ব্যাপারটা তখন জলের মত স্বচ্ছ।
.
০৯.
এ থেকে জে
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়েছিল–যদি আমি সেই রাতটাকে ভুলে যেতে পারতাম, তারপর সেই রাতে যা ঘটেছিল। পোয়ারো অত্যন্ত দুঃখে কাতর হয়ে পড়েছিল–এই শাস্তিটা বোধহয় আমার প্রাপ্য ছিল। আমি অত্যন্ত বেশি মাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলাম–আমি এরকুল পোয়ারো, নিজের সম্পর্কে অত্যন্ত নিশ্চিত হয়ে পড়েছিলাম।
না, না, ওরকম ভাবে কেন ভাবছো? আমি বাধা দিয়ে বলি।
কিন্তু কেউ কি করে ভাবতে পারে, একজন কি করে ভাবতে পারে–অকল্পনীয়, অতুলনীয় স্পর্ধা। আমি ভেবে নিয়েছিলাম, নিশ্চিত হয়েছিলাম যে আমি যত রকমভাবে সম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করেছি। আমি খুনীকে পর্যন্ত সতর্ক করে দিয়েছিলাম।
সতর্ক করে দিয়েছিলে? কি ভাবে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করি আমি।
পোয়ারো সশব্দে নিজের হাতের তালুতে জোরাল চাপড় মারে–সমস্ত নজর আমি নিজের দিকে এনে নিয়েছিলাম এবং আমি বুঝিয়ে দিয়েছিলাম কাউকে, কোনও একজনকে সন্দেহ করছি এবং আমি নিজেও বুঝিনি পরিস্থিতি কতখানি জটিল করে তুলেছিলাম। কি ভয়ঙ্করভাবে মরীয়া করে তুলেছিলাম নিজেকে। আমি মাদাম জোয়েলকে ঘিরে একটা বৃত্ত রচনা করেছিলাম এবং তিনি তা থেকে পিছলে বের হয়ে গেলেন। আর আমাদের চোখের সামনেই পিছলে গেলেন অন্যজন। আমরা থাকা সত্ত্বেও, সবাই সতর্ক থাকা সত্ত্বেও। খুনী সে লক্ষ্য পূরণে সম্ভব হল।
না, তা সে পারেনি। আমি ওকে মনে করিয়ে দিই।
আহ, সেটা একটা পরিবর্তন মাত্র। আমার কাছে ব্যাপারটা একই। হেস্টিংস আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাপারটা একই। একটা মানুষের প্রাণ চলে গেল, যার যাওয়াটা একেবারেই সঙ্গত নয়।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, সেটা ঠিক। আমি সে কথা বলতে চাইনি।
কিন্তু তুমি যা বলেছ সেটা আমাদের পক্ষে আরও ভয়ঙ্কর, ইঙ্গিতবাহী। হেস্টিংস মনে রেখো, খুনী তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারেনি। সে আবার আঘাত হানবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। বুঝতে পারছ বন্ধু। অবস্থা বদলে গেছে এখন। আরও খারাপের দিকে এগোচ্ছে।
তার মানে, একমাত্র অর্থ হচ্ছে–একটা নয়, দু-দুটো জীবন উৎসর্গ হতে চলেছে।
না, তুমি যতক্ষণ রয়েছ কিছুতেই সেরকম কিছু ঘটা উচিত নয়। দৃঢ় গলায় আমি বললাম।
পোয়ারো আমার হাতটা আলতো করে ধরে–এই বুড়ো মানুষটার ওপর তোমার এখনও ভরসা আছে? বিশ্বাস আছে? তুমি আমায় নতুন করে সাহস দিলে বন্ধু। এরকুল পোয়ারো বারবার ব্যর্থ হবে না। না, এই দ্বিতীয় জীবনের সুযোগটা আমি পুরোপুরি ব্যবহার করব। আমি আমার ভুল শুধরে নেব। একটু থেমে কি যেন ভাবে পোয়ারো।
কোথায় একটা ভুল হয়েছে। আমার পদ্ধতি, সিদ্ধান্ত বিচারে কোথাও একটা ভুল ঘটেছে, যার জন্য এই পরিণতির শিকার হয়েছি। নাহ আমি আবার নতুন করে শুরু করব। আর এবার আমি ব্যর্থ হব না। পোয়ারো দৃঢ় গলায় বলে।
তার মানে তুমি মনে করছ, নিক বার্কলির এখনও প্রাণ সংশয় রয়েছে। আমি একটু বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করি।
পোয়ারো অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়–নিশ্চয়ই, তা না হলে আমি হঠাৎ করে ওকে ডাক্তারের সঙ্গে নার্সিংহোমে পাঠালাম কেন? সেটা ওর মানসিক আঘাতের শুশ্রূষার জন্য নয়?
মানসিক আঘাত?
হেস্টিংস, একজন তার নিজের বাড়িতে থেকে অনায়াসে মানসিক আঘাত, স্নায়ু দৌর্বল্য সারিয়ে উঠতে পারেন। বস্তুতপক্ষে, নার্সিংহোমের থেকে বাড়িতেই সেটা অনেক ভালভাবে হয়। ওখানকার লাল বা সবুজ লিনোলিয়াস মেঝে, উজ্জ্বল আলো, ট্রে-তে করে আসা খাবার, অথবা নার্সদের বকবকানি, কোনওটাই উত্তমভাবে স্নায়ু দৌর্বল্যের ধকল সামলানোর কোনও বাড়তি কারণ হয় না, হতে পারে না। না, হেস্টিংস একমাত্র নিরাপত্তা সুরক্ষা ছাড়া মাদাম জোয়েলকে ওখানে পাঠাবার আমার আর কোনও কারণ ছিল না। আমি ডাক্তারকে আমার পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলতেই সৌভাগ্যবশত উনি রাজি হয়ে গেলেন, তাই সব বন্দোবস্ত হয়ে গেল। যেখানে কেউই ওনার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না, এমন কি ওর নিকটতম আত্মীয় পর্যন্তও পারবে না। শুধুমাত্র আমরা কয়েকজন ছাড়া।
পোয়ারো হাসে–ডাক্তারের অনুমতি নেই। বেশি কথাবার্তা ওনার দুর্বল স্নায়ুর পক্ষে ক্ষতি হতে পারে, এটাই সবার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারী থাকবে।
কিন্তু পোয়ারো এভাবে কতদিন? আমি সংশয়গ্রস্থ হয়ে প্রশ্ন করি।
হ্যাঁ, খুবই স্বাভাবিক অনুধাবন। কিন্তু এই মুহূর্তে সাময়িকভাবে এই ব্যবস্থাটা আমাদের শ্বাস নেবার সুযোগ দেবে। আর তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, আমাদের তদন্তের চরিত্র এবার বদল ঘটবে।
সেটা কি রকম?
এখন থেকে আমাদের প্রাথমিক এবং অবশ্যই সর্বপ্রথম কাজ হবে মাদাম জোয়েলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা এবং একইসাথে সমান গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে খুনীকে ধরবার চেষ্টা করা।
আহ্ পোয়ারো, প্রিয় বন্ধু, এমনভাবে তুমি কথাটা বলছ যেন সেটা খুব সহজ কোন কাজ।
নিশ্চয়ই হেস্টিংস, নিশ্চয়ই খুব সহজ কাজ।
পোয়ারো গভীর চোখে আমার দিকে তাকায়–আমি তোমাকে বলেছিলাম নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে? খুনী অপরাধের ওপর তার নাম সই করে দিয়েছে। সে এখন অন্ধকারের আড়াল ছেড়ে প্রকাশ্যে বের হয়ে আসছে, তা খুব শীঘ্রই আসতে চলেছে।
আমি পোয়ারোর অভিব্যক্তিকে খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করি। তারপর সামান্য ইতস্তত করে বলি–তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ যে পুলিশ ঠিক কথাই বলেছে, এটা কোনও বদ্ধ উন্মাদের কাজ? একজন লুনাটিক, হোমিসিডেল ম্যানিয়াক-এর কাজ এটা?
আমি এ বিষয়ে একেবারে নিশ্চিত যে, এটা সেরকম কারও কাজ নয়, হতেই পারে না।
তুমি সত্যিই ভাব… আমি থমকে যাই, পোয়ারো আমার কথার শেষটা থেকে বলতে শুরু করে–খুনী মাদাম জোয়েলের খুব কাছের মানুষদের মধ্যে কেউ একজন, সে ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত।
কিন্তু গত রাতের ঘটনাটা কি সেই তত্ত্ব খারিজ করে দিচ্ছে না? আমরা সবাই-ই তো এক জায়গায় জড়ো হয়েছিলাম, সে ক্ষেত্রে….
পোয়ারো এবার আমাকে বাধা দেয়–তুমি কি শপথ করে বলতে পারো হেস্টিংস যে বিশেষ কোনও একজন ব্যক্তি আমাদের সেই বৃত্ত থেকে আচমকা সরে যায়নি, সামান্য সময়ের জন্য হলেও সে সরে গেছে আমাদের বৃত্ত ছেড়ে যেটা তার কাজ সারার পক্ষে যথেষ্ট সময়। তুমি কি এমন একজনের নাম হলফ করে বলতে পারো যে অনুষ্ঠান শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব সময়ের জন্য তোমার চোখের সামনে ছিল?
না, ওর কথার গূঢ় অর্থের অভিঘাতে আমি বাস্তবতা খুঁজে বেড়াই, কই আমার সেরকম তো মনে হয় না, তাছাড়া আলো অন্ধকারে কারও ওপর সেভাবে নজর রাখা সম্ভব নয়। সবাই তো প্রায় আসে পাশে ঘোরাঘুরি করছিল তারই মধ্যে কে যে কখন কোথায় সরে যাচ্ছে সেভাবে তো নজর রাখিনি, সম্ভবও নয়।
পোয়ারো মাথা নাড়ে সম্মতিবাচক ভঙ্গিতে–একেবারে ঠিক কথা বলেছ। আর ভেবে দেখ, কিছু ঘটানোর জন্য মাত্র কয়েক মিনিটই যথেষ্ট ছিল তার পক্ষে।
পোয়ারো থামে কিছুক্ষণ, তারপর আমাকে বোঝানোর ভঙ্গিতে দু’হাত নেড়ে বলতে শুরু করে–মহিলা দু’জন বাড়ির দিকে রওনা হলেন। খুনী সবার নজর এড়িয়ে ওদের অনুসরণ করল। গাছের আড়াল থেকে খুনী সবকিছুই লক্ষ্য করছে, মহিলারা বাড়িতে ঢুকলেন, তারপর কালো শাল গায়ে দিয়ে মিস বার্কলি দরজার বাইরে এলেন। খুনী আড়াল থেকে সবকিছুই দেখল এবং গাছের আড়াল থেকে লক্ষ্যস্থির করে সে সফলভাবে তিনটি গুলি ছুঁড়ল।
তিনটে? আমি বাধা দিয়ে বলি।
হ্যাঁ, প্রথমবারের ভুল এবার আর করতে চায়নি সে। কোনও ঝুঁকি নেয়নি খুনী। আমরা ম্যাগির শরীরে তিনটে বুলেট পেয়েছি।
কিন্তু পোয়ারো, সেটা তো খুবই ঝুঁকির কাজ হয়েছে, তাই না?
না, সেরকম কিছু নয়। মাউজার পিস্তলে খুব একটা সেরকম আওয়াজ হয় না। তাই খুব যে ঝুঁকি নিয়েছিল খুনী তা বলা যাবে না।
পিস্তলটা পাওয়া গেছে?
না, আর ঠিক সেখানেই আমার সন্দেহটা ঘোরতর বাস্তব চেহারা নিচ্ছে যে কাজটা বহিরাগত কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। আমরা তো আগেই জেনে গেছি যে নিক বার্কলির পিস্তলটা চুরি করা হয়েছে খুনটাকে আত্মহত্যা হিসাবে প্রমাণ করানোর জন্য। এখন তো আর আত্মহত্যার থিয়োরি খাটালে চলবে না। খুনী খুব ভালভাবেই জেনে গেছে যে আমরা সব জেনে গেছি তাই খুনের ব্যাপারটাকে আর আত্মহত্যা বলে চালানো সম্ভব হবে না।
পোয়ারোর যুক্তি যে অকাট্য, মনে মনে আমিও সেটা স্বীকার করে নিই–তাহলে এখন পিস্তলটা তার কি কাজে লাগবে?
আমার প্রশ্নে পোয়ারো কাধ বাকায়–এই মুহূর্তে আমি সে সম্পর্কে নিশ্চিত নই। তবে আমি বা তুমি হলে কি করতাম? বিশাল ওই সমুদ্রকে কাজে লাগাতে না? শুধু হাত ঘুরিয়ে গভীর জলে জিনিসটাকে ছুঁড়ে দাও। চিরকালের জন্য সেটা হরিয়ে যাবে, কেউ কোনওদিন খুঁজে পাবে না।
আমার শরীরে পোয়ারোর কথাগুলো মৃদু কম্পন জাগায়–তোমার কি মনে হয়, খুনী বুঝতে পেরেছে যে সে ভুল মানুষকে খুন করেছে?
আমি নিশ্চিত যে এখনও সেটা বুঝে উঠতে পারেনি। ব্যাপারটা অবশ্যই ওর কাছে অসুস্থজনক এক বিস্ময় এবং তিক্ত অভিজ্ঞতা হবে। যখন আসল সত্যিটা সে জানবে। নিজের বিস্ময়ে এবং হতাশা গোপন করা, আসলে কে মিথ্যে শিকার হল তার জানবার কৌতূহল, সেগুলো অবদমন করা সহজ কাজ হবে না।
আর ঠিক তখনই আচমকা আমার মনে পড়ল বিদ্যুৎ চমকের মতো, নিকের বাড়ির পরিচারিকা এলিনের অদ্ভুত আশ্চর্য রকমের কৌতূহলী এবং বিভ্রান্তকর ব্যবহার। আমি দেরি না করে পোয়ারোকে সবিস্তারে ঘটনাটা জানালাম। ব্যাপারটা শুনে পোয়ারোর ভ্রুযুগল অতিমাত্রায় কুঞ্চিত হয়ে উঠল।
ও, অবাক হয়েছিল, তাই তো? ম্যাগি মারা গেছে শুনে অবাক হয়েছিল, অদ্ভুতভাবে আচরণ করছিল।
শুধু অবাক হয়েছিল বললে খুবই কম বলা হবে। নিঃসন্দেহে যথেষ্ট কৌতূহলী ও উদ্দীপক ছিলেন। এরকম একটা দুঃখজনক ঘটনার কথা জেনে, মহিলা আতঙ্কিত বা দুঃখিত হলেন না, বরং কে মারা গেছেন তা নিয়ে দ্বিধায় দুললেন, এমন কি অন্য কেউ মারা গিয়েছেন নাকি সে বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেলন। খুবই কৌতূহলকর ব্যাপার।
কে সে? অন্য সময় সে যথেষ্ট দায়িত্বশীল, শান্ত, তাহলে কি…… এই সে? যাকে… পোয়ারো আচমকা থেমে যায় এবং হঠাৎ করেই গুম মেরে যায়। ধীর পায়ে সারাটা ঘর পায়চারি করতে শুরু করে। ওর মুখ চিন্তার কুঞ্চনে ভারাক্রান্ত। যে যে কাল রাতে এন্ড হাউসে ছিল, তাদের কেউই সন্দেহের উর্ধে নন। তবে……. অতিথিরা, নাহ, আমার মনে হয় না তারা কেউ জড়িত। সত্যি কথা বলতে কি বাড়ির মালকিনের সঙ্গে ওদের কারোরই খুব একটা অন্তরঙ্গতা ছিল না। থমথমে মুখে বলে পোয়ারো।
আর চালর্স ভ্যাইস?
হ্যাঁ, অবশ্যই ওনার কথাগুলো আমাদের ভুললে চলবে না। সত্যি কথা বলতে কি, যুক্তির বিচারে উনি আমাদের একজন প্রবল সন্দেহভাজন- ধীর পায়ে এসে আমার উল্টো দিকের চেয়ারটায় বসে পোয়ারো।
মোটিভ, প্রিয় হেস্টিংস, যাবার আগে আমাদের মোটিভটাকে বুঝতে হবে যদি আমরা এই অপরাধকে সঠিকভাবে বুঝতে চাই। বারবার আমি একটা জটিল গোলক ধাঁধায় ঢুকে পড়েছিলাম। মাদাম জোয়েল নিককে খুন করার কারও কি মোটিভ থাকতে পারে? আমি কোন রকমের সম্ভাবনাকেই বাদ দিই নি। সব কিছু নেড়েচেড়ে দেখেছি।
পোয়ারো একটু থামে। যেন দম নেবার অছিলায় কিছু ভাবে। তারপর আবার বলতে শুরু করে–এমন কি, লাজারুম সিনিয়র যে পুরানো তৈল চিত্রটা কিনতে চেয়েছেন, সেটা কোনও দুর্মূল্য পেন্টিং নয় তো? আমি একজন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে ছবিটা পরীক্ষাও করিয়েছি। তোমার মনে আছে নিশ্চয়ই, তোমার হাত দিয়ে মাদাম জোয়েলকে আমি একটি চিরকুট পাঠিয়েছিলাম একজন আসবেন তিনি যা করতে চাইবেন বিনা বাধায় ও বিনা প্রশ্নে তাকে যেন তা করতে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই বিশেষজ্ঞ রায় দিয়েছেন ছবিটা মোটেই কয়েকশো পাউন্ডের বেশি দাম হবে না।
লাজারুম? তার মত একজন ধনী……তুমি নিশ্চয়ই সত্যি তা বিশ্বাস কর না।
সত্যি সে ধনী তো? দর্শনধারী হলেই কিন্তু সবকিছু প্রমাণ হয় না। আমরা কোনও কিছুকেই যেমন নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে পারি না, আবার সামান্যতম কিছুকেও উপেক্ষা করতে পারি না। কারণ কোনটা যে আমাদের সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যাবে আমরাই নিশ্চিত করে জানি না।
পোয়ারো টেবিলের ওপর পড়ে থাকা বস্তুগুলোকে আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে খুব শান্ত গলায় বলে–থাক, আবার ফিরে যাওয়া যাক আসল কথায়। শুরু করা যাক মোটিভ নিয়ে। একটা খুনের কি মোটিভ হতে পারে? কি কি কারণ থাকতে পারে যার জন্য একজন মানুষ আর একজনকে প্রাণে মেরে ফেলতে পারে?
পোয়ারো একটা গভীর শ্বাস নেয়। জামার হাতার ভঁজে আঙুল ঘষে সেটাকে সোজা করতে করতে বলে–বিকারগ্রস্থ খুনীদের আমরা এখানে বাদই দিচ্ছি। কারণ আমি ভাল ভাবেই জানি যে আমাদের বর্তমান সমস্যার ক্ষেত্রে এদের ভূমিকা হতে পারে না। তাছাড়া রাগের মাথায় বা আকস্মিক উত্তেজনার বশে খুন হলে এর লক্ষণ অন্যরকম হবে। না এটাকেও গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। এটা খুব ঠান্ডা মাথায়, পরিকল্পিত ভাবে খুন। এছাড়া আর কি হতে পারে?
এবার আমি মুখ খুলি–প্রথমত, লাভের জন্য খুন। মাদাম বার্কলি খুন হলে যাঁরা কোনও ভাবে লাভবান হবেন, সেটা প্রত্যক্ষ ভাবেই হোক বা অপ্রত্যক্ষভাবেই হোক। সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় চার্লস ভ্যাইসকে আমরা বাদ দিতে পারি। কারণ উত্তরাধিকারী সূত্রে তার এমন কোনও লাভের বা প্রাপ্তি যোগের সম্ভাবনা নেই যে সে খুনের মত অপরাধে প্ররোচিত হতে পারে।
হ্যাঁ, মাত্র একজন আছেন, যিনি মাদাম জোয়েল বার্কলির মৃত্যুতে লাভবান হবেন। তিনি ওঁরই বান্ধবী, মিসেস রাইস। কিন্তু সেক্ষেত্রে লাভের অঙ্কটা এতই কম যে খুনের মত অপরাধের কথা কেউ ভাবতেও রাজি হবে না।
পোয়ারো মাথা নাড়ে। তারপর গভীর চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে–হেস্টিংস দেখা যাচ্ছে। লাভ-এর জন্য খুন, তাহলে এক্ষেত্রে এই তথ্যটাকে বাতিল করতেই হচ্ছে। এছাড়া অন্য আর কি মোটিভ হতে পারে?।
আমি বলি–ঘৃণা বা রাগজনিত কারণে খুন। বা ধর প্রেম-ভালবাসা যদি ঘৃণায় পরিণত হয় সেক্ষেত্রে ক্রাইম আসতে পারে। কারণ আমরা জানতে পেরেছি চার্লস ভাইস এবং কমান্ডার শ্যালিঙ্গার দু’জনেই মাদাম জোয়েল বার্কলির প্রতি অনুরক্ত। দ্বিতীয় জনের কথা তো আমরা নিজের চোখেই প্রত্যক্ষ করলাম।
হ্যাঁ, খুব সৎ এবং একনিষ্ট ভালবাসা। অন্যজনের ব্যাপারে কিন্তু আমাদের ভরসা, বিশ্বাস করতে হবে মাদাম জোয়েল ক্রফটের বক্তব্যকে। এই বিষয়ে আমাদের হাতে যথেষ্ট তথ্য বা প্রমাণ নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চার্লস এস. ভ্যাইস কি তার এই সম্পর্কিত তুতো বোনটির ওপর এতটাই অনুরক্ত যে অন্য কারও স্ত্রী হওয়ার আগে তাকে খুন করাটাই শ্রেয়। বলে মনে করবে?
পোয়ারোর কথার উত্তরে আমি বলি–সন্দেহ আছে। ব্যাপারটা কেমন যেন নাটকীয় বলে মনে হচ্ছে।
আসলে ব্যাপারটা হয়তো অ-ইংরেজিত শোনাচ্ছে। তবে মনে রেখ হেস্টিংস, ইংরেজদের মধ্যেও কিন্তু আবেগ বলে কিছু আছে আর চার্লস ভ্যাইসকে আমার ওই ধরনের মানুষ বলে মনে হয়। যারা সহজে নিজেদের আবেককে প্রকাশ করে না তারা তাদের মনের মধ্যে হিংসার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। এক্ষেত্রে এটা অবাস্তব কিছুই নয়। আর আবেগজনিত কারণে কমান্ডার শ্যালিঙ্গারকে আমি কখনও খুনী হিসাবে সন্দেহ করব না–না, না, ওর ধারণা ওরকম হতে পারে না। কিন্তু চার্লস ভ্যাইস? না, ওর ক্ষেত্রেও তার নিরাপত্বতা সম্পর্কে বাজি ধরব না পোয়ারো থামে কিছুক্ষণ। হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ঘরের মধ্যে কয়েকবার পায়চারি করে এসে আবার চেয়ারে ফিরে এসে বসে। খুনের আর একটা মোটিভ হচ্ছে জেলাসি, ঈর্ষা। না, আগের ব্যাপারটা থেকে নিশ্চিত ভাবেই এর অনেকটা তফাত রয়েছে, কারণ ঈর্ষা যে সব সময়ে যৌন আবেগপ্রবণ হবে তার কোনও কারণ নেই সেখানে শত্রুতাবোধ বরং থাকতে পারে। পোয়ারো এবার আমার দিকে তাকায়। তোমার কি মনে হয় হেস্টিংস, আমাদের এই মামলায় জেলাসি কি কোনও ভাবে দায়ী হতে পারে অপরাধের জন্য?
আমাকে কোনও মন্তব্য করার সুযোগ না দিয়ে নিজেই আবার বলতে থাকে–কে শত্রু হতে পারে মাদাম জোয়েল বার্কলির? অন্য কোনও মহিলা? এক্ষেত্রে তো থাকত শুধু মাদাম রাইস। কিন্তু আমরা যতদূর জানি ওনাদের দুজনের মধ্যে তো কোনও রকমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। কিন্তু তবুও আমরা যতটা জানি সেখানে নিশ্চিত করে বলাটা কঠিন কাজ। গভীর ভাঁজ পড়ে পোয়ারোর কপালে। গভীর চিন্তায় ডুবে আছে যেন। বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর আবার বলে–বাকি রইল ভয়। মাদাম জোয়েল নিক কি কারও গোপন কোনও ব্যাপার জেনে ফেলেছেন? হয়তো এমন কিছু জানেন নিক যা জানাজানি হয়ে গেলে সেই ব্যক্তির মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে এমন কি জীবন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে তার। তাছাড়া এমনও হতে পারে তিনি নিজেই হয়তো ব্যাপারটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন, বা ব্যাপারটা তিনি দিব্যি ভুলেই গেছেন বা আমাদের কাছে গোপন করে, গেছেন, আমাদের বলবার প্রয়োজন বোধই করেননি।
আচ্ছা হেস্টিংস তোমার কি সত্যিই মনে হয় সেরকম কিছু ঘটা সম্ভব? এটা একটা হাইপোনেসিস, আমার মনে হয় না এরকম কিছু ঘটা সত্যি সম্ভব। কিন্তু যুক্তিযুক্ত আপাতগ্রাহ্য কোনও থিয়োরি, সম্ভাবনা কোথাও খুঁজে না পেয়ে এই সম্ভাবনাটির দ্বারা তাড়িত হচ্ছি। যখন তুমি অন্য সম্ভাবনাগুলোকে হেঁটে ফেলবে, তুমি তো সেদিকেই তাকাতে বাধ্য হবে, যেটা পড়ে রইল এবং পড়ে থাকছে বলবে……. যেহেতু অন্যগুলো নয়…… তাহলে হয়তো এটাই……..
দীর্ঘক্ষণ সে চুপ করে বসে রইল। তারপর একসময় সে উঠে দাঁড়াল। একটা সাদা কাগজের টুকরো টেনে নিয়ে কিসব যেন লিখতে শুরু করল গভীর মনোযোগ সহকারে।
আমি প্রশ্ন করি, কি লিখছ তুমি?
মনামি, আমি একটা তালিকা বানাচ্ছি। মাদাম জোয়েল বার্কলির আশেপাশে সবসময় যারা থাকে। আমার কার্যপদ্ধতি ও ভাবনা যদি সঠিক পথে চলে, তাহলে এই তালিকার মধ্যেই লুকিয়ে আছে খুনী।
বেশ কিছুক্ষণ লেখার পর কাগজের টুকরোটা আমার দিকে এগিয়ে বলে, দেখো তো হেস্টিংস, তালিকাটা ঠিকঠাক হয়েছে কি না, কোনও নাম বাদ পড়েছে নাকি।
আমি তালিকাটা মনোযোগ সহকারে পড়তে থাকি। ১। এলিন, ২। মালি (এলিনের স্বামী), ৩। মিঃ ক্রফট, ৪। মিসেস ক্রফট, ৫। মিঃ লাজারুম, ৬। মিসেস রাইস, ৭। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার। ৮। মিঃ চার্লস এস. ভ্যাইস, ৯। ?
মন্তব্য :
(ক) এলিন–পারিপার্শ্বিকগতভাবে সন্দেহজনক। ম্যাগি খুন হয়েছেন জেনে এর কথাবার্তা এবং আচরণ রীতিমতো সন্দেহজনক। পিস্তলটি চুরি করা এবং সব কটি খুনের চেষ্টা ঘটানো এবং ভুল করে ম্যাগিকে খুন করা, সব অপরাধগুলো ঘটাবার পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। ওর পক্ষেই ক্রাইমগুলো ঘটানো সবচেয়ে সহজ হবে। তবে গাড়ির ব্রেক-এ কারসাজি করা মনে হয় ওর আয়ত্বের বাইরে। আর মানসিকতার বিচারে মনে হয় না ওর পক্ষে ক্রাইম করার সামর্থ আছে।
মোটিভ কিছুই না। যদি না ঈর্ষা বা ঘৃণা বিষয়ক কোনো ব্যাপার থাকে।
নোট–আরও পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
(খ) মালি (এলিনের স্বামী)–অন্যসব এলিনের মতোই। তবে এর পক্ষে গাড়িতে কারসাজি করা তুলনামূলকভাবে সম্ভব।
নোট–একবার কথা বলে দেখতে হবে।
(গ) মিঃ ক্রফট একমাত্র সন্দেহজনক ব্যাপার। ফাঁকা বাড়িতে আমরা মিস বার্কলির শোবার ঘরের দিকে উঠতে দেখেছিলাম। ওনার জবাব তৈরি ছিল। সেটা অবশ্য সত্যি হলেও হতে পারে। কিন্তু যদি তা না হয়?
মোটিভ–নেই।
(ঘ) মিসেস ক্রফট–সন্দেহের তেমন কিছু নেই। মোটিভ–নেই।
(ঙ) মিঃ লাজারুম–অপরাধ করার সবরকম সুযোগ-সুবিধা ছিল। যথেষ্ট সন্দেহজনক আচরণ। মাত্র কয়েকশো পাউন্ড দামের পুরোনো ছবি কিনতে চাওয়া। গাড়ির ব্রেক একেবারে ঠিক ছিল কেন বলেছিলেন? (ফ্রেডরিকা রাইসের মুখে শোনা)
মোটিভ–এখনও পর্যন্ত সেরকম কিছু জানা যায় নি।
নোট–জানতে হবে সেন্ট লু-তে আসবার আগে লাজারুম কোথায় ছিল? অ্যারন লাজারুম এবং কোম্পানির বর্তমান আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে।
(চ) মিসেস ফ্রেডরিকা রাইস অপরাধ করার সবরকম সুযোগ ছিল। সন্দেহজনক আচরণ, নিক বার্কলিকে গায়ের চাদর ও কোট আনতে পাঠানো। বেশ কয়েকবার ইচ্ছাকৃতভাবে নিককে সবসময় মিথ্যেবাদী বলে প্রমাণ করার চেষ্টা কেন করেছিল? দুর্ঘটনার বিষয়টা নিয়ে নিকের বক্তব্যে ভরসা করা যায় না–এই মন্তব্যটা কেন করেছিল? দুর্ঘটনার সময় সত্যি টাভিস্টকে ছিল না? কেথায় ছিল তাহলে?
মোটিভ–লাভ? সম্ভাবনা খুব কম। ঈর্ষা? হতেও পারে। ভয়? তাও হতে পারে। যদিও ঐ তিনটের কোনওটার বিষয় নিশ্চিত হওয়া যায় নি।
নোট–নিক বার্কলির সাথে সম্পর্কটাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। সম্ভবত ফ্রেডরিকা রাইসের আগের বিয়ে কোনও আলো দেখাতে পারে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে।
(ছ) কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার সন্দেহজনক আচরণ সেরকম কিছু নেই। যদিও অপরাধ ঘটাবার সব সুযোগ (গোটা সপ্তাহটা এই অঞ্চলের থাকার জন্য) পুরোপুরি ওর মধ্যে ছিল। খুনের আধঘণ্টা পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছেন।
মোটিভ–নেই।
(জ) মিঃ চার্লস ভ্যাইস–সন্দেহজনক আচরণ হিসাবে ধরা যেতে পারে। নিক বার্কলির ওপর যেদিন, সে সময় গুলি চলেছিল, তখন তিনি ছিলেন না। এন্ড হাউস বিক্রির ব্যাপারে কি উনি সত্যি কথা বলছেন?
মোটিভ–লাভ? সম্ভাবনা সামান্য। প্রেম বা ঘৃণা? সম্ভব, বিশেষ করে ওর মতো এক রিপ্রেসেড চরিত্রের মানুষের। ভয়, সম্ভব।
নোট বাড়িটা কে মর্টগেজ রেখেছে? তার কাছে বাড়িটা সত্যি বন্ধক আছে কিনা খুঁজে বের করতে হবে। ভ্যাইসের কোম্পানির আর্থিক অবস্থা সম্পর্কেও খোঁজ খবর নিতে হবে।
(ঝ)–কেউ একজন। অবশ্যই আছে। এই ঝ হয়তো একজন বহিরাগত। তবে, কোনও একটা যোগসূত্র হয়তো রয়েছে এই পরিবারের কারোর সঙ্গে। সেটা যদি হয়, সম্ভবত সেক্ষেত্রে ক, খ, ঙ, চ–এদের মধ্যে কারও সঙ্গে হবার সম্ভাবনা বেশি।
ঝ-এর অস্তিত্ব প্রমাণ দিচ্ছে (১) এলিনের ম্যাগি বার্কলি খুন হবার ঘটনায় অবাক অথবা আতঙ্কিত না হওয়া। বরং ঘটনাটা জেনে সে যেন কিছুটা নিশ্চিত হয়েছিল। (২) ক্রফট এবং তার স্ত্রী-এর এই লজে এসে বসবাস করতে শুরু করা। (৩) ফ্রেডরিকা রাইসের ঈর্ষা বা ভয়ের মোটিভ প্রকাশিত করতে বা সে বিষয়ে জানবার জন্যে। সম্ভবত খুব তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা প্রকাশিত হয়ে পড়বে।
আমি যখন পড়ছিলাম পোয়ারো প্রখর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল।
কি মনে হচ্ছে? আমার পড়া শেষ হতেই সে প্রশ্ন করে।
চমৎকার, অসাধারণ পর্যবেক্ষণ। আমি প্রশংসার গলায় বলি, খুব পরিষ্কার ভাবে সবরকমের সম্ভাবনাকে এখানে তুলে ধরেছো তুমি।
আমার হাত থেকে কাগজের টুকরোটা ফেরত নিতে নিতে পোয়ারো বলে, একটা নাম কিন্তু বারবার আমাদের চোখের সামনে এসেও এড়িয়ে যাচ্ছে যেটা হল চার্লস এস. ভ্যাইস। ওনার কিন্তু পুরোপুরি সবরকমের সুযোগই ছিল অপরাধের। তারওপর ওর একটা নয়, দু-দুটো দারুণ মোটিভ রয়েছে। এটা যদি ঘোড়দৌড় হতো আমি নিঃসন্দেহে ভ্যাইসের ওপরই বাজি ধরতাম।
হ্যাঁ, নিশ্চিতভাবেই মিঃ ভ্যাইস একজন প্রধানতম সন্দেহভাজন। সত্যি কথা বলতে কি, আমার তো ওনাকেই অপরাধী বলে মনে হচ্ছে।
হেস্টিংস, প্রিয় বন্ধু, তোমার একটা বাজে অভ্যাস হচ্ছে তুমি যার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম তাকেই প্রধানতম সন্দেহের তালিকায় ধরে বসো। এগুলো অতিরিক্ত গোয়েন্দা গল্প পড়বার ফল। বাস্তব জীবনে কিন্তু দশবারের মধ্যে নয় বারই থাকে সবরকমের সন্দেহের উর্ধে রাখা হয় আসলে সেই অপরাধটা ঘটিয়ে থাকে।
আমি অপ্রস্তুত গলায় প্রশ্ন করি, সেক্ষেত্রে কি তুমি সেরকম কিছু সন্দেহ করছো?
একটাই খটকা হেস্টিংস, একটাই খটকা, অপরাধের বোল্টনেস, এটাই আমাকে ভাবাচ্ছে সবচেয়ে বেশি, বুঝলে হে ভায়া? অনেক মোটিভই ওই দরজায় এসেই ঠোক্কর খাচ্ছে। কোনও মোটিভকে অবশ্যম্ভাবি বলে ভাবা যাচ্ছে না।
হ্যাঁ, প্রথমেই তুমি সেইরকমই বলেছিলে।
হ্যাঁ, এখনও আমি সেই একই কথাই বলছি। কথাটা বলেই কাগজের টুকরোটাকে দলে মুচড়ে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
আমি প্রতিবাদ করে উঠতেই পোয়ারো বলে ওঠে, না হে এভাবে হবে না। আসলে নানা বিভ্রান্তি থাকলেও ছবিটা ক্রমে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। অর্ডার এন্ড মেথড। এটাই রহস্য অনুসন্ধানের প্রথম পর্যায় হতে হবে।
ঠিক আছে, আমি তার কথায় সায় দিই। তার পরের পর্যায়, মনস্তত্ব। মস্তিষ্কের ধূসর কোষগুলোকে তুখোড়ভাবে খেলাতে হবে। হেস্টিংস এবার তোমার শুতে যাওয়া উচিত।
পোয়ারোর আচমকা প্রসঙ্গান্তরে সরে যাওয়ার ব্যাপারটা আমাকে কিছুটা হতচকিত করে তুললেও আমি দৃঢ় গলায় প্রতিবাদ করি। আমি বলি যতক্ষণ না তুমি শুতে যাচ্ছো আমিও তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি না।
খুব ভালো কথা। প্রকৃত বন্ধুর মতো কথা বললে। কিন্তু হেস্টিংস, তুমি তো আমাকে আমার চিন্তায় সাহায্য করতে পারবে না। আর সেই কাজটাই আমাকে জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে।
চিন্তা। আমি তবুও মাথা নাড়ি। তোমাকে চিন্তায় সাহায্য করতে যদিও না পারি, তুমি হয়তো কোনও সূত্র ভেবে বার করতে পারলে সে বিষয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে পারো।
তুমি সত্যিই আমার বিশ্বস্ত বন্ধু। তাহলে এখন এক কাজ করো ওই আরাম কেদারায় গিয়ে বসো।
আমি তাতে আপত্তি করি না। আমি আরাম কেদারায় বসে দোল খেতে থাকি। কখন যে আমার চোখ বুজে আসে আমি নিজেই জানি না।
টেবিলের সামনে চেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসে দুচোখ বন্ধ করে গভীর মনোসংযোগে কি যেন ভেবে চলেছিল পোয়ারো। সামনের খোলা খাতাটায় কি সব আঁকিবুকি কাটছিল আর মাঝে মাঝেই সেই খাতা থেকে পাতা ছিঁড়ে ওয়েস্টপেপার বক্সে ছুঁড়ে ফেলছিল। ওইসব দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারি নি।