০৫. মালঞ্চর মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা

মালঞ্চর মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন সুশীল চক্রবর্তী, ঐখান থেকেই ফোন করলেন।

মৃতদেহের ব্যবস্থা করে সুশীল চক্রবর্তী ঘরটা আর একবার ভালো করে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন।

বেশ বড় সাইজের ঘর, মেঝেতে সুন্দর ডিজাইনের টালি পাতা। একধারে একটি খাটো মোটা ডানলোপিলোর গদির ওপর বিছানা পাতা। দামী একটা বেডকভার দিয়ে তখনো শয্যাটি ঢাকা, বোঝা যায় গতরাত্রে ঐ শয্যা কেউ ব্যবহার করেনি।

একধারে একটা স্টীলের আলমারি, তারই গা ঘেঁষে বিরাট একটা ড্রেসিং টেবিল তার সামনে বসবার একটা গদি-মোড়া কুশন। ড্রেসিং টেবিলের ওপর নানাবিধ দামী দামী প্রসাধন দ্রব্য সাজানো। সবই ফরেন গুডস্। প্রসাধন দ্রব্যগুলো দেখলে মনে হয় মালঞ্চ রীতিমত শৌখিন ছিল।

ঘরে অন্যদিকে একটা ওয়ারড্রোব, তার ওপরে সুন্দর সোনালী ফ্রেমে পাশাপাশি দুটো ফটোই বোধ হয় একসময় ছিল, এখন একটাই মাত্র দেখা যাচ্ছে–মালঞ্চর ফটো।

ফটো-ফ্রেমের সামনে একগোছা চাবিসমেত একটা রুপোর চাবির রিং, এবং তার পাশে রয়েছে একটা দামী লেডিজ রিস্টওয়াচ। ঘড়িটা তখনও চলছে।

ঘরের অন্য কোন সুদৃশ্য জয়পুরী ফ্লাওয়ার ভাসে একগোছা বাসী রজনীগন্ধার স্টিক। তার পাশে একটা মাঝারি সাইজের রেডিওগ্রাম।

ঘরটা দেখা শেষ করে সুশীল চক্রবর্তী ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের দরজা ঠেলে বাথরুমে প্রবেশ করলেন।

দীপ্তেন ভৌমিক কাল সন্ধ্যায় এখানে এসেছিল, কিন্তু তাকে রতন বা মানদা কেউই এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে দেখেনি। তবে কোথা দিয়ে লোকটা বের হয়ে গেল কাল রাত্রে? প্রশ্নটা সুশীল চক্রবর্তীর মাথার মধ্যে তখনো ঘোরাফেরা করছে।

ঘরের দরজায় ইয়েল-লক্ করা ছিল, সেই দরজা ভেঙে এঁরা ঢুকেছেন মালঞ্চর শোবার ঘরে। বাথরুমে দেখা গেল আর একটা দরজা আছে কিন্তু সে দরজাটা বন্ধ। সুশীল চক্রবর্তী আরো একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলেন এ বাড়িতে ঢোকার সময়—সদরের দরজাতেও ইয়েল-লক্ সিস্টেম।

বাথরুমের দরজা বন্ধ, ঘরের দরজাও বন্ধ ছিল। তবে কোথা দিয়ে কোন্ পথে দীপ্তেন ভৌমিক এ বাড়ি থেকে গত রাত্রে বের হয়ে গিয়েছিল। তবে কি সকলের অজ্ঞাতে এক সময় ঐ সদর দিয়েই বের হয়ে গিয়েছিল?

বাথরুমে দেখবার বিশেষ কিছু ছিল না, ঝকঝকে আয়না লাগানো, বেসিন, ব্র্যাকেটের সঙ্গে লিকুইড সোপ কেস লাগানো, গোটা দুই টুথব্রাশ, টুথ পেস্ট, একটা ট্যালকম পাউডারের কৌটো, সাবানের কেস, তাতে সাবান রয়েছে। দেওয়ালের র্যাকে ঝুলছে একটা টাওলে আর সিল্কের নাইটি।

বাথরুমের পিছনের দরজাটা খুলে ফেললেন সুশীল চক্রবর্তী। একটা ঘোরালো লোহার সিঁড়ি নীচের গলিপথে নেমে গিয়েছে। মেথরদের যাতায়াতের ব্যবস্থায় ঐ সিঁড়ি। দরজাটা বন্ধ করে সুশীল চক্রবর্তী আবার ঘরে ফিরে এলেন।

মর্গে বডি নিয়ে যাবার জন্য একটা কালো ভ্যান এসে গিয়েছে।

ডেড-বড়ি নিয়ে যাবার পর সুশীল চক্রবর্তী ঘরের মধ্যেকার আলমারিটা খুললেন–ঐ চাবির রিংয়ের একটা চাবির সাহায্যে।

হ্যাঙারে নানা রঙের সব দামী দামী শাড়ি ও ব্লাউজ সাজানো। চাবি দিয়ে আলমারির ড্রয়ার খুললেন—একটা চন্দন কাঠের বাক্স–বেশ ভারী—তালা লাগানো ছিল না বাক্সটায়, ডালা তুলতেই দেখা গেল অনেক সোনার গহনা—ডালা বন্ধ করে বাক্সটা আবার যথাস্থানে রেখে দিলেন।

.

ড্রয়ারের মধ্যে একটা প্লাস্টিকের বাক্সের মধ্যে একগাদা একশো টাকার নোট বাণ্ডিল বাঁধা, কিছু দশ টাকা ও পাঁচ টাকার নোট, খুচরো পয়সা। আন্দাজে মনে হল একশো টাকার নোট প্রায় হাজার দুই টাকার হবে। আলমারিটা বন্ধ করে, ঘরে ইয়েল-লক্ টেনে দিয়ে চাবিটা সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে এলেন সুশীল চক্রবর্তী।

বাইরে মানদা দাঁড়িয়ে ছিল। মানদাকে জিজ্ঞেস করলেন, এই চাবি কি তোমার মার কাছেই থাকত?

—আজ্ঞে একটা চাবি বাবুর কাছে আর অন্যটা মার কাছে থাকত, মানদা বলল।

—সদরের চাবি তো তাহলে তার কাছেও একটা থাকত?

—হ্যাঁ।

অতঃপর বিক্রম সিংকে বাড়ির প্রহরায় রেখে বাইরে এসে জীপে উঠে বসলেন সুশীল চক্রবর্তী। আসবার সময় আর একবার উঁকি দিলেন নীচের তলায় সুশান্ত মল্লিকের ঘরে-সুশান্ত মল্লিক ঘুমোচ্ছে।

আকাশ কালো হয়ে উঠেছে তখন। গতরাত থেকেই মধ্যে মধ্যে মেঘ জমেছে আকাশে কিন্তু বৃষ্টি নামেনি। পথে যেতে যেতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল।

 

সুরজিৎবাবুর বড় ছেলে যুধাজিৎ পরের দিন তার মার কাছ থেকেই সব ব্যাপারটা জেনেছিল। স্বামীর যে একটা রক্ষিতা আছে, আর তাকে বাড়ি গাড়ি করে দিয়েছেন সুরজিৎ তাঁর স্ত্রী স্বর্ণলতা জানতেন। প্রথম প্রথম স্বামীকে ফেরাবার অনেক চেষ্টা করেছিলেন স্বর্ণলতা, অনেক কান্নাকাটিও করেছিলেন, কিন্তু স্বামীকে ঐ ডাইনীর কবল থেকে উদ্ধার করতে পারেননি। অবশেষে চুপ করে গিয়েছিলেন।

ঐ দিন সুরজিৎবাবু ফিরতেই স্বর্ণলতা শুধালেন, কোথায় গিয়েছিলে এই সাত সকালে?

–কাজ ছিল?

—কি এমন কাজ যে ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছুটেছিলে গাড়ি নিয়ে?

—মালঞ্চকে কে যেন খুন করে গিয়েছে-

-সে কি! অস্ফুট একটা আর্তনাদ স্বর্ণলতার কণ্ঠ চিরে বের হয়ে এলো।

—হ্যাঁ। থানার লোক এসে দরজা ভেঙে তাকে মৃত অবস্থায় দেখেছে।

–তা কি ভাবে মারা গেল গো?

—গলায় রুমাল পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে।

–কি সর্বনাশ! কে–কে করল?

–তা আমি কি করে বলব?

—তুমি জানো না কিছু? প্রশ্নটা করে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন স্বর্ণলতা–সত্যি সত্যিই তুমি জানো না?

স্ত্রীর কণ্ঠস্বরে তাকালেন সুরজিৎ। কয়েকটা মুহূর্ত স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

তারপর শান্ত গলায় স্ত্রীর মুখের দিকে চেয়ে সুরজিৎ বললেন, কি বলতে চাও তুমি?

–তুমি তো কাল রাত্রেও সেখানে গিয়েছিলে?

—তাই কি? স্পষ্ট করে বল, কি বলতে চাও তুমি?

—তুমি কিছুই জানো না?

—কি জানব?

—কে তাকে হত্যা করল?

–জানি না।

–জানো না? তাহলে কাল অত রাত করে বাড়ি ফিরেছিলে কেন?