‘লোহার বাজারে গিয়েছি আমি।
শিকল কিনেছি
কঠিন শিকল
তোমারই জন্য
হে আমার প্রেম…’
–জাক প্রেভের
মার্গারিট আমার দু বছর আগে এদেশে এসেছে, সে অনেককে চেনে, অনেকেই তাকে চেনে। কিন্তু কারুর সঙ্গেই তার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা নেই। রাস্তায় ঘাটে কিংবা ক্যান্টিনে-রেস্তোরাঁয় অনেক যুবকই তার সঙ্গে যেচে কথা বলে, তার সম্পর্কে বেশ আগ্রহ দেখায়। মার্গারিটকে তেমন একটা রূপসি বলা যায় না, বেশ লম্বা বড়সড়ো চেহারা, নাক-চোখ এমন কিছু আহামরি নয়, তবে সব মিলিয়ে একটা আলগা লাবণ্য আছে, মুখখানা হাসিতে ঝলমল করে। তার মাথাভরতি সোনালি চুল সব সময় হুড়োকুড়ো, মনে হয় জীবনে কখনও আঁচড়ায় না, সাজ-পোশাকের দিকে কোনও মনোযোগ নেই, সে কথা বলে ঝড়ের গতিতে, রাস্তা দিয়ে হাঁটার বদলে ছোটে, যে-কোনও ছোটখাটো ব্যাপারেও তার দারুণ বিস্ময় ও ভালোলাগা, সর্বক্ষণ যেন জীবনীশক্তিতে টগবগ করছে। সব মিলিয়ে সে এক আকর্ষণীয়া নারী তা ছাড়া ফরাসিনী বলেও একটা অতিরিক্ত আকর্ষণ আছে। আমেরিকান যুবকরা রাস্তা দিয়ে তার পাশাপাশি হাঁটে, ক্যান্টিন-রেস্তোরাঁয় নিজের টেবিলে ডেকে বসাতে চায়, মার্গারিট আপত্তি করে না, তাদের সঙ্গে হেসে গল্প করে, কিন্তু বেশিক্ষণ না, দশ-পনেরো মিনিট বাদে সে সরে যায়।
শুক্র-শনিবার সন্ধেবেলা ছেলেমেয়েদের মধ্যে ডেটিং এখানে প্রায় একটা অবশ্য পালনীয় রীতি। অনেক ক্ষেত্রেই অবশ্য ডেট করা মানে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের সন্ধেবেলায় একসঙ্গে কোথাও খেতে যাওয়া, বেড়ানে, সিনেমা দেখা, গল্প করা ও বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু শুক্র-শনিবার সন্ধ্যায় কোনও মেয়ে যদি একলা বাড়িতে বসে থাকে, তাহলে ধরে নিতে হবে, সে হয় অসুস্থ কিংবা তার মনে বা শরীরে কোনও খুঁত আছে। মাগরিট যথেষ্ট স্বাস্থ্যবতী তরুণী। হাসি-ঠাট্টা-মজাতে কোনও ক্লান্তি নেই, তবু সে কারুর সঙ্গে ডেট করে না। সন্ধেগুলো লাইব্রেরিতে কাটায়।
আমি কানাঘুষো শুনলাম, গত বছর গ্রেগরি নামে আর্ট ডিপার্টমেন্টের একটি ছেলে মার্গারিটের প্রেমে পড়েছিল খুব। দিনের পর দিন সে মার্গারিটের সঙ্গে ছায়ার মতন লেগে থাকত, মার্গারিটের অনেকগুলো স্কেচও করেছিল, তারপর হঠাৎ ওদের মধ্যে কী হল তা আর জানা যায় না, ওদের বিচ্ছেদ হল তো বটেই, গ্রেগরি এমন মুষড়ে পড়ল যে অনেকের ধারণা হল, তার মেলানকোলিয়া রোগ হয়েছে। কিছুদিন পরেই গ্রেগরি এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেল।
আরও কয়েকজন যুবকের ব্যবহারে লক্ষ করেছি, মার্গারিট সম্পর্কে বেশ একটা রাগ রাগ ভাব। খুব সম্ভবত তারাও মার্গারিটের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠতা করতে গিয়ে পাত্তা পায়নি।
এই সব ঘটনা জেনেও মার্গারিটকে কিছু জিগ্যেস করতে পারি না, আমার বাবো-বাধো লাগে।
আমার সঙ্গে মার্গারিটের একটা সহজ স্বাভাবিক বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেছে কিছুদিনের মধ্যেই। আমি সকালের দিকে বেশি বেরুই না। মাগরিটই যখন তখন আমার ঘরে চলে আসে। মার্গারিট কবিতা নিয়েই কথা বলতে ভালোবাসে বেশি, তা ছাড়া সে আমাকে ইউনিভার্সিটি ক্যামপাসের নানারকম গল্প শোনায়। সেই গল্পে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, অনেক দিন আমরা দুজনে মিলে রান্না করি, আমার তৈরি খিচুড়ি (প্রায় জগাখিচুড়ি বলা যায়) খেয়ে মার্গারিট মুগ্ধ, এক একদিন সে বাইরে থেকেও নানা রকম খাবার কিনে আনে।
আমি লক্ষ করেছি, টাকা পয়সা সম্পর্কে মার্গারিটের বিন্দুমাত্র মোহ নেই। টাকার হিসেব কবতেও যেন জানে না। ও যা উপার্জন করে, মাসের গোড়ার দিকেই তা দু’ হাতে খরচ করতে থাকে, মাসের শেষে কীভাবে চলবে, তা চিন্তাও করে না। পরোপকারের দিকে তার খুব বেশি ঝোঁক। কোনও আড়তে কেউ যদি দৈবাৎ বলে ফেলে, আমি অমুক জিনিসটা খুঁজছি, কিছুতেই পাচ্ছি না, তা হলে মার্গারিট নিশ্চিত পরের দিন সারা শহরের সব কটি দোকান ছুঁড়ে সেই জিনিসটা কিনে এনে দেবে, তার দাম নেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। লিন্ডা নামে আমাদের দুজনেরই পরিচিত একটি মেয়ে তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে শিকাগো যাওয়ার পথে সাংঘাতিক অ্যাকসিডেন্টের মধ্যে পড়ে, লিন্ডার দুটি চোখই নষ্ট হয়ে যায়। মার্গারিট তার জন্য কেঁদে ভাসিয়েছে, লিন্ডা হাসপাতাল থেকে ফেরার পর নিয়মিত তার সেবা করেছে। এখানে কালো মানুষের সংখ্যা কম, তবু রাস্তায় কখনও কোনও গরিব কালো লোক দেখলে মার্গাটির আগ বাড়িয়ে গিয়ে তাকে সাহায্য করবে নানারকম, এর ফলে তাকে দু-একবার বেশ বিপদের ঝুঁকি নিতে হয়েছে, কিন্তু মার্গারিটের যেন সে বোধই নেই। তার হৃদয়ে মায়া-মমতা, পরের জন্য সহানুভূতি, এই সবই যেন বেশি বেশি। সে কখনও পরনিন্দা করে না, আমি একবারও তার মুখে কোনও ব্যক্তিবিশেষ সম্পর্কে মন্দ কথা শুনিনি।
মার্গারিট ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রাম কিংবা রাইটার্স ওয়ার্কশপের সঙ্গে যুক্ত নয়, সুতরাং যেসব পার্টিতে আমি আমন্ত্রিত হই, তার অনেকগুলিতেই মার্গারিটের নেমন্তন্ন থাকে না। তার জন্য মাঝে মাঝে আমি খুব অস্বস্তিতে পড়ি। আমার ঘরে বসে মার্গারিট আর আমি হয়তো কোনও কবিতা পড়ছি, মার্গারিট ফরাসি ভাষা থেকে আক্ষরিক অনুবাদ করে আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, এমন সময় পল এঙ্গেলের টেলিফোন। পলের সব সময়েই ব্যস্ত-সমস্ত ভাব। পল বলল, আধ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে নাও, আমি এসে তোমাকে গাড়িতে তুলে নেব, পুলিজার পুরস্কার পাওয়া একজন লেখক এসেছেন, তাঁর সম্মানে পার্টি।
আমার দ্বিধা হয়, মার্গারিটকে কী করে একা ফেলে চলে যাই। ও আমার জন্য পিৎসা এনে রেখেছে। দু’জনে একসঙ্গে খাওয়ার কথা। কিন্তু মার্গারিটই উৎসাহ দিনে বলে, তুমি যাও না, ঘুরে এসো, তোমার যাওয়া উচিত, আমি একলা একলা বসে কিছুক্ষণ পড়াশুনো করব। আমার কোনও অসুবিধে হবে না! মার্গারিটের হস্টেলের ঘরটা একটি মেয়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে হয়, সে মেয়েটির বিরুদ্ধে মার্গারিট কোনও কথা বলেনি, তবু বোঝা যায়, দু’জনের রুচির খুব একটা মিল নেই। তাই হস্টেলের ঘরটার থেকে মার্গারিট আমার অ্যাপার্টমেন্ট বেশি পছন্দ করে। পার্টি থেকে ফিরে এসে আমি দেখি, টেবিলের ওপর মার্গারিট একটা সুন্দর চিঠি লিখে রেখে চলে গেছে।
একদিন বিকেলবেলা খুব তুষারপাত আর ঝড়ো হাওয়া চলছে, মার্গারিট হঠাৎ এসে বলল, সামনের জঙ্গলটায় কী কাণ্ড হয়েছে, জানো? চলো, চলো, শিগগির দেখবে চলো!
তার কণ্ঠস্বরে এমনই ব্যগ্রতা যে মনে হয় সেই অবশ্যদ্রষ্টব্য ব্যাপারটির কাছে না যাওয়াটাই একটা পাপ। অতি দ্রুত জুতো-মোজা পরে, একটা ওভারকোট চাপিয়ে (ওভারকোটটা স্যালভেশন আর্মির দোকান থেকে অতি সস্তায় সেকেন্ড হ্যান্ড কেনা) বেরিয়ে পড়লাম। আমার বাড়ির রাস্তাটার নাম সাউথ ক্যাপিটাল, ডান দিকে একটুখানি এগোলেই একটা ছোট জঙ্গলমতন জায়গা, এলোমেলো গাছপালা ও অযত্নের জলাশয়, অনেক সময় এখানে হরিণ দেখা যায়। এদেশে হরিণ মারা নিষিদ্ধ, একদিন একটা বিরাট শিংওয়ালা হরিণ বড় রাস্তায় এসে পড়ে সাংঘাতিক ট্র্যাফিক জ্যাম ঘটিয়ে দিয়েছিল, তবু কোনও একজনও হরিণটার গায়ে হাত ছোঁয়ায়নি।
সেই জঙ্গলের প্রান্তে এসে মার্গারিট আমাকে একটা মরা পাখি দেখাল।
পাখিটা শীতে জমে শক্ত হয়ে গেছে। চড়ুই পাখির চেয়ে একটু বড় আকারের, মোটাসোটা ধরনের, পাখিটার নাম জানি না। এরা বোধহয় বেশি উড়তে পারে না, সেইজন্য শীতের সময় চলে যেতে পারে না গরম দেশে, আবার চড়ুই পাখির মতন মানুষের কোঠাবাড়ির আশ্রয়ের উষ্ণতাও নিতে জানে না। তাই শীতের কামড়ে অসহায়ভাবে মরে।
প্রায় এক ফুটের মতন বরফ জমে গেছে মাটির ওপর, এদিক-ওদিকে আরও কয়েকটা মৃত পাখি দেখা গেল। মার্গারিট সেই বরফের মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে পাখিগুলো কুড়োতে লাগল। ফিসফিস করে ফরাসিতে বলল :
ওরিওল পাখি ছুঁয়েছে ঊষার রাজধানী
তার সঙ্গীত তলোয়ার, এসে
বন্ধ করেছে দুঃখ শয্যা
সব কিছু আজ চিরজীবনের শেষ…
আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছি, মার্গারিট অঞ্জলিতে মৃত পাখি নিয়ে কবিতা পাঠ করছে। আমারই যেন অন্য একটা স্বরূপ একটু দূর থেকে দেখছে এই দৃশ্য।
এক সময় মার্গারিট তার কাতর মুখখানি তুলে জিগ্যেস করল, পাখিগুলো এইভাবে পড়ে থাকবে? আমরা ওদের কবর দিতে পারি না?
মার্গারিটকে সাহায্য করবার জন্য আমি ওর পাশে বসে দু’হাত দিনে খুঁড়তে লাগলাম বরফ।
তখন আমার মনে হল, আমি একা গাছতলায় কোনও মৃত পাখি দেখলে হয়তো দু এক মিনিট থমকে দাঁড়াতাম, পরে কোনও কবিতা লেখার সময় হয়তো এসে যেত এই দৃশ্যটা, কিন্তু সে-মৃত পাখিদের কবর দেওয়ার কথা তো কখনও আমার মনে আসত না। বাস্তবের মৃত পাখিটাকে ফেলে গিয়ে আমি তাকে ব্যবহার করতাম কবিতার রূপকল্পে। মার্গারিটের অনুভূতি কি আমার চেয়েও অনেক সূক্ষ্ম? কিংবা এটা তার ছেলেমানুষি? কিংবা সে সব সময় কাব্যের মায়াময় জগতে বিচরণ করে?
মোট পাঁচটি পাখিকে বরফের নীচে চাপা দেওয়া হল। মার্গারিট তার ওপর এঁকে দিল ক্রুশ চিহ্ন। আমি গ্লাভস করে আসিনি, আমার আঙুলগুলো ঠান্ডায় জমে যাওয়ার উপক্রম। ফ্রস্টবাইট না হয়ে যায়। মার্গারিট স্তব্ধ হয়ে বসে আছে, আমি তাকে তাড়া দিয়ে বললাম, শিগগির ঘরে চলো–
প্রায় ছুটতে ছুটতে ফিরে এসে, অ্যাপার্টমেন্টের উষ্ণতায় কাঁপুনি থামল। এখন শরীরটাকে চাঙ্গা করা দরকার। মার্গারিট কয়েকদিন আগে আমাকে এক বোতল রেমি মারব্যাঁ উপহার দিয়েছিল, দুটি গেলাসে ঢেলে ফেললাম চটপট। মার্গারিট তার গেলাসটা হাতে নিয়ে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরের তুষার ধারাপাত দেখতে লাগল একমনে।
আমি পাশে এসে ওঁর কাঁধে হাত দিয়ে জিগ্যেস করলাম, তুমি তখন যে কবিতাটা বললে, ওটা কার?
মার্গারিট বলল, রেনে শান-এর। তুমি চিনতে পারোনি?
আমি বললাম, রেনে শার-এর নাম শুনেছি, ওঁর কবিতা বিশেষ কিছু পড়িনি।
মার্গারিট বলল, ফরাসি ভাষার জীবিত কবিদের মধ্যে প্রধান এই রেনে-শার। ফরাসিরা সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করে, কারণ তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্রতিরোধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, নিজে অস্ত্র নিয়ে লড়াই করেছেন।
আমি বললাম, তোমাদের অনেক সাহিত্যিক-সাংবাদিকই প্রতিরোধ আন্দোলনের সময় অস্ত্র হাতে নিয়েছিলেন, তাই না?
মার্গারিট বলল, রেনে শার-এর ভূমিকা ছিল অনেকখানি। তিনি আমাদের জাতীয় বীর। আবার খুব বড় কবি। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জানো, রেনে-শার তাঁর দেশপ্রেমের সঙ্গে কবিতাকে মেশাননি। তিনি লড়াই করেছেন প্রাণপণে কিন্তু কখনও দেশাত্মবোধক কবিতা বা উত্তেজক কবিতা বা চ্যাঁচামেচির কবিতা লেখেননি। তিনি মনে করতেন, কবিতা অতি বিশুদ্ধ শিল্প, তার মধ্যে যুদ্ধ-টুদ্ধ মেশানো উচিত নয়। কবিতা দিয়ে যুদ্ধ করা যায় না, সে চেষ্টা করতে গেলে, সেগুলো কবিতাও হয় না, অস্ত্রও হয় না।
আমি বললাম, তুমি ওই ওরিওল পাখি বিষয়ে মূল কবিতাটা আর একবার শোনাও তো!
কবিতা পাঠের সময় মার্গারিটের মুখখানা উদ্ভাসিত হয়ে যায়, ভেতরে যেন একটা আলো জ্বলে ওঠে। ও সময়ে তাকে সবচেয়ে সুন্দর দেখায়।
পাঠ শেষ হলে আমি মার্গারিটকে আমার দিকে আকর্ষণ করে মৃদু গলায় জিগ্যেস করলাম, তোমাকে একটা চুমু খাব?
সঙ্গে-সঙ্গে যেন চিনে লণ্ঠনের ভেতরের বাতিটা নিভে গেল। বিবর্ণ হয়ে গেল ওর মুখখানা। আমার হাত ছাড়িয়ে একটু দূরে সরে গিয়ে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম। কী হল ব্যাপারটা, আমি কি কোনও অন্যায় করেছি? একটি মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর তাকে চুমু খেতে চাওয়া তো পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যাপার। তাও তো আমি জোর করিনি। ওর কাছে অনুমতি চেয়েছি মাত্র। আমি প্রাচ্যদেশীয়, কালোলোক বলে ওর আপত্তি? তা হতেই পারে না। এই কদিনের পরিচয়ে আমি বুঝেছি, কালো-সাদার বিভেদ নিয়ে মার্গারিটের কোনও রকম সংস্কার নেই। মার্গারিটের এঁটো জ্ঞানও নেই, আমার হাত থেকে ও যখন তখন জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে টানে, আমার গেলাসের পানীয়তে বিনা দ্বিধায় চুমুক দেয়, তবে একটা চুম্বনে কিসের দ্বিধা!
মার্গারিট কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমি জানতাম একদিন এরকম হবে, আমি ভয় পাচ্ছিলাম, ..সুনীল, তোমার কাছে আসতে, তোমার সঙ্গে গল্প করতে আমার খুব ভালো লাগে, কিন্তু আমি শরীরিক সম্পর্কে বিশ্বাস করি না; এই যে আমেরিকান ছেলেমেয়েরা, পারস্পরিক ভালোবাসা আছে কি না তার তোয়াক্কা করে না, ভালোবাসার কিছু বোঝেই না, তবু যখন তখন শুয়ে পড়ে, আমি এটা বিষম ঘৃণা করি। আমি কখনও কারুর সঙ্গে…আমি ভেবেছিলাম, তোমরা ভারতীয়রা শরীরের পবিত্রতায় বিশ্বাস করো..কিন্তু তুমি কবি…আমি পারব না, সুনীল, আমায় ক্ষমা করো…
আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ঠিক আছে, আমার চাই না, এমনিই হঠাৎ বলেছি, তোমার যদি ইচ্ছে না হয়–
মার্গারিট বলল, না, তুমি একবার মুখ ফুটে বলেছ, তুমি পুরুষ, আমি বাধা দিলে তুমি অপমানিত হবে, তোমার রাগ হবে, তোমার ভেতরে-ভেতরে সব সময় ইচ্ছেটা থাকবে, তুমি স্বাভাবিক হতে পারবে না, তুমি বিশ্বাস করো সুনীল, আমি শুধু তোমাকে বাধা দিচ্ছি না, আমি জীবনে এ পর্যন্ত কোনও পুরুষকেই চুম্বন করিনি।
এবার আমার স্তম্ভিত হওয়ার মতন অবস্থা। বলে কী? একটি সাতাশ বছরের স্বাধীনা ফরাসিনি মেয়ে, সে এ পর্যন্ত একটাও চুমু খায়নি। অথচ আমাদের ধারণা, সব ফরাসি মেয়েদের ষোলো-সতেরো বছর বয়েসে যৌন অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। আমেরিকান মেয়েদের যে অনেকেরই হয় তা তো স্বীকৃত সত্য। গল্প-উপন্যাস পড়ে আমাদের মনে হয়, ফরাসি মেয়েরা যৌন লীলাখেলায় সর্বক্ষণ মেতে থাকে। অথচ আমি আমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি এক মূর্তিমতী ব্যতিক্রমকে।
মার্গারিট যে মিথ্যে কথা বলছে না, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। মিথ্যে ব্যাপারটাই নেই ওর চরিত্রের মধ্যে। গোঁড়া ক্যাথলিক পরিবারের মেয়ে, ওর দুই বোন সন্ন্যাসিনী, মার্গারিটের মনের মধ্যেও কি রয়ে গেছে কোনও ধর্মীয় সংস্কার? ওর সারা মুখখানি এখন বেদনাময়।
আমি ওর হাত চেপে ধরে ক্ষমাপ্রার্থীর সুরে বললাম, ঠিক আছে, আমি ওই প্রসঙ্গই আর তুলব না, প্লিজ, প্লিজ, তুমি শান্ত হও, তুমি আমাকে রেনে শার-এর আরও দু’একটা কবিতা শোনাও!
কিন্তু মার্গারিটকে কিছুতেই আর ধরে রাখা গেল না। জোর করেই হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমি এখন আর থাকতে পারব না, সুনীল, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, আমি এখন একা একা প্রার্থনা করব, তোমার কথায় আমি একটুও রাগ করিনি, হয়তো আমারই দোষ, আমি প্রথম দিনেই তোমাকে কিছু বলিনি, আমাকে ছেড়ে দাও!
সেই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে মার্গারিট বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। ওর হস্টেল প্রায় এক মাইল দূরে। জানলা দিয়ে আমি দেখলাম, মার্গারিট মাথা নীচু করে আস্তে আস্তে হাঁটছে, কী জানি কাঁদছে কি না। আমার বুকের ভেতরটা মুচড়ে মুচড়ে উঠছে, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার আর কী করা উচিত ভেবে পাইনি। এক সময় মার্গারিট মিলিয়ে গেল পথের বাঁকে।
তারপর তিন চারদিন তার সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি।
ভ্রমণকাহিনিতে একটি মেয়েকে চুম্বন করা হল কি হল না, এর উল্লেখ অনেকের কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু যে-কোনও ভ্রমণকাহিনিই তো আসলে আত্মজীবনীরও একটা টুকরো বটে। আমার জীবনের এই অতি ব্যক্তিগত ব্যাপারটি আমি অকপটে বর্ণনা করছি, তার কারণ ওই ঘটনাটি নিয়ে সেই সময়ে আমার মনে যে একটা প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল, সেটা আমি প্রকাশ করতে চাই।
আমি একটি কবিতার পত্রিকা সম্পাদনা করেছি, নিজেও লেখালেখি করেছি কিছু, কিন্তু বিশ্ব সাহিত্য বিশেষ কিছু পড়াশুনো করিনি, সুযোগও পেয়েছি কম। যদিও বিশ্বের শিল্প সাহিত্য সম্পর্কে একটা অসীম ক্ষুধা অনুভব করতাম। নিজেদের লেখা নিয়ে লাফালাফি বা আত্মশ্লাঘা করতে গিয়ে এক এক সময় থমকে মনে হত, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কী লেখা হয়েছে, কতখানি লেখা হয়েছে, তাও তো জানা দরকার। নিছক কূপমণ্ডুপের মতন কয়েকজন বন্ধু মিলে পরস্পর পরস্পরের পিঠ চাপড়ানি দিলেই তো হয় না, তাতে বেশিদূর এগোনো যায় না। বাংলায় অনুবাদ শাখাঁটি বেশ দুর্বল। অন্যান্য ভাষার যা কিছু পড়েছি, সবই ইংরিজি অনুবাদে, তাও যেটুকু পাওয়া যায়। সাধারণত চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেকার সাহিত্য অনুবাদে জনপ্রিয় হয়। আমরা ফ্রানৎস কাফকাকে নিয়ে এক সময় এমন মাতামাতি করেছি, যেন তিনি একজন নতুন লোক। হাইনে কিংবা রিলকে সমসাময়িক কবি! আমরা ইংরিজির মাধ্যমে কিছু ফরাসি কবিতা সম্পর্কে জেনে পুলকিত হয়েছি, কবিতাগুলির মূল শব্দের মর্ম গ্রহণ করতে পারিনি, টের পাইনি তার ঝঙ্কার। আমরা দেগা, গগ্যাঁ, ভ্যান গঘ, মাতিসের মূল ছবি একটাও দেখিনি, দেখেছি শুধু কিছু প্রিন্ট! সব কিছুতেই সেকেন্ড হ্যান্ড, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতন।
মার্গারিটের সঙ্গে আকস্মিক পরিচয় আমার পক্ষে দারুণ সৌভাগ্যজনক হয়েছিল। সাহিত্য-শিল্প তার ধ্যানজ্ঞান! আমার সঙ্গে গল্পে, আডড়ায়, নদীর ধার দিয়ে বেড়াতে বেড়াতে, এমনকি এক সঙ্গে রান্না করতে করতেও সে ফরাসি কবি ও শিল্পীদের সম্পর্কে এমনভাবে সব কথা বলত, যা আজও আমি কোথাও পড়িনি। মূল ফরাসি কবিতার দু’তিন লাইন বলার পর প্রতিটি শব্দ ভেঙে-ভেঙে বুঝিয়ে দিলে, আমি পেয়ে যেতাম অনেক গূঢ় অর্থ। ফরাসি দেশের ছবি আঁকার বিভিন্ন পট সম্পর্কে দুটো একটা ছোট ঘটনা তার মুখ থেকে শুনে পরিষ্কার হয়ে যেতে অনেক কিছু। সে আমার বান্ধবী, তবু তার থেকে আমি যা শিখছিলাম, কোনও গুরু বা শিক্ষক বা প্রতিষ্ঠান আমাকে তা শেখাতে পারত না। তার বন্ধুত্বের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল আমার কাছে উপভোগ্য এবং মহার্ঘ।
আবার এ কথাও তো ঠিক, আমি তখন একটি স্বাস্থ্যবান, মুক্ত, পিছুটানহীন যুবক। একটি মেয়ের সঙ্গে যদি বন্ধুত্ব হয়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা এক সঙ্গে কাটাই, অনেক সময় বন্ধ ঘরের মধ্যে (শীতের দেশে কেউ কখনও ঘরের দরজা খুলে রাখে না) দুজনে থাকি, একই খাবার দুজনে ভাগ করে খাই, পরস্পরের ওপর বিশ্বাসও ন্যস্ত করেছি, তাহলে কোনও এক সময় সেই মেয়েটিকে কি আমার আদর করতে বা চুমু খেতে ইচ্ছে করবে না? এরকম ইচ্ছে না জাগাটাই তো অস্বাস্থ্যকর বা রুগির লক্ষণ। আমি দেশে কোনও বাগদত্তা কিংবা প্রেমিকা রেখে আসিনি যে তার প্রতি মিথ্যাচার হবে। মার্গারিটেরও কোনও প্রেমিক নেই। তাহলে কেন সে বাধা দেবে? তার ধর্মীয় সংস্কার যদি এত প্রবল হয়, তবে তা কি আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব?
মার্গারিট বলেছিল ভারতীয়রা নাকি শরীরের পবিত্রতায় বিশ্বাস করে। ভারতীয়দের সম্পর্কে কতরকম ভুল ধারণা যে বিদেশে চালু আছে!
মার্গারিট আমাকে প্রত্যাখ্যান করায় আমি খুব ক্রুদ্ধ বা অপমানিত না হলেও খানিকটা যে আহত হয়েছিলাম, তাও ঠিক। আমার পৌঁরুষে ঘা লেগেছিল। তখন আমি বুঝতে পেরেছিলাম, অনেক আমেরিকান ছেলে কেন মার্গারিটের ওপর চটা। তারা কেউ কেউ মার্গারিটের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠতা করতে গিয়ে অচিরেই শারীরিকভাবে কাছাকাছি আসতে চাইবেই। তারা সকলেই যে হৃদয়হীন তাও নয়, শরীরের মধ্য দিয়েই তারা। হৃদয়কে খোঁজে। এটা অনেকটা সামাজিকভাবে স্বীকৃতও বটে। অবিবাহিত ছেলেমেয়েরা যদি বাড়ির বাইরে ভোর রাত পর্যন্ত কাটিয়ে আসে, তাতেও বাবামায়েরা আর প্রকাশ্যে আপত্তি জানাতে পারেন না। সুতরাং মার্গারিট যদি কোনও ছেলেকে প্রত্যাখ্যান করে রূঢ় কথা শোনায়, তা হলে সে তো চটে লাল হবেই, তার কাছে মার্গারিটের এই ব্যবহার মনে হবে ন্যাকামি!
সারা সন্ধে আমি মাথা চেপে বসে রইলাম। মনে হচ্ছে সাংঘাতিক কিছু একটা ভুল করে ফেলেছি, তবু নিজেকে ঠিক অপরাধী মনে করতে পারছি না। বারবার মনে পড়ছে, মার্গারিটের দারুণ নৈরাশ্য আর বেদনামাখা, মুখখানি। কী করুণভাবে হেঁটে গেল তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে। আমি যতটা আহত হয়েছি, মার্গারিট যেন আঘাত পেয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। আমরা মনে করি আমরা অন্যায় করছি না, তবু আমাদের কোনও কোনও ব্যবহারে অন্য কেউ আঘাত পেতে পারে। এই সব উপলব্ধি আমার কাছে নতুন। মার্গারিট আর আসবে না আমার কাছে? এ কথাটা ভাবতেই বুকটা বিষম খালি খালি মনে হতে লাগল। না, কোনও কিছুর বিনিময়েরই আমি মার্গারিটকে হারাতে রাজি নই!