০৫. মারলা লি বললেন

মারলা লি বললেন, এই সামান্য বিষয় নিয়ে আপনার আসার প্রয়োজন ছিল না। বিয়ের লাইসেন্স এমন জরুরি কিছু নয়।

ফিহা বললেন, আরেকটা জরুরি বিষয় আমার আলোচ্যসূচিতে আছে। আপনার কি সময় হবে?

আমার সময়ের একটু টানাটানি যাচ্ছে। কিন্তু আপনার জন্যে সময় বের করা হবে।

মেন্টালিস্টদের উপর লেখা আরো কিছু বই পড়তে চাচ্ছি।

কেন? যে বইটি দিয়েছেন সেটি অস্পষ্ট।

সব বইই অস্পষ্ট। বিজ্ঞানের বই এগুলি নয়।

মেন্টালিস্টদের জীবনযাপন পদ্ধতি, এদের আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে যদি কোনো বই থাকে।

শুনুন মহামতি ফিহা, আপনি যেভাবে কথা বলছেন তার থেকে মনে হতে পারে আমরা মানুষ নই। আমরা জন্তু বিশেষ।

শুধু শুধুই আপনি রাগ করছেন।

আমি মোটেই রাগ করছি না। আপনাকে মেন্টালিস্ট সম্পর্কে আর কোনো বই দেয়া যাবে না। আপনি সমাজবিজ্ঞানী নন। আপনি তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। বাজে কাজে সময় নষ্ট করবেন কেন? সবার কাজ নির্দিষ্ট করা আছে। আপনি আপনার কাজ করবেন।

ফিহা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, সবার সব কাজ তো আপনারা করিয়ে নিচ্ছেন। আমি জানতে চাচ্ছি আপনাদের কাজটা কি। আপনারা কি করেন? মাটির নিচে শহর বানিয়ে বাস করেন জানি। কিন্তু বেঁচে থাকা ছাড়া আর কি করেন?

আমরা ভাবি।

কি ভাবেন?

পৃথিবীর মঙ্গল নিয়ে ভাবি। মানুষকে পরিচালনা করার সর্বোত্তম পন্থা নিয়ে ভাবি। ভবিষ্যত পৃথিবী কি করে সাজানো হবে তা নিয়ে ভাবি।

ভবিষ্যত পৃথিবীতে আমাদের স্থান কোথায়?

আমার জানা নেই। শুনুন মহামতি ফিহা, আজ আপনি বিয়ে করেছেন। একটি তরুণী মেয়ে ঘরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে—আজ কেন বাজে তর্ক করে সময় নষ্ট করছেন। তার কাছে যান। যাবার পথে ফুল কিনে নিয়ে যান। ফুলের দোকান এত রাতে নিশ্চয়ই বন্ধ হয়ে গেছে। আমি খোলাবার ব্যবস্থা। করছি।

কোনো প্রয়োজন দেখছি না।

আপনার প্রয়োজন নেই। কিন্তু মেয়েটির প্রয়োজন আছে। আপনারা মেন্টালিস্ট নন। আপনাদের একেকজনের চিন্তা-ভাবনা একে রকম। ফুল একজনের কাছে অর্থহীন, অন্যজনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

ফিহা উঠে দাঁড়ালেন। মারলা লি বললেন, আমি দুঃখিত যে আপনি খানিকটা হলেও মন খারাপ করে যাচ্ছেন। আপনার মন ভালো করার জন্য কিছু কি করতে পারি?

আমি আমার পালক বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে চাই। তা-কি সম্ভব হবে?

না। তা সম্ভব হবে না। তাঁরা যদি ভূগর্ভস্থ শহরে না থাকতেন তাহলে সম্ভব হত। ভূগর্ভস্থ শহর শুধু মেন্টালিস্টদের জন্যে।

সাধারণ মানুষ সেখানে গেলে শহর কি অশুচি হয়ে যাবে?

শুচি-অশুচির প্রশ্ন নয়। এটা হচ্ছে আইন।

আইনের পেছনে যুক্তি থাকে। এই আইনের পেছনের যুক্তিটি কি?

আমরা মানুষ হিসেবে আপনাদের থেকে অনেকখানিই আলাদা। সহাবস্থান আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় বলেই এই ব্যবস্থা। আপনারা আমাদের সম্পর্কে যত কম জানবেন ততই মঙ্গল।

আপনারা আমাদের সম্পর্কে সবকিছুই জানবেন, আর আমরা কিছু জানব না?

আপনাদের সম্পর্কে জানা আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সম্পর্কে আপনাদের জানা প্রয়োজন নয়। আলোচনা যথেষ্ট হয়েছে ফিহা। এখন বাড়ি যান। ফুলের দোকান কি খোলাবার ব্যবস্থা করব?

ফিহা জবাব না দিয়ে বের হয়ে এলেন। রাস্তায় তেমন আলো নেই। ঝড়ে বিদ্যুত ব্যবস্থায় যে সমস্যা হয়েছিল সে সমস্যা এখনো কাটিয়ে ওঠা যায় নি। ফিহা হাঁটছেন অন্ধকারে। তীব্র হতাশাবোধ তাঁকে গ্রাস করতে শুরু করেছে। ফিরে এসেছে পুরোনো অস্থিরতা।

স্যার।

তিনি চমকে তাকালেন। অন্ধকারে রাস্তার পাশে বিশালদেহী একজন। যুবক।

আপনি কে?

স্যার আমি টহল পুলিশ। আপনি কোথায় যেতে চান বলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দেব।

তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই, আপনাকে ধন্যবাদ। আমি যদি আপনার পেছনে পেছনে আসি আপনার কি অসুবিধা হবে?

হ্যাঁ হবে। আমি একা হাঁটতেই পছন্দ করি। ভালো কথা, এরিন নামের একজন টহল পুলিশের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তাকে কি একটা খবর দিতে পারবেন? তাকে কি বলবেন যে আমি বিয়ে করেছি?

এরিনকে খবর দেয়া যাবে না স্যার।

কেন?

ঝড়ের রাতে সে মারা গেছে। রাস্তায় ডিউটি ছিল। রাস্তা ছেড়ে কোথাও আশ্রয় নেবার অনুমতি ছিল না। কাজেই সে ঝড়ের সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল।

প্রাণ বাঁচানোর জন্যেও সে কোথাও যেতে পারে নি?

না। আমরা মানসিকভাবে নিয়ন্ত্রিত।

ও আচ্ছা।

ফিহা এগিয়ে চললেন। টহল পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে দেখছে তাঁকে।

 

ফিহা রাতের খাবার শেষ করলেন নিঃশব্দে।

নুহাশ তার মুখোমুখি বসেছে। কিন্তু তার সঙ্গে তেমন কোনো কথাবার্তা হচ্ছে না। অন্যদিন খাবার টেবিলের আশেপাশে লীম এবং পাঠক দুজনই থাকে। আজ তারা নেই।

নুহাশ বলল, আপনার খাবারে লবণের সমস্যা হয় বলে শুনেছি। লবণ কি ঠিক আছে?

ঠিক আছে।

আপনাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে।

চিন্তিত না। আমার মন খারাপ হয়ে আছে। মেন্টালিস্টদের সঙ্গে দেখা হলেই আমার মন খারাপ হয়ে যায়।

ওদের সঙ্গে দেখা না করলেই পারেন।

দেখা না করেও কি ওদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় আছে? এই মুহূর্তে আমরা দুজন যে কথা বলছি তা কি মেন্টালিস্টরা শুনছে না?

নুহাশ ক্ষীণ স্বরে বলল, খুব সম্ভব শুনছে।

আমার প্রায়ই ইচ্ছা করে আমরা সাধারণ মানুষরা পৃথিবীর কোনো এক নির্জন প্রান্তে চলে যাই। আমাদের নিজেদের একটি দেশ হোক। স্বাধীন দেশ।

নুহাশ কঠিন গলায় বলল, এ জাতীয় কথা আর কখনো বলবেন না। যারা এ জাতীয় কথা বলেছে বা ভেবেছে তাদের ভয়াবহ শাস্তির কথা কি আপনি জানেন না?

ফিহা চুপ করে গেলেন। হ্যাঁ, এই অপরাধের শাস্তির কথা তিনি জানেন। শাস্তি একটিই—জেল নয়, মৃত্যুদণ্ড নয়—মানসিকতা হরণ। অপরাধীর মাথা থেকে সমস্ত স্মৃতি নষ্ট করে দেয়া হয়। অপরাধী তখন পৃথিবীতে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর মতই হয়ে যায়। সে কিছুই জানবে না। সব তাকে নতুন করে শিখতে হয়। সে হাঁটতে শেখে, কথা বলতে শেখে। এই শাস্তির চেয়ে মৃত্যুদণ্ড অনেক সহজ শাস্তি।

খাওয়া শেষ না করেই ফিহা উঠে পড়লেন। তাঁর আর খেতে ইচ্ছা করছে। না। নুহাশ বলল, আপনার কি শরীর খারাপ করছে?

না। তুমি ঘুমুতে যাও। আমি কাজ করব।

কি কাজ করবেন?

অঙ্কের একটা মডেল তৈরি করার চেষ্টা করছি। ওটা শেষ করব।

আজ না করলে হয় না?

না, হয় না নুহাশ, এই জিনিসটা আমার মাথায় ঘুরছে, এটা শেষ না করে অন্য কোনো কিছুতেই আমি মন দিতে পারব না।

আপনি যখন কাজ করবেন তখন আমি কি আপনার পাশে বসে থাকতে পারি?

না, পার না। তুমি রাগ করো না নুহাশ।

আমি রাগ করি নি। তবে আপনাকে একটা কথা দিতে হবে—

ফিহা বিস্মিত হয়ে বললেন, কি কথা?

রাতে আপনি যখন ঘুমুতে আসবেন তখন আমি আপনাকে একটা গল্প পড়ে শোনাব। অতিপ্রাকৃত গল্পগুচ্ছ থেকে একটা গল্প। আপনাকে সেই গল্প শুনতে হবে।

আমি কখন ঘুমুতে আসি তার তো ঠিক নেই…

নুহাশ লজ্জিত গলায় বলল, যত রাতই হোক। আমি জেগে থাকব আপনার জন্যে।

 

ডাটা এন্ট্রির মাঝপথে আবারো বাধা পড়ল। কমুনিকেটরে যোগাযোগ করলেন মারলা লি।

মহামতি ফিহা।

কথা বলছি।

গভীর রাতে আপনাকে বিরক্ত করছি বলে দুঃখিত।

কি বলবেন বলুন।

আপনি আপনার পালক বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আপনি বলেছিলেন ব্যবস্থা করা যাবে না।

এখন করা হয়েছে। এঁরা দুজনই গুরুতর অসুস্থ। মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছেন। মৃত্যুপথযাত্রী মেন্টালিস্টদের শেষ ইচ্ছা পূর্ণ করা হয়। এঁরা দুজন আপনাকে দেখতে চাচ্ছেন। আপনি কি আসবেন?

আমি এক্ষুণি আসছি।

আপনার গেটের কাছে গাড়ি থাকবে।

ফিহা পাঠকের দিকে তাকালেন। পাঠক বলল, আমার মনে হয় আজ রাতে কাজটা করতে পারব না।

আমারো তাই মনে হচ্ছে। নুহাশের সঙ্গে খানিকটা সময় কাটাতে হবে। সে আমাকে কি এক গল্প না-কি পড়ে শোনাবে।

আপনি কখন ফিরবেন?

বুঝতে পারছি না কতক্ষণ লাগবে। তাড়াতাড়িই ফিরতে চেষ্টা করব। এখন কটা বাজে?

রাত তিনটা। ভোর হবার বেশি বাকি নেই।

ফিহা বাড়ি থেকে বের হলেন। নুহাশকে কিছু বলে গেলেন না।

চল্লিশ বছর পর ফি তার পালক পিতামাতাকে দেখলেন। ঘরে এই দুজন ছাড়া অন্য কেউ নেই। প্রশস্ত একটি বাটে দুজন বসে আছেন। দুজনকেই চূড়ান্ত রকমে অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে। দেখেই মনে হচ্ছে এঁরা মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছেন। মানুষ না কঙ্কাল, জ্বলজ্বলে চোখ ছাড়া এদের যেন কিছুই নেই। ঘর প্রায় অন্ধকার। অস্পষ্টভাবে সব কিছু চোখে আসে।

ফিহা বললেন, আপনারা কেমন আছেন?

দুজনই এক সঙ্গে ফিহার দিকে তাকালেন। বৃদ্ধ হাতের ইশারায় ফিহাকে পাশে বসতে বললেন। ফিহা বললেন, আপনার কি কথা বলার মতত শক্তি আছে?

দুজনই একত্রে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। কিন্তু কোনো কথা বললেন না।

ফিহা বললেন, আমার শৈশব আপনারা আপনাদের ভালবাসায় ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। আপনাদের ছেড়ে চলে এলেও আমি সেই ভালবাসার কথা ভুলি নি। আমার সবচে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারটির নামকরণ করা হয়েছে আপনার নামে। মিরান ফাংশান।

বৃদ্ধ মিরান আবার মাথা নাড়লেন, আবার হাত ইশারা করে পাশে বসতে বললেন। ফিহা বসলেন না।

দাড়িয়ে রইলেন। দুজনকে দেখে তীব্র কষ্ট হচ্ছে। এতটা কষ্ট তাঁর হবে তা কখনো কল্পনা করেননি। তাঁর চোখ ভিজে উঠল। তিনি কোমল গলায় বললেন, যতদিন পদার্থবিদ্যা বেঁচে থাকবে আপনার নাম বেঁচে থাকবে। আমি আপনাদের ছেড়ে এসেছি কিন্তু আপনাদের ভালবাসার অমর্যাদা করি নি। আমি মেন্টালিস্টদের ঘৃণা করি। তারা আমাদের রোবট বানিয়ে রেখেছে। আপনারাও মেন্টালিস্ট। আমি আপনাদেরও ঘৃণা করি কিন্তু…

কিন্তু কি?

আপনাদের দুজনের প্রতি আমার ভালবাসারও সীমা নেই।

জানি।

কি করে জানেন?

আমরা মেটালিস্ট। আমরা দূর থেকে তোমার মন পড়তে পারি। চল্লিশ বছর ধরেই পড়ছি। চল্লিশ বছর ধরে তোমার মঙ্গল কামনা করছি।

আপনাদের ধন্যবাদ।

নুহাশ মেয়েটি ভালো। তুমি সুখী হবে।

আপনাদের আবারো ধন্যবাদ।

আমরা তোমার স্ত্রীর জন্যে ফুল আনিয়ে রেখেছি। ফুলগুলি নিয়ে যেও।

অবশ্যই নিয়ে যাবে।

ফিহা লক্ষ করলেন খাটের এক পাশে প্রচুর গোলাপ। টকটকে রক্তবর্ণের গোলাপ। ফিহার চোখ আবারো ভিজে উঠছে।

তুমি ছোটবেলায় যে সব খেলনা নিয়ে খেলতে তার কোনোটাই আমরা নষ্ট করিনি। তুমি কি সেগুলি দেখতে চাও?

না।

বৃদ্ধা এবার কথা বললেন। অতি ক্ষীণ স্বরে বললেন, খুব ছোটবেলায় তুমি পিঠে ব্যথা পেয়েছিলে। ছেলেবেলায় ক্ষত চিহ্ন ছিল। এখনো কি আছে?

আছে।

তুমি ছোটবেলায় বার বার ছুটে ছুটে আসতে, আমাকে বলতে, মা আমার ব্যথায় চুমু দিয়ে দাও। তোমার কি মনে আছে?

আছে।

তুমি যদি খুব লজ্জা না পাও তাহলে আমি সেখানে আরেকবার চুমু দিতে চাই।

ফিহা গায়ের কাপড় খুললেন। তাঁর কোনো রকম লজ্জা লাগল না। বরং মনে হল এই তো স্বাভাবিক। বৃদ্ধা গভীর আবেগে চুমু খেলেন। বৃদ্ধার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। ফিহা বললেন, যাই।

আর একটু বস। আমার পাশে বস।

ফিহা বসলেন। বৃদ্ধ বললেন, আমার হাত ধরে বস। পক্ষাঘাত হয়েছে। আমি হাত নাড়াতে পারি না। পারলে আমি তোমার হাত ধরতাম। ফিহা বৃদ্ধের হাত ধরলেন।

বৃদ্ধ বললেন, তুমি সময় সমীকরণের সমাধান করতে যাচ্ছ?

হ্যাঁ।

তুমি চাচ্ছ অতীতে ফিরে যেতে। যাতে আদি মেন্টালিস্ট তৈরির এক্সপেরিমেন্ট কেউ করতে না পারে।

আপনারা মেটালিস্ট। আমি কি ভাবছি তার সবই আপনারা জানেন।

হ্যাঁ জানি। কিন্তু তুমি জান না তোমার চিন্তায় বড় ধরনের ভুল আছে। তুমি যেই মুহূর্তে সমাধান বের করবে সেই মুহূর্তে মেন্টালিস্টরা তা জেনে যাবে। অতীতে তুমি যেতে পারবে না ফিহা, তোমাকে যেতে দেয়া হবে না। তোমার বিদ্যা কাজে লাগিয়ে একটি রোবট পাঠানো হবে। তাকে মেন্টালিস্ট তৈরির বিদ্যা শিখিয়ে দেয়া হবে। এই ভাবেই চক্র সম্পন্ন হবে।

আপনি নিশ্চিত?

হ্যাঁ।

চক্ৰ ভাঙা যাবে না?

তুমি যদি সময় সমীকরণ বের না কর তাহলেই চক্র ভেঙে যাবে। অতীতে কেউ যেতে পারবে না। মেন্টালিস্ট তৈরি হবে না। চক্র সম্পূর্ণ করার জন্যেই তোমাকে দরকার। ধর্মগ্রন্থে তা আছে।

ধর্মগ্রন্থে কি আছে?

ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে—জ্ঞানী শত্রুদের প্রতি মমতা রাখিও কারণ জ্ঞানী শত্ৰুরা জগতের মহৎ কৰ্ম সম্পাদন করে। তোমাদের মহা শত্ৰুর কারণেই তোমরা চক্র সম্পন্ন করবে। সে মিরানের পালক পুত্র। সে জ্ঞানী।

ধর্মগ্রন্থে আমার উল্লেখ আছে বলেই কি মেন্টালিস্টরা আমাকে আলাদা করে দেখে?

হ্যাঁ। তোমার জ্ঞান তাদের প্রয়োজন। তোমার জ্ঞান ছাড়া চক্র সম্পূর্ণ হবে না।

ফিহা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। বৃদ্ধা বললেন, আমরা দুজন সর্বশক্তি দিয়ে তোমার মস্তিষ্ক রক্ষা করে চলেছি। চল্লিশ বছর ধরেই করছি। যে কারণে এখননা কেউ তোমার মস্তিষ্ক থেকে কিছু জানে না। আমরা বেশিদিন বাঁচব না। তখন সবাই জানবে। আমাদের যা বলার তোমাকে বললাম, এখন তুমি তোমার বিবেচনা অনুযায়ী কাজ করবে।

ফিহা বললেন, আমি আপনাদের ভালবাসি।

জানি। ভালবাসার কথা বলার প্রয়োজন হয় না।

বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা দুজনই কাঁদতে লাগলেন।

ফিহা দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, আমি যদি মারা যাই তাহলে চক্র ভেঙে যাবে। কারণ সময় সমীকরণ বের হবে না।

বৃদ্ধ মিরান হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।

ফিহা বললেন, চক্র ভেঙে গেলে মেন্টালিস্ট তৈরি হবে না। মেন্টালিস্টদের বিষয়ে বই লেখা হবে না। মেন্টালিস্টদের যাবতীয় ধর্মগ্রন্থের সমস্ত লেখা মুছে যাবে।

বৃদ্ধ বৃদ্ধা দুজনই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।

আমার যে হঠাৎ আপনাদের কাছে আসার ইচ্ছা হল তার কারণ কি এই যে আপনারা আমাকে ডেকেছেন?

হ্যাঁ। তুমি যেভাবে ভাঙতে চাচ্ছ সেভাবে তা সম্ভব নয়। এই কথাটি তোমাকে জানিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।

আপনারা চান চক্র ভেঙে যাক?

চাই। এই চক্র অন্যায় চক্র।

আপনাদের কাছে কি কোনো বিষ আছে?

হ্যাঁ। আমরা জোগাড় করে রেখেছি। আমরা জানি তুমি চাইবে।

বৃদ্ধা বিষের শিশি বের করে আনলেন। দশ বছর ধরে তাঁরা এই শিশি আগলে রেখেছেন। এখন আর আগলে রাখার প্রয়োজন নেই।

ফিহা বললেন, বিষের ক্রিয়া কতক্ষণ পর শুরু হবে?

ঘণ্টা খানেক লাগবে। ক্রিয়া করবে খুব ধীরে ব্যথা বোধ হবে না। আমরা তোমাকে ব্যথা পেতে দেব না। তুমি তোমার স্ত্রীর কাছে পৌছতে পারবে।

 

ফিহার হাতে একরাশ গোলাপ। বাড়ি ফিরছেন হেঁটে হেঁটে। বিষের ক্রিয়া শুরু হয়েছে। তিনি বুঝতে পারছেন। তাঁর চিন্তা চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। তবু গভীর আনন্দে তাঁর মন পরিপূর্ণ। চক্র ভেঙে যাচ্ছে। ভয়ংকর একটি চক্র ভেঙে যাচ্ছে। ফিহা দ্রুত পা ফেলতে চেষ্টা করছেন। যে করেই হোক নুহাশের কাছে পৌছতে হবে। তার গল্পটির শুরুটা হলেও শুনতে হবে। মনে হয় ভোর হতে বেশি দেরি নেই। চারদিকে আলো হতে শুরু করেছে। ফিহার হাতের ফুলগুলি রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে। তিনি দূরে ঘন্টার ধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন। কোত্থেকে আসছে।

এই ঘন্টাধ্বনি?

রাস্তার মানুষ অবাক হয়ে দেখছে ফুল বিছিয়ে বিছিয়ে একজন মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে। সে পা ফেলছে এলোমেলো ভঙ্গিতে। অন্ধকারে মানুষটিকে চেনা যাচ্ছে না। যারা ফুল ছড়িয়ে এগিয়ে যায় তাদের চেনারও তেমন প্রয়োজন নেই।