একটু থেমে থেকে ঘনাদা বললেন, মানুষকে চিনতে হয় চরিত্র দেখে। চেহারা ঢেকে রাখা যায়, কিন্তু চরিত্র তো আর ঢাকা যায় না।
শুঁটকো ডুগান আর গোরিলা কার্ভালোর মতো আরও অনেকে হন্যে হয়ে যাকে খুঁজছে, সে-মানুষটার চেহারা যতটা তার চেয়ে বেশি আসল চরিত্রটা আমি তখন প্রায় অঙ্ক কষার মতো গণনায় বুঝে ফেলেছি। ফাটকাবাজারে সে রাশি রাশি টাকা উপায় করবার ফন্দি বার করে, কিন্তু সেটা তার আসল নেশা নয়। নানা বড় বড় দেশের শহরের কারবারি জগতের কলকাঠি নেড়ে প্রায় যেমন খুশি পয়সা কামাবার অদ্ভুত ক্ষমতা সত্ত্বেও, একবার কোথাও দাঁও মারবার পর কিছুদিন তার আর পাত্তা পাওয়া যায় না। তখন স্বনামে ছদ্মনামে নানারকম দানধ্যানে টাকা ছড়াতে ছড়াতে সে দুঃসাহসিক দুঃসাধ্য কিছু সাধন করবার জন্য দেশ-দেশান্তরে ঘোরে।
ডুগান আর কার্ভালোকে বললুম, তোমাদের কাছে তার চেহারার যা বর্ণনা পেয়েছিলাম শুধু তাই দিয়ে তাকে চিনে খুঁজে বার করা যে যাবে না, তা আমি জানতাম। তোমরা যে চেহারার বর্ণনা দিয়েছিলে তা হল সোনালি চুল, নীল চোখ আর একেবারে ধপধপে ফরসা নর্ডিক অর্থাৎ নরওয়ে সুইডেনের খাস বাসিন্দাদের। কিন্তু সে চেহারা তো খুশি মতো বদলানো যায়! অন্য সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু সোনালি চুলগুলো লালচে, গায়ের রঙ ঠিক মতো আরক লাগিয়ে তামাটে, আর চোখের নীল তারাগুলোও কনট্যাক্ট লেন্সের সাহায্যে অনায়াসে ব্রাউন, এমনকী কালোও করা যায়। সুতরাং আমি চেহারা দিয়ে নয়, চরিত্র দিয়েই সেই ধুরন্ধরকে খুঁজে বার করতে চেষ্টা করেছি।
কিন্তু সেটাও কি সোজা কাজ? লকনেসের জলচর দানবের খবর চালু হওয়ার পর থেকে দেশ-বিদেশের সন্ধানীরা দলে দলে ছুটে এসেছে এই অঞ্চলে। স্কটল্যান্ডের উত্তরের নির্জন একটা পাহাড়ি শহর আর তার আশপাশের অঞ্চলে গিজগিজ করছে সত্যিকার সন্ধানীদের সঙ্গে হুজুগে মেতে আসা টহলদারের দল।
স্কটল্যান্ডের লোকেদের একটু বেশি হিসেবি আর কৃপণ বলে খ্যাতি আছে। ব্যবসাটা তারা ভালই বোঝে। তাই লকনেসের রহস্য নিয়ে হুজুগটা তারা ভাল করেই কাজে লাগিয়েছে। ছোট শহরের সরু সরু নুড়ি বসানো রাস্তায় সাধারণ দোতলা একতলা সব সেকেলে প্যাটার্নের বাড়ি। যাত্রীদের ভিড়ে সেইসব বাড়ির এক-একটা ঘরের জন্য বড় বড় শহরের চার-পাঁচতারা হোটেলের কামরার ভাড়া তারা আদায় করছে। হোটেল-রেস্তোরাঁ দু-চারটে নতুন হয়েছে, কিন্তু তাতে সব সময়ে জমজমাট ভিড়, ভিড় রাস্তায় ঘাটে আর দোকানে-দোকানে তো বটেই, লকনেসের লম্বা পাড় ধরে কিছু দূর অন্তর পাতা সব তাঁবুতেও। ইউরোপ আমেরিকার উত্তর-দক্ষিণ
পূর্ব-পশ্চিমের তো বটেই, আফ্রিকা-এশিয়ার লোকেরও একেবারে অভাব নেই।
এর মধ্যে আমার সেই লোকটিকে খুঁজে বার করব কোন ফুসমন্তরে?
ফুসমন্তরে নয়, একটু সজাগ চোখে আর ভাগ্যের একটু দয়া থাকলে সে অসাধ্যসাধনও হয়ে যায়। আমার বেলাতেও হল।
ইনভারনেসে পৌঁছে কদিন থাকবার জন্যে গলাকাটা ভাড়ার একটি পুরনো সেকেলে বাড়ির দোতলার একটা ঘরে থাকবার ব্যবস্থা করেছিলাম। বাড়িটি একটি বয়স্কা স্কট মহিলার। বাড়িটি ভাড়া দেওয়া ছাড়া ইনভারনেসে তিনি শৌখিন জিনিসপত্রের একটি জমজমাট মনিহারি দোকানও চালান তাঁর অন্য একটি বাড়িতে। ভদ্রমহিলার নাম মিসেস টড। ইনভারনেসেই তাদের বাড়ি। স্বামীর মৃত্যুর পর বছর পনেরো আগে সেখানকার ঘর-বাড়ি-সম্পত্তির একরকম ব্যবস্থা করে তিনি এডিনবরায় শেষ ক-টা বছর কাটাবার জন্য চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারই মধ্যে এই লকনেসের জলচর দানবের রহস্য জমাট বেঁধে উঠতে উঠতে ইনভারনেস শহরের ভাগ্যের চাকাই দিলে ঘুরিয়ে। খুঁটেকুড়ুনির হঠাৎ রাজরানি হওয়ার উপমা দিয়েও ভাগ্যের এ পরিবর্তন বুঝি বোঝানো যায় না। লকনেসের অজানা আদিম জলচর দানবের রহস্যভেদের হুজুগে দেশবিদেশের সব ধনকুবেররা খোলামকুচির মতো ডলার, পাউন্ড, মার্ক আর ফ্রাঁ ছড়াতে লাগল ইনভারনেসের রাস্তায় ঘাটে হাটে বাজারে। এমনিতে সবকিছু দরকারি জিনিস আসলের চেয়ে পাঁচগুণ দামে বিক্রি তো হয়ই, তার ওপর লকনেসের রহস্য-দানবের সঙ্গে একটু সংস্রব থাকলে তো কথাই নেই। সাচ্চা-ঝুটা আসল-নকল লকনেসের নেসি রহস্যের সঙ্গে জড়ানো কোনও কিছু বাজারে দেখা দিতে না দিতেই লুট হয়ে যায় হুজুগে-মাতা খরিদ্দারদের হাতে। কোনও কারণ না থাকলেও ব্যবসাদারেরা সবকিছুতে নেসির একটু ছোঁয়া লাগিয়ে দিয়েই বাজিমাত করে। ইনভারনেসের ট্রেনে আসতে আসতেই চায়ের ট্রে, টি-পট, কাপ-ডিশ, কেক-বিস্কুট-টোস্ট, সবকিছুতেই নেসি নামে চালু অজানা প্লিসিওসোরাসের একটু ছাপ রাখবার চেষ্টা দেখা যায়। ইনভারনেসের দোকানে দোকানে নেসির ছাপমারা জিনিসপত্র তো বিক্রি হয়ই, সেইসঙ্গে নেসির বিষয়ে আসল-নকল ছবি, সত্য-মিথ্যা কাল্পনিক বিবরণের বই, নেসিকে শিকারের সরঞ্জাম ও উপায় ইত্যাদি নিয়ে বই রাশি রাশি বিক্রি হয়।
মিসেস টড এই নতুন হুজুগের ঠিক জোয়ারের মুখে ইনভারনেসে ফিরে এসে নিজের সেকেলে বাড়ির ঘরটর একেলে বড় হোটেলের ভাড়ায় বিলি তো করেই দেন, সেই সঙ্গে তাঁর একটি বাড়ির নীচের তলার হলঘরে নেসি মিউজিয়াম নাম দিয়ে একটি দোকানও খুলেছেন এই অজানা জলার দানব সম্বন্ধে যা-কিছু বেচাকেনার জন্য। হ্যাঁ, প্রত্যক্ষদর্শীর নেসি সম্বন্ধে বিবরণ, তাদের ফ্ল্যাশ ক্যামেরায় তোলা নির্ভেজাল বলে দাবি করা নেসির যথার্থ ছবির প্যাকেট তো বটেই, নেসি সম্বন্ধে আরও যা-কিছু সম্ভব সবকিছু সেখানে যেমন পাওয়া যায়, তেমনই বিক্রিও করা যায় মিসেস টডের কাছে।
মিসেস টডের স্বামী এককালে ভারতবর্ষে চাকরি করতে গিয়েছিলেন। মিসেস টডও তখন ছিলেন তাঁর সঙ্গে। ভারতবর্ষে যে কবছর ছিলেন, তাতে মিসেস টডের মনে ভারতীয় সাধু-সন্ন্যাসী, জ্যোতিষীদের মতো মানুষদের সম্বন্ধে একটা গভীর কৌতূহল আর সম্ভ্রমের ভাব গড়ে উঠেছিল। দেশে ফিরে আসবার পরেও সে ভাবটা তাঁর মন থেকে দূর হয়ে যায়নি। আমি তাঁর বাড়ির একটা কামরা ভাড়া নেওয়ার সময় ভারতীয় বলে জেনে আমায় কটি বিশেষ সুযোগসুবিধে তো দিয়েছিলেনই, ভারতীয় যোগবিদ্যা আর জ্যোতিষ ইত্যাদি সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ আর অনুরাগের কথাও প্রকাশ না করে পারেননি। মিসেস টডের মনের ভাবটা জানা ছিল বলে দিন দুই ইনভারনেসে থাকার পরেই আমি তাঁর কাছে আমার প্রস্তাবটা জানাই। আর কিছু নয়, প্রস্তাবটা শুধু এই যে, তাঁর দোকানে অন্য অনেক কিছু যেমন বিক্রির জন্য রাখা আছে, তেমনই নেসি সম্বন্ধে আমার বিশেষ রহস্য-সংকেতও আমি রাখতে চাই। আমার সে জিনিসটি রাখবার জন্য আমি অবশ্য তিনি যত চান সেই দৈনিক ভাড়াই দেব। কিনতে চাওয়া খরিদ্দারদের জন্য আমার দেওয়া রহস্য-সংকেতের একটা দাম ঠিক করা থাকবে। কোনও খরিদ্দার সেই দাম দিয়ে সংকেতটি কিনলে মিসেস টড তাঁর প্রাপ্য দোকানভাড়া তা থেকে কেটে নিয়ে বাকিটা আমায় দেবেন, এই হল আমাদের মধ্যে চুক্তি। আমার রহস্য সংকেত বিক্রি না-ও হতে পারে বলে আমি হপ্তাখানেক তা দোকানে রাখবার ভাড়া মিসেস টডকে অগ্রিম দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি তা নেননি।
আশ্চর্যের কথা এই যে, আমার রাখা তিন-তিনটি রহস্য-সংকেত দোকানে রাখবার পর দু-দিনের মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। যে তিনজন আমার দিয়ে রাখা-সংকেত প্রায় আকাশছোঁয়া চড়া দামে কিনে নিয়ে যায়, তাদের তিনজনকেই আমি মিসেস টডের অনুগ্রহে দোকানের মধ্যে অন্য জায়গা থেকে লক্ষ করবার সুযোগ পাই, এবং আমার ধারণা, অত্যন্ত নিপুণভাবে ছদ্ম চেহারায় সেজে এলেও তাদের মধ্যে আসল ধুরন্ধরকে চিনতে আমার ভুল হয়নি।
আমার রহস্য-সংকেত যারা কিনেছে, আর একদিন বাদে সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তাদের এক-একজনের আমার সঙ্গে একটি বিশেষ ঠিকানায় দেখা করবার কথা। ওই বিশেষ দেখা করবার ঠিকানাটা মিসেস টডের অনুগ্রহে পাওয়া গেছে। রহস্য-সংকেত আর যা ছিল, তা শুধু একটি সংস্কৃত শ্লোকের অংশ। আর তার চারপাশে জ্যোতিষের কয়েকটা চিহ্নের সঙ্গে একটা জিজ্ঞাসা। যেমন,
নেসির রহস্যভেদ করতে শুনুন:
প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসিবেদং
বিহিতবহিত্ৰচরিত্রমখেদম্…
গীতগোবিন্দর সংস্কৃত শ্লোকটার কিছুটা আবৃত্তি করবার পর শুঁটকো ডুগান আর গোরিলা কার্ভালোকে বললাম, তোমাদের হয়ে যাকে খুঁজছিলাম, সেই ধুরন্ধরকে আমার এই নতুন প্যাঁচে ছাড়া ন-মাসে ছ মাসেও খুঁজে পেতাম কি না সন্দেহ। কিন্তু আমার এই ফন্দিতে আমার বদলে সে-ই যাতে আমায় খোঁজে তার ব্যবস্থা করে কাজটা অনেক সহজ করে ফেলেছি। রাত প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। ইনভারনেসে পৌঁছতে আমাদের ঘণ্টা-দেড়েকের বেশি দেরি নেই। সেখানে পৌঁছে আমার বাসাতেই তোমাদের নিয়ে যাব, তারপর তৈরি হয়ে এক এক করে আমাদের তিন মক্কেলের সঙ্গে–
ব্যস, ওই পর্যন্ত বলার পর একেবারে বেহুশ হয়ে ট্রেনের কামরার সিটের ওপরেই লুটিয়ে পড়লাম।
শুঁটকো ডুগান আর গোরিলা কার্ভালো এরপর যা করল এবার তা-ই বলি।
আমি কামরায় আসনের ওপর হাত-পা এলিয়ে পড়ে যাবার পরেই ডুগান আর কার্ভালো দুজনে চটপট উঠে দাঁড়িয়েছিল।
আমার দিকে চেয়ে কার্ভালো তার মুঠো করে ঘুসিটা আমার মাথার কাছে একটু নেড়ে বললে, দেব আর একটা ঘা?
না, তার দরকার হবে না মনে হচ্ছে, বলল শুঁটকো ডুগান, একটা মোক্ষম ঘায়েই যা ঘায়েল হয়েছে, দটোয় একেবারে কাবার না হয়ে যায়। এমনিতেই কাজ হাসিল হলে সে-সব হাঙ্গামায় যাওয়ার দরকার কী? এখন চটপট হাত-পাগুলো বেঁধে মুখে রুমাল গুঁজে দাও দিকি। পকেটগুলো হাতড়ে যা পাও তা আগে বার করে নিতে অবশ্য ভুলো না।
ডুগানের নির্দেশমতো কার্ভালোর কাজ সারবার মধ্যে ট্রেনটা একটা স্টেশনে একটু থামে।
তখন প্রায় শেষ রাত। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মটা আলোয় ঝলমল করলেও একেবারে নির্জন।
স্টেশনে থামবার আগে গাড়িটার গতিবেগ একটু কমতে দেখেই বুদ্ধিটা শুঁটকো ডুগানের মাথায় আসে নিশ্চয়। তাদের গাড়িটা থামবার সঙ্গে সঙ্গেই বাইরের দরজাটা খুলে ফেলে সে বলে, শিগগির ওর হাত-পা বাঁধা, মুখে রুমাল-গোঁজা পোঁটলাটা দাও এই প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে।
গোরিলা কার্ভালো তাই যখন করতে যাচ্ছে, তখন শুঁটকো ডুগানের মাথায় আরও ভাল একটা বুদ্ধি আসে। আলোয় ঝলমল অথচ একেবারে নির্জন প্ল্যাটফর্মের অন্য দিকে একটা মালগাড়ি দাঁড়িয়ে। এ-প্ল্যাটফর্মের দিকে আসার পথেই ওদিকের মালগাড়ির ইঞ্জিনটা দেখা গেল বলেই, সেটা যে উলটো মুখে যাচ্ছে তা বোঝা গেছল নিশ্চয়। ডুগান তাই আবার মতটা পালটে ব্যস্ত হয়ে হুকুম দিলে, না, প্ল্যাটফর্মে নয়। ওধারের মালগাড়িটার প্রায় সব কোচগুলোই খালি মনে হচ্ছে। ওর একটায় ওটাকে ফেলে এসো।
কার্ভালোর এই হুকুম তামিল করতে দেরি হল না। প্ল্যাটফর্মের ওদিক থেকে কাজ সেরে আসতে আসতেই তাদের গাড়িটা ছেড়ে দিলেও, ছুটে এসে নিজেদের কামরায় উঠতে তার অসুবিধে হল না। শাবাশ! বলে তাকে তারিফ জানিয়ে ডুগান বললে, যাক, এখন হপ্তাখানেকের জন্য অন্তত নিশ্চিন্ত থাকব বলতে পারি। দু-চার ঘণ্টা বাদে জ্ঞান যদি হয়ও, কোথায় গিয়ে যে হতভাগা জাগবে তার কোনও ঠিক নেই।