মহাকাশযানটির কন্ট্রোল প্যানেলে বসে টুকি খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেটি পরীক্ষা করছে। কাছাকাছি মেঝেতে পা ছড়িয়ে খেতে বসেছে ঝা—যন্ত্রপাতিতে তার কোন উৎসাহ নেই। আরো খানিকটা দূরে রোবি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, টুকি খানিকক্ষণ কিছু একটা লক্ষ্য করে অধৈর্য হয়ে হাত নেড়ে বলল, এর মাথামুও কিছু বুঝতে পারছি না।
রোবি বলল, এটি কোন জীবিত জিনিস নয়—এর মাথামুণ্ডু নেই কাজেই এটা বুঝতে পারছ না।
টুকি চোখ পাকিয়ে রোবির দিকে তাকিয়ে বলল, দূর হও হতভাগা।
রোবি দূর হওয়ার কোন চিহ্ন দেখাল না বরং আরো এক পা এগিয়ে এসে বলল, মানুষ যখন নির্বোধের মত কাজ করে তখন আমার দেখতে বড় ভাল লাগে।
আমি কোন জিনিসটা নির্বোধের মত করছি?
এই যে মহাকাশযান চালানোর কোন কিছু না জেনে আপনি এটা চালানোর চেষ্টা করছেন! ভুল জায়গায় টেপাটেপি করছেন।
টুকি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রোবির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি মহাকাশযান চালানো জান?
জানি। এটাকে কেমন করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেওয়া যায় তুমি জান? অবশ্যি জানি।
তাহলে ব্যাটা বদমাইশ আমি এতদিন থেকে এটাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি, আমাকে একবার সাহায্য করতে এলে না কেন?
আমাকে বলেন নাই, তাই আসি নাই।
টুকি খানিকক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রোবির দিকে তাকিয়ে থেকে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ঠিক আছে। এখন আমি বলছি, আমাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাও।
রোবি কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ কিছু যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে বলল, এখান থেকে পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার দুটি উপায় আছে। একটা বড় হাইপার ডাইভ কিংবা দুটি ছোট হাইপার ডাইভ। বড় হাইপার ডাইভ দেয়ার সমস্যা একটিই–মহাকাশানে যথেষ্ট জালানী নেই। ছোট দুটি হাইপার ডাইভ দেওয়া যেতে পারে তবে সেটারও একটা সমস্যা আছে।
কী সমস্যা?
প্রথমে মহাকাশযানের বেগ বড়াতে হবে, সেজন্যে কাছাছি একটা বড় গ্রহ বা নক্ষত্র দরকার। কাছাকাছি সেরকম কিছু নেই। মহাকাশযানের ট্র্যাজেক্টরীও পাল্টাতে পারব না, জ্বালানী নষ্ট হবে। যদি এভাবে যেতে থাকি চার সপ্তাহের মাঝে একটা মাঝারী গোছের নক্ষত্র পাওয়া যাবে, সেটাকে ব্যবহার করে হাইপার ডাইভ দেওয়া যাবে।
টুকি অধৈর্য হয়ে বলল, কিন্তু সমস্যাটা কী?
ঐ যে বললাম, চার সপ্তাহ যেতে হবে। আপনারা যেভাবে তিনবেলা খাচ্ছেন খাবার কম পড়ে যাবে।
ঝা চোখ লাল করে বলল, সেটাই সমস্যা?
সেটাই মূল সমস্যা। আরো কিছু ছোট সমস্যা আছে। মহাকাশযানটা যে পথ দিয়ে যাবে সেখানে আশেপাশে বেশ কিছু গ্রহ উপগ্রহ আছে, সেখানে মানুষ। আর রবোটের বসতি। তারা সেরকম বন্ধুভাবাপন্ন নয়।
ঝা মেঝেতে বসে বড় একটা গলদা চিংড়ি চিবুতে চিবুতে বলল, তাতে সমস্যাটা কী? আমরা কী আর আত্মীয়তা করতে যাচ্ছি?
রোবি তার যন্ত্রপাতির দিকে ঝুকে পড়ে বলল, এ ছাড়াও আরো একটি সমস্যা আছে। হাইপার ডাইভ দেওয়ার পর মাঝে মাঝে সময় নিয়ে গোলমাল হয়।
টুকি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, কী গোলমাল?
যেমন মনে করেন আজকে রওনা দিয়ে গতকাল পৌঁছে যাওয়া।
ঝা হা হা করে হেসে বলল, এটা গোলামাল হবে কেন? এটা তো ভাল, জীবনে খানিকটা সময় বাড়তি পেয়ে যাওয়া যাবে।
ঝা যত সহজে ব্যাপারটা মেনে নিল আসলেই এটা এত সহজে মেনে নেয়া উচিত কী না সেটা নিয়ে টুকির একটু সন্দেহ হয়। কিন্তু এখন সেটা নিয়ে তার আর মাথা ঘামানোর ইচ্ছে করছিল না। একটু অধৈর্য হয়ে বলল, রোবি, বকবক বন্ধ করে এখন তাহলে চল পৃথিবীর দিকে।
ব্যাপারটা যত সহজ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল সেটা যে এত সহজ নয়। সেটা টের পেল দুদিন পরেই। সবুজ রংয়ের মাঝারী একটা গ্রহের পাশে দিয়ে যাবার সময়, কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ করে একটা স্কাউটশীপ এসে টুকি, ঝা আর রোবিকে ধরে নিয়ে গেল।
যারা তাদের ধরে নিয়ে গেল তারা সবাই রবোট। যাদের কাছে ধরে নিয়ে গেল তারাও রবোট এবং তারা যাদের কাছে তাদের ধরে নিয়ে গেল তারাও রবোট। টুকি একজনকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের এখানে কোন মানুষ নেই?
যাকে জিজ্ঞেস করল সে কালচে রংয়ের বিদঘুটে একটি যন্ত্র, মুখ দিয়ে ফোৎ করে একটা শব্দ করে বলল, মানুষ? ছিঃ!
তাহলে আমাদের ধরে এনেছ কেন?
ধরে এনেছি? হাহ্।
এখানে কে আছে? কার সাথে কথা বলা যাবে?
কথা?
হুঁ!।
টুকি বুঝতে পারল এই নিম্নশ্রেনীর রবোটটির সাথে কথা বলার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই। বিভিন্ন রবোটের মাঝে হাত বদল হয়ে যখন শেষ পর্যন্ত তারা মোটামুটি নেতা গোছের একটা চালাক চতুর রবোটের সামনে হাজির হল তখন টুকি জিজ্ঞেস করল, তোমরা আমাদের ধরে এনেছ কেন? রবোটটি তার সবুজ চোখ দুটিকে হালকা লাল রংয়ে পাল্টে দিয়ে বলল, তোমাদের কাপাট্রনের কন্ট্রোলার আই.সি.টা দরকার।
টুকি ভুরু কুচকে বলল, কী বললে? কন্ট্রোলার আই. সি.?
হ্যাঁ! তোমাদের মত রেপ্লিকা রবোট আমাদের খুব কম। যদি কপোট্রন থেকে–
ঝ চোখ কপালে তুলে বলল, রেপ্লিকা রবোট? আমরা মোটেও রেপ্লিকা রবোট না।
তাই নাকি? তোমরা কি তাহলে ড়ুপ্লিকা?
না আমরা রেপ্লিকা ড়ুপ্লিকা কোনটাই না। আমরা মানুষ।
মানুষ! রবোটটা একটা আর্ত চিৎকার করে দুই পা পিছিয়ে গেল। ক্লিক ক্লিক করে কয়েটা শব্দ হল, চারপাশে ঘিরে থাকা রবোটেরা হাতে অস্ত্র ধরে তাদের দিকে তাক করে ধরল। গবেট ধরনের একটা রবোট জিজ্ঞেস করল, গুলি করে দেব নাকি?
নেতা গোছের রবোর্টটা বলল, আগেই করো না, তবে গুলির রেঞ্জের মাঝে রাখ।
বেঁটে খাটো একটা রবোট ভাঙা গলায় বলল, সর্বনাশ! মোটা মানুষটা আমার দিকে তাকাচ্ছে। বিপদ হবে না তো আমার?
হতে পারে। চোখে চোখে তাকিও না। তোমার সর্বনাশ করে দেবে। ওদের সব বদমাইশী চোখের মাঝে।
টুকি এবং ঝা মোটামুটি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কোনমতে নিজেদেরকে সামলে নিয়ে বলল, তোমরা আমাদের এত ভয় পাচ্ছ কেন?
ভয় পাব না? কী বল তুমি? মানুষ হচ্ছে এই সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে খল, ফন্দিবাজ, ধূর্ত, অসৎ, বদমাইশ এবং ধুরন্ধর। তারা ইচ্ছা করলে দিনকে রাত করে দিতে পারে রাতকে দিন করে দিতে পারে। গ্রহকে নক্ষত্র করে দিতে পারে নক্ষত্রকে গ্রহ করে দিতে পারে। মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। আমরা রবোটরা মানুষ থেকে দশ লাইট ইয়ার দূরে থাকি।
আমাদেরকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ঝা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমরা অত্যন্ত সাধারণ মানুষ।
সাধারণ মানুষ বলে কোন কথা নেই। আগুন যেরকম ঠাণ্ডা হয় না মানুষ সেরকম সাধারণ হয় না। মানুষ মানেই অসাধারণ
না। ঝা জোরে জোরে মাথা নাড়ল, মানুষের মাঝে দুষ্টু মানুষ আছে কিন্তু আমরা সেরকম মানুষ নই। আমরা কারো ক্ষতি করি না।
রবোটদের নেতাটি উঁচু গলায় অন্য রববাটদের বলল, বলেছিলাম না, মানুষেরা খুব যুক্তি দিয়ে অযৌক্তিক কথা বলে? এই দেখ। খবরদার কেউ এদের সাথে কথা বলো না।
টুকি একটু এগিয়ে এসে বলল, আমরা মোটেও অযৌক্তিক কোন কথা বলছি না। কিন্তু যদি তোমরা আমাদের সাথে কথা বলতে না চাও তাহলে আমাদের যেতে দাও। আমরা যাই।
গবেট ধরনের রবোটটা আবার বলল, গুলি করে দেব না কী?
না। আগেই করো না, গুলি করলে মরে যাবে। মানুষের মত অপদার্থ প্রাণী খুব কম রয়েছে ছোট একটা গুলি খেলেই মরে যায়।
মরে গেলে আবার সার্ভিসিং করে নেব।
মানুষ মরে গেলে সার্ভিসিং করা যায় না।
কোন কোম্পানি এদের তৈরি করে? কত দিনের ওয়ারেন্টি দেয়?
কোন কোম্পানি এদেরকে তৈরি করে না। এদের কোন ওয়ারেন্টি নেই।
গবেট ধরনের রবোটটা বলল, তাহলে গুলি করে দেই।
না। নেতা গোছের রবোটটা বলল, এদেরকে না মেরে সাবধানে এদের মস্তিষ্ক কেটে আলাদা করে নিতে হবে। তখন আর কোন ভয় থাকবে না, কিন্তু সব রকম বুদ্ধি নেওয়া যাবে। তখন এরা আমাদের সাহায্য করবে।
উপস্থিত সবগুলো রবোট মাথা নেড়ে বলল, চমৎকার বুদ্ধি! চমকার বুদ্ধি!!
টুকি এবং ঝা শুকনো গলায় বলল, তোমরা কী বলছ এই সব? মস্তিষ্ক কেটে নেবে মানে?
আমাদের অস্ত্রোপচারকারী রবোট আছে, নিখুঁতভাবে মস্তিষ্ক কেটে নিতে পারে।
নিলেই হল? তোমার ধারণা আমার মাস্তিষ্ক কেটে নিলে আমি কোনদিন তোমাদের সাহায্য করব?
করবে না?
করব না।
ঝা-ও জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, কক্ষণাে করব না।
টুকি চোখ মুখ লাল করে বলল, শুধু যে সাহায্য করব না তাই নয়, সাহায্য চাইলে এমন উল্টা পাল্টা বুদ্ধি দেব যে তোমরা বুঝতেই পারবে না, সেটা কাজে লাগাতে গিয়ে সর্বনাশ হয়ে যাবে তোমাদের।
গবেট ধরনের রবোট বলল, দেই গুলি করে শেষ করে।
টুকি বলল,তার চাইতে এসো মিলে মিশে থাকি। তোমাদের কী বিষয় সাহায্যের দরকার বল আমরা সাহায্য করি। যদি দেখ আমাদের সাহায্যে কাজ হচ্ছে না তখন না হয় যা ইচ্ছে হয় কর।
সত্যি বলছ? একেবারে একশ ভাগ সত্যি। এন্ড্রোমিডার কসম।
রবোটের নেতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোমার প্রস্তাবটা বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। সেটা আমাদের সব বুদ্ধিজীবী রবোটদের সাথে আলোচনা করে দেখতে হবে।
গবেট ধরনের রবোর্টটা আবার গলা উঁচিয়ে বলল, এত সব ঝামেলা না করে দেই গুলি দিয়ে শেষ করে।
রবোটের নেতা যখন বুদ্ধিজীবী রবোটদের সাথে আলোচনা করছিল তখন টুকি এবং ঝা বসে বসে ঈশ্বরকে স্মরণ করতে থাকে। চুরি করতে যাওয়ার আগে যেসব বিশেষ বিশেষ প্রার্থনা করত বসে বসে সেগুলো আওড়াতে থাকে। রোবি কাছে এসে বলল, আপনারা কী ভয় পাচ্ছেন? ব্লাডার কন্ট্রোল–
টুকি খেকিয়ে উঠে বলল, চুপ কর ব্যাটা গবেট, রবোটের বাচ্চা রবোট।
কী মনে হয় আপনাদের? মানুষ কী আসলেই খল, ফন্দিবাজ, ধূর্ত, অসৎ, বদমাইশ এবং ধুরন্ধর? আপনাদের কাজকর্ম দেখে মনে হয় সত্যি হতেও পারে ব্যাপারটা। কী বলেন?
ঝা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, বাজে কথা বললে এক ঘুষিতে কপোট্রন তুষ করে দেব।
রোবি তার গলায় মধু ঢেলে বলল, মনে হয় আপনারা একই সাথে ভয় পাচ্ছেন এবং রাগ হচ্ছেন। কী বিচিত্র একটা ব্যাপার। শুধু মাত্র মানুষের পক্ষেই। এটা সম্ভব। রাগ এবং ভয়। কী চমৎকার!
ঠিক এরকম সময়ে রবোটের নেতা বুদ্ধিজীবী রবোটদের নিয়ে হাজির হল বলে রোবির সাথে টুকি এবং ঝায়ের কথাবার্তা আর বেশিদূর এগুতে পারল না। বুদ্ধিজীবী রবোটদের দেখেই বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে তারা বুদ্ধিজীবী, তাদের লিকলিকে হাত পা এবং শরীরের তুলনায় বিশাল একটি মাথা। তাদের শরীরের ভারসাম্য ঠিক নয় এবং প্রত্যেকবার পা ফেলার সাথে সাথে মনে হতে থাকে তাল হারিয়ে নিচে আছাড় খেয়ে পড়বে—খুব সাবধানে তারা নিজেদের রক্ষা করে টুকি এবং ঝায়ের কাছে এগিয়ে আসে। যে বুদ্ধিজীবী রবোটের মাথা সবচেয়ে বড় সে বুদ্ধিজীবী সুলভ নাকী গলায় বলল, আপনারা আমাদের সাহায্য করতে রাজী হয়েছেন শুনে আমরা রবোটরা বিশেষ পুলকিত হয়েছি–
ঝা ফিসফিস করে বলল, পুলকিত মানে কী?
টুকি বলল, খুশী হওয়া।
বুদ্ধিজীবী রবোটটা বলল, আমরা সাধারণত মনুষ্য থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে থাকতে পছন্দ করি। তবে ঘটনাক্রমে যেহেতু আপনারা আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছেন, আমাদের কিছু করার নেই। আপনাদের দেহ ব্যবচ্ছেদ করে মস্তিষ্ক উৎপাটন না করে যদি কোন কাজ করা যায় সেটা সম্ভবত গ্রহণযোগ্য। যে ব্যাপারে আমরা আপনাদের সাহায্য কামনা করি সেটি অত্যন্ত গোপনীয়।
টুকি মাথা নেড়ে বলল, আমরা আপনাদের গোপনীয়তা রক্ষা করব।
আপনাদের নিয়ে আমি দুশ্চিন্তিত নই। আমাদের নিজেদের যে অশিক্ষিত অর্বাচীন মূখ রবোর্ট রয়েছে তাদের নিয়েই আমি চিন্তিত–
ঝা আবার ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, অর্বাচীন মানে কী?
কোন একটা গালি গালাজ হতে পারে।
বুদ্ধিজীবী রবোট আবার নাকী সুরে বলল, আপনারা আমাদের সঙ্গে আসুন, ব্যাপারটি বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
গবোট ধরনের রবোটটা ফোৎ করে একটা শব্দ করে বলল, তখনই বলেছিলাম গুলি করে শেষ করে দেই—
বুদ্ধিজীবী রবোটগুলো টুকি এবং ঝাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে, মাথাটি বাড়াবাড়ি রকম বড় হওয়ায় রবোটগুলোর তাল সামলাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল এবং মনে হচ্ছিল যে কোন মূহূর্তে বুঝি উল্টে পড়ে যাবে। সবচেয়ে বড় মাথা যে রবোটটির সে তার নাকী গলায় বলল, সবার জীবনে একটা উদ্দেশ্য থাকতে হয়। উদ্দেশ্যবিহীন জীবন জ্বালানীবিহীন রকেটের মতন।
ঝা মাথা নাড়ল, বলল, কিংবা খাবারহীন ডাইনিং টেবিলের মত।
রবোটটি ঝায়ের কথা শুনতে পেল বলে মনে হল না, রবোটদের খেতে হয় বলে মনে হয় কথার গুরুত্বটাও ধরতে পারল না। সে বলে চলল, আমাদের। জীবনেরও একটা মূল উদ্দেশ্য আছে। সেই উদ্দেশ্য হচ্ছে মানব জাতিকে ধ্বংস করা।
টুকি এবং ঝা একসাথে চমকে উঠল, কী বললে?।
হ্যাঁ, মানব জাতিকে ধ্বংস করা। মানুষ মাত্রই হচ্ছে খল, ফন্দিবাজ, ধূৰ্ত্ত, অসৎ, বদমাইশ এবং ধুরন্ধর। এরা সমস্ত বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডে জীবাণুর মত ছড়িয়ে পড়ছে। সমস্ত সৃষ্টিজগৎকে কলুষিত করে দিচ্ছে। এদেরকে যদি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া যায় এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে সত্যিকারের শান্তি নেমে আসবে।
টুকি ঢোক গিলে বলল, তোমরা কীভাবে সেটা করবে?
আমরা সেটা এর মাঝে শুরু করেছি। শত্রুকে ধ্বংস করার প্রথম পর্যায় হচ্ছে তাদেরকে বোঝা। আমরা মানুষকে বোঝার কাজ শুরু করেছি।
কীভাবে সেটা করছ?।
রাগ, দুঃখ, আনন্দ, ঘৃণা, ভালবাসা এই ধরনের কিছু ব্যাপার আছে মানুষের। তারা সেগুলোর নাম দিয়েছে অনুভূতি। আমাদের সেগুলো নেই।
সেটাই হচ্ছে আমাদের মূল সমস্যা।
ঝ একটু ইতস্তত করে বলল, দেখ, তোমাদের একটা কথা বলি–একেবারে একশভাগ সত্যি, এড্রোমিডার কসম!
কী কথা?
তোমাদের যে অনুভূতি নেই সেটা আসলে সমস্যা নয়, সেটা হচ্ছে তোমাদের উপর আশীর্বাদ। এই ঝামেলা যাদের আছে তাদের জীবন একেবারে ফানা ফানা হয়ে যাচ্ছে।
হতে পারে। কিন্তু তবুও মানুষ নামের এই খল, ফন্দিবাজ, ধূর্ত, অসৎ বদমাইশ এবং ধুরন্ধর শত্রুকে বুঝতে হলে আমাদের এই অনুভূতির সাথে পরিচিত হতে হবে। সেই জন্যে আমরা অনেক দিন থেকে কাজ করছি, আমাদের বেশ খানিকটা সাফল্যও এসেছে।
টুকি ভয়ে ভয়ে মাথা বড় রবোটটির দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে তোমরা আজকাল রেগে যাও? দুঃখ আনন্দ এই সব পাও?
ইচ্ছা করলে পেতে পারি। আমরা সেটা আবিষ্কার করেছি। হার্ডওয়ার সফটওয়ার তৈরি হয়ে গেছে, এখন কপোট্রনে বসিয়ে দেওয়ার জন্যে ছোট চীপ তৈরি হচ্ছে।
কথা বলতে বলতে বুদ্ধিজীবী রবোটটা একটা বন্ধ ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরের উপরে লেখা দুঃখ ল্যাবরেটরি।
টুকি এবং ঝা একটু অবাক হয়ে বুদ্ধিজীবী রবোটটার দিকে তাকাতেই রবোর্টটা বলল, এই ল্যাবরেটরিতে আমরা রবোটদের দুঃখ দেওয়া নিয়ে গবেষণা করি।
ঝা মাথা নেড়ে বিড় বিড় করে বলল, মাথা খারাপ আর কাকে বলে। দুঃখ দেওয়ার গবেষণা!
টুকি জিজ্ঞেস করল, কতদূর হয়েছে গবেষণা?
আসুন, আপনাদের দেখাই।
রবোটটা কোথায় চেপে ধরতেই একটা স্বচ্ছ জানালা খুলে গেল এবং দেখা গেল ভিতরে ছোট একটা জানালার পাশে একটা শুকনো ধরনের রবোট বসে আছে। তার হাতে একটা বই। রবোটটি খুব মনোযোগ দিয়ে বইটি পড়ছে। বুদ্ধিজীবী রবোট বলল, এইটা খুব দুঃখের একটা বই। একটা রবোটের কপোট্রনের পাওয়ার সাপ্লাইয়ে কীভাবে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল সেই কাহিনী। লেখা আছে। এই বইটা পড়ে এই রবোটটা দুঃখ পায় কী না দেখা হচ্ছে।
বুদ্ধিজীবী রবোটের কথা শেষ হবার আগেই জানালার পাশে বসে থাকা শুকনো ধরনের রবোটটা হঠাৎ বই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মেঝেতে মাথা কুটে হাউ মাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করল। টুকি এবং ঝা স্পষ্ট দেখতে পেল চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। বুদ্ধিজীবী রবোটটি খুব সন্তুষ্টির ভান করে বলল, সফল এক্সপেরিমেন্ট। চোখের পানিটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে লোনা হয়েছে কী না!
টুকি এবং ঝা এবারে খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। কপোট্রনের পাওয়ার সাপ্লাইয়ে গোলমাল হলে কী এভাবে কান্নাকাটি করা উচিত? কে জানে। রহোটদের জীবনে এটাই হয়তো গভীর দুঃখের ব্যাপার। বুদ্ধিজীবী রবোট এবারে টুকি আর ঝাকে নিয়ে গেল পাশের ল্যাবরেটরিতে। তার উপর বড় বড় করে লেখা ক্রোধ ল্যাবরেটরি।
ঝা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে কী রাগারাগি হয়?
হ্যাঁ। ক্রোধ অনুভূতিটি এর মাঝে বিশ্লেষণ করা হয়। কী কী কারণে রাগ হওয়া উচিত সেটা বের করে বিশাল একটা ডাটাবেস তৈরি করা হয়েছে। সেই সব কোন একটা ঘটনা ঘটে গেলেই রবোটেরা রেগে উঠে।
রেগে উঠে?
হ্যাঁ তখন কপোট্রনে উল্টোপাল্টা সিগনাল দেওয়া হয়। বিতিকিচ্ছি একটা ব্যাপার ঘটে। আপনাদেরকে দেখাই।
একটা সুইচ টিপে আগের মত একটা স্বচ্ছ জানালা খুলে দেওয়া হল। ভিতরে গাবদা গোবদা একটা রবোট টুলের উপর বসে আছে, তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে শুটকো মত একটা রবোট। বুদ্ধিজীবী রবোট বলল, যে রবোটটা বসে আছে তাকে এখন রাগিয়ে দেওয়া হবে।
কী ভাবে?
রবোটটি আরেকবার সুইচ টিপে দিয়ে বলল, দেখেই বুঝতে পারবেন।
টুকি এবং ঝা আবাক হয়ে দেখল শুটকো রবোটটি ঘরের এক কোণায় হেঁটে গিয়ে বিশাল একটা হাতুরী নিয়ে এসে বসে থাকা রবোটটার মাথায় গদাম করে মেরে বসল। মনে হলো সেই আঘাতে রবোর্টটার মাথা তার শরীরের ভিতর খানিকটা ঢুকে গেছে।
ঝা মাথা নেড়ে বলল, রাগানোর একেবারে এক নম্বর বুদ্ধি।
টুকি এবং ঝায়ের কোন সন্দেহই রইল না যে গাবদা গোবদা রবোর্টটা রেগে উঠছে। তার সবুজ চোখ দুটি আস্তে আস্তে টকটকে লাল হয়ে উঠল, কান থেকে ধোঁয়া বের হতে শুরু করল, শরীর থেকে ছোট ছোট বজ্রপাতের মত বিদ্যুৎপাত হতে শুরু করল। এক সময় হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে আঁ আঁ করে বিকট চিঙ্কার করতে করতে টুলটা তুলে নিয়ে শুটকো রবোটটাকে এলোপাথাড়িভাবে মারতে শুরু করল। টুলটা কিছুক্ষণের মাঝেই ভেঙ্গেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে গেল তখন খালি হাতেই শুটকো রবোটটিকে চেপে ধরে কিল ঘুষি লাথি মারতে মারতে ঘরের এক কোণা থেকে অন্য কোথায় নিয়ে যায়, দেয়ালে চেপে ধরে পেটে ঘুষি মারতে থাকে, মাথা টেনে শরীর থেকে আলগা করে আনে, নিচে ফেলে উপরে লফিয়ে সমস্ত শরীরটাকে দলামোচা করে ফেলে। কিছুক্ষণেই শুকনো রবোটের শরীরের বিশেষ কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না।
বুদ্ধিজীবী রবোট তার মস্ত মাথা নেড়ে বলল, নিখুঁত রাগ। একেবারে মানুষের খাঁটি রাগ।।
টুকি সাবধানে একটা নিঃশ্বাস ফেলে শুটকো রবোটটার ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে রইল।
টুকি এবং ঝা এভাবে আনন্দ ল্যাবরেটরি, ঘৃণা ল্যাবরেটরি, হিংসা ল্যাবরেটরি, ভালবাসা ল্যাবরেটরি দেখে শেষ পর্যন্ত একটা বড় ল্যাবরেটরির সামনে এসে দাঁড়াল। দরজার উপরে বড় করে লেখা কৌতুকবোধ ল্যাবরেটরি। বুদ্ধিজীবী রবোর্টটা ফোঁস করে একটা শব্দ করে বলল, আমাদের সমস্ত গবেষণা এইখানে এসে মার খেয়ে যাচ্ছে।
টুকি জিজ্ঞেস করল, কি ভাবে?
বছরের পর বছর আমরা গবেষণা করে যাচ্ছি কিন্তু কিছুতেই রবোটের মাঝে কৌতুকবোধ জাগাতে পারছি না। কোন জিনিসটা শুনে হাসতে হয় আমরা সেটা বুঝতে পারছি না। আমাদের মাঝে কোন সেন্স অফ হিউমার নেই।
মানুষের তৈরি যত হাসির গল্প রয়েছে, যত কার্টুন, জোক রসিকতা সব নিয়ে আসা হয়েছে, আমাদের শত শত বুদ্ধিজীবী রবোট সেগুলো পড়ে যাচ্ছে, বিশ্লেষণ করে যাচ্ছে। আমাদের যত সুপারকম্পিউটার রয়েছে সেগুলো লক্ষ লক্ষ সফটওয়ার তৈরি করেছে, বিশাল সমস্ত ডাটাবেস তৈরি হয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয় নি। এখনো আমরা দেখে বা শুনে বুঝতে পারি না কোনটা হাসির আর কোনটা হাসির নয়।
ঝা জিব দিয়ে চুকচুক করে শব্দ করে বলল, বড়ই দুঃখের কথা।
বুদ্ধিজীবী রবোটটা নাকী সুরে বলল, এই একটা মাত্র জিনিসের জন্যে আমরা মানুষের সমান হতে পারছি না। এই ব্যাপারে তোমাদের সাহায্যের প্রয়োজন।
টুকি ভুরু কুচকে বলল, আমাদের কী করতে হবে।
আমাদের রসিকতা শেখাতে হবে।
টুকির চোয়াল ঝুলে পড়ল, রসিকতা শেখাতে হবে?
হ্যাঁ! এক সপ্তাহ সময় দেয়া হল। এর মাঝে যদি আমাদের রসিকতা শেখাতে পার তোমাদের চলে যেতে দেব।
টুকি শুকনো গলায় বলল, আর যদি না পারি?
তাহলে তোমাদের মস্তিষ্কটা আলাদা করে নেব।
রবোটদের কোন রসবোধ নেই, তারা যে ঠাট্টা করছে না সেটা বুঝতে টুকি আর ঝায়ের এতটুকু দেরী হল না।
বুদ্ধিজীবী রবোর্টটা কৌতুকবোধ ল্যাবরেটরি ঘরের দরজা খুলে তার মাঝে ঠেলে টুকি এবং ঝাকে ঢুকিয়ে দিয়ে ঘটাং করে বাইরে থেকে তালা মেরে দিল।