পঞ্চম পরিচ্ছেদ – মদিরা ভবন
রাজপুরী হইতে বাহির হইতে গিয়া সুগোপা দেখিল তোরণদ্বার বন্ধ হইয়া গিয়াছে। এমন প্রাযই ঘটে, সেজন্য সুগোপার গতিবিধি বাধাপ্রাপ্ত হয় না। সে প্রতীহারকে গুপ্তদ্বার খুলিয়া দিতে বলিল।
কোনও অজ্ঞাত কারণে প্রতীহারের মনে তখন কিঞ্চিৎ রস-সঞ্চার হইয়াছিল। সে নিজের দ্বিধা-বিভক্ত চাপদাড়িতে মোচড় দিয়া একটা আদিরসাশ্রিত রসিকতা করিয়া ফেলিল। সুগোপাও ঝাঁঝালো উত্তর দিল। সেকালে আদিরসটা গোরক্ত ব্রহ্মরক্তের মত অমেধ্য বিবেচিত হইত না।
তোরণের কবাটে একটি চতুষ্কোণ দ্বার ছিল, বাহির হইতে চোখে পড়িত না। সুগোপার ধমক খাইয়া প্রতীহার তাহা খুলিয়া দিল, বলিল— ‘ভাল কথা, দেবদুহিতার ঘোড়াটা মন্দুরায় ফিরিয়া আসিয়াছে।’
সবিস্ময়ে সুগোপা বলিল— ‘সে কি! আর চোর?’
মুণ্ড নাড়িয়া প্রতীহার বলিল— ‘চোর ফিরিয়া আসে নাই।’
‘তুমি নিপাত যাও। — দেবদুহিতাকে সংবাদ পঠাইয়াছ?’
‘যবনীর মুখে দেবদুহিতার নিকট সংবাদ গিয়াছে, এতক্ষণে তিনি পাইয়া থাকিবেন।’
সুগোপা অনিশ্চিত মনে ক্ষণেক চিন্তা করিল, তারপর সন্তর্পণে ক্ষুদ্র দ্বার দিয়া বাহির হইবার উপক্রম করিল। প্রতীহার কৌতুকসহকারে বলিল— ‘এত রাত্রে কি চোরের সন্ধানে চলিলে?’
‘হাঁ।’
প্রতীহার নিশ্বাস ফেলিল— ‘ভাগ্যবান চোর! দেখা হইলে তাহাকে আমার কাছে পাঠাইয়া দিও।’
‘তাই দিব। চোরের সংসর্গে রাত্রিবাস করিলে তোমার রস কমিতে পারে।’ সুগোপা দ্বার উত্তীর্ণ হইল।
প্রতীহার ছাড়িবার পাত্র নয়, সে উত্তর দিবার জন্য দ্বারপথে মুখ বাড়াইল। কিন্তু সুগোপা তাহার মুখের উপর সজোরে কবাট ঠেলিয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে নগরের দিকে চলিতে আরম্ভ করিল।
সুগোপা যতক্ষণ মদিরাগৃহে পতি অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতেছে, সেই অবকাশে আমরা চিত্রকের নিকট ফিরিয়া যাই।
কপোতকূটে প্রবেশ করিয়া চিত্রক উৎসুক নেত্রে চারিদিকে চাহিতে চাহিতে চলিল। নগরীর শোভা দেখিবার আগ্রহ তাহার বিশেষ ছিল না। প্রথমে ক্ষুন্নিবৃত্তি করিতে হইবে, প্রায় এক অহোরাত্র কিছু আহার হয় নাই। কটিবন্ধন দৃঢ় করিয়া জঠরাগ্নিকে দীর্ঘকাল ঠেকাইয়া রাখা যায় না, ক্লেশ যাহা অবশ্যম্ভাবী তাহা সহ্য করিতে হইয়াছে; কিন্তু দ্যূত প্রসাদাৎ এখন আর ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করিবার প্রয়োজন নাই।
পথে চলিতে চলিতে শীঘ্রই একটি মোদক ভাণ্ডার তাহার চোখে পড়িল। থরে থরে বহুবিধ পক্কান্ন সজ্জিত রহিয়াছে— পিষ্টক লড্ডু ক্ষীর দধি কোনও বস্তুরই অভাব নাই। মেদমসৃণ-দেহ মোদক বসিয়া দীর্ঘ খর্জুর শাখা দ্বারা মক্ষিকা তাড়াইতেছে।
মাদকালয়ে বসিয়া চিত্রক উদরপূর্ণ করিয়া আহার করিল। একটি বালক পথে দাঁড়াইয়া তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মিষ্টান্ন নিরীক্ষণ করিতেছিল, চিত্রক তাহাকে ডাকিয়া একটি লড্ডু দিল। উৎফুল্ল বালক লড্ডু খাইতে খাইতে প্রস্থান করিলে পর, সে জল পান করিয়া গাত্রোত্থান করিল, ভোজ্যের মূল্যস্বরূপ শশিশেখরের থলি হইতে একটি ক্ষুদ্র মুদ্রা লইয়া মোদককে দিল, তারপর তৃপ্তি-মন্থর পদে আবার পথে আসিয়া দাঁড়াইল।
গৃহদ্বারে তখন দুই একটি বর্তিকা জ্বলিতে আরম্ভ করিয়াছে; গৃহস্থের শুদ্ধান্তঃপুর হইতে ধূপ কালাগুরুর গন্ধ বাতাসে ভাসিতেছে, প্রদীপ-হস্তা পুরনারীগণ বদ্ধাঞ্জলি হইয়া গৃহদেবতার অর্চনা করিতেছে। ক্বচিৎ দেবমন্দির হইতে আরতির শঙ্খঘণ্টাধ্বনি উত্থিত হইতেছে। দিবাবসানের বৈরাগ্যমুহূর্তে নগরী যেন ক্ষণকালের জন্য যোগিনীমূর্তি ধারণ করিয়াছে।
অপরিচিত নগরীর পথে বিপথে চিত্রক অনায়াস চরণে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। হাতে কোনও কাজ নাই, উদর পরিপূর্ণ— সুতরাং মনও নিরুদ্বেগ। যে-ব্যক্তি রাজপুরুষের ঘোড়া চুরি করিয়াছিল তাহাকে মাত্র তিনজন দেখিয়াছে, তাহারা চিত্রককে এই জনাকীর্ণ পুরীতে দেখিতে পাইবে সে সম্ভাবনা কম। দেখিতে পাইলেও তাহার নূতন বেশে চিনিতে পরিবে না। অতএব নগর পরিদর্শনে বাধা নাই।
নগর পরিভ্রমণ করিয়া চিত্রক দেখিল, উজ্জয়িনী বা পাটলিপুত্রের ন্যায় বৃহদায়তন না হইলেও কপোতকূট বেশ পরিচ্ছন্ন ও সুদৃশ্য নগর। সে তাহার যাযাবর যোদ্ধৃজীবনে বহু স্থানীয় মহাস্থানীয় দেখিয়াছে, কিন্তু এই ক্ষুদ্র অসমতল পাষাণ নগরটি তাহার বড় ভাল লাগিল। সে ঈষৎ ক্ষুব্ধ হইয়া ভাবিল, এখানে দীর্ঘকাল থাকা চলিবে না, বেশিদিন থাকিলেই ধরা পড়িবার ভয়। এদিকে তিনজন তো আছেই, তাহা ছাড়া শশিশেখর যে বন হইতে বাহির হইয়া আসিবে না তাঁহারই বা নিশ্চয়তা কি?
ক্রমে রাত্রি হইল; আকাশে চন্দ্র ও নিম্নে বহু দীপের জ্যোতি উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। রাজভবন শীর্ষে দীপাবলি মণিমুকুটের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। ঘুরিতে ঘুরিতে চিত্রক একটি উদ্যানের সন্নিকটে উপস্থিত হইয়া দেখিল, কয়েকজন ভদ্র নাগরিক দাঁড়াইয়া গল্প করিতেছে। সে একজনকে জিজ্ঞাসা করিল— ‘মহাশয়, ওটা কি?’
নাগরিক বলিল— ‘ওটা রাজপুরী।’
সপ্রশংস নেত্রে রাজপুরী নিরীক্ষণ করিয়া চিত্রক বলিল— ‘অপূর্ব প্রাসাদ। মগধের রাজপুরীও এমন সুরক্ষিত নয়। রাজা ঐ পুরীতে থাকেন?’
নাগরিক বলিল— ‘থাকেন বটে, কিন্তু বর্তমানে তিনি রাজপুরীতে নাই। তাই তো ঐরূপ অঘটন সম্ভব হইয়াছে।’
‘অঘটন?’
‘শুনেন নাই? রাজকুমারীর অশ্ব চুরি করিয়া এক গর্ভদাস তস্কর পলায়ন করিয়াছে।’
‘রাজকুমারীর অশ্ব—?’ প্রশ্নটা অনবধানে চিত্রকের মুখ হইতে বাহির হইয়া আসিল।
‘হাঁ। কুমারী মৃগয়ায় গিয়াছিলেন, জলসত্রে এই ব্যাপার ঘটিয়াছে। — আপনি কি বিদেশী?’ বলিয়া নাগরিক সম্ভ্রমপূর্ণ দৃষ্টিতে চিত্রকের মূল্যবান বেশভূষার পানে চাহিল।
‘হাঁ। আমি মগধের অধিবাসী, কর্মসূত্রে আসিয়াছি।’
চিত্রক আর সেখানে দাঁড়াইল না।
আকস্মিক সংবাদে বুদ্ধিভ্রষ্ট হইবে চিত্রকের প্রকৃতি সেরূপ নয়। কিন্তু এই সংবাদ পরিগ্রহ করিবার পর প্রায় প্রহরকাল সে বিক্ষিপ্ত চিত্তে ইতস্তত বিচরণ করিয়া বেড়াইল। সংবাদটা নগরে রাষ্ট্র হইয়া পড়িয়াছে সন্দেহ নাই। কে জানিত যে ঐ অশ্বারোহীটি রাজকন্যা! রাজকন্যা পুরুষবেশে ঘোড়ায় চড়িয়া মৃগয়া করিয়া বেড়ায়। আশ্চর্য বটে। চিত্রক রাজকন্যার মুখাবয়ব স্মরণ করিবার চেষ্টা করিল কিন্তু বিশেষ কিছু উদ্ধার করিতে পারিল না; তাহাকে দেখিয়া গর্বিত ও কিশোরবয়স্ক মনে হইয়াছিল এইটুকুই শুধু স্মরণ হইল।
রমণীর সম্পত্তি সে অপহরণ করিয়াছে, মনে হইতেই চিত্রক লজ্জা অনুভব করিল। সে ভাগ্যান্বেষী যোদ্ধা, পরদ্রব্য সম্বন্ধে তাহার মনে তিলমাত্র কুণ্ঠা নাই; সে জানে, এই বসুন্ধরা এবং ইহার যাবতীয় লোভনীয় বস্তু বীরভোগ্য। তবু, রমণী সম্বন্ধে তাহার মনে একটু দুর্বলতা ছিল। জীবনে সে কখনও নারীর নিকট হইতে কোনও দ্রব্য কাড়িয়া লয় নাই, স্বেচ্ছায় তাহারা যাহা দিয়াছে তাহাই হাসিমুখে গ্রহণ করিয়াছে, তদতিরিক্ত নয়।
হয়তো ঐ পুরুষবেশীর রূপ ও ঐশ্বর্য তাহার মনে ঈর্ষার সঞ্চার করিয়াছিল, হয়তো প্রপাপালিকার সহিত যুবকের ঘনিষ্ঠতা তাহার পৌরুষকে আঘাত করিয়াছিল;— সুগোপার সহিত নিজের ব্যবহার স্মরণ করিয়াও তাহার মন সবিস্ময় ক্ষোভে ভরিয়া উঠিল। অবশ্য তাহার আচরণে অনেকখানি কৌতুক মিশ্রিত ছিল; তথাপি, কৌতুক কখন নিজ সীমা অতিক্রম করিয়া নিগ্রহে রূপান্তরিত হইয়াছিল তাহা সে বুঝিতে পারে নাই। বুভুক্ষিত শান্তিভগ্ন দেহে আশাহত অবস্থায় মানুষ যে কর্ম করে, পরিপূর্ণ উদরে সুস্থ দেহে সে নিজেই তাহার কারণ খুঁজিয়া পায় না।
আকাশের পানে চাহিয়া চিত্রক হাসিল। জীবনকে সে বহুরূপে বহু অবস্থায় দেখিয়াছে, তাই পশ্চাত্তাপ ও অনুশোচনাকে সে নিরর্থক বলিয়া জানে। নিয়তির গতি অনুশোচনার দ্বারা লেশমাত্র ব্যতিক্রান্ত হয় না, অদৃষ্টই নিয়ন্তা। চিত্রকের মনে হইল, ভাগ্যদেবী তাহার চারিপাশে সূক্ষ্ম ভবিতব্যতার জাল বুনিতে আরম্ভ করিয়াছেন— এই জালে ক্ষুদ্র মীনের মত আবদ্ধ হইয়া সে কোন্ অদৃষ্টতটে উৎক্ষিপ্ত হইবে কে জানে?
চন্দ্রের দিকে দৃষ্টি পড়িতে তাহার চেতনা ফিরিয়া আসিল। মধ্যগগনে চন্দ্র, রাত্রি গভীর হইতেছে। সচকিতে সে চারিদিকে চাহিল; দেখিল বৌদ্ধ চৈত্যের নিকটস্থ উচ্চ ভূমির উপর সে একাকী দাঁড়াইয়া আছে। এখানে পথ গৃহ-বিরল, লোক চলাচলও কম। দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দেখিল, একটি স্থান আলোকমালায় ঝলমল করিতেছে। বহু নাগরিকের মিলিত স্বরগুঞ্জন তাহার কর্ণে আসিল।
চিত্রক কিছুকাল যাবৎ ঈষৎ তৃষ্ণা অনুভব করিতেছিল, ঐ আলোকদীপ্ত পথের দিকে চাহিয়া তাহার তৃষ্ণা আরও বাড়িয়া গেল। নগরে অবশ্য মদিরাগৃহ আছে, এ কথাটা এতক্ষণ তাহার মনে হয় নাই। রাত্রির জন্য একটা আশ্রয়ও খুঁজিয়া লইতে হইবে। সে আলোকলিপ্সু পতঙ্গের মত দ্রুত সেই দিকে চলিল।
রজনীর আনন্দধারা তখন অন্তঃস্রোতা হইয়া আসিয়াছে। পুষ্প বিপণিতে পুষ্পসম্ভার প্রায় শূন্য, পসারিণীদের চক্ষে আলস্য; রাজপথে নাগরিকদের গতায়াত ও ব্যস্ত আগ্রহ মন্দীভূত হইতে আরম্ভ করিয়াছে। নবীনা রাত্রির নবযৌবনসুলভ প্রগল্ভতা প্রগাঢ়যৌবনার রসঘন নিবিড় মাধুর্যে পরিণত হইয়াছে।
পুষ্পাসব গন্ধে আকৃষ্ট মধুমক্ষিকা যেমন কেবলমাত্র ঘ্রাণশক্তির দ্বারা পরিচালিত হইয়া প্রচ্ছন্ন ফুলকলিকার সন্নিধানে উপস্থিত হয়, চিত্রকও তেমনই পিপাসা-প্রণোদিত হইয়া একটি মদিরাগৃহের দ্বারে উপনীত হইল। মদিরাগৃহের ভিতরে উচ্চ চত্বরের উপর বসিয়া মুণ্ডিতশীর্ষ শৌণ্ডিক স্তূপীকৃত রজতমুদ্রা গণনা করিতেছিল, চিত্রক প্রবেশ করিয়া তাহার সম্মুখে একটি স্বর্ণদীনার অবহেলাভরে ফেলিয়া দিল, বলিল— ‘পানীয় দাও।’
চমকিত শৌণ্ডিক যুক্তকরে সম্ভাষণ করিল— ‘আসুন মহাভাগ! কোন্ পানীয় দিয়া মহোদয়ের তৃপ্তিসাধন করিব? আসব সুরা বারুণী মদিরা— যে পানীয় ইচ্ছা আদেশ করুন।’
‘তোমার শ্রেষ্ঠ মদিরা আনয়ন কর।’
‘যথা আজ্ঞা। — মধুশ্রী!’
শৌণ্ডিক কিঙ্করীকে ডাক দিল। নূপুর কাঞ্চী বাজাইয়া একটি তন্দ্রালসা কিঙ্করী আসিয়া দাঁড়াইল। শৌণ্ডিক বলিল— ‘আর্যকে সুঘট্টিত কক্ষে বসাও, শ্রেষ্ঠ মদিরা দিয়া তাঁহার সেবা কর।’
কিঙ্করী চিত্রককে একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে লইয়া গিয়া বসাইল। কক্ষটি সুচারুরূপে সজ্জিত; কুট্টিমের উপর শুভ্র আস্তরণ; তদুপরি স্থূল উপাধান তাম্বূলকরঙ্ক প্রভৃতি রহিয়াছে। চারি কোণে পিত্তলের দীপদণ্ডে বর্তিকা জ্বলিতেছে। ধূপশলা হইতে চন্দনগন্ধী সূক্ষ্ম ধূম ক্ষীণ রেখায় উত্থিত হইতেছে। প্রাচীরগাত্রে সমুদ্রমন্থনের চিত্র; সুধাভাণ্ড লইয়া সুরাসুরের মধ্যে ঘোর দ্বন্দ্ব বাধিয়া গিয়াছে।
চিত্রক উপবিষ্ট হইলে কিঙ্করী নিঃশব্দ ক্ষিপ্রতার সহিত মদিরা-ভৃঙ্গার, চাষক ও সুচিত্রিত স্থালীতে মৎস্যাণ্ড আনিয়া তাহার সম্মুখে রাখিল, তারপর আদেশ প্রত্যাশায় কৃতাঞ্জলিপুটে দ্বারপার্শ্বে দাঁড়াইল। চিত্রক এক চষক মদিরা ঢালিয়া এক নিশ্বাসে পান করিয়া ফেলিল, তারপর তৃপ্তির সহিত সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল— ‘সেবিকে, তুমি যাও, আমার আর কিছু প্রয়োজন নাই।’
মধুশ্রী সাবধানে কবাট ভেজাইয়া দিয়া প্রস্থান করিল। একাকী বসিয়া চিত্রক স্বাদু মৎস্যাণ্ড সহযোগে আরও কয়েক পাত্র মদিরা পান করিল। ক্রমে তাহার চক্ষু ঢুলু ঢুলু হইয়া আসিল, মস্তিষ্কের মধ্যে স্বপ্নসুন্দরীর মঞ্জীর বাজিতে লাগিল। সে উপাধানের উপর আলস্যভরে অঙ্গ প্রসারিত করিয়া দিল।
মদিরাজনিত মৃদু বিহ্বলতার মধ্যে চিন্তার ধারা আবছায়া হইয়া যায়; একটা অহেতুক স্ফূর্তি আলস্যের সহিত মিলিয়া মনকে হিন্দোলার মত দোল দিতে থাকে। চিত্রকের অবস্থা তখন সেইরূপ। সে নিজের অঙ্গুলিতে অঙ্গুরীয়ের উপর দৃষ্টিপাত করিল, তারপর অঙ্গুরীয় চোখের আছে আনিয়া ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিল। তখন বনের মধ্যে শশিশেখরের সহিত আলাপের কথা তাহার নূতন করিয়া মনে পড়িয়া গেল।
নিজ মনে মৃদু মৃদু হাসিতে হাসিতে সে উঠিয়া বসিল; কটি হইতে থলিটি বাহির করিয়া তাহার মুখোদ্ঘাটনপূর্বক একটি একটি সামগ্রী বাহির করিয়া দেখিতে লাগিল। স্বর্ণপ্রসূ থলির সমস্ত বৈভব এখনও পরীক্ষা করিয়া দেখা হয় নাই।
তিলক চন্দন দেখিয়া তাহার মুখের হাস্য প্রসার লাভ করিল; কঙ্কতিকাটি তুলিয়া ধরিয়া সে উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল। এলাচ লবঙ্গ মুখে দিয়া সকৌতুকে চিবাইল, সব শেষে জতুমুদ্রালাঞ্ছিত কুণ্ডলাকৃতি লিপি খুলিয়া গম্ভীরমুখে পাঠ করিতে আরম্ভ করিল। মগধের লিপি, বিটঙ্করাজের নিকট প্রেরিত হইয়াছে। পাঠ করিতে করিতে চিত্রক তাহাতে নিমগ্ন হইয়া গেল।
এই সময় দ্বার ঈষৎ উন্মুক্ত করিয়া কে একজন ঘরের মধ্যে উঁকি মারিল; কাজলপরা একটি চোখ ও মুখের কিয়দংশ দেখা গেল মাত্র। চিত্রককে দেখিয়া কাজলপরী চোখ ক্রমশ বিস্ফারিত হইল, তারপর ধীরে ধীরে কবাট আবার বন্ধ হইয়া গেল। চিত্রক পত্রপাঠে নিবিষ্ট ছিল, কিছু দেখিল না; দেখিলেও বোধ করি চিনিতে পারিত না।
বলা বাহুল্য যে উঁকি মারিয়াছিল সে সুগোপা। পতি অন্বেষণে কয়েকটি মদিরাগৃহে ঘুরিয়া শেষে সে এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। তাহাকে দেখিয়াই শৌণ্ডিক হাসিমুখে বলিয়াছিল— ‘প্রপাপালিকে, তোমার মানুষটি তো আজ এখানে নাই।’
সুগোপা বলিয়াছিল— ‘তোমার কথায় বিশ্বাস নাই, আমি খুঁজিয়া দেখিব।’
‘ভাল, তাই দেখা।’
তখন এ-ঘর ও-ঘর খুঁজতে খুজিতে একটি ঘরে উঁকি মারিয়া সহসা তাহার চক্ষু ঝলসিয়া গিয়াছিল। বেশভূষা অন্য প্রকার, কিন্তু সেই দুর্বৃত্ত অশ্বচোরই বটে।
কিছুক্ষণ সুগোপা দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর পা টিপিয়া শৌণ্ডিকের নিকট ফিরিয়া গেল। চুপি চুপি বলিল— ‘মণ্ডূক, নগরপালকে সংবাদ দাও।’
বিস্মিত মণ্ডূক বলিল— ‘সে কি! কি হইয়াছে?’
‘চোর। যে চোর আজ কুমারী রট্টার অশ্ব চুরি করিয়াছিল সে ঐ প্রকোষ্ঠে বসিয়া মদ্যপান করিতেছে।’
মণ্ডূকের মুখে ভয়ের ছায়া পড়িল। দুষ্কৃতকারীকে মদিরাগৃহে আশ্রয় দিলে শৌণ্ডিককে কঠিন রাজদণ্ড ভোগ করিতে হয়। সে বলিল— ‘সর্বনাশ, আমি তো কিছু জানি না।’
‘তাই বলিতেছি, যদি নিজের প্রাণ বাঁচাইতে চাও শীঘ্র নগরপালকে ডাকিয়া আন।’
‘নগরপালকে এত রাত্রে কোথা পাইব? তিনি নিশ্চয় গৃহদ্বার রুদ্ধ করিয়া নিদ্রা যাইতেছেন, তাঁহার কাঁচা ঘুম ভাঙাইয়া কি নিজের পায়ে দড়ি দিব?’
সুগোপা চিন্তা করিল।
‘তবে এক কাজ কর। দুইজন যামিক নগররক্ষী ডাকিয়া আন, তাহারা আজ রাত্রে চোরকে বাঁধিয়া রাখুক, কাল প্রাতে মহাপ্রতীহারের হস্তে সমর্পণ করিবে।’
‘সে কথা ভাল’ বলিয়া ব্যস্তসমস্ত মণ্ডূক বাহির হইয়া গেল।
অধিক দূর যাইতে হইল না। রাত্রিকালে যামিক-রক্ষীরা পথে পথে বিচরণ করিয়া নগর পাহারা দিয়া থাকে। একটা তাম্বূল বিপণির সম্মুখে দাঁড়াইয়া দুইজন যামিক-রক্ষী বোধ করি রাত্রিতে পাথেয় সংগ্রহ করিতেছিল, মণ্ডূকের কথায় উত্তেজিত হইয়া তাহার সঙ্গে চলিল।
সুগোপা অল্প কথায় ব্যাপার বুঝাইয়া দিল; তখন চারিজনে চিত্রকের প্রকোষ্ঠের দ্বার খুলিয়া ভিতরে প্রবেশ করিল। চিত্রক তখন লিপি পাঠ শেষ করিয়া থলি কোমরে বাঁধিয়াছে, ভৃঙ্গার হইতে শেষ মদিরাটুকু ঢালিয়া পান করিতেছে। অস্ত্রধারী দুইজন পুরুষকে সম্মুখে দেখিয়া সে বলিল— ‘কি চাও?’
সুগোপা পিছন হইতে বলিল— ‘তোমাকে চাই।’
চিত্রক ত্বরিতে উঠিয়া দাঁড়াইল, কিন্তু তরবারি বাহির করিবার পূর্বেই রক্ষীরা তাহার ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িয়া তাহাকে পাড়িয়া ফেলিল।
সুগোপা তখন সম্মুখে আসিয়া বলিল— ‘অশ্বচোর, আমাকে চিনিতে পার?’
চক্ষু সঙ্কুচিত করিয়া চিত্রক তাহার পানে চাহিল। অদৃষ্টের জাল গুটাইয়া আসিতেছে। সে অধরোষ্ঠ চাপিয়া বলিল— ‘প্রপাপালিকা!’
সুগোপা রক্ষীদের দিকে ফিরিয়া বলিল— ‘ইহাকে সাবধানে পাহারা দিও। অতি ধূর্ত চোর, সুবিধা পাইলেই পালাইবে।’
একজন রক্ষী বলিল— ‘সাবধানে কোথায় রাখিব? রাত্রে কারাগার তো বন্ধ আছে।’
হঠাৎ সুগোপার মনে পড়িয়া গেল। উদ্বেলিত হাসি চাপিয়া সে বলিল— ‘রাজপুরীর তোরণ-প্রহরীর কাছে লইয়া যাও। আমার নাম করিয়া বলিও, সে সমস্ত রাত্রি চোরকে পাহারা দিবে।’
সুগোপাকে নগরের সকলেই চিনিত। প্রপাপালিকা হইলে কি হয়, রাজকুমারীর সখী। রক্ষীরা দ্বিরুক্তি না করিয়া চোরকে বধিয়া রাজপুরীর দিকে লইয়া চলিল।
ভাগ্যক্রমে চিত্রকের থলিটি রক্ষীরা কাড়িয়া লইল না। তাহারা সাধুচরিত্র বলিয়াই হোক, অথবা যে চোর রাজকন্যার ঘোড়া চুরি করিয়াছে তাহার উপর বাট্পাড়ি করিলে গোলযোগ হইতে পারে এই জন্যই হোক চিত্রকের থলিতে তাহারা হস্তক্ষেপ করিল না।