০৫. ভদ্রমহিলার কাছ থেকে

০৫.

ভদ্রমহিলার কাছ থেকে নতুন কিছু জানা গেল না। পোয়ারোকে উদ্দেশ্য করে ব্যাজার মুখে বললেন, ব্যাটেল। আমাকে পর্যন্ত ধমকে দিল শেষটা। একটু প্রাচীনপন্থী মহিলা, তবে অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল। অবশ্য কিছুটা একগুঁয়েও আছেন। উনি একাজ করেছেন। বলে বিশ্বাস হয় না। যদিও কেবল বাইরেটা দেখে ভেতরের বিচার করা অনুচিত। কার মনের মধ্যে কি আছে কে জানে! ভদ্রমহিলার মানসিক শক্তি খুব সুদৃঢ়। একটা কথা, খেলার স্কোরশীটগুলো নিয়ে আপনি এতটা মাথা ঘামাচ্ছেন কেন বুঝতে পারছি না। এগুলো আপনার কি কাজে লাগবে, মিঃ পোয়ারো?

পোয়ারো যত্ন করে স্কোরের কাগজগুলো টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, আপনার কি মনে হচ্ছে না এর ভেতর থেকে আমরা কোনো নিগূঢ় সত্যের ইঙ্গিত পেতে পারি? এক্ষেত্রে কি আমরা জানতে চাই? একটা চরিত্রের সূত্র, তাই নয় কি? কেবল একজনের চরিত্রের সূত্র নয়, চারজনেরই। এবং আঁকাবাকা এই অঙ্কগুলোর মধ্যেই সেটা পাবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। যেমন ধরুন, এটা হচ্ছে, প্রথম রাবারের স্কোরশীট, লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন এর মধ্যে কোথাও কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে ওঠেনি। খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে। ক্ষুদ্র অথচ স্পষ্ট হস্তাক্ষর। সতর্কভাবে যোগ-বিয়োগ করা। সমস্তটাই মিস মেরিডিথের হাতের লেখা। তিনি তখন মিসেস লরিমারের পার্টনার হয়ে খেলছিলেন। ভালো তাস তুলেছেন তাই রাবার পেতেও বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি।

দ্বিতীয় রাবারের খেলাটা কি ভাবে এগিয়েছিল সবটা বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। কারণ মেজর ডেসপার্ড স্কোরটা কাটতে কাটতে গেছেন। এর ফলে স্কোরের ধারাবাহিকতা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কিন্তু এই ঘটনার থেকেও আমরা তাঁর চরিত্রের একটা বৈশিষ্ট্যের কথা জানতে পারি। ভদ্রলোক এক নজরে তার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক অবহিত থাকতে চান। অঙ্কগুলো ছোট ছোট অক্ষরে লেখা এবং তাদেরও একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে।

পরের স্কোরটা হল মিসেস লরিমারের। তিনি তখন ডাক্তার রবার্টসের পার্টনার হয়ে চরমে উঠেছিলেন। দু’দিকেই লম্বা অঙ্কের সারি। বোঝা যাচ্ছে ডাক্তার রবার্টস তার হাতের তাসের চাইতে একটু বেশি বেশি বিড দিচ্ছিলেন। তাই ডাউন দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু যেহেতু তারা দুজনেই বেশ দক্ষ খেলোয়াড় সেইজন্য ডাউনের মাত্রাটা কম। তবে রবার্টসের এই মাত্রাতিরিক্ত বিডের ঝেকে যদি প্রতিপক্ষও একটু বেশি বিড দিয়ে ফেলেন আর তখনই তাঁরা ডবল দিয়ে বেশ মোটারকম পেনালটি আদায় করে ছেড়েছেন। এখানে দেখুন, বিপক্ষ জুটি দু’বার ডিল দুটো করে ডাউন দিয়ে গেছেন। মিসেস লরিমারের হস্তাক্ষরের মধ্যেও একটা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে, সুন্দর, স্পষ্ট, দৃঢ়।

এটা হচ্ছে অসমাপ্ত চতুর্থ রাবারের স্কোরশীট। স্কোর রাখছিলেন ডাক্তার রবার্টস। তাহলে প্রত্যেকের হস্তাক্ষর বিশিষ্ট একটা করে স্কোরশীট পাওয়া গেল। রবার্টসের হাতের লেখাটা তেমন সুন্দর নয় তবে পড়তে কোনো অসুবিধা হয়নি। আগের রাবারটার মতো অতটা উত্তেজনা নেই। সম্ভবত তার কারণ এবারে মিস মেরিডিথ ছিলেন ডাক্তারের পার্টনার। ভদ্রমহিলা একেই একটু কম কম বিড দিয়ে থাকেন। তার ওপর ডাক্তারের মতো তেজী পার্টনার পেয়ে তিনি ভয়ে আর ম্রিয়মান হয়ে পড়েছিলেন। সারা স্কোরের মধ্যে কেমন একটা ঝিমুনি আর অবসাদের ভাব গাঁথা হয়ে আছে।

একটু থেমে আবার শুরু করলেন পোয়ারো। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন আমি অর্থহীন, নির্বোধের মতো প্রশ্ন করেছি, কিন্তু আসলে তা নয়। আমি এই চারজন খোলোয়াড়দের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটা পরিষ্কার আভাস পেতে চাই। এবং যেহেতু আমি তাদের কাছে কেবল ব্রিজ খেলা সম্পর্কেই প্রশ্ন রাখছি তাই তারাও তার উত্তর দিতে কোনো দ্বিধা করছেন না।

আপনার প্রশ্নকে কোনোদিন নিরর্থক বলে মনে করি না। সসম্ভ্রমে সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল বললেন, কারণ আপনার কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আমি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। প্রত্যেকেরই কাজের মধ্যে একটা নিজস্ব ধারা আছে। আমি সব সময় আমার অধীনস্থ ইন্সপেক্টরদের স্বাধীনভাবে কাজ করবার সুযোগ দিই। কোন পদ্ধতিতে কাজ করলে সবচেয়ে বেশি সুফল পাওয়া যাবে সেটা তারা নিজেরাই বেছে নেয়।..

তবে আপাতত এ-প্রসঙ্গ মুলতুবি রেখে মেরিডিথকে আসতে বলাই ভালো।

 মিস মেরিডিথ অতিমাত্রায় বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। দরজার কাছে এসে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। শ্বাস প্রশ্বাসও কেমন এলোমেলো। চোখে মুখে আতঙ্কের পান্ডুর ছায়া।

সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল ত্বরিৎ পায়ে উঠে গিয়ে মেরিডিথের পাশে এসে দাঁড়ালেন। তাকে ধরলেন ও একটা চেয়ারে বসতে সাহায্য করলেন।

বসে একটু জিরিয়ে নিন, মিস মেরিডিথ। অযথা এত নার্ভাস হয়ে পড়বেন না। আমি জানি, এই ধরনের নৃশংস ঘটনাবলি স্নায়ুর ওপর কেমন গভীর প্রভাব বিস্তার করে। তবে এক্ষেত্রে ঘটনাটা সত্যিই অতখানি ভয়াবহ নয়।

এর চেয়ে ভয়াবহ আর কি হতে পারে আমার মাথায় আসছে না। মৃদুকণ্ঠে কথা বললেন মেরিডিথ। কি ভয়ানক ব্যাপার ভাবুন তো দেখি। আমাদেরই একজন…ওঃ, আর ভাবা যায় না।

ভাবনার ভারটা আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হোন। নম্র সুরে সান্ত্বনা দিলেন ব্যাটেল। প্রথমে আপনার ঠিকানাটা আমাদের বলুন।

ওয়েনডন কটেজ; ওয়ালিং ফোর্ড।

শহরের আস্তানার কোনো ঠিকানা নেই?

 না, দু-চারদিনের জন্যে যখন শহরে আসি তখন একটা ক্লাবে উঠি।

 ক্লাবটার নাম?

 লেডিজ অনলি।

 ভাল….আচ্ছা মিস মেরিডিথ, শ্যাতানার সঙ্গে আপনার কতদিনের পরিচয়?

আমার সঙ্গে তাঁর ভালো পরিচয় ই নেই। সত্যি বলতে কি, ভদ্রলোককে আমি একটু ভয়-ই করে চলতাম।

তার কারণ?

কারণ?…কারণ তার সেই ভয়ঙ্কর হিমশীতল হাসি। আর এমনভাবে ঝুঁকে পড়ে লোকের সঙ্গে কথা বলেন যাতে মনে হয় সুযোগ পেলেই বুঝি ঘাড়ের ওপর ছোবল মেরে বসবেন।

ভদ্রলোকের সঙ্গে কবে আপনার প্রথম পরিচয় হল।

প্রায় ন-মাস আগে। শীতকালে সুইজারল্যান্ডের এক হোটেলে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। ভদ্রলোক বরফের ওপর খুব ভালো স্কেটিং করতে পারলে। নানা রকম কায়দাকানুন ও তার জানা ছিল।

হ্যাঁ, চেহারাটা তাঁর স্কেটিংয়েরই উপযোগী। সেখান থেকে ফিরে আসবার পর মিঃ শ্যাতানার সঙ্গে কি আপনার দেখা সাক্ষাৎ ঘটত?

কখনো সখনো। মাঝে মধ্যে তিনি আমাকে তার পার্টিতে নিমন্ত্রণ জানাতেন আর প্রত্যেক পার্টিরই বিশেষ একটা জৌলুস থাকত। মজাও পাওয়া যেত বিস্তর।

কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ভদ্রলোককে ভয় পাবার মতো নিশ্চয় আপনার কোনো বিশেষ কারণ ছিল না?

অ্যানা মেরিডিথ স্বচ্ছ বিশাল দুই আঁখি মেলে ব্যাটেলের দিকে ফিরে তাকালেন। তারপর বললেন, বিশেষ, কারণ? না!

এবার তাহলে আজকের রাতের ঘটনায় আসা যাক। আপনি কি ব্রিজ খেলার সময় কখনো নিজের আসন ছেড়ে উঠেছিলেন?

ঠিক মনে পড়ছে না!…ওহো, হ্যাঁ, একবার বোধহয় উঠেছিলাম। অন্যেরা কে কি তাস পেয়েছে সেটা দেখার জন্য।

আপনি কি সে সময় সারাক্ষণই ব্রিজ-টেবিলের পাশাপাশি ছিলেন?

হ্যাঁ।

এ-বিষয়ে একেবারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত তো, মিস মেরিডিথ?

মেরিডিথের ফর্সা চিবুক অকস্মাৎ রক্তিম হয়ে উঠল। না…না ঘরের মধ্যে বোধ হয় দু-এক পাক পায়চারিও করেছিলাম।

ঠিক কথা।…. মিস মেরিডিথ, আমি আপনাকে সচেতন করে দিতে বাধ্য হচ্ছি বলে আমায় মাফ করবেন। কিন্তু প্রতিটি প্রশ্নের সত্য উত্তর দিতে সচেষ্ট হোন। আমি জানি, আপনি ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। নার্ভাস হয়ে পড়লে লোকে অনেক সময় নানা ধরনের উল্টোপাল্টা কথা বলে। যেটা ঘটা শোভন হত বা যে ঘটনা তাদের কাছে কাম্য ছিল সেই রকমই ঘটেছে বলে আর পাঁচজনের কাছে গল্প করে। তবে শেষকালে এতে ফল ভালো হয় না। যাক, তাহলে আপনি স্বীকার করছেন সে সময় ঘরের মধ্যে ইতস্তত ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। এবার বলুন, তখন কি আপনি মিঃ শ্যাতানার কাছে গিয়েছিলেন?

মিস মেরিডিথের দৃষ্টিতে একটা অসহায় হতাশ ভাব ফুটে উঠল। বিশ্বাস করুন, আমি সত্যিই বলছি সুপারিনটেনডেন্ট, আমার কিছুই যেন সঠিক মনে পড়ছে না!

বেশ, তাহলে আমরা ধরে নেব আপনি হয়তো তার কাছে গিয়েছিলেন। অপর তিনজনের বিষয় কিছু জানেন?

মিস মেরিডিথ মাথা নাড়লেন। না, তাদের কারো সঙ্গেই আমার কোনো পূর্ব পরিচয় নেই। আজ এখানে প্রথম আলাপ হল।

এঁদের সম্পর্কে আপনার কি ধারণা? এই হত্যাকান্ড কার দ্বারা সম্ভব বলে আপনি সন্দেহ করেন?

আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। মেজর ডেসপার্ড ও এ কাজ করতে পারেন না। এবং এটা ডাক্তার রবার্টসের কীর্তি বলেও আমার মনে হয় না। কেননা হত্যার উদ্দেশ্য থাকলে তারা আরও অনেক সহজ পথ বেছে নিতে পারেন। ওষুধের মধ্যে বিষ না ওই জাতীয় কিছু…তাহলে আপনার বিশ্বাস, মিসেস লরিমারই এই কাজ করেছেন?

না না, আমি সেকথা বলছি না। তিনি যে করেননি সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তার আচার ব্যবহার খুবই ভদ্র এবং ব্রিজও অদ্ভুত ভালো খেলেন। নিজে একজন উঁচুদরের খেলোয়াড় হওয়া সত্ত্বেও পার্টনারের ত্রুটি দেখিয়ে তাকে কখনো নার্ভাস করে তোলেন না।

তবু কিন্তু আপনি সবশেষে ভদ্রমহিলার নাম উল্লেখ করলেন।

তার কারণ বুকে ছুরি বসিয়ে খুন করার মতো নাটুকেপনা একমাত্র মেয়েদেরই শোভা পায়।

ব্যাটেল আগের মতোই আচমকা ছুরিটা বার করলেন। ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন মেরিডিথ।

ও ভয়ঙ্কর জিনিসটা একবার হাতে নিয়ে দেখতে পারি?

 হ্যাঁ…..হ্যাঁ, দেখুন না।

 ছুরিটা হাতে ধরে নেড়েচেড়ে দেখার সময় মেরিডিথের মুখটা আড়ষ্ট আর ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। বুকের ভেতরে হৃদপিন্ডটা যেন অতিমাত্রায় ধুকপুক করছে। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়েছিলেন।

এই সামান্য জিনিসটা দিয়ে শেষে কিনা….

একেবারে মাখনের মতো সোজা ঢুকে যাবে। ঈষৎ বিজ্ঞ কণ্ঠে ব্যক্ত করলেন ব্যাটেল, এর সাহায্যে যে কোনো বাচ্চা ছেলেও অনায়াসে খুন করতে পারে।

আপনি বলতে চান….আপনি বলতে চানমিস মেরিডিথ তাঁর ভীত চকিত টলটলে দুই চোখের দৃষ্টি সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেলের মুখের ওপর ন্যস্ত করলেন। কি যেন খুঁজে বেড়ালেন সেখানে কণ্ঠস্বরে বিহ্বলতার ছোঁওয়া আমার দ্বারাও এই হত্যাকান্ড সম্ভব? কিন্তু আমি এ কাজ করিনি। কি উদ্দেশ্যেই বা খামোকা তাকে খুন করতে যাব?

সেই নিগুঢ় প্রশ্নের উত্তরটাই আমরা জানতে চাই। কি উদ্দেশ্য? কেনই বা একজন মিঃ শ্যাতানাকে খুন করতে উদ্যত হবে? হতে পারে তিনি কিঞ্চিৎ দাম্ভিক প্রকৃতির;একটু যেন কেমন কেমন! কিন্তু আমি যতদূর জানি, তেমন কিছু বিপজ্জনক ছিলেন না!….

চকিতের জন্যে কি মেরিডিথের শ্বাস প্রশ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো, হৃৎপিন্ডটা লাফিয়ে উঠল অতিমাত্রায়?

ব্ল্যাকমেলার বা এই ধরনের কিন্তু তিনি নন। ব্যাটেল বলে চললেন, তাছাড়া আপনাকে দেখেও মনে হয় না যে আপনার কোনো গোপন অপরাধ থাকতে পারে? পুরানো প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন। মিঃ শ্যাতানাকে অপছন্দ করবার মতো আপনার কোনো বিশেষ কারণ আছে?

হ্যাঁ…..অসংখ্য কারণ?

 হুঁ, সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল রীতিমতো স্তম্ভিত।

অপছন্দ করবার মতো অনেক কারণ আছে, তবে তাকে হত্যা করবার কোনো পরিকল্পনা আমার ছিল না। সহজ কণ্ঠে স্বীয় অভিমত ব্যক্ত করলেন মেজর ডেসপার্ড। অবশ্য তাঁর পশ্চাদ্দেশে ঝেড়ে একটা লাথি কষাতে পারলে আমি মনে মনে খুবই পরিতৃপ্তি লাভ করতাম। দুর্ভাগ্য, তার আগেই ভদ্রলোক ইহলোক থেকে সরে পড়লেন।

কেন আপনার মনে এমন বাসনার উদ্রেক হল?

কারণ তার স্বভাবটাই ছিল লাথি খাওয়ার উপযুক্ত। তাহলেই তিনি শায়েস্তা থাকতেন। ইদানীং তাকে দেখলেই আমার বুটের ডগাটা খুব নিসপিস করত।

তাঁর অপকীর্তি সম্বন্ধে আপনি কি জানেন যার জন্যে এমন বিজাতীয় ধারণার উদ্ভব?

তিনি বড্ড বেশি ভালো সাজপোশাক করতেন….মাথার চুলগুলোও ছিল বিশ্রী ধরনের লম্বা…তাছাড়া তার গা দিয়ে সর্বদা আতরের উগ্র গন্ধ বেরোত…

এ সত্ত্বেও তো আপনি নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতেন? ব্যাটেলের কণ্ঠে ক্ষুব্ধ জিজ্ঞাসা।

যদি আমাকে কেবল আমার পছন্দমতো লোকের বাড়িতেই নিমন্ত্রণ রাখতে যেতে হয় তাহলে ভবিষ্যতে আমার পক্ষে আর কোনো নিমন্ত্রণ রাখার সৌভাগ্যই হয়তো ঘটে উঠবে না।

আপনি সামাজিকতাকে পছন্দ করেন কিন্তু ঠিকমতো মানিয়ে নিতে পারেন না। সংশয়ের সুরে মন্তব্য করলেন ব্যাটেল।

হ্যাঁ, ঠিকই। মাঝে মধ্যে আমি এই সমস্ত গোলমাল হৈ-হট্টগোল পছন্দ করি। উজ্জ্বল মহিলা, দামি দামি পোশাক-পরিচ্ছদ, ঝকঝকে আলো, নাচ-গান, খাওয়া-দাওয়া, আমোদ ফুর্তি, হাসি-ঠাট্টা-সবই খুব ভালো লাগে। তারপরই এর কৃত্রিমতা দেখে আমার বমি এসে যায়। আমি অসুস্থ বোধ করি। তখনি আবার বনে জঙ্গলে, উদার প্রকৃতির উন্মুক্ত প্রান্তরে ফিরে যাবার জন্যে মনে মনে হন্যে হয়ে উঠি।

বনে-জঙ্গলে জীবন কাটানোও কম বিপজ্জনক নয়। আপনাকে নিশ্চয় খুব সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতে হয়?

ডেসপার্ড অবহেলা ভরে মৃদু হাসলেন। মিঃ শ্যাতানা নিশ্চয় বিপজ্জনক জীবন-যাপন করতেন না, তবু তিনি আজ মৃত আর আমি এখনও বেঁচে আছি।

আপনি যা ভাবছেন তার চেয়ে মিঃ শ্যাতানা হয়তো আরও বেশি বিপজ্জনক জীবনযাপন করতেন!

তার মানে?

এর ওর গোপন ব্যাপারে নাক গলানো মিঃ শ্যাতানার একটা স্বভাব ছিল।

আপনি বলছেন তিনি অপরের জীবনের লুকোনো খবর সংগ্রহ করে বেড়াতেন?

হ্যাঁ, সেই প্রকৃতির লোকই ছিলেন তিনি। অথবা কোনো নারীঘটিত ব্যাপারেও থাকতে পারেন তিনি।

মেজর ডেসপার্ডও অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলেন। আমার মনে হয় না কোনো মহিলাই তাকে তেমনভাবে পাত্তা দেবে।

ওসব কথা থাক। এঁদের মধ্যে কাকে আপনি হত্যাকারী বলে সন্দেহ করেন, মেজর ডেসপার্ড।

এ কাজ আমি করিনি। মিস মেরিডিথের দ্বারাও এ কাজ সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস হয় না। মিসেস লরিমারও যে এমন দুষ্কর্মে লিপ্ত হবে তা আমি কল্পনাতেও আনতে পারি না। তাকে দেখলে আমার এক ধর্মভীরু পিসির কথা মনে পড়ে যায়। অতএব একমাত্র ডাক্তার বার্টসই অবশিষ্ট থাকেন।

ব্রিজ খেলার সময় আপনার এবং অন্য সকলের গতিবিধির কথা কিছু স্মরণ করতে পারেন?

দু’বার মাত্র আমি আসন ছেড়ে উঠেছিলাম। একবার একটা অ্যাসট্রে আনবার জন্য। সেই অবসরে ফায়ারপ্লেসের আগুনটাও একটু উস্কে দিয়েছিলাম। আর একবার একপাত্র কড়া পানীয়ের প্রয়োজনে?

তখন আন্দাজ কটা হবে?

সঠিক বলতে পারব না। প্রথমবার তখন বোধহয় সাড়ে দশটা হবে। তার আধঘন্টা পরে দ্বিতীয়বার উঠেছিলাম। তবে সমস্তই অনুমানের ব্যাপার মিসেস লরিমার একবার উঠে আগুনের ধারে গিয়েছিলেন। সেই সময় মিঃ শ্যাতানার সঙ্গে তাঁর যেন কি কথাও হয়েছিল। তবে ভদ্রলোকের গলার স্বর আমি শুনতে পাইনি। কেন না, সেদিকে মনোযোগ দেবার মতো তখন অবসর ছিল না। শ্যাতানা হয়তো উত্তর দিয়ে থাকবেন। মিস মেরিডিথ একবার ঘরের চারধারে পায়চারি করছিলেন। তবে তাকে ফায়ারপ্লেসের ধারে কাছে আমি যেতে দেখিনি। ডাক্তার রবার্টস প্রায়ই তাঁর চেয়ার ছেড়ে উঠে যাচ্ছিলেন। অন্তত তিন চারবার তো হবেই।

আর একটা প্রশ্ন, আড়চোখে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন ব্যাটেল। ব্রিজ খেলোয়াড় হিসাবে এই তিন জনের সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

মিস মেরিডিথ বেশ ভালোই খেলেন। ডাক্তার রবার্টস বিপজ্জনকভাবে মাত্রাতিরিক্ত ডাক দিয়ে থাকেন। এর জন্যে তাঁর আরও বেশি ডাউন যাওয়া উচিত ছিল। মিসেস লরিমার সত্যিই একজন জাত খেলোয়াড়।

ব্যাটেল পোয়ারোকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি কি আর কিছু প্রশ্ন করতে চান?

পোয়ারো নেতিবাচক মাথা নাড়লেন। ডেসপার্ড সুপারিনটেনডেন্টকে তার ঠিকানা দিলেন। তারপর শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিলেন।

ভদ্রলোক চলে যেতেই নিজেই আসনে নড়েচড়ে বসলেন পোয়ারো। কি একটা বলতে গিয়েও থেমে বসলেন মাঝপথে।

কিছু যেন বলতে যাচ্ছিলেন মনে হচ্ছে?

তেমন কিছু নয়। পোয়ারোর কণ্ঠস্বরে শান্ত শীতলতা, আচমকা আমার মনে হল মেজর ডেসপার্ডের হাঁটা চলার ভঙ্গিতে কেমন একটা বাঘ বাঘ গন্ধ। কেমন সহজ, সাবলীল এবং মিশ্র।

হুঁ, ব্যাটেল কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। ভাসা ভাসা চোখে তাকালেন সকলের দিকে। এখন প্রশ্ন, ওদের মধ্যে কে এই অপকীর্তির নায়ক?

.

০৬.

 সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেলের চোখের দৃষ্টি একে একে প্রত্যেকের মুখের ওপর দিয়ে ঘুরে গেল। সবাই নির্বাক। কেবল একজনই উত্তর দিতে এগিয়ে এলেন। তিনি শ্রীমতী অলিভার। ভদ্রমহিলা কখনোই তাঁর ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হন না।

ওই মেয়েটা, আর না হয়তো ডাক্তার রবার্টস। শ্রীমতী অলিভারের কণ্ঠে কোনো দ্বিধা বা জড়তা নেই।

ব্যাটেল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অন্য দুজনের দিকে তাকালেন। তাদের কেউ কোনো মন্তব্য করতে আগ্রহ দেখালেন না। কর্নেল রেস উদ্দেশ্যহীনভাবে মাথা দোলাতে লাগলেন। পোয়ারো ব্রিজের দলা পাকানো স্কোরশীটগুলো সযত্নে ভাঁজ করতে ব্যস্ত।

শেষে ব্যাটেলই নীরবতা ভঙ্গ করলেন। এঁদের মধ্যেই কেউ একজন খুন করেছে তাতে কোনো দ্বিমত নেই, আর সেই নরকের পোকাটা ক্রমাগত মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু সে কে?…উত্তরটা খুব সহজ নয়, মারাত্মক রকমের জটিল।

 মিনিট দুয়েক সকলেই নির্বাক। তারপর ব্যাটেল আবার শুরু করলেন, যদি ওঁদের জবানবন্দী থেকে খুনির সন্ধান করতে যাই তাহলে দেখব ডাক্তারের অভিমতে ডেসপার্ডই খুনি। ডেসপার্ড আবার ডাক্তারকেই পুরোপুরি সন্দেহ করেন। মিস মেরিডিথ ভাবেন কাজটা মিসেস লরিমারের এবং মিসেস লরিমার এ প্রসঙ্গে একেবারেই মুখ খুলতে চান না। সমগ্র পরিস্থিতিটা খুবই অস্পষ্ট….।

অতটা বোধহয় নয়। পোয়ারোর গম্ভীর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হল।

ব্যাটেল চকিতে পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকালেন। আপনি কি কোনো পথের সন্ধান পেয়েছেন?

দ্বিধাগ্রস্তভাবে হাত নাড়লেন পোয়ারো। কেবল একটা ধোঁয়াটে ছায়া, এর বেশি কিছু নয়।

কিন্তু আপনারা দু’জনে তো আমার আগের প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না?

সুনির্দিষ্ট প্রমাণের একান্তই অভাব। সংযত কণ্ঠে বললেন কর্নেল রেস।

ওঃ, পুরুষরা সবাই এক ধাঁচের শ্রীমতী অলিভারের কণ্ঠ থেকে একরাশ ক্ষুব্ধ হতাশা ঝরে পড়ল। কেবল প্রমাণ আর প্রমাণ! তাছাড়া তারা যেন এক পাও চলতে জানেন না।

তাহলে এবার সম্ভাবনার কথা ধরা যাক। আলোচনায় মুখর হলেন ব্যাটেল। একটু থেমে নিজের বক্তব্যটাকে গুছিয়ে নিলেন। প্রথমে ডাক্তার রর্বাটসের কথা স্মরণ করুন ভদ্রলোককে সন্দেহ করার মতো যথেষ্ট কারণ আছে। বুকের ঠিক কোথায় আঘাত করলে সঙ্গে সঙ্গে অভিলাষিত ফল পাওয়া যাবে এটা তিনি বেশ ভালোই জানেন। কিন্তু এছাড়া তার বিরুদ্ধে অভিযান চালাবার মতো আমাদের হাতে আর কোনো অস্ত্র নেই। তারপর আসছেন মেজর ডেসপার্ড। ভদ্রলোকের মানসিক শক্তি খুবই সুদৃঢ়। চটপট সিদ্ধান্ত নিতেও তার জুড়ি নেই। তাছাড়া বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও তিনি অভ্যস্ত। মহিলাদেরও সন্দেহ করার মতো প্রচুর অবকাশ আছে। মিসেস লরিমারের নার্ভ ভীষণ শক্ত। হাভ-ভাব দেখলে মনে হয় ভদ্রমহিলার অতীত জীবনে কোনো গোপন রহস্য থাকা এমন কিছু বিচিত্র নয়। তিনি যে মানসিক অশান্তিতে ভুগছেন সে কথা তার চোখের মধ্যেই লেখা আছে। অপরপক্ষে তিনি একজন রীতিমতো আদর্শবাদী, স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার পদেই তাঁকে ভালো মানায়। তিনি কারো বুকে ছুরি বসাচ্ছেন এ-দৃশ্য কল্পনা করা কঠিন। প্রকৃতপক্ষে আমিও তা মনে করি না। সর্বশেষে মিস মেরিডিথ, তার সম্বন্ধে আমাদের বিশেষ কিছু জানা নেই, সাদামাটা সুন্দরী তরুণী। একটু যেন লাজুক লাজুক ভাব। তাহলেও একথা মনে রাখতে হবে, তার সম্বন্ধে আমরা বিশেষ কিছু জানি না।

কিন্তু আমরা এটা জানি যে পরলোকগত শ্যাতানার বিশ্বাস মেয়েটি কাউকে খুন করেছে। ধীরকণ্ঠে মন্তব্য করলেন পোয়ারো।

সুন্দর মুখ হল শয়তানের মুখোশ। শ্রীমতী অলিভারের গুন গুন শোনা গেল।

এ সমস্ত অবান্তর কথা আলোচনা করে আমরা কি কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারব? কনেল রেস সুপারিনটেনডেন্টের দিকে ফিরে তাকিয়ে অধৈর্য সুরে প্রশ্ন করলেন।

এ-ধরনের আলোচনায় কোনো লাভ নেই বলে ভাবছেন? কিন্তু এমন ক্ষেত্রে এ ধরনের আলোচনা অল্পবিস্তর হয়েই থাকে। তাকে আপনি বাধা দেবেন কি উপায়ে?

এর চেয়ে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের অতীত জীবন সম্বন্ধে খোঁজ খবরের চেষ্টা করলে ভালো হয় না? তাতে হয়তো কোনো সুফল পাওয়া যেতে পারে।

ব্যাটেল মৃদু হাসলেন। নিশ্চয়, নিশ্চয়! এ বিষয়ে তো আমরা যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাবই। আশা করি, আপনিও আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন?

আমি সর্বদা প্রস্তুত। কিন্তু কিভাবে আপনাদের কাজে আসতে পারি?

মেজর ডেসপার্ডের ব্যাপারে। তিনি বহুদিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। দক্ষিণ আমেরিকা, পূর্ব আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি নানা জায়গায়, এসব জায়গার খোঁজখবর জোগাড় করা আপনার পক্ষে খুব একটা কষ্টসাধ্য হবে না।

রেস মাথা নেড়ে স্বীকার করলেন, না, তবু খুব কষ্টসাধ্য নয়। আমি আপনাকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজখবর দিতে পারব।

আমার মাথায় চমৎকার একটা মতলব এসেছে। অতি উৎসাহের সুরে চেঁচিয়ে উঠলেন শ্ৰীমতী অলিভার। সত্যিই অভূতপূর্ব। এখানে আমরা চারজন উপস্থিত আছি। প্রত্যেকেই গোয়েন্দা বিভাগের ক্রিয়া-পদ্ধতির সঙ্গে কমবেশি জড়িত। আর ওঁরাও হলেন সংখ্যায় চারজন। আমরা প্রত্যেকেই যদি আমাদের সন্দেহভাজন এক-একজনের ওপর নজর রাখি, যেমন কর্নেল রেস মেজর ডেসপার্ডের খবর সংগ্রহ করবেন, সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল নেবেন ডাক্তার রবার্টসের দায়িত্ব, মাঁসিয়ে পোয়ারোর ওপর মিসেস লরিমারের ভার দেওয়া থাকবে। আমি না হয় মেরিডিথকে লক্ষ্য রাখব। প্রত্যেকেই আমরা নিজেদের পদ্ধতিতে কাজ চালিয়ে যাব।

ব্যাটেল দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়লেন। না, মিসেস অলিভার, এমন প্রস্তাবে আমি অন্তত রাজি হতে পারি না। বুঝতেই পারছেন, এ সব হল সরকারি ব্যাপারের কথা। এর মধ্যেই আমাকে চালাতে হবে। তাছাড়া আর একটা কথা, ব্যক্তি নির্বাচনেও আমাদের মধ্যে মতান্তর দেখা দিতে পারে। মাসিয়ে পোয়ারো হয়তো মনে করেন মিসেস লরিমার নির্দোষ। তেমন ক্ষেত্রে কে কার ওপর নজর রাখবে সেটাও একটা দারুণ সমস্যার ব্যাপার।

শ্ৰীমতী অলিভার হতাশ হলেন। কিন্তু প্ল্যানটা খুবই চমৎকার ছিল। তার কণ্ঠ বিষাদমন্থর, সত্যিই অপূর্ব প্ল্যান। তারপর আবার তিনি উৎসাহে চপল হয়ে উঠলেন। ঈষৎ আদুরে সুরে বললেন, আচ্ছা, আমি যদি আমার নিজস্ব পদ্ধতিতে কোনো অনুসন্ধান চালাই তাহলে নিশ্চয় আপনি বাধা দেবেন না?

না তাতে আমার খুব বেশি আপত্তি থাকবার কথা নয়। প্রকৃতপক্ষে এটা আমার আওতার বাইরে। আর যেহেতু আপনি আজকের পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন সেহেতু কৌতূহল নিবৃত্তির জন্য আপনি যা খুশি করতে পারেন। তবে আমি আপনাকে বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই এইসব খুনের মামলায় মাথা বাইরে থেকে না গলানোই ভালো।

কিন্তু আমি আমার তদন্তের ফলাফল বাইরের আর পাঁচজনের কাছে সম্পূর্ণ গোপন রাখব। এ-বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। দেখবেন, কোনো কথাই ফাঁস হয়ে যাবে না….দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে মাঝপথে থেমে গেলেন শ্রীমতী অলিভার।

সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল কিন্তু সে উদ্দেশ্য এমন একজনের সম্পর্কে তদন্ত করতে হবে আমরা যতদূর জানি ইতিমধ্যে অন্তত দুটো খুন সে করেছে। এবং প্রয়োজন উপস্থিত হলে তৃতীয় খুনের বেলাতেও তার হাত কাঁপবে না।

শ্রীমতী অলিভারকে কিছুটা চিন্তান্বিত মনে হল। তারপরই তিনি মৃদু হাসলেন। দুষ্ট শিশুর অবোধ হাসি। সেই চিরাচরিত গোয়েন্দা কাহিনির প্রতিধ্বনি, আপনাকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল, আপনাকে সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল?…ধন্যবাদ মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি যথেষ্ট সতর্ক হয়েই চলাফেরা করব। কিন্তু এ রহস্যের শেষ না দেখে আমি ছাড়ছি না।

পোয়ারো সসম্ভ্রমে মাথা দোলালেন। আপনি প্রকৃতপক্ষেই একজন তেজস্বিনী মহিলা। আমি মেনে নিচ্ছি, শ্রীমতী অলিভার নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন। যেন কোনো গুরুতর কমিটি মিটিংয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। এ সম্পর্কে যে সমস্ত খবর আমরা সংগ্রহ করব তা কখনোই নিজের কাছে গোপন রাখব না, সঙ্গে সঙ্গে সুপারিনটেনডেন্টকে জানিয়ে দেব। অবশ্য সেই সমস্ত ঘটনা থেকে আমার ধারণা বা সিদ্ধান্তের কথা অপরের কাছে ব্যক্ত করতে বাধ্য নই।

সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল মৃদু হাসলেন। এটা কোনো কাল্পনিক গোয়েন্দা কাহিনি নয়, মিসেস অলিভার রেসও ভদ্রমহিলার কথায় সায় জানালেন। সে তো নিশ্চয়, সমস্ত খবরই আমরা সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানিয়ে দেব। তারপর হাল্কা সুরে শ্রীমতী অলিভারের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কিন্তু যথার্থভাবে সত্যরক্ষা করবেন, মিসেস অলিভার। ভাঙা কাঁচের টুকরোর ওপর আঙুলের ছাপ বা পোড়া চিঠির অবশিষ্ট অংশ, এমন ধরনের প্রয়োজনীয় কিছু সংগ্রহ করলেই সেটা সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেলের হাতে তুলে দিতে দেরি করবেন না।

আপনি ঠাট্টা করতে পারেন, শ্রীমতী অলিভার ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, কিন্তু স্ত্রীলোকের অনুভূতি…..

কথাটা শেষ না করেই তিনি বিজ্ঞভাবে মাথা নাড়লেন।

দু’পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন কর্নেল রেস। ঠিক আছে, আমি ডেসপার্ডের ব্যাপারে যাবতীয় খোঁজখবর এনে দেব। তবে দু-চারদিন সময় লাগবে।…এছাড়া আর কোনো সাহায্যে আসতে পারি?

এতেই আমাদের অনেক উপকার হবে। অজস্র ধন্যবাদ। তবে আমি কি ধরনের খবরের সন্ধান করছি তা নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন?

সে বিষয়ে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। কোনো শিকার, দুর্ঘটনা বা ওই জাতীয় কোনো কিছুর সঙ্গে ভদ্রলোক জড়িত ছিলেন কিনা এই তো?

ব্যাটেল মৃদু হাসলেন। কর্নেল রেস ঘুরিয়ে সকলের কাছ থেকে একে একে বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন।

ভদ্রলোকটি কে? শ্রীমতী অলিভার আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারলেন না।

সেনা-বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী। প্রচুর ঘুরে বেরিয়েছেন। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই যেখানে তার পায়ের ছাপ পড়েনি।

আমি তাহলে ঠিকই আন্দাজ করেছিলাম। উনি সিক্রেট সার্ভিসের লোক। শ্রীমতী অলিভারের চোখে দুষ্টুমির হাসি। অবশ্য যদিও আপনি আমার কাছে সে কথা স্বীকার করবেন না, কিন্তু তাছাড়া কেনই বা মিঃ শ্যাতানা আজ রাতে তাকে ডিনারের নিমন্ত্রণ জানাবেন? চারজন খুনি আর চারজন গোয়েন্দা। একজন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের, একজন সিক্রেট সার্ভিসের, একজন বেসরকারি আর একজন কাল্পনিক রহস্য উপন্যাসের…পরিকল্পনাটার মধ্যে রীতিমতো বাহাদুরি আছে।

পোয়ারো বাধা দেবার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। আপনি ভুল করছেন ম্যাডাম, মস্ত ভুল করছেন। আসলে কাজটা সত্যিই খুব বোকার মতো হয়েছে। বাঘকে খোঁচা মেরে জাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন তারা খুব ভালো লাফাতে পারে।

বাঘ? কেন বাঘ বলছেন কাকে? বাঘ বলতে আমি খুনিকেই বোঝাতে চাইছি।

ব্যাটেল হঠাৎ কথার মাঝখানে বলে উঠলেন, আপনার কি ধারণা মঁসিয়ে পোয়ারো? কোন পথে এগোলে এ রহস্যের হদিশ মিলবে বলে মনে হয়? আর একটা কথা, এই চারজনের মানসিক গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধেই বা আপনি কি অভিমত পোষণ করেন? এ নিয়ে তো অনেক ভাবনাচিন্তা করছিলেন।

পোয়ারো তখনও হাত দিয়ে দোমড়ানো স্কোরশীটগুলো সোজা করতে ব্যস্ত। বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন মনস্তত্ত্বই হচ্ছে আসল। খুনটা কি প্রকৃতির এবং কেমনভাবেই বা সংঘটিত হয়েছে তা আমরা জানি। এখন যদি এমন কোনো প্রমাণ পাই, একজন লোক তার বিশেষ মানসিক গঠনের জন্য এই প্রক্রিয়ায় খুন করতে পারে না তখন আমরা অনায়াসে তাকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারি। আজ রাতে নিমন্ত্রিত অতিথিদের চরিত্র সম্পর্কে আমরা কিছু কিছু জানি। এদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পর প্রত্যেকের সম্বন্ধে আমাদের একটা ধারণা জন্মেছে। এদের কার কি রকম মনোভাব তাও আমরা এখন কিছুটা আঁচ করতে পেরেছি। প্রত্যেকের ব্রিজ খেলার বৈশিষ্ট্য থেকেও আমরা তাদের মানসিক গঠনের ইঙ্গিত পাই। হাতের লেখা এবং স্কোর রাখার ধরণও চরিত্রের গভীরে পৌঁছাবার একটা চাবিকাঠি, কোনো স্বচ্ছ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেও বিশেষ সাহায্য করে না। এই হত্যার ব্যাপারে দুটি জিনিস খুবই স্পষ্ট। প্রথমতঃ মনের জোর অসাধারণ। দ্বিতীয়তঃ আত্মম্ভরিতাও তার বিপুল। এমন একজন লোক যে চরম ঝুঁকি নিতেও পেছপা হয় না। এবার ডাক্তার রবার্টসের ব্রিজ খেলার বৈশিষ্ট্যের কথা চিন্তা করুন। ভদ্রলোক ভাওতা দিতে ওস্তাদ। মাত্রাতিরিক্ত ডাক দেন। তার অর্থ নিজের ওপর তার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। বিপদে পড়লে ঝক্কি সামলাতে পারবেন। মনস্তপ্ত এই অপরাধটার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। আবার এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে সন্দেহজনক ব্যক্তির তালিকা থেকে প্রথমেই মিস মেরিডিথের নাম বাদ পড়বে। তিনি একটু ভীতু স্বভাবের। সাবধানে হিসেব করে ডাক দেন। আত্মবিশ্বাস বা মনের জোরও তার কম। তিনি এমন একটা খুনের ঝুঁকি নেবেন একথা চিন্তা করা যায় না।

কিন্তু আর একটা দিকও ভাববার আছে। নার্ভাস স্বভাবের লোক ভয় পেলেও সাংঘাতিক বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। ভয়ে কান্ডজ্ঞান হারিয়ে তারা তখন খুন করতে পারে। ইঁদুর জাঁতাকলে পড়লে যেমন মরিয়া ভাব ধারণ করে তাদেরও সেই অবস্থা। যদি মিস মেরিডিথ অতীতে কোনো খুন করে থাকেন এবং বুঝতে পারেন মিঃ শ্যাতানাও দৈবক্রমে তা জানতে পেরেছেন এবং ভদ্রলোক অচিরেই সে কাহিনি সকলের কাছে প্রকাশ করে দিতে যাচ্ছেন তখন ডুবন্ত মানুষ যেমন সামান্য খড়কুটো অবলম্বন করেও ভেসে থাকতে চেষ্টা করে তিনিও তেমনিভাবে মিঃ শ্যাতানাকে খুন করে নিজেকে বাঁচাতে চাইবেন। সেক্ষেত্রে ফলাফলটা একই থাকবে শুধু ভিন্ন প্রতিক্রিয়া থেকে জাত, এইমাত্র! ঠান্ডা মাথায় শক্ত হাতের খুন নয়, আতঙ্কে উন্মত্ত হয়ে এমন কাজ সে করতে বাধ্য হবে। তারপর মেজর ডেসপার্ড। চিন্তাশীল আত্মবিশ্বাসী মানুষ বিপদে পড়লে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা তার স্বভাব নয়। অপরিহার্য মনে করলে যেকোনো রকমের ঝুঁকি নিতে তিনি প্রস্তুত। সবশেষে মিসেস লরিমার। বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি হলেও প্রখর বুদ্ধিমতী। স্বভাব বেশ শান্ত। অঙ্কের মতো সবকিছু হিসেব করে চলেন। তাঁর বুদ্ধি অন্য জিনের থেকে অনেক বেশি। তিনি যদি কোনো অপরাধ করতে উদ্যত হন তবে ভেবে চিন্তেই অগ্রসর হবেন। এবং তার পরিকল্পনার মধ্যে কোথাও কোনো ফাঁক আছে কিনা খুঁটিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে দেখে নেবেন। সেইজন্য আজকের খুনটা তাঁর পক্ষে না করাই সম্ভব। তবে ভদ্রমহিলার ব্যক্তিত্ব আছে। যদি কিছু করব বলে মনে করেন সে কাজ সুচারুরূপেই সম্পন্ন করবেন। দক্ষ স্ত্রীলোক বলতে যা বোঝায় মিসেস লরিমার তার উজ্জ্বলতম নিদর্শন।

পোয়ারো খানিক দম নিয়ে আবার শুরু করলেন, তাহলে দেখতে পাচ্ছেন এ-বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে আমরা বেশি লাভবান হব না। আমাদের সামনে এখন মাত্র একটা পথই খোলা আছে তা হচ্ছে অতীত। এই অতীতের গোপন আবরণ উন্মোচন করতে পারলে তবেই আমরা সত্যের সিংহ দরজার সন্ধান পাব।

ব্যাটেল বিড়বিড় করলেন, একথা আপনি আগেও বহুবার বলেছেন।

গৃহস্বামী মিঃ শ্যাতানার মতে এঁদের প্রত্যেকের হাতই কোনোনা কোনো খুনের রক্তে কলঙ্কিত। প্রত্যেকেই খুনি। তিনি কি সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই এমন সিদ্ধান্ত করেছিলেন, না এটা তার নিছক একটা ধারণা মাত্র? এখন আর এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। তবে প্রতিক্ষেত্রেই তাঁর হাতে প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছিল এটাও ঠিক বিশ্বাস করা শক্ত।

এ-বিষয়ে আমিও আপনার সঙ্গে একমত। ব্যাটেল মাথা নেড়ে সায় দিলেন। চারজনের প্রত্যেকেই খুনি আর প্রত্যেকটা প্রমাণই তার হাতের মুঠোয়, এতটা ভাবাও বাড়বাড়ি।

আমার মনে হয়, এমনটা সম্ভব। তিনি হয়তো একজনকে খুনি বলে সন্দেহ করেছিলেন কিন্তু ঠিকমতো প্রমাণ পাচ্ছিলেন না। তখন সমবেত অতিথিবৃন্দের মাঝখানে গল্পচ্ছলে সেই বিশেষ ধরনের খুনের প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করলেন। মিঃ শ্যাতানার দৃষ্টি ছিল খুবই তীক্ষ্ণ। অতিথিদের মধ্যে, এই গল্প শুনে কার কি প্রতিক্রিয়া ঘটছে তিনি সমস্ত নজর রাখতেন। কারোর হয়তো একবার চোখের পলক পড়ল, কেউ বেশি মাত্রায় গম্ভীর হয়ে গেলেন, কেউ আবার প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, সবই তার লক্ষ্য থাকত। ব্যাপারটা খুব শক্ত নয়। আপনি যদি কোনো বিষয়ে কাউকে সন্দেহ করেন তখন একটু চালাকির আশ্রয় নিয়ে অনায়াসে সন্দেহভঞ্জন করতে পারেন। উদ্দেশ্যহীনভাবে ছুঁড়ে দেওয়া আপনার প্রতিটি কথাতেই প্রকৃত অপরাধী মনে মনে বিচলিত হয়ে উঠবে।

মিঃ শ্যাতানা নিশ্চয় এ ধরনের লুকোচুরি খেলা খুব পছন্দ করতেন। ব্যাটেলের কণ্ঠে। তীব্র ব্যঙ্গের ভঙ্গি।

আমরা ধরে নিতে পারি একটা বা দুটো ক্ষেত্রে তাকে হয়তো এই ধরনের চালাকির আশ্রয় নিতে হয়েছিল তবে অন্য ক্ষেত্রে তিনি নিশ্চয় সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। তবে পুলিশের হাতে তুলে দেবার মতো জোরালো কোনো প্রমাণ তার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল কিনা এ বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

পরিস্থিতিটা খুব জটিল। বিমর্ষ কণ্ঠে ব্যাটেল বললেন, অনেক সময় আমরা কোনো গন্ডগোলের ব্যাপারে আঁচ করতে পারি, বুঝতে পারি কেউ কোনো চালাকি খেলে চলেছে, কিন্তু তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া প্রায়শই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। তবে এক্ষেত্রে এগোবার মতো একটা পথ আমাদের সামনে খোলা আছে। এই চারজনের অতীত জীবনের ইতিহাস সংগ্রহ করতে হবে। দেখতে হবে কোথাও কোনো অপঘাত মৃত্যুর সঙ্গে এঁদের কেউ জড়িত কিনা। ডিনারের আসরে মিঃ শ্যাতানা কি বলেছিলেন নিশ্চয় স্মরণে আছে?

হ্যাঁ, একজন ডাক্তারের পক্ষে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা কত সোজা, অনায়াসে ব্যাপারটাকে দুর্ঘটনা বলে চালানো যায়। শিকারে গিয়েও ভ্রমবশত একজন তার সঙ্গীকে খুন করতে পারে। ঘটনাটা সত্যিই ভ্রমবশত না ইচ্ছাকৃত বাইরে থেকে বুঝে ওঠা কঠিন।.এই সমস্ত মন্তব্যের মাধ্যমেই হয়তো শ্যাতানা তাঁর মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করেছিলেন।

সেই সময় ভদ্রলোকের মুখের ভাবও কেমন ভয়াবহ হয়েছিল। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে সভয়ে মন্তব্য করলেন শ্রীমতী অলিভার।

মিঃ শ্যাতানার রকম সকম দেখে কেউ হয়তো ধরে নিয়েছিল, ভদ্রলোক তার সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানেন। তার গোপন অপরাধের সমস্ত প্রমাণ শ্যাতানার হাতে মজুত আছে। তিনি এখন খুনিকে নিয়ে ইঁদুরের মতো খেলা করছেন। আসর ভাঙলে সাক্ষী প্রমাণসহ পুলিশের জিম্মায় তুলে দেবেন।…হা ঠিকই, তিনি যে তখনই তার মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করলেন এতে আর কোনো ভুল নেই।

ক্ষণকাল সকলেই নীরব রইলেন। এই মামলাটা অনেক দিন গড়াবে। ব্যাটেলের কণ্ঠে ক্ষুব্ধ অভিযোগ, অনেক ঝামেলা দেখা দেবে মনে হচ্ছে। প্রয়োজনীয় তথ্যাদি কিছুই প্রায় হাতের কাছে নেই। আমাদের খুব সাবধানে পা ফেলে এগোতে হবে। আমরা কি ভাবছি বা করছি কিছুই ওদের জানতে দেওয়া চলবে না। আর সবচেয়ে দুঃসাধ্য কাজ হচ্ছে চারজন সম্ভাব্য খুনির অতীত ইতিহাস সংগ্রহ করা। একজন দু’জন হলে তবু না হয় চেস্টা করে দেখা যেত।

গৃহস্বামী শ্যাতানাও হয়তো সম্পূর্ণ অভ্রান্ত নন। পোয়ারোর কণ্ঠস্বরে অকপট গাম্ভীর্য, বললেন, তিনিও কোনো ভুল করে থাকতে পারেন।

চারজনের সম্বন্ধেই? না, না তাকে অতটা বোকা মনে করবার কোনো কারণ নেই। তবে কোনো বিশেষ একজনের সম্পর্কে ভুল করাটা খুব বিচিত্র নয়।

আপনি বলতে চান চার জনের মধ্যে একজন নির্দোষ?…পরিস্থিতিটা সত্যিই খুব ঘোরালো হয়ে দাঁড়াল দেখছি। আর সবচেয়ে মুশকিলের ব্যাপার হল, যদি এদের অতীত জীবন ঘেঁটে আমরা কোনো গোপন অপরাধের হদিশ খুঁজে বার করতে পারি তাহলেও এই মামলার সমাধানে সেটা বিশেষ ফলপ্রসূ হবে না। তর্কের খাতিরে না হয় ধরেই নিলাম কেউ তার ঠাকুমাকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে খুন করেছে, কিন্তু এতদিন বাদে আজ তার মূল্য কি?

তার মূল্য একেবারেই ফুরিয়ে গেছে বলে মনে করবেন না। উৎসাহের সুরে বললেন পোয়ারো, আমার মতো আপনিও সে কথা ভালো করেই জানেন।

আপনার বক্তব্য আমি বুঝতে পারছি। ব্যাটেল মুখ তুলে তাকালেন। এক্ষেত্রেও খুনি তার পুরোনো পদ্ধতিই অনুসরণ করবে।

শ্রীমতী অলিভার আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। আপনি কি বলতে চান আগের বারও খুনি কাউকে ছুরিকাঘাতে খুন করেছে?

সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল মাথা নাড়লেন। ছুরিকাঘাতই যে হতে হবে এর কোনো মানে নেই তবে ধরণটা প্রায় একই থাকে। বিভিন্ন পরিবেশে হলেও দুয়ের মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। ভাবতে অবাক লাগে, কিন্তু অনেক সময় মাত্র এইটুকু সূত্র ধরেই আমরা প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হই।

মানবপ্রকৃতির মধ্যে মৌলিকত্বের একান্তই অভাব। দার্শনিক ভঙ্গিতে মন্তব্য করলেন পোয়ারো।

শ্ৰীমতী অলিভার প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলেন। বললেন, মহিলাদের কথা সম্পূর্ণ আলাদা কেবল তারাই নিত্য নতুন উপায় অবলম্বন করতে পারে।

আমি কখনো একই পদ্ধতিতে দুবার খুন করব না।

আপনি কি ম্যাডাম এই প্লটকে ভাঙিয়ে দুবার কোনো গল্প লেখেননি? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফিরে তাকালেন ব্যাটেল।

পদ্মপাতায় খুন আর একটুকরো মোম। মৃদু কণ্ঠে বিড়বিড় করলেন পোয়ারো।

শ্ৰীমতী অলিভার বিস্ফারিত দৃষ্টিতে পোয়ারোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সে দৃষ্টিতে বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশংসাও মিশ্রিত ছিল।

সত্যিই আপনার ক্ষমতা অসাধারণ। এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পৃথিবীতে দুর্লভ…হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি একই চিন্তাধারা থেকে কাহিনি দুটোর উৎপত্তি। কিন্তু আজ পর্যন্ত অন্য কেউই আমার কাছে এপ্রসঙ্গ উল্লেখ করনি। তারা কেউ এটা ধরতেই পারেনি। প্রথমটা হচ্ছে একটা মূল্যবান সরকারি দলিল চুরিকে কেন্দ্র করে। এক জমকালো সান্ধ্য ভোজের আসরে বিভিন্ন মন্ত্রীমহোদয় এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীরা উপস্থিত হয়েছেন, তার মাঝখান থেকে দলিলটা চুরি গেল। যার কাছে জিনিসটা গচ্ছিত ছিল। তিনিই সকলের চোখে ধুলো দেবার জন্য এই নকল চুরির আয়োজন করেছিলেন। আর দ্বিতীয়টার কাহিনি সংস্থাপন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে। বোর্ণিওর এক রাবার বাগানের মালিক তার নিজের বাংলোর মধ্যে নিহত হলেন। আসলে তিনি নিজে আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু একজনের প্রতি আক্রোশবশত এমনভাবে আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেন যাতে সকলের ধারণা হয় তিনি খুন হয়েছেন এবং ওই বিশেষ একজনই হত্যাকারী। প্রকৃতপক্ষে দুটো প্লটের উৎস একই। দুজনেই আর পাঁচজনের চোখে ধুলো দেবার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে নকল ধোয়ার সৃষ্টি করেছেন এমন সময় রঙ্গমঞ্চে তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব। তিনিই সমস্ত জটিল রহস্যের সাবলীল সমাধান করে দিলেন।

আমি আপনার শেষ বইটা পড়েছি, মৃদুকণ্ঠে ব্যাটেল বললেন। খুবই চিত্তাকর্ষক। একের পর এক হোমরা চোমরা পুলিশ অফিসাররা যখন খুন হতে লাগলেন তখন জটিল রহস্যের সাবলীল সমাধান করে দিলেন।

শ্রীমতী অলিভার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে উঠলেন। সত্যি বলতে কি, নিভীকতার জন্য আমি এক মুহূর্তও মাথা ঘামাই না। আজকের দিনে কে নির্ভুল খুঁজে বার করতে পারেন? একটাও পাবেন না। যদি কোনো রিপোের্টার খবর পাঠায় যে বাইশ বছরের তরুণী তার প্রিয় পিকনিজ কুকুরটাকে কোলে করে নিয়ে সমুদ্রের দিকে চোখ তুলে ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে আত্মহত্যা করেছে তখন কি কেউ পরীক্ষা করে দেখতে যায় যে সত্যিই তার বয়স বাইশ না আঠাশ? ঘরটা থেকে সমুদ্র দেখা যায় কিনা, অথবা কুকুরটা পিকনিজ না টেরিয়ার? যদি একজন রিপোর্টর অনায়াসে এমন খবর কাগজে প্রকাশ করতে পারে তখন আমার বিবরণেও দু-চারটে ভুলচুক হতে বাধা কোথায়? রহস্য উপন্যাসে প্রধান প্রয়োজন হচ্ছে দু-চারটে রক্তমাখা মৃতদেহের। যদি দেখেন গল্পটি ক্রমশই বড় একঘেয়ে হয়ে আসছে তখন জায়গা বুঝে দু-একটা নতুন মৃতদেহের আমদানি করুন। যখন কেউ কোনো গোপন খবর ব্যক্ত করে দেবে বলে মনস্থ করেছে এমন সময় সে নিহত হল। দেখবেন গল্প আপনার তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের কাহিনিগুলো খুবই ভালো জমে। পাঠকেরা রুদ্ধনিশ্বাসে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করে।

আমার প্রায় সমস্ত উপন্যাসেই এমন ঘটনা ঘটে। তিনি বলতে লাগলেন, সবটাই লোক ঠকানো ব্যাপার। তবে ভিন্ন ভিন্ন মোড়কে পরিবেশন করা হয়, এই যা। এ পর্যন্ত মোট বত্রিশটা উপন্যাস লিখেছি, সকলেরই এক ধাঁচের চরিত্র। কিন্তু কেউ তা ধরতে পারেনি। একমাত্র মঁসিয়ে পোয়ারো যা ব্যতিক্রম। তবে মুশকিলটা বেধেছে আমার গোয়ন্দাকে নিয়ে। ভদ্রলোক ফিনল্যান্ডের অধিবাসী। আর এই দেশটা সম্বন্ধে আমার একেবারেই কোনো ধারণা নেই। তাদের স্বভাব প্রকৃতি ও আচার ব্যবহার সমস্তই আমার অজানা। তার ফলে দু-একটা ভুলভ্রান্তি হয়ে যায়। এজন্য প্রায়ই ফিনল্যান্ড থেকে আমি প্রতিবাদ পত্র পেয়ে থাকি। ওখানকার লোকেরা বোধ হয় গোয়েন্দা কাহিনির একনিষ্ঠ পাঠক। বালগেরিয়া বা রোমানিয়ায় এসব বইয়ের তেমন কাটতি নেই। তারা অতটা সচেতনও নয়। আমার গোয়েন্দা এইসব কোনো দেশে জন্মালেই ভালো করত।

শ্রীমতী অলিভারের হঠাৎ খেয়াল হল সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছেন। তিনি মনে মনে বিব্রতবোধ করলেন। বিনীত ভঙ্গিতে বাস্তবিক পক্ষে এটা যে একটা জীবন্ত হত্যাকান্ড সেকথা স্মরণ ছিল না।

এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপরই তাঁর দু’চোখে আর এক নতুন ভাবনার উদ্ভব হল। আচ্ছা, যদি এমন হয় যে এই চারজনের মধ্যে কেউই মিঃ শ্যাতানার হত্যাকারী নয়। ভদ্রলোকই প্ল্যান করে চারজন খুনিকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এলেন, তারপর মজা দেখার জন্য শান্ত মস্তিষ্কে আত্মহত্যা করলেন!…..।

মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন পোয়ারো। সমাধানটার মধ্যে একটা অপূর্ব অভিনবত্ব আছে। আপনার কল্পনা শক্তির ভূয়সী প্রশংসা না করে পারা যায় না। কিন্তু মিঃ শ্যাতানা আত্মহত্যা করার মতো মানুষ নন। জীবন তার কাছে পরম প্রিয় বস্তু।

তবে ভদ্রলোক যে ভালো লোক ছিলেন না সে কথাটাও অস্বীকার করার উপায় নেই।

না, তা নেই। পোয়ারোর কণ্ঠস্বর জলভরা মেঘের মতো গম্ভীর। তিনি মোটেই ভালো লোক ছিলেন না। তাহলেও তো তিনি ছিলেন জীবিত। এখন মৃত….নিহত। আর খুনিদের সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত, একথাটা তাঁকেও একবার বলেছিলাম। এখনও পর্যন্ত আমি সেই অভিমতই পোষণ করি।

একটু থেমে বাকিটা শেষ করলেন পোয়ারো। আর সেইজন্যই বাঘের খাঁচার মধ্যেও আমি যেতে প্রস্তুত…আমি যাব।

.

০৭.

সুপ্রভাত সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল। ডাক্তার রবার্টস অমায়িক সৌজন্যে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সামনের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর হাতের তালুতে এখন কার্বলিক সাবানের ম্লান গন্ধ জড়িয়ে আছে। আপনার তদন্ত কেমন এগোচ্ছে? খুনি ধরা পড়বে তো?

ব্যাটেল সুদৃশ্য সোফাকৈাচ সম্বলিত ঘরের চারধারে একবার নজর বুলিয়ে নিলেন। তারপর একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললেন, সত্যি কথা বলতে কি ডাক্তার, রবার্টস, এখনও আমরা এক পাও এগোতে পারিনি। যেখানে ছিলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি।

হ্যাঁ, সান্ধ্যভোজের আসরে গৃহস্বামী মিঃ শ্যাতানা আকস্মিক ভাবে মারা গেছেন। কেবল এই খবরই আপাতও পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পোস্টমর্টেম রিপোর্টও আমাদের হাতে এসে পৌঁচেছে। হয়তো আপনার কৌতূহল জাগতে পারে, সেইজন্যে সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বার করে ডাক্তার রবার্টসের দিকে এগিয়ে দিলেন। ডাক্তার রর্বাটস সেটা হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করলেন।

ভদ্রলোকের সলিসিটরের সঙ্গেও আমরা তার উইলের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি, মনে হয় সিরিয়ায় মিঃ শ্যাতানার এক আত্মীয় থাকেন। দানপত্রে তাঁর নামোল্লেখ আছে। তাছাড়া ভদ্রলোকের ব্যক্তিগত কাগজপত্র আমরা ঘেঁটে দেখেছি।

ক্ষণিকের জন্য রবার্টসের হাস্যোজ্জ্বল মুখের ওপর যেন একটা কালো ছায়া খেলে গেল। অথবা সেটা চোখের ভুলও হতে পারে। সেখান থেকে কিছু পাওয়া গেছে?

আশাব্যঞ্জক কিছুই না। হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন ব্যাটেল। তবে তাঁর তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি স্থিরভাবে রবার্টসের মুখের ওপরেই নিবদ্ধ!

ডাক্তার রবার্টস আবার সহজ হয়ে উঠলেন। চোখেমুখে সহজাত পেশাদারি প্রশান্তি। কণ্ঠে কৌতুকের ছোঁওয়া। বললেন, আর সেইজন্যেই কি সাত-সকালে একেবারে আমার চেম্বারে এসে হানা নিয়েছেন?

সুপারিনটেনডেন্টের কাছ থেকে তেমন সাড়া পাওয়া গেল না। তিনি আগের মতোই স্বল্পবাক। রবার্টস নিজেকে সংযত করে নিলেন। ব্যাটেলের দিকে চোখ তুলে প্রশ্ন করলেন আমার কাগজপত্রও নিশ্চয় আপনি পরীক্ষা করে দেখতে চাইবেন?

সেইরকমই মনোগত বাসনা বলতে বলতে ব্যাটেল মাথা নাড়লেন। কোনো সার্চ ওয়ারেন্ট আছে?

না।

তবে সেজন্য আমি আপনাকে বাধা দেব না। সেটা আমার সাধ্যাতীত। কেন না, সার্চ ওয়ারেন্ট বার করা আপনার পক্ষে খুবই সহজ। অবশ্য নিজেকে সম্ভাব্য খুনির তালিকায় ভাবতে মনটা স্বভাবতই সঙ্কুচিত হয়ে আসে। কিন্তু আপনাদের কাজে সহায়তা করাও তো প্রত্যেক সৎ নাগরিকেরই কর্তব্য।

অজস্র ধন্যবাদ। ব্যাটেলের ঠোঁটের ফাঁকে অমায়িক সৌজন্যের হাসি। আপনার কর্তব্যবোধকে সম্ভ্রম না জানিয়ে পারা যায় না। আশা করি অপর সকলেও এই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হবেন।

হ্যাঁ, যাকে নিরাময় করা যাবে না তাকে নির্মূল করাই ভালো। এটাই আমার অভিমত। আবার প্রাণবন্ত হয়ে উঠলেন ডাক্তার রবার্টস। বললেন, এইমাত্র চেম্বারের রুগি দেখা শেষ করলাম। এখন আমার কলে বেরোবার কথা। আমি না হয় এখানকার আলমারি বা ড্রয়ারের সব চাবি আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি। আমার সেক্রেটারিকেও জানিয়ে দিচ্ছি সেকথা। প্রয়োজন হলে তার সাহায্য নিতে পারেন।

খুবই ভালো কথা। আপনার রোগী দেখার কাজে আমি কোনো বাধা দিতে চাই না। তবে তার আগে গোটা কয়েক প্রশ্ন করব। আশা করি যথাযথ উত্তর দেবেন।

সেদিন রাত্রের ঘটনা সম্পর্কে কি কোনো জিজ্ঞাসা আছে? কিন্তু সে বিষয়ে আমি যা জানি তার সমস্তই তো আপনাদের কাছে খুলে বলেছি।

না, সেদিন রাত্রের কোনো ঘটনা নয়। আমার আজকের প্রশ্ন আপনার নিজের সম্পর্কে। বেশ, কি জানতে চান বলুন?

আপনার ব্যক্তিগত জীবন, আপনার জন্ম, আপনার বিবাহ….এই আর কি।

রবার্টস সোজা হয়ে বসলেন। তারপর শুরু করলেন ছোট বেলায় আমি স্নোভিউ হোটেলে থেকে লেখাপড়া করতাম। বাবা ছিলেন একটা ছোট মফস্বল শহরের একজন সাধারণ ডাক্তার। আমার পনেরো বছর বয়েসের সময় তিনি মারা যান। দু’বছর বাদে মাও গত হলেন। বাবার দেখাদেখি মেডিক্যাল লাইনই বেছে নিলাম।

আপনার অন্যান্য ভাইবোন….? আমিই তাদের একমাত্র সন্তান। এখন অবিবাহিত। ডাক্তারি পাশ করার পর প্রথমে প্রবীণ ডাক্তার এমারির সঙ্গে পার্টনারশিপে এই চেম্বারে রুগি দেখার সুযোগ পাই। বছর পনেরো আগে তিনি ডাক্তারি থেকে অবসর নিয়েছেন। বর্তমানে আয়াল্যান্ডে থাকেন। তার ঠিকানাও আমার ডায়েরিতে লেখা আছে। চাকর বাকর বলতে একজন বাবুর্চি, একজন বেয়ারা আর এক বুড়ি ঝি। এরা সকলেই আমার কোয়ার্টারে থাকে। চেম্বারের কাজে সাহায্য করবার জন্য একজন তরুণী সেক্রেটারি আছেন। সকাল আটটার মধ্যেই তিনি হাজির হন। ডাক্তারিতে আমার আয় বেশ ভালোই। রুগিরাও সকলে অবস্থাপনন্ন ঘরের। আর খুব বেশি কারণ উপস্থিত না হলে সচরাচর কেউ মারা যান না। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেলের দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে কথাটা শেষ করলেন। রবার্টস এই হচ্ছে আমার সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত।

এবার ব্যাটেলও সে হাসিতে যোগ দিলেন। আপনার কথায় না হেসে পারা যায় না। আর একটা প্রশ্ন, আপনি তো অনেক বছর এই শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। সেই সূত্রে বহু সম্ভ্রান্ত লোকের সঙ্গেও নিশ্চয় আলাপ পরিচয় হয়েছে। এমন চারজন লোকের নাম বলুন তো, যারা আপনার বিশেষ পরিচিত ও আপনার সম্বন্ধে খোঁজ খবর দিতে পারবেন।

হ্যাঁ, আমি বুঝতে পেরেছি, ডাক্তার রবার্টর্স মনে মনে অল্প চিন্তা করে টেবিল থেকে লেখার প্যাডটা টেনে নিলেন। পকেট থেকে কলম বার করতে করতে প্রশ্ন করলেন, যাঁরা বর্তমানে এ শহরের বাসিন্দা, আপনি কি তাদের কথাই বলতে চাইছেন?

না না, তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে স্থানীয় বাসিন্দা হলে আমাদের তদন্তের পক্ষে সুবিধা হয়।

ডাক্তার রবার্টস সবালীল ভঙ্গিমায় প্যাডের পাতায় চারজনের নাম-ঠিকানা লিখে কাগজটা ব্যাটেলের দিকে এগিয়ে দিলেন। ব্যাটেল একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন তার ওপর। তাকে বেশ সন্তুষ্টই মনে হল।

এতেই আমার কাজ চলে যাবে…আসলে সন্দেহজনক সকলকেই আমরা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখি। যত তাড়াতাড়ি এই পরীক্ষার ঝামেলা চুকিয়ে নিজেকে নির্দোষ বলে প্রমাণিত করা যায় ততই মঙ্গল। এর ফলে একএকজন করে বাছাই হতে হতে এক সময় আসল অপরাধীর গায়ে হাত পড়ে। সেই জন্য আগে আমাকে সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হতে হবে যে আপনার সঙ্গে মিঃ শ্যাতানার কোনো খারাপ সম্পর্ক ছিল না। ব্যক্তিগত জীবনে আপনারা দুজনে দুজনের অপরিচিত। অবশ্য আপনার মুখের কথা আমি বিশ্বাস করি, কিন্তু আমার নিজের বিশ্বাসই সব নয়। প্রত্যক্ষ প্রমাণ চাই।

অত বিষদভাবে বুঝিয়ে বলবার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার অবস্থা আমি উপলব্ধি করতে পারছি। প্রকৃত প্রমাণ না পাবার আগে কোনো কথাকেই সত্যি বলে বিশ্বাস করা পুলিশি আইনের রীতি নয়। এই রইল আমার চাবির গোছা। এটা দেরাজের চাবি, আর ওই ছোট চাবিটা বিষের আলমারির। দরকার হলে সবকিছু পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। তবে কাজ শেষ হলে আলমারির চাবিটা যেন বন্ধ করতে ভুলবেন না। আমার সেক্রেটারিকেও আপনাকে সাহায্য করার জন্য বিশেষ নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি।

হাত বাড়িয়ে কলিং বেলের বোতাম টিপলেন ডাক্তার রবার্টস। অনতিবিলম্বে দরজা ঠেলে এক ছিমছাম সুবেশা তরুণী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তাঁর সঙ্গে ব্যাটেলের আলাপ করিয়ে দিলেন তিনি। মিস বার্জেস, ইনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল।…

শ্ৰীমতী বার্জেস বড় বড় চোখ তুলে ব্যাটেলের দিকে ফিরে তাকালেন। তার দৃষ্টি দেখে মনে হয় তিনি যেন এইনবাগত প্রাণীটিকে সম্যকভাবে অনুধাবন করবার চেষ্টা করছেন।

আমি এখন রুগি দেখতে বাইরে বেরিয়ে যাব। ডাক্তার বললেন, সেই অবসরে সুপারিনটেনডেন্ট আমার কাগজপত্র পরীক্ষা করবেন। প্রয়োজন হলে আপনার সাহায্যও চাইতে পারেন। দেখবেন, ভদ্রলোকের যেন কোনো অসুবিধে না হয়।

নিশ্চয়, নিশ্চয়, আপনার অনুমতি পেলে আমি সবরকম সাহায্য করতে প্রস্তুত।

ডাক্তার রবার্টস চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, তাহলে আমি চললাম। আমার ব্যাগের মধ্যে মরফিয়ার শিশিটা ভরে দিয়েছেন তো? লকহার্টকে দেখার সময় এর প্রয়োজন হতে পারে।

কথা বলতে বলতে ব্যস্তভাবে ডাক্তার রবার্টস ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। মিস বার্জেস সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অনুসরণ করলেন। যাবার আগে মুখ ফিরিয়ে মিষ্টি করে ব্যাটেলকে বলে গেলেন, আমি পাশের কামরাতেই আছি।

যখনই দরকার মনে হবে বেল টিপবেন। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের কাজে মন দিলেন।

তাঁর কর্মপদ্ধতি খুবই হিসেবি। কোথাও একচুল ফঁক থাকবার উপায় নেই। এখানে তেমন কিছু খুঁজে পাবেন বলে মনে হল না। ডাক্তার রবার্টস যেমন অনায়াসে তাকে সবকিছু পরীক্ষা করে দেখবার সুযোগ দিলেন তাতে সে সম্ভাবনা খুবই কম বোঝা যাচ্ছে। বার্টস বোকা নন। তার এ চেম্বারে যে পুলিশ এসে হানা দিতে পারে সে কথা তার মনে নিশ্চয় আগেই উদয় হয়েছে এবং তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও তিনি ইতিমধ্যে নিয়ে রেখেছেন। তবে ব্যাটেলের ক্ষীণ আশা তিনি তাঁর অভীষ্ট বিষয়ের কোনো সন্ধান পেয়েও যেতে পারেন। কারণ, যে বিষয়ে তিনি অনুসন্ধান করবেন সেটা রবার্টসের জানার কথা নয়।

সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল প্রথমে দেরাজ খুলে তন্ন তন্ন করে সবকিছু পরীক্ষা করলেন। ব্যাঙ্কের পাসবইটাও দেখলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। তারপর রুগির নাম, ধাম ও রোগের বিবরণ সম্বলিত খাতাটার ওপর নজর দিলেন। আধঘন্টা ধরে উল্টোপাল্টে দেখেও আশাপ্রদ কিছু পাওয়া গেল না। বিষের আলমারিটা পরীক্ষা করেও বিফল হলেন। কবে কতটা কিনেছেন এবং কেমনভাবে খরচ হয়েছে সমস্ত বিবরণ পরিষ্কার লেখা আছে। কোনো দিক দিয়েই সন্দেহ করার মতো এতটুকু অবকাশ নেই। এরপর চিঠিপত্রের ফাইলটা টেনে নিলেন। সবই ব্যক্তিগত চিঠি, তার আকাঙ্খিত বিষয়বস্তুর কোনো হদিশ মিলল না। হতাশভাবে মাথা নাড়লেন ব্যাটেল। অবশেষে চেয়ারের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে বেল টিপলেন।

শ্ৰীমতী বার্জেস যেন এতক্ষণ প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন সঙ্গেসঙ্গে।

সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল নম্র সুরে তাকে একটা চেয়ারে বসতে বললেন। তারপর কথা শুরুর আগে কয়েক মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভদ্রমহিলা যে তার এই আগমনে ঈষৎ ক্রুদ্ধ হয়েছেন তা তিনি অনুভব করতে পারলেন। তাই চড়া সুরে কথা বলে তার ক্রোধকে আরও উদ্বুদ্ধ করে তুলবেন, নাকি শান্তভাবে সেটা প্রশমিত করার চেষ্টা করবেন, সেই কথাটাই ভেবে নিলেন মনে মনে।

আপনি মনে হয় সমস্ত ঘটনাই শুনেছেন? অবশেষে মুখ খুললেন ব্যাটেল।

হ্যাঁ, ডাক্তার রবার্টস আমায় বলেছেন। ছোট্ট করে জবাব দিলেন শ্রীমতী বার্জেস।

সমস্ত পরিস্তিতিটা খুবই সাংঘাতিক তাই বুঝি?

হ্যাঁ, খুবই নোংরা জঘন্য ব্যাপার। আমাদের সন্দেহের তালিকায় চারজনের নাম আছে। এটা তাদেরই একজনের কীর্তি। এখন আমার জিজ্ঞাস্য, মিঃ শ্যাতানাকে কি আপনি কখনো দেখেছেন?

না, কখনো না।

ডাক্তার বরার্টস কি আপনার কাছে কোনোদিন তার নাম করে ছিলেন উঁহু….ও হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সপ্তাহখানেক আগে ডাক্তার রবার্টস আমাকে তার এনগেজমেন্ট বুকে একটা ডিনারের অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথা নোট করে রাখতে বললেন। ১৮ তারিখ সন্ধ্যা। আটটা পনেরোয় মিঃ শ্যাতানা তাঁকে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

তখনই কি আপনি প্রথম মিঃ শ্যাতানার নাম শুনলেন?

হ্যাঁ।

 ইতিপূর্বে কোনো ভদ্রলোকের নাম আপনার চোখে পড়েনি? মাঝেমাঝেই নানান কাগজে তাঁর সম্বন্ধে অনেক মজার খবর বের হোত।

আমার অনেক জরুরি কাজ আছে। আজেবাজে খবর পড়ে সময় নষ্ট করার মতো আমার সময় নেই।

তা ঠিক, তা ঠিক! সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল মৃদুমন্দ মাথা নাড়লেন। তারপর পুরোনো কথার জের ধরে বলে চললেন, একটা কথা কি জানেন, এই চারজনের প্রত্যেকেই বলছেন মিঃ শ্যাতানার সঙ্গে তাদের পরিচয় ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু সেটা তো আর সত্যি হতে পারে না। তাদের কোনো একজনের সঙ্গে নিশ্চয় তার কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, এবং মিঃ শ্যাতানাকে খুন করাটাও সেই ব্যক্তির পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। সেই বিশেষ ব্যক্তিটিকে খুঁজে বার করাই আমার কাজ।

শ্রীমতী বার্জেসের মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেলের এই কাজে তাঁর যেন কোনো আগ্রহ নেই। তিনি কেবল তার মনিব রবার্টসের আদেশেই ব্যাটেলের সামনে হাজির হয়েছেন এবং নিয়মমাফিক সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন।

শ্ৰীমতী বার্জেন্সকে আগে আনা যে বহু পরিশ্রম সাপেক্ষ সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল তা বুঝতে পারলেন। তবু তিনি চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখলেন না। নতুনভাবে শান্ত কণ্ঠে আলাপ শুরু করলেন। আমাদের কাজ যে কত জটিল তা হয়তো আপনি ঠিক অনুধাবন করতে পারছেন না। যেমন ধরুন, নানান লোকে নানান কথা বলে। অবশ্য তার সবই হুবহু সত্যি বলে বিশ্বাস করি না, কিন্তু তা সত্ত্বেও কে কি বলল সমস্ত আমাদের নজর রাখতে হবে। এ ধরনের মামলায় এমন গুজব শোনা যায় খুব বেশি। মহিলাদের বিরুদ্ধে কোনো মন্তব্য করা যদিও আমারও অভিপ্রায় নয়, তবে এটা তো ঠিক যে গুজবটা তাদের কাছ থেকেই বেশি ছড়ায়। তারা এমন সব ভিত্তিহীন অভিযোগ করে, এমন ধরনের ইঙ্গিত দেয় যার মূলে কোনো সম্পর্ক নেই মামলার। আবার মুখরোচক পুরোনো স্ক্যান্ডাল খুঁজে বার করতেও তাদের জুড়ি মেলা ভার।

কেন? শ্রীমতী বার্জেস দৃঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, আপনি কি বলতে চান অন্যদের মধ্যে কেউ ডাক্তার রবার্টসের নামে কোনো ঘৃণ্য কুৎসা ছড়াচ্ছেন।

না, ব্যাপারটা ঠিক হয়তো সেরকম নয়, সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল সংযত কণ্ঠে অগ্রসর হলেন। তবে আমাদের তো সবদিকে চোখ কান খোলা রাখতে হয়। হয়তো আকস্মিকভাবে কোনো রোগী মারা গেলেন সাধারণ দৃষ্টিতে মৃত্যুটা হয়তো কিঞ্চিৎ সন্দেহজনক। এসব ব্যাপারে ডাক্তারকে সন্দেহ করা খুবই অন্যায় কিন্তু…..

 বুঝেছি কেউ নিশ্চয় মিসেস গ্রেভসের ব্যাপারে কিছু বলেছেন? শ্রীমতী বার্জেসের কণ্ঠে ঝঝের সুর ধ্বনিত হল। বললেন যে বিষয়ের কিছুই তারা জানে না কেন যে সে বিষয়ে কথা বলে যায়…..?

অনেক বৃদ্ধা মহিলার মনোভাবই এই রকম। তাদের ধারণা, সকলেই তাদের বিষ দিয়ে মারার চেষ্টা করছে।

আত্মীয়স্বজন, চাকরবাকর এমন কি নিজের ডাক্তারকেও তারা ভোলা মনে বিশ্বাস করতে চায় না। ডাক্তার রবার্টসের কাছে আসবার আগে ভদ্রমহিলা তিন-তিনজন ডাক্তারকে নাকচ করেছিলেন। ডাক্তার রবার্টসকেও তিনি ক্রমে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেন। তারপর যান ডাক্তার লীর কাছে, সেখান থেকে ডাক্তার স্টীল। পরিশেষে ডাক্তার ফার্মার। ফার্মারের চিকিৎসাধীন থাকাকালীন তাঁর মৃত্যু হয়। সত্যিই একজন রীতিমতো বাতিকগ্রস্ত মহিলা।

কত ছোট জিনিস থেকে যে ক্রমে ক্রমে বড়ো গুজবের জন্ম হয় ভাবলে অবাক লাগে। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল আবার কথা শুরু করলেন। যখনই কোনো পেশেন্টের মৃত্যুতে ডাক্তার কিছু লাভবান হয় তখনই এ ধরনের গুজবের অঙ্কুরোদাম ঘটে। শেষকালে তাই এক বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়। আমার বক্তব্য, যদি কোনো কৃতজ্ঞ রুগি তাঁর ডাক্তারকে নিজের সম্পত্তির কিছু অংশ দান করতেই যান তবে তাতে দোষের কি? আর সম্পত্তিটা বেশি পরিমাণের হলেও তাতে আপত্তির কিছু কারণ থাকতে পারে না।

শ্রীমতী বার্জেও ব্যাটেলের কথায় সায় দিলেন। মানুষের চরিত্র যে কত নীচ হতে পারে কোনো ধনী ব্যক্তির মৃত্যুর পরই তার সম্পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। এমন কি মৃতদেহটা ভালোভাবে ঠান্ডা হবার আগেই তারা তার সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে শেয়াল কুকুরের মতো তাড়া শুরু করে। তবে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ডাক্তার রবার্টসকে এ ধরনের কোনো নোংরামির মধ্যে পড়তে হয়নি। তাঁর পেশেন্টরা যেন তাকে কোনো সম্পত্তির ভাগীদার না করে যান এটাই তার মনোগত ইচ্ছা। একবার একজন তার উইলে ডাক্তার রবার্টসকে পঞ্চাশ পাউন্ড দিয়ে গিয়েছিলেন। আর একজন পেশেন্ট তাঁর সোনার হাত ঘড়িটা কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ বরার্টসের নামে লিখে রেখে যান, এছাড়া রুগীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে তিনি আর বিশেষ কিছু পাননি।

এই জাতীয় পেশাদার মানুষকে খুবই সঙ্কটপূর্ণ জীবনযাপন করতে হয়। ব্যাটেলের কণ্ঠে সহৃদয় সহানুভূতির সুর। ব্ল্যাকমেলের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা তাদের খুব বেশি। অনেক সময় নির্দোষ সাধারণ ঘটনাও লোকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। ফলে তাদের নামে নানান স্ক্যান্ডাল ছড়াতে শুরু করে। বিশেষত এই ধরনের স্ক্যান্ডাল আবার ডাক্তারদের পশারের ক্ষেত্রে খুবই ক্ষতিকর। তাই যতটা সম্ভব তারা সভয়ে এগুলি এড়িয়ে চলতে সচেষ্ট হন।

হ্যাঁ, খুব খাঁটি কথা বলেছেন, বিশেষ করে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মহিলাদের নিয়ে তাদের ঝামেলার আর অবধি থাকে না।

ব্যাপারটা প্রথম শোনবার পর আমারও তাই মনে হয়েছিল। ভদ্রমহিলার নিশ্চয় হিস্টিরিয়া রোগ আছে।

আপনি নিশ্চয় মিসেস ক্রাডাকের কথা বলছেন। ভদ্রমহিলা খুবই সাংঘাতিক।

মিসেস ক্রাডাক? ব্যাটেল চোখ বুজে চিন্তার ভান করলেন। যেন সঠিক মনে আনতে পারছেন না। তারপর সেই একই চিন্তান্বিত সুরে বললেন ঘটনাটা বোধহয় বছর তিনেক হল, তাই না?

না, চার-পাঁচ বছর তো হবেই। ভদ্রমহিলার মানসিক ভারসাম্য বজায় ছিল না। তিনি লন্ডন ছেড়ে চলে যাবার পর আমি আন্তরিক খুশিই হয়েছিলাম। ডাক্তার রর্বাটসও হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। মহিলাটি তার স্বামীকে বানিয়ে বানিয়ে নানান ধরনের মিথ্যে কথা বলতেন এঁদের স্বভাবই এরকম। তার ফলে স্বামী বেচারাও অশান্তিতে ভুগে ভুগে শেষে অসুস্থ হয়ে পড়েন। একদিন সকালে নিজের হাতে দাড়ি কামাবার সময় তাঁর গালটা একটু ছড়ে যায়। সেভিং ব্রাশটা দূষিত ছিল। সেই দূষিত জীবাণু রক্তে সংক্রমিত হয়ে পরে তিনি মারা যান। নীচু মানের সেভিং ব্রাশে মাঝে মধ্যে এধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঘটনাটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। খাঁটি মিথ্যে কথাটা অকপটে বলে গেলেন ব্যাটেল। তারপরেই ভদ্রমহিলা বিদেশে চলে যান। মারাও যান অতি অল্পকালের মধ্যে। তাঁর স্বভাবচরিত্র খুবই নোংরা প্রকৃতির। শক্তসমর্থ পুরুষ দেখলেই সঙ্গলাপের জন্যে হন্যে হয়ে উঠতেন।

এই ধরনের মহিলারা খুবই বিপজ্জনক হয়ে থাকে। বিজ্ঞভাবে মাথা নাড়লেন ব্যাটেল। ডাক্তারদেরও এঁদের সম্বন্ধে খুব সাবধান থাকতে হয়। কোথায় যেন মারা গেলেন শেষটা। জায়গার নামটা আমার ঠিক মনে আসছে না।

যতদূর স্মরণ হচ্ছে মিশরে।

ডাক্তারদের আর একটা সমস্যা হচ্ছে, আলোচনার ভঙ্গিতে বললেন ব্যাটেল, যখন রুগির কোনো আত্মীয় রুগিকে স্লো-পয়জন করছে বলে তারা সন্দেহ করে, নিশ্চিতভাবে প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত এক্ষেত্রে তাদের কিছু করণীয় নেই। চুপচাপ মুখ বুজে বসে থাকতে বাধ্য হয়। আবার ইতিমধ্যে রুগির মৃত্যু ঘটলে অনেক নিন্দুকে তখন ডাক্তারের নামেই নানান কুৎসা রটাতে শুরু করে। তাদের তখন সসেমিরা অবস্থা। আচ্ছা, ডাক্তার রবার্টকে কি কখনো এমন বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়েছে।

না, এমনভাবে আমি কখনো চিন্তা করে দেখিনি। শ্রীমতী বার্জেস সরল কণ্ঠে উত্তর দিলেন। তাছাড়া এমন ঘটনা এ পর্যন্ত কানেও আসেনি আমার।

আর একটা কথা। যদিও এর সঙ্গে বর্তমান তদন্তের কোনো যোগাযোগ নেই, কেবল মনের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্যই জিজ্ঞেস করছি, একজন ডাক্তারের হাতে গড়পড়তা কতজন রুগি মারা যায়। মোটামুটি একটা আন্দাজ পেলেই চলবে। আপনি তো অনেক দিন ধরেই ডাক্তার রবার্টসের সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করছেন…

হ্যাঁ, সাত বছর?

সাত বছর? তাহলে তো আপনার জানা উচিত। ইতিমধ্যে ডাক্তার রবার্টসের হাতে কতজন রুগি মারা গেছেন?

ঠিক বলা শক্ত। শ্রীমতী বার্জেস সুকুঁচকে চিন্তা করতে লাগলেন। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল এমন নিপুণ চতুরতার সঙ্গে প্রশ্নটা উত্থাপন করেছেন যে ভদ্রমহিলার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহের উদ্রেক হয়নি। সহজ সরল মনেই তিনি জবাব দিলেন, কোনো কোনো বছরে সাত-আটজনও হয়ে যায় তবে এই সাত বছরে তিরিশজনের বেশি হবে না।

তাহলে তো ভদ্রলোককে একজন রীতিমতো ভালো ডাক্তার বলতে হবে। ব্যাটেলের কণ্ঠে সহৃদয় বিশ্বস্ততার সুর। তার রুগিরাও নিশ্চয় সকলে খুব বড়লোক? নিজেদের স্বাস্থ্যরক্ষার প্রয়োজনে ব্যবয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থার বন্দোবস্ত করতে পারেন।

হ্যাঁ, রুগিদের কাছে ডাক্তার রবার্টসের খুব পসার আছে। তার রোগ নির্ণয়ের ক্ষমতাও প্রায় নির্ভুল।

ব্যাটেল নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। কথায় কথায় মূল প্রসঙ্গ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি। ডাক্তার রবার্টমের সঙ্গে মিঃ শ্যাতানার কোনো সম্পর্ক ছিল কিনা সেইটাই আমার জ্ঞাতব্য বিষয়। আপনি তাহলে স্থির নিশ্চিত যে মিঃ শ্যাতানা ডাক্তার রবার্টসের পেশেন্ট ছিলেন না।

হ্যাঁ, সেটা আমি জোরের সঙ্গেই বলতে পারি।

মিঃ শ্যাতানা হয়তো ছদ্মনাম ব্যবহার করে থাকবেন। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল পকেট থেকে একটা ছবি বার করে শ্রীমতী বার্জেসের দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা?

শ্রীমতী বার্জেস ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছবিটা দেখলেন। তারপর সেটা ব্যাটেলকে ফিরিয়ে দিতে দিতে বললেন, কেমন যেন থিয়েটারি ঢংয়ের চেহারা। না, আগে কোনোদিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

তবে আর কি করা যাবে। বিরস মুখে ব্যাটেল দরজার দিকে তাকালেন। ডাক্তার রবার্টসকে বলবেন, আমি তাঁর অকৃত্রিম সহযোগিতার জন্য আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। তাকে এ কথাও জানিয়ে দেবেন যে এখন আমার তালিকার দু’নম্বরের দিকে এগোচ্ছি। আচ্ছা, নমস্কার নিন মিস বার্জেস। আপনার সাহায্যের জন্য অজস্র ধন্যবাদ।

রাস্তায় নেমে পকেট থেকে নোটবই বের করেন ব্যাটেল। ডাক্তার রবার্টসের নামের নীচে ছাড়া ছাড়া কয়েকটা শব্দ লিখলেন।

মিসেস গ্রেভস? খুব সম্ভব নয়। মিসেস ক্রাডাক? কোনো উত্তরাধিকারী নেই। বিয়ে করেননি (খুবই দুঃখের ব্যাপার)।

রুগিদের মৃত্যুর বিষয়ে তদন্ত করতে হবে। খুবই পরিশ্রম সাপেক্ষ। প্রায় অসম্ভব। তারপর নোটবই বন্ধ করে ওয়েসেক্স ব্যাঙ্কের দিকে এগোলেন। এখানেই ডাক্তার রবার্টস তার সঞ্চয় গচ্ছিত রাখেন।

পকেট থেকে অফিসিয়াল কার্ড বার করতেই কাজ হল। ব্যাঙ্কের কর্মচারী মহা সমারোহে তাকে খোদ ম্যানেজারের ঘরে নিয়ে হাজির করলেন, অমায়িক হেসে করমর্দনের অভিপ্রায়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন ব্যাটেল। সুপ্রভাত! আমি যতদূর জানি, ডাক্তার রবার্টস আপনাদেরই একজন ক্লায়েন্ট।

আপনি ঠিকই জানেন। মাথা নেড়ে সায় দিলেন ম্যানেজার।

এই ব্যাঙ্কের সঙ্গে তার গত কয়েক বছরের লেনদেনের হিসেবটা একবার পরীক্ষা করে দেখতে চাই।

নিশ্চয়, নিশ্চয়! সম্ভাব্য সব সাহায্যই আপনি পেতে পারেন।

আধঘন্টা ধরে গভীর মনোযোগ দিয়ে ব্যাটেল সবকিছু পরীক্ষা করলেন। তারপর নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন।

আপনার উদ্দেশ্য সফল হল? ম্যানেজারের কণ্ঠে মৃদু কৌতূহলের সুর।

না। ব্যাটেল হতাশভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন, সন্দেহজনক তেমন কিছু পেলাম না। আচ্ছা চলি। আপনার সাহায্যের জন্য অজস্র ধন্যবাদ।

ঠিক সেই সময় ডাক্তার রবার্টস তার চেম্বারে বীজানুনাশক কার্বলিক সাবান দিয়ে হাত ধুতে ধুতে তার সেক্রেটারিকে প্রশ্ন করছিলেন। তারপর সুপারের খবর কি? ভদ্রলোক হয়তো তন্ন তন্ন করে সবকিছু ঘেঁটে দেখেছেন। আপনাকেও হয়তো জেরায় জেরায় নাজেহাল করে ছেড়েছেন?

তবে আমার কাছ থেকে তেমন কিছু আদায় করতে পারেননি। শ্রীমতী বার্জেসের চোখে মুখে খুশির হাসি উপচে উঠল। আমার পেট থেকে কথা বার করা অত সহজ নয়।

এই তো, বোকার মতো ভুল করে বসলেন। শামুকের মতো মুখ গুটিয়ে থেকে লাভ কি? আমি তো সব প্রশ্নেরই জবাব দিতে বলে গেলাম। সে হোক, ভদ্রলোকের আসল উদ্দেশ্যটা কি? কিছু বুঝতে পারলেন? তিনি কোন বিষয়ে জেরা করছিলেন?

মিঃ শ্যাতানার সঙ্গে আপনার পরিচয় কতখানি সেইটাই তার জ্ঞাতব্য বিষয়। এমন কি ভদ্রলোক হয়তো ছদ্মনামে আপনার পেশেন্ট ছিলেন। এমন সন্দেহও তিনি প্রকাশ করলেন। সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হবার জন্য আমাকে তাঁর ছবি বার করে দেখালেন পর্যন্ত। কেমন থিয়েটারি ঢংয়ের চেহারা ভদ্রলোকের।

কে? শ্যাতানা?….ভদ্রলোক ছিলেন শয়তানের প্রধান অনুচর। পোশাক-পরিচ্ছদে সে ভাব ফুটিয়ে তুলতে ভালবাসনে। তাছাড়া আর কি কি জিজ্ঞেস করলেন?

বিশেষ কিছুই না।…ও হা, কেউ বোধহয় ব্যাটেলের কাছে মিসেস গ্রেভসের বিষয়ে কিছু বলে থাকবে। লোকে একবার গুজব রটাবার সুযোগ পেলে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার না করে ছাড়তে চায় না।

গ্রেভস? মিসেস গ্রেভস? সেই বৃদ্ধা?…ভারী মজার তো। হো হো করে হেসে উঠলেন রবার্টস। সত্যিই বেশ মজার। তারপর সেই হাসির রেশ মুখে মেখেই লাঞ্চের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন।

.

০৮.

সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল পোয়ারোর সঙ্গে একই টেবিলে লাঞ্চে বসেছিলেন। ব্যাটেলের মুখে গভীর উদ্বেগ আর বিষাদের ছায়া। পোয়ারোর দৃষ্টিতে শান্ত সহানুভূতি। তাহলে আপনার সকালের পরিশ্রমটা প্রায় বৃথাই গেল মনে হচ্ছে?

ব্যাটেল সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। ব্যাপারটা সহজে মিটবে বলে মনে হচ্ছে না। খুবই জটিল সমস্যা।

ভদ্রলোককে দেখে কেমন মনে হল?

কে? ডাক্তার রবার্টস? আমার বিশ্বাস শ্যাতানার সিদ্ধান্ত নির্ভুল। ভদ্রলোক সত্যিই একজন খুনি। তাঁকে দেখে আমার নরফোকের সেই অ্যাটর্নির কথা মনে পড়ে। সেই একই রকম দিলখোলা, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, সেই ভদ্রলোকের মতো ডাক্তার রবার্টসেরও লোকসমাজে যথেষ্ট পসার আছে। শ্যাতানাকে তিনি খুন করেছেন বলে মনে হয় না। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। এর পেছনে কতখানি ঝুঁকি আছে সেটা তিনি ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারেন যা একজন অনভিজ্ঞ লোকের পক্ষে বুঝে ওঠা শক্ত। শ্যাতানা ঘুম থেকে জেগে চিৎকার করে উঠতে পারতেন।

তবে এটা তো আপনি বিশ্বাস করেন, তিনি আর কাউকে খুন করেছেন?

একজন কেন, বহু লোককেই খুন করে থাকতে পারেন। নরফোকের অ্যাটর্নি ভদ্রলোক যেমন করেছিলেন। তবে প্রমাণ পাওয়া শক্ত। তার ব্যাঙ্কের পাসবইও আমি পরীক্ষা করে দেখেছি। তেমন সন্দেহজনক কিছু খুঁজে পাইনি। কোনো বড় অঙ্কের টাকাও হঠাৎ জমা পড়েনি। গত সাত বছরের মধ্যে কোন পেশেন্টের সম্পত্তি তিনি পাননি। তার ফলে প্রত্যক্ষ ফলের উদ্দেশ্য নিয়ে খুন করেননি বলে বোঝা যায়। ভদ্রলোক অবিবাহিত। সেটাও ভেবে দেখবার বিষয়। একজন ডাক্তারের পক্ষে তার নিজের স্ত্রীকে খুন করা খুব সহজ। অবশ্য তিনি যে খুব অবস্থাপন্ন একথা সত্যি, আর তাঁর পেশেন্টরাও সবাই ধনী সম্ভ্রান্ত ঘরের।

তার থেকে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে তিনি এতদিন নির্দোষ জীবনযাপন করে এসেছেন এবং এখনও তাই করেন।

হতে পারে। আমার কিন্তু একথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না।

একটু থেমে ব্যাটেল আবার আলোচনা শুরু করলেন। একজন মহিলা পেশেন্টকে নিয়ে তাঁর নামে কিছু স্ক্যান্ডাল রটেছিল। ভদ্রমহিলার নাম মিসেস ক্রাডাক। ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা দরকার। গোয়েন্দা দফতরের কোনো চতুর ছোকরাকে এই কাজের ভার দেব। যদিও এই তদন্তের পক্ষে ঘটনাটি তেমন প্রয়োজনীয় বলে আমার মনে হয় না তবুও তার সাধারণ চরিত্রের ওপর আলোকসম্পাত করতে পারে।

আর মহিলাটির স্বামীর খবর কি?

ভদ্রলোক অ্যানথ্রক্স রোগে মারা যান।

অ্যানথ্রক্স!

হ্যাঁ, সেই সময় নীচু মানের এক ধরনের সেভিং ব্রাশ বাজারে চালু ছিল। তার মধ্যে কিছু ছিল এই রোগের জীবানুবাহী। এইজন্য সেই কোম্পানির নামে আদালতে মামলা পর্যন্ত উঠেছিল।

হত্যাকারীর পক্ষেও এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ। গম্ভীরভাবে মন্তব্য করলেন পোয়ারো।

কথাটা আমিও ভেবে দেখেছি। যদি ভদ্রলোকের স্বামী এ-বিষয়ে কোনো কেলেঙ্কারি বাধাবার হুমকি দিয়ে থাকেন…তবে সমস্তই অনুমান নির্ভর। দু’পায়ে দাঁড়াবার মতো কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।

এতটা হতাশ হবেন না; আশ্বাস দেবার সুরে বললেন পোয়ারো। আমি জানি, অসীম আপনার ধৈর্য। হয়তো শেষ কালে প্রমাণের ঘনঘটায় আপনি নিজেই দিশেহারা হয়ে পড়বেন।

ব্যাটেল মৃদু হাসলেন। তারপর কৌতূহলের সুরে প্রশ্ন করলেন। আপনি কোন কোন পথ ধরে এগোবেন বলে ভাবছেন?

আমি আপনার মতো ডাক্তার রবার্টসের দর্শনপ্রার্থী হব।

একই দিনে দু’জন! ভদ্রলোক তো রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে উঠবেন। তাকেই হত্যাকারী সন্দেহ করা হচ্ছে বলে তার ধারণা হবে।

না না, আমি খুব সন্তর্পণেই অগ্রসর হব। তাছাড়া আমার প্রশ্নও ভিন্ন ধরনের। আমি তার অতীত জীবন সম্বন্ধে কোনো কথাই জানতে চাইব না।

কিন্তু আমি আপনার কর্মপদ্ধতির সঠিক হদিশটাকে পেতে চাইছি। ব্যাটেলের কণ্ঠে কৌতূহলের সুর তখন শান্ত হয়নি। তবে যদি বলবার বাসনা না থাকে তবে জোর করব না।

অবশ্যই, অবশ্যই। বলতে আমার কোনো বাধা নেই। আমি কেবল তার সঙ্গে ব্রিজ খেলা সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করব। আর কিছু নয়।

হ্যাঁ, বিষয়টা আমার কাছে খুবই প্রয়োজনীয় বলে মনে হচ্ছে।

ভালো, প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব কর্মপদ্ধতি থাকে। তবে এইসব ভাসা ভাসা শৌখিনি জিনিসে তেমন আগ্রহী নই। আমার কর্মপদ্ধতির সঙ্গে এটা খাপ খায় না।

পোয়ারো চোখ মিটমিট করে ফিরে তাকালেন। বললেন, কেন? আপনার কাজের ধারা কি রকম, মিঃ ব্যাটেল?

সাদাসিধে সোজাসুজি। একজন কর্তব্যপরায়ণ পুলিশ অফিসার যে রকম নিষ্ঠার সঙ্গে পরিশ্রম করে সত্য অনুসন্ধানে ব্রতী হয়, সেইরকম। আমার কাজের মধ্যে কোনো ফাঁকিজুকি নেই।

হাসিমুখে নিজের পানীয়ের গ্লাস তুলে ধরলেন পোয়ারো। আসুন, আমরা পরস্পর পরস্পরের কর্মপদ্ধতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমাদের যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমেই সাফল্যের উষ্ণীষ নেমে আসবে।

ব্যাটেল দিলখোলা ভঙ্গিতে হেসে উঠলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, আমার মনে হয় কর্নেল রেস মেজর ডেসপার্ডের বিষয় কোনো প্রয়োজনীয় বিষয়ের হদিশ এনে দিতে পারেন।

লাঞ্চের পর তারা দু’জনে যে যার পথ ধরলেন। ব্যাটেল পরবর্তী কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে নির্দেশ দেবার জন্য স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ফিরে গেলেন, পোয়ারো এগোলেন ডাক্তার রবার্টসের চেম্বারের দিকে।

পোয়ারোকে দেখে ডাক্তার রবার্টসের ভ্রু কুঞ্চিত হল। চোখে মুখে অপরিসীম বিস্ময়ের ভাব ফুটিয়ে ঠাট্টার সুরে বললেন, একদিনে দু’জন টিকটিকির শুভাগমন! রকমসকম দেখে মনে হচ্ছে সন্ধের মধ্যেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরিয়ে যাবে!

পোয়ারো স্বভাব সুলভ মৃদু হাসলেন। না না, আমি অন্তত এই আশ্বাস দিতে পারি যে আমার দৃষ্টি এখনও সমানভাবে আপনাদের চারজনের প্রতিই নিবদ্ধ।

যাক, তবু সেটা মন্দের ভাল। সিগারেটটা খান তো। ডাক্তার রবার্টস কোটের পকেট থেকে দামি সিগারেটের প্যাকেট বার করলেন।

যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি আমার নিজের ব্যান্ড ধরাতে পারি, পোয়ারো ছোট আকারের রাশিয়ান সিগারেট বার করে অগ্নি সংযোগ করলেন।

বলুন কিভাবে আপনার কাজে লাগতে পারি? রবার্টস বিনয়ে বিগলিত।

পোয়ারো মিনিটখানেক কোনো কথা বললেন না। নিজের সিগারেটেই মত্ত হয়ে রইলেন। তারপর অল্প কেশে আরম্ভ করলেন, আপনি কি মানুষের চরিত্র খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেন। ডাক্তার রবার্টস।

ঠিক বলতে পারি না, তবে চেষ্টা করি, এই পর্যন্ত। একজন ডাক্তারের পক্ষে সেটা করা দরকার।

আমিও মনে মনে সেই কথাই ভাবছিলাম। একজন দক্ষ চিকিৎসকের প্রধান কর্তব্য হল তার পেশেন্টের খুঁটিনাটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা। তার হাবভাব, তার গায়ের রঙ, কত তাড়াতাড়ি তার শ্বাসপ্রশ্বাস প্রবাহিত হচ্ছে, অতি অল্পেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে কিনা–এ সমস্ত লক্ষণ অতি সহজেই তাদের নজরে ধরা পড়ে। এজন্য একজন ডাক্তারকে বিশেষভাবে চেষ্টা করতে হয় না। অনেক সময় তাদের অজান্তেই এটা ঘটে থাকে। তাই মনে হল ডাক্তার রবার্টস সবচেয়ে উপযুক্ত লোক যার কাছ থেকে আমি সাহায্য পেতে পারি।

আমি আপনাকে সাহায্য করতে সর্বদাই হাত বাড়িয়ে আছি। কিন্তু বিষয়টা কি?

পোয়ারো তার কোটের পকেট থেকে নিখুঁত ভাজ করা তিনটে ব্রিজ খেলার স্কোরশীট বার করে টেবিলের ওপর রাখলেন। এগুলো হচ্ছে সেদিন সন্ধ্যায় প্রথম তিনটে রবারের ফলাফল। শান্ত সুরে তার বক্তব্য ব্যাখ্যা করলেন পোয়ারো। এই প্রথমটি হচ্ছে মিস মেরিডিথের হাতের লেখা। এখন আমার জিজ্ঞাসা এই স্কোরশীটটা দেখে আপনি কি সেদিনের তাসের কথা কিছু স্মরণ করতে পারেন? ডাকগুলো কি হয়েছিল, খেলাটাই বা এগিয়েছিল কিভাবে?

রবার্টস বিস্ময় বিস্ফারিত চোখে মিনিট খানেক তাকিয়ে রইলেন। আপনি কি ঠাট্টা করছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো? এতদিন বাদে সেসব আমি স্মরণ করব কিভাবে?

একেবারেই কি অসম্ভব। পোয়ারো ভরসা দেবার সুরে বললেন, এই স্কোরশীটটার দিকে তাকিয়ে দেখুন প্রথম হাতটা নিশ্চয় হার্ট বা স্পেডে ডাক হয়েছিল। তবে খেলা হয়নি, একটা শর্ট গিয়েছিল।

দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমাকে ভাবতে দিন। হ্যাঁ, মনে পড়ছে। স্পেডের খেলা ছিল। ওঁরা একটা শর্ট দিলেন।

পরের তাসটা?

মনে হচ্ছে আমি বা আমার পার্টনার দুটো ডায়মন্ডে খেলছিলাম। তবে, এবারও খেলা হয়নি। পঞ্চাশ ডাউন দিলাম। কিন্তু এতদিন পর সবকিছু সঠিক মনে রাখা সম্ভব নয়। আপনি নিশ্চয় তা আশা করেন না?

আচ্ছা, কোনো উত্তেজনাপূর্ণ ডাক বা খেলার কথা আপনার মনে পড়ে না? রাবার হবার আগে কোনো চরম মুহূর্ত।

একটা গ্র্যান্ডস্লামের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সেটা ছিল আমারই হাতের খেলা। আর একবার তিনটে নো ট্রাম্প ডেকে বিশ্রীভাবে অনেকগুলো শর্ট দিলাম। প্রত্যেকটা রঙের ডিস্ট্রিবিউশন এত খারাপ ছিল যে কল্পনা করা শক্ত। বলতে গেলে আমরা কোনো পিটই পায়নি। তবে এটা শেষ দিকের তাস।

তখন কে আপনার পার্টনার ছিলেন?

 মিসেস লরিমার। ভদ্রমহিলা মাঝে-মাঝে মুষড়ে পড়ছিলেন বোধহয় আমার ওভার কলিংয়ের ঝোঁকটা তার ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না।

অন্য কোনো ডিলের কথা আপনার মনে পড়ে না?

রবার্টস মৃদু হাসলেন।

মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কি করে আশা করেন যে সেদিনের সমস্ত ডিলকে স্মৃতি থেকে মুছে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। তাছাড়া মিঃ শ্যাতানার মৃত্যুর পর থেকে এ পর্যন্ত আমি অন্তত সাত আটটা রাবার খেলেছি।

পোয়ারোর মুখে কোনো ভাবান্তর পরিলক্ষিত হল না।

আপনাকে নিরাশ করতে বাধ্য হলাম। আমি খুবই লজ্জিত। আপনার যুক্তি স্বীকার করছি। পোয়ারো ঈষৎ নড়েচড়ে বসলেন। কিন্তু চেষ্টা করলে একটা দুটো ডিলের কথা মনে পড়বে না, এতটা স্মৃতিবিভ্রম ঘটাও উচিত নয়। বিশেষভাবে এই ডিলগুলো যখন অন্য নানা ধরনের ঘটনার সঙ্গেও জড়িত। আমার বিশ্বাস, সেই লোকে আমরা অচেনা নতুন পথের ইঙ্গিত খুঁজে পাব।

অন্য কোনো ঘটনা বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?

যেমন ধরুন আপনার পার্টনার কোনো একটা অতি সহজ খেলা ভুল করে বসলেন কিংবা বিপক্ষের উে অন্ধের মতন ডিফেন্স করে যাবার ফলে আপনারা একটা অসাধ্য গেম খেলে যেতে পারলেন, বা এই ধরনের এমন কিছু…..।

ডাক্তার রবার্টসকে, এবার বেশ সিরিয়াস বলে মনে হল। চেয়ারটা টেবিলের আর কাছে টেনে আনলেন। বললেন, এতক্ষণে আপনার বক্তব্য আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। কথাটা আগে অনুধাবন করতে পারিনি, সেটা আমার বোকামি। এর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ভাবছিলাম, আপনি বুঝি উদ্দেশ্যহীন আবোল-তাবোল প্রশ্ন করছেন। এর সঙ্গে যে গভীর মনস্তত্ত্বের বিষয় জড়িত আছে এতক্ষণে সেটা মাথায় ঢুকেছে। আপনি বলতে চান যে লোক সদ্য সদ্য মিঃ শ্যাতানাকে খুন করে এসেছে তার হাবভাব, আচার আচরণ সাধারণ আর পাঁচজনের চেয়ে পৃথক হবে। তার তখনকার মানসিক উদ্বেগ-উত্তেজনার ছায়া তার খেলার মধ্যেও প্রতিফলিত হতে বাধ্য। তার ভেতরে একটা অপরাধী মনোভাব তাকে সর্বদা অশান্ত করে তুলবে।

পোয়ারো গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ, এতক্ষণে আপনি আমার ধারণাটা ঠিকভাবে বুঝতে পেরেছেন। খুনিকে খুঁজে বার করার পক্ষে এটা একটা মস্ত সূত্র। অবশ্য যদি প্রত্যেকে প্রত্যেকের খেলা সম্বন্ধে আগে থেকে পরিচিত থাকতেন তবে পার্থক্যটা সহজে নজরে পড়ত। কিন্তু এক্ষেত্রে সকলেই সকলের কাছ অপরিচিত। তাই কে কতটা ভালোভাবে খেলে ভেবে দেখতে অনুরোধ করি। কারোও খেলার মধ্যে কি কোনো ভুলভ্রান্তি আপনার নজরে পড়েছে সাধারণ দৃষ্টিতে যা বিস্ময়কর?

ডাক্তার রবার্টস মিনিট দুয়েক মনে মনে চিন্তা করলেন। অবশেষে হতাশ হয়ে মাথা নাড়লেন। না, তেমন কিছুই আমার মনে পড়ছে না। ইতিপূর্বে এ-বিষয়ে আপনাকে যা বলেছি তাছাড়া নতুন কোনো বক্তব্য নেই। মিসেস লরিমার প্রকৃতই একজন জাত খেলোয়াড়। সাধারণ ভুলভ্রান্তি তিনি আদপেই করেন না, গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত নিখুঁত খেলে গেছেন। মেজর ডেসপার্ডের খেলাও মোটের ওপর ভালোই বলতে হবে, তবে বড় বেশি বই ধরে খেলেন। তার বাইরে যেতে চান না। বাকি রইলেন মিস মেরিডিথ। তিনি অবশ্য…..

ডাক্তার রবার্টস অল্প ইতস্তত করলেন।

হ্যাঁ বলুন, মিস মেরিডিথ…সঙ্গে সঙ্গে খেই ধরিয়ে দিলেন পোয়ারো।

তিনি মাঝে মধ্যে ভুল করে বসছিলেন। বার দুই তিন তো হবেই। অন্যমনস্কতা তার প্রধান কারণ। তবে সেটা শেষের দিকে। মনে হয় খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তাছাড়া তার অভিজ্ঞতারও একান্ত অভাব। খেলতে গেলে হাত কঁপে। বলতে বলতে থেমে গেলেন রবার্টস।

কখন হাত কাঁপা প্রথম শুরু হয়?

তা ঠিক আমার মনে আসছে না। বোধহয় কিছুটা নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি হয়তো জোর করেই আমাকে দিয়ে এ সমস্ত কল্পনা করিয়ে নিচ্ছেন?

আমি খুবই লজ্জিত। পোয়ারোর কণ্ঠে বিনয়ের সুর ঝরে পড়ল। আর একটি বিষয়ে আমার জিজ্ঞাসা আছে।

হ্যাঁ, বলুন।

পোয়ারো ধীরে ধীরে শুরু করলেন। ব্যাপারটা ঠিকমতো বুঝিয়ে বলা কষ্টসাধ্য। আমি যদি প্রশ্ন করি, এইসব বস্তু আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল কিনা। তাহলে আমিই যে সেগুলো আপনার মাথায় ঢুকিয়ে দিতে সাহায্য করছি তাই বোঝাবে। সেক্ষেত্রে আপনার উত্তরেরও তত মূল্য থাকবে না। সেইজন্য প্রশ্নটা আমি আপনার কাছে একটু ঘুরিয়ে রাখছি। আচ্ছা সেদিন ডিনারের পর যে ঘরে বসে আপনারা তাস খেলছিলেন তার একটা সরল বিবরণ দিন তো যেমন, ঘরের মধ্যে কি কি বস্তু আপনার নজরে পড়েছিল–এই সব আর কি?

রবার্টস আবার বিস্মিত হলেন। সেই ঘরের মধ্যে যা ছিল আমার কাছ থেকে তার বিবরণ জানতে চাইছেন?

হ্যাঁ, তাই আমার অভিপ্রায় কিন্তু কোথা থেকে শুরু করব ভেবে পাচ্ছি না।

যে কোনো জায়গা থেকে আরম্ভ করুন।

 বেশ। প্রথমে ধরুন আসবাবপত্রের কথা। অনেক দামি দামি সৌখিন আসবাবপত্র ছিল…..

না, না, ওভাবে নয়; পোয়ারো তাকে বাধা দিলেন। আমি পৃথক পৃথক ভাবে প্রতিটি বস্তুর নাম জানতে চাই।

ডাক্তার রবার্টস একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর নিলামওয়ালার মতো শুরু করলেন, হাতির দাঁতের কাজ করা একটা বড় সেটি ছিল। চার-পাঁচটা বড় বড় চেয়ার। আটটা কি ন’টা পার্সিয়ান কম্বল। বারোটা ছোটো ছোটো চেয়ারের একটি সুন্দর সেট। খুব সুন্দর একটা চাইনিজ আলমারি। একটা বড় পিয়ানো। আসবাবপত্র আরও অনেক ছিল, কিন্তু তেমন লক্ষ্য করিনি। ছটা ভালো জাপানি ছবি। আয়নার দুপাশের ছবি দুটো চাইনিজ। পাঁচ-ছটা বাহারি নস্যির কৌটো। টেবিলের ওপর হাতির দাঁতের কাজ করা কতগুলো ছোট ছোট মূর্তি। প্রথম চার্লসের শীলমোহর খচিত কিছু মুদ্ৰা…..

হ্যাঁ, ঠিক হচ্ছে! পোয়ারোর গলায় খুশির সুর।

কিছু প্রাচ্যদেশীয় জিনিসপত্রও ছিল। সূক্ষ্ম রূপোর কাজ করা কতগুলো শিল্প বস্তু। কিছু অলঙ্কার! তবে তাদের ব্যবহার সম্বন্ধে আমি একেবারেই অজ্ঞ। একটা সুদৃশ্য কাঁচের বাক্সে কতগুলো ছোট ছোট সৌখিন বস্তুর সমাবেশ। ঘরে আরও অনেক কিছুই ছিল। কিন্তু আমার আর কিছু মনে নেই।

চমৎকার চমৎকার। আপনার স্মৃতিশক্তি খুবই তীক্ষ্ণ। পোয়ারো প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠলেন, আপনার চোখ খাঁটি পর্যবেক্ষকের।

ডাক্তার বরার্টসের গলায় কৌতূহলের সুর। যে জিনিসটার কথা আপনি জানতে চান। সেটা কি আমার তালিকার মধ্যে আছে?

খুব মজার ব্যাপার। পোয়ারো রহস্যময় হাসি হাসলেন। যে জিনিসটা আমার মনে ছিল, আপনি তার উল্লেখ যদি করতেন তবে আমি অবাক হতাম। আমার ধারণা নির্ভুল হয়েছে। জানতাম আপনি সেটার কথা উল্লেখ করবেন না।

কেন?

পোয়ারো বেড়ালের মতো চোখ মিটমিট করলেন। কারণ জিনিসটা হয়তো আদৌ তখন সেখানে ছিল না।

রবার্টস বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, ব্যাপারটা আমাকে যেন অন্য একটা ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

হয়তো শার্লক হোমসের কথা আপনার মনে পড়ছে, তাই না? রাত্রিকালে কুকুরটার সেই অদ্ভুত আচরণের কথা। প্রতিদিন রাত্রিতেই কুকুরটা চিৎকার করত কিন্তু সেদিন সে ডাকেনি। ব্যাপারটা খুবই বিস্ময়।….দেখা যাচ্ছে আমিও আজকাল অপরের আইডিয়া চুরি করতে শিখেছি।

কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার কথাবার্তা খুবই হেঁয়ালিপূর্ণ বলে আমার কাছে প্রতিভাত হচ্ছে। কোন দিকে ইঙ্গিত করেছেন, কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

সেটাই আমার ঐকাভিক অভিপ্রায়। তার ফলে শেষ দৃশ্যে নাটক খুব জমে ওঠে। কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো। ডাক্তার রবার্টস তখন তার দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। পোয়ারো হেসে বললেন, তবে একটা কথা মনে রাখবেন। আজ আপনি আমাকে যা বললেন, তা আমার পরবর্তী উদ্যোগে খুব সহায়তা করবে।

রবার্টস উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, কেমনভাবে করবে তা আমি বুঝতে পারছি না। তাহলেও আপনি যখন বলছেন তখন নিশ্চয় কিছু একটা আছে।

দু’জনে করমর্দন করলেন। পোয়ারো ডাক্তার রবার্টসের চেম্বার থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরলেন। এবার তিনি মিসেস লরিমারের সঙ্গে দেখা করবেন।

.

০৯.

১১১ নম্বর চেইন লেন, সুন্দর ছিমছাম একটি ছোট বাড়ি। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বেশ শান্ত আর নির্জন। দরজাটা গভীর কালো রঙ করা। সিঁড়িগুলো ঝকমক করছে।

কলিং বেল টিপতেই এক বুড়ি এসে দরজা খুলে দিল। কাকে চান?

মিসেস লরিমারের নাম করলেন পোয়ারো।

হ্যাঁ, তিনি বাড়িতেই আছেন। আসুন।

পোয়ারো বুড়ি ঝির পেছন পেছন সরু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলেন।

কি নাম বলব আপনার?

মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো।

 তাকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখে বুড়ি ঝি ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। তিনি একবার চারদিকে নজর বুলিয়ে নিলেন। ঘরটির আকৃতি ইংরাজি এল-এর মতো। প্রাচীন বনেদি পরিবারের পুরানো ঢংয়ের আসবাবপত্র। সমস্তই ঝকঝকে তকতকে। সেটি এবং চেয়ারগুলোয় দামি কুশন পাতা। দেওয়ালে টাঙানো পুরানো আমলের ফটোগ্রাফ। এছাড়া আসবাবপত্র আর বিশেষ কিছু নেই। ঘরটিও বেশ খোলামেলা। আলো হাওয়া প্রবেশের ব্যবস্থা ভালোই। টেবিলের ওপর একটা কাজ করা কাঁচের ফুলদানিতে বড় আকারের গোলাপ শোভা পাচ্ছে। অল্পক্ষণের মধ্যেইমিসেস লরিমার হাজির হলেন। তার চোখেমুখে ঘন বিস্ময়ের ছায়া। একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে সাধারণভাবে সেদিনের সুন্দর আবহাওয়া সম্বন্ধে প্রশান্তিসূচক মন্তব্য করলেন।

পোয়ারো মৃদু হাসলেন। তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন, আমার বিশ্বাস, ম্যাডাম এই অযাচিত আগমনকে ক্ষমার চোখেই দেখবে।

 মিসেস লরিমার সরাসরি পোয়ারোর দিকে চোখ তুলে তাকালেন বললেন, এই আগমনের সঙ্গে কি আপনার পেশার কোনো সম্পর্ক আছে? পোয়ারো অকপটে মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, আছে।

কিন্তু আপনার বোঝা উচিত,সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল বা অন্য কোন পুলিশ কর্মচারীকে আমি যথাসাধ্য সাহায্য করতে প্রস্তুত। তাই বলে একজন শখের গোয়েন্দার কোনো প্রশ্নের জবাবদিহি করতে আমি নিশ্চয় বাধ্য নই।

একথা আমি জানি ম্যাডাম। যদি আমায় আঙুল তুলে দরজা দেখিয়ে দেন তবে কিনা দ্বিধায় চলে যেতেও প্রস্তুত।

মিসেস লরিমারের মুখে ঈষৎ হাসির আভাস ফুটে উঠল। না না, আমি এখনই অমন চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাতে রাজি নই। তবে আপনাকে মাত্র দশ মিনিট সময় দিতে পারি। তারপরেই একটা ব্রিজের আসরে যোগ দেবার জন্য আমাকে বেরোতে হবে।

দশ মিনিটই আমার পক্ষে যথেষ্ট। আচ্ছা, সেদিন যে ঘরে বসে আপনারা ব্রিজ খেলছিলেন, অর্থাৎ যে ঘরে মিঃ শ্যাতানা নিহত হন, সে ঘরের একটা বর্ণনা আমায় দিতে পারেন?

মিসেস লরিমারের ভ্রু কুঞ্চিত হল। আপনার প্রশ্নটা ভারী অদ্ভুত। এর মাথামুণ্ডু কোন কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। এ ধরনের প্রশ্নের অর্থই বা কি?

কিন্তু ম্যাডাম, ব্রিজের টেবিলে আপনাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, এখানে টেক্কাটা কেন অত তাড়াতাড়ি খেলে বসলেন, অথবা ডামি থেকে হোট খেলে আপনি সাহেবটা না মেরে গোলামটা মারলেন কেন যার ফলে প্রতিপক্ষ বিবি দিয়ে পিট নিয়ে গেল, সাহেবটা মারলে তো আপনারই থাকত পিটটা? এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে আপনি নিশ্চয়। বিরক্ত বোধ করবেন। কারণ অনভিজ্ঞ আনাড়িকে বোঝানো খুবই কঠিন এবং শ্রমসাধ্য ব্যাপার এবং বললেও সে ভাবটা বুঝবে কিনা সন্দেহ। শুধু শুধু আপনার পরিশ্রমই সার হবে।

মিসেস লরিমার হাসিমুখে বললেন, তার অর্থ, আপনি বলতে চান গোয়েন্দাগিরির ব্যাপারে আপনার দক্ষতা যতখানি আমি ঠিক ততখানিই আনাড়ি। ঠিক আছে, আপনার কথা মেনে নিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত নই। মিনিট খানেক চুপ করে মনে মনে কি ভেবে নিলেন, তারপর আবার কথা শুরু করলেন। ঘরটা আকারে প্রকারে বেশ বড় ছিল, জিনিসপত্রও ছিল প্রচুর….কি কি জিনিস ছিল মনে আছে।

গোটা কতক কাঁচের ফুলদানি ছিল, আধুনিক ডিজাইনের, দেখতেও বেশ সুন্দর। মনে হচ্ছে চীনে বা জাপানি ঢংয়ের কতগুলো ছবিও দেওয়ালে টাঙানো দেখছি। একগুচ্ছ ছোট ছোট টিউলিপ। অবশ্য টিউলিপ ফুলের এখন সময় নয়, কি করে যে ভদ্রলোক সেগুলো জোগাড় করেছিলেন…

আর কিছু?

খুবই দুঃখিত বিশেষ মনোযোগ দিয়ে কিছুই লক্ষ্য করিনি।

আসবাবপত্রের কথা, সেগুলোর রঙ কি রকম ছিল কিছু মনে পড়ছে না। ধূসর সিল্ক রঙের দু-একটা আসবাবপত্র ছিল, এইটুকুই যা মনে পড়ে। ছোটখাটো অন্য কোনো বস্তু আপনার নজরে পড়েনি?

বোধহয় না। ঘরটা এত বেশি জিনিসপত্রে ঠাসা যে প্রথম ঢুকেই মনে হল যেন কোনো যাদুঘরে এসে পড়েছি। অল্প থামলেন মিসেস লরিমার। তারপর বললেন, আমি হয়তো আপনার কোনো কাজেই লাগতে পারলাম না।

আর একটা প্রশ্ন বাকি আছে। পোয়ারো পকেট থেকে ব্রিজের স্কোরশীটগুলো বার করে টেবিলের ওপর রাখলেন। এগুলো হচ্ছে প্রথম তিনটে রাবারের হিসেব। এই হিসেব দেখে সেদিনের ডিলগুলোর কথা কি আপনার মনে পড়বে?

কই দেখি। মিসেস লরিমার পোয়ারোর হাত থেকে স্কোরের কাগজগুলো নিয়ে তার ওপর ঝুঁকে পড়লেন। বললেন, এটা হল প্রথম রাবার। আমার পার্টনার ছিলেন মিস মেরিডিথ। অপরপক্ষে ডাক্তার রবার্টস আর মেজর ডেসপার্ড। প্রথম ডিলে আমরা তিনটে স্পেড ডেকেছিলাম। পাঁচের খেলা হয়। পরের তাসে দুটো ক্লাব ডাক হয়েছিল। ডাক্তার রবার্টস খেলতে পারেননি। একটা ডাউন দেন। তৃতীয় ডিলে খুব বেশি ডাকাডাকি চলে। আমার স্পষ্ট মনে আছে। মিস মেরিডিথ পাস দিলে একটা হার্ট দিয়ে মেজর ডেসপার্ড ডাক শুরু করেন। আমি পাস দিলাম। ডাক্তার রবার্টস লাফিয়ে বিড় দেন, সিটে ক্লাব। মিস মেরিডিথ এবার মুখ খোলেন। তিনি ডাকেন তিনটে স্পেড। মেজর ডেসপার্ড বলেন চারটে ডায়মন্ড। আমি ডবল দিই। ডাক্তার রবার্টস গোড়ার হার্ট রঙে ফিরে যান। কিন্তু চারটে হার্টসে একটা ডাউন দেন।

অপূর্ব! পোয়ারো সপ্রসংশ কণ্ঠে বললেন, কি অত স্মৃতিশক্তি আপনার।

মিসেস লরিমার প্রশংসায় বিশেষ কান দিলেন না। বলতে লাগলেন, পরের বার মেজর ডেসপার্ডের ডিল ছিল। তিনি পাস দেন। আমি একটা নো ট্রাম্প দিয়ে ডাক শুরু করলাম। রবার্টস আবার লাফিয়ে বললেন, তিটে হার্ট। আমার পার্টনার পাস দিলেন। মেজর ডেসপার্ড চারটে হার্ট ডাকলেন। আমি ডাবল দিলাম। ওরা দুটো শর্ট দিলেন। পরের তাসে আমরা স্পেড ডাকলাম কিন্তু একটা ডাউন হয়ে গেল।

মিসেস লরিমার পরের স্কোরশীটটা তুলে নিলেন।

পোয়ারো বললেন, মেজর ডেসপার্ড যেমন কেটে লিখেছেন, স্কোর দেখে তাসগুলো মনে আসা শক্ত হবে।

যতদূর মনে পড়ছে, প্রথম দুটো ডিলে দু’পক্ষই পঞ্চাশ করে শর্ট দিয়েছিলাম। তারপর ডাক্তার রবার্টস পাঁচটা ডিলে ডায়মন্ড ডাকলেন। আমরা ডবল দিয়ে তিনটে শর্ট দিলাম একশো। ওরা আবার পাঁচটা ক্লাবে গেম করলাম। পরের তাসটায় শর্ট দিলাম একশো। ওরা আবার একটা হার্ট খেলে গেলেন। কিন্তু পর পর দুটো নো ট্রাম্প এবং চারটে ক্লাবের খেলা করায় গেম হয়ে গেল। রাবারও পেলাম।

তৃতীয় স্কোরশীটিটা তুলে নিলেন মিসেস লরিমার। এই রাবারটায় খুব যুদ্ধ চলেছিল। আরম্ভ হয়েছিল অবশ্য খুব শান্তভাবে মেজর ডেসপার্ড এবং মিসেস মেরিডিথ প্রথমে একটা হার্টের খেলা করলেন। তারপর আমরা হার্ট ও স্পেডে গেম ডেকে একটা করে শট দিলাম। ওরা স্পেডে গেম করলেন। রাবার বাঁচাবার আশা খুব কম। এরপর তিনটে তাস আমরা একটা দুটো করে শর্ট দিলাম। অবশ্য ওরা কেউ ডবল দেননি। অবশেষে আমরা নোট্টাম্পে গেম খেলোম। তখন থেকেই যুদ্ধ শুরু হল। কেউ কাউকে সহজে ছেড়ে দিতে চায় না। ফলে প্রত্যেকেই ডাউন দিতে লাগলাম। ডাক্তার রবার্টসের বিডের তোড়ে মেরিডিথ একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তাস ভালো থাকলেও বেশি বিড দিতে ভরসা পাচ্ছিলেন না। এর পরেই ডাক্তার রবাটর্স গেম ফোর্সিং দুটো স্পেড় দিয়ে ডাক শুরু করেন। আমি বললাম তিনটে ডায়মন্ড। তিনি ডাকলেন চারটে নো ট্রাম্প। আমি পাঁচটা শেড। রবার্টস হঠাৎ ডায়মন্ডে গ্র্যান্ডস্লাম ডেকে বসলেন। ডেসপার্ডও মুখিয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, ডকল। হট লীডে তাসটায় তিনটে শট ছিল। ভাগ্য ভালো, লীড় হল ক্লাবের সাহেব। ফলে খেলা হয়ে গেল। খুবই উত্তেজনার মধ্যে শেষ হল রাবারগ।

হায় ভগবান!……ভাল মারেবল এ্যাভমের খেলা তার ওপর বল। যা, সত্যিই মহাউত্তেজনাকর ব্যাপার। আমি হলে ছয় সাতের ডাকে না গিয়ে গেমেই সন্তুষ্ট থাকতাম।

কিন্তু সেটা উচিত নয়। হাতে ভালো অস থাকলে নিশ্চয় হয় সাতের চেষ্টা করবেন।

 আপনি তাহলে ঝুকি নেবার পক্ষে।

ডাক নির্ভুল হলে ঝুঁকির কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এতো সহজ অঙ্কের ব্যাপার। তবে দুর্ভাগ্যবশত খুব অল্প লোকই নির্ভুল বিড দিতে পারে। প্রথম ডাকটা তারা হয়তো আইন মেনেই শুরু করে কিন্তু শেষে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে। নিজের তাস হয়তো আর এক পার্টনারের সঙ্গে মিলিয়ে মোট কটা পিট হওয়া সম্ভব সেটা তারা হিসেবে আনতে পারে না। অবশ্য এখন আপনাকে ব্রিজ সম্বন্ধে কোনো উপদেশ দেবার বাসনা আমার নেই, মঁসিয়ে পোয়ারো।

মিসেস লরিমার চতুর্থ স্কোরশীটটায় মনোনিবেশ করলেন। গতবারের দারুণ উত্তেজনার পর খেলাটা স্বভাবতই একটু ঝিমিয়ে পড়েছিল। কেউই আর বিড দিয়ে ঠিকমতো খেলা করতে পারছিলাম না। একটা দুটো করে ডাউন হয়ে যাচ্ছিল।

হ্যাঁ, বেশিক্ষণ খেলা চললে শেষকালে আর হিসেব রাখতে পারা যায় না, ভুল হতে শুরু করে।

ঠিকই বলেছেন। তাসগুলোও কেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

পোয়ারো স্কোরগুলো নিখুঁতভাবে ভাজ করে পকেটে রাখলেন। তারপর বিনয়ের সুরে বললেন, তাসের ব্যাপারে আপনার স্মৃতিশক্তি অতুলনীয়। এর জন্য আপনাকে অভিনন্দন জানাই। আমার বিশ্বাস, প্রত্যেক তাস কিভাবে খেলা হয়েছিল সমস্তই আপনার ছবির মতো স্পষ্ট মনে আছে।

হ্যাঁ, আছে বলেই আমার ধারণা। স্মৃতিশক্তি সত্যিই একটা অসামান্য উপহার। এর ফলে অতীতও কখনো হারিয়ে যাবার সুযোগ পায় না। আমার মনে হয়, আপনার কাছে অতীত নিজেকে নিয়ত ভাঁজ খুলে খুলে দেখায় প্রতিটি বিষয়, প্রতিটি খুঁটিনাটি যেন সবেমাত্র গতকালের ঘটনা। সবকিছু এত ঝকঝকে আর পরিষ্কার। বলুন, আমি ঠিক বলছি কিনা?

মিসেস লরিমার চকিত দৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকালেন। তার বড় চোখে যেন এক অন্ধকার ছায়া নেমে এল। কিন্তু সে মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপরেই নিজেকে সামলে নিলেন। তবে কিছুই পোয়ারোর দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না। তার তীর যে লক্ষ্যভেদ করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

মিসেস লরিমার উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, কিছু মনে করবেন না, আমি খুবই দুঃখিত। এক্ষুনি আমাকে বেরোতে হবে। আর দেরি করা অনুচিত।

নিশ্চয়, নিশ্চয়। আপনাকে দেরি করিয়ে দেবার জন্য আমার নিজেরই লজ্জিত হওয়া উচিত।

কিন্তু আপনার কোনো কাজে লাগতে পারলাম না।

সেজন্য কিছু ভাববেন না। আর ধারণাটাও সম্পূর্ণ সত্য নয়। আপনি সত্যিই আমার অনেক উপকারে এসেছেন।

মিসেস লরিমার তার প্রত্যয়ে স্থির নিশ্চল রইলেন। বললেন, আমার যদিও তেমন কিছু মনে হয় না।

কিন্তু ব্যাপারটা সত্য। আপনি এমন কিছু বলেছেন যা আমি জানতে চাইছিলাম।

মিসেস লরিমার সে বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। তিনি কি বলেছেন আর মঁসিয়ে পোয়ারোই বা কি জানতে পারলেন তাতে যেন তার কোনো ঔৎসুক্য নেই।

পোয়ারো উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন। আপনার সৌজন্যের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি সত্যিই অসাধারণ ব্যক্তি, মঁসিয়ে পোয়ারো।

বিধাতা আমাকে যেমনভাবে সৃষ্টি করেছেন আমি ঠিক তাই, ম্যাডাম।

সেকথা তো আমাদের সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

না না, আদৌ তা নয়। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার নিজেকে বড় বেশি জাহির করবার চেষ্টা করে। মিঃ শ্যাতনাই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

কেন? কোন দিক থেকে আপনি কথাটা বলছেন?

যেমন ধরুন, ভদ্রলোকের কোনো কিছু লক্ষ্য করবার মতো অদৃষ্টি ছিল। সে বিষয়ে তাঁর কৌতূহল ছিল যথেষ্ঠ। তাই নিয়েই তার সন্তুষ্ট থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তু সংগ্রহে মন দিলেন।

কি ধরনের বস্তু?

এই, মানে যাতে লোকে চমকে ওঠে; ভয় পায়।

আপনি কি মনে করেন সেটা তার চরিত্র বহির্ভূত।

বিষাদগ্রস্তের মতো মাথা নাড়লেন পোয়ারো। শয়তানের ভূমিকায় তিনি ভালোই অভিনয় করতে। কিন্তু সেটা তার আসল চরিত্র নয়। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন নির্বোধ। আর সেই জন্যেই তিনি মারা গেলেন।

নিজের বোকামির জন্যে ভদ্রলোক মারা পড়লেন?

হ্যাঁ বোধহীনতা থেকেই পাপের উদ্ভব। আর পাপের বেন মৃত্যু।

পোয়ারো কয়েক মুহূর্ত নীরব রইলেন। অবশেষে ধীরে ধীরে বললেন, ঠিক আছে, আজ আমি বিদায় নিচ্ছি, আপনার সৌজন্যের জন্যে শতশহস্র ধন্যবাদ। আর একটা কথা, আপনি ডেকে না পাঠালে আর কোনোদিনই আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে আসব না।

মিলেস লরিমারের ভ্রু কুঞ্চিত হল। কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো কেনই বা আমি আপনাকে ডেকে পাঠাব।

হয়তো পাঠাবেন, এ কেবল আমার একটা ধারণামাত্র যদি ডেকে পাঠান, আমি নিশ্চয় আসব। দয়া করে একথাটা স্মরণ রাখবেন।

পোয়ারো তাকে অভিবাদন জানিয়ে রাস্তায় পা দিলেন। তারপর মনে মনে অস্ফুট কণ্ঠে বিড়বিড় করলেন। আমি ঠিক,…আমার অনুমান ভুল হতে পারে না।…হয়তো এই রকমই ঘটে থাকবে ব্যাপারটা।