ব্যাকরণ (বেদাঙ্গসূত্র)
অধ্যয়নের বিষয়রূপে ব্যাকরণ নিশ্চিতই দীর্ঘকাল ধরে বহু গবেষক দ্বারা অনুশীলিত হচ্ছিল—প্ৰাচীন বিশেষজ্ঞদের অভিমত বিভিন্ন বেদাঙ্গে বহুবার উল্লিখিত হওয়ার মধ্যে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তবু একমাত্র পাণিনির বৈদিক ব্যাকরণটিই আমাদের নিকট এসে পৌঁছেছে, তাও আবার ধ্রুপদী ব্যাকরণ-বিষয়ক রচনার বৈদিক ব্যাকরণ-সংক্রান্ত বিষয় একটিমাত্র অধ্যায়েই নিহিত। এখানে পাণিনি ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষার অপ্রচলিত স্বরন্যাস এবং প্রাচীনতর ভাষার বিচিত্র ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে প্ৰণীত এই রচনায় ভাষা-আলোচনার ক্ষেত্রে ব্যাপ্তি লক্ষ্য করা যায়, কেননা বৈদিক ভাষা ততদিনে সম্পূর্ণ অপ্রচলিত হয়ে পড়েছে; দৈনন্দিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা এবং সাহিত্যরচনার ক্ষেত্রে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের উপভাষা ও ধ্রুপদী প্ৰাচীন ভারতীয় আর্যভাষা বৈদিক ভাষার বিকল্প হয়ে উঠেছিল।
পাণিনির দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতি অতুলনীয় এবং সম্পূর্ণত বৈজ্ঞানিক। বৈদিক অধ্যায়টি সংক্ষিপ্ত; ধ্রুপদী ভাষার অধ্যায়ে প্ৰযুক্ত পারিভাষিক শব্দ এখানেও ব্যবহৃত হয়েছে। তাছাড়া ধ্রুপদী ভাষা সম্পর্কে সচেতনতার আভাস এই সংক্ষিপ্ত অধ্যায়টিতে পরিস্ফুট। আরো পরবর্তীকালে পতঞ্জলি বৈদিক ভাষাকে ‘ছন্দঃ’ এবং কথ্য ভাষাকে ‘লৌকিক’ বা ‘ভাষা’ নামে অভিহিত করেছেন। পাণিনির মৌলিক অবদান সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা সহজ নয় কারণ তাঁর পূর্বসূরীদের রচনার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতির ফলে (এদের মধ্যে অনেকের নাম পাণিনি তার ব্যাকরণে উল্লেখ করেছেন)। আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না ব্যাকরণের কী কী ধারণা তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে অর্জন করেছিলেন আর কোন অংশ তার নিজস্ব উদ্ভাবন। তবে মনে হয় প্ৰত্যয় ও বিভক্তির মতো পারিভাষিক শব্দ এবং বর্ণমালা-সংক্রান্ত প্ৰাথমিক নিয়মাবলী যেমন শিবসূত্র, গণ ইত্যাদি সম্ভবত পাণিনির নিজস্ব অবদান। পাণিনি স্পষ্টতা, সংক্ষিপ্ততা ও দ্ব্যর্থবিহীনতার পক্ষপাতী; তাঁর সমগ্র ব্যাকরণ-প্রকরণে এই পূর্বানুমান আভাসিত যে সাহিত্য শ্রীতি-সঞ্চরণের উপর নির্ভরশীল। যদিও ততদিনে লিখন-প্রক্রিয়া প্রবর্তিত হয়ে গেছে। চূড়ান্ত সংক্ষিপ্ততার আদর্শরূপে তার ব্যাকরণ সেই সূত্ৰ-শৈলীর চমৎকার নিদর্শন যেখানে একটি বাহুল্য অক্ষরও বর্জিত হয়ে থাকে। যে যুগে সংস্কৃত আর কথ্য ভাষা ছিল না, সেই সময়েই পাণিনি ব্যাকরণ প্ৰণয়ন করেন, তাই তিনি প্রচলিত শব্দভাণ্ডারকে ব্যাপকভাবে অনুশীলন করেছিলেন, এতে অনুমান করা যায় যে ইতোমধ্যে সংস্কৃত মৃত ভাষা হয়ে পড়েছিল। বিখ্যাত গবেষক টি. বারো দেখিয়েছেন যে পাণিনির প্রচেষ্টায় সংস্কৃত ভাষা তৎকালে প্রচলিত রূপে চূড়ান্ত স্থিতিশীলতা অর্জন করেছিল। অন্যভাবে বলা যায়, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর এই বৈয়াকরণের আবির্ভাব বিশেষ তাৎপৰ্যপূৰ্ণ; কেননা তার রচনা প্রাচীন ভারতীয় আর্য ও মধ্যভারতীয় আর্যভাষার মধ্যে জলবিভাজন রেখারূপে বর্তমান। তৎকালীন ভাষাতাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষাটি ছিল জটিল, যেহেতু তখন বৈদিক, প্রত্ন-ধ্রুপদী সংস্কৃত ও কথ্য উপভাষাগুলি পরস্পরের সঙ্গে সহাবস্থান করছিল। কিন্তু মধ্যভারতীয় আর্যভাষা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও দুই সহস্রাব্দের বেশি কাল ধরে সংস্কৃত ও কথ্য উপভাষাগুলি পরস্পরের সঙ্গে সহস্রাব্দের বেশি কাল ধরে সংস্কৃত ভাষা বিদ্বদ্বত্তার একমাত্র মাধ্যম হয়ে রইল; পাণিনির ব্যাকরণ দ্বারা কঠোরভাবে তা নিয়ন্ত্রিত হত। তাই ভারতীয় বিদ্বৎসমাজে পাণিনির সম্মানিত প্ৰতিষ্ঠা অবিসম্বাদিত।
শিক্ষা ও প্রাতিশাখ্য, ব্যাকরণ ও নিরুক্ত স্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছে যে বৈদিক ভাষা কালক্রমে অপরিচিত ও বিরল হয়ে পড়েছিল। বস্তুত খ্রিস্টপূর্ব অষ্ট শতাব্দীতে বৈদিক ভাষা যেহেতু বিশেষ সহায়ক ব্যতীত দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে তাই কতকটা অনিবাৰ্যভাবেই একটি পবিত্রতার ধারণা যুক্ত হয়ে পড়ল। শুধুমাত্র বৃত্তিধারী পুরোহিত ও শিক্ষকদের কাছেই ঐ ভাষা বোধগম্য ছিল। এই বিশেষ ভাষাগত পরিপ্রেক্ষিতে–পবিত্রীভূত বৈদিক সাহিত্যের ভাষা থেকে যখন কথ্যভাষার কিছু কিছু অনুপুঙ্খ স্পষ্টভাবে পৃথক হয়ে পড়েছিল তখন শিক্ষা, ব্যাকরণ প্রভৃতির উত্থান ঘটায় এদের চরিত্রবৈশিষ্ট্যে ঐ পরিপ্রেক্ষা ধরা পড়েছিল। শিক্ষাগ্রন্থগুলিতে এমন অনেক কিছু পাওয়া যায় যা ইতোপূর্বে প্রাতিশাখ্যগুলিতে বিবৃত হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয়োক্ত রচনাগুলিতে যেহেতু এমন অনেক নিয়ম ছিল যাদের সঙ্গে বেদমন্ত্র আবৃত্তিকারীদের কোনো সম্পর্ক ছিল না-বেদমন্ত্র বিশুদ্ধভাবে আবৃত্তি করার জন্য উপযুক্ত বিধিসম্বলিত সংক্ষিপ্ত গ্ৰন্থ প্ৰণয়ন তাই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। ঐসব বিধিকে একই সঙ্গে বোধগম্য ও সহজে স্মরণযোগ্য আঙ্গিকে সন্নিবেশিত করার জন্যই “শিক্ষাগুলি রচিত হল; যখন বেদমন্ত্রের আবৃত্তি এত কৃত্রিম হয়ে পড়ল যে অপেক্ষাকৃত সরল প্রাতিশাখের নিয়মের সাহায্যে তাদের যথাযথ ব্যাখ্যাদান আর সম্ভব হল না–সে সময়ে এ-ধরনের গ্রন্থ প্রণয়ন আরো প্রয়োজনীয় হয়ে উঠলো। তাছাড়া প্রতিবেশী ভাষা অর্থাৎ অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষাগোষ্ঠীর প্রভাবে পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে প্ৰাচীন ভারতীয় আর্যভাষা আরো বেশি রূপান্তরিত হলো। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কাছাকাছি মধ্য-ভারতীয় আর্য ভাষা উদ্ভূত হয়েছিল এবং পরবর্তী শতাব্দী থেকে বৌদ্ধ সাহিত্য ক্রমশ অধিক মাত্রায় পালি ভাষায় রচিত হতে থাকে। এমন কি, ঋগ্বেদেও প্রাকৃত ভাষার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়; খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে অথর্ববেদ চতুর্থ বেদরূপে স্বীকৃতিলাভের পরে ধর্মগ্রন্থের শব্দভাণ্ডারে বহু লোকায়ত ও আঞ্চলিক ভাষাতাত্ত্বিক উপাদান প্রবিষ্ট হতে থাকে।
গ্রিক, শক, কুষাণ, হূন প্রভৃতি বৈদেশিক জাতির আক্রমণের পরে উচ্চারণ ও স্বরভঙ্গির ক্ষেত্রে সংশয় যেমন বহুগুণ বর্ধিত হলো, তেমনি স্বরন্যাসের চরিত্রও আমূল পালটে গেল। পরস্পরের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ভাষাগোষ্ঠীভুক্ত জনসাধারণের পাশাপাশি বসতি করে নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করল। এই পরিস্থিতির সুদূরপ্রসারী পরিণতি দেখা গেল প্ৰাচীন ভারতীয় আর্যের বৈদিক ভাষা যা ব্ৰাহ্মণ শ্রেণীর সীমাবদ্ধ অধিকারে পর্যবসিত হল। এরা বিভিন্ন কৌম ও গোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দূতের ভূমিকা গ্ৰহণ করেছিলেন (যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট কৌমের প্রতি তারা আনুগত্য প্ৰকাশ করতেন না)। প্ৰাচীন ভারতীয় বৈদিক আর্যভাষায় ব্ৰাহ্মণরা তাদের ধর্মানুষ্ঠান পরিচালনা করলেও এটা ছিল সেই সময় (৫০০-২০০ খ্রিস্টপূর্ব) যখন বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তার ফলে বৈদিক ধর্ম ও তদনুগামী ভাষার মহিমা ক্রমশ খর্ব হয়ে পড়েছিল। এই ভাষাগত সংশয়দীর্ণ জটিলতার পরিবেশে পুরোহিত সম্প্রদায়কে তঁদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণের দুরূহ দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। কিন্তু কঠোর ধর্মচৰ্যা ও প্রয়োজনীয় ভাষাগত প্ৰশিক্ষণের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান অনীহার ফলে ভাষার ক্ষেত্রে সমস্যা নিশ্চিতই প্রবল সংকট সৃষ্টি করেছিল। পবিত্র বৈদিক সাহিত্যের নিরবচ্ছিন্নতা রক্ষার ক্ষেত্রে সংকট-সম্ভাবনায় শঙ্কিত হয়ে পুরোহিতরা সংরক্ষিত ঐতিহ্যকে বিধিবদ্ধ করার জন্য যত্নবান হয়ে উঠেছিলেন; আঞ্চলিক রূপভেদকে তারা স্বাভাবিক ও কখনো কখনো অনুমোদনযোগ্য বিকল্প হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন।
প্ৰাচীন বিশেষজ্ঞদের নামোল্লেখ (যাঁদের রচনা আমাদের কাছে পৌঁছয় নি) প্রমাণিত করে যে বৈদিক সাহিত্যের অন্তিম পর্যায়ের সময় থেকে কথ্যভাষা ক্রমাগত প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা থেকে দূরে সরে যাওয়ায় শেষোক্ত ভাষা অপ্রচলিত হয়ে পড়েছে; যে-সমস্ত বিশেষজ্ঞের তত্ত্ব উপযুক্ত নমনীয়তা ও ব্যাপকতার জন্যে নিজেদের চিন্তাধারায় বিভিন্ন ভাষাগত রূপান্তরকে যথাযথ স্থান দিতে পেরেছেশুধুমাত্র সেইসব গ্ৰন্থই নিজস্ব অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। দ্ব্যর্থবিহীন স্পষ্টতার প্রয়োজনে সৃষ্ট সামঞ্জস্যবিধানের প্রবণতা বিভিন্ন প্ৰতিশাখ্যে বিশেষজ্ঞের অভিমত দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত। তাই যদিও আমরা প্রতি বেদের অনেক শাখা, এমনকি অনেক প্রাতিশাখের কথাও শুনি, প্রতি বেদের জন্য একটিমাত্র প্রাতিশাখাই আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। সংক্ষেপে বলা যায়–বৈদিক আবৃত্তি নিয়ন্ত্রণকারী ভাষাবিষয়ক নিয়মাবলী সূত্রে পরিণত হওয়া অনিবাৰ্য; তাই এ ধরনের নূতন অর্ধ লোকায়ত পদ্ধতির উদ্ভব ও বেদাঙ্গরূপে তাদের স্বীকৃতিলাভ সম্ভব হল।