বেশ কয়েক মিনিট চুপ করে রইলেন কাকাবাবু। তারপর উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বললেন, কী ব্যাপারটা হল বল তো?
সন্তু বলল, সমর চৌধুরী মাত্র তিনবার হেলিকপটার নিয়ে এসেছিলেন। গ্রামের লোক দেখেছে অন্তত পাঁচবার। আজ সমর চৌধুরীর আসবার কোনও কথাই নেই। আমার মনে হয়, আর একজন কেউ আসে।
কাকাবাবু বললেন, আর্মি ছাড়া আর কার কাছে হেলিকপটার থাকবে?
সন্তু বলল, তা হলে এটা হেলিকপটার নয়, অন্য কিছু!
কাকাবাবু বললেন, তুই এখনও ইউ এফ ওর কথা ভাবছিস?
সন্তু বলল, ওরা যেন কী কথা বলল, আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না।
কাকাবাবু বললেন, ভাল করে শুনতেও পাইনি। ওইটুকু সময়ের মধ্যে ওরা কী এমন কথা বলবে? সব ব্যাপারটাই আমার কাছে ধাঁধার মতন লাগছে।
সন্তু বলল, সব যখন অন্ধকার হয়ে গেল, তখন আকাশের ওই জিনিসটা থেকে টোবি দত্তর ছাদে কোনও জিনিস নামিয়ে দিয়ে যায়নি তো? কিংবা কোনও লোক নেমেছে?
কাকাবাবু বললেন, আজ আর কিছু জানা যাবে না। চল, এবার ফেরা যাক।
হাঁটতে শুরু করে সন্তু বলল, কাকাবাবু, তুমি যেটাকে হেলিকপটার বলছ, সেটা যখন আগুন ছড়াতে-ছড়াতে উড়ে এল, তখন আমার বুকটা কাঁপছিল। আমার মনে হচ্ছিল, ওটা আমাদের পৃথিবীর কিছু নয়, আরও দূর থেকে আসছে।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে পৃথিবীতে আমরাই প্রথম স্বচক্ষে অন্য কোনও গ্রহের বায়ুন দেখলাম? কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয়, সত্যি-সত্যি? কিন্তু সন্তু, হেলিকপটারের ফট-ফট ফট-ফট শব্দটা যে লুকনো যায় না?
সন্তু বলল, ওদের কোনও বায়ুযানে একই রকম শব্দ হতে পারে। টোবি দত্ত সেইজন্যই আকাশে আলো দেখায়।
কাকাবাবু বললেন, পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে টোবি দত্তর সঙ্গেই বা শুধু অন্য গ্রহের প্রাণীদের ভাব হতে যাবে কেন?
সন্তু বলল, আমি একবার ওর ছাদে উঠে দেখে আসব?
কাকাবাবু চমকে উঠে বললেন, তুই ওর ছাদে উঠবি কী করে?
সন্তু বলল, চেষ্টা করে দেখতে পারি। টোবি দত্ত ওর বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেয় না। এখন চুপিচুপি দেখে আসা যায়। ওর বাড়িতে তো কুকুর নেই।
কাকাবাবু বললেন, যাঃ, পাগল নাকি? নাঃ, ওসব দরকার নেই। ফিরে গিয়ে এখন ঘুমনো যাক। কাল সকালে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করা যাবে!
নদীর ধার ছেড়ে ওরা উঠে এল রাস্তার দিকে। টোবি দত্তর বাড়িটা ডানপাশে। এখন সেটা আগের মতনই অন্ধকার। কোনও সাড়াশব্দ নেই।
কাকাবাবু বললেন, অন্যের মুখে শোনা আর নিজের চোখে দেখায় কত তফাত বুঝলি? সবাই বলেছে, আলোটা সোজা আকাশের দিকে উঠে যায়। তারপর যে আলোটা বেঁকে অনেকক্ষণ জঙ্গলের মধ্যে থাকে, সেটা কেউ বলেনি।
সন্তু এ ব্যাপারটায় তেমন গুরুত্ব দিল না। সে আগুনের পাখির মতন বায়ুযানটার কথাই ভাবছে।
কাকাবাবু আবার আপনমনে বললেন, জঙ্গলের মধ্যে ওরকম আলো ফেলার মানে কী?
সন্তু বলল, আকাশ দিয়ে আগুন ছড়াতে-ছড়াতে অত শব্দ করে জিনিসটা উড়ে এল, তবু গ্রামের কোনও লোক জাগেনি?
কাকাবাবু বললেন, কেউ-কেউ নিশ্চয়ই জেগে উঠে দেখেছে। ভয়ে বেরোয়নি বাড়ি থেকে।
সন্তু কাকাবাবুর গা ঘেঁষে এসে বলল, কাকাবাবু, আমার খুব ইচ্ছে করছে ওই বাড়ির ছাদটা একবার দেখে আসতে। আমার দৃঢ় ধারণা, ওখানে অন্য গ্রহের কোনও প্রাণী আছে।
কাকাবাবু বললেন, দূর, যতসব উদ্ভট ধারণা!
তবু একবার দেখে আসি না!
তুই ছাদে উঠবি কী করে? বাড়ির বাইরের দেওয়ালে মোটা-মোটা জলের পাইপ আছে। সেই একটা পাইপ বেয়ে উঠে যাব।
তারপর ধরা পড়ে গেলে?
ধরা পড়ব কেন? এখন সব শুনশান হয়ে গেছে। এ বাড়িতে বেশি লোক নেই তা তো বোঝাই যাচ্ছে। কুকুরও নেই। আমি টপ করে দেখে চলে আসব।
কী যে বলিস, সন্তু! হঠাৎ যদি ধরা পড়িস—আমি তোকে উদ্ধার করব কী করে? আমি তো আর পাইপ বেয়ে উঠতে পারব না?
আমাকে ধরে রাখলে তো সুবিধেই হবে। তুমি পুলিশ ডেকে তখন জোর করে ওর বাড়িতে ঢুকতে পারবে।
তবু আমার ভাল লাগছে না রে, সন্তু?
তুমি কিচ্ছু ভেবো না। আমি খুব সাবধানে যাব। যদি একটা দারুণ কিছু আবিষ্কার করে ফেলতে পারি?
টোবি দত্তর বাড়ির পেছন দিকে দুজনে আগে খানিকটা ঘোরাঘুরি করে দেখে নিলেন। এদিকে কোনও পাহারাদার নেই। কাকাবাবু দু-একবার টর্চ জ্বালালেন নিচু করে, তাতেও কিছু হল না।
সত্যিই দুটো জলের পাইপ রয়েছে দেওয়ালে। পুরনো আমলের মোটা-মোটা পাইপ। সন্তু নিজের ক্যামেরাটা কাকাবাবুকে রাখতে দিয়ে নিজে একটা টর্চ পকেটে রাখল।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুই এই পাইপ বেয়ে উঠতে পারবি?
সন্তু পাইপটার গায়ে একটা চাঁটি মেরে বলল ইজি! নাইজিরিয়াতে এর চেয়েও শক্ত আর অনেক উঁচুতে পাইপ বেয়ে কতবার উঠেছি!
কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে তাকাতেই সন্তু বলল, এটা আমার কথা নয়। হঠাৎ মনে হল, জোজো এখানে থাকলে এইরকম কথাই বলত।
এত উদ্বেগের মধ্যেও কাকাবাবুর মুখে পাতলা হাসি ফুটে উঠল। সন্তু যে এখনও ইয়ার্কি করতে পারছে, তার মানে ওর মনে ভয় ঢোকেনি। ছেলেমানুষ তো, ইউ এফ ও আবিষ্কার করার উত্তেজনায় ছটফট করছে।
কাকাবাবু বললেন, দশ মিনিটের বেশি কিছুতেই থাকবি না।
সন্তু জুতো খুলে পাইপটা জড়িয়ে ধরে উঠতে শুরু করল। কাকাবাবু এখনও ভাবছেন, কাজটা হঠকারিতার মতন হয়ে গেল কি না! দুঃসাহস আর হঠকারিতা এক নয়। টোবি দত্ত অভদ্র, রুক্ষ, নিষ্ঠুর ধরনের লোক। সন্তুকে ধরে ফেলে যদি অত্যাচার করে!
সন্তু আস্তে-আস্তে উঠতে লাগল। মরচে-ধরা পাইপ বলেই পিছলে যাচ্ছে না হাত। মাঝে-মাঝে আংটা আছে, পা রাখা যায়। একতলা পেরিয়ে দোতলায় উঠে গেল সে। এক জায়গায় পাশে একটা জানলা পড়ল, সেটা ভেতর থেকে বন্ধ। দোতলায় কার্নিসে এসে একটুক্ষণ থেমে-থেমে শব্দ শুনবার চেষ্টা করল। তারপর শোনা গেল একটা বাচ্চা ছেলের গলায়, আচ্ছা, আচ্ছা, আচ্ছা!
কে যেন কী হুকুম করল তাকে।
বাচ্চার গলাটা আবার বলল, আচ্ছা, আচ্ছা, আচ্ছা!
এবাড়িতে কোনও বাচ্চা ছেলে আছে, তা তো কেউ আগে বলেনি!
এরপর একটা গম্ভীর মোটা গলা বলল, আচ্ছা, আচ্ছা আচ্ছ!
যেন একজন কেউ একটা বাচ্চাকে কথা বলা শেখাচ্ছে। সন্তুর মনটা আনন্দে নেচে উঠল। ই টি? অন্য গ্রহের শিশু?
এবার সন্তু আস্তে মাথা তুলল। কেউ নেই। প্রথমে একটা ছোট ছাদ। তারপর একটা পাঁচিলের ওপর আবার ছোট ছাদ। বড় বাড়ি হলেও ছাদগুলো খোপ-খোপ করা। একপাশে একটা ঘর, কথা শোনা যাচ্ছে সেখান থেকেই।
সন্তু একটা পাঁচিল ডিঙিয়ে এল। পরের ছাদটায় একটা কোনও বড় যন্ত্র ঢাকা দেওয়া আছে। ওইটাই নিশ্চয়ই আলোর ব্যাপার। আরও কয়েকটা কাঠের বাক্স এদিক-ওদিক ছড়ানো।
দ্বিতীয় পাঁচিলটা ডিঙোতে যেতেই কয়েকটা খুব সরু-সরু তারে তার পা লেগে গেল। পাঁচিলের নীচের দিকে এই তারগুলো টান-টান করে বাঁধা আছে। ইলেকট্রিক তার নয়। সেতারের তারের মতন। মৃদু ঝন্ন করে শব্দ হল। সন্তু চট করে সেখান থেকে সরে গিয়ে দাঁড়াল আর-একটা পাঁচিলের পাশে। দাঁড়িয়ে রইল কাঠ হয়ে।
খুট করে শব্দ হয়ে জ্বলে উঠল একটা মিটমিটে আলো। খুলে গেল ঘরের দরজা। তারপর সন্তু যা দেখল, তাতে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল, যেন তার চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসবে।
দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল একটা কঙ্কাল। সাদা হাড় আর মাথার খুলি, চোখ দুটোর জায়গায় সবুজ আলো জ্বলছে।
সন্তু ভাবল, এ আমি কী দেখছি? ভূত? কিন্তু ভূত বলে তো কিছু নেই। আমি ভূত বিশ্বাস করি না। তবে কি চোখের ভুল!
সন্তু চোখ কচলে নিল। না। একটা সত্যিকারের কঙ্কাল এগিয়ে আসছে তার দিকে।
সন্তু তবু জোর দিয়ে ভাবার চেষ্টা করছে, না, না, হতেই পারে না। মানুষের শুধু কঙ্কাল হাঁটবে কী করে? কঙ্কালের তো প্রাণ থাকে না! তবু ওটা হেঁটে আসছে, ধপধপ আর ঝনঝন শব্দ হচ্ছে।
সন্তু এমনই স্তম্ভিত হয়ে গেছে যে, তার পা যেন গেঁথে গেছে মাটির সঙ্গে। সে পালাতেও পারছে না। সে প্রাণপণে বলবার চেষ্টা করছে, এটা চোখের ভুল, ভূত নেই, ভূত নেই, কঙ্কাল হাঁটতে পারে না, পারে না!
কঙ্কালটা কাছে এসে পড়ে দু-হাত দিয়ে সন্তুর কাঁধ চেপে ধরে শূন্যে তুলল। অসম্ভব শক্ত আর ঠাণ্ডা তার হাত। সন্তু নড়তে চড়তে পারছে না। কঙ্কালটা এইবার তাকে ছুড়ে ফেলে দেবে।
ঠিক তক্ষুনি গম্ভীর মোটা গলায় কেউ ডাকল, রোবিন! রোবিন!
কঙ্কালটা অমনই একটা বাচ্চা ছেলের গলায় বলে উঠল, আচ্ছা, আচ্ছা, আচ্ছা!
দরজার সামনে এখন এসে দাঁড়িয়েছে একজন লম্বাচওড়া মানুষ। কঙ্কালটা থপথপিয়ে এসে সন্তুকে নামিয়ে দিল সেই লোকটির সামনে।
সন্তু লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে আরও কেঁপে উঠল। এ কী দেখছে। সে? লোকটির মোটে একটা চোখ, অন্য চোখটার জায়গায় শুধু একটা অন্ধকার গর্ত!
লোকটি কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল, কী চাই এখানে?
লোকটির মুখ দেখে চিনতে পারেনি সন্তু। চোখের গড়ন দেখেই মানুষকে চেনা যায়। কিন্তু গলার আওয়াজ শুনে বুঝল, এই-ই টোবি দত্ত। কিন্তু সকালবেলা নদীর ধারে সে দেখেছিল টোবি দত্তকে, তখন তার দুটো চোখই ঠিকঠাক ছিল, এখন একটা চোখ একেবারে অদৃশ্য। অন্য চোখটা জ্বলছে। তা হলে কি টোবি দত্তও মানুষ নয়? অন্য গ্রহের প্রাণী? এদের আসল রূপ এমন বীভৎস?
সন্তু আর চিন্তা করতে পারল না। তার পেছনে একটি জীবন্ত কঙ্কাল, সামনে একটি একচক্ষু দৈত্য। তার বুক চিরে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল। সে আ-আ-আ শব্দ করতে-করতে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
কাকাবাবু সন্তুর আর্তনাদ শুনতে পেলেন না। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন পাইপের নীচে। তাঁর রেডিয়াম দেওয়া ঘড়ি অন্ধকারেও দেখা যায়। ঘনঘন ঘড়ি দেখছেন। সন্তু ওপরে ওঠার পর এখনও দশ মিনিট কাটেনি।
হঠাৎ পেছনে খড়মড় শব্দ হতেই তিনি রিভলভার নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। প্রথমে কিছু চোখে পড়ল না। টর্চ জ্বালাতেই দেখলেন, একটা ঝোপের পাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে মণিকা। তার মুখে দুষ্টুমির হাসি।
কাকাবাবু দারুণ চমকে গিয়ে বললেন, এ কী, তুমি এখানে?
মণিকা তার উত্তর না দিয়ে বলল, সন্তুর কী হল? নিশ্চয়ই ধরা পড়ে গেছে।
কাকাবাবু বিরক্তভাবে বললেন, তোমাকে বাড়িতে যেতে বলেছি, তুমি এতক্ষণ বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছ?
মণিকা বলল, বাড়ি গিয়েছিলাম তো! আগুন-পাখিটা যখন এল, সেই আওয়াজে আবার ঘুম ভেঙে গেল। বাড়িতে আমার ভয় করছিল।
কাকাবাবু বললেন, অন্ধকারে একা-একা ঘুরে বেড়াতে বুঝি ভয় করে না!
মণিকা বলল, একা তো ঘুরিনি। তোমাদের কাছাকাছিই ছিলাম। কিন্তু সন্তু ফিরছে না কেন? ধরা পড়ে গেছে। ও চেঁচিয়ে বলল, শুনতে পাওনি!
কাকাবাবু বললেন, না তো!
মণিকা বলল, আমি গিয়ে দেখে আসছি!
কাকাবাবু বললেন, তুমি কোথায় যাবে?
মণিকা বলল, ছাদে! আমিও পাইপ বেয়ে উঠতে পারব। আমি ছাদে চড়তে জানি!
কাকাবাবু বললেন, পাগলের মতন কথা বোলো না। তুমি পাইপ বেয়ে উঠবে?
মণিকা বলল, মেয়ে বলে বুঝি পারব না? দেখো না!
সত্যিই সে পাইপ বেয়ে ওঠার চেষ্টা করল। এ যে আর-এক ঝামেলা! সে কাকাবাবুর নিষেধ শুনবে না কিছুতেই। কাকাবাবু দৃঢ়ভাবে তার কাঁধ ধরে এক হ্যাঁচকা টানে নামিয়ে এনে বললেন, শোনো, তোমাকে আরও শক্ত একটা কাজ করতে হবে!
মণিকা বলল, কী?
কাকাবাবু বললেন, আমরা দুজন দরকার হলে দরজা ভেঙে এই বাড়ির মধ্যে ঢুকব! কিন্তু তার আগে একটা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সামনের লোহার গেটের কাছে গুমটির মধ্যে একজন পাহারাদার বসে আছে। তুমি তাকে গুমটির বাইরে ডেকে আনতে পারবে?
মণিকা বলল, ওর হাতে বন্দুক থাকে।
কাকাবাবু বললেন, বন্দুক থাকলে কী হয়েছে! তোমার মতন একটা মেয়েকে দেখামাত্র গুলি করবে নাকি? সে ভয় নেই। তুমি ওর গুমটির সামনে গিয়ে কাঁদতে শুরু করো। কাঁদতে কাঁদতে বলবে যে, তোমাদের বাড়িতে চোর এসেছে, ওর সাহায্য চাইতে এসেছ।
মণিকা বলল, যদি তবুও না বেরোয়?
কাকাবাবু বললেন, যা হোক বানিয়ে বলবে। চোরেরা তোমাকে মেরেছে, পা দিয়ে রক্ত পড়ছে! কোনওক্রমে ওকে বের করা চাই! যাও, ছুটে যাও!
কাকাবাবু আর-একবার পাইপের ওপর দিকটা দেখলেন। সন্তুর কোনও চিহ্ন নেই। সন্তু ধরাই পড়ে গেছে তা হলে।
তিনিও দ্রুত এগিয়ে গেলেন গুমটির দিকে।
মণিকা বেশ ভালই অভিনয় করতে পারে। সে কেঁদে-কেঁদে বলছে, ওগো, আমাদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে! সব নিয়ে গেল। আমার বাবাকে বেঁধে রেখেছে।
গুমটির পাহারাদারটি ভেতর থেকেই কথা বলছে। বাইরে আসবার লক্ষণ নেই।
মণিকা মাটিতে বসে পড়ে বলল, আমার পায়ে রামদা দিয়ে কোপ মেরেছে।
লোকটি বলল, আমার যে এখান থেকে কোথাও যাওয়ার হুকুম নেই। দেখি, পায়ে কতখানি লেগেছে?
লোকটি বেরিয়ে আসতেই আড়াল থেকে এসে কাকাবাবু রিভলভার ঠেকিয়ে কঠিন গলায় বললেন, বন্দুকটা ফেলে দাও! নইলে তোমার মাথার খুলি উড়ে যাবে।
লোকটি বন্দুকটা ফেলে দিয়ে বলল, এখানেও ডাকাত?
কাকাবাবু বললেন, বাড়ির কাছে চলো। দরজা খুলতে হবে।
লোকটি বলল, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, আমি খুলব কী করে?
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বাড়ির মধ্যে কজন লোক আছে?
লোকটি বলল, তিন-চারজন হবে। আমি তো ভেতরে যাই না।
দরজার কাছে এসে কাকাবাবু বললেন, লাথি মারো। ভেতরের লোকজনদের ডাকো!
লোকটি বেশ অবাক হয়ে বলল, দলে আর কেউ নেই? আপনি একা, মানে বগলে লাঠি নিয়ে যেতে চান!
কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, ডাকো!
মণিকা দমাদম সেই দরজায় লাথি মারতে লাগল।
কাকাবাবু চিৎকার করে ডাকলেন, টোবি দত্ত, টোবি দত্ত! দরজা খোলো! আমি রাজা রায়চৌধুরী।
কয়েকবার ডেকেও কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।
কাকাবাবু বললেন, মণিকা, পাহারাদারের রাইফেলটা কুড়িয়ে নিয়ে এসো তো! গুলি করে আমি দরজা ভেঙে ফেলব।
মণিকা রাইফেলটা নিয়ে আসার আগেই দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল। হাতে একটা হ্যাজাক বাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টোবি দত্ত। স্থির দু চোখে কটমট করে তাকাল কাকাবাবুর দিকে।
কাকাবাবুর রিভলভারটা তখনও পাহারাদারের ঘাড়ে ঠেকানো। এক ঝটকায় পাহারাদারকে সরিয়ে দিয়ে টোবি দত্তর দিকে রিভলভার উঁচিয়ে বললেন, সন্তু কোথায়? সন্তুর যদি কোনও ক্ষতি হয়, তোমাকে আমি চরম শাস্তি দেব। এই বাড়িটা গুঁড়িয়ে চুরমার করে দেব!
টোবি দত্ত কাকাবাবুর রিভলভার কিংবা ভয়-দেখানো কথা গ্রাহ্যই করল না। ঠাণ্ডা গলায় বলল, অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে আসেন কেন? মাইন্ড ইওর ওউন বিজনেস।
তারপর মাথাটা পেছন দিকে ফিরিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আবার বলল, ছেদিলাল, ছেলেটাকে বাইরে শুইয়ে দে। ওর কিছু হয়নি, নিজেই ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
টোবি দত্তর পেছনে দাঁড়িয়ে একজন বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা লোক। সে দু হাতে পাঁজাকোলা করে ধরে আছে সন্তুকে। আস্তে-আস্তে সে সন্তুকে মাটিতে শুইয়ে দিল।
তারপরেই দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল দরজা।