রাক্ষসের মায়া যত, সব দূর হৈল।
শিলাবৃষ্টি বরিষণ ঝড় কোথা গেল।।
দূর হৈল অন্ধকার, সুপ্রকাশ ভানু।
পরস্পর নিরীক্ষয়ে নিজ নিজ তনু।।
কেহ বলে, আরে ভাই অনর্থ হইল।
রাজার যজ্ঞের ঘোড়া কেবা লয়ে গেল।।
কেহ বলে, অশ্বেকে ধরিয়া একজন।
দেখিনু আকাশপথে করিল গমন।।
কি বলিয়া যাব মোরা নৃপ সন্নিধানে।
ঘোড়া না দেখিয়া রাজা বধিবেক প্রাণে।।
গন্ধর্ব্ব কিন্নর কেবা ঘোড়া নিল হরি।
ধেয়ে যায় নৃপসৈন্য হাতে ধনু ধরি।।
আকাশপথেতে কেহ করে নিরীক্ষণ।
কেহ বলে, ঘোড়া নিল সহস্রলোচন।।
কোলাহল করি সৈন্য ধাইল পর্ব্বতে।
আগু হৈল ভীমসেন ধনুর্ব্বাণ হাতে।।
মেঘবর্ণ বলে, শুন পিতামহ বীর।
ঘোড়া লয়ে যাই চলি হস্তিনা নগর।।
অগোচরে যাই, যুদ্ধ নাহি প্রয়োজন।
তত্ত্ব নাহি পায় যেন নৃপ সৈন্যগণ।।
ভীম বলে, মেঘবর্ণ কি কর বিচার।
শুনিলে হাসিবে কৃষ্ণ সংসারের সার।।
উপহাস করিবেন মোরে ধনঞ্জয়।
চুরি করি বৃকোদর আনিলেক হয়।।
এ সব নিন্দিত কর্ম্ম আমি না করিব।
বাহুবলে নৃপসৈন্য আমি পরাজিব।।
বক হিড়িম্বক মারি কির্ম্মীর দুর্ব্বার।
শত ভাই কীচকেরে করিনু সংহার।।
বিনাশ করিনু শত ভাই দুর্য্যোধনে।
অশ্ব লুকাইয়া লব, এ বল কেমনে।।
অপযশ থাকিবেক অবনী-মণ্ডলে।
পাণ্ডবের সখা কৃষ্ণ সর্ব্বলোকে বলে।।
ইহা যদি বলিলেন বীর বৃকোদর।
ঘটোৎকচ-সুত বলে যুড়ি দুই কর।।
ঘোড়া লয়ে তোমরা থাকহ দুই জন।
আজ্ঞা কর যাই আমি করিবারে রণ।।
এত বলি ভীমসেনে করিয়া প্রণাম।
মেঘবর্ণ বীর যায় করিতে সংগ্রাম।।
উপাড়ি পাথরখণ্ড নিল বাম হাতে।
সিংহনাদ করি যায় সংগ্রাম করিতে।।
এড়িল পাথরখান দিয়া হুহুঙ্কার।
পাথর চাপনে হৈল সৈন্যের সংহার।।
চারি শত সেনাপতি গেল যমঘরে।
দুই শত হস্তী মরে শিলার প্রহারে।।
গাছ শিলা আঘাতে পড়িল সেনাচয়।
একলা করিছে যুদ্ধ রাক্ষস দুর্জ্জয়।।
পরস্পর নৃপসেনা মনে বিচারিল।
সঙ্কট সংগ্রাম দেখি রণে ভঙ্গ দিল।।
ঊর্দ্ধশ্বাসে ধেয়ে গেল পুরীর ভিতরে।
যোড়হাতে বার্ত্তা কহে নৃপতি গোচরে।।
শুন রাজা, ঘোড়া নিল সহস্রলোচন।
শিলাবৃষ্টি ঘোরতর কৈল বরিষণ।।
অন্ধকার কেহ নাহি চিনে আত্ম-পর।
ধরিয়া যজ্ঞের ঘোড়া নিল পুরন্দর।।
ঘোড়া লয়ে পর্ব্বতে গেলেন সুরপতি।
কুবের বরুণ যম আছেন সংহতি।।
তাঁর সহ যুদ্ধ করিলাম প্রাণপণে।
শরীর জর্জ্জর হৈল দেবতার বাণে।।
গজ বাজী পড়িল বিস্তর সেনাগণ।
পলাইনু প্রাণ লয়ে পরিহরি রণ।।
শুনিয়া কুপিল যুবনাশ্ব নৃপবর।
সাজ সাজ বলি ঘন ডাকে নরেশ্বর।।
নৃপআজ্ঞা পাইয়া যতেক সেনাগণ।
হরিষেতে গেল সবে করিবারে রণ।।
গজ বাজী বিমানেতে আরোহণ করি।
পদাতিকগণ যায় হাতে খড়্গ ধরি।।
ধনুর্ব্বাণ লয়ে হাতে সাজে যত জন।
কোলাহল করি যায় নৃপ সেনাগণ।।
যুঝিতে চলিল যুবনাশ্ব মহাবল।
ভুজঙ্গনাথের ফণা করে টলমল।।
আপনি নৃপতি এল যুদ্ধ করিবারে।
বৃষকেতু কহে কথা ভীমের গোচরে।।
আজ্ঞা কর, খুড়া আমি করি গিয়া রণ।
আজি যুবনাশ্বে আমি করিব নিধন।।
অনুমতি দিল ভীম বৃষকেতু বীরে।
কর্ণের নন্দন যায় হাতে ধনু ধরে।।
আকর্ণ পূরিয়া বীর টঙ্কারিল ধনু।
সিংহনাদে কম্পমান নৃপতির তনু।।
সিংহনাদে নৃপতির মন উচাটন।
ডাক দিয়া বলে রাজা, শুন সেনাগণ।।
একেশ্বর আসে মোর সৈন্যের ভিতরে।
অসীম সাহস বীর শঙ্কা নাহি করে।।
কিবা ইন্দ্রদেব কিবা শমন পবন।
মানুষের রূপে এল করিবারে রণ।।
সাহস করিয়া সবে কর গিয়া রণ।
নৃপাদেশে সাহস করিল সেনাগণ।।
মার মার শব্দে সবে আরম্ভিল রণ।
নানা অস্ত্র বরিষয়ে না হয় গণন।।
রাজপুত্র সুবেগ সে বড় বীরবর।
করিপৃষ্ঠে আসে সেই করিতে সমর।।
হংসব্যূহ করি সেই আরম্ভিল রণ।
ব্যূহ ভেদি বৃষকেতু মারে সেনাগণ।।
একত্র হইয়া যত নৃপতির সেনা।
বাণবৃষ্টি করে সবে, নাহিক গণনা।।
বৃষকেতু-শিরে পড়ে লক্ষ লক্ষ বাণ।
তথাপি সে নহে ভীত হেন বলবান্।।
কাতর হইল বীর বাণের প্রহারে।
তাহা দেখি ভীম বীর কুপিল অন্তরে।।
ভীম বলে, মেঘবর্ণ শুনহ বচন।
একা গেল বৃষকেতু করিবারে রণ।।
পর্ব্বতে থাকহ তুমি ঘোটক লইয়া।
যুদ্ধ করিবারে আমি যাইব সাজিয়া।।
এত বলি ভীমসেন করিল গমন।
বৃষকেতু সম্মুখে আইল সেইক্ষণ।।
ভীমে দেখি বৃষকেতু হরিষ অন্তরে।
যোড়হাত করি বীর নিবেদন করে।।
আপনি আসিলে কেন সংগ্রাম ভিতর।
আমি যুদ্ধ জিনিতে পারিব একেশ্বর।।
ভীম বলে, নৃপতির বহুতর সেনা।
দরশনে আমি বড় হইনু উন্মানা।।
একলা করিছ যুদ্ধ, ভয় করি মনে।
বিনাশিব নৃপসেনা মোরা দুই জনে।।
এত বলি দুই জনে করেন সন্ধান।
ঈষৎ হাসিয়া এড়ে শত শত বাণ।।
বৃষকেতু দেখিয়া বলিছে নৃপবর।
কাহার তনয় তুমি মহাধনুর্দ্ধর।।
কি নাম তোমার হে, আসিলে কি কারণ।
পরিচয় দেহ আগে তোমরা দুজন।।
যুবনাশ্ব-বচনেতে বৃষকেতু বীর।
পরিচয় দিল নৃপে প্রফুল্ল শরীর।।
রবির তনয় কর্ণ জানে এ জগতে।
জনম হইল তাঁর কুন্তীর গর্ভেতে।।
কর্ণের তনয় আমি নাম বৃষকেতু।
তুরঙ্গ লইনু যুধিষ্ঠির-যজ্ঞ-হেতু।।
তাহা শুনি যুবনাশ্ব আনন্দিত মন।
ধন্য ধন্য মহাবীর কর্ণের নন্দন।।
এ নহে উচিত, শুন কর্ণের নন্দন।
আমার বচনে কর রথে আরোহণ।।
তবে সে করিব দুই জনে ঘোর রণ।
এত শুনি ডাকি বলে কর্ণের নন্দন।।
শুন রাজা মম রথে নাহি কোন কাজ।
তুমি রথে যুদ্ধ কর, শুন মহারাজ।।
বৃষকেতু-বাক্য রাজা দুঃখিত অন্তরে।
রথ ত্যজি নামিলেন ধরণী উপরে।।
দোঁহে যুদ্ধে বিশারদ, কেহ নহে ঊন।
দোঁহে দোঁহাকার কাটি পাড়ে ধনুর্গুণ।।
পুনরপি ধনুক লইল দুই জন।
বাণ বরষিয়ে দোঁহে ছাইল গগন।।
বাণে বাণে দোঁহে কৈল অনেক সংগ্রাম।
কেহ কারো ঊন নহে, দোঁহে অনুপাম।।
তবে যুবনাশ্ব রাজা ক্রোধযুক্ত হয়ে।
অগ্নিবাণ এড়িলেক আকর্ণ পূরিয়ে।।
এড়িল বরুণ বাণ কর্ণের তনয়।
নির্ব্বাণ হইল অগ্নি, নাহি আর ভয়।।
বায়ু-অস্ত্র নরপতি এড়িলেক রণে।
পর্ব্বতাস্ত্রে নিবারয় কর্ণের নন্দনে।।
সর্পবাণ যুবনাশ্ব কৈল অবতার।
গরুড়াস্ত্রে কর্ণসুত করিল সংহার।।
হেনমতে দোঁহে কৈল অনেক সংগ্রাম।
বাণের উপরে বাণ করেন সন্ধান।।
তবে বৃষকেতু বীর কর্ণের নন্দন।
কোপযুক্ত হয়ে করে বাণ বরিষণ।।
নিবারয়ে যুবনাশ্ব ধনুঃশর হাতে।
তাহা দেখি ভীমসেন দুঃখ ভাবে চিতে।।
তবে যুবনাশ্ব রাজা মারে দশ বাণ।
বৃষকেতু উপরে সে করিয়া সন্ধান।।
মহাকোপে ভীমসেন গদা নিল হাতে।
গজ বাজী রথ মারিলেন যূথে যূথে।।
ভীম-গদাঘাতে সেনা হইল চঞ্চল।
রণে ভঙ্গ দেয় সবে করি কোলাহল।।
সৈন্যভঙ্গ দেখি বীর সুবেগ আইল।
ভীমের সহিত আসি যুদ্ধ আরম্ভিল।।
বুভুক্ষিত সিংহ যেন গজেন্দ্র পাইল।
গদা হাতে ভীমসেন রণে প্রবেশিল।।
তা দেখি সুবেগ বীর গদা নিল হাতে।
আরম্ভিল গদাযুদ্ধ ভীমের সহিতে।।
সুবেগ মারিল গদা ভীমের উপরে।
গদাঘাতে ভীমসেন সিংহনাদ করে।।
সুবেগ উপরে ভীম করে গদাঘাত।
হাহাকার করে সৈন্য, সুবেগ নিপাত।।
চৈতন্য পাইল নৃপসুত কতক্ষণে।
পুনঃ গদাযুদ্ধ করে বৃকোদর সনে।।
যুবনাশ্ব সনে যুঝে কর্ণের নন্দন।
দোঁহে মহাধনুর্দ্ধর করে মহারণ।।
এড়িল পঞ্চাশ বাণ বীর বৃষকেতু।
যুবনাশ্ব নৃপতির বিনাশের হেতু।।
অচেতন মহারাজ পড়িল ভূমিতে।
তাহা দেখি বৃষকেতু দুঃখ পায় চিতে।।
ধনুর্ব্বাণ ভূমে রাখি কর্ণের নন্দন।
যোড়হাতে নারায়ণে করেন স্তবন।।
পাণ্ডবে প্রসন্ন যদি হও চক্রপাণি।
তবে যুবনাশ্ব রাজা বাঁচিবে এখনি।।
যদি কিছু কর্ণের থাকয়ে পুণ্যফল।
নৃপতিরে তবে রক্ষ ভকতবৎসল।।
এত বলি বৃষকেতু মাগিলেন বর।
চৈতন্য পাইয়া রাজা উঠিল সত্বর।।
নৃপতি চৈতন্য পায় হরষিত সেনা।
মহাকোলাহল করি বাজায় বাজনা।।
যুবনাশ্ব বলে, শুন কর্ণের তনয়।
তুমি মেরা পিতা সম, আমি ত তনয়।।
বাপের সমান তুমি হও মহামতি।
বৃকোদর সনে মোর করাহ পীরিতি।।
আর যুদ্ধে কাজ নাই কর্ণের নন্দন।
আমি লইলাম এবে পাণ্ডব-শরণ।।
মারিয়া জীবন দিলে কি আশ্চর্য্য কথা।
মহাধর্ম্মবন্ত ছিল কর্ণ তব পিতা।।
তেমতি দেখিনু ধর্ম্ম তোমার শরীরে।
আমা লৈয়া চল তুমি ভীমের গোচরে।।
ভীম-সুবেগের যুদ্ধ অপূর্ব্ব-কথন।
গদাযুদ্ধে বিশারদ রাজার নন্দন।।
বাহুবলে ভীম তারে তুলিল উপরে।
আছাড়িয়া ফেলিলেক নৃপতি-কুমারে।।
নৃপতি-নন্দন তাহে ভয় না পাইল।
সিংহনাদ করি পুনঃ গদা হাতে নিল।।
পুত্রের বিক্রম দেখি সুখী নরপতি।
ডাক দিয়া কহে রাজা আনন্দিত মতি।।
শুন পুত্র যুদ্ধে আর নাহি প্রয়োজন।
প্রাণপণে লইলাম পাণ্ডব-শরণ।।
সংগ্রাম ত্যাজহ পুত্র আমার বচনে।
যুদ্ধযোগ্য নহ তুমি ভীমসেন সনে।।
ভীমের বিক্রম আমি করেছি শ্রবণ।
পাণ্ডবের সহায় আপনি নারায়ণ।।
পরাজয় পাণ্ডবের নাহি ত্রিভুবনে।
সংগ্রাম ত্যজহ পুত্র আমার বচনে।।
বাপের বচন শুনি সুবেগ কুমার।
আনন্দিত হইয়া ত্যজিল মহামার।।
তবে বৃষকেতু বলে ভীমের সাক্ষাতে।
যুবনাশ্ব-পরিবার ভজিল তোমাতে।।
এই দেখ নৃপতি মাগিল পরাজয়।
অভয় প্রসাদ দেহ পাণ্ডুর তনয়।।
বৃষকেতু বচনেতে ভীম মহাবলী।
ত্যজিল সংগ্রাম হইয়া কুতূহলী।।
তবে রাজা যুবনাশ্ব আনন্দ পাইয়া।
ভীমেরে প্রণাম কৈল সাষ্টাঙ্গ হইয়া।।
রাজারে তুষিল ভীম আলিঙ্গন দানে।
সুবেগ প্রণাম কৈল ভীমের চরণে।।
বৃষকেতু সহিত করিয়া সম্ভাষণ।
যোড়হাতে যুবনাশ্ব করে নিবেদন।।
নিবেদন করি শুন ভীম মহাশয়।
আজি যে হইল মম তপের উদয়।।
পূর্ব্বপুণ্য মানিলাম তব দরশনে।
পবিত্র হইল পুরী তব আগমনে।।
ধন্য ধন্য বৃষকেতু কর্ণের কুমার।
নয়নে দেখিনু আজি চরণ তোমার।।
কতেক আমার ভাগ্য বলিতে না পারি।
পবিত্র হইল আজি ভদ্রাবতীপুরী।।
আমার পুরেতে তুমি চল এইক্ষণে।
ঘোড়া লয়ে যাব আমি ধর্ম্ম বিদ্যমানে।।
অনুমতি দিল ভীম রাজার বচনে।
প্রীতি পেয়ে যুবনাশ্ব গেল নিকেতনে।।
সুবেগে রাখিয়া এল বৃকোদর সনে।
ঘরে গিয়া নৃপতি ডাকিল পাত্রগণে।।
পূর্ব্বে সুরাসুর বলি ছিল অনুমান।
তাহা নহে, আসে ভীম পাণ্ডুর সন্তান।।
অন্তঃপুরে গিয়া কহে প্রভাবতী স্থান।
বৃষকেতু সহ পাণ্ডবের আগমন।।
মঙ্গল সামগ্রী শীঘ্র কর প্রভাবতী।
মম পুরে আসিবেন ভীম মহামতি।।
পাণ্ডুর তনয় তাঁরা ভাই পঞ্চজন।
যুধিষ্ঠির ভীমার্জ্জুন কুন্তীর নন্দন।।
সহদেব নকুল দোঁহে মাদ্রীর তনয়।
কৃষ্ণ হেতু পাণ্ডবের নাহি পরাজয়।।
যুদ্ধ-বিবরণ যত সকলি কহিল।
তাহা শুনি রাজরাণী অদ্ভুত মানিল।।
মঙ্গলায়োজন সবে করিল হরিষে।
মেঘবর্ণ এল তথা বৃকোদর পাশে।।
ঘোড়া লয়ে ঘটোৎকচ-সুত মহাবলী।
দাণ্ডাইলা ভীম পাশে হয়ে কৃতাঞ্জলি।।
গজপৃষ্ঠে চাপিলেন ভীম কর্ণসুত।
ভদ্রাবতী-পুরে যান আনন্দ বহুত।।
আগে যায় মেঘবর্ণ অশ্বরশ্মি ধরি।
পিছে সেনাগণ যায় সিংহনাদ করি।।
মহাভারতের কথা সুধার ভাণ্ডার।
কাশীরাম দাস কহে, রচিয়া পয়ার।।