০৫. বিধ্বস্ত ঘরে জঞ্জালের মাঝে

দুদিন পর আমি একটি বিধ্বস্ত ঘরে জঞ্জালের মাঝে বসে ছিলাম। আমার পরনের কাপড় শতচ্ছিন্ন। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। আমার শরীর নোংরা, হাতে যেখানে ফুটো করে ট্রাকিওশান ঢুকিয়েছে সেখানে বিষাক্ত দগদগে ঘা। কয়েকদিন থেকে অত্যন্ত বিস্বাদ কিছু খাবার খেয়ে আছি, কেন জানি সেই খাবারের ওপর থেকে রুচি পুরোপুরি উঠে গেছে। কোনো একটি বিচিত্র কারণে হঠাৎ করে খুব গরম পড়েছে, বাতাসে জলীয় বাষ্প বলতে গেলে নেই, শুকনো ধুলা হু–হুঁ করে বইছে। চারদিকে এক ধরনের পোড়া গন্ধ, কোনো এক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস রয়েছে আশপাশে, আমার মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা।

ক্রিশি আমার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি অনেকটা স্বগতোক্তির মতো করে বললাম, আর তো পারি না ক্রিশি। বড় কষ্ট!

ক্রিশি শান্ত গলায় বলল, মহামান্য কুশান, আমার ধারণা আপনার এই কষ্ট সহ্য করার পিছনে কোনো যুক্তি নেই।

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তুমি আমাকে কী করতে বল?

আপনার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য দুই। এই অবস্থায় আত্মহত্যা করা খুব যুক্তিসঙ্গত ব্যাপার হবে।

আত্মহত্যা! আমি চমকে উঠে ক্রিশির দিকে তাকালাম, কী বলছ তুমি?

আমি ঠিকই বলছি। ক্রিশি শান্ত গলায় বলল,আমি আপনাকে ধারালো একটা ছোরা এনে দিতে পারি। কব্জির কাছে একটা ধমনী কেট দিলে রক্তক্ষরণে অল্প সময়ে মৃত্যুবরণ করতে পারেন। আপনার সমস্ত সমস্যার যে হবে সবচেয়ে সহজ সমাধান।

আমি বিস্ফারিত চোখে ক্রিশির দিকে তাকিয়ে রইলাম, নিজের কানকে আমার বিশ্বাস হয় না যে আমার একমাত্র কথা বলার সঙ্গী একটি নিম্নশ্রেণীর রবোট আমাকে আত্মহত্যা করার পরামর্শ দেবে। আমি খুব সঙ্গত কারণেই ক্রিশির কথাটি উড়িয়ে দিলাম।

কিন্তু সারাদিন ঘুরেফিরে আমার কথাটি মনে হতে লাগল। আমি যতবারই কথাটি ভাবছিলাম প্রত্যেকবারই সেটাকে খুব যুক্তিসঙ্গত একটা সমাধান বলে মনে হতে লাগল। সন্ধেবেলা সত্যি সত্যি আমি আত্মহত্যা করব বলে ঠিক করলাম এবং এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে এই প্রথমবার আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের শান্তি অনুভব করতে থাকি। পৃথিবীর এই ভয়ঙ্কর ধ্বংসস্থূপ, রবোটদের নৃশংস অত্যাচার, ক্ষুধা–তৃষ্ণা, শরীরের যন্ত্রণা–সবকিছু থেকে। আমি মুক্তি পাব! আর আমাকে পশুর মতো বেঁচে থাকতে হবে না। ভয় আতঙ্ক আর হতাশায় ডুবে যেতে হবে না। আমার জীবন কেমন হবে আমি নিজে সেটা ঠিক করব।

আমি নিজের ভিতরে এত বিস্ময়কর একটা শান্তি অনুভব করতে থাকি যে আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই। অনেকদিন পর আমি প্রথমবার অনেক যত্ন করে নিজেকে পরিষ্কার করে নিই। বেছে বেছে সুস্বাদু একটা খাবার বের করে প্লেটে সাজিয়ে পানীয়ের গ্লাসে লাল রঙের খানিকটা পানীয় ঢেলে সত্যিকারের খাবারের মতো ধীরে ধীরে খেয়ে উঠি।

রাত গভীর হলে আমি আমার ব্যাগটায় মাথা রেখে আকাশের নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে হতে থাকে লক্ষ কোটি যোজন দূরে থেকে নক্ষত্রগুলো বুঝি গভীর ভালবাসা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার চারপাশে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পৃথিবীর একটি বিশাল ধ্বংসস্তূপ, কিন্তু এখন কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না।

গভীর রাতে হঠাৎ রবোটগুলো একটি মানুষের লোকালয় আক্রমণ করতে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। গত কয়েক দিন থেকে তারা একটু বিচিত্র ব্যবহার করছিল এবং তাদের ভাবভঙ্গি দেখে আমি বুঝতে পারি এবারে তারা বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষের লোকালয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্যটি কী আমি বুঝতে পারলাম না। রওনা দেবার আগে হঠাৎ করে বাহাত্তর আমার কাছে এসে বলল, তোমাকে এবার আমাদের সাথে যেতে হবে না। মানুষ প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা বাড়িয়ে দিচ্ছে, তোমার ক্ষতি হতে পারে।

কিন্তু ট্রাকিওশান? আমি ট্রাকিওশানের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারি না।

কয়েক ঘণ্টার জন্যে ট্রাকিওশানের নিয়ন্ত্রণ দূরত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছি, আশা করছি নিজের স্বার্থেই কোনো ধরনের অর্থহীন নির্বুদ্ধিতা করবে না।

আমি কোনো কথা বললাম না, কোনোকিছুতেই এখন আর কিছু আসে যায় না।

জীবনের শেষ মুহূর্তে নির্বোধ কিছু রবোটের পিছু পিছু একটি দস্যুবৃত্তিতে সহযোগিতা করতে হবে না জেনে কেমন জানি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ অনুভব করতে থাকি। তারা কখন ফিরে আসবে জানি না–কিন্তু আর আমার এদের মুখোমুখি হতে হবে না। এরা ফিরে আসার আগে আমি আমার জীবনটিকে শেষ করে দেব।

রবোটগুলো চলে যাবার পর আমি বহুদিন পর এক ধরনের অপূর্ব শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি স্বপ্ন দেখি একটি নীল হ্রদের। বিশাল হ্রদ তার মাঝে আশ্চর্য নীল পানি টলটল করছে। হ্রদের মাঝখানে একটি দ্বীপ। সেই দ্বীপে সবুজ গাছ। সত্যিকারের গাছ। সেই গাছে সত্যিকার পাতা। গাছের ডালে বসে আছে লাল ঠোঁটের অপূর্ব একঝাক পাখি। আমি একবার হাত তুলতেই সেই একঝাক পাখি গাছ থেকে উড়ে গেল আকাশে। আকাশে সাদা মেঘ, তার মাঝে পাখি উড়ছে। উড়তে উড়তে গান গাইছে পাখি। কী অপূর্ব সেই গান!

খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকার কেটে যাচ্ছে হালকা আলো চারদিকে। এই সময়টার নিশ্চয়ই একটা জাদু রয়েছে। কুৎসিত ধ্বংসস্তূপটিও এখন কেমন জানি মায়াময় মনে হচ্ছে। আমি উঠে বসি। রবোটগুলো কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে আসবে। আর অপেক্ষা করা ঠিক নয়। আমি কোমল স্বরে ডাকলাম, ক্রিশি–

ক্রিশি এগিয়ে এল, বলুন মহামান্য কুশান।

আমার মনে হয় আত্মহত্যা করার জন্য এটাই ঠিক সময়।

আমারও তাই ধারণা। রবোটগুলো ফিরে আসতে শুরু করেছে। ঘণ্টা দুয়েকের মাঝে পৌঁছে যাবে। মেয়েটিকে নিয়ে একটু যন্ত্রণা হচ্ছে, না হয় আরো আগে ফিরে আসত।

মেয়েটি? আমি অবাক হয়ে বললাম, কোন মেয়েটি?

রবোটগুলো একটা মেয়েকে ধরে আনতে গিয়েছিল মহামান্য কুশান। তারা বিনোদনের যে সফটওয়ার পেয়েছে সেখানে পুরুষ ও রমণীর মাঝে জৈবিক সম্ভোগের ব্যাপার রয়েছে। রবোটগুলো সেটা একটা মেয়ের উপরে পরীক্ষা করে দেখতে চায়।

আমি বিস্তারিত চোখে ক্রিশির দিকে তাকালাম, কী বলছ তুমি?

আমি সত্যি কথা বলছি। তারা নিজেদের কপোট্রনে খানিকটা পরিবর্তন করেছে। আমার মনে হয় এখন তাদের ভিতরে নিম্ন শ্রেণীর যৌনচেতনা আছে। ব্যাপারটি কী সে সম্পর্কে আমার অবশ্যি কোনো ধারণা নেই।

আমি বুঝতে পারছি আমার ভিতরে যে কোমল শান্ত একটা ভাব এসেছিল সেটা দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে সেখানে প্রচণ্ড একটা ক্রোধের জন্ম নিচ্ছে। ধারালো চাকুটা হাতে নিয়ে আমি বসে রইলাম, হাতের ধমনীটি কেটে দেয়ার সহজ কাজটি করতে গিয়েও আমি করতে পারলাম না। মৃত্যুর আগে দুর্ভাগা মেয়েটির সাথে মনে হয় আমার অন্তত একবার কথা বলা দরকার।

বাহাত্তরের দলটি যখন পৌঁছেছে তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। যে মেয়েটিকে তারা ধরে এনেছে সে অল্পবয়সী। তাকে আমি যেরকম আতঙ্কগ্রস্ত দেখব বলে ভেবেছিলাম সেরকম দেখলাম না, মনে হল কেমন যেন হতচকিত হয়ে আছে। আমাকে দেখে সে একরকম ছুটে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কুশান?

আমি মেয়েটিকে ভালো করে লক্ষ করলাম, তার মাথায় ঘন কালো চুল এবং চোখ দুটিও আশ্চর্য রকম কালো। তার শরীরটি অসম্ভব কোমল, আমি এর আগে এত লাবণ্যময় কোনো মেয়ে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। মেয়েটির গলায় রঙিন পাথরের একটি মালা। কাপড়ের সাথে এই রঙিন মালাটিতে তাকে একটি প্রাচীন তৈলচিত্রের চরিত্র বলে মনে হতে থাকে।

মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কুশান?

আমি তার গলায় এক ধরনের উত্তাপ অনুভব করি। মেয়েটি কেন আমার ওপর রাগ করছে আমি তখন বুঝতে পারি নি। আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, আমি কুশান।

তুমি কেন এভাবে আমাকে ধরে এনেছ?

মেয়েটির কথা শুনে আমি একেবারে হতচকিত হয়ে গেলাম। সে সত্যিই ভাবছে আমি রবোটগুলোকে পাঠিয়ে তাকে ধরে এনেছি? সেটা সত্যি সম্ভব? আমি অবাক হয়ে ক্রিশির দিকে তাকাতেই ক্রিশি মাথা নেড়ে বলল, লোকালয়ের মানুষেরা বিশ্বাস করে আপনি গ্রুস্টানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে সংঘবদ্ধ হচ্ছেন। রবোটগুলো আপনার অনুগত। আপনার আদেশে তারা কম্পিউটার ঘাটি ধ্বংস করছে গ্রুস্টানের ক্ষমতা কমানোর জন্যে। অনেক মানুষ সে জন্যে আপনাকে শ্রদ্ধা করে

আমি ধড়মড় করে উঠে বসি,কী বলছ তুমি?

ক্রিশি মাথা নাড়ল, আমি সত্যি কথা বলছি।

মানুষের বসতিতে আপনার সম্পর্কে অনেক রকম গল্প প্রচলিত আছে। আমি কমিউনিকেশান মডিউলে শুনেছি।

মেয়েটি খুব কৌতূহল নিয়ে আমাদের কথা শুনছিল। আমি দেখতে পাই তার মুখে ক্রোধের চিহ্নটি সরে গিয়ে সেখানে চাপা বিস্ময় এবং এক ধরনের আতঙ্ক এসে উঁকি দিতে শুরু করেছে। আমার দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই রবোটদের নেতা নও?

আমি মাথা নাড়লাম, না।

তাহলে?

আমি এদের বন্দি। আমাকে গ্রুস্টানের কাছে ফেরত দেবার জন্যে এরা আমাকে ধরে রেখেছে।

মেয়েটি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি দেখতে পাই ধীরে ধীরে তার মুখ রক্তশূন্য হয়ে যাচ্ছে। সে কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, অসম্ভব, এটি হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না।

আমার মেয়েটির জন্যে এক ধরনের কষ্ট হতে থাকে হঠাৎ করে নিজেকে এক ধরনের অপরাধী মনে হয় ঠিক কী জন্যে নিজেই বুঝতে পারি না।

মেয়েটি হঠাৎ হাঁটু ভেঙে বসে, তারপর এক ধরনের ভাঙা গলায় প্রায় আর্তনাদ করে উঠে বলল, এরা তাহলে আমাকে ধরে এনেছে কেন? কেন?

আমি মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলাম না, মেয়েটার চোখের দিকেও তাকাতে পারলাম, দৃষ্টি সরিয়ে আমি মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটির প্রশ্নের উত্তর দিল ক্রিশি। নিচু গলায় বলল, রবোটগুলো আপনাকে জৈবিক সম্ভোগে ব্যবহার করার জন্যে এনেছে

মেয়েটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ক্রিশি কী বলছে ঠিক বুঝতে পারল বলে মনে হয় না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, কী বলছ তুমি?

আমি সত্যি কথাই বলছি। ব্যাপারটি কী সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। রবোটগুলো তাদের কপোট্রনে কী একটা পরিবর্তন করেছে।

মেয়েটি হঠাৎ এগিয়ে এসে খপ করে আমার দুই হাত ধরে ফেলল, তারপর ব্যাকুল হয়ে বলল, এই রবোট ভুল বলেছে, বলছে না?

আমার নিজেকে একটি অমানুষের মতো মনে হল। কিন্তু কিছু করার নেই, মাথা নেড়ে বললাম, না।

কয়েক মুহূর্ত সে কোনো কথা বলল না। তারপর হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বলল, তুমি আমাকে রক্ষা করবে, করবে না?

আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকালাম, কী আশ্চর্য রকম সরল মেয়েটির জগৎ! কী ভয়ঙ্কর নিষ্পাপ। শুধু তাই নয় হঠাৎ করে বুঝতে পারি মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী। তার কোমল ত্বক, কালো রেশমের মতো চুল, চোখের ভিতর এক ধরনের বিচিত্র ব্যাকুলতা। লাল ঠোঁট, ঠোঁটের আড়ালে তার কী অপূর্ব স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো দাঁত। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অসহায় বোধ করতে থাকি। যে ভয়ঙ্কর রবোটের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যে আমি আত্মহত্যা করার প্রস্তুতি নিয়েছি সেই রবোটের হাত থেকে তাকে আমি রক্ষা করব? সেটা কি সম্ভব?

মেয়েটা আমার দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে ছিল, আবার ভাঙা গলায় বলল, তুমি আমাকে রক্ষা করবে, করবে না?

আমি গভীর বেদনায় মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি। হঠাৎ আমার কী হল জানি না, আমি তার রেশমের মতো কোমল চুলে হাত বুলিয়ে নরম গলায় বললাম, অবশ্যি আমি তোমাকে রক্ষা করব। অবশ্যি–

আমার নাম টিয়ারা।

অবশ্যি আমি তোমাকে রক্ষা করব টিয়ারা।

মেয়েটি হঠাৎ একটা ছোট শিশুর মতো হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।