০৫. বায়োবট
আমার মা রুকাসের কনুইয়ে একটা ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিচ্ছিলেন। এক জন মানুষ যে নিজের শরীরের ভেতরে করে এরকম ভয়ঙ্কর একটি অস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে সেটি কে জানত। ব্যান্ডেজটি লাগাতে লাগাতে বললেন, তোমার শরীরের ভেতরে কি আর কিছু রয়েছে?
না। আর কিছুর প্রয়োজনও নেই।
কেন?
কাস টেবিলের উপর রাখা ছোট ধাতব অস্ত্রটি হাতে তুলে নিয়ে বলল, এই অস্ত্রটি শুধু আমিই ব্যবহার করতে পারব, পৃথিবীর আর কেউ এটা ব্যবহার করতে পারবে না। এটা শুধু অস্ত্র নয়, এটা আমার যোগাযোগের যন্ত্র। এটা দিয়ে আমি আমার মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারব।
তোমার কোন মানুষ? আমি যে সময় থেকে এসেছি, সেই সময়ের মানুষ। তুমি যোগাযোগ করেছ?
এখনো করি নি। অস্ত্রটা যখন ব্যবহার করেছি তখন অবশ্যি নিজে থেকে যোগাযোগ হয়ে গেছে। আমার যারা বন্ধু তাদের সাথে, যারা আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের সাথেও
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে?
রুকাস হাতের ব্যান্ডেজটা একবার হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলল, সেটা অনেক বড় একটা গল্প।
বলবে আমাদের সেই গল্প?
শুনতে চাও? ভালো লাগবে না শুনে।
তবু শুনব।
রুকাস যে গল্পটি বলল, সেটি খুব বিচিত্র। কেন জানি না আমার ধারণা ছিল যত দিন যাবে, মানব সভ্যতার তত উন্নতি হবে। কিন্তু মানব সভ্যতার যে সময়ের সাথে সাথে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে, সেটি আমার ধারণার বাইরে ছিল।
ব্যাপারটি শুরু হয়েছিল একটা দুর্ঘটনার মাঝে দিয়ে। একটি শিশু একটা খারাপ দুর্ঘটনায় দুই হাত-পা-ই শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসাসংক্রান্ত ইঞ্জিনিয়ারিং তখন বেশ অনেকদূর এগিয়ে গেছে, কাজেই শিশুটিকে কৃত্রিম হাত এবং পা লাগিয়ে দেয়া হল, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল তার হাত এবং পা সাধারণ মানুষের হাত এবং পায়ের থেকে অনেক বেশি কার্যকর, অনেক বেশি শক্তিশালী।
ব্যাপারটির শুরু এভাবেক্ষুদ্র বিন্দুর মতো আকারের শক্তিশালী কম্পিউটার আবিস্কৃত হয়েছে, কৃত্রিম হাত এবং পায়ের মাঝে অসংখ্য কম্পিউটার জটিল কাজকর্ম করতে পারে। সাধারণ মানুষ তার হাত দিয়ে যে কাজ করতে পারে না, কৃত্রিম হাতের মানুষ তার থেকে অনেক নিখুত কাজ করতে পারে। ” তখন জটিল কাজকর্ম করার জন্যে কিছু মানুষ ইচ্ছে করে নিজের হাত কেটে সেখানে যান্ত্রিক হাত লাগিয়ে নেয়া শুরু করল। প্রথম প্রথম সেটা নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক শুরু হয়েছিল সত্যি, কিন্তু কিছুদিনেই সাধারণ মানুষজন ব্যাপারটিকে বেশ সহজভাবেই গ্রহণ করা শুরু করে দিল।
কৃত্রিম হাত-পা তৈরির কলকারখানাগুলো তখন সাধারণ মানুষজনকে তাদের সত্যিকার হাত-পা পাল্টে অনেক ক্ষমতাশালী যান্ত্রিক হাত-পা ব্যবহার করার জন্যে উৎসাহিত করতে শুরু করে দিল। কিছুদিনের মাঝেই দেখা গেল বিপুল জনগোষ্ঠী তাদের কথা শুনে কৃত্রিম হাত-পা ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তারা সাধারণ মানুষ থেকে বেশি কার্যক্ষম, এধরনের একটা কথা নানা জায়গায় শোনা যেতে লাগল। কৃত্রিম হাত-পা তৈরির কলকারখানা তখন বিশাল আকার নিয়েছে, তারা একসময় ব্যাপারটিকে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করতে শুরু করে। ছোট শিশুর জন্ম নেয়ার সাথে সাথে তার স্বাভাবিক হাত-পা কেটে সেখানে যান্ত্রিক হাত-পা লাগিয়ে দেয়ার একটা প্রবণতা খুব ধীরে ধীরে মানুষজনের মাঝে জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে। জৈবিক বা বায়োলজিক্যাল মানুষ এবং তাদের রবোটের মতো হাত-পা, দুই মিলে তাদের বায়োলজিক্যাল রবোট বা সংক্ষেপে বায়োবট বলা শুরু করা হল।
এর পরের কয়েক শতাব্দী মূলতঃ বায়োবটগোষ্ঠী এবং সাধারণ মানুষদের মাঝে একটা প্রতিযোগিতায় কেটে গেল। পৃথিবীর মূল অর্থনীতি রবোটিক শিল্পভিত্তিক। এই শিল্প গুলো নানাভাবে পৃথিবীর মাঝে করতে শুরু করায় বায়োবটদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করল।
নানা ধরনের গবেষণা শুরু হল তখন। মায়েরা সন্তানদের পেটে ধরামাত্রই তাদের নানারকম ঔষধপত্র খাওয়ানো শুরু করিয়ে দেয়া হত, যে কারণে শিশুরা জন্ম নিল বিকলাঙ্গ অবস্থায়। তাদের বায়োবট তৈরি না করে কোনো উপায় ছিল না। খুব ধীরে ধীরে বায়োবটের মাঝে মস্তিষ্ক এবং প্রজননের অঙ্গ ছাড়া প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কৃত্রিম কোনো যন্ত্র দিয়ে পাল্টে দেয়া হল। মানুষের চিন্তা এবং বংশবৃদ্ধির ক্ষমতার সাথে যন্ত্রের নিখুত কাজ করার ক্ষমতা যোগ করে এক ধরনের বিচিত্র প্রাণীর সৃষ্টি হল তখন। তাদের সংবেদনশীল ফটো সেলের চোখ আলট্রা ভায়োলেট থেকে শুরু করে ইনফ্রায়েড পর্যন্ত দেখতে পায়। চোখ ইচ্ছেমতো অণুবীক্ষণ বা দূরবীক্ষণ ক্ষমতায় পারদর্শী হতে পারে। তাদের ইলেকট্রনিক শ্রবণযন্ত্র কয়েক হার্টজ থেকে মেগা হার্টজ পর্যন্ত শুনতে পারে। তাদের ঘ্রাণশক্তি শ্বাপদের ঘ্রাণশক্তিকে হার মানিয়ে দিতে থাকে।
তাদের বুকের ভেতর ছোট দুর্বল ফুসফুসকে জুড়ে দেয়া হয় স্বয়ংক্রিয় ফুসফুসের সাথে। পৃথিবীর দূষিত বাতাসকে বিশুদ্ধ করে সেই ফুসফুস রক্তের সাথে বিশুদ্ধ অক্সিজেন মিশিয়ে দেয়। কৃত্রিম যান্ত্রিক হৃৎপিণ্ড সেই রক্ত মস্তিষ্ক এবং প্রজনন যন্ত্রে পাঠাতে থাকে। সেকেন্দ্রে দশবার করে হৃৎপিণ্ড বুকের মাঝে ধুকপুক করতে থাকে। হৃৎপিন্ডের যান্ত্রিক দেয়ালে অসংখ্য সংবেদনশীল ইলেকট্রনিক সেন্সর প্রতি মুহূর্তে শরীরের পরিবর্তন মনিটর করতে থাকে। রক্ত পরিশোধন করা হয় যন্ত্র দিয়ে, শরীরের বাইরে। অব্যবহৃত কিডনি, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয় সরিয়ে ফেলা হয় জনামুহূর্তে, শরীরের আকার হয় ক্ষুদ্র, বিশাল বায়োবটের দেহের মাঝে জুড়ে দেয়া হয় সেই ক্ষুদ্র অপুষ্ট বিকৃত দেহ।
বায়োবটের ক্ষুধা-তৃষ্ণা নেই। পরিপাকযন্ত্রের জায়গা শরীরের নানা অংশে টিউব দিয়ে আসতে থাকে পুষ্টিকর তরল। পরিপাকযন্ত্র নেই বলে মলমূত্র নেই। মানুষকে এরা প্রথমবার মুক্ত করেছে দৈনন্দিন জৈবিক প্রক্রিয়া থেকে, যদিও সেই ভয়াবহ প্রাণীটিকে সম্ভবত মানুষ আখ্যা দেয়ার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ আর নেই।
জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে মস্তিষ্ককে বিকশিত করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ থেকে তাদের চিন্তা করার ক্ষমতা বেশি, নিউরনের সংখ্যা বেশি বলে তাদের স্মরণশক্তি অচিন্তনীয়। দৈহিক প্রক্রিয়া থেকে মুক্ত করা হয়েছে মস্তিষ্ককে, দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা যায় সেই মস্তিষ্ককে। দীর্ঘায়ু হয়েছে এই বায়োবট সম্প্রদায়।
বংশবৃদ্ধির জন্যে অবিকৃত রাখা হয়েছে প্রজননকে। যদিও সন্তানকে আর মায়ের গর্তে বড় হতে হয় না। চূণকে বের করে আনা হয় জরায়ু থেকে, কৃত্রিম যন্ত্রে বড় হয় দৃণ। প্রসববেদনার ভিতর দিয়ে যেতে হয় না কোনো বায়োবট রমণীকে, যন্ত্র খুলে বের করে আনা হয় সেই ভ্রূণ।
বিশাল শিল্প গড়ে উঠেছে এই বায়োবট শ্রেণীকে নিয়ে। পৃথিবীর অর্থনীতি এই বায়োবট শিল্পকে ঘিরে। পৃথিবীর নিয়ন্ত্রণে এই বায়োবট শ্রেণী।
মানুষের ছোট একটি দল বায়োবট হতে রাজি হল না। যন্ত্রের খাচায় অতিকায় মস্তিষ্ক এবং প্রজননযন্ত্রকে জুড়ে দিয়ে যান্ত্রিক সাবলীলতায় বাধা পড়ে যাওয়াকে তারা প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ মনে করল। সেই অল্পসংখ্যক মানুষকে বায়োবট শ্রেণী উপেক্ষা করে যাচ্ছিল। কিন্তু কোনো একটি কারণে হঠাৎ করে বায়োবট শ্রেণী সিদ্ধান্ত নিল পৃথিবীতে সত্যিকার মানুষ কেউ থাকতে পারবে না। সবাইকে বায়োবট হয়ে যেতে হবে। মানুষের সাথে তখন বয়োবটের সংঘর্ষের সূত্রপাত। সেই ঘটনা ঘটেছে আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর পর।
বায়োবটরা তখন প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী, সমস্ত পৃথিবী মোটামুটিভাবে তাদের হাতের মুঠোয়। মানুষের জন্যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে এল হঠাৎ। খুব ধীরে ধীরে মানুষ সংঘবদ্ধ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বায়োবটদের বিরুদ্ধে তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে। কিন্তু সামনে রয়েছে ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে কে জয়ী হবে এখনো কেউ জানে না।
রুকাসকে এই সময় আমি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেন বলছ কেউ জানে না? তুমি তো সময়ের উল্টোদিকে অতীতে চলে এসেছ, তেমনি ভবিষ্যতে চলে গিয়ে দেখে এস।
রুকাস একটু হেসে বলল, সময় পরিভ্রমণের একটা সুত্র আছে। অনিশ্চয়তার সূত্রের মতো। তুমি শুধুমাত্র সেই সময়েই যেতে পারবে, যেই সময়ের ঘটনাবলীর সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই।
মানে?
মনে কর তুমি সময়ে পরিভ্রমণ করে দশ বছর অতীতে গেলে। সেখ দেখতে পেলে তোমাকে, ছোট শিশু। তাকে যদি তুমি হত্যা কর তাহলে তুমি কেমন করে আসবে? কাজেই সময় পরিভ্রমণের সূত্র বলে তুমি দশ বছর অতীতে যেতে পারবে না। তুমি দুই হাজার বছর অতীতে যেতে পারবে। কারণ সেখানে তুমি তোমার পূর্বপুরুষকে সম্ভবত খুঁজে পাবে না। তার সম্ভাবনা খুব কম। প্রকৃতির সূত্র সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করে। যে জিনিসটির সম্ভাবনা কম সেটি সূত্রকে লঙঘন করে না।
কিন্তু সত্যি যদি পেয়ে যাই?
পেয়ে গেলেও তুমি তাকে মারতে পারবে না।
মা আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, জ্ঞানের কচকচিটা একটু বন্ধ কর দেখি, আমি আগে ইতিহাসটা শুনি।
যেটা এখনো হয় নি, ভবিষ্যতে হবে, সেটা ইতিহাস হয় কেমন করে?
চুপ কর তুই।
একটু হেসে রুকাস আবার শুরু করল।
রুকাসের বয়স যখন ছয়, তখন বিশাল এক বায়োবট বাহিনী হামলা চালিয়েছিল তাদের এলাকায় অনেকটা ট্রনেদের হামলার মতো। নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছিল সত্যি, কিন্তু হামলার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল এক জন মানুষকে খুঁজে বের করা। সেই মানুষটা হচ্ছে রুকাস। কেন এই ছয় বছরের শিশুটির জন্যে বায়োবটেরা এত ব্যস্ত হয়েছিল, সেটি তখনো কেউ জানত না। বায়োবটদের সেই ভয়ংকর হামলা থেকে রুকাস খুব অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিল। তার বাবা-মা ভাই-বোন কেউ রক্ষা পায় নি।
এই ঘটনার পরও অসংখ্যবার রুকাসকে অপহরণ করার চেষ্টা করেছে, কখনো সফল হয় নি। অসংখ্য মানুষের মাঝে কেন রুকাসকে নিয়ে যেতে তারা এত মরণপণ করে চেষ্টা করেছে সেটা কেউ জানত না, কিন্তু যেহেতু রুকাসকে নিতে চাইছে, মানুষেরা বুঝে গেল এর মাঝে কোনো একটা রহস্য আছে। রুকাসকে অক্ষত অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখার উপর নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ যুদ্ধে কে জয়ী হবে।
আমি রুকাসকে আবার বাধা দিলাম, কিন্তু সেটা কেমন করে হয়? তুমি তো বললে কাছাকাছি ভবিষ্যতের কিছু কেউ জানতে পারবে না।
জানতে পারবে না বলি নি, বলেছি জানার সম্ভাবনা কম।
মানে?
যদি অসংখ্যবার চেষ্টা করা যায়, খুব ছোট একটা সম্ভাবনা আছে কাছাকাছি ভবিষ্যৎ থেকে কোনো তথ্য আনার। মনে হয় বায়োবটেরা কিছু-একটা তথ্য এনেছে। যেখানে দেখা গেছে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু-একটা করেছি। কী করেছি আমি জানি না।
তুমি জান না তুমি কী করেছ, কিন্তু সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ?
হ্যাঁ। তাই আমাকে অক্ষত লেহে বেঁচে থাকতে হবে। যেভাবে হোক। বায়োবটেরা এত ভয়ঙ্করভাবে আমাকে খুঁজে বের করে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে, যে, আমাকে বাঁচিয়ে রাখার একটিমাত্র উপায়–।
সেটা হচ্ছে অতীতে সরিয়ে ফেলা?
হ্যাঁ, আমি অজ্ঞাত কোনো জায়গায় লুকিয়ে না গিয়ে অজ্ঞাত কোনো সময়ে লুকিয়ে গেছি।
আমি অবাক হয়ে রুকাসের দিকে তাকিয়ে রইলাম।