০৫. বাস থেকে নেমে সেরিনা

বাস থেকে নেমে সেরিনা তার ব্যাগটা ঘাড়ে তুলে নিল। নার্গিস তার ব্যাগটা নিয়ে সেরিনার পাশে দাঁড়াল। জেলেপাড়ার দুটি মেয়ে গৌরি আর ললিতা তাদের ব্যাগ খুঁজে পাচ্ছিল না, শেষ পর্যন্ত তারাও তাদের ব্যাগ খুঁজে পেল তখন চারজন তাদের ব্যাগ নিয়ে নাজমা ম্যাডামের পিছু পিছু সিঁড়ি দিয়ে বিল্ডিংটার উপরে উঠে যায়। এটা মেয়েদের একটা হোস্টেলে মত, সারা দেশ থেকে সাঁতার প্রতিযোগিতায় যে ।এসেছে তারা আগামী কয়েকদিন এখানে থাকবে।

কালো মতন মোটা একজন মানুষ সবাইকে তাদের রুম নম্বর বলে দিচ্ছে। নাজমা ম্যাডাম মানুষটার কাছে থেকে সেরিনাদের রুম নম্বর জেনে নিলেন তারপর তাদেরকে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেলেন, একেবারে একটা কোনার দিকে একটা বড় ঘর, সেখানে অনেকগুলো বিছানা সারি সারি সাজানো। নাজমা ম্যাডাম বললেন, “তোমরা তোমাদের পছন্দের বিছানা বেছে নাও। আর কেউ যখন এখনো আসে নি তোমাদের ফার্স্ট চয়েস।“

নাজমা ম্যাডামের কথা শুনে মনে হল এটা বুঝি বিশাল একটা সুযোগ–আসলে সবগুলো বিছানা একই রকম, কাজেই আগে আর পরে বেছে নেওয়ার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। নার্গিস কোনার দিকে জানালার পাশে একটা বিছানার দিকে গিয়ে বলল, “এইটা আমার বিছানা।” তখন কাছাকাছি অন্য তিনটা বিছানা বাকী তিনজন দখল করে নিল।

নাজমা ম্যাডাম বললেন “করিডোরের অন্য মাথায় বাথরুম আছে। নিচে ডাইনিং রুম।”

সেরিনা বলল, “ঠিক আছে ম্যাডাম।”

“টিচারদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। আমাদেরকে অন্য বিল্ডিংয়ে রাখবে। তোমরা নিজেরা নিজেরা থাকতে পারবে না?”

মেয়েরা মাথা নাড়ল, সেরিনা বলল, “পারব।”

“গুড। আমি তাহলে যাই, গিয়ে দেখি আমাদের জন্যে কী ব্যবস্থা করেছে।”

নাজমা ম্যাডাম চলে যাবার পর সেরিনা তার বিছানায় বসে বলল, “আমার খিদে লেগেছে।”

নার্গিস বলল, “চল নিচে গিয়ে খেয়ে আসি।”

সেরিনা বলল, “আগে হাত মুখে ধুয়ে আসি।”

গৌরী বলল, “এই এত বড় ঘরে খালি আমরা থাকব? আর কেউ থাকবে না?

“মনে হয় থাকবে। অন্যেরা এখনো আসে নাই।”

নার্গিস তার ব্যাগ থেকে একটা তোয়ালে বের করে বলল, “আমি হাত মুখ ধুয়ে আসি।” ও

নার্গিসের সাথে সাথে অন্যেরাও গেল। হাত মুখ ধুয়ে তারা নিচে খেতে গেল। খাওয়া শেষ করে যখন তারা ওপরে নিজেদের রুমে ফিরে এসেছে তখন তাদের রুমের ভিতরে অনেক মেয়ে, মনে হল রীতিমত বাজার বসে গেছে। ওরা দেখল ফর্সা করে লম্বা মতন একজন মেয়ে গলা উঁচু করে বলছে, “থাকব না। আমি এখানে থাকব না। আই উইল নট স্টে হেয়ার।”

সেরিনা একটু অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল সমস্যাটা কী। মেয়েটা মেঝেতে পা ঠুকে বলল, “এ রকম নোংরা জায়গায় মানুষ থাকতে পারে? আমি নিজের চোখে একটা তেলাপোকা দেখেছি। এ ফ্যাট আগলি ককরো।”

নাদুস নুদুস একটা মেয়ে বলল, “এই দেশের সব জায়গায় তেলাপোকা থাকে। প্রেসিডেন্টের বাড়ীতেও আছে।”

ফর্সা মেয়েটা চোখ পাকিয়ে বলল, “তুমি আমার সাথে ঠাট্টা করছ? তুমি আমাকে চিনো?”

নাদুস নুদুস মেয়েটা থতমত খেয়ে বলল, “সরি। আমি আসলে ঠাট্টা করছিলাম না। আমি বুঝতে পারি নাই।”

ফর্সা মেয়েটার সাথে আরো কয়েকজন আছে তাদেরও মেজাজ খুব গরম দেখা গেল। চেহারা দেখে বোঝা যায় তারা এরকম হোস্টেলের মতো জায়গায় থেকে অভ্যস্ত না। এতোজন মানুষের সাথে একটা ঘরে থাকতে হবে চিন্তা করেই তারা খুব বিরক্ত হয়ে উঠছিল। তাদের দলের আরেকটা মেয়ে বলল, “আমরা এখানে কেমন করে ঘুমাব? প্রাইভেসি কোথায়?”

ফর্সা মেয়েটা বলল, “আমি আগে জানলে আসতেই রাজী হতাম না। মনে আছে যখন আমরা নেপাল গিয়েছিলাম আমাদের ফাইভ স্টার হোটেলে রেখেছিল?”

তার দলের মেয়েরা মাথা নাড়ল। একজন বলল, “এখন চিৎকার করে লাভ নাই, কাল সকালে দেখা যাবে

ফর্সা মেয়েটা বলল, “আমি ডেফিনিটলি এখান থেকে বের হয়ে যাব। আই এম নট স্লিপিং উইথ ককরোচস।”

বিছানা ভাগাভাগি করতে গিয়ে হঠাৎ করে তারা আবিষ্কার করল, যে তাদের একটা বিছানা কম। তখন তারা এমন চিৎকার করতে শুরু করল, যে নিচ থেকে একজন মানুষ উপরে উঠে এল। ফর্সা মেয়েটি পা দাপিয়ে বলল, “আমরা চারজন মানুষ, তিনটা বিছানা। কীভাবে ঘুমাব?”

নিচ থেকে উঠে আসা মানুষটা মাথা চুলকে বলল, “আজকে রাতটা ম্যানেজ করে ফেল, কাল একটা ব্যবস্থা করে দেব।”

“কীভাবে ম্যানেজ করব? একজন জেগে বসে থাকব? কালকে আমাদের কম্পিটিশান, রাত্রে না ঘুমিয়ে কম্পিটিউশনে যাব?”

“ভাগাভাগি করে ঘুমিয়ে যাও!”

মেয়েটা চিৎকার করে বলল, “হোয়াট? এক বিছানায় দুইজন? আর ইউ ক্রেজী?”

গৌরী ফিসফিস করে সেরিনাকে বলল, “সেরিনা।”

“কী হয়েছে?”

“আমি আর ললিতা এক বিছানায় ঘুমিয়ে যাব। তুই বলে দে আমাদের একটা বিছানায় ওদের একজন ঘুমাতে পারবে।”

সেরিনা ফিসফিস করে বলল, “তোদের অসুবিধে হবে না?”

গৌরী হেসে ফেলল, বলল, বাড়ীতে কি আমার আলাদা বিছানা আছে নাকী? আমরা একসাথে ঘুমাই না? তাই নারে ললিতা?”

ললিতা মাথা নাড়ল। সেরিনা তখন ফর্সা মেয়েটাকে বলল, “শোনো। আমরা চারজন তিনটা বিছানায় ঘুমাতে পারব। তোমরা আমাদের একটা বিছানা নিতে পার।”

মেয়েটা কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল। বলল, “আর ইউ শিওর?”

সেরিনা মাথা নাড়ল, “শিওর।”

এরকম জটিল একটা সমস্যার হঠাৎ করে এত সহজ সমাধান হয়ে যাওয়ায় মনে হল মেয়েটার একটু আশা ভঙ্গ হল। সে আসলে আরো কিছুক্ষণ চিৎকার করতে চাচ্ছিল। নিচ থেকে যে মানুষটা এসেছিল সে এবার বেশ কঠিন স্বরে বলল, “এবারে তোমার সমস্যা মিটেছে?”

ফর্সা মেয়েটা গজগজ করতে থাকে। মানুষটা গলায় স্বর আরেকটু কঠিন করে বলল, “দেখো, সারা দেশ থেকে মেয়েরা আসছে। নানা ধরণের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে মেয়েরা আসছে। আগামী কয়েকদিন সবাই মিলে মিশে থাকবে এটা হচ্ছে আমাদের আসল উদ্দেশ্য। মনে করো না প্রতিযোগিতা করে পুরস্কার পাওয়াটা আসল উদ্দেশ্য। বুঝেছ?”

ফর্সা মেয়েটা আসলে সব সময়েই চিৎকার চেঁচামেচি করেছে এবং সবাই সবসময় তাকে সমীহ করে এসেছে। সে কোনো কিছু নিয়ে অভিযোগ করবে আর তাকে একজন উল্টো উপদেশ দেবে এরকম কিছু সে মোটেও অভ্যস্ত নয়। রাগে মেয়েটার মুখ থম থম করতে লাগল।

রাতে ঘুমানোর সময় গৌরী আর ললিতা এক সাথে শুয়ে ফিস ফিস করে কথা বলছিল। সেরিনা বলল, “তোরা কী নিয়ে কথা বলিস?”

গৌরী বলল, “কিছু না।”

ললিতা বলল, “গৌরী বলছিল তার বাড়ীর জন্যে মন খারাপ লাগছে।”

গৌরী লজ্জা পেয়ে বলল, “মোটেই বলি নাই।”

সেরিনা বলল, “আমি আগে কোনোদিন আমার আব্বুকে ছাড়া একা থাকি নাই। আমারও আব্বুর জন্যে একটু একটু মন খারাপ করছে।”

নার্গিস হি হি করে হেসে বলল, “ধূর গাধা। আমরা কালকে যদি হেরে যাই তাহলে পরশুদিন বাড়ী যাব। তোদের এতো মন খারাপ করার কী আছে?”

গৌরী বলল, “প-র-শু দি-ন? এতো দিন পরে?”

তার বলার ভঙ্গী শুনে অন্যেরাও হেসে উঠল। ঠিক এই সময় ফর্সা মেয়েটা খুবই কায়দার একটা ঘুমের কাপড় পরে তাদের পাশের বিছানায় ঘুমাতে এল। মেয়েটা তাদের বয়সী, খুব বেশী হলে হয়তো এক বছর বেশী বয়স হবে। কিন্তু মেয়েটার ভায় ভঙ্গি দেখে মনে হয় যে বুঝি তাদের থেকে অনেক বড়। ঠিক সেরকম ভাব করে তাদের দিকে তাকাল, বলল, “তোমরা ঘুমাবে না?”

সেরিনা বলল, “ঘুমাব?”

“কখন?”

“এই তো এখন।” ‘ঘুমের কাপড় পরবে না?”

ওরা একে অন্যের দিকে তাকাল। আলাদা করে যে ঘুমের কাপড় পরে ঘুমাতে হয় সেটাও তারা জানে না।

নার্গিস বলল, “এইটাই আমাদের ঘুমানোর কাপড়।”

মেয়েটা খুবই অবাক হল এবং সেটা গোপন রাখার চেষ্টা করল না। জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কোন স্কুল থেকে এসেছ?”

সেরিনা তাদের স্কুলের নাম বলল। মেয়েটা তখন জানতে চাইল সেটা কোথায়? তারা সেটাও বলল কিন্তু মেয়েটা জায়গাটা চিনল বলে মনে হল না। সেটা নিয়ে সে অবশ্যি মাথা ঘামাল না জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের স্কুলের সুইমিং পুলটা কী রকম?”

সেরিনা নার্গিস গৌরী আর ললিতা আবার একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। নার্গিস বলল, “আমাদের স্কুলে কোনো সুইমিং পুল নাই।”

মেয়েটা হকচকিয়ে বলল, “সুইমিং পুল নাই? তাহলে তোমরা কোথায় প্র্যাকটিস কর?”

“পুকুরে।

“পুকুরে?” মেয়েটা এতো জোরে চিৎকার করে উঠল যে শুনে মনে হল তারা পুকুরে’ বলে নি বলছে ‘আলকাতরায়।

সেরিনা গৌরী আর ললিতার দিকে দেখিয়ে বলল, “এরা দুইজন নদীর ধারে থাকে। এরা নদীতে সাঁতরায়”

মেয়েটা খানিকক্ষণ ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। মনে হল ব্যাপারটা সে বুঝতেই পারছে না। খানিকক্ষণ পর জিজ্ঞেস করল, “যদি তোমাদের সুইমিং পুল নাই তাহলে তোমরা কেমন করে প্র্যাকটিস করেছ? কীভাবে টাইমিং করেছ? কালকে কেমন করে কম্পিটিশনে পার্টিসিপেট করবে?”

সেরিনা হাত নেড়ে বলল, “করব কোনো রকম ভাবে।”

মেয়েটার কাছে পুরো ব্যাপারটাই মনে হল খুবই আজব লেগেছে তাই সে একটু পরে উঠে তার দলের অন্য যে মেয়েরা আছে তাদের কাছে গিয়ে ফিস ফিস করে কথা বলতে লাগল, মাঝে মাঝে আঙ্গুল দিয়ে সেরিনাদের দেখাতে লাগল, তারপর হেসে কুটি কুটি হতে লাগল।

নারগিস বলল, “দেখ! আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করছে।”

সেরিনা বলল, “করুক।”

গৌরী বলল, “আমার বাড়ীর জন্যে মন খারাপ লাগছে।”

ললিতা বলল, “আমারও।”

.

পরদিন সকালে নাস্তা খাবার পর বড় একটা বাস এসে সবাইকে স্পোর্টস সেন্টারে নিয়ে গেল। সেখানে সেরিনাদের দলের সবাই জীবনের প্রথম একটা সুইমিং পুল দেখল। কী সুন্দর টলটলে নীল পানি, দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। সাঁতার দেয়ার জন্যে আলাদা আলাদা লেন, সেখানে একেকজন একেকটা লেনে সাঁতার কাটবে।

নাজমা ম্যাডাম তাদেরকে নিয়ে গেলেন রেজিস্ট্রেশন করানোর জন্যে, তাদেরকে একটা নম্বর দেয়া হল, সাতার কাটার সময় সেটা বুকে লাগিয়ে রাখতে হবে। একেকজন দুইটা ইভেন্টে অংশ নিতে পারবে। সেরিনারা ফ্রী স্টাইল আর রিলে সাতারে নাম দিয়েছে। সকালে ফ্রী স্টাইল বিকেলে রিলে সাঁতার।

সেরিনাদের দল দ্বিতীয় রাউন্ডে হেরে গেল। গৌরী প্রাণপণ চেষ্টা করল, আরেকটু হলে সে এর পরের রাউন্ডে উঠতে পারত কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারল না। ফর্সা মেয়েটা চাম্পিওন হল। তার দলের অন্যেরাও অন্যান্য ইভেন্টে খুব ভালো করল। তাদের স্কুলের টিচার মহা খুশী। নাজমা ম্যাডাম মুখ শুকনো করে ঘুরাঘুরি করতে লাগলেন। মাঝে মাঝে এসে তাদের বলে যেতে লাগলেন, “তোমরা মন খারাপ করো না। কম্পিটিশনে জেতা বড় কথা না, অংশ নেয়া হচ্ছে বড় কথা।”

সেরিনা কিছু বলল না, সে তো আর নাজমা ম্যাডামকে বলতে পারে যে আসলে তাকে খুব সাবধানে সারাতে হচ্ছে যেন কোনোভাবে কোনো পুরস্কার না পেয়ে যায়। কোনো ভাবে কেউ যেন সন্দেহ করতে না পারে যে পানির সাথে তার অন্য এক ধরণের সম্পর্ক! সেরিনা ইচ্ছে করলেই এখানে যারা আছে তাদের যে কাউকে যে কোনো সময়ে হারিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সেটা যেন না করে ফেলে সেটা নিয়েই সাবধান থাকতে হয়। চেষ্টা করে তাকে হেরে যেতে হয়!

দুপুরের পরে রিলে সাঁতার। সেরিনাদের জন্যে তিন নম্বর ট্র্যাক, চার নম্বর ট্র্যাকে সেই ফর্সা মেয়েটির দল। সেরিনাদের দেখে মেয়েটি খিল খিল করে হেসে ফেলল, বলল, “তোমাদের সুইমিং কস্টিউটম নেই?”

সেরিনা মাথা নাড়ল, বলল, “না নেই?”

“এই টি শার্ট পরে সাঁতরাবে।”

সেরিনা মাথা নাড়ল। মেয়েটা বলল, “সুইমিং কস্টিউম ছাড়া একজন কেমন করে সারায়? কিনে নাও না কেন?”

নার্গিস বলল, “আমাদের থাকলেও কেউ পরতে রাজী হবে না।”

“কেন?”

গৌরী বলল, “লজ্জা করবে।”

মেয়েটা আবার খিল খিল করে হাসল, তারপর বলল, “তোমাদের মাথাতে ক্যাপ নেই? চোখে গগলস নেই?”

সেরিনা আবার মাথা নাড়ল, বলল, “না, নেই।”

“চুল তোমাদের ডিস্টার্ব করে না।“

“করে না। আমাদের অভ্যাস আছে।”

ফর্সা মেয়েটা বলে, “তোমাদের আসলে পানিতে নামাই ঠিক হয় নাই।”

সেরিনা ভুরু কুঁচকে বলল, “কেন?”

“পানিতে মানুষ সাঁতার কাটে। সাঁতার কাটার নিয়ম আছে। স্টাইল আছে। তোমরা তো কিছু জান না।”

নার্গিস চোখ পাকিয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটা বলল, “সাতারের মাঝে হাইজিনেরও ব্যাপার আছে। ভাগ্যিস এই পানিতে ক্লোরিন দেওয়া থাকে। তা না হলে তোমরা কোথা থেকে কী ব্যাকটেরিয়া নিয়ে আসতে কে জানে!”

গৌরী ফিস ফিস করে সেরিনাকে জিজ্ঞেস করল, “মেয়েটা কী বলছে রে?”

“মেয়েটা বলছে, আমাদের শরীরে জীবানু থাকলেও সমস্যা নাই। সুইমিং পুলের পানিতে ক্লোরিন থাকে।”

গৌরী ফিস ফিস করে বলল “ইচ্ছে করছে মেয়েটার মুখে খামচি দিয়ে চোখ তুলে নেই।”

সেরিনা বলল, “আমারও।”

.

এরকম সময়ে নাজমা ম্যাডাম এসে বললেন, “সেরিনা তুমি প্রথম শুরু কর যদি ভালো একটা শুরু হয় অন্যেরা উৎসাহ পাবে।”

সেরিনা বলল, “না ম্যাডাম আমি সবার শেষে।”

“সবার শেষে?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম।”

“তাহলে প্রথম কে?”

“নার্গিস থাকুক।”

নার্গিস একটু ইতস্তত করে রাজী হল। নাজমা ম্যাডাম ঠিক করে দিলেন নার্গিসের পর গৌরী। গৌরীর পর ললিতা, ললিতার পর সেরিনা। নাজমা ম্যাডাম যে সাঁতারের কায়দা কানুন খুব ভালো জানেন তা নয়, তারপরেও কিছু গাধা উপদেশ দিলেন। তখন সবাই সাঁতারের রিলের জন্যে রেডী হল। সুইমিং পুলের এক পাশে নার্গিস আর ললিতা অন্যপাশে গৌরি আর সেরিনা। নার্গিস ব্যাটন নিয়ে সুইমিং পুলের উপরে রেডি হল, ললিতা এক পাশে সরে নার্গিসের জন্যে জায়গা করে দিল।

সবাইকে প্রস্তুত করানোর জন্যে হুইসেলের একটা লম্বা শব্দ হল। সবাই মাথা নিচু করে রেডি হল। এইবারে একটা তীব্র শব্দ হতেই সবাই নিজের ট্র্যাকে লাফিয়ে পড়ল। পানি ছিটিয়ে সবাই সাঁতরাতে থাকে। গৌরী উত্তেজনায় ছটফট করতে থাকে। সেরিনা গৌরীকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে–“ঘাবড়াবি না গৌরী, একটুও ঘাবড়াবি না। তোকে শুধু ব্যাটনটা ঠিক করে নিতে হবে–ব্যাটনটা ফেলিস না তাহলেই হবে।”

গৌরী আশে পাশের ট্র্যাকের দিকে তাকাল, তাদের পাশের ফর্সা মেয়ের দলের মেয়েটা এর মাঝে পৌঁছে গেছে সাত নম্বর ট্র্যাকও চলে এসেছে। গৌরীর মনে হতে থাকে নার্গিস বুঝি পৌঁছাবেই না। শেষ পর্যন্ত পানি ঝাঁপটে নার্গিস পৌঁছালো, গৌরী ব্যাটনটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে উল্টো দিকে যেতে থাকে। ট্র্যাকের দড়ি ধরে ফর্সা মেয়েটা জোরে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে আড় চোখে সেরিনার দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হাসে। সেরিনাও মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসল–যেন খুব মজার একটা ব্যাপার। হয়েছে।

গৌরী সুইমিং পুলের আধাআধি হতেই ফর্সা মেয়ের দলের মেয়েটি গন্তব্যে পৌঁছে পরের জনকে ব্যাটল দিয়ে দিয়েছে। গৌরী পৌঁছে ললিতাকে ব্যাটন দিতে গিয়েও একটু সমস্যা করে ফেলল, হাত থেকে ছুটে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত ব্যাটনটা ললিতা ধরতে পারল। তখন ললিতা সাঁতরে আসতে থাকে।

ফর্সা মেয়েটা সেরিনাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কতো পজিশন পাবে বলে মনে কর?”

সেরিনা জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কতো পজিশন পাবে?”

“চ্যাম্পিওন, আবার কী? দেখছ না তাকিয়ে!”

সেরিনা বলল, “তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। ফর্সা মেয়েটা বলল, তোমাদের পজিশন কী হবে আমি বলব?”

“বল।”

“লাস্ট।”

সেরিনা উত্তর না দিয়ে মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। এরকম সময়ে সেরিনা কেন মিষ্টি করে হাসছে ফর্সা মেয়েটা বুঝতে পারল না।

ফর্সা মেয়েটা যখন ব্যাট হাতে সুইমিং পুলের মাঝামাঝি পৌঁছে গেছে তখন ললিতা সেরিনার হাতে ব্যাটনটি দিল। সেরিনা ব্যাটনটি নিয়ে ললিতার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, “সাবাস ললিতা?”

সেরিনা ললিতা ঠিক বুঝল না এতো দেরী করে পৌঁছানোর কোন জায়গাটা সাবাস।

সেরিনা পানিতে ডুব দিল, তারপর দুই পা দিয়ে পানিটা ধাক্কা দিয়ে হঠাৎ করে নাচের ভঙ্গীতে পা দুটো নাড়াতে থাকে, হাত দুটো সামনে ধরে রেখেছে সাতারের ভঙ্গীতে কিন্তু পানি কেটে আনার চেষ্টা করছে না। যারা সাঁতার কাটে তারা তাদের হাত আর পা ব্যবহার করে সেরিনা আপাত দৃষ্টিতে তার হাতগুলো ব্যবহার পর্যন্ত করল না, সারা শরীর একটা তরঙ্গের মতো ঝাঁকুনি দিয়ে নিয়ে গেল একটি বার মাথাটা পানির ওপরে না তুলে সে একটা তীরের মতো এগিয়ে গেল, ফর্সা মেয়েটি গন্তব্যে প্রায় পৌঁছে গিয়েছিল সেরিনা তাকে পিছনে ফেলে একটা বিদ্যুৎ ঝলকের মতো সামনে এগিয়ে গেল। গন্তব্য পৌঁছে সে একটা ডিগবাজী দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফর্সা মেয়েটির জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।

ফর্সা মেয়েটি হঠাৎ করে সেরিনাকে দেখতে পায়, গন্তব্যে পৌঁছে শান্ত মুখে তার জন্যে অপেক্ষা করছে, সে তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না, বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে কোনো মতে বলল, “তুমি-তুমি-তুমি?”

সেরিনা কিছু বলল না, মেয়েটার দিকে মিষ্টি করে হাসল।

মেয়েটি আবার বলল, “তু-তু-তুমি কেমন করে?”

সেরিনা বলল “আমাদের শরীরের ব্যাকটেরিয়া!”

সেরিনার দল যখন মেডেল নিচ্ছে তখনও ফর্সা মেয়েটা সেরিনার দিকে তাকিলে রইল। বুঝতে পারছে না এটি কীভাবে সম্ভব।

.

দুই দিন পর খাবার টেবিলে শামীম সেরিনাকে বলল, “তোকে এতো করে করলাম কারো চোখে পড়বি না আর তুই এমন একটা নাটক করে ফেললি?

সেরিনা বলল, “আন্ধু তুমি হলে আরো বেশী করতে। তুমি জান ঐ পাজী মেয়েটা আমাদেরকে কীভাবে টিটকারী মারছিল? উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। মুখটা এই রকম হা হয়ে গেছে!” কথা শেষ করে সেরিনা মুখটা হা করে দেখাল।

শামীম সেরিনার হা করা মুখটা দেখে হেসে ফেলল কিন্তু আবার হাসি বন্ধ করে গম্ভীর হয়ে বলল, “কিন্তু তুই যে আসলে সাঁতরাসনি তুই যে আসলে পানির টর্পেডো হয়েছিলি সেটা কেউ লক্ষ্য করে নি মনে করিস? কোথাও ভিডিও হয়ে গেছে হয়ত।”

“না আব্বু। এতোজন পানি ঝাঁপটে সাঁতার দিচ্ছে কেউ আমাকে লক্ষ্য করে নি।”

না করলে ভালো, কিন্তু এ-রকম একটা জিনিষ কী লক্ষ্য না করে থাকা সম্ভব?”

সেরিনা বলল, “লক্ষ্য করলেও ভেবেছে আমি খুব ভালো সাঁতার কাটি। তার বেশী কিছু না। কেউ বুঝে নি যে আমি ফুসফুস দিয়ে নিশ্বাস নিই নি।”

শামীম বলল, “সেটা অবশ্যি ঠিক। কেউ তো জানে না তুই ফুসফুস দিয়ে নিশ্বাস না নিয়েও থাকতে পারিস। তাই সেটা কারো সন্দেহ করার কথা না। তারপরেও সেরিনা ভবিষ্যতে আর কখনো যেন এরকম না হয়।”

“হবে না আব্বু।”

“আমাকে ছুঁয়ে বল আর কখনো এরকম করবি না।”

সেরিনা শামীমকে ছুঁয়ে বলল, “আর কখনো করব না। আব্বু।”

তারপর হাসি হাসি মুখ করে বলল, “কিন্তু আলু তুমি যদি ঐ পাজী মেয়েটার মুখটা দেখতে

শামীম বলল, “আমার দেখতে হবে না, আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছি।”

সেরিনা শামীমকে ধরে আনন্দে হি হি করে হাসতে লাগল।