সন্ধের পর ওপরের বারান্দায় বসে শুরু হল গল্প।
চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে। দুপুরে গরম ছিল, এখন শিরশিরে ভাব। এখানেও রয়েছে কতকগুলো বেতের চেয়ার। বাংলোটি সুন্দরভাবে সাজানো, কোনও কিছুরই অভাব নেই। কোল ইন্ডিয়ার অতিথি ছাড়া বাইরের লোকদের থাকতেই দেওয়া হয় না।
কাকাবাবু প্রথমে বললেন, সন্তু আর জোজো আমার কী করে পা খোঁড়া হল, সেই ঘটনাটা শুনতে চেয়েছে। খুবই রোমহর্ষক ব্যাপার হয়েছিল। আমি সবটা নিজের মুখে বললে, হয়তো ওদের বিশ্বাস হত না। তাই কামাল আর আমি দুজনে মিলে বলব। আমরা দুজনে সেখানে একসঙ্গে ছিলাম।
কামাল বললেন, নরেন্দ্র ভার্মাও কিছুদিন ছিলেন, তারপর চলে এসেছিলেন।
কাকাবাবু বললেন, আমরা তখন কাজ করতাম ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগে। সরকার থেকে আমাদের আফগানিস্তানে পাঠানো হয়েছিল। কেন পাঠানো হয়েছিল, সেটা আগে বলব না। তার আগে একটু জিজ্ঞেস করে নিই, তোরা আফগানিস্তান সম্পর্কে কতটা জানিস। জোজো, তুমি তো তোমার বাবার সঙ্গে অনেক জায়গায় গিয়েছ, আফগানিস্তানেও গিয়েছিলে কখনও?
জোজো বলল, না। আমার বাবা ঘুরে এসেছেন, সেবার একটুর জন্য আমার যাওয়া হল না!
সন্তু বলল, রবীন্দ্রনাথ কাবুলিওয়ালা নামে একটা গল্প লিখেছেন, আমি সেটা পড়েছি।
কামাল বললেন, আহা, কী চমৎকার গল্প। কলকাতায় এক সময়ে অনেক কাবুলিওয়ালা দেখা যেত, এখনও কিছু কিছু আছে। হিং, কিশমিশ, পেস্তাবাদাম বিক্রি করত।
কাকাবাবু বললেন, কামাল, আমরা একটা জায়গায় পেস্তা বাদাম গাছের প্রায় একটা বন দেখেছিলাম, মনে আছে? কামাল বললেন, হ্যাঁ, মনে আছে।
জোজো বলল, গোড়া থেকে বলুন। আপনারা কী করে গেলেন ও-দেশে?
কাকাবাবু বললেন, পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে যাইনি। প্লেনে গিয়ে কাবুলে নেমেছিলাম। তখন অমৃতসর থেকে কাবুল পর্যন্ত প্লেন সার্ভিস ছিল। এখন আছে কি না জানি না। কাবুলে অবশ্য দু-একদিনের বেশি থাকিনি। তোরা আমুদরিয়া কাকে বলে জানিস?
সন্তু বলল, ভূগোলে পড়েছি। আমুদরিয়া আফগানিস্তানের একটা নদীর নাম।
কাকাবাবু বললেন, সেই নদীর ধার দিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের যাত্রা।
কামাল বললেন, তখন তোমাদের এই কাকাবাবুর কী দারুণ স্বাস্থ্য ছিল। ঝকঝকে চেহারা। যেমন ঘোড়া ছোটাতে পারতেন, তেমনই বন্দুক-পিস্তল চালানো, এমনকী তলোয়ার খেলাতেও ওস্তাদ ছিলেন। রাজাসাহেব, আপনার মনে আছে, একবার আপনাকে তলোয়ার লড়তে হয়েছিল?
কাকাবাবু হেসে বললেন, হ্যাঁ, খুব জোর বেঁচে গেছি। সেই লোকটির নাম ছিল জাভেদ দুরানি। আমাদের ইন্ডিয়ার ক্রিকেট টিমে একসময় সেলিম দুরানি নামে একজন খেলোয়াড় ছিল জানিস? সেও আসলে ছিল কাবুলি। আফগানিস্তানে অনেক দুরানি আছে।
জোজো জিজ্ঞেস করল, তার সঙ্গে আপনার তলোয়ার লড়তে হয়েছিল কেন?
কাকাবাবু বললেন, সে যে আমাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল!
কামাল বললেন, রাজাসাহেব, আগেই ওটা বলে দিলে জমবে না। তার আগে একটা সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার হয়েছিল।
কাকাবাবু বললেন, ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। কাবুল থেকেই শুরু করা যাক। আমরা কাবুলে ছিলাম পাঁচদিন, সরকারি লোকজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হল। আমাদের অভিযানের জন্য অনুমতি নেওয়ার দরকার ছিল। আগেই চিঠিপত্রে সব জানানো হয়েছিল অবশ্য। তবু একটা শর্তে আটকে গেল।
কামাল বললেন, সেই সময় নরেন্দ্র ভার্মা চলে এলেন দিল্লি থেকে। উনি কাজ করতেন হোম ডিপার্টমেন্টে। ওঁর অনেক ক্ষমতা। তা ছাড়া নরেন্দ্র ভার্মা তুঘোড় লোক, অচেনা মানুষের সঙ্গে নিমেষে ভাব জমিয়ে ফেলতে পারেন। কাবুলের যে দুজন সরকারি অফিসার শর্তের খুঁটিনাটি নিয়ে আমাদের যাওয়া আটকে দিয়েছিলেন, সেই দুজনকে নরেন্দ্র ভার্মা একদিন রাত্তিরে খাওয়ার নেমন্তন্ন করলেন ভারতীয় দূতাবাসে। আমাকে আগের দিন বললেন, ওদের শুধু পেটভরে নয়, প্রাণভরে খাওয়াতে হবে। এমন রান্না হবে, যা ওরা জীবনে খায়নি। কামাল, তুমি হরিণের দুধ জোগাড় করতে পারবে? আর কচি ভেড়ার মাংস। সেই ভেড়ার বয়েস এক মাসের বেশি হলে চলবে না।
কাকাবাবু বললেন, কামালকে তুমি যা বলবে, ও ঠিক জোগাড় করে আনবে।
কামাল বললেন, কচি ভেড়ার মাংস জোগাড় করা শক্ত কিছু নয়। ওখানকার গ্রামের দিকে অনেকেই ভেড়া চরায়। বেশি দাম দিয়ে একটা বাচ্চা ভেড়া কিনে ফেললাম। কিন্তু হরিণের দুধ পাই কোথায়? জঙ্গলে গিয়ে তো হরিণ ধরতে পারি না। ধরলেও সেই হরিণের যে দুধ থাকবে, তার কোনও মানে নেই। আমি তখন কাবুল শহরের চিড়িয়াখানায় অনেকক্ষণ ঘুরলাম। সেখানে অনেকরকম হরিণ আছে, সেখানে একটা হরিণীর সদ্য বাচ্চাও হয়েছে দেখা গেল। কিন্তু তার দুধ নেব কী করে? একজন পাহারাদারকে কথাটা বলতেই সে এমন কটমট করে তাকাল, যেন মেরেই ফেলবে। এর পর একটাই উপায় আছে। আমি রাত্তিরবেলা চিড়িয়াখানার পাঁচিল ডিঙিয়ে ঢুকে পড়লাম চুপিচুপি। সঙ্গে নিয়েছিলাম একটা বদনা। টর্চের আলোয় হরিণীটাকেও খুঁজে পেলাম, কিন্তু দুধ দুইতে গেলেই চ্যাঁচাবে। কোনওক্রমে রুমাল দিয়ে বেঁধে ফেললাম তার মুখ। পেছনের পা দুটোও বাঁধতে হল। তারপর এক বদনা ভর্তি দুধ দুয়ে নিলাম। ওরই মধ্যে হরিণীটা শিং দিয়ে একবার টু মেরেছিল আমার পেটে। আর একটু হলে পেটটা ফুটো হয়ে যেত!
কাকাবাবু বললেন, আঃ, কী অপূর্ব রান্না হয়েছিল! এখনও জিভে লেগে আছে সেই স্বাদ। জল দেওয়াই হয়নি। শুধু দুধ দিয়ে রান্না করা নরম তুলতুলে মাংস, অসম্ভব ঝাল। তাই খেয়ে অফিসার দুজন যাকে বলে কুপোকাত। পরদিনই অনুমতি পাওয়া গেল।
কামাল বললেন, নরেন্দ্র ভামা আমাদের সঙ্গে গেলেন না, তিনি ফিরে এলেন দিল্লিতে। আমরা দুজনেই শুধু যাব শুনে অনেকে আমাদের নিষেধ করেছিল, ভয় দেখিয়েছিল। ও-পথে খুব ডাকাতের উৎপাত। কিন্তু তখন আমাদের কম বয়েস, বিপদ-টিপদ গ্রাহ্য করি না, বিপদের কথা শুনলে রক্ত আরও চাঙ্গা হয়ে ওঠে।
জোজো জিজ্ঞেস করল, আমাদের দেশে এত জায়গা থাকতে আপনারা আফগানিস্তানে অভিযানে গেলেন কেন?
কাকাবাবু বললেন, তা হলে একটু ইতিহাসের কথা বলতে হয়।
জোজো বলল, এই রে, হিস্ট্রি আমার খুব বোরিং লাগে, বড্ড সাল-তারিখ মুখস্থ রাখতে হয়।
সন্তু বলল, আমার কিন্তু ইতিহাস বেশ ভাল লাগে।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, খুব সংক্ষেপে বলব। যাতে মোটামুটি একটা ধারণা হয়। সাল-তারিখও মনে রাখতে হবে না। আফগানিস্তান দেশটা যদিও পাহাড় আর মরুভূমিতে ভরা, আর বিশেষ কিছু নেই, কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য দেশটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেইজন্য বারবার বিদেশিরা এই দেশ আক্রমণ করে দখল করে নিয়েছে। গ্রিস থেকে আলেকজান্ডার এসে আফগানিস্তান জয় করে ভারতের দিকে এগিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর গ্রিস সাম্রাজ্য টুকরো-টুকরো হয়ে যায়। ভারতে তখন মৌর্য বংশের রাজারা খুব ক্ষমতাশালী, তাঁরা আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পাহাড় পর্যন্ত তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। সম্রাট অশোকের সময়ও এ-দেশটা তাঁর অধীনে ছিল। এরপর কুশান নামে এক দুর্ধর্ষ জাত মধ্য এশিয়া থেকে এসে অনেক দেশ জয় করে নেয়। কুশানদের সবচেয়ে বিখ্যাত সম্রাটের নাম কনিষ্ক।
জোজো বলে উঠল, মুণ্ডুকাটা কনিষ্ক!
কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ইতিহাসের বইতে তাঁর মুণ্ডু ভাঙা মূর্তির ছবি থাকে শুধু। কিন্তু তাঁর মুণ্ডু কেউ-কেউ দেখেছে। সন্তু, তোর মনে আছে; সেই যে কাশ্মীরে–
সন্তু বলল, বাঃ, মনে থাকবে না? সেবারই তো আমি প্রথম তোমার সঙ্গে গেলাম।
কাকাবাবু বললেন, সে যাই হোক, সম্রাট কনিষ্কের রাজ্য ওদিকে তো অনেকখানি ছিলই, ভারতের মধ্যেও মথুরা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। এর পরের ইতিহাস আর আমাদের জানার দরকার নেই। কনিষ্কের আমলে আফগানিস্তানের অনেক উন্নতি হয়েছিল, তখনকার কিছু কিছু ব্যাপার এখনও অজানা রহস্য রয়ে গেছে। সেইরকমই একটা কিছুর খোঁজে আমাদের যেতে হয়েছিল।
জোজো জিজ্ঞেস করল, একটা কিছু মানে কী?
কাকাবাবু বললেন, সেটা যথাসময়ে জানতে পারবে।
কামাল বললেন, কাবুল থেকে আমরা একটা জিপগাড়িতে পৌঁছে গেলাম ফৈজাবাদ। সেটা খুব ছোট শহর। সেখান থেকে আমাদের ঘোড়া ভাড়া নিতে হল। সঙ্গে অস্ত্র রাখতে হয়েছিল, আমার কাছে একটা রাইফেল, রাজাসাহেবের কাছে একটা রিভলভার।
কাকাবাবু বললেন, কামাল, তুমি আমাকে বারবার রাজাসাহেব, রাজাসাহেব বলছ কেন? শুনলে অন্য কেউ ভাববে, আমি বুঝি সত্যি কোনও রাজা। তুমি তো আগে আমাকে শুধু দাদা বলতে!
কামাল বললেন, ঠিক আছে, দাদাই বলব, দাদার তখন কী সুন্দর চেহারা ছিল, সবাই দেখলেই খাতির করত। আমরা সঙ্গে অনেক খাবারদাবার নিয়েছিলাম, শুকনো ফলই বেশি, আখরোট, পিস্টাশিও, কিশমিশ, খেজুর এইসব। কোথায় কী জুটবে তার ঠিক নেই। পাহাড় আর জঙ্গল, মাঝখান দিয়ে চলেছে আমুদরিয়া নদী, মাইলের পর মাইল কোনও জনবসতি নেই।
জোজো বলল, সেই তলোয়ারের যুদ্ধটা হল কোথায়? কাকাবাবুর সঙ্গে কি তলোয়ারও ছিল?
সন্তু বলল, আঃ জোজো, তোর একদম ধৈর্য নেই। চুপ করে শোন না!
কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা কামাল, সেই বাঘটা আমরা দেখেছিলাম কবে? প্রথম দিনই?
কামাল বললেন, না, দাদা। সেটা তো তৃতীয় দিন। প্রথম দিন শুধু পিঁপড়ে।
কাকাবাবু বললেন, ওরেবাব্বা, সেরকম পিঁপড়ে জীবনে দেখিনি! বাঘের থেকে কম ভয়ঙ্কর নয়। সন্তু, তোর মনে আছে, একবার মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে আমরা পিঁপড়ের পাল্লায় পড়েছিলাম? সে-পিঁপড়েও আফগানিস্তানের পিঁপড়ের তুলনায় কিছুই নয়।
কামাল বললেন, প্রথম দিনটায় কিছুই ঘটেনি। শুধু আমাদের আস্তে-আস্তে এগোতে হচ্ছিল। পাহাড়ি রাস্তায় তো জোরে ঘোড়া ছোটাবার উপায় নেই। সন্ধের সময় আমরা নদীর ধারে তাঁবু খাটিয়ে নিলাম বিশ্রামের জন্য।
জোজো জিজ্ঞেস করল, আপনাদের সঙ্গে তাঁবুও ছিল?
কামাল বললেন, ছোট্ট নাইলনের হালকা তাঁবু। শুধু মাথা গোঁজবার জন্য। আফগানিস্তানে শীতকালে খুব শীত, আর গরম কালে খুব গরম। তখন ছিল গরমকাল। কম্বল-টম্বল নিতে হয়নি। বৃষ্টিও হয় খুব কম। পাথর দিয়ে উনুন বানিয়ে আমরা রুটিও সেঁকে নিয়েছিলাম। রুটি আর খেজুর, চমৎকার খাওয়া হল। একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝরাত্তিরে আক্রমণ করল পিঁপড়ে।
কাকাবাবু বললেন, হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ পিঁপড়ে। লাল লাল রং, এক-একটা প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা, তাদের কামড়ে সাঙ্ঘাতিক বিষ। যন্ত্রণার চোটে আমরা নাচতে শুরু করেছিলাম। শেষপর্যন্ত আমরা ঝাঁপ দিলাম নদীতে। গলা পর্যন্ত ড়ুবিয়ে রাখলাম জলে।
কামাল বলল, দ্বিতীয় রাতে কিন্তু কিছুই হয়নি। পিঁপড়ে-টিপড়ে ছিল না, পরিষ্কার জায়গা। খুব ভাল ঘুমিয়েছিলাম।
অংশু একটু দূরে একেবারে চুপচাপ বসে আছে, একটি কথাও বলেনি। কাকাবাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন, কী অংশু, শুনছ তো? ভাল লাগছে?
অংশু শুকনো গলায় বলল, হ্যাঁ সার।
জোজো চুপিচুপি সন্তুকে বলল, ও বেচারা কবিতার দ্বিতীয় লাইন ভেবে-ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছে!
কামাল বলল, তৃতীয় দিন দিনের বেলাতেই আমরা বাঘটাকে দেখলাম। আমরা তখন একটা টিলার ওপরে—
সন্তু খানিকটা সন্দেহের সুরে বলল, আফগানিস্তানে বাঘ আছে?
কাকাবাবু বললেন, থাকবার কথা নয়। এককালে এই আমুদরিয়া নদীর ধারে-ধারে এক ধরনের বাঘ ছিল, তাদের বলা হত সাইবেরিয়ান টাইগার। সবাই জানে, তারা সব লুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা চোখের সামনে একটাকে দেখলাম। নিশ্চয়ই দুটো-একটা তখনও রয়ে গিয়েছিল। মুখে ঝাঁটার মতন মস্ত গোঁফ, পিঠটা উঁচুমতন। আমরা তখন একটা টিলার চূড়া পেরিয়ে অনেকটা নেমে এসেছি, এই সময় একটা বড় পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল বাঘটা, আমাদের দেখে লেজ আছড়াতে লাগল। আমরা যদিও ওপরের দিকে আছি, বাঘটা লাফিয়ে আমাদের ধরতে পারবে না। কিন্তু আমাদের পশ্চাদপসরণ করতে হলে পেছন ফিরতেই হবে, তখন যদি ও তেড়ে আসে?
জোজো বলল, আপনাদের সঙ্গে তো রাইফেল ছিল?
কাকাবাবু বললেন, তা ছিল। কিন্তু সাইবেরিয়ান টাইগার দুর্লভ প্রাণী, তাকে মারব? ও আমাদের একবার দেখে ফেলেছে, এদিকে মানুষ খুব কমই যাতায়াত করে, আমাদের দেখে ও লোভ সামলাবে কী করে? শেষপর্যন্ত কামালই একটা ব্যবস্থা করল।
কামাল বললেন, কেন ও-কথা বলছেন দাদা? বাঘটাকে দেখে ভয়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। হিংস্রভাবে গরগর শব্দ করতে-করতে ল্যাজ আছড়াতে দেখলেই মনে হয়, এবার আর নিষ্কৃতি নেই। তখন তোমাদের কাকাবাবু আমার হাত থেকে রাইফেলটা নিয়ে বললেন, কামাল, তুমি টিলাটার ওপর দিকে চলে যাও, আমি একে সামলাচ্ছি। উনি পরপর দুটি গুলি করলেন, একটাও বাঘটার গায়ে লাগল না, পাথরের বলটা ছিটকে গেল। বাঘটা অবশ্য একলাফে অদৃশ্য হয়ে গেল সঙ্গে-সঙ্গে। তখন আমি ভেবেছিলাম, রাজা রায়চৌধুরীর হাতে টিপ নেই, নতুন বন্দুক চালাতে শিখেছেন। পরে বুঝেছি, উনি ইচ্ছে করে বাঘটাকে মারেননি।
কাকাবাবু হেসে বললেন, বাঘটা তো আমাদের আক্রমণ করেনি, শুধু ল্যাজ আছড়েছিল। হয়তো বাঘটাও আমাদের দেখে অবাক হয়েছিল। ওর ঠিক কানের কাছে গুলি চালিয়েছিলাম।
জোজো জিজ্ঞেস করল, বাঘটা আর ফিরে আসেনি?
কাকাবাবু বললেন, নাঃ! তার আগেই যে অন্য একটা ঘটনা ঘটল। গুলি না চালিয়েই বাঘটাকে তাড়াবার ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। পাহাড়ে গুলির শব্দ অনেকদূর পর্যন্ত শোনা যায়। আমার সেই গুলির শব্দ শুনে চলে এল একটা ডাকাতের দল।
কামাল বললেন, ওরা ছ-সাতজন ছিল। আমরা বাধা দেওয়ার কোনও সুযোগই পেলাম না। প্রত্যেকের হাতে বন্দুক, চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরল আমাদের।
জোজো বলল, এ যে ওয়েস্টার্ন ফিলমের মতন!
বাংলোর সামনে একটা জিপ এসে থামল। তার থেকে দুজন লোক নেমে চিৎকার করল, চৌকিদার? কেয়ারটেকার!
গল্পে বাধা পড়ল। কামালসাহেব উঠে গিয়ে বারান্দার রেলিং-এর কাছে দাঁড়িয়ে নীচে উঁকি মারলেন।
গেটের কাছে একজন চৌকিদার সবসময় থাকে, সে এখন নেই। ওই লোকদের হাঁকডাক শুনে বেরিয়ে এলেন ইউসুফ বাবুর্চি।
একজন লোক তাকে বলল, এখানে ঘর খালি আছে? একটা ঘর খুলে দাও!
ইউসুফ বললেন, এখানে তো রিজার্ভেশান ছাড়া কাউকে থাকতে দেওয়া হয় না।
লোকটি রুক্ষস্বরে বলল, আমাদের রিজার্ভেশান আছে কি নেই, তা তুমি জানছ কী করে? আগে ঘর খোলো!
ইউসুফ বললেন, ঘর তো খালি নেই। আজই একটি পার্টি এসেছে।
অন্য লোকটি বলল, ঘর খালি নেই? ঠিক আছে, আমরা বারান্দায় বসছি, আমাদের চা করে দাও। আর চটপট রুটি-মাংস বানিয়ে দাও, আমরা নিয়ে যাব।
ইউসুফ বললেন, মাফ করবেন সার। এখানে বাইরের লোকদের খাবার দেওয়ার নিয়ম নেই।
লোকটি দুখানা একশো টাকার নোট বার করে দিয়ে বলল, বেশি কথা বোলো না, এই নাও, যা বলছি করে দাও!
ইউসুফ বললেন, আমি পারব না। আপনারা বরং ডান দিকে এক কিলোমিটার চলে যান, সেখানে হোটেল আছে। খাবারদাবার সব পাবেন।
একজন লোক এবার ইউসুফ মিঞার গলা চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কোথায় আমরা যাব না যাব, তা তোমার কাছে কে শুনতে চেয়েছে? মারব এক থাপ্পড়!
কামাল একবার ওপর থেকে চেঁচিয়ে বললেন, ও কী হচ্ছে, ওকে ছেড়ে দিন।
সন্তু দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল।
লোক দুটি কামালের কথা গ্রাহ্যই করল না। একজন ইউসুফকে চুলের মুঠি ধরে বলল, আমাদের চিনিস না? মুখে-মুখে কথা! টাকা দেব, খাবার তৈরি করে দিবি।
কাকাবাবুও উঠে এসে রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বললেন, লোকদুটি তো বড় বেয়াদপ। শুধু-শুধু ইউসুফকে মারছে!
সন্তু ততক্ষণে নীচে পৌঁছে গেছে। ইউসুফের কাছে গিয়ে শান্ত কণ্ঠে লোক দুটিকে বলল, ওকে ছেড়ে দিন।
কাকাবাবু বললেন, সন্তু একা পারবে না। কামাল, তুমি নীচে গিয়ে লোক দুটিকে ধরো।
এবার ওদের একজন টর্চের আলো ফেলল দোতলায়।
অন্যজন অস্ফুট স্বরে বলল, ও কে? রাজা রায়চৌধুরী না?
অন্য লোকটি বলল, হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।
ইউসুফকে ছেড়ে দিয়ে ওরা দ্রুত ফিরে গেল জিপগাড়িটার দিকে। কামাল নীচে পৌঁছবার আগেই ওরা স্টার্ট দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল!
কামাল বিরক্তভাবে বললেন, চৌকিদার গেল কোথায়? ইউসুফ, তুমি বেরোতে গেলে কেন? বাইরের লোক ডাকাডাকি করলেও তুমি বেরোবে না।
ইউসুফ আস্তে-আস্তে বললেন, এইসব লোক, বেআইনিভাবে পয়সা রোজগার করে, আর সব জায়গায় গায়ের জোর ফলায়।
সন্তু আর কামাল ফিরে এলেন দোতলায়।
জোজো বলল, ওরা কাকাবাবুকে দেখেই ভয়ে পালাল।
কাকাবাবু চিন্তিতভাবে বললেন, ব্যাপারটা ভাল হল না রে জোজো। আমি ভেবেছিলাম, এই সাতনার মতন জায়গায় আমাকে কেউ চিনবে না।
কামাল বললেন, সত্যিই তো, চিনল কী করে? এখানে আপনি অনেকদিন আসেননি। এখানে হিরের খনি আছে, অনেকরকম ব্যবসা শুরু হচ্ছে, তাই গুণ্ডা বদমাশদের উৎপাত বাড়ছে। তোক দুটোর ব্যবহার টিপিক্যাল গুণ্ডার মতন।
কাকাবাবু বললেন, অনেকদিন আগে সূর্যপ্রসাদ নামে একটা লোক আমার কাছে জব্দ হয়েছিল। খাজুরাহো মন্দিরের মূর্তি ভেঙে-ভেঙে বিক্রি করা ছিল তার কাজ। ফাঁদে ফেলে তাকে আমি ধরেছিলাম। খুব একটা শাস্তি দিইনি। মূর্তিগুলো সব উদ্ধার করার পর সে আমার সামনে নাকে খত দিয়েছিল, তারপর তাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম।
কামাল বললেন, এই তো আপনার দোষ! আপনার দয়ার শরীর, আপনি ক্ষমা করে দেন। তারা কিন্তু আপনার শত্রুই থেকে যায়।
কাকাবাবু অংশুর দিকে তাকালেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, না, তা নয়। অনেক সময় ক্ষমা করে দিলে তারা ভাল হয়ে যায়।
কামাল বললেন, ওই সূর্যপ্রসাদ তো কুখ্যাত অপরাধী। চোরাচালান, মানুষ খুন, কিছুই বাকি রাখেনি। পুলিশের হাত থেকে দুবার পালিয়েছে। আপনি ক্ষমা করে দিলেও সে একটুও শোধরায়নি। এখন তার মস্তবড় দল। তবে শুনেছি, তার নিজেরই দলের একজন লোক তার তলপেটে একবার ছুরি মেরেছিল, তাতেও সে বেঁচে গেছে বটে, কিন্তু শরীর ভেঙে গেছে। নিজে আর বেরুতে পারে না। কোনও জায়গায় লুকিয়ে থেকে সে দল চালায়। এ-লোকগুলো সূর্যপ্রসাদের দলের লোক হতে পারে।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে আর কী করা যাবে? কামাল বললেন, সূরপ্রসাদকে আপনি নাক-খত দিইয়েছিলেন, সেই অপমানের সে শোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে না? যখন সে শুনবে আপনি এখানে এসেছেন … আমার মনে হচ্ছে দাদা, ওই লোক দুটো দলবল নিয়ে ফিরে আসবে, এখানে হামলা করবে!
কাকাবাবু বললেন, আমি তো আর ওদের ঘাঁটাতে যাচ্ছি না। এখানে আমি গুণ্ডা দমন করতে আসিনি, এসেছি বিশ্রাম নিতে।
কামাল জোরে-জোরে মাথা নেড়ে বললেন, উঁহুঃ, ভাল বুঝছি না। এখানকার চৌকিদার তো দেখছি অপদার্থ। পুলিশের পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। নরেন্দ্র ভামা আমার ওপর আপনাদের দেখাশুনোর দায়িত্ব দিয়েছেন।
জোজো বলল, গল্পটার কী হল? তারপর আফগানিস্তানের গল্পটা বলুন। ডাকাতের দল আপনাদের ঘিরে ধরেছিল—
কামাল বললেন, এখন তো আর গল্প হবে না ভাইটি। আমার এখনই থানায় যাওয়া দরকার। যদি রাত্তিরেই ওরা ফিরে আসে?
কামাল উঠে দাঁড়ালেন।
কাকাবাবু বললেন, ভেবেছিলাম এখানে নিরিবিলিতে শান্তিতে থাকব। তা নয়, এর মধ্যে এসে গেল গুণ্ডা, তার ওপর পুলিশ। গল্পটা মাটি হয়ে গেল। তুমি যাও বঙ্গে, কপাল তোমার সঙ্গে! অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকায়ে যায়!