০৫. বাইরের ঘরে আলো জ্বলছে

বাইরের ঘরে আলো জ্বলছে। বাড়ির সামনে জিপ দাঁড়িয়ে। এই জিপ পুলিশের। বেল টিপতেই বৃদ্ধ দরজা খুললেন, আরে এসো, এসো। গঙ্গাপদ বলল হাওয়া খেতে বেরিয়েছ। আগে বেড়াবার পক্ষে আদর্শ জায়গা ছিল সল্ট লেক।

আগে ছিল মানে?

লবণহ্রদ সংবাদ বলে একটা পাক্ষিক কাগজ আছে এখানে। খুললেই দেখবে ছিনতাই আর গুণ্ডামি হচ্ছে সন্ধের পর রাস্তায় রাস্তায়। এসো।

ঘরে ঢুকে অর্জুন দেখল, রোগা ভদ্র চেহারার একটি মানুষ বসে আছেন চেয়ারে। বৃদ্ধ আলাপ করিয়ে দিলেন, ইনি হচ্ছেন অবনীমোহন। খুব ভাল ছেলে। পুলিশে চাকরি না করে অধ্যাপক হলে মানাত।

অবনীমোহন হাসলেন, কেন? পুলিশের চাকরি করলে বিশাল ভয়ঙ্কর চেহারা করতে হবে?

ইয়েস। কারেক্ট। ইংরেজ আমলে অফিসারদের চেহারা ছিল বুলডগের মতো। আরে সেই চেহারা দেখেই অপরাধীরা ভয়ে মরত। ওহহ, এই ছেলেটির নাম অর্জুন। জলপাইগুড়িতে থাকে। আজই আমার কাছে বেড়াতে এসেছে।

অর্জুন নমস্কার করলে অবনীমোহন হাতজোড় করলেন।

অবনীমোহন বললেন, আপনার নামটি খুব বিখ্যাত।

ডক্টর পত্ৰনবীশ বললেন, টিভিতে কিন্তু অর্জুনের চেয়ে শ্রীকৃষ্ণ বেশি বিখ্যাত হয়েছে।

অবনীমোহন বললেন, সে অর্জুনের কথা বলছি না। জলপাইগুড়ি শহরে অর্জুন নামের একজন নাকি দারুণ-দারুণ রহস্যের সমাধান করেছেন। আপনি সেই লোক নন তো?

অর্জুন হেসে ফেলতেই অবনীমোহন উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেন, ঠিক ধরেছি, তাই না? আসুন হাত মেলান। কিন্তু সার, এ কী ব্যাপার হল? রাতারাতি ওঁকে জলপাইগুড়ি থেকে টেনে আনলেন অথচ আমাকে কিছু জানালেন না?

ডক্টর পত্ৰনবীশ বললেন, আহা, আমি তো ওর কথা জানতামই না। আমি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলাম অমল সোমকে। ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার একবার পরিচয় হয়েছিল। অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ। তিনিই ওকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

অমল সোম! হ্যাঁ, এই নামটিও শোনা। আমার এক বন্ধু জলপাইগুড়ির ওসি ছিলেন। তিনি খুব প্রশংসা করতেন ভদ্রলোকের। তা অর্জুনবাবু, নিশ্চয়ই সারের কাছে সব শুনেছেন। আপনার কী মনে হয়? আমি তো এখনও আশঙ্কার কিছু দেখছি না। যে ভদ্রলোক টেলিফোনে শাসিয়েছিল সে দ্বিতীয়বার ফোন করেনি। সারের বাড়িতে যে ফোন আসবে তা চেক করার ব্যবস্থাও করেছি। অবনীমোহন বললেন।

অর্জুন বলল, কিন্তু দুটো কুকুরের একটা যে গলার স্বর পেয়েছে সেটা তো সত্যি।

অবনীমোহন অন্যমনস্কভাবে নিজের চুলে হাত বোলালেন, ওটা নেহাতই দুর্ঘটনা। আমরা শুনেছি দীর্ঘদিন ধরে যে মানুষ বিছানা থেকে নিজে নামতে পারেননি তিনি কোনও আকস্মিক আঘাত পেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সেই একই আঘাত ওই ধরনের কোনও রুগিকে দিয়ে একফোঁটা কাজ হয়নি। তাই এগুলোকে দুর্ঘটনা বলাই ভাল।

এই সময় গঙ্গাপদ ছুটতে-ছুটতে এসে জানাল ফোন এসেছে এবং সেই সাহেবই কথা বলছে, যা সে একবর্ণও বুঝতে পারেনি। সঙ্গে-সঙ্গে ডক্টর পত্ৰনবীশ উঠে দাঁড়ালেন। অবনীমোহন বললেন, আপনি কথা বলুন। যতটা সম্ভব সময় নেবেন যাতে লোকটার টেলিফোন নাম্বার ভাল করে নোট করা যেতে পারে।

ডক্টর পত্ৰনবীশ ভেতরে যেতে বাকিরাও তাঁকে অনুসরণ করল।

রিসিভার তুলে ডক্টর পত্ৰনবীশ জিজ্ঞেস করলেন, কে বলছেন?

ওদিকের কথা শুনে ইংরেজিতে বললেন, ইয়েস, ডক্টর পত্ৰনবীশ স্পিকিং।, আমার টেলিফোন গোলমাল করছিল। না, এখনও কিছু ভাবিনি আমি। এইটুকু বলার পর ডক্টর অনেকটা সময় ধরে ওপাশের বক্তব্য শুনলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আপনি যে এতটা করতে চাইছেন এতে আপনার স্বার্থ কী? জবাব শুনে বললেন, কোনও প্রাইভেট ডোনেশনের চেয়ে সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভর করতে আমার ভাল লাগবে। আপনার টেলিফোন নাম্বার দিন, যদি মত পরিবর্তন করি তা হলে জানিয়ে দেব। কয়েক সেকেন্ড রিসিভার ধরে রেখে ধীরে-ধীরে সেটাকে নামিয়ে ফেললেন ডক্টর।

অবনীমোহন চটপট রিসিভার তুলে ডায়াল করলেন, কে বক্সী? শোনো, তুমি এখনই টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ফোন করো। ডক্টর পত্ৰনবীশের বাড়িতে এইমাত্র ঘোস্ট কল এসেছিল। আমি এখানেই আছি। কুইক। রিসিভার নামিয়ে অবনীমোহন বললেন, এখনই লোকটার নাম্বার পেয়ে যাব। ও নিশ্চয়ই আপনাকে নাম্বার দেয়নি!

মাথা নেড়ে না বললেন ডক্টর পত্ৰনবীশ। ওঁকে, খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল। অবনীমোহন জিজ্ঞেস করলেন, কী বলল লোকটা তু।

ডক্টর বললেন, একই কথা। আমার গবেষণার সমস্ত আর্থিক দায়িত্ব সে নিতে চায়। স্বার্থ কী জানতে চাইলে বলল, বিজ্ঞানের সেবা করতে চায়। বুঝুন! আমি নাম্বার চাইতে বলল, ও আবার টেলিফোন করবে। ডিস্টার্নিং, খুব বিরক্তিকর।

যদি কেউ ফালতু রসিকতা করে থাকে তা হলে তাকে উচিত শিক্ষা পেতে হবে। অবনীমোহন বেশ জোরের সঙ্গে বললেন। আর তখনই টেলিফোনটা শব্দ তুলল। অবনীমোহন খপ করে রিসিভার তুলে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যালো? ও বক্সী, পেয়েছ? হ্যাঁ, কী? মাই গড। ঠিক আছে। রাখছি। রিসিভার রেখে রুমালে মুখ মুছলেন অবনীমোহন।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?

অতি ধড়িবাজ লোক। একটা পাবলিক বুথ থেকে পয়সা ফেলে ফোন করেছে। এসটিডি আইএসডি বুথ হলেও ট্র্যাক করা যেত।

সন্ট লেকের কোনও টেলিফোন বুথ?

না। লিন্ডসে স্ট্রিটের। ওখানে কাউকে পাঠিয়ে আর কাজ হবে না।

লিন্ডসে স্ট্রিটের নাম শুনেছিল অর্জুন। কিন্তু এলাকাটা তার জানা নেই। সেটা জিজ্ঞেস করতে অবনীমোহন বুঝিয়ে দিলেন। সেটা শোনার পর অর্জুন বলল, যদি বিদেশি কেউ হয় তা হলে তার ওই পাড়াতেই থাকা উচিত। কিন্তু আপনার কি মনে হয় যার সঙ্গে কথা বলেছেন সেই লোকটা বিদেশি?

বিদেশি হতে পারে, তবে ইংরেজ নয়। আবার আমেরিকানও নয়।

অবনীমোহন আর এ-নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইলেন না। তাঁকে এখন অন্য একটি তদন্তে যেতে হবে। তিনি চলে যাওয়ার পর গঙ্গাপদ জানাল, রাতের খাবার দেওয়া হয়েছে। ঘড়িতে এখন মাত্র নটা। এত তাড়াতাড়ি জলপাইগুড়িতে খাওয়ার কথা চিন্তাও করে না অর্জুন। কিন্তু ডক্টর পত্ৰনবীশ তাঁর নিজস্ব রুটিন মেনে চলতেই পছন্দ করেন। অতএব অর্জুনকে তাঁর সঙ্গে বসতে হল। গঙ্গাপদ মন্দ রান্না করে না। খাওয়া শেষ করে ডক্টর চলে গেলেন তাঁর গবেষণাগারে! আজ আকাশ নিমেঘ।

নিজের ঘরে ফিরে জানলার পাশে চেয়ার টেনে অর্জুন সামনের দেবদারু গাছগুলো দেখছিল। অত ওপরে রাস্তার আলো না পৌঁছনোয় অন্ধকার জাঁকিয়ে রয়েছে গাছগুলোর মাথায়-মাথায়। নাঃ! আজকের দিনটা বৃথাই গেল। ব্যাপারটা এমন সাধারণ যে, কোনও সূত্র পাওয়া যাচ্ছে না এগিয়ে যাওয়ার। ওরাং ওটাংটার এ বাড়িতে ঢোকা, মন্মথ দত্তর উপস্থিতি যে তাকে উদ্ধার করার জন্যে তা প্রমাণ করা যাবে না। ভক্টর পত্ৰনবীশ যদি ঘরের দরজা না খুলতেন তা হলে ওরাং ওটাংটা পালাবার সুযোগই পেত না। সে ক্ষেত্রে মন্মথ দত্ত কী করে তাকে উদ্ধার করত? আর প্রাণীটি মন্মথ দত্তর হলে ঘর থেকে বেরিয়ে ও মন্মথর কাছেই আশ্রয় নিত। ঘটনাটা তো এমন হতে পারে ওরাং ওটাং এবং মন্মথ দত্তর আসা দুটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ঘটনা। হ্যাঁ, টেলিফোন যে করছে সে নিজেকে রহস্যের আড়ালে রেখেছে। কিন্তু রহস্য মানেই অপরাধ নয়। এক্ষেত্রে অবনীমোহন যা বলছেন সেটাই সত্যি মনে হচ্ছে। ডক্টর পত্ৰনবীশ খামোকা ভয় পেয়ে অমল সোমকে টেলিগ্রাম করেছিলেন।

এই সময় গঙ্গাপদ জানাল জলপাইগুড়ি থেকে টেলিফোন এসেছে। অর্জুন দ্রুত গিয়ে রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই অমল সোমের গলা পেল, কিছু কাজ হল

নাঃ। আমার মনে হচ্ছে এখানকার ওসি অবনীমোহনবাবুর কথাই ঠিক। ডক্টর পত্ৰনবীশের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। এক টেলিফোন ছাড়া। যে লোকটি নিজের পরিচয় না দিয়ে প্রথমবার ফোন করেছিল সে আমরা থাকতেই আবার ফোন করে। তবে ভয় দেখায়নি বা শাসায়নি। বিনীতভাবে আর্থিক সহায়তা দিতে চেয়েছে।

কেন?

এটুকুই রহস্য। এ ছাড়া আর কিছু নেই।

ঠিক আছে। আরও দুদিন থাকো। বাড়িতে বসে না থাকতে চাইলে আশেপাশের রাস্তায় হাঁটাহাটি করো। শুনেছি সল্ট লেক চমৎকার জায়গা।

অর্জুনের মনে পড়ল, আজ সন্ধের পর বেরিয়েছিলাম। একটা ঘটনা। বলতেই তার খেয়াল হল লোকটার কথা। বৃদ্ধ যাকে ফোটোগ্রাফার বলছিলেন!

কী ঘটনা? অমল সোম জানতে চাইছিলেন।

অর্জুন ঘটনাটা বলল। বলতে বলতে তার মনে হল ব্যাপারটা কীরকম হল? পাড়ার লোক জানে ভদ্রলোকের বাড়িতে পোষা প্রাণী নেই, অথচ তিনি দূর্বাঘাস নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর অসুস্থ প্রাণীকে খাওয়াবেন বলে?

অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন, ওঁর বাড়িটা দেখেছ?

না। আসলে দেখার কারণ তো ছিল না।

ভদ্রলোক বিদেশে থাকা বাড়ির মালিকের কেয়ারটেকার হয়ে আছেন। তাঁকে রেখে গেছেন যিনি, তিনি পাড়ায় কীরকম পরিচিত? কাল গিয়ে আলাপ করে এসো। আরে ফোটোগ্রাফির ওপর নতুন তথ্য হয়তো জানতে পারবে, তাই বা মন্দ কী? অমল সোম টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন।

সকালে ব্রেকফাস্ট করে হাঁটতে বের হল অর্জুন। ব্রেকফাস্ট টেবিল থেকে বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন ডক্টর। কাল সারারাত ভদ্রলোক কাজ করেছেন। বললেন, সাঙ্ঘাতিক একটা ভুল করতে চলেছিলাম হে! বড় বড় অঙ্ক সহজে করেও অনেকে ওয়ান প্লাস ওয়ান যেমন ওয়ান লেখে সেইরকম ব্যাপার। ভুলটা ধরা পড়ায় পুরো ব্যাপারটা নতুন করে করতে হবে। তুমি তো কলকাতা শহর ভাল করে দ্যাখোনি। আজ যাও পাতাল রেল চড়ে এসো। কলকাতার একমাত্র গর্বের বস্তু।

খানিকটা হাঁটতেই গাড়ির আওয়াজ পেতেই সরে দাঁড়াতেই গাড়িটা পাশে এসে দাঁড়াল। অবনীমোহন ড্রাইভারের পাশে বসে জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাচ্ছেন?

কোথাও নয়, এমনি?

উঠে পড়ন। মনে হচ্ছে একটা ইস্টারেস্টিং ঘটনা দেখাতে পারব। সুইমিং পুলের কাছে সেই ওরাং ওটাংটা আটকে পড়েছে। উঠুন।

অর্জুন জিপে উঠে জিজ্ঞেস করল, আটকে পড়েছে মানে?

একটা বড় গাছ একা দাঁড়িয়ে ছিল। পাবলিকের তাড়া খেয়ে ব্যাটা সেই গাছে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু গাছটাকে ঘিরে এত লোক জমে গিয়েছে, আর পালাতে পারছে না। আমরা জাল ছুড়ে ওকে ধরে ফেলব। অবনীমোহন বেশ জোরের সঙ্গে বললেন।

দূর থেকেই ভিড় দেখা যাচ্ছিল। শখানেক মানুষ গাছটাকে ঘিরে উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করছে। কেউ-কেউ ঢিল ছুড়ছে। গাড়ি থেকে নেমে অবনীমোহন চিৎকার করলেন, কেউ ঢিল ছুড়বেন না। বন্য প্রাণীকে আহত করাও অপরাধ। আপনারা গাছের একদিকে সরে যান। গাড়ির পেছন থেকে নেমে কয়েকজন সেপাই জনতাকে সরিয়ে দিচ্ছিল। অর্জুন চেষ্টা করছিল দেখতে কিন্তু ডালপাতার কোন আড়ালে প্রাণীটি নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে তা ধরা যাচ্ছে না। অবনীমোহনও তাকে দেখতে না পেয়ে কাছাকাছি একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, ওরাং ওটাংটা গাছে আছে তো?

দুমিনিট আগে দেখেছি সার। নীচে নেমে তাড়া খাওয়ামাত্র আবার ওপরে উঠে গেল! অবনীমোহন তাঁর লোককে নির্দেশ দিলেন, যেদিকে জনতা দাঁড়িয়ে আছে তার উলটো দিকে জাল পাততে। সেটা পাতা হলে গাড়ি থেকে দুটো ধোঁয়াবোম বের করে গাছের গোড়ায় নিয়ে গিয়ে তাতে আগুন দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে গলগল করে ধোঁয়া ওপরে উঠতে লাগল। অবনীমোহন চিৎকার করে সতর্ক করলেন তাঁর সঙ্গীদের, নাকে ধোঁয়া গেলেই ও লাফিয়ে নীচে নামবে। ও যাতে জালের ওপর পড়ে সেই চেষ্টা করতে হবে। বি অ্যালার্ট।

সবাই চুপ করে গেল। প্রত্যেকের নজর গাছের ওপর! কৌটো থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে ক্রমশ গাছটিকে গ্রাস করে নিচ্ছে। এই সময় একটি লরি বেশ দ্রুতগতিতে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল। সামনে লোক পড়ায় ড্রাইভার ব্রেক কষতে বাধ্য হল। লোকটি সরে যাওয়ামাত্র লরি যখন চলতে শুরু করেছে তখনই ওপর থেকে ওরাং ওটাংটা লাফিয়ে নেমে পড়ল লরির চার দেওয়ালের। মধ্যে। হইহই চিৎকারের দাপটে সম্ভবত ঘাবড়ে গিয়েই ট্রাক ড্রাইভার স্পিড বাড়াল। লোকজন পেছনে ধাওয়া করতে না করতেই সেটা উধাও। অবনীমোহন তাঁর গাড়ির দিকে ছুটলেন, ট্রাকটাকে ধরতে হবে। ওর মধ্যেই আছে প্রাণীটি। যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি চালু করে পুলিশের ড্রাইভার অনুসরণ শুরু করেই একটু থিতিয়ে গেল। রাস্তা সুনসান। কোথাও লরি বা ট্রাকের টিকিও দেখা যাচ্ছে না। সে দুর্বল গলায় জিজ্ঞেস করল, কোনদিকে যাব সার?

বাঁ দিকে, বাঁ দিকে বাঁক নিয়েছিল, আমি দেখেছি।

মিনিটপাঁচেক এগিয়েও যখন ওটাকে পাওয়া গেল না তখন অবনীমোহনের আফসোস শুরু হল, অ্যাঃ। হাতের মুঠোয় পেয়েও ধরতে পারলাম না। ঠিক সময়ে ট্রাকটা এসে গেল গাছটার ওপাশে। ব্যাড লাক।

ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে, হিন্দি ছবিকেও হার মানায়। হিন্দি ছবির হিরোর মতো কাণ্ড করল ওরাং ওটাংটা। অর্জুন হেসে ফেলল।

হাসছেন যে?

প্রাণীটি বেশ বুদ্ধিমান।

হুঁ। অদ্ভুত শব্দ ছিটকে এল অবনীবাবুর গলা থেকে।

ছুটন্ত গাড়িতে বসে বাঁ দিকে তাকাতেই আর-একটা রাস্তার পাশে যেন এক ঝলকে কিছু দেখতে পেল অর্জুন। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামাতে বলল সে। ড্রাইভার ব্রেক কষতে সে বলল, ব্যাক করে নিয়ে যান তো, ওই গলি পর্যন্ত।

অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?

এক ঝলক দেখেছি, আর একবার দেখি।

গাড়ি পিছিয়ে যেতে গলির মধ্যে লরিটাকে স্পষ্ট দেখা গেল। উত্তেজিত অবনীমোহন ড্রাইভারকে নির্দেশ দিতেই সে গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেল লক্ষ্যে। লরিতে কেউ নেই। ওরাং ওটাংটার থাকার কথা নয়, ড্রাইভার খালাসিও নেই। অথচ লরিতে বালি বোঝাই করা হয়েছে। আশেপাশের ছাড়া-ছাড়া বাড়িগুলোর দরজা-জানলা বন্ধ। কাছাকাছি বাড়িটির দরজার বেল টিপে অবনীমোহন আবিষ্কার করলেন সেখানে একজন বৃদ্ধ থাকেন। পুত্র এবং পুত্রবধূ চাকরি করতে বেরিয়ে গিয়েছে। বৃদ্ধা কিছুই দ্যাখেননি, কারণ তিনি শুয়ে ছিলেন।

অবনীমোহন ফিরে এসে বললেন, এখানে ট্রাটা পড়ে আছে কেন?

অর্জুন বলল, যে বালি সাপ্লাই দিতে যাচ্ছিল সে ইচ্ছে করে এখানে ফেলে রেখে যাবে না। যে রেখে গিয়েছে সে লরির চাবিও নিয়ে যায়নি।

তাই নাকি? স্ট্রেঞ্জ।

আপনি নিশ্চয়ই থানায় গেলে কমপ্লেন পাবেন কারও লরি ছিনতাই হয়েছে। আর যে ছিনতাই করেছে সে ওরাং ওটাংটাকে বাঁচাবার জন্যেই। করেছে।

তার মানে, আমাদের চোখের সামনে ওরাং ওটাংটাকে রেসকু করে হাওয়া। হয়ে গিয়েছে ওর মালিক? এ তো সিনেমার মতো ব্যাপার? অবনীমোহন যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তা ছাড়া এখান থেকে যাবে কোথায়? একটা লোক ওরাং ওটাং নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দেখলে সবাই তো কৌতূহলী হবে। ওই মোড়ে একটা সিগারেটের দোকান আছে, দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে দেখি ও কিছু বলতে পারে কি না।

কোনও লাভ হবে না। ওরাং ওটাং নিয়ে যখন এত টেনশন তখন কেউ ওর হাত ধরে রাস্তায় হাঁটবে না। এখানে গাছগুলো রাস্তার ধারে একেবারে গায়ে-গায়ে চলে গিয়েছে। লোকটা রাস্তা দিয়ে হেঁটেছে আর প্রাণীটি গাছ থেকে গাছে। অর্জুন নিশ্চিন্ত হয়ে বলল।

লরিটাকে থানায় নিয়ে আসা হল। এবং তখনই ওরা কিছু উত্তেজিত লোককে দেখতে পেল। অবনীমোহনকে দেখে তারা একসঙ্গে অভিযোগ করতে লাগল, লরি ছিনতাই হয়েছে। সুইমিং পুলের ওপাশে একটা নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। সেখানে লরিটা বালি নিয়ে এসেছিল।

নিজের চেয়ারে বসে অবনীমোহন বিস্তারিত শুনলেন। লরিওয়ালা স্পটে পৌঁছে লরি থেকে নেমে কন্ট্রাক্টরের লোকের সঙ্গে কথা বলছিল যখন, তখন একটা লোক দ্রুত লরিতে উঠে যায়। চাবি গাড়িতেই ঝুলছিল বলে স্টার্ট নিতে অসুবিধে হয়নি। ওরা হইহই করে তেড়ে যেতেই লোকটা লরি ছুটিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল। সেই লরি যে এত তাড়াতাড়ি ফেরত পাওয়া যাবে, তা ওরা কল্পনাও করেনি।

টেবিলের একপাশে চেয়ারে বসে অর্জুন চুপচাপ শুনছিল। প্রশ্ন যা করার অবনীমোহন করছিলেন। বালিসমেত লরি ফিরে পাওয়ায় লোকগুলোর আগের উত্তেজনা দ্রুত কমে যাচ্ছিল। এখন আর ডায়েরি করে ঝামেলা বাড়াতে তারা তেমন উৎসাহী নয়। কিন্তু অবনীমোহন তাদের কথা শুনলেন না। ডায়েরি লিখে লোকগুলোকে দিয়ে সই করালেন। কোনও লোক তাঁর এলাকায় অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে এ তিনি হতে দেবেন না। এবার অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, যে লোকটি লরি চালিয়ে নিয়ে উধাও হয়েছিল তাকে আপনারা দেখেছেন?

তিনজনই একসঙ্গে হ্যাঁ বলে উঠল। কী

রকম দেখতে লোকটা?

দুজন দুরকমের বর্ণনা করল। তৃতীয়জন মাঝামাঝি। সে বলল, ঠিক লম্বা নয়, আবার খুব বেঁটেও না। তবে যুবক বলে মনে হচ্ছে না।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, মনে করে দেখুন তো, লোকটাকে দেখে খুব দুর্বল বলে মনে হয়?

না সার। গায়ে যে জোর আছে তা দেখলেই বোঝা যায়।

চোখদুটো কি ছোট? তিনজনেই বলল তারা চোখ দেখার সুযোগ পায়নি। তবে এখন মনে হচ্ছে লোকটা যাকে বলে কমবয়সী তা নয়। বড়বাবুর বয়সী তো হবেই।

অবনীমোহনের কপালে ভাঁজ পড়ল, আমার বয়সী? তা হলে তো পঞ্চাশ হয়ে গিয়েছে? বলে হাসলেন তিনি, দুর। পঞ্চাশের ওপর বয়সী কোনও বাঙালি এমন করিমা হতে পারে না। এরা কী দেখতে কী দেখেছে! ঠিক আছে, যাও তোমরা।

ওরা চলে গেলে অর্জুন উঠে দাঁড়াল, আচ্ছা–!

আরে! এক কাপ চা খেয়ে যান। এই প্রথম আমার এখানে এলেন।

অর্জুন মাথা নাড়ল, আজ থাক।

একটা কথা। আপনি তো লোকটাকে দেখেননি। তা হলে চোখ ছোট কিনা জিজ্ঞেস করলেন কেন? এইটে আপনার মাথায় কেন এল?

কোনও কারণ নেই। একটা কিছু বৈশিষ্ট্য খুঁজতে চেয়েছিলাম, তাই!