বনবাসোদ্যত ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যপালনোপদেশ
বৈশম্পায়ন বলিলেন, ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এই কথা কহিলে, মহামতি ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর সহিত জীর্ণ গজপতির ন্যায় অতিকষ্টে মন্দগমনে আপনার আবাসাভিমুখে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। মহাত্মা বিদুর, সঞ্জয় ও কৃপাচার্য্য তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। অনন্তর অন্ধরাজ আপনার গৃহে প্রবিষ্ট হইয়া পূৰ্ব্বাহ্ণকৃত্যসমুদয় সমাপনপূৰ্ব্বক ব্রাহ্মণগণকে পরিতৃপ্ত করিয়া ভোজনক্রিয়া সম্পাদন করিলেন। তখন ধৰ্ম্মশীলা গান্ধারী ও কুন্তীও অন্যান্য বধূগণকর্ত্তৃক অর্চ্চিত হইয়া আহার করিতে লাগিলেন। উঁহাদিগের আহার সমাপন হইলে পাণ্ডবগণ ও বিদুরাদি মহাত্মারা আহার করিয়া ধৃতরাষ্ট্রের নিকট সমুপস্থিত হইলেন। তখন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরের পৃষ্ঠে হস্ত প্রদান করিয়া কহিলেন, “বৎস! তুমি এই অষ্টাঙ্গসংযুক্ত [স্বামী, অমাত্য, সুহৃৎ, কোব, রাষ্ট্র, দুর্গ, সৈন্য, পৌরবর্গ] রাজ্যে সৰ্ব্বদা সাবধানে অবস্থান করিবে। ধর্ম্মানুসারে যেরূপে রাজ্য রক্ষা করিতে হয়, এক্ষণে তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি সৰ্ব্বদা বিদ্যাবৃদ্ধদিগকে [জ্ঞানে প্রবীণগণকে] উপাসনা, তাঁহাদিগের বাক্যশ্রবণ ও সেই বাক্যানুসারে অবিচারিতচিত্তে কার্য্যানুষ্ঠান করিবে। প্রাতঃকালে গাত্রোত্থান করিয়া ঐ সমস্ত জ্ঞানবান লোকের সম্মাননা ও কার্য্যকাল সমুপস্থিত হইলে তাঁহাদিগকে কর্ত্তব্য জিজ্ঞাসা করা সর্ব্বতোভাবে বিধেয়। তাঁহারা সম্মানিত হইলে অবশ্যই তোমাকে হিতোপদেশ প্রদান করিবেন।
“তুমি অশ্বসমুদয়ের ন্যায় ইন্দ্রিয়গণকে সংযত করিয়া রাখিবে; তাহা হইলে উহারা যত্নপরিরক্ষিত ধনরাশির ন্যায় উত্তরকালে অবশ্যই হিতকর হইয়া উঠিবে। যে মন্ত্রিগণ ছলপরিশুন্য ও দমগুণসম্পন্ন এবং যাঁহারা পিতা ও পিতামহের সময় অবধি কাৰ্য্য সন্দর্শন করিতেছেন, তাঁহাদিগকেই সমুদয় কাৰ্য্যে নিয়োগ করা কর্ত্তব্য। স্বীয় অধিকারস্থ পরীক্ষিৎ চরদ্বারা শত্রুর অজ্ঞাতসারে সতত তাহার সমাচার জ্ঞাত হওয়া আবশ্যক। তুমি যে পুরমধ্যে বাস করিবে, তাহার প্রাচীর ও তোরণ সুদৃঢ় হওয়া এবং উহার মধ্যে ছয় প্রকোষ্ঠ, বিবিধ অট্টালিকা ও সুদৃঢ় দুর্গ থাকা উচিত। ঐ পুর সৰ্ব্বদা সাবধানে রক্ষা করা কর্ত্তব্য। উহার দ্বারসকল বৃহৎ, যথাস্থানে সন্নিবেশিত ও সুরক্ষিত হওয়া সর্ব্বতোভাবে উচিত।
“যেসকল ব্যক্তিদিগের কুলশীল বিশেষরূপে অবগত হইবে তাঁহাদিগের দ্বারাই কাৰ্য্যসাধন করাইবে। আহার-বিহার, মাল্যপরিধান, শয়ন ও আসনে উপবেশনসময়ে সাবধানে আত্মরক্ষা করিবে। সৎকুলসম্ভূত সুশীল বিশ্বস্ত বৃদ্ধ ব্যক্তিরা যেন তোমার অন্তঃপুরিকাগণকে সাবধানে রক্ষা করেন। কুল, শীল ও বিদ্যাসম্পন্ন, বিনীত, সরলস্বভাব, ধার্ম্মিক ব্রাহ্মণদিগকে মন্ত্রিপদে নিযুক্ত করিয়া তাঁহাদিগের সহিত মন্ত্রণা করিবে। এই সকল ব্যক্তি ভিন্ন অন্য কাহারও সহিত মন্ত্রণা করা বিধেয় নহে। মন্ত্রণাকালেও হয় সকলের সহিত, নচেৎ কোন কার্য্যব্যপদেশে অভিলষিত ব্যক্তিদিগকে নিভৃত স্থানে আনয়ন করিয়া তাহাদের সহিত মন্ত্রণা করিবে। মন্ত্রণাগৃহ নিভৃত হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। বন ও অনাবৃত স্থান মন্ত্রণার উপযুক্ত স্থান বটে, কিন্তু রাত্রিকালে ঐ দুই স্থানে মন্ত্রণা করা কদাপি বিধেয় নহে। বানর, পক্ষী, জড় ও পঙ্গু ব্যক্তিদিগকে মন্ত্রণাগৃহ হইতে বহিস্কৃত করা অবশ্য কর্ত্তব্য। মন্ত্রভেদ হইলে নরপতিদিগের যে দোষ উপস্থিত হয়, তাহার প্রতিবিধান করা নিতান্ত সুকঠিন। মন্ত্রভেদ হইলে যে যে দোষ এবং মন্ত্রভেদ না হইলে যে যে শুভফল হয়, তৎসমুদয় তুমি মন্ত্রিদিগের নিকট সতত কীৰ্ত্তন করিবে।
“পুরবাসী ও জনপদবাসিগণের দোষগুণ অবগত হইবার চেষ্টা করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। সন্তুষ্টচিত্ত ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদিগকে বিচারাসনে নিযুক্ত করিয়া যাহাতে তাঁহারা দোষানুরূপ দণ্ডবিধান করেন, তুমি তদ্বিষয়ে সতত যত্নবান থাকিবে এবং তাঁহারা দোষানুরূপ দণ্ড করিলেন কি না, চরদ্বারা তাহার তথ্যানুসন্ধান করিবে। যাহারা উৎকোচ[ঘুষ]জীবী, পরদারাপহারী, উগ্রদণ্ডকর্ত্তা [অত্যধিক দণ্ডদাতা], মিথ্যাবাদী, অন্যের অনিষ্টকারী, লুব্ধস্বভাব, পরধনাপহর্ত্তা, অসৎকর্ম্মানুষ্ঠাননিরত, সভাভঙ্গকারী ও বর্ণদূষক, দেশকাল বিবেচনা করিয়া তাহাদিগের কখন সুবর্ণদণ্ড, কখন বা প্রাণদণ্ডের আদেশ করা বিধেয়।
“প্রাতঃকালে গাত্রোত্থান করিয়া প্রথমতঃ ব্যায়ামকার্য্যে নিযুক্ত ব্যক্তিদিগের তত্ত্বাবধারণ এবং তৎপরে অলঙ্কারধারণ ও আশ্রিত ব্যক্তিদিগের যথাযোগ্য অর্থদানপূর্ব্বক সৈন্যদিগের তত্ত্বাবধান করা কর্ত্তব্য। সন্ধ্যাকালই দূত ও চরদিগের কাৰ্য্যসন্দর্শনের উপযুক্ত সময়। নিশাশেষে নিদ্রাপরিত্যাগপূর্ব্বক কর্ত্তব্য কার্য্য নির্ণয় এবং মধ্যরাত্রি ও মধ্যাহ্নসময়ে স্বয়ং বিচরণপূর্ব্বক প্রজাদিগের কার্য্য দর্শন করা বিধেয়। তুমি সকল সময়েই কাৰ্য্যের উপায়চিন্তায় প্রবৃত্ত হইবে, আবার উপযুক্ত সময়ে অলঙ্কৃত হইয়া সুস্থচিন্তে অবস্থান করিবে। কাৰ্য্যসমুদয় চক্রের ন্যায় পরিভ্রমণ করিয়া থাকে। তুমি ন্যায়ানুসারে সর্ব্বদা কোষপরিবর্দ্ধনে যত্নবান হইবে। কোষপরিবর্দ্ধনবিষয়ে ঔদাসীন্য বা অন্যায় ব্যবহারদ্বারা কোষবর্দ্ধন কদাপি কৰ্তব্য নহে। চরদ্বারা ছিদ্রান্বেষণতৎপর শত্রুগণের অভিপ্রায় অবগত হইয়া দুর হইতেই আত্মীয়পুরুষরা তাহাদিগের বিনাশসাধন করা কর্ত্তব্য। ভৃত্যপদাভিলাষী ব্যক্তিদিগের কাৰ্য্য সন্দর্শন করিয়া তাহাদিগকে অভিলষিত পদে নিযুক্ত করা কর্ত্তব্য। আশ্রিত ব্যক্তিগণ কোন কার্য্যে নিয়মিতরূপে নিযুক্ত হউক বা না হউক, তাহাদের দ্বারা কাৰ্য্যসাধন করা অবশ্য। কর্ত্তব্য।
“অধ্যবসায়সম্পন্ন, পরাক্রমশালী, কষ্টসহ [ক্লেশ সহ্য করিতে সমর্থ], হিতাভিলাষী ও প্রভুভক্ত ব্যক্তিকে সেনাপতিপদে নিযুক্ত করা উচিত। জনপদবাসী, শিল্পী প্রভৃতি লোসমুদয় গো, গর্দ্দভাদির ন্যায় কেবল আহারমাত্র গ্রহণ করিয়া, যাহাতে তোমার কাৰ্য্যসাধন করে, তুমি তদ্বিষয়ে নিয়ত যত্নবান্ হইবে। সৰ্ব্বদা কি আপনার, কি শত্রুর উভয়েরই রন্ধ্র অন্বেষণ করিবে। স্ব স্ব ব্যবসায়ে সুনিপুণ স্বদেশীয় ব্যক্তিদিগকে সময়ে সময়ে বিহারযাত্রাদির উপলক্ষে উৎসাহ প্রদান করা অবশ্য কর্ত্তব্য এবং গুণী ব্যক্তিদিগের গুণ যাহাতে পরিবর্দ্ধিত হয় ও যাহাতে তাঁহারা গুণ হইতে বিচলিত না হয়েন, তদ্বিষয়ে যত্নবান হওয়া সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়।”