প্রাক-বিভক্ত সাম্যসমাজের স্মারক
ঋগ্বেদ-সংহিতায় প্রাক্-বিভক্ত সাম্য-সমাজের স্মৃতি শুধু এইটুকুই নয় যে, এ-সাহিত্যের একটি প্রধানতম বৈশিষ্ট্য বলতে ব্যক্তিগত সম্পত্ত্বির চেতনার অভাব, বা এখানে পার্থিব সম্পদের কামনাটা প্রধানতই সাধারণের জন্য,—একার জন্য বা একের জন্য নয়; তাছাড়াও আরো নানান দিক থেকে ঋগ্বেদ-সংহিতায় প্রাচীন প্রাক-বিভক্ত সমাজের স্মৃতি খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে বৈদিক আর্যদের সমান বা সাম্য-জীবন সংক্রান্ত কয়েকটি চিত্তাকর্ষক তথ্য উদ্ধৃত করবো।
ইন্দ্রের আহ্বানকারীরা পরস্পরের সহিত মিলিত ও সমান-দক্ষ (ঋগ্বেদ : ৭.২৬.২) এবং মরুৎগণের স্তোতারাও সকলে সমান (ঋগ্বেদ : ৬.৬৬.১)। অগ্নিকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে :
বিশ্বাসাং ত্বা বিশাং পতিং হবামহে সর্বাসাং সমানং দম্পতিং ভূজে॥
অর্থাৎ,—সমস্ত প্রজাদিগের (= যজমানদিগের : সায়ন) পতি, তোমাকে (অগ্নিকে) আমরা আহ্বান করি, সকলের সমান পালক, যিনি গৃহের পতি, তাঁহাকে॥ ঋগ্বেদ : ১.১২৭.৮ ॥
সমানৈর্নৃভির্যদ্যুক্তো বিবে রপাংসি॥
অর্থাৎ,—সমান নরগণের সহিত মিলিত হইয়া (তুমি, হে অগ্নি) রাক্ষসদিগকে বিতাড়িত কর॥ ঋগ্বেদ : ১.৬৯.৮॥
ইন্দ্রকে আহ্বান করে বলা হচ্ছে, তুমি সকলের প্রতি সমান (১.১৩১,. ২); তুমি সেই সাধারণ ধনের ভাগ আমাদের দাও যাহাতে আমাদের শরীরের উপকার সাধন হয় (ঋগ্বেদ : ২.১৭.৭); তিনি গাভিসকলের পালক এবং সকলের প্রতি সমান (ঋগ্বেদ : ৪.৩০.২২)। বৈশ্বানর সকলের প্রতি সমান (ঋগ্বেদ : ৪.৫.৭); সূর্য আমাদিগকে অভিলষিত প্রদান করেন; তিনি সকলের প্রতি সমান (ঋগ্বেদ : ৭.৬৩.৩); ইন্দ্র শত্রুবিমর্দক, গোবিশিষ্ট, অন্নদাতা এবং সকলের প্রতি সমান (ঋগ্বেদ; ৮র৪৫.২৮); ইন্দ্র সমান ধনাচ্ছাদক ও বসুপ্রেরক (ঋগ্বেদ : ৮.৯৯.৮)। আরো উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, শুধুই যে দেবতারা সব মানুষের প্রতি সমান তাই নয় মানুষেরাও দেবতাদের সঙ্গে সমান হয়েছিলেন॥ অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে,
পুনঃ কৃণ্বানাঃ সখ্যা শিবানি মধ্বা মদেম সহ নূ সমানাঃ।
অর্থাৎ, —পুনরায় মঙ্গলময় সখ্য করিয়া, সোমদান করিয়া, আমরা তোমাদের সহিত সমান হইয়াছি॥ ঋগ্বেদ :৩.৫৮.৬॥
এমনকি দেবতাদের পরস্পরের মধ্যেও একটা সাম্য-সম্পর্কর ইংগিত পাওয়া যায়। ইন্দ্র ও অগ্নির সমান জনক, তাঁরা যমজ ভ্রাতার মতো (ঋগ্বেদ; ৬.৫৯.২); নাসত্যদ্বয় দেবগণের সঙ্গে সমান প্রীতিযুক্ত হয়ে আমাদের কাছে উপস্থিত হোন (ঋগ্বেদ : ৭.৭৩.২); অশ্বিদ্বয়ের সমান উৎপত্তিস্থান এবং সমান বন্ধু (ঋগ্বেদ : ৮.৭৩.১২); উষাসমূহ সমান বিখ্যাত (ঋগ্বেদ : ৪.৫১.৮) এবং পরস্পরের সঙ্গে সমান (ঋগ্বেদ : ৪.৫১.৯); মরুৎগণ শোভার্থ সমানরূপ আভরণ ব্যক্ত করেন (ঋগ্বেদ : ৭.৫৭.৩); মরুৎগণ তাঁদের সাধারণ বসতি থেকে নির্গত হন (ঋগ্বেদ : ৫.৮৭.৪)।
আমরা ইতিপূর্বে (পৃ. ২২৯) ব্রাত্য শব্দের অর্থ-প্রসঙ্গে আলোচনা করেছি, বৈদিক মানুষেরাও একসময়ে প্রাক্-বিভক্ত সাম্যসমাজে জীবন যাপন করতেন বলেই তাদের সাহিত্যের একটা পর্যায়ে ‘গণ’ ‘ব্রাত’ প্রভৃতি এই প্রাক্-বিভক্ত সমাজ ব্যঞ্জক শব্দগুলিরও বিশেষ সমাদর ছিলো। উত্তরকালে সে-সমাজ ভেঙে যায় এবং এই শব্দগুলিও নিন্দিত হয়। হয়তো সেই ভাঙন ধরবার মুখোমুখী সময়েই বৈদিক কবিরা অতীতের স্মৃতি উদ্বুদ্ধ করে ব্যাকুল কণ্ঠে সকলকে আহবান করেছিলেন :
সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সংযো মনাংসি জানতাম।
দেবা ভাগঃ যথাপূর্বে সংজানানা উপাসতে॥
অর্থাত,–তোমরা একত্র মিলিত হও, এককণ্ঠে ঘোষণা কর, একত্র মন বিনিময় কর; যেরূপ অতীতের দেবতাগণ সচেতনভাবে একত্র তাহাদের ভাগ গ্রহণ করিতেন॥ ঋগ্বেদ : ১০.১৯১.২॥
সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী
সমানং মনঃ সহচিত্তমেষাম্।
সমানং মন্ত্রমভি মন্ত্রয়ে বঃ
সমানেন বো হবিষা জুহোমি।
অর্থাৎ, —মন্ত্র সমান হউক, সমিতি সমান হউক, মন সমান হউক, বিচার একরূপ হউক। তোমাদের সহিত একই মন্ত্রে আমি মন্ত্রণা করি, তোমাদের সহিত একই হবি দ্বারা আমি হোম করি। ঋগ্বেদ : ১০.১৯১.৩ ॥
সমানী ব আকূতিঃ সমানা হৃদয়ানি বঃ।
সমানমন্ত বো মনো যথা বঃ সুসহাসতি ॥
অর্থাৎ, –তোমাদের প্রচেষ্টা সমান হউক, হৃদয়গুলি এক হউক, মন এক হউক, যাহাতে তোমাদের ঐক্য স্থাপিত হয়॥ ঋগ্বেদ : ১০.১৯১.৪॥
এই মন্ত্রগুলিই হলো ঋগ্বেদের সর্বশেষ মন্ত্র। ঋগ্বেদের শেষ বা দশম মণ্ডলটি অনেক পরের যুগের রচনা। ততোদিনে আদিম সাম্যসমাজ কী ভাবে ভেঙে গিয়েছে তার আলোচনায় আমরা একটু পরেই প্রত্যাবর্তন করবো। এই ভাঙনের মুখেই ঋগ্বেদের কবি সেই অতীত স্মৃতির কাছে আবেদন জাগাতে চাইছেন—“অতীতে দেবতাগণ সচেতনভাবে একত্র তাহাদের ভাগ গ্রহণ করিতেন।” কিন্তু এই ব্যবস্থাই যদি অতীত-ব্যবস্থা হয়ে থাকে, তাহলে ঋগ্বেদের ইংগিত থেকেই অনুমান করবার সুযোগ থাকে যে, কালক্রমে সেব্যবস্থায় ভাঙন ধরেছিলো : উদিন্ন্বস্য রিচ্যতেহংশো ধনং ন জিগ্যুষঃ-অর্থাৎ, জিতধনে (ইন্দ্রের) অংশ অপরের অংশ হইতে অধিক (ঋগ্বেদ : ৭.৩২.১২)।
অতীতে একত্রে ভাগ গ্রহণ করার তাৎপর্য কী? অংশ মানে কী? এ-জাতীয় প্রশ্নর উত্তর পেতে হলে প্রাচীন প্রাকৃবিভক্ত সমাজের বৈশিষ্ট্যর আলোচনা তুলতে হবে।