০৫. প্রচণ্ড শব্দ করে জিপটা

প্রচণ্ড শব্দ করে জিপটা নড়ে উঠে গড়াতে-গড়াতে থেমে গেল। হরিশ ড্রাইভার আফসোসের গলায় বলল, পাংচার হো গিয়া।

শ্রীকান্ত বক্সি জিজ্ঞেস করলেন, স্টেপনি ঠিক আছে তো?

ড্রাইভার মাথা নাড়ল, রিপেয়ারমে দিয়া থা, নেহি মিলা আজ।

শ্রীকান্ত বক্সি খিঁচিয়ে উঠলেন,এত দায়িত্বজ্ঞানহীন কেন তোমরা? স্টেপনি ছাড়া কেউ গাড়ি বের করে? তারপর অমলদার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখুন তো কাণ্ড। এই সময় আমি যদি কোনও ক্রিমিনালকে তাড়া করতাম, তা হলে কীরকম বোকা বনতাম?

অমলদার দেখাদেখি অর্জুনও জিপ থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিল। জায়গাটা শিলিগুড়ি থেকে বেশি দূরে নয় এবং একেবারে ফাঁকা মাঠের গায়ে তারা দাঁড়িয়ে নেই। কিছু একতলা ঘরবাড়ি এবং একটি বড় দোকান চোখে পড়ছে। ওই দোকানের পান্তুয়া এ-অঞ্চলে খুব বিখ্যাত। দোকানের সামনে একটি কালো অ্যাম্বাসাডার দাঁড়িয়ে আছে। অলদা সেদিকে তাকিয়ে বললেন, এখান থেকে তো আর বাসে চড়া যাবে না, আগেরটায় যা অবস্থা দেখলাম, আপনাকে দেখে কেউ যদি লিফট দেয় তা হলে মুশকিল আসান হতে পারে।

শ্রীকান্ত বক্সি রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। জলপাইগুড়ির দিক থেকে একটা মারুতি আসছে। দারোগাবাবু হাত দেখালেন। মারুতি থামল। তিনজন বসে আছেন ড্রাইভারকে বাদ দিয়ে। আরোহীরা জানতে চাইলেন গাড়ি থামাবার কারণ। দারোগাবাবু কারণটা জানালেন। স্পষ্টতই বোঝা গেল একজন মানুষের জায়গা ওই গাড়িতে হতে পারে। অমলদা দারোগাবাবুকে বললেন আগে চলে যেতে। শিলিগুড়ির থানায় কথা বলে তিনি যেন সোজা হোটেলে চলে যান। শ্রীকান্ত বক্সির তেমন ইচ্ছে ছিল না কিন্তু অমলদা দ্বিতীয়বার বলার পরে আর আপত্তি করলেন না। মারুতি বেরিয়ে গেলে অমলদা বললেন, এস, একটু পান্তুয়া খাওয়া যাক।

রাস্তায় আর কোনও গাড়ি দেখা যাচ্ছিল না। ওরা পাতৃয়ার দোকানে ঢুকে দেখল খদ্দের দুজন। লোক দুটো চা খাচ্ছে আর নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় কথা বলছে। কাঠের টেবিল-বেঞ্চির ফাঁক গলে অর্জুন বসতেই শুনল অমলদা চারটে করে পান্তুয়া দিতে বললেন। ইদানীং অমলদা চায়ে পর্যন্ত নামমাত্র চিনি খান। চারটে পান্তুয়া অর্জুনের পক্ষেই বেশি বেশি হয়ে যাবে। কিন্তু সে কিছু বলল না।

দুটো বড় প্লেটে পান্তয়া এলে জিভে জল এল অর্জনের। যেমন আকার তেমন লোভনীয় চেহারা। অমলদা প্রথমটা শেষ করে হঠাৎ দুহাত দূরে বসা লোক দুটোকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা তো শিলিগুড়িতে যাচ্ছেন, তাই না?

লোক দুটো কথা থামিয়ে এদিকে তাকাল। যার ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আছে সে জিজ্ঞেস করল কী করে বুঝলেন? লোকটার ঠোঁটে তখন সিগারেট চাপা রয়েছে।

গাড়িটা তো আপনাদের?

ফ্রেঞ্চকাট বাইরে দাঁড় করানো গাড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।

ওটা শিলিগুড়ির দিকে মুখ করে আছে, শিলিগুড়ি থেকে এলে উলটোমুখখা থাকত।

ফ্রেঞ্চকাট হাসল, বাঃ, আপনার নজর তো খুব। হ্যাঁ, শিলিগুড়িতেই যাচ্ছি। কিন্তু কেন?

অমলদা বললেন, এখান থেকে বাসে ওঠা যায় না, একটু লিফট চাইছি।

এবার দ্বিতীয় লোকটি জিজ্ঞেস করল, ওই পুলিশের জিপটাতে আপনারা ছিলেন না?

হ্যাঁ। লিফট নিচ্ছিলাম, খারাপ হয়ে গেল।

আপনারা পুলিশ?

না, না। বললাম না, লিফট নিচ্ছিলাম।

ফ্রেঞ্চকাট কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে দ্বিতীয় লোকটি বলল, ঠিক আছে, হিল ভিউ হোটেলের সামনে নামিয়ে দেব।

বাঃ, তাতেই হবে।

কথাবার্তা শুনতে শুনতে অর্জুনের পান্তুয়া খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। অমলদা দ্বিতীয়টিতে আর চামচ বসাননি। অর্জুনের প্লেট খালি দেখে ইশারা করলেন বাকি তিনটে সে খেতে পারে। অর্জুন মাথা নাড়ল, অসম্ভব। আমার পেট ভর্তি হয়ে গিয়েছে।

অমলদা উঠে দাঁড়ালেন। আটটা পান্তুয়ার দাম মিটিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। অর্জুনও চলে এল তাঁর সঙ্গে। লোক দুটোর যেন চা খাওয়া শেষ হচ্ছিল না।

হঠাৎ অমলদা জিজ্ঞেস করলেন, অর্জুন, তোমার কী মনে হয়, হরিপদবাবু হয়কে খুন করে খুনি এখন বলছ তা কোথ

কেন খুন হলেন?

যে লোকটা শাসিয়েছিল সে-ই খুন করেছে।

কিন্তু কেন?

ওই সম্পত্তির লোভে।

কিন্তু তুমি যাকে সম্পত্তি বলছ তা কোথায় আছে কেউ জানে না। হরিপদবাবুকে খুন করে খুনি এখনই লাভবান হচ্ছে না। তাই না?

হয়তো হরিপদবাবু কিছু জানতেন, যা জানলে খুনি কালাপাহাড়ের সম্পত্তি খুঁজে পেতে পারে। কিংবা ওঁরা দুজনেই একটা সূত্র জানতেন। খুনি হরিপদবাবুকে সরিয়ে দিয়ে নিজের খোঁজার পথ নিষ্কণ্টক করল।

তা হলে আমাদের কাছে সাহায্য চাইতে এসে হরিপদবাবু সূত্রটা বললেন না কেন? আমাদের ওপর তিনি আস্থা রাখতেই চেয়েছিলেন।

হয়তো প্রথম আলাপেই বলতে চাননি। এমন হতে পারে আজ এলে বলতেন।

উঁহু। এত হয়তের ওপর নির্ভর করা চলে না। তা হলে খোঁজার পথটা গোলকধাঁধা হয়ে যাবে। আরও স্পেসিফিক কিছু বলো।

অর্জুন ফাঁপরে পড়ল, এখনই কিছু মাথায় আসছে না। অমলদা গাড়িটার সামনে এগিয়ে গেলেন। গাড়ির ডিকির ওপর কাঁচা হাতে কেউ এস. আই. এল. লিখেছে। হয়তো কোথাও পার্ক করা ছিল, কোনও বাচ্চাছেলে আঙুলের ডগায় অক্ষর তিনটে লিখেছিল। এখন তার ওপর আরও ধুলো পড়ায় বেশ অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। অমলদা বললেন, গাড়িটা গতকাল শিলিগুড়িতে ছিল। আজ যদি জলপাইগুড়ি থেকে আসে তা হলে বুঝতে হবে ভোরেই শিলিগুড়ি থেকে বেরিয়েছিল।

অর্জুন বুঝতে পারছিল না অমলদা হঠাৎ এই গাড়ি নিয়ে এত চিন্তিত হয়ে উঠলেন কেন! তার মনে হল আজকাল অমলদা অকারণে সব ব্যাপার মাথায় নেন।

এই সময় লোক দুটো বেরিয়ে এল। চারপাশে তাকিয়ে দেখে দ্বিতীয়জন স্টিয়ারিং-এ বসল। পেছনের দরজা খুলে দিয়ে ফ্রেঞ্চকাট সামনের আসনে গিয়ে কাচ নামাতে লাগল। অমলদার পাশাপাশি পেছনের সিটে বসে অর্জুন দেখল দ্বিতীয় লোকটির বাঁ কান একটু ছোট। লতি প্রায় নেই বললেই চলে।

গাড়ি চলতে শুরু করা মাত্র দ্বিতীয় লোকটি জিজ্ঞেস করল আপনারা শিলিগুড়িতে কাজে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ। অমলদা স্বাভাবিক গলায় বললেন, ব্যবসার কাজে।

কিসের ব্যবসা?

বিনা মূলধনে যা করা যায়!

স্ট্রেঞ্জ! মূলধন ছাড়া ব্যবসা করছেন? উকিল-ডাক্তারদেরও তো এক সময় কয়েক বছর খরচা করতে হয় ডিগ্রি পেতে। জলপাইগুড়িতেই থাকেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ। কয়েক পুরুষ।

এবার ফ্রেঞ্চকাট বলল, কলকাতায় বাস করে জানতামই না যে, জলপাইগুড়ির ঐতিহাসিক গুরুত্ব এত বেশি। আমার তো বেশ ভাল লাগছে। কথাগুলো বলেই সিগারেট ধরাল।

দ্বিতীয় লোকটি হাসল, শিলিগুড়ির নেই ভাবছেন? এই যে শিলিগুড়ি, এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব কম? শিলিগুড়ি নামটা কী করে হল? লেপচাদের সঙ্গে ব্রিটিশদের লড়াই। সেই ভয়ঙ্কর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে হটিয়ে দিয়ে লেপচারা পাহাড় থেকে নেমে সমতলে শিবির গেড়েছিল। পরাজিত হয়েও ব্রিটিশরা আবার সৈন্য জোগাড় করে যখন ফিরে আসছে তখন একজন লেপচা সেনাপতি চিৎকার করে আদেশ দিলেন, শ্যালিি। শ্যালিগ্রি লেপচা শব্দ। মানে ধনুকে ছিলা পরাও। এই শ্যালিগ্রি থেকে শ্যালগিরি এবং শেষ পর্যন্ত শিলিগুড়ি।

অর্জুনের মজা লাগছিল। জলপাইগুড়ি এবং শিলিগুড়ির লোকেরা পরস্পরকে সব সময় একটু নীচে রাখতে ভালবাসে। এব্যাপারে বেশ রেষারেষি আছে অনেকদিন ধরেই। জলপাইগুড়ির লোকের চেষ্টায় শিলিগুড়ির মুখে বিশাল রেল স্টেশন তৈরি হলেও তাই নাম রাখতে হলে নিউ জলপাইগুড়ি। এই দ্বিতীয় লোকটি নিশ্চয়ই শিলিগুড়ির অনেকদিনের বাসিন্দা। ফ্রেঞ্চকাট তো নিজেকে কলকাতার লোক বললই। কয়েক মিনিটেই রাস্তাটা শেষ হয়ে গেল। হিল ভিউ হোটেলের সামনে গাড়িটা থামলে অমলদা নেমে পড়ে অনেক ধন্যবাদ দিলেন ড্রাইভার ভদ্রলোককে। তিনি মাথা নেড়ে চলে গেলেন।

একটা রিকশা নেওয়া হলো। শিলিগুড়িকে রিকশার শহর বললে ভুল বলা হবে না। প্রায় গাযে-গায়ে অতি দ্রুত গতি নিয়ে রিকশাগুলো যেভাবে ছুটোছুটি করে তাতে হৃৎপিণ্ড ধড়াস ধড়াস করে। মহানন্দার ব্রিজ পেরিয়ে অমলদার পাশে বসে অর্জন হোটেলের দিকে চলেছিল। অমলদা বসে আছেন গম্ভীর মুখে। বাঁ দিকে নতুন তৈরি বাস টার্মিনাস। এখন ফাঁকাই বলা যায়। আর-একটু গেলেই সিনক্লেয়ার হোটেল, তারপরেই দার্জিলিং যাওয়ার রাস্তা, অর্জুনদের অত দূরে যেতে হলো না। ডান দিকের একটা সাধারণ হোটেলের সামনে অমলদা রিকশা থামালেন। হোটেলটির দরজায় দুটো সেপাই দাঁড়িয়ে আছে লাঠি হাতে। ভাড়া মিটিয়ে রিকশা ছেড়ে দিয়ে অমলদা এগিয়ে যেতেই অর্জুন অনুসরণ করল।

হোটেলে ঢোকার মুখে সেপাইরা বাধা দিল। একজন বলল, হোটেল বন্ধ আছে।

আমরা জলপাইগুড়ি থেকে আসছি। শিলিগুড়ির ও. সি. সাহেব আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন।

তা হলে থানায় যান। আমাদের ওপর অডার আছে কাউকে ঢুকতে না দেওয়ার।

ম্যানেজারবাবু আছেন?

না। ওঁকে থানায় ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

অমলদা অর্জুনের দিকে তাকালেন, এখানেও একই সমস্যা। বিশল্যকরণীর জন্য গোটা গন্ধমাদন পর্বত তোলা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। শ্রীকান্ত বক্সি এসে পড়েছেন।

অর্জুন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল শ্রীকান্ত বক্সি একটা পুলিশের জিপ থেকে নামছেন। তাঁর সঙ্গে আর একজন অফিসার নেমে এলেন। লোকটি রোগাটে, চোয়াল বসা, মাথার চুল অল্প, পঞ্চাশের ওপর বয়স। ইনিই সম্ভবত শিলিগুড়ির ও. সি.। এমন চেহারার মানুষ খুব সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হন।

আপনারা কীসে এলেন? শ্রীকান্ত বক্সি জিজ্ঞেস করলেন।

দুই ভদ্রলোক অনুগ্রহ করে পৌঁছে দিলেন। অমলদা সহাস্যে জবাব দিলেন!

আপনিই বোধহয় এখানকার ও. সি.? আমার নাম অমল সোম, এই ছেলেটির নাম অর্জুন।

শ্রীকান্তবাবু বললেন, আপনি আমাদের তলব করেছেন। নিশ্চয়ই কথা বলব, কিন্তু তার আগে আমরা কি সেই ঘরটিতে যেতে পারি যেখানে হরিপদবাবু খুন হয়েছেন?

শিলিগুড়ি দারোগা বললেন, কেন যেতে চাইছেন ওখানে?

হরিপদবাবু আমার ক্লায়েন্ট ছিলেন।

হুম। শ্রীকান্ত, তুমি কী বলো? শিলিগুড়ির ও. সি. এবার মুখ ফেরালেন।

শ্রীকান্ত বক্সি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, মিস্টার সোম সাহায্য করলে এই কেস দুদিনেই সলভড হয়ে যাবে রায়দা। তা ছাড়া উনি যা বলছেন তা করাটাই যুক্তিসঙ্গত হবে।

যুক্তিসঙ্গত মানে? উনি গোয়েন্দা হতে পারেন কিন্তু এই কেসে উনি একজন..মানে, ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ! চলুন ওপরে। তবে আমিও সঙ্গে থাকব। শিলিগুড়ির ও. সি., যাঁর পদবি রায়, হাত নেড়ে সেপাইদের সরে যেতে বললেন।