আমরা তিনজন কোনওরকমে নামবার পর প্লেনটার সেই অবস্থাই হল। ঝড় তো দারুণ বেগে বইছে-ই, তার মধ্যে প্রচণ্ড একটা ঝাপটা এসে পাইলট সমেত প্লেনটাকে যেন কাগজকুচির মতো ঝেটিয়ে চোখের আড়াল করে দিলে।
নিজেরা তখন চোখমুখ চাদরে বেশ করে বেঁধে বালির ওপরই শুয়ে পড়েছি। ঝড়ে যাতে উড়িয়ে নিয়ে না যায় তাই পরস্পরের হাত ধরে আছি প্রাণপণে।
আশা এমনিতেই কিছু নেই। তবু তিনজনে একসঙ্গে থাকলে একটু যুঝতে অন্তত পারব। ভরসাও কিছু পাব পরস্পরের কাছে থাকার দরুন।
কিন্তু সে ভরসা পেয়ে শেষ পর্যন্ত কিছু লাভ হবে কি?
পাকিস্তানের মধ্যে পড়ে থাকি বা না থাকি, থর মরুভূমির মধ্যে যে আমাদের প্লেন নেমেছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ তখন নেই। আয়তনে না হোক ভীষণতায় এ মরুভূমিটি সাহারার চেয়ে কম যান না। তিনটে অসহায় নিঃসম্বল আর এ জগতের পক্ষে একান্ত আনাড়ি মানুষ শুধু হাত ধরাধরি করেই এ মরুভূমি থেকে কি উদ্ধার পেতে পারে? আমাদের প্লেনটার তো কোনও পাত্তা নেই। চেষ্টা করলেও আমাদের মতো তিনটে প্রাণীকে এই ধু ধু শূন্যতায় খুঁজে বার করা পাইলটের পক্ষে অসম্ভব। সুতরাং যা কিছু নিজেদের চেষ্টাতেই করতে হবে। কিন্তু, উদ্ধার পেতে কোথায় কোন দিক যাব!
ঝড়ের দাপট ক্রমশ কমে এল। তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। মরুভূমির শান্ত পরিষ্কার আবহাওয়ার রাত নয় যে, আর কিছু না হোক, আকাশের ঝকঝকে তারা দেখেই কিছুটা দিক-নির্ণয় করা যাবে।
চারিদিকে মরুঝড়ের রেশ রেখে যাওয়া ঘোলাটে একটা বিশ্রী অন্ধকার। বালির ওপর থেকে উঠে বসে নিজেদেরই ভাল করে তখন দেখতে পাচ্ছি না।
তিনজনের মনেই তখন এক প্রশ্ন।
কিন্তু মুখ ফুটে কেউ আর কিছু বলছে না। বলে লাভও কিছু নেই। মনে মনে সবাই তখন জানি যে নেহাত অঘটন কিছু না ঘটলে আমাদের উদ্ধার পাবার কোনও আশাই নেই। প্লেন থেকে কোনওরকমে নামবার সময় নিজেদের জামা কাপড়-জুতো আর বালির ঝাপটা সামলাবার জন্য দুটো চাদর ছাড়া আর কিছু নিয়ে নামিনি। অন্য কিছু দূরে থাক, সকাল পর্যন্ত তেষ্টা মেটাব এমন একটা ফোঁটা জলও নেই।
সব কিন্তু এক হিসেবে আমারই দোষ। আমি শুধু এই আমেদাবাদ নিয়ে যাওয়ারই চক্রী নই, পাইলটের বারণ সত্ত্বেও ঝড়ের ভয় হেসে উড়িয়ে আজকের দিনে প্লেন ছাড়বার দুর্বুদ্ধিও আমার।
এইসব কিছুর জন্যে আমাকেই দায়ি করে সুরঞ্জন যদি আশ মিটিয়ে আমায় একহাত নিত, তা হলে সত্যিই আমার কিছু বলবার থাকত না।
কিন্তু এই বিপদের মধ্যেও মুগ্ধ হলাম সুরঞ্জন চরিত্রের মহত্ত্ব দেখে। আমার বিরুদ্ধে তো নয়ই, ভাগ্যের নাম করেও সুরঞ্জনকে একবার একটুও হা-হুতাশ করতে শুনলাম না।
আর বটুকেশ্বর! বটুকেশ্বর যে কী জাতের মানুষ তা বোঝবার অবসর তখনও মেলেনি। সে রাত্রে তার অসীম স্থৈর্য ধৈর্য দেখেই আমি অবাক। সুরঞ্জনের পাশে আছে এই যেন তার যথেষ্ট। মরুভূমি না জলাবাদা, তাতে যেন তার কিছু আসে যায় না।
মনের মধ্যে তখন একমাত্র আশা প্লেনটাকে জড়িয়ে।
পাইলটের পক্ষে প্লেন নিয়ে আমাদের খুঁজে বার করা প্রায় অসম্ভব হলেও কাছাকাছি কোথাও এলে প্লেনটা আমাদের চোখে তো পড়তে পারে।
অনেকগুলো যদি অবশ্য তার মধ্যে আছে।
প্লেনটা যদি চলবার মতো অবস্থায় থাকে, আমাদের কাছাকাছি যদি তা কোথাও থাকে, আর পাইলট নিজে যদি জখম না হয়ে থাকে।
এতগুলো যদি একসঙ্গে মিলে যাওয়া অলৌকিক অঘটন ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।
অলৌকিক অঘটনই শেষ পর্যন্ত একটা ঘটল। কিন্তু ঘটল যেভাবে তা কিন্তু আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
মরুভূমির যা দস্তুর, দিনের ফোসকা-পড়া গরমের পর রাতের সেই কনকনে ঠাণ্ডা তখন পড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে বালির ঝড়টার পর ঠাণ্ডাটা নামছে আর একটু তাড়াতাড়ি।
ঠাণ্ডায় তিনজনেই যখন ভেতরে ভেতরে একটু কাঁপতে শুরু করেছি, এমন সময় বটুকের গলা শুনে রীতিমত চমকে উঠলাম।
বটুকের গলার আওয়াজে চমকাবার মতো কিছু অবশ্য নেই।
ঠাণ্ডায় কাঁপুনি তার মধ্যে একটু আছে, কিন্তু বলার ধরনটা একেবারে যেন, চা হয়ে গেছে কি অমুকবাবু এসেছেন খবর দেওয়ার মতো। তার মধ্যে আবেগ উত্তেজনার বাষ্পও এক ছিটেফোঁটা নেই।
চমকে উঠতে হল তার খবরটায়। নেহাত ঠাণ্ডা গলায় সে যা বলেছে তার তাৎপর্য যে দারুণ! কথাটা হল, একটা আলো দেখা যাচ্ছে।
আলো! আলো দেখা যাচ্ছে? কোথায় আলো!
উত্তেজনায় এক মুহূর্তে উঠে দাঁড়ালাম। সুরঞ্জনও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ধীরে সুস্থে বটুকই উঠল সবশেষে।
ব্যাকুল হয়ে চারদিকে তখন তাকাচ্ছি।
কিন্তু কোথায় আলো?
বটুকেশ্বরের পুরোপুরি পরিচয় তো তখনও পাইনি। বিপদে পড়ে মাথায় গোলমাল হয়ে চোখে ধাঁধা দেখছে বলে সন্দেহ হল। ধমক দিলামও সেইজন্য, কী আলো-আলো বলছ! স্বপ্ন দেখছ নাকি!
না, না, সুরঞ্জনই প্রতিবাদ জানাল, বটুক যদি দেখে থাকে তা হলে ভুল দেখেনি। ওর একেবারে ঈগলপাখির চোখ। কই, কোথায় আলো বটুক?
ওই যে দেখা যাচ্ছে।
বটুক হাত বাড়িয়ে যে দিকটায় আঙুল দেখালে সেখানে আবছা ঘোলাটে অন্ধকার ছাড়া কিছুই তো দেখতে পেলাম না।
সুরঞ্জনের অবস্থাও বুঝলাম তাই। চোখের ওপর হাত রেখে যথাসাধ্য ঠাহর করবার বৃথা চেষ্টা করে সে জিজ্ঞাসা করল, আলোটা এখনও জ্বলছে, না নিভে গেছে?
না, নিভে তো যায়নি। বটুকের সেই উচ্ছাসহীন নিরুত্তাপ গলা—একটা ঢিবি মতনের ভেতর থেকে জ্বলছে!
একে অদৃশ্য আলো, তার ওপর আবার ঢিবি! প্লেনটা হলেও তবু কথা ছিল। ঢিবি এখানে কোথা থেকে আসবে!
আজগুবি খবরের জন্য এবার বেশ রেগেই তাই ধমকে দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই দেখি সুরঞ্জন বটুককে নিয়ে এগিয়ে চলেছে।
এদের দুজনের মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি একসঙ্গে? বটুক অন্ধকারে খোয়াব দেখে বলেছে ঢিবির আলো, আর সুরঞ্জন তার কথাতেই অন্ধের মতো ছুটছে!
আবার ডেকে তাদের থামাবার চেষ্টা করলাম। সে ডাক তাদের কানেই গেল না বোধ হয়।
বাধ্য হয়ে তাই তাদের পেছনেই যেতে হল। এই অজানা ধু-ধু মরুতে রাতের অন্ধকারে ছাড়াছাড়ি হতে তো কিছুতেই দেওয়া যায় না। খেপেই যাক আর যাই হোক, তাদের সঙ্গেই থাকতে হবে।
সঙ্গে থাকলেও অবস্থা শেষ পর্যন্ত যা হবে তা তখন বুঝতে আর বাকি নেই। ওই মরুর মধ্যেই ক-জনের হাড়গুলো যে বছরের পর বছর শুকোবে, কল্পনায় তা তখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
ওই ধু-ধু অজানা বালির মরুতে সুরঞ্জন আর বটুকের মতো দুজনকে আমার সঙ্গে একত্র করার মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডের নিয়তিরই যে অমন একটা অভিপ্রায় আছে তা কি তখন ভাবতে পেরেছি।
মরুভূমির মধ্যে আমাদের হারিয়ে যাওয়া যে ভবিষ্যতের একটা আভাস, তাই বা তখন কেমন করে বুঝব!
কত বড় অঘটন যে ঘটতে যাচ্ছে আগের মুহূর্ত পর্যন্ত কল্পনা করতে পারিনি।
বটুক আর সুরঞ্জনের পেছনে কিছু দূর পর্যন্ত যাওয়ার পর সত্যি সত্যিই এবার ফাঁক থেকে ক্ষীণ আলোর রেখা দেখে তখন শুধু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি।
ওই ঢিবির কাছে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে অঘটন যা ঘটবার তা অবশ্য ঘটে গেছে।
আমরাই শুধু বুঝতে পারিনি।
বুঝতে পারিনি যে আর মাত্র ঘণ্টা দুয়েক বাদে এমন এক অভিজ্ঞতার ভাগীদার হতে যাচ্ছি, পৃথিবীর মানুষের যা কল্পনার বাইরে।