[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০৫. প্যারিস থেকে লন্ডনে

প্যারিস থেকে লন্ডনে বিমানে উড়ে আসতে সময় লাগে একঘন্টা। দুই দেশের মধ্যে সময়ের ব্যবধানও একঘন্টা। অর্থাৎ বিকেল পাঁচটার প্লেনে প্যারিস থেকে যাত্রা করলে আবার বিকেল পাঁচটাতেই লন্ডনে পৌঁছোনো যায়। মাঝখানকার একটা ঘন্টা যে আমার আয়ু খরচ হয়ে গেল সেটা কী করে মেলাব কে জানে! কিংবা এই এক ঘন্টা আয়ু অন্য কোন সময়ে আবার ফেরত দিতে হবে।

হিথরো বিমানবন্দর সম্পর্কে আমাদের পূর্ব সংস্কার মোটেই ভালো নয়। অনেক রকম গল্প শুনেছি, খবরের কাগজেও অনেক রকম অপ্রীতিকর ঘটনার কথা পড়া আছে। ভারতীয়দের সেখানে নানারকম হয়রানি করা হয়, একবার আমাদের এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে পর্যন্ত ঢুকতে দেওয়া হয়নি, ভারতীয় মেয়েদের নাকি বিবস্ত্র করে কুমারীত্বের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে, ইত্যাদি।

অনেকেই বিলেত যাওয়ার আগে এনট্রি পারমিট সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। আমার সেসব কিছুই নেই। হুডুড়-ধাডুস করে বেরিয়ে পড়া, ওসব জোগাড় করার সময়ই পাইনি। হিথরো এয়ারপোর্টে নেমে আমার একটু-একটু অস্বস্তি বোধ হল। ঢুকতে দেবে তো?

অনেকদিন আগে, প্রায় বাল্যকালে আমি যখন লন্ডনে এসেছিলুম, সেবার আমার ছবি হাতে নিয়ে এক মেমসাহেব এই এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিল আমার জন্য। আমাকে সে চেনে না, আমিও তাকে চিনি না, সেইজন্য আমার ছবি সে উঁচু করে তুলে ধরেছিল। এবার সেরকম কোনও ব্যাপার নেই, তা ছাড়া অবস্থাও অনেক বদলে গেছে। এখন যা সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে, তাতে আমার মনে হয়, কমনওয়েলথ ব্যাপারটা ন্যাকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্য যে-কোনও দেশের মতন ব্রিটেনের সঙ্গেও ভারতের সরাসরি ভিসা ব্যবস্থা রাখাই উচিত। ভারতের অন্য কমনওয়েলথ দোস্ত কানাডাও তো কয়েকদিন আগে ভারতীয়দের জন্য ভিসার সম্পর্ক করে দিল।

ইমিগ্রেশান কাউন্টারে শ্বেতাঙ্গদের জন্য একরকম ব্যবস্থা, আর আমার মতন কালো বা খয়েরিদের জন্য অন্যরকম। দাঁড়ালুম একটা লাইনে। আগের লোকদের নানারকম জেরা করা হচ্ছে। তখনই ঠিক করে রাখলুম, যদি বেশি উলটোপালটা কথা বলে, সাফ বলে দেব, যাব না তোমাদের দেশে, যাও! বিলেত যেতেই হবে এমন কোনো মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। ফেরার টিকিট পকেটেই আছে, পরের প্লেনেই ফিরে যাব।

আমার কাউন্টারে এক তরুণী মেম। ব্যবহারের হেরফেরের জন্য সুশ্রী মুখকেও যে কত অসুন্দর লাগে, তা বোঝা যায় এই সময়। মেয়েটির বয়েস পঁচিশের বেশি না, চোখ-নাক-ঠোঁট সবই সুন্দর, কিন্তু মুখে একটুও হাসি নেই, আর কী কঠোর দৃষ্টি! আমার পাসপোর্টটা বেশ খানিকক্ষণ উলটোপালটা দেখল, তারপর নীরব নীরস গলায় বলল, তুমি লন্ডনে এসেছ কেন?

কেন? সেরকম তো কোনও গূঢ় জরুরি উদ্দেশ্য নেই। সাঁওতাল পরগনা কিংবা সুন্দরবনে যাই কেন? সেইরকমই আলগা উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছি। এসেছি আমার বাল্যবন্ধু ভাস্করের সঙ্গে আড্ডা দিতে আর পিকাসোর একটা আলাদা ধরনের ছবির প্রদর্শনী হচ্ছে সেটা দেখতে। কিন্তু এই কথা কি এই রূঢ়লোচনা যুবতীটি বিশ্বাস করবে? নাকি বলব, ওগো, আমি তোমাদের দেশে চাকরিও খুঁজতে আসিনি কিংবা বেশিদিনের জন্য তোমাদের এই ছোট্ট দ্বীপটির ভারবৃদ্ধিও করতে চাই না।

সে কথা না বলে আমি শুধু বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা আর ছবির প্রদর্শনীর কথাই জানালুম। মেয়েটি কয়েকপলক তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে। আমি ভাবলুম, এবার সে নিশ্চয়ই আমার কাছ থেকে সেই বন্ধুর ঠিকানা কিংবা তার কোনও চিঠিপত্র দেখতে চাইবে। কাঁধের ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে চিঠি খুঁজছি, মেয়েটি অকস্মাৎ তার চেয়ার ছেড়ে উঠে গেল।

তারপর সে আর আসে না, আসেই না। আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাসপোর্টটা তার টেবিলের ওপর রাখা। একটুবাদে পাশের কাউন্টার থেকে একজন উঠে এসে আমার পাসপোর্টটা নেড়েচেড়ে দেখে বলল, তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? তোমায় তো ছেড়ে দিয়েছে!

খানিকটা বিভ্রান্ত অবস্থার মধ্যে আমি দিব্যি বেরিয়ে গেলুম বাইরে, আর কেউ একটাও প্রশ্ন করল না।

হিথরো এয়ারপোর্টে যে আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে তা আমি বলতে পারি না। একটিমাত্র প্রশ্ন করে আমায় ছেড়ে দিয়েছে, কোনওরকম কাগজপত্রও দেখতে চায়নি। কিন্তু ওই মেয়েটি একবারও হাসল না, আর হঠাৎ উঠে চলে গেল কেন? ওই তাচ্ছিল্যটাই ভীষণভাবে গায়ে বেঁধে।

ভাস্কর বাইরেই দাঁড়িয়েছিল, উঠলুম ওর গাড়িতে। ও আবার শুধুমাত্র বাঁ-হাতের দুটো আঙুল স্টিয়ারিং-এ রেখে গাড়ি চালায়। রাস্তার লোকজনদের ও ধুলো জ্ঞান করে। অনেকদিন আগে ভাস্কর দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে বিলেতে এসেছিল। ইংরেজ মুচি দিয়ে জুতো পালিশ করাবে আর লন্ডনে নিজের নামে একটা রাস্তা করে দিয়ে তারপর দেশে ফিরবে। ওর দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি প্রায় সফল হয়ে এসেছে।

কয়েকদিন তো তুমুল আড্ডা ও ঘোরাঘুরি হল। কিন্তু আমার মাঝে-মাঝেই মনে পড়ে ইমিগ্রেশান কাউন্টারের সেই মেয়েটির কথা। কেন সে অমন অদ্ভুত ব্যবহার করল? তার চোখে আমি কি একটা মানুষ না? রাস্তায়-ঘাটে, দোকানে কিংবা যে-কোনও জায়গায় কোনও ইংরেজ নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আমার দ্বিধা হয়, যদি ওই রকম নীরব অভদ্রতা দেখায়।

মন ভালো করার জন্য গেলুম রাজকীয় শিল্প প্রদর্শনী ভবনে। টেমস নদীর ধারে লন্ডন ব্রিজের অদূরে নতুন তৈরি হয়েছে একই সঙ্গে নাট্যশালা, শিল্প প্রদর্শনী ভবন, চলচ্চিত্র ও কনসার্ট হল মিলিয়ে বিশাল এক সুরম্য হৰ্ম। সঙ্গে আছে রেস্তোরাঁ, অথবা ইচ্ছে করলে ছাদে বসে নদী ও নগরীর শোভা দেখতে-দেখতে নিজস্ব ওয়াইন ও স্যান্ডউইচের জলখাবার সেরে নেওয়া যায়।

এখানেই মহাসমারোহে চলছে পিকাসোর প্রদর্শনী, যার নাম পিকাসো’জ পিকাসো। অর্থাৎ পিকাসোর নিজের কাছে তাঁর নিজের আঁকা সারা জীবনের যে ছবির সঞ্চয় ছিল, তার উত্তরাধিকারীরা এই প্রথম তা বার করে দেখাচ্ছেন সর্বসাধারণকে। নিজের ছবির ব্যাপারে পিকাসো খুব আঁটিসুঁটি ছিলেন, অনেক ছবি ব্যাঙ্কের ভলটে রেখে দিতেন, তা সবাই জানে। এই প্রদর্শনীটি বিশাল তো বটেই, এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পিকাসোর প্রথম যৌবন থেকে তার পরবর্তী শিল্পী-জীবনের পরিবর্তনগুলো পরিষ্কার বোঝা যায়।

এই সব ছবি সম্পর্কে বিশদ করে কিছু বলা আমার সাজে না। সে ভার রয়েছে শিল্পবোদ্ধাদের ওপর। আমি সাধারণ মানুষ, ছবি দেখতে ভালো লাগে তাই দেখি। তবু একটা কথা না বলে পারি না। ছবিগুলো দেখতে-দেখতে অনেক সময় যেমন বিস্মিত হয়ে যাই; তেমনি মাঝে-মাঝে আবার মর্মাহতও হতে হয়। অনেক ছবিতেই পিকাসোর শক্তিমত্তার পরিচয় পেয়ে হতবাক হয়ে যাওয়ার মতন, মনে হয় এ-লোকটা মানুষ নয়, দৈত্য, রেখা-রং-আয়তনকে ব্যবহার করার এক অলৌকিক শক্তি ছিল এর দখলে। নইলে এত বিস্ময়কর আর এত বেশি ছবি একটা মানুষ আঁকতে পারে এক জীবনে? আবার অনেক ছবি দেখে একথাও মনে হয়, এসব কি ছবি, না ইয়ার্কি? পৃথিবীর যাবতীয় শিল্পবোদ্ধাদের বোকা বানাবার জন্য পিকাসো এসব নিজস্ব মজা করেছেন। এ কথাও বলতে ইচ্ছা করে, জীবনের অর্ধেক পর্যন্ত এই লোকটা প্রকৃত শিল্পী ছিল, বাকি জীবনটা ছিল উন্মাদ, আর স্রেফ প্রচারের জোরে বিশ্বের এক নম্বর শিল্পী হয়েছে।

একখানা বিকট মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আমি ভাস্করকে জিগ্যেস করলুম, কী বুঝছিস? এটাও শিল্প?

ভাস্কর বললে, ব্যাটাচ্ছেলে এখান থেকে ফর্ম ভাঙা শুরু করেছিল। এরপর থেকে ও মানুষকে ক্রমাগত ভেঙে তুবড়ে দিয়েছে।

আমি বললুম, কিন্তু যে ছবি দেখে ভয় হয় কিংবা মুখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে হয়, সেরকম ছবি আঁকার মানে কী?

–ছবির বুঝি মানে থাকে?

ক্রমশ ভাস্কর আর আমি দূরে দূরে সরে গেলুম। আমার গোড়ার দিককার ছবি দেখতেই ভালো লাগছিল। মনে হয় যেন নারীজাতি সম্পর্কে পিকাসোর সারাজীবনের কোনও শ্রদ্ধা ছিল না। প্রথমদিকে নগ্ন নারী শরীর নিয়ে তিনি অনেক কাণ্ড করেছেন। কিন্তু সেই সব নারীরা আমাদের কাছে কোনও ভাষাই প্রকাশ করে না। একজন ভাঙাচোরা চেহারার বৃদ্ধ বেহালাবাদকও পিকাসোর ছবিতে কত বাঙময়, সেই তুলনায় পিকাসোর নারীরা শুধুই যৌন অবয়ব।

একজোড়া ব্রিটিশ দম্পতি মনোযোগ দিয়ে একটি ছবি দেখছিল, আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াতে সরে গেল অন্যদিকে। তখন খেয়াল করলুম, আরও দু-একটা ছবি দেখার সময় আমি যেতেই এরা সরে গেছে। আমার ছায়া গায়ে লাগলে কি ওদের এঁটো হয়ে যাওয়ার ভয়? শিল্প প্রদর্শনীতে সাধারণত এমনভাবে আলোর ব্যবস্থা থাকে যাতে কারুর কোনও ছায়া না পড়ে। তবে কি আমার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের হাওয়া ওদের গায়ে লাগলে গা জ্বলে যায়?

কিংবা এমনও হতে পারে, এটা আমার মনের ভুল। নিছক কাকতালীয়। আমি পাশে দাঁড়িয়েছি। ওরা এমনিই অন্য ছবির কাছে চলে গেছে। ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখবার জন্য এবারে আমি ইচ্ছে করে আবার ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালুম। পুরুষটি তার সঙ্গিনীকে কী যেন বোঝাচ্ছিল, মাঝপথে কথা থামিয়ে ওরা সরে গেল তাড়াতাড়ি। এটাও কাকতালীয়? আমার আবার মনে পড়ে গেল, এয়ারপোর্টের কাউন্টারের সেই তরুণীটির মুখ।

বিলেতে সকলেরই দু-চারজন পরিচিত ইংরেজ থাকে। কোথাও কোনও কবির সঙ্গে দেখা হয়, কোনও বন্ধুর সাহেব-মেম, বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে আলাপ হয়। তারা কি কথা বলে না? হাসে না? তা কেন করবে না? হাতে হাত ঝাঁকায়, অনর্গল গল্প করে।

কিন্তু অন্য কোথাও অপরিচিত ইংরেজের সঙ্গে চোখাচোখি হলেই, আমি যেন টের পাই, তারা সঙ্গে-সঙ্গে মুখে একটা কঠিন আবরণ টেনে আনে। সারা শরীরে ফুটে ওঠে অপছন্দের ইঙ্গিত। ইংরেজ জাতি এমনিতেই থাকে খোলসের মধ্যে, চট করে কোনও অচেনার সঙ্গে ভাব করে না, কিন্তু আমাকে দেখামাত্র কেন কোনও ইংরেজের হাসি-হাসি মুখ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যাবে? কলকাতার রাস্তায় কোনও সাহেবকে দেখলে আমি তো মুখ গোমড়া করি না।

আর একদিন একটা রেস্তোরাঁয় খেতে গেছি, পাশের টেবিলে এক প্রৌঢ় দম্পতি। আমরা বসবার খানিকটা পরেই সেই দম্পতি তাদের খাবার অসমাপ্ত রেখে উঠে চলে গেল। যতক্ষণ তারা বসেছিল, ততক্ষণ তারা একটিবারের জন্যও আমাদের দিকে চায়নি। আমি চোরা চাহনিতে ওদের লক্ষ করছিলুম, ওরা পরস্পর একটাও কথা বলেনি পর্যন্ত।

আমি ভাস্করকে জিগ্যেস করলুম, ওরা হঠাৎ উঠে গেল কেন রে?

ভাস্কর বলল, নিশ্চয়ই বড় বাথরুম।

আমি বললুম, আমাদের পাশে বসে খাবে না, সেইজন্য উঠে গেল?

ভাস্কর আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমি একটা উদ্ভট কথা বলছি।

তাহলে কি এটাও আমার মনের ভুল? হয়তো ওরা এমনিই উঠে গেছে। আমরাও অনেক সময় পুরো খাবার খাই না। কিংবা ওদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া চলছিল। কিংবা ওরা স্বামী-স্ত্রী নয়, লোকটি এসেছে পরস্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে, দূরে, অন্য কোনো লোককে দেখে উঠে গেছে।

কিংবা, ভাস্কর চোদ্দো-পনেরো বছর ধরে আছে বলেই ওর এসব চোখে পড়ে না, আমি নতুন এসেছি বলেই টের পাচ্ছি। কিংবা এয়ারপোর্টের সেই মেয়েটি আমার মাথার মধ্যে এই চিন্তা ঢুকিয়ে দিয়েছে।

শুনেছি, একসময় আমাদের দেশের ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাসের কামরায় কোনও ভারতীয়কে দেখলে ইংরেজরা জোর করে নামিয়ে দিত। ইংরেজদের জন্য আলাদা পাড়া, আলাদা ক্লাব, আলাদা সুইমিংপুল ছিল, যেখানে ভারতীয়দের তারা ঢুকতে দিত না। ইংরেজদের সেই প্রতাপ অনেকদিন আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন খোদ লন্ডন শহরে বসে ভারতীয়রা ইংরেজ পুলিসদের ঠ্যাঙানি দেয়। আমাদের মতন কালো মানুষদের গায়ের জোরে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না বলেই কি ওরা এখন নিজেরাই দূরে-দূরে সরে যায়? নিজের দেশে বসেও!

জওহরলাল নেহরু যে স্কুলে পড়তেন, সেই হ্যারো স্কুলের কাছাকাছি আমার বন্ধুর বাড়ি। ছোট টিলার ওপর স্কুল, তার পাশের উপত্যকাটি বসতি এলাকা। বেশ শান্ত, নির্জন পাড়া। লন্ডনে দাঙ্গাহাঙ্গামা হলে আমরা কলকাতায় বসে উদ্বেগ বোধ করি আমাদের চেনাশুনা বন্ধুদের জন্য। কিন্তু সেরকম কোনও গোলমাল এই মিডলসেক্সে হয়নি। সেরকম পাড়া আছে লন্ডনে যেখানে সন্ধেবেলা রাস্তায় হাঁটলে মনে হতে পারে গুজরাট কিংবা পাঞ্জাবে চলে এসেছি। শুধু হিন্দি জানলেই সেখানকার দোকান-টোকানে কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। সিঙারা-কচুরির গন্ধ রাস্তায় ভুরভুর করে। একলা কোনো ইংরেজকে চিৎ দেখা যায় সেসব পাড়ায়।

কিন্তু আমরা যেখানে আছি সেটা পুরো সাহেবপাড়া। দু-একজন বাঙালির বাড়ি আছে এখানে।

সন্ধেবেলা জমিয়ে আড্ডা হচ্ছে, আরও কয়েকজন এসেছেন, কথায়-কথায় আমরা চলে যাচ্ছি প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে। একসময় অশোক বলল, ভাস্করদা, আপনার চেনা কেউ বাড়ি কিনবে? আমাদের পাশের বাড়িটা বিক্রি আছে, বেশ সস্তায় ছেড়ে দিচ্ছে .

ভাস্কর বলল, তোমাদের পাশের বাড়ি? কোনটা? সেই বুড়োর, জেমসন না কী যেন নাম…

–হ্যাঁ সেই বাড়িটা!

–মাত্র তো বছরদেড়েক আগে বাড়িটা বানাল…সুন্দর বাগান করেছে, আমি একদিন দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখছিলুম, বুড়োর সঙ্গে আলাপও হল,…হঠাৎ বাড়িটা বিক্রি করে দেবে কেন?

–তার পরের বাড়িটাতে একটা নিগ্রো ফ্যামিলি এসে উঠেছে।

–কবে?

–গত মাসে। ওরা সে বাড়িটা কিনেছে কি না বোঝা যাচ্ছে না, মোটকথা উঠেছে একটা নিগ্রো ফ্যামিলি (ওদেশে এখন নিগ্রো কথাটা উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ, বলতে হয় ব্ল্যাক)…

–সেইজন্য বুড়ো তার অত শখের বাড়ি বেচে দেবে?

–মিসেস জেমসনের একটু ইচ্ছে নেই, অত যত্ন করে বাগান করেছে, কিন্তু বুড়ো জিদ ধরেছে কোনও নিগ্রোর পাশে সে কিছুতেই থাকবে না। আমাদের সঙ্গে অবশ্য বুড়ো কোনওদিন খারাপ ব্যবহার করেনি…কিন্তু নিগ্রো শুনেই…

আমি মুচকি হাসলুম। বুড়ো জেমসন কোনওক্রমে খয়েরি ভারতীয়দের প্রতিবেশী হিসেবে সহ্য করেছিল, কিন্তু কুচকুচে কালো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান তার পক্ষে অসহ্য। খোদ লন্ডন শহরে বসেও পাশের বাড়ি থেকে একটা নিগ্রো পরিবারকে তাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই, সেইজন্য রাগ করে, সে নিজের বাড়ি ছেড়ে দূরে সরে যাচ্ছে।

এত সরতে-সরতে শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা কোথায় যাবে?