ন্যূনাধিক পাঁচ বৎসর অতীত হইয়াছে।
কুন্তল রাজপুরীর অন্তঃপুরে রাজকুমারী হৈমশ্রী নিজ শয়নকক্ষে ভূমির উপর অজিনাসনে বসিয়া আছেন। তাঁহার সম্মুখে কাষ্ঠাসনের উপর একটি উন্মুক্ত পুঁথি, রাজকুমারী তন্ময় হইয়া পুঁথি পড়িতেছেন।
পাঁচ বৎসরে হৈমশ্রীর দেহলাবণ্যের অতি অল্পই পরিবর্তন হইয়াছে। তাঁহার দেহে সূক্ষ্ম শুভ্র কার্পাসবস্ত্র, কেশ একটিমাত্র বেণীতে আবদ্ধ, ললাটে আয়তির চিহ্ন কেবল একটি কুমকুমের টিপ— অলঙ্কার নাই বলিলেও চলে। চুলের ঈষৎ রুক্ষতায়, চোখের কোলে ছায়ার নিবিড়তায়, দেহের অল্প কৃশতায় তাঁহার রূপ বাহুল্য বর্জন করিয়া নিষ্কলুষ হইয়া উঠিয়াছে— বর্ষার অন্তে স্বচ্ছসলিলা শরতের স্রোতস্বিনীর মত।
পুঁথি পড়িতে পড়িতে তাঁহার মনে প্রবল ভাবাবেশ উপস্থিত হইয়াছিল, তিনি কম্পিত কণ্ঠে কাব্যের শেষ পংক্তি আবৃত্তি করিলেন—
‘মাভূদ্ এবং ক্ষণমপি চতে বিদ্যুতা বিপ্রয়োগঃ ॥’
গবাক্ষপথে বাষ্পাচ্ছন্ন দৃষ্টি প্রেরণ করিয়া তিনি ধীরে ধীরে পুঁথি বন্ধ করিলেন। মলপট্টের উপর বড় বড় অক্ষরে লেখা রহিয়াছে—
মেঘদূতম্
শ্রীকালিদাস বিরচিতম্
পুঁথির উপর হাত রাখিয়া রাজকুমারী উন্মনা হইয়া রহিলেন। ক্রমে তাঁহার চক্ষু পুঁথির উপর ফিরিয়া আসিল। কালিদাসের নামের উপর ললাট স্পর্শ করিয়া তিনি প্রণাম করিলেন— ‘ধন্য কবি।’
নামের দিকে চাহিয়া চাহিয়া তাঁহার মুখের ভাব আবার উন্মনা হইল, তিনি অর্ধস্ফুট স্বরে বলিলেন— ‘কালিদাস! কে তিনি?—’ তাঁহার অধর কাঁপিয়া উঠিল, তিনি বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়িলেন— ‘না না…সে তো মূর্খ ছিল—’
অঞ্চলে চোখ মুছিয়া দ্বারের দিকে মুখ ফিরাইতেই চোখে পড়িল, দ্বারের চৌকাঠ ধরিয়া বিষাদ গম্ভীর মুখে রাজা দাঁড়াইয়া আছেন। তাড়াতাড়ি মুখে হাসি আনিবার চেষ্টা করিয়া হৈমশ্রী বলিয়া উঠিলেন— ‘পিতা!— আসুন আর্য।’
রাজা কক্ষে প্রবেশ করিলেন। হৈমশ্রী আসন ছাড়িয়া উঠিবার উপক্রম করিতেই রাজা হাত তুলিয়া তাঁহাকে নিবৃত্ত করিলেন— ‘বোসো বোসো বৎসে।’
রাজা আসিয়া দ্বিতীয় একটি আসনে বসিলেন, স্নিগ্ধস্বরে প্রশ্ন করিলেন— ‘কি পড়ছিলে?’
হৈমশ্রী ঈষৎ লজ্জিতভাবে পুঁথিটি নড়াচাড়া করিতে করিতে বলিলেন— ‘কিছু নয় পিতা— একটি নতুন কাব্য— মেঘদূত।’
রাজা প্রীতভাবে ঘাড় নাড়িলেন। সেকালে পিতাপুত্রীতে কাব্য আলোচনা, এমন কি আদিরস ঘটিত কাব্যের আলোচনা দূষণীয় বিবেচিত হইত না; আদিরসের প্রতি তাঁহাদের সম্ভ্রম ছিল।
কুন্তলরাজ বলিলেন— ‘মেঘদূত— বিরহী যক্ষ ও বিরহিণী যক্ষপত্নী! আমি পড়েছি— সুন্দর কাব্য।’
হৈমশ্রী পিতার দিকে উদ্দীপ্ত চক্ষু তুলিলেন। যে কাব্য পড়িয়া তাঁহার মন আষাঢ়ের মেঘের মতই দ্রবীভূত হইয়া গিয়াছে তাহার এইটুকু প্রশংসা তাঁহার মনঃপূত হইল না; তিনি বলিলেন— ‘সুন্দর কাব্য কী বলছেন পিতা— অপূর্ব। ভাষায় এর প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। আমি বারবার পড়েছি, তবু আবার পড়তে ইচ্ছে করে।’
কুন্তলরাজ কন্যার উৎসাহ দেখিয়া সানন্দে ঘাড় নাড়িলেন, বলিলেন— ‘সত্যই অপূর্ব। কাব্য জগতে এক অপূর্ব সৃষ্টি। — তুমি যে কাব্যশাস্ত্রের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছ এতে আমার মনে একটু শান্তি হচ্ছে।’
রাজা কন্যার মুখের পানে চাহিলেন; হৈমশ্রীর চোখের দীপ্তি নিভিয়া গেল, তিনি মুখ নত করিলেন। রাজা একটি নিশ্বাস মোচন করিয়া নিজ মনেই বলিতে লাগিলেন— ‘পাঁচ বছর হয়ে গেল…সেই রাত্রে চুপি চুপি তাকে রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেছিলাম, তারপর আর কিছুই জানি না। গোপনে গোপনে কত খোঁজ করিয়েছি—’
হৈমশ্রী মুখ তুলিলেন কিন্তু পিতার দিকে না চাহিয়া ধীরস্বরে বলিলেন— ‘প্রয়োজন কি পিতা! আমি তো বেশ আছি, ভালই আছি—’
রাজা বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়িলেন— ‘না বৎসে। ভালই যদি থাকবে তবে মাঝে মাঝে তোমার চোখে জল দেখি কেন। তুমি এখনো তাকে ভুলতে পারনি। এই তো এখনি—’
হৈমশ্রী ব্যাকুল হইয়া বলিলেন— ‘ও কিছু নয় পিতা। কাব্য পড়তে পড়তে—’
কুন্তলরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলিলেন— ‘মা, আমার কাছে লুকোবার চেষ্টা কোরো না, তুমি এখনো তাকে ভুলতে পারনি। আমিও পারিনি। — কি জানি কী ছিল তার সেই সরল সুকুমার মুখে! যদি কোথাও তাকে পাই, ফিরিয়ে নিয়ে আসি।’
হৈমশ্রী সহসা পুঁথির উপর মাথা রাখিয়া ফুঁপাইয়া উঠিলেন, রুদ্ধস্বরে বলিলেন— ‘না না পিতা, সে মূর্খ— নিরীক্ষর—’
রাজা বুঝিলেন কন্যার হৃদয়ে প্রেম ও অভিমানে কঠিন দ্বন্দ্ব চলিতেছে। তিনি শান্তস্বরে বলিলেন— ‘সে তোমার স্বামী।’
শিপ্রা নদীর মাঝখান দিয়া একটি মধ্যমাকৃতি মহাজনী নৌকা পালের ভরে তরতর করিয়া চলিয়াছে। পাশে শিপ্রার তীরে মালব রাজ্যের রাজধানী উজ্জয়িনী মহানগরী তাহার অসংখ্য ঘাট মন্দির সৌধ লইয়া দ্বিপ্রহরের প্রদীপ্ত আলোকে জ্বল্জ্বল্ করিয়া জ্বলিতেছে। নগরীর সীমান্তে শষ্প-হরিৎ প্রান্তর; মাঝে মাঝে দুই একটি কুটির, জলের কিনারায় সৈকতলীন হংসমিথুন—
নৌকার পিছনে বসিয়া মাঝি গান ধরিয়াছে। নৌকার ছাদে পালের ছায়ায় বসিয়া এক পুরুষ একটি তন্ত্রীযুক্ত স্বরযন্ত্র অলসভাবে বাজাইয়া মাঝির গানের সঙ্গে সুর মিলাইতেছেন। পরিধানে অতি সাধারণ শুভ্র বস্ত্র ও উত্তরীয়, ললাটে শ্বেত চন্দনের তিলক। পাঁচ বছরে তাঁহার বহিরাকৃতির কোনো পরিবর্তন হয় নাই, তেমনি সরল হাসিটি মুখে লাগিয়া আছে; কিন্তু তবু মনে হয় এ ব্যক্তি সে ব্যক্তি নয়, অন্তর্লোকে বিপুল পরিবর্তন ঘটিয়া গিয়াছে।
কালিদাস যে যন্ত্রটি বাজাইতেছেন তাহা বোধ করি নাবিকদের কাহারো স্বরচিত সম্পত্তি, একটি বক্রাকৃতি তুম্বের শূন্যগর্ভ খোলসের উপর তিনটি তার চড়ানো। কালিদাস তাহাই বাজাইতে বাজাইতে মাঝির গানের প্রাকৃত ভাষা লক্ষ্য করিতেছেন—
আমার মন-তরণী ভাসল দরিয়ায়—
মরি হয় মারি হায় রে!
দখিন বায়ে রূপ লহরে চলছে তরী পালের ভরে
কিনার ডাকে কলস্বরে আয় রে তরী আয়—
মরি হায় মারি হায় রে!
কোন্ ঘাটেতে পথিক-বধূ আছে রে পথ চেয়
সেই কিনারে বৈঠা তুলে ভিড়াস্ তরী, নেয়ে,
যেথা কমল চোখে সজল হাসি অঝোর ঝরি যায়—
মরি হায় মারি হয় রে!
গান শেষ হইলে কালিদাস যন্ত্র নামাইয়া রাখিয়া চক্ষু তুলিলেন, অমনি উজ্জয়িনীর রবি-করজ্জ্বল দৃশ্যটি তাঁহার দৃষ্টি টানিয়া লইল, তিনি বিস্ময়োৎফুল্ল নয়নে চাহিয়া রহিলেন। তারপর যেন আত্মগতভাবে বলিলেন— ‘কী চমৎকার নগরী! যেন আমার কল্পলোকের অলকাপুরী। — মাঝি ভাই, এ কোন্ রাজ্য?’
মাঝি একবার তীরের দিকে মুখ ফিরাইল, বলিল— ‘ঠাকুর, এটা অবন্তী রাজ্য। আমরা এখন উজ্জয়িনীর পাশ দিয়ে যাচ্ছি।’
কালিদাস তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে চাহিয়া রহিলেন— ‘অবন্তী! উজ্জয়িনী! এতদিন শুধু কল্পনাই করেছি। — এর পর কোন রাজ্য?’
মাঝি বলিল— ‘এর পর কুন্তল রাজ্য।’
কালিদাসের মুগ্ধ তন্দ্রা ছুটিয়া গেল, তিনি সজাগ হইয়া উঠিলেন— ‘কুন্তল রাজ্য!’
মাঝি বলিল— ‘হ্যাঁ। কিন্তু কুন্তল রাজ্য অবন্তীর কাছে লাগে না। এখানকার রাজা বিক্রমাদিত্য একজন মহাবীর, অসভ্য হূণদের উনিই যুদ্ধে হারিয়েছিলেন। ভারি তেজী রাজা। শুনেছি পণ্ডিতদের খুব আদর করেন।’
মাঝি যতক্ষণ হূণ-হরিণ-কেশরী বিক্রমাদিত্যের পরিচয় দিতেছিল, কালিদাস ততক্ষণে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন; তাঁহার মুখে দৃঢ় সংকল্প স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। মাঝি থামিতেই তিনি বলিয়া উঠিলেন— ‘ভাই মাঝি, আমাকে তুমি এখানেই নামিয়ে দাও।’
মাঝি ঈষৎ বিস্ময়ে চোখ তুলিল— ‘এখানেই—?’
কালিদাসের দৃষ্টি শিপ্রার তীরভূমি চুম্বন করিয়া চলিয়াছিল; তিনি মাঝারি পানে না ফিরিয়াই বেদনা-বিদ্ধ কণ্ঠে বলিলেন— ‘হ্যাঁ, এখানেই। আমার কাছে সব রাজ্যই তো সমান। এই উজ্জয়িনীর উপকণ্ঠে নদীর তীরে কুটির বেঁধে আমি থাকবো—’
মাঝি একটু চুপ করিয়া রহিল, তারপর বলিল— ‘তা বেশ, আপনার যা ইচ্ছে ঠাকুর। — ওরে ওরে, পাল নামা।’
মাঝি হালের মুখ ফিরাইয়া ধরিল। অন্য যেসব নাবিকেরা নীচে ছিল তাহারা ছাদে উঠিয়া আসিল।
কয়েকদিন কাটিয়াছে।
উজ্জয়িনীর সীমান্তে শিপ্রার উপকূল। তীরভূমি ঢালু হইয়া জলে মিশিয়াছে, তীরে দূরে দূরে উপবনবেষ্টিত কুটির। যাহারা ফুলের চাষ করে নগরের বাহিরেই তাঁহাদের সুবিধা, তাই মালাকরেরা এইদিকেই পুষ্পোদ্যান রচনা করিয়াছে।
জলের কিনারা দিয়া যে হাঁটা-পথ গিয়াছে সেই পথে মালিনী নগরের দিকে চলিয়াছিল। তাহার বিশেষ তাড়া ছিল না, সূর্যাস্তের এখনো বিলম্ব আছে। বাঁ হাতের মণিবন্ধ হইতে ফুলের সাজি ঝুলিতেছে, ডান হাতে সূচী ও সূত্রের সাহায্যে মালা গড়িয়া উঠিতেছে। মালিনী অস্ফুট গুঞ্জনে গান গাহিতে গাহিতে চলিয়াছিল।
মালিনীর বয়স পনেরো-ষোল, শ্যামকান্তি পল্লবিতা দেহলতা; মনে ও দেহে দুই-একটি কুঁড়ি ধরিতে আরম্ভ করিয়াছে। মালব দেশের মালিনীদের যৌবন যেমন বিলম্বে আসে তেমনি বিলম্বে যায়। এই তরুণী মালিনীটি দেখিতে ছোটোখাটো চঞ্চলা হাস্যময়ী, চুলগুলি চিকণ করিয়া বাঁধা। পরিধানে বাসন্তী রঙ্ শাড়ি, ঊর্ধ্বাঙ্গে বাসন্তী রঙ আঙরাখা সর্বাঙ্গে আঁট হইয়া বসিয়াছে।
মালিনী চলিতে চলিতে মালা গাঁথিতেছে, তাহার চক্ষু তাহাতেই নিবদ্ধ। যে গানটি ঈষন্মুক্ত অধর হইতে নিঃসৃত হইতেছে তাহা বেশি দূর যাইতেছে না, ফুলের চারিপাশে ভ্রমরের মত গুঞ্জন করিয়া ফিরিতেছে। তাহার গতিভঙ্গিতেও একটু নৃত্যের স্পর্শ আছে।
মালা গাঁথা শেষ করিয়া সে এক পাক ঘুরিয়া চোখ তুলিয়া সবিস্ময়ে দাঁড়াইয়া পড়িল! এ কি, হঠাৎ একটা নূতন কুটির কোথা হইতে আসিল? সাত দিন আগেও কিছু ছিল না!
নদীতীর হইতে পঞ্চাশ হাত ব্যবধানে উঁচু জমির উপর সত্যই একটি নূতন কুটির নির্মিত হইয়াছে। ঘন সন্নিবিষ্ট পাহাড়ী বেত্রের উপর মাটির প্রলেপ দিয়া দেয়াল, উপরে কুশের ছাউনি। সম্মুখের খানিকটা স্থানে ছিটে-বেড়ার বেষ্টনী; উঠানের মধ্যস্থলে একটি ক্ষুদ্র বেদিকা।
কুটির সম্পূর্ণ হইয়াছে বটে কিন্তু তাহার প্রসাধন ও অঙ্গশোভা এখনো বাকি আছে। স্বয়ং গৃহস্বামী অধুনা এই কার্যে ব্যাপৃত। এক হাতে পিটুলি-পূর্ণ ভাঁড় ও অন্য হাতে দাঁতনের মত একটি তুলি লইয়া তিনি অভিনিবেশ সহকারে গৃহদ্বারের উপর শঙ্খ চক্র প্রভৃতি চিত্রলেখায় প্রবৃত্ত।
দূর হইতে দেখিয়া মালিনী কৌতূহল বশে সেই দিকে অগ্রসর হইল। পা টিপিয়া টিপিয়া কালিদাসের পিছনে গিয়া দাঁড়াইল। কালিদাস চিত্র রচনায় এতই নিমগ্ন যে কিছুই জানিতে পারিলেন না।
চিত্রবিদ্যায় কবির পটুত্ব কিছু কম। দ্বারের একটি কপাটে তিনি যে-শঙ্খটি আঁকিয়াছেন তাহা যে শঙ্খই এমন কথা জোর করিয়া বলা শক্ত, কুণ্ডলিত বিষধর সর্পও হইতে পারে; এইজন্য কবি তাহার নিম্নে স্পষ্টাক্ষরে চিত্রপরিচয় লিখিয়া দিয়াছেন— ‘শঙ্খ’। বর্তমানে যে-চিত্রটি আঁকিতেছেন তাহাও আশানুরূপ আকার গ্রহণ করিতেছে না। সুদর্শন চক্র গোলাকার হওয়াই বাঞ্ছনীয়, কিন্তু কবির হস্তে উহা ডিম্বের আকৃতি ধারণ করিবার চেষ্টা করিতেছে। তাছাড়া তুলিটাও ভদ্র ব্যবহার করিতেছে না, অতর্কিতে কবির চোখে মুখে রঙ ছিটাইয়া দিতেছে।
কালিদাস শেষে উত্ত্যক্ত হইয়া তুলির দ্বারা সুদর্শন চক্রের মাঝখানে একটা খোঁচা দিলেন; তুলির রঙ আমনি ধারার মত গড়াইয়া পড়িল। মালিনী এতক্ষণ কালিদাসের পিছনে দাঁড়াইয়া সকৌতুকে দেখিতেছিল; এখন খিল্খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল।
চমকিয়া কবি ফিরিলেন; হাতের তুলিটা কেমন একভাবে ছিট্কাইয়া উঠিয়া মালিনীর মুখে চোখে রঙ ছিটাইয়া দিল।
মালিনী মুখখানি একবার কুঞ্চিত করিয়া আবার হাসিয়া উঠিল— ‘কেমন মানুষ গা তুমি! আমার মুখেও চিত্তির আঁকবে নাকি?’
কালিদাস অত্যন্ত অপ্রস্তুত হইয়া পড়িলেন— ‘এ হে হে, দেখতে পাইনি— ভারি অন্যায় হয়েছে। — তা, এ চুন নয় পিটুলি গোলা, তোমার মুখের কোনো ক্ষতি করবে না। বরং— বেশ দেখাচ্ছে—।’
মালিনীর মুখে শ্বেত বিন্দুগুলি তিলকের মত ফুটিয়া উঠিয়া সত্যই সুন্দর দেখাইতেছিল, সে স্মিতমুখে এই কান্তিময় তরুণ ব্রাহ্মণকে ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিল। মানুষটি দেখিতেও সুন্দর, কথাও বলে ভারি মিষ্ট। সে বলিল— ‘তুমি নতুন এসেছ না? সাত দিন আগেও এ পথ দিয়ে গেছি, তোমার কুঁড়ে ঘর তো ছিল না।’
কালিদাস বলিলেন— ‘না, এই তো ক’দিন হল এসেছি। নিজের হাতে ঘর তৈরি করেছি। কেমন, চমৎকার হয়নি?’ তিনি সগর্বে গৃহের পানে তাকাইলেন।
মালিনী বলিল— ‘বেশ হয়েছে। ওটা কি হচ্ছিল?’
মালিনীর তর্জনীনির্দেশ অনুসরণ করিয়া শঙ্খ চক্র দেখিয়া কালিদাস লজ্জিত হইলেন, আম্তা আম্তা করিয়া বলিলেন— ‘মঙ্গল চিহ্ন আঁকছিলাম, তা ওই হয়েছে।’ বলিয়া নিজেই হাসিয়া ফেলিলেন।
মালিনীও হাসিল। ফুলের মালা সাজিতে রাখিয়া সাজি কালিদাসের হাতে ধরাইয়া দিয়া বলিল— ‘তুমি সাজি ধরো আমি এঁকে দিচ্ছি। আল্পনা দেওয়া কি পুরুষের কাজ!’
ভাঁড় ও তুলি হাতে লইয়া মালিনী দ্বারের কাছে গেল; কালিদাস পুলকিত হইয়া বলিলেন— ‘তুমি এঁকে দেবে! বাঃ, তাহলে তো কথাই নেই। — আমরা পুরুষেরা শুধু মোটা কাজ করতে পারি, সূক্ষ্ম কাজ মেয়েরা না হলে হয় না।’
মালিনী হাসিমুখে স্বজাতির এই প্রশংসা আত্মসাৎ করিয়া আল্পনা অঙ্কনে মন দিল, পূর্বের অঙ্কন মুছিয়া দক্ষহস্তে নূতন করিয়া শঙ্খ আঁকিতে লাগিল। কালিদাস সপ্রশংস নেত্রে দেখিতে লাগিলেন। দেখিতে দেখিতে বলিলেন— ‘ভাল কথা, তুমি কে তা তো বললে না।’
‘ফুলের সাজি দেখে বুঝলে না?— মালিনী।’
‘ও— তা বটে। কিন্তু তোমার একটা নাম আছে তো।’
মালিনী মুখ না ফিরাইয়াই মাথা নাড়িল।
‘না, সবাই আমাকে মালিনী বলে ডাকে। আমার কেউ নেই কিনা। — গুরুবারে গুরুবারে আমি রাজবাড়িতে যাই রানী ভানুমতীকে ফুল যোগাতে। রানী ভানুমতী আমাকে খু— ব ভালবাসেন। সবাই আমাকে খুব ভালবাসে। আমার কেউ নেই কিনা।’
কালিদাস ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে শুনিতেছিলেন, মালিনী মুখ ফিরাইয়া প্রশ্ন করিল— ‘তুমি কে?’
কালিদাস একটু ইতস্তত করিয়া শেষে বলিলেন— ‘আমি কালিদাস।’
মালিনী পরিতুষ্টভাবে ঘাড় নাড়িল— ‘বেশ নাম। — তুমি কি কাজ কর?’
কালিদাস চিন্তা করিয়া বলিলেন— ‘কাজ!— আমিও মালা গাঁথি।’
মালিনীর চক্ষু উজ্জ্বল হইয়া উঠিল— ‘ওমা সত্যি! কিন্তু— কিন্তু তোমার গলায় পৈতে রয়েছে, তুমি তো মালাকর নও।’
কালিদাস মৃদু হাসিলেন— ‘আমি কথার মালাকর— কবি।’
চিবুকে একটি আঙুল ঠেকাইয়া মালিনী কিছুক্ষণ অবাক হইয়া রহিল, তারপর রুদ্ধশ্বাসে বলিল— ‘কবি! তুমি গান বাঁধতে পার?’
কালিদাস হাসিয়া ঘাড় নাড়িলেন, মালিনীর চক্ষু বিস্ময়ে আরো বর্তুলাকার হইল। সে বলিল— ‘তবে— তবে তুমি এখানে কুঁড়ে ঘর বেঁধেছ যে? রাজসভায় যাও না কেন? রাজা কবিদের ভারি ভালবাসেন, কত সোনাদানা দেন, থাকবার বাড়ি দেন—’
কালিদাসের মুখে ঈষৎ তিক্ততার আভাস খেলিয়া গেল, তিনি আকাশের দিকে চাহিয়া বলিলেন— ‘রাজারানীর সোনাদানা আমার দরকার নেই। নিজের হাতে তৈরি এই কুঁড়ে ঘর আমার অট্টালিকা।’
মালিনী ক্ষণেক জিজ্ঞাসু নেত্রে চাহিয়া থাকিয়া মৃদু হাসিল, সদয় কণ্ঠে বলিল— ‘বুঝেছি। তুমি রাজারানীদের সঙ্গে কখনো মেশোনি কিনা তাই ভয় করছে। তুমি ভয় পেও না। ওরা খুব ভাল লোক হয়। আমার রানী ভানুমতী খুব ভাল লোক— আর কী সুন্দর! চোখ ফেরানো যায় না।’
কালিদাস একটু হাসিলেন— ‘তুমিও তো ভাল লোক; জানা-শোনা নেই তবু আমার কত কাজ করে দিচ্ছ। আর দেখতেও সুন্দর— যেন প্রতিমাটি। তবে তোমাকে ফেলে রাজারানীর পিছনে ছোটবার কী দরকার?’
মালিনী আহ্লাদে বিগলিত হইয়া গেল, বলিল— ‘আমি সুন্দর! যাঃ— তুমি কবি কিনা তাই মিছিমিছি বলছ। এবার এদিকে দ্যাখো দেখি, কেমন আল্পনা হয়েছে।’
কবি সহজ কৃতজ্ঞতার কণ্ঠে বলিলেন— ‘ভাল হয়েছে, যেমনটি হওয়া উচিত তেমনি হয়েছে। নারীই গৃহকে গৃহের রূপ দিতে পারে— সে গৃহদেবতা।’
মালিনী মাথা হেলাইয়া কিছুক্ষণ কবির পানে চাহিয়া রহিল। এ ধরনের কথাবার্তার সহিত সে পরিচিত নয়, তবু একটু হাসিয়া বলিল— ‘তোমার কথার মানে বুঝেছি। শুনতে হেঁয়ালির মত লাগে, কিন্তু ভাবলে মানে পাওয়া যায়। — আচ্ছা, সব কবিই কি হেঁয়ালির ছন্দে কথা বলে?’
কালিদাস হাসিয়া বলিলেন— ‘স— ব।’
ইতিমধ্যে সূর্যদেব শিপ্রার পরপারে অস্তচূড়া স্পর্শ করিয়াছেন; এখন নগর হইতে সন্ধ্যারতির শঙ্খঘণ্টাধ্বনি ভাসিয়া আসিল। মালিনী চকিতে দিগন্তের পানে চাহিয়া সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল— ‘ওমা কি হবে! সৃয্যি যে পাটে বসলেন! আজকেই আমি মরেছি, রানীমার ফুল যোগান দিতে দেরি হয়ে যাবে। দাও দাও, সাজি দাও, আমি চললুম—’
কালিদাসের হাতে ভাঁড় ধরাইয়া দিয়া এবং সাজিটি প্রায় কাড়িয়া লইয়া মালিনী ক্ষিপ্রপদে অঙ্গনের বাহিরে চলিল। যাইতে যাইতে একবার পিছু ফিরিয়া বলিল— ‘আবার যেদিন আসব তোমার ঘর গুছিয়ে দিয়ে যাব।’
কালিদাস স্মিতমুখে তাহার দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন, তারপর মৃদুস্বরে আত্মগতভাবে বলিলেন— ‘মালিনী! যেন সাক্ষাৎ মালিনী ছন্দ— চপল-চরণ-ছন্দা— নন্দিনী— পুষ্পগন্ধা!’