পরিত্যক্ত খনি থেকে বের হওয়ামাত্রই ইশি আমার মস্তিষ্কে ফিসফিস করে বলল, আমাকে কেউ একজন ডাকছে।
প্রতিরক্ষা দপ্তর। উত্তর দেবার কিছু প্রয়োজন নেই।
কেন উত্তর দেবার কোনো প্রয়োজন নেই?
আমি কোথায় সেটা জানতে দিতে চাই না। তুমি উত্তর দেওয়ামাত্র আমার অবস্থান জেনে যাবে।
তোমার অবস্থান জানলে ক্ষতি কী?
আসলে কোনো ক্ষতি নেই। আমার অবস্থান আগে হোক পরে হোক জেনে যাবেই। কিন্তু আমি একটু সময় চাইছি।
আমি পরিত্যক্ত খনি থেকে অনেক কষ্টে শহরে ফিরে এলাম। নিজের বাসায় একদিন শুয়ে–বসে কাটিয়ে দিলাম। পরদিন শহরতলিতে পানশালায় গেলাম নিফ্রাইট মেশানো পানীয় খেতে। সেখানে কোমের সঙ্গে দেখা হল–আমার সাথে যে বেশ কয়েকদিন দেখা হয় নি সেটা নিয়ে কোম কিছু সন্দেহ করল না। আমরা পানীয়তে চুমুক দিয়ে শিল্প–সাহিত্য–সংস্কৃতি এই ধরনের বড় বড় ব্যাপার নিয়ে কথা বললাম। উঠে আসার সময় কোমকে জিজ্ঞেস করলাম, হিম নগরীতে যাবার সহজ রাস্তা কি জান?
কোম অবাক হয়ে বলল, হিম নগরী! সেখানে কেন যাবে?
আমি রহস্যময়ভাবে হেসে বললাম, একটু কাজ আছে!
হিম নগরীর রাস্তা কোম জানে না, আমি জানতাম সে জানবে না। কয়দিন পর যখন প্রতিরক্ষা দপ্তর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে সে নিশ্চয়ই এই কথাটা বলবে, এই জন্যই তাকে জিজ্ঞেস করা।
আমি শহরের বড় বড় ব্যাঙ্ক ভন্টে কয়দিন ঘোরাঘুরি করলাম, আন্তঃভূমণ্ডল পরিবহন কেন্দ্রে কেনাকাটা করলাম, কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্কে একদিন বসে বসে পৃথিবীর বড় বড় ডাটা সেন্টারে তথ্য বিনিময় করলাম। পৃথিবীর বড় কিছু গবেষণাগারে অর্থহীন বিষয় নিয়ে। আলোচনা করলাম। অবশেষে শহরের বড় একটি লেভিটেশান টার্মিনালে অসংখ্য মানুষের ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে ইশিকে বললাম প্রতিরক্ষা দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করতে।
আমাকে খুঁজে বের করতে কতক্ষণ লাগবে সেটা নিয়ে আমার একটু কৌতূহল ছিল, দেখতে পেলাম ঘণ্টাখানেকের মাঝেই আমাকে প্রতিরক্ষা দপ্তরের কাছাকাছি একটা অফিসে নিয়ে যাওয়া হল। লেভিটেশান টাওয়ারের ভিড় থেকে আমাকে তুলে আনা হয়েছে বলে অসংখ্য দৃষ্টিক্ষেপণ মডিউলে সেটি সংরক্ষিত থাকার কথা, রিগা কম্পিউটার ইচ্ছে করলেই তার পরিবর্তন করতে পারবে কিন্তু এই বিশাল মানুষের ভিড়ের দৃশ্যে সেটি সহজ নাও হতে পারে।
প্রতিরক্ষা দপ্তরে আমার সাথে যে কথা বলতে এল সে সম্ভবত খুব উচ্চপদস্থ কর্মচারী, তার সাথে এসেছে দুজন আইনরক্ষাকারী অফিসার এবং একটি প্রতিরক্ষা রোবট। উচ্চপদস্থ কর্মচারীটি মধ্যবয়স্ক, জীবনের একটি বড় সময় ভুরু কুঁচকে থাকার কারণে তার কপাল পাকাপাকিভাবে কুঞ্চিত হয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে রুষ্ট স্বরে বলল, আধা জৈবিক প্রাণীটি ধ্বংস করে তোমার সাথে আমার যোগাযোগ করার কথা ছিল।
আমি একটু অবাক হবার দুর্বল অভিনয় করে বললাম, ছিল নাকি? আমি ভেবেছিলাম সে জন্য তোমরা আমার মাথায় একটা ট্রাকিওশান লাগিয়েছ।
মানুষটি মুখ কালো করে বলল, ট্রাকিওশানটি আমাদের আনুগত্য স্বীকার করতে অস্বীকার করছে।
তাই নাকি! আমি গলায় বিদ্রূপটুকু লুকানোর কোনো চেষ্টা না করে বললাম, কী অন্যায়! কী ঘোরতর অন্যায়?
প্রতিরক্ষা রোবটটি ভাবলেশহীন মুখে বসে রইল, কিন্তু আমার কথায় সাথের আইনরক্ষাকারী অফিসার দুজন বিশেষরকম বিচলিত হয়ে উঠল বলে মনে হল।
উচ্চপদস্থ কর্মচারীটি ক্ষুব্ধ গলায় বলল, আধা জৈবিক প্রাণীটিকে ধ্বংস করার একটি পূর্ণ বিপোর্ট দরকার। তুমি কি সেটি দেবার জন্য প্রস্তুত?
না।
কর্মচারীটি অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে রাখল। আইনরক্ষাকারী অফিসারদের একজন বলল, কেন নয়?
সেটি সম্ভব নয় বলে।
কেন সেটি সম্ভব নয়?
কারণ আমি সেই প্রাণীটিকে হত্যা করি নি।
অসম্ভব। সেই প্রাণীটিকে হত্যা না করলে তুমি জীবন্ত বের হতে পারতে না। আমাদের সিসমি রেকর্ডে তোমার এটমিক ব্লাস্টারের বিস্ফোরণের সংকেত ধরা পড়েছে।
তোমরা যদি সেটি জান তা হলে কেন আমাকে প্রশ্ন করছ?
আমরা ঘুঁটিনাটি জানতে চাই। আধা জৈবিক প্রাণীটির ধ্বংসাবশেষ আনতে চাই।
আমি হঠাৎ করে সামনে ঝুঁকে গলার স্বর পরিবর্তন করে বললাম, আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য আছে, কিন্তু সেই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটি আমি দিতে পারি ঠিক সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কোনো মানুষকে।
উচ্চপদস্থ কর্মচারীটি দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তোমার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি কে হতে পারে?
তুমি তাকে চিনবে না। সত্যি কথা বলতে কী, আমি যদি সেই মানুষের কথা তোমাকে বলি, তোমার বিপদ হতে পারে। তুমি কি সত্যিই শুনতে চাও?
আমি এই প্রথমবার মানুষটির মুখে এক ধরনের ভীতির ছাপ দেখতে পেলাম। সে ইতস্তত করে বলল, তুমি কী বলতে চাও?
আমি তোমাকে বিপদে ফেলতে চাই না। তুমি তোমাদের সবচেয়ে উচ্চপদস্থ মানুষ কিংবা যন্ত্রকে নিয়ে এস। যদি সেটা নিয়ে সমস্যা থাকে আমাকে একটি গোপন চ্যানেল দাও আমি ইশিকে ব্যবহার করে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কিংবা যন্ত্রের সাথে যোগাযোগ করি।
আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না।
আমি কাঠ কাঠ স্বরে হেসে উঠে বললাম, তুমি জান আমি এক ছুঁয়ে তোমাদের ধ্বংস করে দিতে পারি? তোমরা নিজেরা আমার মুখে ভয়ঙ্কর একটি বিস্ফোরক লাগিয়ে দিয়েছিলে? সেটি এখনো ব্যবহার করি নি। তুমি জান?
আমার এই কথায় হঠাৎ ম্যাজিকের মতো কাজ হল। সামনে যারা উপস্থিত ছিল তারা হঠাৎ করে উঠে দাঁড়াল এবং আমাকে একা বসিয়ে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আমি কালো একটি গ্রানাইট টেবিলের সামনে একাকী বসে রইলাম।
দীর্ঘ সময় পরে আমার সামনে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে একজন বয়স্ক মানুষের ছবি দেখতে পেলাম। মানুষটি শুষ্ক গলায় বলল, তুমি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে চাইছ?
হ্যাঁ। শুধুমাত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কাছে।
বয়স্ক মানুষটি হাসার ভঙ্গি করে বলল, আমি প্রতিরক্ষা দপ্তরের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
সেটি সত্যি কি না আমি এক্ষুনি বুঝতে পারব। আমি একমুহূর্ত অপেক্ষা করে বললাম, তুমি কি প্রজেক্ট অতিমানবীর কথা শুনেছ?
বয়স্ক মানুষটি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি–তুমি কী বললে?
প্রজেক্ট অতিমানবী।
তুমি কেমন করে প্রজেক্ট অতিমানবীর কথা জেনেছ?
তোমরা আমাকে যে অতিমানবীকে হত্যা করতে পাঠিয়েছিলে, আমি তাকে হত্যা করি নি। আমার তার সাথে পরিচয় হয়েছে
অসম্ভব।
তার কোন ক্রোমোজমের কোন জিনটির কোন বেস পেয়ারবটির মিউটেশানের কারণে তাদের মৃত্যু ঘটে নি সেটি বললে কি তুমি বিশ্বাস করবে?
বয়স্ক মানুষটি দীর্ঘসময় আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর কেমন জানি ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি কী চাও?
আমি প্রজেক্ট অতিমানবীর মহাপরিচালকের সাথে কথা বলতে চাই।
বৃদ্ধ মানুষটি বিচিত্র এক ধরনের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তাকে হঠাৎ কেমন জানি ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত দেখাতে থাকে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, তুমি কেন এটা করতে চাইছ?
অতিমানবীদের নিয়ে যে নৃশংসতা শুরু হয়েছে আমি সেটা বন্ধ করতে চাই।
তুমি?
হ্যা আমি।
তুমি কীভাবে সেটা করবে?
আমি সেটা প্রজেক্ট অতিমানবীর মহাপরিচালককে বলব।
বৃদ্ধ মানুষটি খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, প্রজেক্ট অতিমানবীর মহাপরিচালক সম্পর্কে তুমি কতটুকু জান?
আমি কিছু জানি না।
আমারও তাই ধারণা, তাই তুমি তার সাথে দেখা করতে চাইছ।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, কেন? তার সাথে দেখা করতে অসুবিধা কী?
আমার জানামতে কোনো মানুষ তার সাথে দেখা করে নি।
কেন?
এই প্রজেক্টটি পুরোপুরি পরিচালিত হয় আধা জৈবিক কিছু প্রাণী, কিছু রোবট, কিছু পরামানব–মানবী এবং কিছু যন্ত্র দিয়ে। সেখানে কোনো মানুষের প্রবেশাধিকার নেই।
আমার শরীর কেন জানি শিউরে উঠল, আমি বৃদ্ধ মানুষটির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, আমি তবু সেখানে যেতে চাই।
হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে বৃদ্ধ মানুষটি দীর্ঘসময় আমার দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, আমি যদি তোমাকে এই মুহূর্তে হত্যা করার নির্দেশ দিয়ে অতিমানবীদের একে একে ধ্বংস করার প্রক্রিয়াটি চালু রাখি?
তুমি সেটা করবে না।
কেন?
তোমরা যে অতিমানবীকে হত্যা করার জন্য আমাকে পাঠিয়েছিলে, সেই লাইনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। আমি তার শরীর থেকে রক্ত নিয়েছি, টিস্যু নিয়েছি। সেই রক্ত, টিস্যু, জীবন্ত কোষ বায়োজ্জ্যাকেটে করে হিম নগরীতে পাঠিয়েছি, পৃথিবীর নানা প্রান্তে জমা রেখেছি।
না– বৃদ্ধ মানুষটি চিৎকার করে বলল, না!
হ্যাঁ। তথ্যকেন্দ্রে আমি সেই তথ্যও জমা রেখেছি– বিশ্বাস না হলে খোঁজ নিতে পার। আমার মৃত্যু হলে সেই তথ্য প্রকাশিত হবে। পৃথিবীর অর্থলোলুপ ব্যবসায়ীরা সেই টিস্যু, সেই জীবন্ত কোষ থেকে ৪৬টি ক্রোমোজম নিয়ে অতিমানবীর ক্লোন তৈরি করবে। কয়েকটি অতিমানবীর জায়গায় পৃথিবীতে থাকবে কয়েক সহস্র অতিমানবী। সেখান থেকে কয়েক লক্ষ। তোমরা কত জনকে হত্যা করবে?
না। না না। তুমি জান না তুমি কী ভয়ঙ্কর খেলায় হাত দিয়েছ। বৃদ্ধ মানুষটি চিৎকার করে বলল, তুমি উন্মাদ। তুমি বদ্ধ উন্মাদ।
সম্ভবত। কিন্তু একটা জিনিস জান?
কী?
আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ ছিলাম। তোমরা আমাকে বদ্ধ উন্মাদ করে তুলেছ। আর মজা কী জান? বদ্ধ উন্মাদ হয়ে আমার কিন্তু ভালো লাগছে।
বৃদ্ধ মানুষটি শীতল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি আমার কাছে কী চাও?
আমি একটি নিশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি কি আমাকে প্রজেক্ট অতিমানবীর মহাপরিচালকের সাথে দেখা করিয়ে দেবে?
বৃদ্ধ মানুষটি খানিকক্ষণ আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল, তার পর অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে আমি চেষ্টা করব।
.
ভাসমান যানটি আমাকে চত্বরের শক্ত কংক্রিটে নামিয়ে দিয়ে এইমাত্র আবার আকাশে উঠে গেছে। আমি যতক্ষণ সম্ভব ভাসমান যানটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। লাল আলো জ্বলতে জ্বলতে এবং নিভতে নিভতে ভাসমান যানটি দূরে মিলিয়ে গেল। আমি সামনে তাকালাম, আমাকে বলে দেওয়া না হলে কখনোই বিশ্বাস করতাম না যে এই প্রায় বিধ্বস্ত দালানটি প্রজেক্ট অতিমানবীর মূল ল্যাবরেটরি। দূরে শক্ত পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা, উপরে নিশ্চয়ই শক্তিশালী ইনফ্রারেড আলোর অদৃশ্য প্রহরা। ভিতরে অবিন্যস্ত গাছপালা এবং ঝোঁপঝাড়, কংক্রিটের চত্বর থেকে ল্যাবরেটরি পর্যন্ত নুড়ি পাথর ছড়ানো রাস্তা। আমি হেঁটে হেঁটে ল্যাবরেটরির সামনে দাঁড়ালাম। কোথায় দরজা হতে পারে সেটা নিয়ে চিন্তা করছিলাম ঠিক তখন হঠাৎ ঘরঘর শব্দ করে চতুষ্কোণ একটা দরজা খুলে গেল, মনে হচ্ছে আমার জন্য কেউ একজন সেখানে অপেক্ষা করে আছে। আমি একটা নিশ্বাস ফেলে ভিতরে পা দিলাম, নিজের অজান্তেই বুকের ভিতরে হঠাৎ আতঙ্কের একটা শিহরন বয়ে গেল।
দরজার পাশে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, মানুষটিকে দেখে আমি চমকে উঠলাম, তার চারটি হাত। দুই হাতে সে শক্ত করে একটি বীভৎস অস্ত্র ধরে আছে, অন্য দুই হাতে আমাকে জাপটে ধরে আমি কিছু বোঝার আগেই আমার দুই হাতে একটা হাতকড়া লাগিয়ে দিল।
আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মানুষটির দিকে তাকালাম, সে খসখসে গলায় বলল, নিরাপত্তার খাতিরে তোমার হাতে হাতকড়া লাগাচ্ছি, তার বেশি কিছু নয়।
আমি মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, একজন মানুষের চারটি হাত দেখে নিজের অজান্তেই সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। কিন্তু যে জিনিসটি আমাকে বিস্মিত করল তার সাথে এই মানুষটির বিচিত্র দেহ–গঠনের কোনো সম্পর্ক নেই। আমার মুখে এবং হাতের মাংসপেশিতে ভয়াবহ বিস্ফোরক লাগানো রয়েছে, ইচ্ছে করলেই আমি কঠোর নিরাপত্তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে এখানে ভয়ঙ্কর আঘাত হানতে পারি। প্রজেক্ট অতিমানবীর ল্যাবরেটরির এই প্রহরী সেই কথা জানে না প্রতিরক্ষা দপ্তর এই তথ্যটি জানার পরেও এদেরকে সে বিষয়ে সতর্ক করে দেয় নি ইচ্ছে করেই দেয় নি যার অর্থ এই ভয়ঙ্কর প্রজেক্টের জন্য প্রতিরক্ষা দপ্তরের কারো মনে এতটুকু সহানুভূতি নেই। কেন নেই?
চার হাতের মানুষটি আমাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে নিতে নিতে বলল, তোমার জন্য মহামান্য গ্রুটাস অপেক্ষা করছেন।
গ্রুটাস?
আমাদের এই ল্যাবরেটরির মহাপরিচালক।
আমি কোনো কথা না বলে হেঁটে যেতে যেতে কিছু বিচিত্র জিনিস দেখতে পেলাম। ঘরের মেঝেতে একটি হাত গড়াগড়ি খাচ্ছে, দেখে মনে হয় কেউ বুঝি কারো একটা হাত কেটে ফেলে রেখেছে; একটু ভালো করে দেখলেই বোঝা যায় সেটি সত্যি নয় হাতের অন্যপাশে একটা ছোট কয়েক আঙুল লম্বা বিচিত্র অপুষ্ট দেহাবশেষ ঝুলছে। দেখে আমার শরীর ঘিনঘিন করে উঠল। আমি একাধিক মানুষ দেখতে পেলাম যাদের মুখের জায়গায় একটি বীভৎস গর্ত। চোখের জায়গায় কান বের হয়ে এসেছে সেরকম কিছু বিচিত্র মানুষকেও ইতস্তত ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম। যে জিনিসটি দেখে আমি অমানুষিক আতঙ্কে প্রায় ছুটে যেতে চাইলাম সেটি মাথাহীন কিছু দেহ, যেগুলো অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে পা নাড়ছে।
আমি একাধিক করিডোর ধরে হেঁটে, অনেক ধরনের বিচিত্র মানুষকে পাশ কাটিয়ে একটি বড় হলঘরের মতো জায়গায় হাজির হলাম। চার হাতের মানুষটি আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে দিল।
বিশাল হলঘরের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একজন মানুষ ঝুলছে, মানুষটি স্বাভাবিক নয়, নিচের ঠোঁটটি একটু বেরিয়ে এসেছে। মানুষটির মুখের চামড়া কুঞ্চিত, চোখে অসুস্থ হলুদ রং। মানুষটির মুণ্ডিত মাথা দেহের তুলনায় অস্বাভাবিক বড়, তার ভিতরে কিছু–একটা নড়ছে, সেটা কী বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছে না। মানুষটার বিশাল মাথার ভিতর থেকে নানা ধরনের টিউব বের হয়ে গেছে, তাদের ভিতর দিয়ে নানা রঙের তরল প্রবাহিত হচ্ছে। একাধিক টিউব নমনীয় ধাতবের, সম্ভবত বৈদ্যুতিক সঙ্কেত আদান–প্রদানের জন্য। পিছনের দেয়ালে জটিল কিছু যন্ত্রপাতি, আমি বিজ্ঞানী নই বলে সেগুলো কী ধরনের যন্ত্র। বুঝতে পারলাম না। মানুষটি কীভাবে শূন্যে ভেসে আছে দেখে বোঝা যাচ্ছে না, সম্ভবত সূক্ষ্ম কোনো তার দিয়ে ছাদ থেকে ঝোলানো রয়েছে।
বীভৎস এই মানুষটি আমাকে দেখে হঠাৎ সবৃসর করে নিচে নেমে আমার দিকে এগিয়ে। এল, যে সূক্ষ্ম ধাতব ফাইবারগুলো তাকে উপর থেকে ঝুলিয়ে রেখেছে আমি এবারে সেগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলাম। মানুষটি আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই তার দেহ থেকে একটা দূর্গন্ধ ভেসে এল, পচা মাংসের মতো এক ধরনের উৎকট দুর্গন্ধ। সাধারণ মানুষের মস্তিষ্ক থেকে তার মস্তিষ্ক অনেক বড়, সেখানে যান্ত্রিক কিছুও রয়েছে। নানা ধরনের টিউব দিয়ে সেই যন্ত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। এই অসম্ভব কুদর্শন কদাকার মানুষটির গলা থেকে আমি এক ধরনের উৎকট কণ্ঠস্বরের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু এই মানুষটির কণ্ঠস্বর অপূর্ব। সে গমগমে গলায় বলল, আমার নাম গ্রুটাস। তুমি আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছ?
আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ।
গ্রুটাস নামের মানুষটি হা হা করে হেসে আবার সরসর করে উপরে ডানদিকে সরে গেল, সেখান থেকেই বলল, আশা করছি কারণটি জরুরি। আমি সাধারণত কারো সাথে দেখা করি না।
আমার মনে হয়েছিল কারণটা জরুরী। আমি একটা নিশ্বাস নিয়ে বললাম, কিন্তু তোমার ল্যাবরেটরিতে হেঁটে আসতে আসতে আমি যা যা দেখেছি এখন আর নিশ্চিত নই।
গ্রুটাস সরসর করে নিচে নেমে আসতে আসতে বলল, তুমি কেন এ কথা বলছ?
তোমার এখানে মানুষকে নিয়ে গবেষণা হয়। যারা মানুষের দেহ–মনকে যেভাবে খুশি বিকৃত করতে পারে তাদেরকে আমি বুঝতে পারি না।
মানুষটি সরসর করে উপরে উঠে যেতে যেতে বলল, মানুষ কথাটির একটা সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে।
সেটি কী?
তাদের ৪৬টি ক্রোমোজমের দুই লক্ষাধিক জিনকে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে দেওয়া আছে। সেই জিনকে পরিবর্তন করা হলে তারা আর মানুষ থাকে না। তাদেরকে নিয়ে গবেষণা করা যায়। পৃথিবীর আইন আমাকে সেই অধিকার দিয়েছে।
আমি আসতে আসতে যাদের দেখেছি তারা মানুষ নয়?
প্রচলিত সংজ্ঞায় মানুষ নয়। তাদের অত্যন্ত সীমিত আয়ু দিয়ে কৃত্রিমভাবে দ্রুত বড় করা হয়েছে। মানুষের শরীরের একেক জায়গার কোষ একেকভাবে বিকশিত হয় কারণ তার জন্য নির্ধারিত জিন যেভাবে নিজেকে প্রকাশ করে, অন্যগুলো সুপ্ত থাকে। আমরা ইচ্ছেমতো তাদের বিকশিত করতে পারি, সুপ্ত রেখে দিতে পারি, প্রয়োজন থেকে বেশি জুড়ে দিতে পারি। যেখানে চোখ থাকার কথা সেখানে কান তৈরি হয়, একটা হাতের জায়গায় দুটি হাত বের হয়ে আসে। এই গবেষণার প্রয়োজন আছে। মানুষকে রক্ষা করার জন্য এইসব অসম্পূর্ণ। প্রাণী তৈরি করার প্রয়োজন আছে।
এই ল্যাবরেটরিতে সবাই অসম্পূর্ণ প্রাণী?
হ্যাঁ। সবাই অসম্পূর্ণ প্রাণী। আমি একমাত্র মানুষ।
আমি মানুষ নামের এই বিচিত্র প্রাণীটির দিকে এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। সে সরসর করে আবার সরে গিয়ে বলল, তুমি কেন এসেছ? কী চাও?
এটি প্রজেক্ট অতিমানবী ল্যাবরেটরি। তোমাদের তৈরি অতিমানবী বিষয়ে আমি একটি তথ্য নিয়ে এসেছি।
গ্রুটাস সরসর করে আমার এত কাছে সরে এল যে তার শরীরের দুর্গন্ধ আমার জন্য সহ্য করা কঠিন হয়ে উঠল। সে তার হলুদ চোখে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, কী তথ্য?
তারা তোমার এই ল্যাবরেটরি থেকে পালিয়ে গেছে।
আমি জানি।
ইচ্ছে করলে তারা তাদের ক্লোন দিয়ে সারা পৃথিবী ছেয়ে ফেলতে পারে, পৃথিবীর মানুষ এই ক্লোনদের দিয়ে অপসারিত হতে পারে।
গ্রুটাসের মুখ শক্ত হয়ে আসে, সে ক্রুদ্ধ গলায় বলে, প্রতিরক্ষা দপ্তর তাদেরকে একজন একজন করে হত্যা করার দায়িত্ব নিয়েছে।
একজন অতিমানবীকে হত্যা করা এত সহজ নয় গ্রুটাস। আমি জানি তারা সেই দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।
তুমি কেমন করে জান?
কারণ আমি সেই হত্যাকারীদের এক জন। আমি তাদের হত্যা করতে পারি নি।
গ্রুটাস সরসর করে ছিটকে আমার কাছ থেকে সরে গেল, একবার উপরে উঠে গেল, নিচে নেমে এল, তারপর ঘরের মাঝামাঝি স্থির হয়ে বলল, কেন তুমি হত্যা করতে পার নি?
তাদেরকে হত্যা করার প্রয়োজন নেই বলে।
কেন প্রয়োজন নেই?
কারণ তারা স্বেচ্ছায় এখানে ফিরে আসবে।
গ্রুটাস সরসর করে নিচে নেমে এল। শক্ত মূখে জিজ্ঞেস করল, কেন ফিরে আসবে?
কারণ তাদের সম্পর্কে যেটা ভাবো সেটা সত্যি নয়–তারা ভয়ঙ্কর নৃশংস প্রাণী নয় তারা প্রকৃত অর্থে একজন মানুষ। শুধু একটি ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিলেই তারা ফিরে আসবে।
কোন ব্যাপারে?
তারা অতিমানবী হতে চায় না। সাধারণ মানুষ হতে চায়। তাদেরকে সাধারণ মানুষে পাল্টে দিতে হবে।
গ্রুটাস কোনো কথা না বলে আমার দিকে হলুদ চোখে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, জিনের যে পরিবর্তনটুকুর কারণে তারা অতিমানবী রয়েছে, ধরে নাও সেটি একটি ক্রটি। সেই টিটুকু সারিয়ে দাও। সেই কত শত বছর আগে রিকম্বিনেন্ট ডি, এন, এ. টেকনিক দিয়ে ক্রটিপূর্ণ জিনকে ভালো জিন দিয়ে সারিয়ে দেওয়া হত। তোমরা এখন সেটা নিশ্চয়ই অত্যন্ত নিখুঁতভাবে করতে পার।
গ্রুটাস মাথা নাড়ল, পারি।
তা হলে তাদেরকে সারিয়ে দাও, অতিমানবিকতাকে একটি জিনেটিক ক্রটি হিসেবে ধরে নিয়ে তাদের চিকিৎসা করে সারিয়ে তোল। তাদের সাধারণ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে দাও।
গ্রুটাস কোনো কথা বলল না, আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, যদি না দিই?
তুমি দেবে। কারণ তোমার কোনো উপায় নেই। তোমার ল্যাবরেটরিতে তৈরি একজন অতিমানবীর সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। আমি তার দেহকোষ নিয়ে সারা পৃথিবীর অসংখ্য গোপন জায়গায় সঞ্চিত রেখেছি। অতিমানবীদের সাধারণ মানুষে পাল্টে না দেওয়া পর্যন্ত আমি সেই দেহকোষ ফিরিয়ে দেব না।
উৎকট দুর্গন্ধ ছড়িয়ে গ্রুটাস আমার কাছে ছুটে এল, তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?
হ্যাঁ। আমি হাতকড়া দিয়ে লাগানো আমার দুই হাত উপরে তুলে বললাম, তুমিও আমাকে ভয় দেখাচ্ছ এই দেখ আমাকে হাতকড়া পরিয়েছ।
গ্রুটাস কোনো কথা না বলে আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি শান্ত গলায় বললাম, তুমি কি আমার প্রস্তাবে রাজি?
গ্রুটাস সরসর করে পিছনে সরে গিয়ে বলল, কিন্তু আমি কীভাবে নিশ্চিত হব যে তুমি অতিমানবীদের কোনো দেহকোষ লুকিয়ে রাখবে না?
আমাকে তোমার বিশ্বাস করতে হবে। আমি একমুহূর্ত থেমে শান্ত গলায় বললাম, মানুষকে মানুষের বিশ্বাস করতে হয়।
গ্রুটাস তীব্র স্বরে বলল, আমি মানুষ, তাই আমি মানুষকে বিশ্বাস করি না।
আমি হাসার ভঙ্গি করে বললাম, সেটি তোমার সমস্যা। তুমি যদি চাও আমার মস্তিষ্ক স্ক্যান করেও দেখতে পার।
তাই দেখব।
বেশ। এখন তুমি কি অনুমতি দেবে? আমি কি অতিমানবীদের নিয়ে আসব?
গ্রুটাস আবার একটি বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, যাও। নিয়ে এসো।
তোমাকে ধন্যবাদ গ্রুটাস। আমি চলে যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বললাম, গ্রুটাস!
বল।
তোমাকে ব্যক্তিগত কিছু প্রশ্ন করতে পারি?
কী প্রশ্ন?
তুমি নিজেকে মানুষ বলে দাবি কর, কিন্তু বেঁচে আছ যন্ত্রের মতো। তোমার মস্তিষ্ক থেকে টিউব বের হয়ে আসছে, আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার মস্তিষ্কের ভিতরে কোনো একটা যন্ত্র নড়ছে, টিউবে করে তরল যাচ্ছে, সূক্ষ্ম ধাতব ফাইবার দিয়ে তুমি শূন্য থেকে ঝুলে আছ, কারণটা কী?
আমি মানুষের সীমাবদ্ধতার কথা জানি। তাই চেষ্টা করছি যন্ত্রের কাছাকাছি যেতে। মানুষের জিন নিয়ে আমি কাজ করি, গুরুত্বপূর্ণ জিনের বেস পেয়ারের তালিকা আমাকে জানতে হয়, তাই বিশাল তথ্যকেন্দ্রের সাথে আমার মস্তিষ্ককে জুড়ে দিয়েছি। আমি সরাসরি তথ্য নিতে পারি। মস্তিষ্ককে জীবাণুমুক্ত রাখার জন্য আমার মস্তিস্কে জীবাণু–নিরোধক তরল পাঠাতে হয়, মস্তিষ্ককে সতেজ রাখার জন্য উত্তেজক ওষুধ পাঠাতে হয় সে জন্য খুলির ভিতরে ক্রায়োজেনিক পাম্প বসিয়েছি।
আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে, গ্রুটাসের বীভৎস মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি ইচ্ছে করে এই জীবনপদ্ধতি বেছে নিয়েছ?
গ্রুটাস হঠাৎ ছটফট করে সরসর করে ছিটকে গিয়ে চিৎকার করে বলল, তুমি সীমানা অতিক্রম করছ নির্বোধ মানুষ। আমি ইচ্ছে করে এই জীবনপদ্ধতি বেছে নিয়েছি নাকি বাধ্য হয়ে নিয়েছি তাতে তোমার কিছুই আসে–যায় না।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, ঠিকই বলেছ। আমার কিছুই আসে–যায় না।