পরদিন টিশা কাজে এল না। আমাদের মতো মানুষদের কাজে না আসা খুব গুরুতর ব্যাপার, কেন আসেনি তার একশ রকম কৈফিয়ত দিতে হয়। কৈফিয়ত পছন্দ না হলে নানারকম উপদেশ দেওয়া হয়, সেই উপদেশ শাস্তি থেকেও ভয়ংকর। উপদেশে কাজ না হলে সত্যিকারের শাস্তি দেওয়া হয়–শাস্তিটা কী ধরনের সে সম্পর্কে আমরা শুধু ভাসা ভাসা শুনেছি; সঠিক ধারণা নেই। শুধু এটুকু জানি শাস্তি দেওয়ার পর কেউ ঠিক হয়ে যায়নি, এরকম কোনো উদাহরণ নেই।
।তাই টিশা যখন কাজে এল না আমি তখন দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমরা অনেকে একসাথে কাজ করি, তাই ব্যাপারটা অন্য কারো চোখে পড়েনি। টিশা একা একা থাকে, সে যে আজ কাজে আসেনি সেটা কেউ লক্ষ করবে না আমি আগেই জানতাম।
সারাটি দিন আমি এক ধরনের দুশ্চিন্তা নিয়ে কাটালাম। বিকেল বেলা কাজ শেষ হওয়ামাত্র আমি টিশাদের বাসায় হাজির হয়েছি। বারো তলা বাসা, আটতলার একটা ছোট ফ্ল্যাটে টিশা তার মাকে নিয়ে থাকে। আমি আগে এক-দুইবার তাদের ফ্ল্যাটে এসেছি। টিশার মা অনেকটা টিশার মতোন, চুল ছোট করে কাটা, খুব কম কথা বলে, চোখের দৃষ্টি কেমন জানি তীব্র।
দরজায় শব্দ করতেই টিশা দরজা খুলে দিল, বলল, “এসো। ভেতরে এসো রিহি।” তার কথা শুনে মনে হলো সে যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল।
আমি ভেতরে ঢুকলাম। টিশা দরজা বন্ধ করে বলল, “আমার মা এখনো বাসায় আসেনি। কিছুক্ষণের মাঝে চলে আসবে। মা চলে আসার আগে আমি তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই।”
“কী কথা?”
রান্নাঘরে খাবার টেবিলের পাশে চেয়ারটাতে বসার আগেই টিশা বলল, “তোমার মনে আছে মাথায় ক্রেনিয়াল লাগানোর জন্য লুক আর হুনাকেও নিয়ে গিয়েছিল, তাদের আর দেখা যায়নি?”
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, “মনে আছে।”
টিশা বলল, “তাদের কী হয়েছে আমি বের করেছি।”
আমি ভয়ানকভাবে চমকে উঠলাম, জিজ্ঞেস করলাম, “কী বের করেছ?”
টিশা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কিছু-একটা দেখে আমার দিকে ঘুরে তাকাল, “লুক আর হুনার কী হয়েছে।”
“কী হয়েছে?”
“তাদের মাথায় বাই-ক্রেনিয়াল লাগিয়েছে।”
“বাই-ক্রেনিয়াল? সেটা কী?”
“ক্রেনিয়াল লাগালে মাথার ভেতরে শুধু তথ্য দেওয়া যায়। বাই ক্রেনিয়াল হলে দুটো ইন্টারফেস লাগানো হয়। তখন যে রকম তথ্য দেয়া যায় সে রকম তথ্য নেওয়া যায়।”
“তারা এখন কোথায়?”
“এত দিন এখানে হাসপাতালে ছিল। আজ ভোরে একটা কনভয়ের সাথে তাদেরকে অন্য শহরে পাঠিয়ে দিয়েছে।”
“তারা যেতে রাজি হয়েছে?”
টিশা হাসার ভঙ্গি করল, সেই হাসিতে বিন্দুমাত্র আনন্দ নেই। বলল, “তোমার ধারণা তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো মূল্য আছে? নেই। আমি যতদূর জানি, বাই-ক্রেনিয়াল লাগানোর পর তাদের জ্ঞান ফেরেনি। কিংবা জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টাও করা হয়নি।”
আমি নিজের ভেতর এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি, আতঙ্কটুকু ঠিক কী নিয়ে বুঝতে পারছিলাম না। টিশাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কেমন করে এত কিছু জেনেছ?”
টিশা জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকাল, তারপর আবার মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল, বলল, “কাজটা খুব সহজ ছিল না। আমি অনেক দিন থেকে জানার চেষ্টা করছিলাম। লুক আর হুনার মায়ের সাথে কথা বলেছি। কুশ, মিকি আর ক্রিটনের সাথে কথা বলেছি। হাসপাতালের লোকজনের সাথে কথা বলেছি। আর—”
“আর কী?”
“কিছু বেআইনি কাজ করেছি।”
আমার বুক কেঁপে উঠল, “কী বেআইনি কাজ?”
“তাদের গোপন ভিডিও ডাউনলোড করেছি।”
“কেমন করে করেছ?”
“তোমাকে বললে তুমি বুঝবে না। কেমন করে করতে হয় আমি জানি। ভিডি টিউবে বই পড়ে শিখেছি। আমার মাথায় ক্রেনিয়াল নেই, তাই আমাকে কেউ সন্দেহ করে না। সবাই ধরে নিয়েছে আমি কিছু জানি না। আসলে আমি অনেক কিছু জানি।”
আমি এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে টিশার দিকে তাকিয়ে রইলাম। টিশা বলল, “কী হলো, তুমি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?”
“তুমি কি জান তুমি যেটা করছ সেটা কত বিপজ্জনক?”
“জানি।”
“যদি তুমি ধরা পড় তাহলে তোমার কী হবে তুমি জান?”
“জানি। আমাকে ডিটিউন করে দেবে।”
“তাহলে?”
“তাহলে কী?”
“তাহলে তুমি এত বড় ঝুঁকি কেন নিচ্ছ?”
টিশা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি এই শহরে আর থাকব না।”
আমি কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলতে পারলাম না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বললাম, “তুমি কোথায় যাবে?”
“আমি যাযাবর হয়ে যাব।” টিশা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল অবিশ্বাস্য এক ধরনের হাসি।
“তুমি যাযাবর হয়ে যাবে?”
“হ্যাঁ।”
“শহর থেকে তুমি বের হবে কেমন করে? তুমি জান না গেট সব সময় বন্ধ থাকে? সেন্ট্রিরা চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা দেয়?”
“আমি গেট দিয়ে বের হব না।”
“তাহলে কোন দিক দিয়ে বের হবে?”
“তোমার মনে নেই, প্রাচীরের নিচে একটা ফাঁক আছে? আমি সেই ফাঁক দিয়ে বের হয়ে যাব।”
“তারপর? তুমি হেঁটে হেঁটে কতদূর যাবে? পাঁচ কিলোমিটার যাবার আগে তোমাকে ধরে নিয়ে আসবে।”
“আমি হেঁটে হেঁটে যাব না, আমি মোটর বাইকে যাব। তুমি ভুলে গেছ আমার একটা মোটর বাইক আছে।”
আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। অবাক হয়ে টিশার দিকে তাকিয়ে রইলাম। টিশা বলল, “আমি তোমাকে বলিনি, তাহলে তোমাকেও বিপদে ফেলা হবে। আমি মোটর বাইকে পানি খাবার জমা করেছি। কষ্ট করে একটা অস্ত্র জোগাড় করেছি। কিছু যন্ত্রপাতি ওষুধপত্র, পুরানো একটা ম্যাপ–”
“ম্যাপ?”
“হ্যাঁ, এখান থেকে সোজা উত্তরে গেলে একটা বনভূমি পাবার কথা। সেখানে একটা হ্রদও আছে।”
আমি নিঃশব্দে বসে রইলাম। টিশা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি তোমাকে কেন এসব কথা বলছি জানি না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “মনে হয় সব মানুষেরই কথা বলার একজন মানুষ থাকতে হয়। তুমি ছাড়া আমার কথা বলার কোনো মানুষ নেই তাই তোমাকে বলছি। কাজটা ঠিক হলো কি না বুঝতে পারছি না।”
ঠিক তখন খুট করে দরজা খুলে টিশার মা ঘরে ঢুকল। আমাকে দেখে একটু ভুরু কুঁচকে তাকাল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “টিশা আজকে কাজে যায়নি। তাই একটু দেখতে এসেছিলাম। এখন যাই।”
টিশার মা বলল, “বসো। এক কাপ পানীয় খেয়ে যাও। উত্তেজক পানীয়, তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের ভালো লাগবে।”
আমি বললাম, “আরেক দিন খাব। আজকে যাই।”
“টিশা কেন কাজে যায়নি বলেছে?”
আমি কী উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না। ইতস্তত করে বললাম, “না মানে, কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত
“হ্যাঁ। সব সময়েই কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু কী নিয়ে ব্যস্ত আমি বুঝি না। সব সময়ে মেয়েটাকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকি।”
আমি আর কোনো কথা না বলে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম। টিশা আমাকে চলন্ত সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল। টিশাদের বারো তলা দালান থেকে বের হয়ে আমি যখন সরু একটা রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছি তখন আমার পাশ দিয়ে চারজন সশস্ত্র সেন্ট্রি হেঁটে গেল। আমি তখনো বুঝতে পারিনি তারা টিশাকে ধরে নিয়ে যেতে যাচ্ছে। কমিউনের কার্যকরি পরিষদে দুপুর বেলা টিশাকে ডিটিউন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেওয়া হয়েছে।
.
ঠিক কী কারণ জানা নেই সেই রাতটি আমি বিচিত্র দুঃস্বপ্ন দেখে ছটফট করে কাটিয়ে দিয়েছি। পরদিন ভোরে গিয়ে দেখি আমাদের কর্মী বাহিনী কাজ না করে এখানে-সেখানে জটলা করে নিচু গলায় কথা বলছে। আমি একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
ছেলেটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি জান না? টিশাকে ডিটিউন করার জন্য ধরে নিয়ে গেছে।”
আমার মাথাটা ঘুরে উঠল। মনে হলো আমার পুরো জগৎটি মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে গেল। চোখের সামনে একটা দৃশ্য ফুটে উঠল, টিশা একটা মপ নিয়ে নর্দমার ময়লা পানি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, চোখের দৃষ্টি স্থির, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। আমি তাকে ডাকছি সে আমার দিকে ঘুরে তাকাচ্ছে না, যখন ঘুরে তাকাচ্ছে তখন আমাকে চিনতে পারছে না। মনে হলো আমার বুকের ভেতর কিছু একটা তছনছ হয়ে যাচ্ছে।
ছেলেটি আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল, বলল, “দেখো রিহি, তোমার নিশ্চয়ই খুব খারাপ লাগছে, আমরা দেখেছি তুমি আর টিশা খুব ঘনিষ্ঠ ছিলে কিন্তু কী করবে, মেনে নাও। তা ছাড়া আরো একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, তুমি নিজেও কিন্তু বিপদে আছ। টিশার পর যদি তোমাকে নিয়ে টানাটানি করে…”
ছেলেটি কথা বলে যাচ্ছিল, আমি কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল ছুটে বের হয়ে যাই কিন্তু আমাদের জেনারেটর ঘরের দরজা তালা মেরে দিয়েছে। কাজ শেষ হবার আগে বের হবার কোনো উপায় নেই।
আমি কীভাবে সারাটি দিন কাটিয়েছি আমি নিজেও জানি না। বিকেলে দরজা খুলে দেওয়ামাত্র আমি বের হয়ে ছুটতে থাকি। টিশাদের বারো তলা বিল্ডিংয়ের নিচে চলন্ত সিঁড়ির উপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে আমি আটতলায় টিশাদের ফ্ল্যাটে হাজির হলাম, দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। জানালার কাছে টিশার মা পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দরজায় শব্দ শুনে টিশার মা ঘুরে আমার দিকে তাকাল।
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “টিশা টিশা–”
টিশার মা বলল, “টিশা নাই। চলে গেছে।”
“কোথায় চলে গেছে?”
“আমি জানি না। কাল তুমি চলে যাবার পর চারজন সেন্ট্রি এসে তাকে ধরে নিয়ে গেছে। টিশা নাকি খুব ভয়ংকর একটা অপরাধ করেছে সেজন্য তাকে ডিটিউন করে দেবে।” টিশার মা এক মুহূর্তের জন্য থামল, তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “যাদেরকে ডিটিউন করা হয় তাদেরকে শেষবারের মতো তার আপনজনদের সাথে দেখা করার জন্য পাঠানো হয়। টিশাকেও পাঠিয়েছিল। তখন অনেক রাত।”
“টিশা-টিশা কী বলেছে?”
“কিছু বলেনি। সে যেন পালিয়ে যেতে না পারে তাই তার আঙুলে একটা ট্রাকিওশান লাগিয়ে দিয়েছিল। বাম হাতের কড়ে আঙুলে। লাল রঙের ট্রাকিওশান। বাইরে সেন্ট্রিরা অপেক্ষা করছে, ঘরের ভেতরে আমি আর টিশা।”
আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বললাম, “তখন?”
“তখন টিশা বলল, মা আমাকে একটা ধারালো চাকু দাও। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? টিশা বলল আমাকে জিজ্ঞাসা কোরো না। আমি তাকে একটা চাকু দিলাম। সেই চাকু নিয়ে সে তার ঘরে ঢুকে গেল। ঘরে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। বাইরে থেকে আমি শুধু একবার একটা যন্ত্রণার আর্তচিৎকার শুনতে পেলাম।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর?”
শেষ রাতে সেন্ট্রিরা টিশাকে নিতে এল। তার ঘরে ধাক্কা দিল। কেউ দরজা খুলল না। তখন তারা ধাক্কা দিয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেল। ভেতরে টিশা নেই। টেবিলের উপর ট্রাকিওশান লাগানো তার বাম হাতের কড়ে আঙুলটি পড়ে আছে। ট্রাকিওশানটা সিগনাল দিয়ে যাচ্ছে। আমার টিশা তার বাম হাতের কড়ে আঙুল কেটে ট্রাকিওশন আলাদা করে জানালার পাইপ বেয়ে নেমে গেছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না।” টিশার মা আমার দিকে অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তুমি জান বিহি, আমার মেয়ে টিশা কোথায়?”
আমি মাথা নাড়লাম, জানালাম যে আমি জানি না। টিশার মায়ের মুখে খুব বিচিত্র একটা হাসি ফুটে উঠল। আমায় চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আর কিছু জানতে চাই না। তুমি যাও। আগে হোক পরে হোক ওরা তোমাকে খুঁজে বের করবে।”
আমি টিশাদের ফ্ল্যাট থেকে ছুটে বের হয়ে এলাম। বুকের উপর থেকে একটা পাষাণ নেমে গেছে। ওরা টিশাকে ধরতে পারেনি। আমার টিশা একটা মোটর বাইকে করে মরুভূমির লাল বালু উড়িয়ে ছুটে যাচ্ছে। পৃথিবীর কোনো শক্তি তাকে ধরতে পারবে না। আমার টিশা যাযাবর হয়ে গেছে। আমিও যাযাবর হয়ে যাব। আমি জানি আমাকেও এখন পালাতে হবে। টিশাকে খুঁজে বের করতে হবে।
টিশাদের বাসা থেকে বের হয়ে আমি আমার অনাথ আশ্রমে ফিরে গেলাম না। টিশার একজন মা আছে, আমার কেউ নেই। আমি জন্মের পর থেকে অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি, অনাথ আশ্রমের ছেলেমেয়েগুলো আমার সবকিছু। তাদের কাছ থেকে আমার বিদায় নেয়া দরকার কিন্তু মনে হয় বিদায় নেওয়া হবে না। আমি শহরের শেষ প্রান্তে হেঁটে হেঁটে গিয়ে একটা ধসে যাওয়া দালানে ঢুকে গেলাম। পুরোটা বিধ্বস্ত হয়ে আছে, ভাঙা যন্ত্রপাতিতে বোঝাই। আমি কোথাও ভাঙা সিঁড়ি কোথাও ভাঙা দেয়াল কোথাও জং ধরা যন্ত্রপাতি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। একটা ফাটলের পাশে বসে আমি পুরো ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করলাম। আমাকে খুঁজে খুঁজে যদি সেন্ট্রিরা এখানে চলে আসে আমি এখানে বসে দেখতে পাব, তখন সাবধানে পাশের দালানে সরে যাব। আমার এখন কিছুতেই ধরা পড়া চলবে না। কিছুতেই না।
আমি এর আগে কখনোই ঠান্ডা মাথায় কিছু চিন্তা করে কোনো কাজ করিনি–যখন যেটা ইচ্ছে হয়েছে তখন সেটা করেছি। এই প্রথমবার আমার খুব ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে কাজ করতে হবে।
আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে, পালানোর জন্য একটা মোটর বাইক দরকার। মোটর বাইকটা বেশি বড় হতে পারবে না তাহলে প্রাচীরের ছোট ফুটো দিয়ে সেটা বের করা যাবে না। মোটর বাইকে যথেষ্ট পরিমাণ পাওয়ার থাকতে হবে–সেটি অবশ্যি সমস্যা নয়–এক সময় তেল-গ্যাস দিয়ে পৃথিবী চলত তখন পাওয়ার নিয়ে সমস্যা ছিল। এখন তেল-গ্যাস দিয়ে পৃথিবী চলে না, ফিউশান পাওয়ার ব্যবহার শুরু করার পর সারা পৃথিবীর শক্তির সমস্যা মিটে গেছে। শুধুমাত্র পরিত্যক্ত ব্যাটারিতে যে পরিমাণ শক্তি জমা আছে সেটা দিয়েই এই পৃথিবীর মানুষ আরো দু-চারশ বছর টিকে থাকতে পারবে।
শুধু মোটর বাইক হলে হবে না, আমার কিছু শুকনো খাবার দরকার, তার সাথে খাবার পানি। এক-দুটো অস্ত্র হলে আরও নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। কোনো রকম ঝামেলা তৈরি না করে কীভাবে এগুলো জোগাড় করা যায় আমি চিন্তা করতে থাকি।
অনেকক্ষণ চিন্তা করেও কোনো রকম ঝামেলা না করে এগুলো জোগাড় করার কোনো সহজ বুদ্ধি খুঁজে পেলাম না। তখন আমি অন্যভাবে চিন্তা করতে থাকলাম, বড় ধরনের ঝামেলা করেই কাজটা করা যাক। কিন্তু কাজটা যেন খুব দ্রুত শেষ করা যায়। সব শেষে অস্ত্র জোগাড় না করে প্রথমেই যদি অস্ত্রটা জোগাড় করি তাহলে সেই অস্ত্র দিয়ে শুকনো খাবার কিংবা পানি জোগাড় করা বিন্দুমাত্র কঠিন কাজ নয়। সেই অস্ত্র দেখিয়ে কারো কাছ থেকে একটা মোটর বাইক কেড়ে নেওয়া কোনো বড় ধরনের ঝামেলা নয়। আইন না ভেঙে এই কাজগুলো করা মোটেই সহজ নয়। কিন্তু যদি ঠিক করে ফেলি আইনটা যেহেতু ভাংতেই হবে সেটা ঠিকভাবেই ভাঙা হোক তাহলে সবকিছুই খুব সহজ। পুরো পরিকল্পনাটার একটাই সমস্যা, আমি এর আগে কখনো কোনো দিন আইন ভেঙে কিছু করিনি–আজ করতে হবে।
অস্ত্র জোগাড় করার কাজটা সবচেয়ে কঠিন হবার কথা কিন্তু আমার মনে হলো এই কাজটাই হবে সবচেয়ে সহজ। আমি আর টিশা কংক্রিটের প্রাচীরের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে অনেকবার শহরের মূল গেটের কাছে এসেছি, যে দৃশ্যটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে সেটি হচ্ছে গেটের সেন্ট্রি গেটে হেলান দিয়ে ঢুলু ঢুলু চোখে বসে আছে। এই গেট কয়েক মাসেও একবারের জন্য ভোলা হয় কি না সন্দেহ, তাই সেন্ট্রির কোনো কাজ নেই। কাজেই আধা ঘুমন্ত একজন সেন্ট্রির কাছ থেকে আচমকা একটা অস্ত্র কেড়ে নেওয়া কঠিন হওয়ার কথা নয়। তবে আমার চেহারায় পনেরো বছর বয়সের একটা ছেলের চেহারার ছাপ আছে, সেই ছাপটি রাখা যাবে না। কালিঝুলি মেখে প্রথমে চেহারার মাঝে একটা বীভৎস ভাব আনতে হবে।
কীভাবে পুরো পরিকল্পনাটা কাজে লাগানো হবে সেটি ঠিক করে নেবার পর আমি কাজে লেগে গেলাম। ধসে যাওয়া বিল্ডিংটা খুঁজে খুঁজে কিছু কালিঝুলি বের করে মুখে লাগাতে থাকি। চোখের নিচে, গালে এবং মুখটা ঘিরে কালো রঙের একটা আস্তরণ দিয়ে চেহারার মাঝে একটা ভয়ংকর ভাব ফুটিয়ে আনি। খুঁজে এক টুকরো কটকটে লাল রঙের কাপড়ের টুকরো পেয়ে গেলাম, সেটা মাথায় বেঁধে নিলাম, আয়না নেই বলে নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলাম না কিন্তু আমি অনুমান করতে পারছিলাম এখন আমার মোটামুটি একটা ভয়ংকর দর্শন চেহারা হয়েছে।
আমি তখন সাবধানে বিল্ডিং থেকে বের হয়ে কংক্রিটের প্রাচীরের দিকে ছুটতে থাকি। প্রাচীরের কাছাকাছি পৌঁছে কংক্রিটের টুকরোগুলোর আড়ালে থেকে গেটের দিকে এগোতে থাকি। গেটের কাছাকাছি পৌঁছে আমি মাথা তুলে উঁকি দিলাম। যা ভেবেছিলাম তাই, সেন্ট্রি গেটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে, অস্ত্রটা দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখেছে।
আমি পা টিপে টিপে তার দিকে অগ্রসর হতে থাকি, ঠিক কী কারণ জানা নেই আমি নিজের ভেতর বিন্দুমাত্র ভয়ভীতি টের পেলাম না। নিজের ভেতরে বিচিত্র এক ধরনের আত্মবিশ্বাস। আমি নিশ্চিতভাবে জানি কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই আমি কাজটা শেষ করতে পারব।
সেন্ট্রিটার খুব কাছে পৌঁছানোর পর হঠাৎ কী কারণে সেন্ট্রি চোখ খুলে আমার দিকে তাকাল। আমি তখন আর দেরি না করে এক লাফ দিয়ে তার অস্ত্রটা হাতে তুলে নিয়ে তার দিকে তাক করে বললাম,
“দুই হাত উপরে তুলে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ো!”
মানুষটা একটু দ্বিধা করছিল। আমি তখন চিৎকার করে বললাম, “খবরদার! দেরি করলেই গুলি!” শুধু যে কথাটা উচ্চারণ করেছি তা নয় মুহূর্তের জন্য মনে হলো দেরি করলে সত্যি বুঝি গুলি করে দিতে পারব।
মানুষটা তখন সত্যি সত্যি উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল, দুই হাত মাথার উপর উঁচু করে রাখা। আমি কাছে গিয়ে তার বেল্টটা খুলে নিয়ে হাত দুটো পেছনে বেঁধে নিলাম। তারপর তার গলার স্কার্ফটা খুলে সেন্ট্রির মুখটা শক্ত করে বেঁধে দিলাম। নির্জন এই জায়গা থেকে তার ছুটে আসতে দশ পনেরো মিনিট লেগে যাবে, আমাকে তার মাঝে কাজ শেষ করে ফেলতে হবে। অস্ত্রটাকে দেখে অনেক ভারী মনে হয় কিন্তু সেটা আশ্চর্য রকম হালকা। আমি সেটা হাতে নিয়ে রাস্তা ধরে ছুটতে থাকি, প্রথম যে মোটর বাইক চোখে পড়বে সেটা ছিনিয়ে নিতে হবে।
প্রথম মোটর বাইকে একজন মা তার ছোট মেয়েকে পেছনে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাই তাকে ছেড়ে দিলাম। দ্বিতীয় মোটর বাইকে পাহাড়ের মতো বিশাল একজন মানুষ যাচ্ছে, তাকেও ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমার হাতে সময় নেই তাই ছোটখাটো একটা হুংকার দিয়ে তার সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মানুষটা অবাক হয়ে মোটর বাইক থামাল, আমি চিৎকার করে বললাম, “নেমে যাও! এই মুহূর্তে, না হলে গুলি করে দেব।”
আমার কথা শুনে মানুষটা এত অবাক হলো যে সেটি বলার মতো নয়, আমাদের এই শহরে এর আগে কখনোই কেউ কারো কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেনি। একজনকে অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখিয়ে যে কিছু একটা ছিনিয়ে নেয়া যায় এই শহরের মানুষেরা সেটা জানে না। মানুষটা আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করল না, মোটর বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল।
আমি লাফিয়ে সেটার উপর উঠে মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেলাম। বড় কাজ দুটি শেষ, এখন কিছু শুকনো খাবার আর পানি জোগাড় করতে হবে। এই পথে একটা দোকান আছে কিন্তু সেখানে মানুষের ভিড় হবে বলে সেখানে না গিয়ে একটা ছোট অনাথ আশ্রমে হানা দিলাম। আমাকে দেখে সেখানে ছোট শিশুরা আতঙ্কে ছোটাচ্চুটি করতে থাকে, আমার কাজটি সে জন্যে সহজ হয়ে গেল। আমি অস্ত্র উঁচিয়ে চিৎকার করে বললাম, “দশ সেকেন্ডের মাঝে দশ গ্যালন পানি আর দশ কেজি শুকনো খাবার-এক সেকেন্ড দেরি হলে সবাইকে খুন করে ফেলব।”
দশ সেকেন্ডের মাঝে এগুলো দেওয়া সম্ভব না, আমার পক্ষেও কাউকে খুন করা সম্ভব না কিন্তু অনাথ আশ্রমের ম্যানেজার মেয়েটির এগুলো জানার কথা নয়–সে ছোটাচ্চুটি করে খাবার আর পানির প্যাকেট আনতে থাকে।
এক মিনিটের মাঝে আমি সেখান থেকে বের হয়ে প্রাচীরের দিকে ছুটতে থাকি। প্রাচীরের ঠিক কোন জায়গাটিতে গর্ত সেটি আমি বেশ ভালোভাবে জানি। জানি, সেটার উপর ভরসা করেই আমি সেদিকে ছুটে যেতে থাকি।
ঠিক তখন অনেক দূর থেকে সাইরেনের বিকট শব্দ শুনতে পেলাম। আমি আমাদের এই শহরে কখনো কোনো বড় ধরনের অপরাধ ঘটতে দেখিনি। কিছু একটা ঘটে গেলে কী করতে হয় মনে হয় কারো ভালো করে জানা নেই। তাই আমাকে ধাওয়া করার জন্য সশস্ত্র বাহিনীকে প্রস্তুত করে আনতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গিয়েছে।
প্রাচীরের কাছে পৌঁছে আমি যখন গর্তটাকে খুঁজে বের করে তার ভেতরে ঢুকে মোটর বাইকটাকে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি তখন বাইরে সশস্ত্র বাহিনীর গাড়িগুলো হাজির হয়েছে। তারা যখন আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন আমি প্রাচীরের অন্য পাশে বের হয়ে গেছি। মোটর বাইকের বাতি নিভিয়ে আমি নিঃশব্দে মরুভূমির লাল বালু উড়িয়ে ছুটে যেতে থাকি।
প্রাচীরের উপর সার্চলাইট জ্বালিয়ে নিরাপত্তা রক্ষা বাহিনী যখন আমাকে খুঁজে বেড়াতে শুরু করেছে তখন আমি শহর থেকে বহুদূরে চলে এসেছি। আমাকে তারা আর কোনো দিন খুঁজে পাবে না।
কিন্তু আমার টিশাকে খুঁজে পেতে হবে। পেতেই হবে।