০৫.
পরদিন একেনবাবুর বাড়িতে গিয়ে শুনলাম যে, উনি অজয়কে ফোনে ধরতে পেরেছেন। অজয় খুব ব্যস্ত। বাড়িতে দেখা হবে না, তবে সন্ধ্যার সময়ে অগ্রগামী লাইব্রেরিতে কিছুক্ষণের জন্য আসবে। সেখানে আমাদের মিনিট দশ-পনেরো সময় দিতে পারে। দ্যাক্স ইট।
ঠিক হ্যায়, সন্ধ্যার সময়ই সবাই যাব।
একেনবাবু দেখলাম অগ্রগামী লাইব্রেরির উপর একটু চটা। বললেন, “যাই বলুন স্যার, যাচ্ছেতাই সার্ভিস লাইব্রেরিটার। নিউ ইয়র্কের কমুনিটি লাইব্রেরিগুলোতে গিয়ে এদের ট্রেনিং নেওয়া উচিত।”
বিরক্তির কারণটা একটু বাদেই জানলাম। একেনবউদির কার্ড হারিয়ে যাওয়ায় নতুন কার্ড করাতে কয়েকদিন আগে বউদিকে নিয়ে লাইব্রেরি গিয়েছিলেন। আধ ঘণ্টা লাগবে কার্ড বানাতে। বেশ কিছু ফেরত দেওয়া বই একটা টেবিলে জমা করা আছে, মনে হয় খানিক বাদে বাদে ওগুলো র্যাকে তোলা হয়। বউদির পছন্দের একটা বই ওখানে দেখতে পেয়ে চাইতেই ডেস্ক-লাইব্রেরিয়ান বললেন, কার্ড না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কারণ বইয়ের কার্ড আর মেম্বারশিপ কার্ড একসঙ্গে ক্লিপ করে জমা রেখে বই ইস্যু করা হয়।
একেনবাবু বললেন, “আধ ঘণ্টা বাদেই তো কার্ডটা পেয়ে যাবেন!”
কে শোনে?
একেনবাবুর মাথায় একটা প্রশ্ন জাগল। লাইব্রেরিয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার, যদি দুটো বই চাই, কার্ড তো একটা?”
“তাহলে দুটো কার্ড লাগবে। যতগুলো বই একসঙ্গে নিতে চান, ততগুলো কার্ড করাতে হবে।”
অত্যন্ত সেকেলে নিয়ম! একেনবাবু ঠিক করলেন সুযোগ পেলে কর্মকর্তাদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে হবে। তিনটে বই নিতে চাইলে তিনটে কার্ড? ননসেন্স!
ওঁরা যখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কার্ড আসার অপেক্ষা করছেন, একটি সুন্দরী মেয়ে এসে টেবিলে রাখা আরেকটা বই চাইতেই কার্ড না নিয়েই লাইব্রেরিয়ান বইটা ইস্যু করে দিলেন। একেনবাবু সেটা দেখতে পেয়ে প্রশ্ন তুলতেই লাইব্রেরিয়ান বললেন, ‘কার্ডটা ওঁর গাড়িতে আছে, ড্রাইভার এখুনি এসে দিয়ে যাবে।’
আসল ব্যাপারটা পরে জানা গেল, মেয়েটি লাইব্রেরির এক ট্রাস্টির মেয়ে!
.
প্রমথ কাহিনিটা শুনে বলল, “ওগুলো বাজে কথা, সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। আপনি যদি আঠেরো-উনিশ বছরের তন্বী হতেন, আপনিও বইটা পেতেন। হুমদো মোটা লোক হলেও পেতেন, তবে কিনা ডেস্ক-লাইব্রেরিয়ানের হাতে দশ-বিশ টাকা ধরিয়ে দিতে হত। আপনার তো জানা উচিত। পুলিশে চাকরি করতেন এতদিন… দেশটা তো এভাবেই চলে।”
“জানি স্যার, ভেরি ব্যাড।”
“আপনার কিন্তু ওই মেয়েটিকে কনফ্রন্ট করা উচিত ছিল,” আমি বললাম। “কেন বাবার সুবাদে এভাবে অ্যাডভান্টেজ নিচ্ছে?”
“সেটা মন্দ বলেননি স্যার। এবার যখন দেখা হবে সেই প্রশ্নটাই করব।”
“তার মানে?”
“মানে স্যার, মেয়েটি হলেন মিস শ্রীময়ী। কাল ছবি দেখেই চিনতে পারলাম।”
.
সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় অজয় যেতে বলেছিল। আমরা তার কিছুক্ষণ আগেই গিয়ে পৌঁছোলাম। মোবাইলে ফোন করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই একজন সুবেশ যুবক অজয় বলে নিজের পরিচয় দিল। তারপর বলল, “কী ব্যাপার বলুন তো, আমার খোঁজ কেন করছেন?”
একেনবাবু ইনিয়ে বিনিয়ে আসল কারণটাতে পৌঁছোনোর আগেই অজয় বলল, “দেখুন, আমি তাস লুকিয়ে খেলি না। শুভংকরবাবু আপনাকে অ্যাপয়েন্ট করেছেন কে তাঁর মেয়েকে চিঠি লিখছে আর কে তাঁকে ভয় দেখাচ্ছে বার করতে, তাই তো?”
“অনেকটা তাই স্যার।”
“তার উত্তর হল, আমি চিঠি লিখছি, কিন্তু আমি ভয় দেখাচ্ছি না। কারণ তার কোনো প্রয়োজন আমার নেই। শ্রীময়ীকে আমি ভালোবাসি, আমি ওকে বিয়েও করব। শ্রীময়ীর বাবা আপনার মতো একশো গোয়েন্দা দিয়েও সেটা আটকাতে পারবেন না।”
একেনবাবু বললেন, “কিন্তু স্যার, উনি যদি বিয়ে না দেন।”
“ওঁকে বিয়ে দিতে হবে কেন, শ্রীময়ী যেদিন আঠেরো বছরে পা দেবে, সেদিনই আমরা বিয়ের রেজিস্ট্রেশনের জন্য অ্যাপ্লাই করব। শুভংকর কুণ্ডু সেটা ঠেকাতে পারবেন?”
“কিন্তু স্যার, উনি তো ওঁর সম্বন্ধ অন্য জায়গায় করেছেন!”
“সে বিয়ে হবে না, কারণ শুভংকরবাবুর মারণাস্ত্র আমার হাতে আছে।”
“কী স্যার সেটা?”
“সেটা আপনাকে বলব কেন?” কথাটা শেষ করতে না করতেই অজয়ের ফোন বাজল। “আপনি এসে গেছেন? হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি আসছি…” বলে হাত তুলে আমাদের বাই’ বলে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
আমরা অবশ্য অত দ্রুত বেরোতে পারলাম না। আমার সঙ্গে একটা ব্যাগ ছিল, সেটা খুলে সিকিউরিটিকে দেখাতে হবে। আমার আগে জনা দুই ছিল। তারা আবার অনেক বই নিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো ইস্যু করা হয়েছে কিনা দেখতেও একটু সময় লাগল। তবে একই নিয়ম সবার জন্য নয়। যে হেড লাইব্রেরিয়ান সেদিন বললেন, সব কর্মচারীদের ব্যাগ চেক করা হয়। উনি নিজেই আমার সামনে একটা বড় ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, সিকিউরিটি টু শব্দ করল না।
.
০৬.
এরমধ্যে একদিন শুভংকরবাবু এলেন। কেসটা এতটুকু এগোয়নি দেখে মনে হল বেশ ক্ষুণ্ণ হয়েছেন।
“আপনার কত খরচ হয়েছে?” একেনবাবুকে প্রশ্ন করলেন।
“বিশেষ কিছুই নয় স্যার।”
“তাও এই টাকাটা রাখুন,” বলে একটা পাঁচ হাজার টাকার চেক হাতে ধরিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, “ভেবেছিলাম, ব্যাপারটার একটা কিনারা করে ফেলবেন, কিন্তু কিছুই পারলেন না! বিয়ের বন্দোবস্ত করছি, অথচ কী ঘটতে চলেছে জানি না।”
আমরা সবাই চুপ।
“আমাদের বনেদি পরিবার। আমার বাবা ও জ্যাঠা এখনও বেঁচে। শেষে অঘটন ঘটলে তার পরিণতি কী হবে, সেটা আপনারা কতটা বোঝেন জানি না।”
আমরা সবাই বাঙাল, বাপ-ঠাকুরদা উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে এসেছেন। বনেদিয়ানা বস্তুটা কী সেটা আমরা বুঝি না, সেইজন্যই নিশ্চয় মন্তব্যটা করা।
“আমারা আপ্রাণ চেষ্টা করছি স্যার,” একেনবাবু সাফাই গাইলেন।
“বহু পড়াশুনো করে ফেল করলেও সেটা ফেলই,” বলে ভদ্রলোক উঠে পড়লেন।
শুভংকরবাবু চলে যেতে আমি বললাম, “ভদ্রলোক বোধহয় জবাব দিয়ে গেলেন।”
প্রমথ বলল, “বোধহয়’ কথাটা আর জুড়ছিস কেন। সোজা ফুটিয়ে দিয়ে গেলেন। তখনই আমি বলেছিলাম, এইসব ঘেঁদো কাজ না নিতে!”
এরমধ্যে আমি আর প্রমথ দু-দিনের জন্য শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে শুনলাম মস্ত সুখবর, একেনবউদি অবশেষে আমেরিকা যেতে রাজি হয়েছেন। একেনবাবু খুশীতে ডগমগ। বললেন, “বুঝলেন স্যার, ফ্যামিলিকে যে শেষ পর্যন্ত রাজি করাতে পারব ভাবিনি। এবার আমেরিকাতে গিয়ে কোনো দুর্ভাবনা থাকবে না। ফ্যামিলি দূরে থাকলে স্যার, বুঝতেই তো পারছেন… একটা টেনশন।”
প্রমথ গম্ভীর ভাবে বলল, “আপনিও টেনশন-মুক্ত, আমরাও।”
“কেন স্যার?”
“এতদিন আপনার হ্যাপা সামলাতে সামলাতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। এখন আপনিও বউদিকে নিয়ে নিরিবিলিতে থাকবেন, আমাদেরও ঝাড়া হাত-পা।”
“কেন স্যার, আমি কি এতই জ্বালিয়েছি আপনাদের?”
“প্রমথর কথা ছাড়ুন তো! ওখানে গিয়ে আপনাদের জন্য কাছাকাছি একটা জায়গা দেখতে হবে।”
“বাপি কাছাকাছি কেন বলছে জানেন তো? যাতে বউদির রান্না যখন তখন গিয়ে খেয়ে আসতে পারে।”
“কী আশ্চর্য স্যার, ফ্যামিলি ওখানে থাকলে আপনারা অন্য কোথাও হাবিজাবি খাবেন, এটা কি হয় নাকি?”
“কেন মশাই, আমি কি বাজে রাঁধি?” প্রমথ তেড়ে উঠল।
“না, না, তা নয় স্যার। ফ্যামিলি খুশি হবে আপনারা খেলে। আপনাদের খুব পছন্দ করে ও।”
কথাটা মিথ্যে নয়, একেবউদি একজন গ্র্যান্ড বউদি। একেনবাবু বাঙাল, কিন্তু উনি কলকাতার মেয়ে। এত যত্ন করেন আমাদের দুজনকে, মনে হয় আমরা ওঁর আপন ভাই।
আদরের তাড়নায় প্রমথ তো একদিন বলেই ফেলল, “আপনি বড় বাড়াবাড়ি করেন বউদি!”
“কী যে বলেন ভাই, ওঁকে তো আমি চিনি, আপনারা দু-জন ওখানে না থাকলে কোথায় খেত, কী করত, ভাবতেও ভয় করে।” তারপর একটু মিষ্টি হেসে বললেন, “উনি কী বলেছেন জানেন?”
“কী?”
“আপনাদের বৌ খোঁজার জন্য নাকি আমাকে চেষ্টা করতে হবে।”
“রক্ষে করুন বউদি, ওইটি করবেন না,” আমি বললাম। “দেশে আসা ছেড়ে দেব ভাবছিলাম মায়ের বিয়ের তাগিদের জন্য। এখন ওখানে গিয়ে যদি আপনার তাগাদা শুরু হয়, তাহলে ইউরোপে কোথাও চাকরির খোঁজ করতে হবে। তবে হ্যাঁ, প্রমথ আর ফ্রান্সিস্কার বিয়েটা মনে হয় আপনাকেই ওখানে দিতে হবে। এখানে ও খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছে না।”
“চুপ কর শালা! সরি বউদি, বাপিটা এত ইডিয়টের মতো কথা বলে, মাথা ঠান্ডা রাখা কঠিন হয়ে যায়।”
“থাক ভাই, বউদির কাছে আর অত লজ্জা পেতে হবে না।”
“একটু পাওয়া ভালো বউদি,” আমি বললাম। “তাতে যদি মুখটা একটু শুদ্ধ হয়। ভাগ্যিস ফ্রান্সিস্কা বাংলা জানে না, নইলে আউট-রাইট ওকে রিজেক্ট করত।”
“করত না, কারণ গালাগালগুলো আমি তোকে দিই– এ ট্রলি ডিসার্ভিং ক্যান্ডিডেট। চাস তো খিস্তিগুলো ট্রান্সলেট করে বলে দিস, তারপর দেখিস কী রিয়্যাকশন হয়।”
“মাপ কর, ওগুলো আন্-ট্রানস্লেটেবল।”
যাক সে কথা, একেনবাবু আর একটা মোক্ষম খবর দিলেন। শুভংকরবাবু শেষ পর্যন্ত মেয়ের ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি ঠিক করেছেন অজয়ের সঙ্গেই শ্রীময়ীর বিয়ে দেবেন। হঠাৎ এই অ্যাবাউট টার্নের কারণটা একেনবাবু সঠিক জানেন না। যদিও আমি আঁচ করতে পারছিলাম যে, পাত্রপক্ষের কাছে অপমানিত হবার মানসিকতা ওঁর ছিল না। সংসারে কিছু কিছু লোক আছে যারা জীবনে কারোর কাছে নীচু হতে বা খোঁটা খেতে রাজি নয়। তারা যা করবে, যা ভাববে, সেটাই চূড়ান্ত ও শেষ কথা। তিনি নিজেই সম্বন্ধ ভেঙে অজয়ের সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছেন মাথা উঁচু করে। নিশ্চয় বিয়ে ভেঙে দেবার একটা কারণও জানিয়েছেন পাত্রপক্ষকে। বলেছেন, কেন পাত্রকে বা তার পরিবারকে ওঁর পছন্দ হয়নি। একেনবাবু অবশ্য শুভংকরবাবুর কাছ থেকে ব্যাপারটা শোনেননি। সুবীর এর মধ্যে ফোন করেছিল একদিন, তার কাছেই জেনেছেন।
প্রমথ বলল, “চেকটা ক্যাশ করেছেন তো? তাড়াতাড়ি করুন, নইলে ওটা হয়তো স্টপ পেমেন্ট করে দেবেন– সব কিছু যখন মিটেই গেছে।”
.
০৭.
আমাদের আমেরিকা ফিরে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে। এরমধ্যে একদিন সকালে একেনবাবুর বাড়িতে বসে গল্প করছি, প্রমথ এল। হাতে একটা বই, ‘টেররিস্ট এন্ড কেমিক্যাল ওয়ারফেয়ার’। আমি ওর কাছ থেকে বইটা নিয়ে পাতা উলটোতে উলটোতে বললাম, “তোর হল কী, এইসব পড়ছিস!”
“হাতে নিয়ে ঘুরছি, পড়ছি না তো!”
“হাতে নিয়েই বা ঘুরছিস কেন?”
“আর বলিস না, আমার মেসো গতকাল জোর করে হাতে ধরিয়ে দিল… এই দুর্দান্ত বই নাকি সকলের পড়া উচিত! ‘না’ বলতে পারলাম না, আজ গিয়ে ফেরত দেব।”
“না পড়েই?”
“কেন, তাতে হয়েছে কী, মেসো তো আর পরীক্ষা নিতে যাচ্ছে না?”
“তুই অত্যন্ত ডিজঅনেস্ট।”
“চুপ কর, জ্ঞান দিস না। ও ভালোকথা, অগ্রগামী লাইব্রেরির সেই ডেস্ক-লাইব্রেরিয়ান মারা গেছেন, শুনেছিস?”
“তুই কী করে জানলি?”
“গতকাল মেসোর বাড়িতেই শুনলাম। মাসতুতো ভাই খুব নাটক-ফাটক করে। ওদের দলের সঙ্গেই ওই ডেস্ক-লাইব্রেরিয়ান অভিনয় করেতেন। দুর্দান্ত অ্যাক্টর। হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে কয়েকদিনের মধ্যেই গন।”
“কীসে মারা গেলেন স্যার, ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় নাকি?”
আমি জানি ওটাতে একেনবাবুর দারুণ ভয়। খুঁজে খুঁজে পত্রিকায় দেখেন ক-জনের ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়েছে।
“তা বলতে পারব না। তবে জ্বর, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, রক্তবমি– এইসব নাকি উপসর্গ ছিল। সম্ভবত হার্ট অ্যাটাক।”
আমি বললাম, “অসম্ভব নয়। তবে হার্ট অ্যাটাকে কি রক্তবমি হয়?”
“নির্ঘাত ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া স্যার,” একেনবাবু বললেন। “আমরাও তো লাইব্রেরিতে গেছি। বেশ কয়েকটা মশা ছিল স্যার ওখানে। আমাদের না হলে বাঁচি!”
“ছাড়ুন তো মশাই, অত ভয় থাকলে নিউ ইয়র্কে গিয়ে বসে থাকুন!”
প্রমথর ধমকে বোধহয় একটু কাজ হল। একেনবাবু কিছুক্ষণের জন্য চুপ করলেন।
আমি প্রসঙ্গ পালটাবার জন্য বললাম, “কী একেনবাবু, শুভংকরবাবু কি মেয়ের বিয়েতে আপনাকে নেমন্তন্ন করবেন বলে মনে হয়?”
“কে জানে স্যার, তবে না করলেই বাঁচি?”
“কেন মশাই, গিফট কিনতে হবে বলে?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
“কী যে বলেন স্যার!”
“ঠিকই বলি, আপনার মাথা কোন দিকে যায়, সেটা আমার জানা আছে। তবে চিন্তার কী আছে, সস্তার গিফট দেবেন আর পেট পুরে খাবেন। পয়সা দিব্বি উশুল হবে।”
“আপনি না স্যার, সত্যি!”
“ঠিক আছে, আর জ্বালাব না। আর ফ্র্যাঙ্কলি এ নিয়ে আপনার চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। শুভংকরবাবু দু-সপ্তাহের জন্য ইংল্যান্ড না কোথায় জানি যাচ্ছেন, তিনি ফিরলে তারপর বিয়ের আয়োজন হবে। তার আগেই আমরা নিউ ইয়র্কে।”
“তুই এত কথা জানলি কী করে?”
“ইংল্যান্ড কিনা জানি না, তবে বাইরে যাচ্ছেন সেটা অজয়ের কাছে শুনলাম।”
“অজয়ের কাছে?”
“হ্যাঁ। মেসোর বাড়ি থেকে ফেরার পথে চানাচুর কিনতে উজ্জ্বলায় থেমেছিলাম। বিশাল লাইন, সেখানে অজয়ের সঙ্গে দেখা। অবাকই হলাম আমাকে চিনতে পেরেছে দেখে। একেনবাবুর কথা জিজ্ঞেস করল। বলল, মনে হচ্ছে আপনার গোয়েন্দা-বন্ধু আমাদের বিয়েটা আটকাতে পারলেন না। তখনই শুভঙ্করবাবুর বাইরে যাবার খবরটা বলল।”
আমি একেনবাবুকে বললাম, “দেখুন তো, কাজটায় একটা পয়সাও পেলেন না, অথচ শুধু শুধু দুর্নাম কুড়োলেন।”
পত্রিকা টেবিল থেকে পত্রিকাটা তুলে একটু অন্যমনস্ক হয়ে একেনবাবু বললেন, “তাই তো দেখছি স্যার।” তারপরেই একটা আর্তনাদ, “সর্বনাশ স্যার!”
“কী হল মশাই?”
“দেখেছেন পত্রিকার খবর?”
“কী?”
অগ্রগামী লাইব্রেরির আরও দু-জন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে… জ্বর, শ্বাসকষ্ট, রক্তবমি। ঠিক ওই লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোকের মত। আমি বলছি স্যার, ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া ছাড়া এটা আর কিছুই হতে পারে না। আই অ্যাম ইন ডিপ ট্রাবল স্যার।”
“আপনি তো আচ্ছা পাগল! গন্ডায় গন্ডায় লোক লাইব্রেরিতে প্রতিদিন যাচ্ছে, কারো কিছু হচ্ছে না, শুধু আপনারই হবে?”
“হবে স্যার, হবে। আমার ভীষণ ছোঁয়াচে রোগ হয়।”
এমন সময়ে একটা গাড়ি বাড়ির সামনে এসে থামল। গাড়ি থেকে নামল সুবীর। ঘরে ঢুকে একেনবাবুর হাতে একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বলল, “মামা একটু আগে এয়ারপোর্টে চলে গেলেন। গাড়িতে ওঠার সময়ে ওঁর খেয়াল হল, আপনার পুরো ফি দেওয়া হয়নি। তাই ভাগ্নের উপর দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।”
“পুরো ফি! আমি তো কিছুই করলাম না স্যার।”
“সেটা আপনি মামা ফিরে এলে বলবেন, এখন তো এটা ধরুন।” বলে খামটা একেনবাবুর হাতে প্রায় জোর করে গুছিয়ে দিলেন।
খামটা টেবিলে রেখে একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় উনি যাচ্ছেন স্যার?”
“লন্ডনে। তারপর বোধহয় প্যারিসও যাবেন। মামার ডিসিশন সব সময়ই লাস্ট মোমেন্টে। যাইহোক গুনে নিন। দশ হাজার টাকা থাকার কথা।”
একেনবাবু বললেন, “সত্যি স্যার, এটা কিন্তু আমি নিতে পারি না। পাঁচ হাজার দিয়ে গেছেন, এখন আবার দশ হাজার! কিছু করারই তো সুযোগ পেলাম না!”
“সুযোগ পাবেন কী করে, মামা মত পালটালে? ধরে নিন, এটা ওঁর মত পালটাবার খেসারত। তবে ভালোই করেছেন মত পালটেছেন, অন্য জায়গায় বিয়ে হলে বোনটা অসুখী হত।”
“মতটা পালটালেন কেন স্যার?”
“তা তো বলতে পারব না, অজয়কে জিজ্ঞেস করুন। তবে এলেম আছে ছেলেটার!”
“বিয়েটা হচ্ছে কবে স্যার?”
“ডেট এখনও ঠিক হয়নি, মামা ফিরলে ফাইনালাইজড হবে। মনে হয় জানুয়ারির শেষে।”
“ভেরি ইন্টারেস্টিং! একটু চা বলি স্যার?”
“না, থ্যাঙ্ক ইউ। আমায় এখুনি বেরোতে হবে শ্রীময়ীকে নিয়ে, ড্রাইভার হঠাৎ ছুটি নিয়েছে।”
“ভালো কথা স্যার, আমরা একটু আগে আলোচনা করছিলাম অগ্রগামী লাইব্রেরিতে বেশ কয়েক জনের অসুস্থ হওয়া নিয়ে। মিস শ্রীময়ীকে ক’দিন অন্তত ওখানে না-যেতে বলবেন। যদি ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়, তাহলে কখন যে কী হয়ে যায়!”
“তাই নাকি, জানতাম না তো!”
“আজকের খবর, স্যার।”
“ঠিক আছে বলে দেব। লাকিলি ও বেশ কয়েকদিন লাইব্রেরিতে যায়নি জানি।”
“তাহলে তো চমৎকার। আরকটা প্রশ্ন স্যার, এই অগ্রগামী লাইব্রেরির একজন ট্রাস্টি তো আপনার মামা। আর ক-জন ট্রাস্টি আছেন?”
“আরও দু-জন, কেন বলুন তো?”
“লাইব্রেরি সিস্টেম-এর ইম্প্রভমেন্ট নিয়ে একটু আলোচনা করতাম। এই যে স্যার, এক-একটা বইয়ের জন্য এক-একটা কার্ড করা… যাক গে স্যার, ওঁদের সঙ্গে দেখা হলে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব। ওই দু-জন ট্রাস্টির নাম জানেন স্যার?”
একেনবাবু ঠিক কী বলতে চান, সুবীরের মাথায় ঢুকল না। কিন্তু উত্তরটা দিল, “অন্য দু-জন নামেই ট্রাস্টি। একজন বিকাশ দত্ত, হাঁটুর ব্যথায় শয্যাশায়ী, কানেও শোনেন না। মাঝে মাঝে মামার জন্য ওঁকে দিয়ে ট্রাস্টের কোনো কাগজে সই করাতে যা ঝামেলা হয়! আরেকজন সুরঞ্জন মিত্র। এখন মুম্বাইয়ে থাকেন, কালেভদ্রে কলকাতায় আসেন।”
“তাহলে তো এবার আলোচনাটা হবে না স্যার।”
“আপনি হেড লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। উনিই প্রায় চালান লাইব্রেরি।”
“বেশ, তাই বলব। থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।”
“আচ্ছা চলি।”
“আসুন স্যার।”
.
প্রমথ এই ফাঁকে পত্রিকাটা তুলে নিয়ে পড়ছিল। সুবীর চলে যেতেই বলল, “কী অসুখ হয়েছে কিছু না জেনে খামোকা ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার ভয় দেখালেন কেন বলুন তো? সিম্পটমগুলোও তো ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার নয়।”
“কেন স্যার?”
“এই যে রক্তবমি, জ্বর, বুকে ব্যথা– এগুলি কি সব ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াতে হয়?”
“জ্বর আর গায়ে ব্যথা তো হয় স্যার। হয়তো সেইসঙ্গে অন্য কোনো অসুখও হচ্ছে।”
হঠাৎ প্রমথর কাছ থেকে নেওয়া বইটার একটা পাতায় চোখ পড়ল। আমি আর ঠাট্টা করার লোভ সম্বরণ করতে পারলাম না। বললাম, “বুঝলেন, একেনবাবু, সিম্পটমগুলো সব অ্যানথ্রক্সের। নিশ্চয়, নিরীহ বুক-লাভারদের মারবে বলে ‘হেট-বুক’ টেররিস্টরা গুচ্ছের মশাকে অ্যানথ্রক্স খাইয়ে অগ্রগামী লাইব্রেরিতে ছেড়ে দিয়ে গেছে।”
প্রমথ যোগ করল, “শুধু বুক-লাভার কেন, ‘হেট-কলকাতা’ গ্রুপ মশা ব্যবহার করে সারা কলকাতাকেই ধ্বংস করতে পারবে। শুধু একটাই সমস্যা, মশা অ্যানথ্রক্স জীবাণু খেলেও ছড়াতে পারে না।”
একেনবাবু বোধহয় সেই সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হবার জন্যেই বইটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন।
“কি মশাই, ভয় দূর হয়েছে?”
একেনবাবু আমাদের হাসিঠাট্টায় কান না দিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন, “আই ওয়াজ এ ফুল স্যার, আই ওয়াজ এ ফুল।” তারপরেই ঘরে অদৃশ্য হলেন।
.
একেনবাবুর এইসব খ্যাপামিতে আমরা অভ্যস্ত। তাই চেঁচিয়ে বউদিকে বললাম, “বউদি আর এক কাপ চা হবে নাকি?”
খানিক বাদে একেনবাবু ফিরে আসতে প্রমথ বলল, “সেলফ-রিয়্যালাইজেশনটা এত লেটে হল কেন?”
“কী স্যার?”
“এই যে, ‘আই ওয়াজ এ ফুল’ কথাটা বললেন।”
“আই মে বি এ বিগার ফুল স্যার।”
“তার মানে?”
“তার মানে স্যার, এয়ারপোর্ট পুলিশকে শুভংকরবাবুর ব্যাগ সার্চ করতে বললাম।”
“কী বলছেন যা-তা!”
“তাই তো বলছি স্যার, আই মে বি এ বিগার ফুল।”
“দাঁড়ান, দাঁড়ান, কী ব্যাপার বলুন তো?”
“জানি না স্যার, একটা থিওরি, জাস্ট এ থিওরি।”
“আঃ, বলুন না ব্যাপারটা কী!”
“আগে চা-টা আসুক স্যার।”
.
০৮.
ইতিমধ্যে চা এসে গেছে।
একেনবাবু বললেন, “চা-টা আগে খান স্যার, তারপর বলছি।”
চা খাচ্ছি। একেনবাবু ঘন ঘন পা নাড়াচ্ছেন, কিন্তু কিছু বলছেন না! চা শেষ হতে না হতেই আরেকটা ফোন।
একেনবাবু প্রায় লাফিয়ে উঠে চলে গেলেন। তারপর একটু বাদে ফিরে এসে বললেন, “যাক স্যার, ডায়েরি দুটো পাওয়া গেছে।”
“কী পাওয়া গেছে?” জিজ্ঞেস করলাম।
“ডায়েরি দুটো স্যার, যেগুলো অগ্রগামী লাইব্রেরি থেকে চুরি হয়েছিল।”
“কোথায় পাওয়া গেছে?”
“শুভংকরবাবুর ব্যাগের মধ্যে।”
“দাঁড়ান মশাই, দাঁড়ান।” প্রমথ ধমকের সুরে বলল, “কোয়েশ্চেন-অ্যানসার-এর ফরম্যাট ছেড়ে পরিষ্কার করে বলুন। আমাদেরই এখন কনফিউসড করে দিচ্ছেন!”
“বলছি স্যার, বলছি। আসলে ব্যাপারটা সত্যিই বেশ গোলমেলে! আমার প্রথম থেকেই একটা সন্দেহ ছিল, শুভংকরবাবুর মত একজন ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোক– কেন এত বিচলিত হচ্ছেন একটা উড়ো চিঠি পেয়ে? না হয় ওঁর মেয়ের বিয়ে ভেঙেই যাবে। কিন্তু বংশ-মর্যাদা নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করা কেন… অবশ্য এই ‘অনার কিলিং’-এর খবর-টবর শুনে মনে হল স্যার, পরিবারের সুনাম রক্ষার জন্য বাপ যদি নিজের মেয়েকে পর্যন্ত খুন করতে পারে তাহলে তো সব কিছুই সম্ভব! সে যাইহোক, এবার রহস্যের কথায় আসি।
শুভংকরবাবু দুটো জিনিস বুঝতে পারছিলেন না। কী করে তাঁর চোখ এড়িয়ে মেয়ে চিঠি চালাচালি করছেন, আর কে চিঠিগুলো দিয়ে ওঁকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছেন। একজন সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেট হলেন যাঁকে ওর মেয়ে চিঠি লিখছেন। কারণ মেয়ের অন্য কোথাও বিয়ে হোক, তিনি অবশ্যই সেটা চাইবেন না। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে স্যার, তিনি ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করবেন কেন, বরং সোজাসুজি পাত্রপক্ষকে জানিয়ে বিয়েটা ভেস্তে দেবেন।”
“অথবা ডুডুও খাব, তামাকও খাব,” প্রমথ বলল। “ব্ল্যাকমেল করে টাকা হাতাবেন এবং পাত্রপক্ষকে জানিয়েও দেবেন।”
“পসিবল স্যার, অবশ্যই সম্ভব। কিন্তু এটাও সম্ভব যে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি এই সমস্ত ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু সে কথা আপাতত থাক। আগে আসি স্যার, চিঠি চালাচালির ব্যাপারটাতে। চিঠি চালাচালি যে অজয়বাবুর সঙ্গে মিস কুণ্ডু করছেন, সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই। রহস্য হল, কী ভাবে চিঠি চালাচালি হচ্ছে। কিন্তু একটু ভাবতেই বুঝলাম, ইট ইজ সো সিম্পল। লিস্ট থেকে পর পর একটা করে বই নেওয়া, আর সেই বইয়ের মধ্যে চিঠি ঢুকিয়ে লাভারকে পাঠানো।”
“দাঁড়ান মশাই, কী করে সেটা সম্ভব?” প্রমথ প্রশ্ন তুলল, “সে বই তো অন্য কারো হাতে যেতে পারে!”
“না স্যার, যে অ্যারেঞ্জমেন্ট ওঁরা করেছিলেন, তাতে পারে না। ভেবে দেখুন স্যার, একেবারেই অখ্যাত লেখকের অজানা বইয়ের লিস্ট। কে ওই বই পড়ার জন্য হাপিত্যেশ করে থাকবে! বইগুলো সব সময়েই লাইব্রেরিতে পাওয়া যাবে। আর বইগুলো ফেরত দেবার পরে সেগুলো আলমারিতে ওঠার আগেই আরেকজন বইটা ইস্যু করে নেবে। লাইব্রেরিতে যাবার টাইমিংটা ঠিক রাখতে পারলে তো এতে কোনো অসুবিধা থাকে না স্যার।”
আমি বললাম, “বুঝেছি। শ্রীময়ী এসে চিঠি-লুকোনো বইটা জমা দেবে, আর বইটা রিসিভ হয়ে র্যাকে যাবার আগেই অজয় সেটা নিজের নামে ইস্যু করাবে। তারপর নিজের চিঠি ঢোকানো বইটা জমা দেবে। শ্রীময়ী খানিক বাদে লিস্টের আরেকটা বই আলমারি থেকে তুলে এনে সেটা আর অজয়ের সদ্য জমা-দেওয়া বইটা লাইব্রেরিয়ানকে দিয়ে ইস্যু করিয়ে বাড়ি ফিরবে। অন্য কারো হাতে পড়ার সম্ভবনা নেই।”
“এক্সাক্টলি স্যার। সেটাই আমি দেখেছিলাম, যখন মিস শ্রীময়ী টেবিলে ফেরত আসা একটা বই ইস্যু করে নিলেন। তখন অবশ্য বুঝিনি ব্যাপারটা। কিন্তু প্রমথবাবু আমার চোখটা খুলে দিলেন।”
“আমি!”
“হ্যাঁ স্যার, আপনি বললেন না যে, টাকা ফেললে আমিও ওই ভাবে বই নিতে পারতাম। তখনই ক্লিয়ার হতে শুরু করল চিঠি চালাচালির সহজ প্ল্যানটা। অর্থাৎ এর জন্য একটা সাহায্যের দরকার। সেই সাহায্যটা করতে পারেন সার্কুলেশন ডেস্কে বসা লাইব্রেরিয়ান। আমার ধারণা স্যার অজয়বাবু ওকে টাকাপয়সা দিয়ে হাত করিয়ে এই বন্দোবস্তটা করেছিলেন। এটা স্যার চমৎকার চলছিল। লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোকও বুঝতে পারছিলেন কী হচ্ছে! মুশকিল হল, উনি লোভ সামলাতে পারেননি… সুন্দরী মেয়েকে লেখা প্রেমপত্র আর সুন্দরীর লেখা উত্তর… এগুলো কি না পড়ে পারা যায় স্যার? একটু সুযোগ পেলেই উনিও লুকিয়ে লুকিয়ে চিঠিগুলো পড়তে শুরু করলেন। মিস শ্রীময়ীর একটা চিঠির মধ্যেই অজয় পেয়ে গেলেন শুভংকরবাবুকে ঘায়েল করার মারণাস্ত্র আর ওই লাইেব্রিয়ানমশাই পেয়ে গেলেন তাঁর ব্ল্যাকমেলের হাতিয়ার।”
“মারণাস্ত্র!”
“হ্যাঁ স্যার, ওই ডায়েরি চুরির ব্যাপারটা। ওই ব্যাপারটা স্যার আমাকে একটু ভাবিয়েছিল। ছিঁচকে চোর ওটা চুরি করবে না, ওর মূল্যই বুঝবে না। একজন গবেষক তার মূল্য বুঝলেও, সেটা বিক্রি করবার যে মার্কেট, সেখানে সহজে ঢুকতে পারবে না। আপনাদের মনে আছে কিনা, আমরা যখন ডায়েরি দুটো দেখতে গিয়েছিলাম, তখন শুনেছিলাম দুটোই অদৃশ্য হয় লাইব্রেরির একজন ট্রাস্টি সেগুলো দেখে যাবার পরে। ট্রাস্টিদের একজন হলেন শুভংকরবাবু আর একমাত্র তিনিই গত দু-সপ্তাহের মধ্যে বেশ কয়েকবার লাইব্রেরিতে গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন অবশ্য মিস শ্রীময়ীকে পাহারা দেবার জন্য। ব্যবসার সূত্রে বিদেশে ওঁর অনেক কানেকশন আছে। উনি কি ডায়েরি-দুটো সরাতে পারেন? অসম্ভব নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা মিস শ্রীময়ীর চোখে পড়ে যাওয়াটাও খুবই সম্ভব। তারপর যখন মিসেস কুণ্ডুর কাছে শুনলাম লাইব্রেরি থেকে ফিরে বাবা আর মেয়ের তুমুল ঝগড়ার কথা, চিন্তা শুরু করলাম তার কারণটা কী হতে পারে? যে মেয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেছে, হঠাৎ কী এমন ঘটল, যার জন্য সেই মেয়ে বাবার ঘরে ঢুকে চেঁচামেচি করবে? আর মেয়ের সঙ্গে ঝগড়ার কারণটা শুভংকরবাবুই বা কেন স্ত্রীকে জানাবেন না? একটু স্ট্রেঞ্জ স্যার, তাই না? তাহলে কি এর সঙ্গে ডায়েরি-চুরির ব্যাপারটাই জড়িত?”
“কিন্তু শ্রীময়ী অজয়কে এটা জানাল কেন?”
“শুধু অনুমান করতে পারি স্যার। লাইব্রেরিতে বাবার এই আচরণে মিস শ্রীময়ী মনে মনে দগ্ধ হচ্ছিলেন। এমনিতেই শুভংকরবাবুর ওপর মিস শ্রীময়ীর রাগ ছিল, এখন তাতে ঘৃতাহুতি পড়ল… যে-বাবা বংশ-মর্যাদা রক্ষার জন্য অজয়বাবুর সঙ্গে ওঁর বিয়ে আটকাচ্ছেন, তিনি কিনা আত্মসম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে অম্লান বদনে ডায়েরি চুরি করছেন! কী শকিং! কাকে এটা জানাবেন, প্রিয়তমকে ছাড়া? কিন্তু ফলটা হল শুধু অজয়বাবু না, আমাদের লাইব্রেরিয়ানমশাইও এই গোপন তথ্যটি জেনে গেলেন। যে চিঠিতে শুভংকরবাবুকে ভয় দেখানো হয়েছিল, সেটা মেয়ের পুরোনো প্রেমের কথা ভাবি শ্বশুরবাড়িতে জানানো নিয়ে নয়, ডায়েরি চুরির ব্যাপারটা পুলিশকে জানিয়ে দেওয়া নিয়ে। এই কারণেই চিঠিটা স্যার শুভংকরবাবু আমার হাতে দেননি, পুলিশকেও ব্যাপারটা জানাতে চাননি। বুঝলেন স্যার, কী বলছি?”
“এ পর্যন্ত বুঝলাম, কিন্তু তারপর?”
“তারপর স্যার, শুভংকরবাবু আমাদের উপর ভরসা রাখতে পারলেন না। সোজা অজয়বাবুর দ্বারস্থ হলেন। ওঁর প্রথমে ধারণা হয়েছিল, হয়তো অজয়বাবুই মিস শ্রীময়ীকে পাওয়ার জন্য ওঁকে ভয় দেখাচ্ছেন। কিন্তু অজয়বাবুর সঙ্গে কথা বলে বুঝলেন, সেটা নয়। অজয়বাবুও সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন, আর কে ব্যাপারটা জানতে পারে, বিশেষ করে চিঠির একটা জেরক্স কপি যখন শুভংকরবাবু পেয়েছেন। এঁদের মধ্যে নিশ্চয় একটা চুক্তি হল, অজয়বাবু লোকটিকে খতম করবেন আর শুভংকরবাবু তাঁর কন্যাকে অজয়বাবুর হাতে সমর্পণ করবেন।”
“মাই গড,” আমি বললাম।
“কিন্তু অজয় এ প্রস্তাবে রাজি হল কেন? সে তো এমনিতেই শ্রীময়ীকে পাচ্ছিল!” প্রমথ প্রশ্ন তুলল।
“অর্থ অনর্থম স্যার। আমার ধারণা টাকার লোভে। মিস শ্রীময়ীকে হয়তো পেতেন, কিন্তু শ্বশুরের সম্পত্তি পেতেন না। এক্ষেত্রে দুটোই মিলল। যেমন শ্বশুর, তেমনি জামাই স্যার। অজয়বাবু এলেমদার লোক, আন্ডারগ্রাউন্ড গ্রুপের সঙ্গে কানেকশন ওঁর নিশ্চয়। ছিল। সেই সূত্রেই অ্যানথ্রক্সের মতো ভয়াবহ পাউডার উনি সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। লাইব্রেরিয়ানকে মারাটা কোনো প্রব্লেমই নয়। মনে আছে স্যার, আমেরিকাতে একজন পোস্টম্যান আর এক মহিলা চিঠিতে অ্যানথ্রক্স থাকায় মারা গিয়েছিলেন?”
“তা আর নেই!”
অজয়বাবু নিশ্চয় সেটা জানতেন। খামের ভেতরে অ্যানথ্রক্স পাউডার ছড়িয়ে, যে-রকম সাধারণত লেখেন তেমন একটা চিঠি সেখানে ঢোকালেন। এসব করতে গিয়ে নিজে যাতে মারা না যান, তার জন্য সব রকম সতর্কতা নিশ্চয় নিয়েছিলেন। এবার বইয়ের মধ্যে খামটা পুরে, বইটা সাবধানে লাইব্রেরিতে ফেরত দিয়ে এলেন, যেমন সাধারণত দিয়ে আসেন। তবে এই বইটা লিস্ট-এর বাইরে ছিল, যাতে মিস শ্রীময়ী এটা না নেন। এও হতে পারে স্যার, ইতিমধ্যেই অজয়বাবু সম্পর্কে শুভংকরবাবুর সঙ্গে মিস শ্রীময়ীর সমঝোতা হয়ে গেছে। সুতরাং মিস শ্রীময়ী লাইব্রেরিতে আর যাবেন না। অজয়বাবু জানতেন লাইব্রেরিয়ান বইটা খুলে খাম থেকে চিঠি বার করে পড়বেন। আর সঙ্গে সঙ্গে অ্যানথ্রক্সের জীবননাশী জীবাণু নিঃশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে গিয়ে ঢুকবে। যার ফল দিন কয়েকের মধ্যেই অবধারিত মৃত্যু।”
“শুভংকরবাবু লন্ডন যাচ্ছিলেন কেন?”
“ওই ডায়েরি দুটো বেচতে স্যার। কোটি কোটি টাকার ব্যাপার। যে পার্টি কিনবে, তারা পরখ করে দেখবে। তাই নিজেই নিয়ে যাচ্ছিলেন।”
আমি বললাম, “ভাগ্যিস, প্রমথ বইটা এনেছিল, নইলে আপনার অ্যানথ্রক্সের থিওরিটা ভেস্তে যেত।”
“এখনও যেতে পারে স্যার। লাইব্রেরি থেকে যারা অসুস্থ হয়েছেন হাসপাতালে তাঁদের আলাদা করে রেখে পরীক্ষা করানোর কথা পুলিশকে বলেছি। পরীক্ষার রেজাল্ট না পাওয়া পর্যন্ত এখনও থিওরি। অজয়বাবুর বাড়িও সার্চ করা হচ্ছে– স্পেশাল টাস্কফোর্স দিয়ে।”
“যে গল্প আজ শোনালেন, তাতে ভাবছি কাগজের চিঠি পড়াই ছেড়ে দেব। এখন থেকে স্রেফ, ইমেল।” প্রমথ গম্ভীরভাবে বলল।