পঞ্চম পরিচ্ছেদ
০১.
সকাল দশটা বাজতে দশ মিনিট আগে নার্ভাস হয়ে এমন এক কাণ্ড করে বসলাম যা জীবনে কোনদিন করিনি। সারারাত জাগা এবং ভয়ে আমার নিজে স্নায়ুতীগুলোকে সতেজ করতে একের পর এক, দু বোতল হুইস্কি গিলে ফেললাম।
সকালে বাংলোর চারপাশে পায়চারি করতে করতে খবরের কাগজের হকারের অপেক্ষা করতে লাগলাম। সেদিন আটটায় কাগজ দিয়ে গেল। বারান্দায় ছুঁড়ে দেওয়া কাগজটা কুড়িয়ে নিতে যেই এগিয়েছি এমন সময় আমার ফিলিপিন দেশীয় চাকর টটি এসে হাজির।
খবরের কাগজটা তার সামনে পড়তে দ্বিধা লাগছিল।
আজ অফিস যাচ্ছি না, টটি।
অসুখ করেছে, মিঃ স্কট?
না, সপ্তাহের শেষদিনটা ছুটি নিচ্ছি।
আপনাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে।
কেমন দেখাচ্ছে তা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। ব্রেকফাস্টের জিনিসগুলো নিয়ে এখান থেকে যাও। টটি বেশ চটপটে হোকরা। চাইছিলাম না যে সে কিছু সন্দেহ করুক।
আজ সকালে রান্নাঘরটা পরিষ্কার করব ভেবেছিলাম, মিঃ স্কট। আর বিরক্ত করব না।
গলার স্বর নামিয়ে বললাম, সোমবার পর্যন্ত এসব কাজ বন্ধ রাখ। যখন তখন ছুটি পাওয়া যায় না। আমি ইচ্ছামত দিনগুলি কাটাতে চাই।
ঠিক আছে, মিঃ স্কট। আর কিছু বলবেন?
আমি বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতেই, ও বলল, মিঃ স্কট…
আবার? কি বল?
আমি কি গ্যারেজের চাবিটা নিতে পারি?
কেঁপে উঠল বুকটা। সে জানতে চাইবে ওখানে পন্টিয়াকটা কেন, ক্যাডিলাকটা বা কোথায়? সে ক্যাডিলাকটাকে এত সুন্দর পরিষ্কার রাখত যে যথেচ্ছভাবে সবসময় ব্যবহার করা গাড়িটা একেবারে নতুনের মত দেখাত।
চাবিটা কেন চাইছ?
ভিতরে একটা বোয়ামোছার ন্যাকড়া আছে, সেটা বাড়িতে নিয়ে গেলে আমার বোন সেটা পরিষ্কার করে দেবে।
ভগবানের দোহাই, ওটার জন্য আর বিরক্ত করো না। ওসব ভুলে যাও। আমি এখন কাগজটা পড়তে চাই।
বারান্দায় গিয়ে কাগজটা কাঁপা হাতে খুলে বসলাম।
খবরের কাগজের সামনের পাতায় বড় বড় করে খবরটা দেওয়া হয়েছে। তারা লিখেছে, এটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার সঙ্গে নির্মমভাবে চাপা দেওয়ার ঘটনা।
পাম সিটি ইনক্যোয়ারারের মতে, মৃত ব্যক্তি পেট্রল অফিসার হ্যারি ও’ব্রায়ান শহরের পুলিশ বাহিনীর জনপ্রিয় অফিসার। তিনটি কাগজেই মৃত ব্যক্তির ছবি দেওয়া হয়েছে, তাকে কঠিন ও নির্মম পুলিশ মনে হচ্ছিল। বয়স ত্রিশের কাছে, চোখ দুটো ছোট যেন গ্রানাইট পাথরে তৈরি, ঠোঁটে নেই বললেই চলে এবং শরীরটা বেশ ভারি ধরনের।
পাম সিটি ইনক্যোয়ারার লিখেছে, মৃত ব্যক্তি ধর্মনিষ্ঠ ক্যাথলিক, বাপ-মায়ের প্রিয় পুত্র এবং দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন পুলিশ অফিসার।
বিবরণীতে লেখা ছিল, মাত্র দুদিন আগে এমন জোরে ধাক্কা দেওয়া হয়েছিল, ও’ব্রায়ান তার বন্ধুদের বলেছিলেন যে, তিনি বিয়ের দিন পরের মাসের শেষ দিকে লিটল টাভার্ন নাইট ক্লাবের জনপ্রিয় বিনোদিনী মিস ডলোরেস লেন।
তিনটি পত্রিকারই সম্পাদকীয়তে দাবী জানানো হয়েছে যে শহরের শাসন কর্তৃপক্ষের উচিত দোষী ড্রাইভারকে খুঁজে বার করে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া।
পত্রিকাগুলোর বিবরণীতে আমি ভয় পাইনি, ভয় পেয়েছিলাম পুলিশের কার্যকলাপে।
পুলিসের ক্যাপ্টেন, জন সুলিভা গতকাল রাতে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেছেন যে ও’ব্রায়ানের হত্যাকারী ড্রাইভারকে খুঁজে বার করার আগে পর্যন্ত একজন লোকও বিশ্রাম নেবে না।
সুলিভা তার দশ মিনিট বক্তৃতার শেষে বললেন, এ ব্যাপারে একটুও ভুল বুঝবেন না। আমরা দোষীকে খুঁজে বার করবই। এটা একটা সাধারণ অ্যাকসিডেন্ট নয়। অতীতে অনেক পুলিশ অফিসারই দুর্ভাগ্যবশতঃ মোটর অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছেন কিন্তু সেইসব ড্রাইভারদের সকলকেই কোর্টে হাজির হতে হয়েছিল। কিন্তু এই লোকটা পালিয়ে গিয়ে নিজেকে আসামী সাব্যস্ত করেছে। তাকে খুঁজে বার করতেই হবে। আর তার গাড়ি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই শহরের প্রতিটি গাড়িকেই পরীক্ষা করে দেখা হবে। গাড়ির প্রতিটি মালিককে ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। এই ঘটনার পরে যদি কোন গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে ড্রাইভার যেন তৎক্ষণাৎ থানায় খবর দেয়, নইলে ঝামেলায় পড়বে। রাস্তায় অবরোধ রাখা হয়েছে। কোন গাড়িই পরীক্ষা না করে ছাড়া হবে না। গাড়িটা নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে, আমাদের খুঁজে বার করতে হবে।
এটা খুঁজে পেলে মালিককে উপযুক্ত ওষুধ দিতে পারব।
ইতিমধ্যে দশটা বাজতে দশ মিনিট হয়ে এল, টটির কাছ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে যা পড়ল সে সব ভাবছিলাম। এর মধ্যে প্রায় দু বোতল ডবল হুইস্কি খেয়ে ফেললাম।
শহরের প্রতিটি গাড়ি পুলিশ পরীক্ষা করে দেখবে এটা হেঁয়ালি ঠেকলেও মনে পড়ে গেল একটা মারাত্মক অস্ত্রের সন্ধানে এই শহরের পুলিশেরা একবার শহরের সমস্ত ডাস্টবিন তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল এবং প্রায় চারদিনের পরিশ্রমের পর সেটা উদ্ধার হয়েছিল। ভাবলাম সুলিভাকে তাচ্ছিল্য করা ঠিক হবে না।
লুসিলির আশায় দশটায় গেটে এসে দাঁড়ালাম।
আমি দুটো সিদ্ধান্তে এলাম। পুলিশের কাছে গিয়ে সমস্ত সত্যি কথা বলা, নইলে ক্যাডিলাক যদি ধরা পড়ে তকে সমস্ত দোষটা নিজের কাঁধে তুলে নেব।
এই সিদ্ধান্ত শুধু লুসিলির প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগের জন্য নয়, এছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই। দুজনে বিপদে জড়িয়ে পড়ায় লাভ নেই। তাছাড়া দোষটা তো আমারই। আমি যদি সে ওরকম ব্যবহার না করতাম তাহলে হয়তো সে অত জোরে গাড়ি চালাত না।
লুসিলিকে দোষী ধরলে আসল সত্য প্রকাশ হয়ে পড়বে, তাতে যে শুধু চাকরী হারাব নয়, সাহায্য করার অভিযোগে জেলেও যেতে হবে। তাকে ঝামেলার বাইরে রাখলে আর সাজা পেয়ে বাইরে বেরোলে, মিঃ আইকেন হয়ত আমার চাকরী ফিরিয়ে দেবেন।
তখন লুসিলি এল, তার সাইকেল গ্যারেজে রেখে তাকে লাউঞ্জে নিয়ে এলাম।
কাগজ দেখেছ?
হ্যাঁ, আজ সকালে রেডিওতে ঘোষণা করেছে। কি বলেছে তুমি শুনেছ?
রেডিও? না, এদিকটা আমি একেবারেই ভাবিনি। কি বলেছে?
তারা খবর জানতে চেয়েছে। যে কেউ গতরাতে ভাঙ্গা, ক্ষতিগ্রস্ত গাড়িটা দেখেছে সে যেন থানায় জানিয়ে আসে। সব গ্যারেজকে জানানো হয়েছে যদি কেউ ভাঙ্গা গাড়ি মেরামত করতে আসে তবে যেন থানায় জানিয়ে দেওয়া হয়। সে হঠাৎ তার ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে আমার বাহুবন্ধনে এসে আমার কাঁধে মাথা রাখল। ভীষণ ভয় করছে। উঃ, চেস… আমার বিশ্বাস ওরা আমায় খুঁজে বার করবে। আমি কি করব?
তাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বললাম, সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার ভয় পাবার কিছু নেই। চল আলোচনা করা যাক।
আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে লুসিলি ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কি বলতে চাইছ?
সে একটা গলা–খোলা শার্ট একটা হালকা নীল স্ন্যাক পরেছিল। এই চরম মুহূর্তেও ভাবছিলাম কি সুন্দর দেখাচ্ছে।
বস। ইজিচেয়ারটার কাছে তাকে নিয়ে এলাম।
আমিও বসে বললাম, দুজনের একসঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার কোন যুক্তি নেই। যদি গাড়িটা ধরা পড়ে সমস্ত দোষটা আমিই নেব।
সে শক্ত হয়ে বলল, না, তুমি তা করতে পার না। দোষটা আমারই…
এটা একটা অ্যাকসিডেন্ট যদি তুমি থামতে এবং সাহায্য করতে, লুসিলি তাহলে রেহাই পেত। কিন্তু তোমাকে জানাতে হত কেন অত জোরে গাড়ি চালিয়েছিল। এতে হয়ত জেলখানা এড়িয়ে যেতে কিন্তু একটা স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পড়তে। বুঝতেই পারছ কাগজের লোকেরা কিভাবে আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ফেলবে। তোমার স্বামী তোমাকে ডিভোর্স করবে আমি চাকরীহারাব। সুতরাং এখন পুলিশকে সব বললে আমরা দুজনেই একটা বিরাট ঝামেলায় জড়িয়ে পরব।
লুসিলি মাথা নেড়ে চলল।
আমি পুলিশকে সবকিছু বলতে চাইছি না। একটা সুবিধে আছে যে ওরা হয়ত ক্যাডিলাকটা খুঁজে পাবে না। যদি খুঁজে পায় তবে বলব যে আমিই পুলিশের লোকটাকে ধাক্কা মেরেছি। তুমি ঝামেলার বাইরে থাকলে আমাদের দুজনের পক্ষেই মঙ্গলকর। ভাগ্য ভাল হলে আমি হয়ত অল্প শান্তি পেয়েই বেরিয়ে আবার চাকরীটাও ফিরে পাবে। কিন্তু তুমি জড়িয়ে পড়লে আমি আর কোনদিনই বিজ্ঞাপন এজেন্সীতে চাকরী পাব না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলল, তুমি কি সত্যি বলছ চেস? সত্যিই তাদের বলবে যে তুমি এটা করেছ?
হ্যাঁ, আমি তাই চাইছি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে লুসিলি বলল, বেশ, তুমি যদি ঠিকই করে থাক..
হ্যাঁ, আমি ঠিক করেছি।
সে কাঁধ থেকে চুলগুলো সরিয়ে ভুরু কোঁচকাল, কিন্তু উদ্বেগ কিছু কমল না।
তোমার কি একটু ভাল বোধ হচ্ছে না, লুসিলি?
হ্যাঁ, নিশ্চয়। একটা জিনিস চেস, আমি সাঁতারের স্যুটটা তোমার গাড়িতে ফেলে এসেছি।
বেশ ঠিক আছে। তুমি চলে যাওয়ার পর আমি গাড়িটা একবার পরীক্ষা করে দেখতে যাব। আমি তখন সাঁতারের পোশাকটা নিয়ে আসব।
আমরা কি এখনই গিয়ে নিয়ে আসব?
যখন গাড়িটা দেখতে যাব তখন নিয়ে আসব।
আমি এখনই যেতে চাইছি।
বুঝলাম তার জেদের কারণ। পুলিশের লোক যদি গাড়িটা দেখতে পায় তবে সাঁতারের পোশাকটা পেয়ে ঠিক জেনে নেবে ওটা কার।
ঠিক আছে তুমি অপেক্ষা কর। আমি এখনই নিয়ে আসছি।
আমি তোমার সঙ্গে যাব…
তোমার না যাওয়াই ভাল। আমাদের এক সঙ্গে থাকা ঠিক হবে না।
বরং আমি যাই।
কি ব্যাপার লুসিলি? আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না?
আমার কাছে এটা খুব দরকারী।
নিশ্চয়ই, কিন্তু আমাদের দুজনকে একসঙ্গে যাতে না দেখে সেটাও দরকার। আমি নিয়ে আসছি।
লুসিলি উঠে আমি বরং তোমার সঙ্গে যাই, চেস।
বেশ কষ্ট করেই রাগ চেপে হলঘরের দিকে চললাম। সেও আমাকে অনুসরণ করল।
এখানে অপেক্ষা কর। আমি গাড়িটা নিয়ে আসি।
গ্যারাজে গিয়ে পন্টিয়াকটা বার করে রাস্তায় এনে চারপাশে তাকালাম কাউকে দেখতে পেলাম না।
হাত নেড়ে বললাম, এস।
সে ছুটে গাড়িতে এসে বসতেই আমি এক মাইলের তিন-চতুর্থাংশ পথ জোরে চালিয়ে সিবোর্নের বাড়ি এলাম।
দুজনে বাইরে বেরিয়ে গ্যারেজের দিকে এগিয়ে গেলাম, হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম। গ্যারেজের দরজাটা ভেজান।
ক্যাডিলাকটা রেখে আমি দরজায় তালা লাগিয়ে গিয়েছিলাম আবার টেনে দেখেছিলাম ভালভাবে লাগানো হয়েছে, কিনা।
কি ব্যাপার, চেস?
এখানে অপেক্ষা কর বলে ছুটে গ্যারেজে ঢুকে দেখলাম তখনও ক্যাডিলাকটা সেখানেই ছিল কিন্তু আগের রাতে ফ্ল্যাশের আলোয় যেমনটি দেখেছিলাম তার চেয়ে অনেক বিশ্রী দেখাচ্ছিল।
তালাটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওটা ভাঙা এবং মোচড়ান। দরজার কাঠেও আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেলাম।
লুসিলি পাশে এসে কি ব্যাপার?
কেউ এখানে এসেছিল।
কে?
কি করে জানব?
তুমি কি মনে কর পুলিশ…
না। পুলিশ হলে নিশ্চয়ই আমার কাছে যেত। লাইসেন্স ট্যানে আমার নাম লেখা আছে।
চেস সুইম স্যুট?
কোথায় রেখেছিলে?
পিছনের সীটে পায়ের কাছে।
গাড়ির পিছন দরজাটা খুললাম। সত্যিই যদি সাঁতারের পোশাকটা ফেলে থাকে। এখন কিন্তু। সেটা সেখানে নেই।
.
০২.
একটা উড়োজাহাজ উপরে গর্জন করে উড়ে যাচ্ছিল। আর কোন শব্দ ছিল না। পিছনের খালি সীট ও সামনের খালি মেঝেয় তাকিয়ে বুকটা দুর দুর করে কাঁপছে।
লুসিলি ধীর গলায়, ব্যাপার কি?
সেটা ওখানে নেই।
নিশ্চয়ই আছে, আমাকে দেখতে দাও।
একপাশে সরে দাঁড়ালাম। লুসিলি নিশ্চয়ই এখানে আছে বলতে বলতে ভেতরে ঢুকে নিচের দিকে হাত বাড়াল।
তোমার কি ঠিক মনে আছে সমুদ্রের ধারে ফেলে আসনি?
নিশ্চয়ই না, আমি নিশ্চিত মেঝের ওপর রেখেছিলাম।
লুসিলির চোখ দুটো ভয়ে গোল হয়ে উঠেছে।
গাড়ির পেছনটা একবার দেখি, বলে পিছনের পেটির ঢাকনাটা খুললাম। খুলে দেখলাম না, নেই।
ওটা নিয়ে কি করেছ?
তার দিকে চাইলাম, কি বলতে চাও? আমি জানতাম না যে তুমি ওটা গাড়িতে রেখেছ।
মিথ্যা বলছ! তুমি নিয়ে লুকিয়ে রেখেছ।
এ কথা তুমি কি করে বলতে পারলে?
লুসিলির মুখ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। সে ক্ষেপে বলল, মিথ্যা বলবে না, তুমি নিশ্চয়ই নিয়েছ। সেটা কোথায়?
তুমি কি পাগল হয়েছ? নিশ্চয়ই কেউ এসেছিল। নিজেই তো দেখতে পাচ্ছ। দরজার দিকে দেখ, কেউ নিশ্চয়ই এসেছিল এবং সুইমস্যুটটা দেখে নিয়ে গেছে।
না, না, কেউ আসেনি। তুমিই দরজা ভেঙেছ। সেইজন্যেই দোষটা ঘাড়ে তুলে নিতে তোমার এত আগ্রহ। তুমি ভেবেছিলে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। তোমার পায়ের নিচে পড়ে পা দুটোয় চুমু খাব, তাই না? ভেবেছিলে আমার সঙ্গে প্রেম করবে, তাই না? তোমায় যা ইচ্ছে তাই করতে দেব, তাই তোমার ধারণা ছিল, তাই না? তুমি সবসময়ই আমাকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলে। তুমি ঠিক করেছিলে যে সুইমস্যুটটা আবার পরে গাড়িতে রেখে যাবে যাতে পুলিশ জানতে পারে। যে আমি তোমার সঙ্গে গাড়িতে ছিলাম।
সজোরে চড় বসাতে যাচ্ছিলাম, অতি কষ্টে সামলে নিলাম।
ঠিক আছে। আমি তোমার সুইমস্যুট নিইনি। বোকাদের এভাবে ভয় দেখাতে পার। কেউ এসে নিয়ে গিয়েছে, তবে আমি নিইনি।
সে চাপাস্বরে, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
আমি প্রশ্ন করলাম, এর অর্থ কী?
সে তার কপালটা আঙুলের ডগা দিয়ে চেপে ধরে হঠাৎ হেসে উঠল।
অত্যন্ত দুঃখিত, চেস, সত্যিই আমি দুঃখিত। তোমার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে আমি চাইনি। কাল রাতে ঘুম হয়নি, নার্ভগুলোর অবস্থা ভয়ানক। তুমি আমাকে ক্ষমা কর।
হ্যাঁ, সব ভুলে যাও।
কে নিয়ে যেতে পারে চেস? পুলিশও হতে পারে, পারে না?
না, পুলিশ নয়।
অন্যদিকে চাইল লুসিলি। মনে হল, যেন তার ভাবনা অনেক দূরে চলে গিয়েছে।
এখানে তোমার থাকার কোন প্রয়োজন নেই, লুসিলি, তোমার থাকা বিপজ্জনক।
হ্যাঁ, আমাকে একটা সিগারেট দেবে?
অবাক হয়ে আমার ক্যাসেল মার্কা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা বার করে তাকে দিলাম। সিগারেট ধরিয়ে জোরে টান দিয়ে গোছ গোছা ধোয়া মুখ থেকে বার করতে লাগল। সে সবসময় গ্যারেজের সিমেন্ট বাঁধানো মেঝের দিকে তাকিয়েছিল।
সে মুখ তুলে চাইতে দেখতে পেল আমি তাকে লক্ষ্য করছি। সে হেসে বলল, সুতরাং আমরা দুজনেই এই ঝামেলায় পড়লাম, তাই না, চেস?
ঠিক তা নয়। ছিঁচকে চোরও হতে পারে।
তোমার তাই মনে হচ্ছে? ব্ল্যাকমেলারও হতে পারে।
কেন, একথা বলছ কেন?
আমার এরকম মনে হচ্ছে। ব্ল্যাকমেলিং-এর পক্ষে আমরা বেশ খারাপ অবস্থায় আছি, তাই না? আমি পুলিশের লোকটাকে চাপা দেওয়ার জন্য, আর তুমি আমাকে প্রলোভন দেখানোর জন্য।
এ দিকটা অবশ্য আমার খেয়াল হয়নি, কিন্তু এখন লুসিলি বলাতে মনে হল ঠিকই বলেছে।
অবশ্য নাও হতে পারে…
না। আমাদের বরং অপেক্ষা করে দেখা উচিত কি ঘটে। সে আমার পাশ কাটিয়ে গ্যারেজের দরজার দিকে গেল। মনে হয় আমার ফিরে যাওয়াই ভাল।
হ্যাঁ।
আমি যখন গ্যারেজের দরজা লাগাচ্ছিলাম সে অপেক্ষা করছিল।
আমাকে আবার ফিরে এসে তালা দিতে হবে।
হ্যাঁ।
লুসিলি এবার পন্টিয়াকের ভিতর এসে সোজা হয়ে হাত দুটো হাঁটুর উপর রেখে বসল।
আমিও বসে ইঞ্জিনে স্টার্ট দিয়ে একেবারে উল্টোদিকে ঘুরে সোজা বাংলোর দিকে চালালাম।
গেটের বাইরে এসে দাঁড়ালাম।
তোমার সাইকেল নিয়ে আসছি।
আমি ভিতরে যাব চেস। তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চাই।
বেশ, ঠিক আছে।
দুজনে এসে বাংলোতে ঢুকলাম। আমি একটু দাঁড়িয়ে লাউঞ্জের সদর দরজাটা লাগিয়ে দিলাম।
লাউঞ্জে ঢুকে দেখি লুসিলি একটা ইজিচেয়ারে বসে সমুদ্রের দিকে চেয়ে রয়েছে, ঘড়িতে তখন এগারোটা বাজতে পনেরো মিনিট। অন্য একটা চেয়ারে বসে তার দিকে তাকালাম। সেই সৌন্দর্য যেন তার হারিয়ে গেছে। একটা কাঠিন্য এসে তাকে ঢেকে দিয়েছে। এখনও সে দেখতে সুন্দর। লোভনীয় কিন্তু তার সেই সরলতা ও যৌবন যেন উধাও হয়ে গেছে।
লুসিলি আস্তে আস্তে মাথাটা ঘুরিয়ে আমার দিকে চেয়ে বলল, মনে হচ্ছে আমি একটা বিরাট ঝামেলার সৃষ্টি করেছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি হয়ত মুক্তি পেতাম, কিন্তু সেখানে সুইম সুটটা ছেড়ে রাখার জন্য আবার হয়ত ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ব, তাই না?
আমি অবশ্য তা বলবনা। এটা নির্ভর করে কে নিয়েছে তার উপর। দামী কিছু পাবার লোভে একটা ছিঁচকে চোর ভিতরে ঢুকতে পারে। গাড়ির মধ্যে সুইমস্যুটটা ছাড়া অন্য কিছুই ছিল না। সে এর থেকে কিছু পাবে এই আশায় সেটা নিয়ে গেছে।
লুসিলি মাথা নেড়ে, আমি তা মনে করি না। স্যুটটায় আমার নাম লেখা আছে। এই শহরের প্রায় সকলেই জানে রোজার কি রকম ধনী।
আমার হৃৎপিণ্ডটা কাঁপতে লাগল, হাত দুটো ভিজে উঠল। এইসব কথাবার্তা আমার মনে বিপদের লাল সংকেত জ্বালাল।
সে শান্ত গলায় বলে চলল, আর যাই হোক, একটা ছিঁচকে চোর কেন সুইমস্যুট নিতে যাবে? এটা কার দরকার হবে? মনে হয় আমাদের ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তুমি বড় তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে আসতে চাচ্ছো….
সে অধৈর্য ভঙ্গিতে, দেখা যাক কি হয়। তুমি কি ব্ল্যাকমেলের টাকা দিতে চাও, চেস?
এতে কোনও লাভ হবে না। একবার ব্ল্যাকমেলের টাকা দিতে শুরু করলে আর রেহাই নেই মনে হবে একটা ভূত যেন ঘাড়ে চেপে বসে আছে।
আমার মনে হয়, রোজারের সঙ্গে কথা বলা উচিত।
তিনি কিছুই করতে পারবেন না।
আমি তাকে যতটা জানি তুমি ততটা জান না। সে নিজের পদমর্যাদা এবং লোকে তার সম্বে কি ভাববে সে ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন। আমি যদি তাকে সব খুলে বলি আর তুমি যদি সম দোষটা নিজে নিতে চাও তবে আমার মনে হয় সে ব্ল্যাকমেলের টাকাটা দিয়ে দেবে।
ভয়ে চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
লুসিলি বলে চলল, তার টাকা অনেক। সে দর কষাকষিও করতে পারে। মনে হয় না তা পক্ষে এটা বেশি কিছু হবে।
কিন্তু তিনি তোমাকে ডিভোর্স করবেন।
জেলে যাওয়ার চেয়ে ডিভোর্স ভাল।
কিন্তু এখনও আমরা জানি না যে আমাদের ব্ল্যাকমেল করা হবে।
তুমি কি মনে কর এই লোকটা আমার সুইমস্যুটটা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে নিয়েছে?
এ নিয়ে তোমার বিদ্রূপ করা ঠিক না। আমি সাহায্য করার চেষ্টা করছি।
অন্ততঃ তোমার বাস্তববাদী হওয়া দরকার।
অস্বাভাবিক জোরে বলে ফেললাম, এই মুহূর্তে ব্ল্যাকমেলের কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমি বলেছি যে তোমাকে ঝামেলার বাইরে রাখব ভেবেই বলেছি।
অর্থাৎ এই লোকটার মুখ বন্ধ করতে টাকা খরচ করবে?
কোন লোকটা?
যে লোকটা আমার সুইমস্যুট নিয়েছে।
এ তোমার কল্পনামাত্র। আমরা এখনও লোকটার অস্তিত্ব সম্বন্ধে কিছুই জানি না।
তুমি কি মনে কর সেটা আপনাআপনি উধাও হয়ে গেল?
আমি মনে করি, তুমি সেটা সমুদ্রের ধারেই ফেলে এসেছ।
লুসিলি চিৎকার করে বলল, না ফেলে আসিনি। আমি গাড়িতেই রেখেছিলাম, কেউ নিয়ে গেছে।
ঠিক আছে, এ নিয়ে আর তর্ক করে লাভ নেই।
চেস, তুমি কি দিব্যি করে বলবে তুমি নাও নি?
নিশ্চয়ই, আমি নিই নি। উঃ, ভগবানের দিব্যি।
আমি ভেবেছিলাম আজ সকালে তুমিই আমাকে ফোনে ভয় দেখাবার চেষ্টা করেছিলে। মনে হচ্ছিল তোমারই গলা।
আমি শক্ত হয়ে উঠলাম। কি বলতে চাইছ? কে তোমাকে ফোন করেছিল?
আজ সকালে প্রায় নটা নাগাদ টেলিফোনে ঠিক তোমার গলার মত করে বলল, মিসেস লুসিলি, আশা করি কাল রাতে সাঁতার বেশ আনন্দের হয়েছে। তারপরেই চুপ হয়ে গেল।
শরীরটা হিম হয়ে এল।
আগে কেন একথা বলনি?
ভেবেছিলাম তুমিই ফোন করেছ আর সেইজন্যেই সুইমস্যুটটা ফিরিয়ে আনতে এত ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলাম।
না, আমি নই।
সেইজন্যই বলছি আমাদের ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা হচ্ছে।
কিন্তু সমুদ্রের ধারে কেউই ছিল না।
যেই হোক না কেন, সে জানত যে আমি গাড়ি চড়েছিলাম সাঁতার কাটার জন্য।
তাহলে কি এই লোকটাই তোমার সুইমসুট নিয়ে গিয়েছে?
হ্যাঁ।
মদের ক্যাবিনেটের দিকে যেতে যেতে, তুমি ড্রিংক করবে?
হ্যাঁ, দাও।
হুইস্কি, না জিন?
হুইস্কি।
দুটো গ্লাসে মদ ঢেলে বরফের টুকরো দিয়ে ঘরের ভিতর দিয়ে যেই যাচ্ছি টেলিফোনটা বেজে উঠল।
মনে হল মাংসপেশীগুলো শক্ত হয়ে উঠেছে। লুসিলি চেয়ারে সোজা হয়ে বসে। আমরা পরস্পরের দিকে চেয়ে। লুসিলি চাপা গলায়, তুমি কি ধরবে না?
রিসিভারটা তুলে ধরলাম, হ্যালো?
মিঃ, চেস্টার স্কট বলছেন?
হ্যাঁ, কে বলছেন?
ওর সঙ্গে তোমার প্রেম করা উচিত ছিল, মিঃ স্কট। ওভাবে ওকে পালিয়ে যেতে দেওয়া তোমার উচিত হয়নি। আর যাই হোক, এই উদ্দেশ্যেই তো মেয়েদের আমাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।
কি বলতে চাইছেন? কে বলছেন? কপালে তখন ঠাণ্ডা ঘাম জমা হয়েছে।
একটানা কড় কড় শব্দে বুঝলাম, আমার কথাগুলো যখন বলছিলাম তখন লাইনের ওপাশে কেউ নেই।