০৫. নয়, দশ, রামপাখি বশ
ইনকোয়েস্ট শেয। দুই বন্ধু বাড়ির পথে রওনা দিয়েছেন। জ্যাপের মনে আনন্দের উচ্ছ্বাস। জোরে হেসে উঠে তিনি বললেন–ফাটিয়ে দিয়েছেন মশাই। শিহরণ জাগছে শরীরে।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন পোয়ারো।
জ্যাপ অবার বলতে লাগলেন প্রথম থেকেই আপনি সঠিক পথে এগোচ্ছিলেন। তবে আমারও সন্দেহ ছিল না তা নয়। এমন নৃশংস হত্যালীলা কেউ যে করতে পারে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। কারণ ছাড়া মৃতদেহের মুখ বিকৃত করা যায় না। সনাক্তকরণে বিঘ্ন ঘটানোই এর প্রকৃত কারণ। মৃতদেহটা মিস সীলের না হয়ে অন্য মহিলার হতে পারে এটা বোঝা উচিত ছিল আমার। বিচক্ষণতার অভাব ঘটেছে।
পোয়ারো স্মিত হেসে বললেন–ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক। মিস সেইনসবারি সীল অতি সাধারণ, সাজ পোশাকে শৌখিনতার আধিক্য নেই। সাদামাটা প্রসাধন। সেই তুলনায় মিসেস চ্যাপম্যান সুন্দরী, ধনী, করিৎকর্মা মহিলা। তবে তাদের দুজনের বিশেষত্ব হল, দু’জনেই চল্লিশ বছর পার করেছেন। উচ্চতা প্রায় এক, শুভ্র কেশ দু’জনেরই।
জ্যাপ বললেন–হ্যাঁ, তা সত্যি। ম্যাকেল আমাদের বোকা বানিয়েছে। আমি নিশ্চিত তিনিই নাটের গুরু।
নিশ্চয়ই। তার অতীত জীবন আমাদের অজানা নয়।
তবে খুন করতেও তার হাত কাঁপে না সেটা আজ প্রত্যক্ষ করলাম। এখন মনে হচ্ছে ম্যাকেলই সিলভিয়াকে খুন করেছে। নাকি সিলভিয়ার খুনি ম্যাকেল।
এরকুল পোয়ারো তীব্র স্বরে প্রতিবাদ করে বললেন–আমি আপনার কথা মানতে পারছি না। আমি কিছুতেই মিসেস সীলকে খুনির আসনে বসাতে পারছি না।
জ্যাপ উত্তেজিত হয়ে বললেন–আমি এই মামলার শেষ দেখে ছাড়ব, বন্ধু আমি ওই মহিলাকে হার মানতে বাধ্য করবই।
পরদিন ফোন পেলেন পোয়ারো। জ্যাপ করেছেন। তার গলার স্বর ভারী। তিনি বললেন একটা খবর দিই আপনাকে, বন্ধু। আমাদের সব পরিশ্রম বৃথা গেল।
–ঠিক বুঝলাম না। উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ছে পোয়ারোর গলার স্বরে।
–আমাদের দায়িত্ব শেষ। কাজকর্ম বন্ধ। এখন আমরা ছুটি কাটাব ইচ্ছেমতো।
পোয়ারো চমকে উঠে বললেন–পাগলের মতো কি সব বলছেন?
তিক্ত স্বরে জ্যাপ বললেন–তদন্তের কাজ সব নষ্ট হয়ে গেল। এত প্রচার, হৈ চৈ, জেরা, জবাবদিহি সব কৌশলে চাপা দেওয়া হল।
কিছুই আমার বোধগম্য হচ্ছে না। তাহলে শুনুন। এতদিন ধরে আমরা যে তল্লাশি চালিয়েছি তা মনে আছে তো? কোন মাছ ধরতে সারা দেশে জাল ফেলেছি সেটাও মনে আছে?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ। তারপর?
–সেটা গুটিয়ে ফেলতে হবে। বলতে পারেন চাপা দেওয়া হল ব্যাপারটাকে।
–কিন্তু কার নির্দেশে? বিদেশ দপ্তরের নির্দেশে। এটা অকল্পনীয় নয় কি? হতে পার তবে এরকম ঘটনা বিরল নয়। ওই মাছ নিয়ে তাদের এত আগ্রহ কেন?
–তাকে নিয়ে তারা অত মাথা ঘামায় না। প্রচারে তাদের আপত্তি। অভিযুক্তকে আদালতে তুলতে হবে। জেরাতে মিসেস চ্যাপম্যানের মৃত্যুর প্রসঙ্গ উঠবে। সুতরাং এখানেই ইতি টানো। জ্যাপ চিন্তিত স্বরে বললেন কিন্তু মি. চ্যাপম্যানের অবস্থা কি হবে?
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।
–তিনি বিদেশে কোনো বিপজ্জনক জায়গায় থাকলে এই ঘাঁটাঘাঁটিতে ব্যাপারটা কোথায় এসে দাঁড়াবে বুঝতে পারছেন?
-ওঃ বুঝলাম। ভীষণ বিরক্তিকর ব্যাপার।
জ্যাপ কর্কশ সুরে বললেন–ওই মহিলাকে হাতে পেয়েও ছেড়ে দিতে হবে। এটা মনে পড়লেই সারা শরীর রাগে জ্বলে যাচ্ছে, বন্ধু।
পোয়ারো ধীরে ধীরে বললেন কিছু ভাববেন না, দোস্ত, সে হাতছাড়া হবে না।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জ্যাপ বললেন কিন্তু কিভাবে, আমরা ওপরতলার কড়া নিয়মে বাঁধা পড়েছি।
–আরে মশাই, আমি তো রয়েছি। আমি আপনাদের মতো নিয়মের বেড়াজালে আটকে নেই।
জ্যাপ দারুন খুশি। বললেন–বাঃ চমৎকার। আপনি এগিয়ে যান। আমার শুভেচ্ছা রইল।
–অবশ্যই আমৃত্যু লড়ে যাব।
–তা ভাল। তবে দেখবেন, প্রথম থেকেই ঘটনার যা ঘনঘটা দেখলাম, আপনাকে না কেউ শেষ করে ফেলে।
পোয়ারো ফোন ছেড়ে দিলেন। মনে মনে বললেন–এরকম অতিরঞ্জিত কথা না বলাই ভালো ছিল। ভারি অদ্ভুত একটা মন্তব্য করলাম–আমৃত্যু।
সন্ধ্যার ডাকে এরকুল পোয়ারোর নামে একটি চিঠি। টাইপ করা চিঠির বয়ান আর সইটা হাতে লেখা।
পোয়ারো চিঠিটা খুললেন। তাতে লেখা আছেঃ
আমি আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থী। আমার বাড়ি বেলসিতে যদি একবার আসেন তাহলে আমি খুব খুশি হব। আগামীকাল সাড়ে বারোটায়। আপনাকে একটা কাজ দেব। যদি আসতে না পারেন তাহলে দয়া করে আমার সেক্রেটারিকে টেলিফোনে জানিয়ে দেবেন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে অন্য কোনো সময় ঠিক করতেও পারেন। তবে মনে রাখবেন আগামীকালই এলে উপকৃত হব। কম সময় দেওয়ার জন্যে ক্ষমা চাইছি।
—আপনার বিশ্বস্ত,
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট।
চিঠিখানা মন দিয়ে পড়লেন। বার বার পড়লেন। চিঠির বক্তব্যেই গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করলেন। ঠিক সেই সময় তাঁর টেলিফোন বেজে উঠল।
এরকুল পোয়ারো নিজের সম্পর্কে আস্থাবান যে টেলিফোনের শব্দ শুনে ধরতে পারেন কি ধরনের খবর পেতে চলেছেন।
এ ক্ষেত্রে তিনি বুঝলেন, বার্তাটা জরুরি। এটা রঙ নাম্বার অথবা কোনো বন্ধুর ফোন হতে পারে না।
তিনি রিসিভার কানে ধরলেন। তিনি স্বভাবসুলভ স্বরে বললেন–হ্যালো?
নেতিবাচক এক মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন–এটা কত নম্বর?
–এটা হোয়াইট হল ৭২৭২।
একটু থেমে ওই মহিলার কণ্ঠস্বর পোয়ারোর কানে এল–মঁসিয়ে পোয়ারো বলছেন?
–হ্যাঁ, বলছি।
–মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো?
–হ্যাঁ।
–মঁসিয়ে পোয়ারো, ইতিমধ্যে আপনি একটা চিঠি পেয়েছেন অথবা পাবেন।
–কে বলছেন? আমি কি জানতে পারি?
–আপনার জানার প্রয়োজন নেই।
–বেশ। জানতে চাই না। তবে, একটা কথা জানাই মাদাম, এর মধ্যে আমি আটটি চিঠি ও তিনটে বিল পেয়েছি।
কোন চিঠির কথা বলছি তা আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। যে কাজের দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হবে তা গ্রহণ না করলেই মঙ্গল হবে, মঁসিয়ে পোয়ারো।
–এটা আমার ওপর ছেড়ে দিন, মাদাম।
হিমশীতল স্বরে জবাব এল–মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনাকে সাবধান করছি। আপনি এর মধ্যে মাথা গলাবেন না। আপনার এই ঔদ্ধত্য আমরা বরদাস্ত করব না।
যদি আপনাদের সাবধানবাণী না শুনি?
–তাহলে আপনি বিপদে পড়বেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। আমরা সেই ব্যবস্থাই করব।
–এটা হুমকি দেওয়া হচ্ছে, মাদাম।
–আমরা আপনাকে সচেতন করতে চাইছি। এতে আপনার মঙ্গল হবে।
–আপনার মহত্ত্বের পরিচয় পেয়ে কৃতার্থ হলাম, মাদাম।
–যা বলছি সেটা মেনে চলুন। যে বিষয়ে আপনি নিজেকে জড়িয়ে ফেলছেন সেটা থেকে সরে আসুন।
ওহ, হ্যাঁ। তবে মি. মর্লের মৃত্যু নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। ওটা নিছক দুর্ঘটনা একটা মাত্র। সে আমাদের কাজে বাধার সৃষ্টি করছিল।
–তিনি মানবিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাই অকালে মরতে হল।
–সে অবিবেচকের মতো কাজ করেছিল। তাই সে যোগ্য শাস্তি পেয়েছে।
–আমিও বিবেচক হতে রাজি নই।
–তাহলে আপনি বোকামি করবেন।
বলেই অন্যদিক থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
পোয়ারো বারকয়েক হ্যালো বললেন, কিন্তু ও প্রান্ত থেকে কোনো শব্দ শুনতে পেলেন না। রিসিভার নামিয়ে রেখে ভাবলেন, ফোনটা কোথা থেকে করা হয়েছে ইচ্ছে করলে জানা যাবে। কিন্তু লাভ হবে না কারণ ফোনটা এসেছে কোনো পাবলিক বুথ থেকে।
ধীরে ধীরে তিনি মনে করতে লাগলেন ওই মহিলার কণ্ঠস্বর তার ভীষণ চেনা লাগছে। আগে কোথাও শুনেছিলেন। ম্যাকেল সেইনসবারি সীলের কণ্ঠস্বর নয়তো? তবে মিস সীল একটু চড়া সুরে কথা বলে থাকেন। এটাও আশ্চর্যের নয় যে তিনি অন্যের গলা অনুকরণ করে ফোন করতে পারেন না। কারণ তিনি একজন অভিনেত্রী এটা ভুললে হবে না।
কিন্তু এই যুক্তি তাঁর মনঃপূত হল না। তিনি অন্য একজনের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে মিল খুঁজতে চাইছেন।
সকালে সংবাদপত্রে এক দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ সংবাদ প্রকাশিত হল। প্রধানমন্ত্রীকে কে বা কারা গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেছে। তিনি সেই সময় ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। সঙ্গে এক বন্ধু ছিলেন। তবে ভাগ্য ভাল, গুলিটা তাঁর শরীরে লাগেনি। কিছুটা দূর থেকে চলে গেছে। এজন্য একজন ভারতীয়কে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। খবরটা পোয়ারো মন দিয়ে পড়লেন। তারপর সোজা গিয়ে হাজির হলেন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে জ্যাপের অফিস ঘরে। জ্যাপ তাকে সাদরে অভ্যর্থনা করলেন।
বাঃ আপনারও চোখে পড়েছে খবরটা। আর পড়বেই না কেন এমন মুখরোচক খবর। তা বন্ধুটি কে তা লিখেছে খবরের কাগজে?
না, তিনি কে আপনি জানেন?
–অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট।
–-সত্যি? পোয়ারো অবাক হয়ে বললেন?
-হ্যাঁ, বন্ধু। আমি নিশ্চিত মি. ব্লাস্টকে গুলিটা ছোঁড়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী তাদের লক্ষ্য নয়। লোকটার লক্ষ্যভেদ ভুল হওয়ায় মি. ব্লাস্ট বেঁচে গেলেন।
–লোকটা কে জানতে পেরেছেন?
–এক হিন্দু ছাত্র। ওর সাথে মি. ব্লাস্ট-এর কোনো শত্রুতা নেই এটা জানা গেছে। ওকে টাকার বিনিময়ে কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু সে কার হুকুমে একাজ করেছে, তা এখনও স্বীকার করেনি। ছাত্রটিকে গ্রেপ্তার করার কৃতিত্ব কিন্তু আমাদের নয়। এতে সাহায্য করেছেন এক আমেরিকান ভদ্রলোক। তিনি সে সময় ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি গুলি ছোঁড়া দেখেছেন। আর সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটিকে ধরে ফেলেন। সে পালাবার চেষ্টা করলে লোকটি চিৎকার করে পুলিশ ডাকেন। এরপর আমাদের লোক গিয়ে ছেলেটিকে গ্রেপ্তার করে।
পোয়ারো বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন–আমেরিকান? দেখেছেন আপনি? দাড়ি আছে?
–এক তরুণ, নাম তার হাওয়ার্ড রেইকস। পোয়ারোর মুখের দিকে দৃষ্টি পড়তে থমকে গেলেন জ্যাপ। তারপর কোনরকমে বললেন–কি হল, বন্ধু? আপনি চেনেন?
পোয়ারো বিষণ্ণ সুরে বললেন–হাওয়ার্ড রেইকস। থাকেন হাবোর্ন প্যালেস হোটেলে।
–হ্যাঁ। ওহ মনে পড়েছে। তাই ভাবছিলাম নামটা কেন চেনা লাগছে। আরে সেই ভদ্রলোক যে নাকি মর্লের মৃত্যুর দিন তার কাছে এসেছিল। অথচ ডাক্তার না দেখিয়ে চলে গিয়েছিল। কি আশ্চর্য। তাই না। একই জিনিস বার বার আমাদের সামনে আসছে। এখনও আপনার মাথাতে সেই পুরোনো পোকাটা রয়েছে?
পোয়ারো তীব্রস্বরে বললেন–হ্যাঁ, এটা আমার প্রত্যাশা পূরণ না হলে বেরোবে না।
ঠিক সাড়ে বারোটায় পোয়ারো গথিক হাউসে এলেন। তাকে অভ্যর্থনা করলেন একজন সেক্রেটারি। মার্জিত; শিক্ষিত তরুণ যুবা।
তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি দুঃখিত মি. ব্লাস্টও দুঃখপ্রকাশ করেছেন আপনাকে এখানে ডেকে আমার জন্যে, তিনি এখন নেই। তাঁর ডাক এসেছে ১০ ডাউনিং স্টিট থেকে। কারণ, গতকালের সেই অযাচিত ঘটনাটা। আমি আপনার ফ্ল্যাটে যোগাযোগ করেছিলাম। আপনার পরিচারক বলল, আপনি বেরিয়ে পড়েছেন। থেকে কোনো মন্তব্য না পেয়ে তরুণটি আবার বলতে লাগলেন–কেন্টের এমহ্যাসে মি. ব্লাস্টের একটি বাগানবাড়ি আছে। যদি সম্ভব হয় আপনাকে সেখানে যেতে বলেছেন। সপ্তাহের শেষের দিনটি আপনার সঙ্গে কাটানোর ইচ্ছে তার। আপনি যদি রাজি থাকেন বলুন। আমি তাকে জানিয়ে দেব। ফলে তিনি গাড়ি নিয়ে চলে যাবেন সেখানে।
পোয়ারো ভাবছিলেন কি জবাব দেবেন।
যুবকটি আবার বলতে শুরু করলেন মি. ব্লাস্ট আপনার সাথে দেখা করার জন্য খুবই ব্যাকুল হয়েছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো।
পোয়ারো এবার মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন বেশ, আমি আমন্ত্রণ গ্রহণ করছি।
ধন্যবাদ, আপনি যেতে রাজি হয়েছে শুনলে মি. ব্লাস্ট খুশি হবেন। একটা কথা, তিনি যদি ছটা নাগাদ যান তাহলে তার চোখ পড়ল মিসেস অলিভেরা জেনের দিকে। ইনি মিস অলিভেরার মা। তিনি সেই মুহূর্তে ঘরে প্রবেশ করেছেন। তিনি সুন্দর সাজে সজ্জিত। মাথায় দামি টুপি। সেই টুপিটি চোখের ভু পর্যন্ত নামানো ছিল।
তিনি তীব্রস্বরে বললেন–ওহঃ! মি. সেলবি, মি. ব্লাস্ট কি বাগানের চেয়ারের বিষয়ে আপনাকে কিছু বলেছেন? আমি গত সপ্তাহে তাকে বলেছিলাম। শুনেছি উনি সপ্তাহের শেষে বাইরে বেড়াতে যাবেন তাহলে তো কথা শেষ না করেই থেমে গেলেন পোয়ারোকে দেখে।
সেক্রেটারি ছেলেটি জানতে চাইলেন মিসেস অলিভেরার সঙ্গে আপনার এর আগে আলাপ হয়েছিল, মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
মিসেস অলিভেরা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন,
–ওহ! মি. পোয়ারো? ভালো আছেন? হ্যাঁ, মি. সেলবি, যা বলছিলাম, মি. ব্লাস্ট খুবই ব্যস্ত মানুষ জানি তাই এইসব ছোটোখাটো বিষয়ে তিনি মাথা ঘামান না–
মি. সেলবি সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন ঠিক আছে, মিসেস অলিভেরা। এই প্রসঙ্গে স্যারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি মেসার্স ভিডার্সকে ডেকে পাঠিয়েছি। তিনি আজ আসবেন।
মিসেস অলিভেরা বললেন–ধন্যবাদ, আমি নিশ্চিন্ত হলাম মি. সেলবি, আর একটা কথা, সপ্তাহের শেষে আমরাই কি কেবল ক্রমহ্যামে যাব নাকি আর…..।
মি. সেলবি শান্ত স্বরে বললেন–হা, মিসেস অলিভেরা, আপনার অনুমানই ঠিক। আমাদের সঙ্গে মি. পোয়ারোও যাচ্ছেন।
-সত্যি?
পোয়ারো হাসি মুখে বললেন মি. ব্লাস্টের মতো মানুষের আমন্ত্রণ আমি উপেক্ষা করতে পারি না। তাই তাঁর আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করলাম।
মিসেস অলিভেরা ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন–মানে, আলিস্টেয়ার আমাকে বলেছিলেন সপ্তাহটা আমাদের সঙ্গেই কাটাবেন। অন্য কোনো অতিথি সেখানে থাকবে না।
মি. সেলবি গলায় দৃঢ়তা এনে বললেন–মাপ করবেন, মিসেস অলিভেরা, মি. পোয়ারোর সঙ্গে মি. ব্লাস্টের জরুরি আলোচনা আছে। তাই তিনি তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
–তাহলে উনি আমাকে কথাটা জানাননি কেন?
এমন সময় সেখানে হাজির হল মিস জেন অলিভেরা। সে তার মাকে বলল–গলার স্বরে বিরক্তির প্রকাশ।, তুমি এখনও রেডি হওনি। মধ্যাহ্নভোজের সময় হয়ে গেছে।
আর একটু অপেক্ষা করো জেন, আসছি। হঠাৎ দেখতে পাওয়ার ভান করে পোয়ারোকে বলল–ওহ মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কখন এলেন?
মিসেস অলিভেরা তিক্ত স্বরে বললেন–মসিয়ো পোয়ারো, সপ্তাহের শেষ কাটাতে যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গে ক্রমহ্যামে।–
ওহ, বেশ মজা হবে। মিসেস অলিভেরা চলে গেলেন। এবার জেন পোয়ারোর সামনে একটু এগিয়ে এল। খুব নিচু গলায় বলল, কেউ যাতে শুনতে না পায়–মঁসিয়ে পোয়ারো, সত্যি আপনি ক্রমহ্যামে আসছেন? কিন্তু কেন? ‘
কাঁধ ঝাঁকিয়ে পোয়ারো বললেন–এটা আপনার কাকার সিদ্ধান্ত, মিস অলিভেরা।
জেন অসহিষ্ণু হয়ে বলল–তিনি কখন বলেছেন আপনাকে? কাকা তো কিছুই জানেন না–সম্ভবত না জানার কথা। আপনার সেখানে কি প্রয়োজন?
জেনের মা হলঘর থেকে চিৎকার করে ডাকলেন–জেন, একটা বাজে, দেরি হয়ে যাবে চলে এসো।
জেন চলে যেতে যেতে হিস হিস করে বলে গেল প্লীজ, আপনি আসবেন না।
জেন চলে যেতে পোয়ারো মিসেস অলিভেরার চীৎকার শুনতে পেলেন। তিনি উচ্চস্বরে বলছেন, জেন, তুমি ভীষণ অবাধ্য হয়েছ। আমাকে একটা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আমার কথার বিরুদ্ধাচরণ না করো।
তরুণ সেক্রেটারি মি. সেলবি বলে উঠলেন–তাহলে মঁসিয়ে পোয়ারো, আগামীকাল ঠিক পৌনে ছ’টার সময়। ভুলবেন না যেন।
পোয়ারো পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। কোনোরকমে জবাব দিলেন অবশ্যই।
মুহূর্ত কয়েক আগে তাঁর কানে যে কথাগুলো এল সেই কণ্ঠস্বরের সঙ্গে গতরাত্রে টেলিফোনে শোনা কণ্ঠস্বরের মিল খুঁজতে চাইছিলেন তিনি। তাই গতকাল গলাটা তার চেনা বলে মনে হয়েছিল।
তিনি গথিক হাউস থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
পথ চলতে চলতে ভাবছেন, তাহলে মিসেস অলিভেরা টেলিফোনে ভয় দেখাচ্ছেন? কি করে সম্ভব? স্বার্থপর, বুদ্ধিহীনা, যুক্তির ধার ধারেন না, আত্মগরিমায় বিভোর, মুরগির মতো নাদুসনুদুস মহিলার পক্ষে এমনটা করা অসম্ভব। তিনি মনে মনে হাসলেন, ভাবলেন তার কানই তাঁর সঙ্গে বিট্রে করেছে।
সকাল পৌনে ছ’টায় একটা রোলস গাড়ি এসে দাঁড়ালো এরকুল পোয়ারোর বাড়ির সামনে। গাড়িতে দুজন আরোহী। একজন গাড়ির মালিক অ্যালিস্টোর ব্লাস্ট, অন্যজন তার সেক্রেটারি মি. সেলবি।
পোয়ারো গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়ি চলতে শুরু করল। ব্লাস্ট তাঁর বাগান ও পুষ্প প্রদর্শনী নিয়ে কিছু কথা বললেন।
পোয়ারো বললেন–অভিনন্দন মি. ব্লাস্ট। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসতে পেরেছেন বলে সত্যিই আনন্দিত হয়েছি।
মি. ব্লাস্ট পোয়ারোর কথা শুনতে পেলেন না। তিনি বলে চললেন–সেদিন ছেলেটি আমাকে মারার চেষ্টা করেনি। ও চেয়েছিল প্রধানমন্ত্রীকে গুলি করতে। একাজে ছেলেটির কোনো অভিজ্ঞতা নেই। পেশাদার খুনি নয় সে। তাই প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি ছোঁড়ে সে। বেচারা টিপ কিভাবে করতে হয় তাই জানে না। ভেবেছিল প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দিলেই অর্থনীতির পালাবদল ঘটবে। মূর্খ সব।
এরকুল পোয়ারো বিমর্ষ সুরে বললেন আপনার জীবনের ওপর দিয়েও এরকম কতবার বিপদ গেছে, তাই না?
মি. ব্লাস্ট হেসে বললেন–এতে ওরা আমায় দমিয়ে দিতে পারেনি। অনেকদিন আগে একবার কে বা কারা ডাকে বোমা পাঠিয়েছিল। আমাকে মারার জন্য। কিন্তু সেই বোমা ছিল নিষ্ক্রিয়। তাই আমার কোনো ক্ষতি ওরা করতে পারেনি। যারা বিশ্বের কর্তৃত্ব হাতের মুঠোয় নিতে চাইছে তারা কিভাবে একটি বোমাকে কার্যকরী করতে হয় সেটাই জানে না। এতটাই মূর্খ তারা, ভাবুন একবার?
পোয়ারো মাথা ঝাঁকালেন।
মি. ব্লাস্ট আবার বলতে শুরু করলেন, আমি উচ্চ পদাধিকারী হলেও চালাক চতুর নই। চিরকালই সরল সাধারণ বুদ্ধিতে চলি। তবে অঙ্ক ও ইংরাজিতে আমার অসাধারণ জ্ঞান আছে। ইংরাজি কোনো লেখা যদি আমি পড়ি তার অর্থ সহজেই বুঝতে পারি। একটু হেসে বললেন, ছাড়ন ওসব কথা, তবে আমি বড় বড় কথা বলতে পছন্দ করি না। নিজের প্রশংসা নিজেই করা খুব খারাপ অভ্যেস। কাজের সব ব্যাপার আমি অফিসেই রেখে আসি। বেড়াতে বেরিয়ে ওসব কথা আলোচনা করে বেড়ানোর মজাটা নষ্ট করার পক্ষপাতী আমি নই। অনেক দিন ধরে আপনার রোমাঞ্চকর কাহিনি শোনার জন্যে আমি অপেক্ষা করে আছি। আমি অনেক রহস্য কাহিনি ও থ্রিলার পড়েছি। মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কি বিশ্বাস করেন বাস্তব জীবনেও এরকম ঘটনা ঘটতে পারে?
এরপরের যাত্রাপথে পোয়ারো নিজের কিছু চমকপ্রদ সাফল্যের কাহিনি শোনালেন। মি. ব্লাস্টও বাচ্চা ছেলের মতো মন দিয়ে শুনছিলেন। কখনো হো হো করে হেসে উঠছিলেন, আবার কখনো ভয়ে শিউরে উঠছিলেন।
শেষপর্যন্ত তাঁরা তাঁদের গন্তব্যে এসে পৌঁছলেন। ক্রমহ্যামের বাগান বাড়ি। সেখানে আগেই এসে উপস্থিত হয়েছিলেন জেন অলিভেরা ও তার মা মিসেস অলিভেরা।
মিসেস অলিভেরা পোয়ারোকে দেখে নিজের রাগ আর চেপে রাখতে পারলেন না। তাঁর আচরণে অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। তিনি পোয়ারোকে গ্রাহ্যই করলেন না। মি. ব্লাস্ট ও মি. সেলবিকে সমাদরে বাড়ির ভেতর ডেকে নিয়ে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত আগের আনন্দমুখর পরিবেশটা নিমেষে বিষাদে পরিণত হল।
জেন এগিয়ে এসে এরকুল পোয়ারোকে নিয়ে গেলেন বাড়ির ভেতরে। দেখিয়ে দিলেন নির্দিষ্ট ঘরটিকে।
চমৎকার বাড়ি। তবে ছোট্ট। ঘরগুলো খুব সুন্দর করে সাজানো। গৃহকর্তা শৌখিন মানুষ। তাই রুচিবোধও উচ্চমানের। লণ্ডনের বাড়ি যেভাবে সাজানো ঠিক সেই ভাবেই এই ঘরগুলি সুসজ্জিত। প্রতিটি জিনিসই মহামূল্যবান। এখানকার মানুষগুলোর কাজকর্ম পরিপাটি ও পরিষ্কার। ইংরাজসুলভ খাবার এবং ইউরোপীয় বয়। উৎকৃষ্ট স্যুপ, মটরশুটি সিদ্ধ, স্ট্রবেরি ও ক্রিম দিয়ে নৈশভোজ সারলেন পোয়ারো। নৈশভোজে প্রদত্ত সুরা পোয়ারোকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল। তিনি আহারে এতই মগ্ন ও তৃপ্ত ছিলেন যে মিসেস অলিভেরার বিসদৃশ আচরণ ও জেনের রুক্ষ ব্যবহার মনেই রাখলেন না। আহারের শেষে এরকুল পোয়ারো ভাবলেন যে কোনো কারণেই হোক জেন তার প্রতি ক্ষুব্ধ। তাই সে বিরূপ আচরণ করছে তাঁর সাথে কিন্তু কি সেই কারণ?
মি. ব্লাস্ট মিসেস অলিভেরার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন–হেলেন আমাদের সঙ্গে খেতে বসল না কেন?
জুলিয়া অলিভেরা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল–ওঁর বড্ড পরিশ্রম হয়েছে আজ। তাই ওকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। আমি ওকে বলেছি পোশাক পাল্টে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে।
ব্লাস্ট হতাশ হয়ে বললেন–ভেবেছিলাম সপ্তাহের শেষ দিনটি সবাই মিলে মজা করে কাটাব।
মিসেস অলিভেরা নিজের দোষ চাপা দেওয়ার জন্যে বললেন–হেলেন খুব ভালো মেয়ে। তাছাড়া ওর বেশি রাত পর্যন্ত জাগার অভ্যেস নেই।
এরকুল পোয়ারো খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন, তিনি ড্রয়িং রুমে এলেন, অ্যালিস্টেয়ার ও তার সেক্রেটারি সেখানে বসে রইলেন।
পোয়ারো ড্রয়িং রুমে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। তার কানে গেল জেনের রুক্ষ গলা। সে তার মাকে বলছে, মা, হেলেন মসেরকে তুমি অ্যালিস্টেয়ার কাকার চোখের আড়াল করলে কেন? তিনি খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন এতে।
মিসেস অলিভেরা কর্তৃত্বের সুরে বললেন–বেশ করেছি। অ্যালিস্টেয়ার অতি সজ্জন মানুষ। সে খুব উদার প্রকৃতিরও বটে। তাই কোনো গরিব আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুদের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয়। তেমনি হেলেনও একজন। তাকে বিনা ভাড়ায় এখানে থাকতে দিয়েছেন। সেটাই কি যথেষ্ট নয়। তা নয়, প্রতিবার আমরা সপ্তাহের শেষে এখানে আনন্দ করতে আসব, আর ওকেও তখন ডাকতে হবে, এর কোনো যুক্তি আছে। হতে পারে সে বোন বুও নিজের তো নয়। আলিস্টেয়ার ওর সব দায় দায়িত্ব নেবে তা আমি একেবারে বরদাস্ত করব না।
জেন বলল–বাগান পরিচর্যার কাজ ও খুব দক্ষ হাতে করে। তাই ও ভীষণ অহংকারী।
মিসেস অলিভেরা বললেন সেটাই তো স্বাভাবিক। স্কচরা কারও দাসত্ব গ্রহণ করে না, তাই তাদের সবাই সম্মান করে।
এমন সময় ব্লাস্ট সেখানে এলেন। তিনি পোয়ারোকে সহাস্যে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো আমার ঘরে চলুন।
পোয়ারো তাকে অনুসরণ করে ঘরে এলেন। খুবই আরামদায়ক ঘরটি। তবে একটু নীচু। বাগানমুখী দুটি জানালা। বেশ কিছু সোফা ও চেয়ারে ঘরটি সাজানো।
মি. ব্লাস্ট পোয়ারোর দিকে সিগারেট এগিয়ে দিলেন। নিজে একটি পাইপ ধরিয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলেন।
কিছুক্ষণ নীরবে কেটে গেল। এরপর মি. ব্লাস্ট বললেন এবার কাজের কথায় আসা যাক, মঁসিয়ে পোয়ারো। আমি মিস সেইনসবারি সীলের কথা আপনার কাছ থেকে জানতে চাইছি। পুলিশ প্রশাসন তার সম্পর্কে অনুসন্ধান চালাতে আর রাজি নয়। এর পিছনে কি কারণ আছে আমার জানা নেই। তাছাড়া অ্যালবার্ট চ্যাপম্যান কে, তার অভিসন্ধি কি সে বিষয়েও আমি ওয়াকিবহাল নই। ভিতরের ব্যাপার আমার জানা নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এটা খুশি মনে নিচ্ছেন না। তিনি প্রচার বন্ধ করতে বলেছেন। যাতে জনসাধারণের মনে এই ঘটনাটা রেখাপাত করতে না পারে, সেইজন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছেন। এসবই হল সরকারি নিয়মকানুন। সেই মেনে পুলিশও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। মি. ব্লাস্ট পোয়ারোর সামনে এগিয়ে এসে বললেন, সে যাইহোক, আমি প্রকৃত সত্য জানতে চাই। তাই এই কাজটার দায়িত্ব আপনার হাতেই সঁপে দিলাম, মঁসিয়ে পোয়ারো। সরকারি নিয়মকানুনে আপনার হাত বাঁধা পড়েনি। তাই আপনি স্বাধীনভাবে এই কাজটি করতে পারবেন।আমি কি করতে পারি মি.-ব্লাস্ট? আপনি মিস সেইসনবারি সীলের খোঁজ করুন। মৃত অথবা জীবিত যে অবস্থায় পান তাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসুন। দু-এক মিনিট নীরব রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন। আমি নিশ্চিত মিস সীল মারা গেছেন। মি. ব্লাস্ট গম্ভীর গলায় বললেন–আপনি কি করে জানলেন মিস সীল মারা গেছেন। এর কোনো প্রমাণ রয়েছে আপনার হাতে। পোয়ারো হেসে বললেন–আপনাকে এখন বোঝাতে পারবনা। তবে বলি মিসেস চ্যাপম্যানের ঘর থেকে একজোড়া নতুন মোজা পাওয়া গেছে। এটাই আসল কারণ, মি. ব্লাস্ট।
অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মি. ব্লাস্ট। পরে বললেন–আপনি ভারি মজার মানুষ, মঁসিয়ে পোয়ারো।
মৃদু হেসে পোয়ারো বললেন–সত্যি কথা হল, আমার একটা আদর্শ আছে, নিয়ম নীতি মেনে চলতে হয় যা কিছু সব যুক্তি দিয়ে বিচার করি। এছাড়া কোনো কিছুর ওপর নিজের মত চাপিয়ে দেওয়াও আমি পছন্দ করি না।
ব্লাস্ট বললেন–ঘটনার গতি প্রকৃতি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। সব কেমন অদ্ভুত লাগছে। প্রথমে ওই দন্তচিকিৎসকের আত্মহত্যা, তারপর ওই মিসেস চ্যাপম্যানের দেহ সিন্দুক থেকে উদ্ধার, মুখ বিকৃত হওয়া। সব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা এই কুৎসিত জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পিছনে নিশ্চয় কোনো কারণ আছে।
পোয়ারো মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়লেন।
ব্লাস্ট বললেন আমার যতদূর মনে পড়ছে ওই স্ত্রীলোকটিকে কখনোই আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেখিনি। কোনোদিনই তার সঙ্গে আমার স্ত্রীর আলাপ পরিচয় হয়নি। আমার সঙ্গে দেখা করার একটা ছল মাত্র। কিন্তু কেন? এতে তার কি লাভ? অতিরিক্ত টাকার লোভ? বাড়ির সামনে ওইভাবে দেখা করাটা আমার সন্দেহজনক বলে মনে হচ্ছে। বুদ্ধি খাঁটিয়ে পরিকল্পনা করে ওই সময়টা উনি বেছে নিয়েছেন। তাই বার বার আমার মনে আশঙ্কা জাগছে, এর কারণ কি হতে পারে?
পোয়ারো বললেন–দুঃখিত মি. ব্লাস্ট আমিও এই মুহূর্তে আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে পারছি না।
–এই ব্যাপারে আপনার ধারণা কি? মঁসিয়ে পোয়ারো–আমার ধারণাকে হাস্যকর বলে মনে হতে পারে যাকে এই কাজে নিয়োগ করা হয়েছে, সে চাইছিল আপনার ওপর অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। যেহেতু আপনি দেশের একজন সম্মানীয় ব্যক্তি। ব্লাস্ট অধৈর্য হয়ে বললেন–এতে তাদের কি আসে যায়?–অবশ্যই তাদের আসে যায়। যেদিন মি. মর্লে আত্মহত্যা করেন সেদিনের কথা ভাবুন। সেদিন মর্লের ব্যবহার আপনাকে কোনোভাবে ক্ষুণ্ণ করেছিল? এমন কিছু অসংলগ্ন কথা যার থেকে কোনো সূত্র পাওয়া যায়? ব্লাস্ট মনে করার চেষ্টা করলেন। বললেন–না মঁসিয়ে পোয়ারো, কিছুই মনে করতে পারছি না। তার মুখ থেকে মিস সেইনসবারি সীলের নামও শোনেন কি? অথবা মিসেস চ্যাপম্যানের নাম? তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন–না, না, মঁসিয়ে পোয়ারো, উনি কারো নাম বলেননি। আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল খেলাধুলা, বাগান, বৃষ্টি–এইসব।আপনারা যখন কথা বলছিলেন তখন অন্য কেউ ছিলেন? আলিস্টেয়ার ব্লাস্ট ভাবার জন্য সময় নিলেন। মিনিট কয়েক পর বললেন–না, তেমন কিছু মনে পড়ছে না। গতবার একজন সুন্দরী মহিলাকে দেখেছিলাম। এবার সে আসেনি–কিন্তু মর্লের সেই অংশীদার মি. রেইলি একবার এসেছিলেন, যিনি আইরিশদের মতো কথা বলেন। তার সঙ্গে মলে কি কথা বলেছিলেন? হা, মি. রেইলি মাত্র মিনিট দুয়েক ছিলেন। সামান্য কিছু কথা বলেছিলেন তারা দু’জনে। তারপর মি. রেইলি চলে গিয়েছিলেন। এরপরও তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলেন।
পোয়ারো চিন্তিতভাবে বললেন–আমিও তাকে সুস্থ ও স্বাভাবিক দেখেছিলাম। ঘরে পিন পতন নীরবতা। অনেকক্ষণ পরে নীরবতা ভঙ্গ করে এরকুল পোয়ারো প্রশ্ন করলেন–ভুলে যদি না যান তবে বলুন তো মি. ব্লাস্ট, সেদিন সকালে ওয়েটিং রুমে একজন তরুণকে অপেক্ষায় থাকতে দেখেছিলেন?
ভ্রু কুঁচকে ভেবে নিয়ে মি. ব্লাস্ট বললেন–না, না, ভুলিনি–একজন তরুণকে দেখেছিলাম। সে অস্থির হয়ে পায়চারি করছিল। তবে তার প্রতি বিশেষ কোনো মনোযোগ ছিল না আমার। কিন্তু কেন বলুন তো?
–তাকে আবার দেখলে চিনতে ভুল করবেন না তো?
মাথা নেড়ে না বললেন তিনি।
–সেকি আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য উদগ্রীব ছিল? ব্লাস্ট উৎসাহিত হয়ে বললেন, ব্যাপার কি? আমি কি ওই তরুণকে চিনি? ওর নাম কি?
পোয়ারো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ব্লাস্টের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। শেষে তিনি বললেন–আপনি তাকে চেনেন কিনা আমি বলতে পারব না। তবে আপনার ভাইঝি জেন তাকে ভালোভাবেই চেনে। তাদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। নাম হাওয়ার্ড রেইকস।
–ওহ, জেনের বন্ধু। আমি তো শুনেছি ওর মা ওদের সম্পর্ক মেনে নেননি। মি. ব্লাস্ট আনমনা হয়ে বললেন–তাতে জেনের কোনো ক্ষতি হবে না।
তিনি এতটাই রুষ্ট হয়েছেন যে আমেরিকা থেকে মেয়েকে এখানে নিয়ে এসেছেন। তাঁর ধারণা এতে মেয়েকে ওই তরুণটির কবল থেকে মুক্ত করা যাবে।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্টের মুখে চিন্তার কালো মেঘ। তিনি বললেন–এবার তাকে চিনতে পারছি। শুনেছি ছেলেটা খুব খারাপ। তার নামে নানা কুৎসা রটেছে। সে সন্ত্রাসমূলক কাজে লিপ্ত।
মিস অলিভেরা আমাকে বলেছে সে সেদিন সকালে মর্লের চেম্বারে গিয়েছিল। ছেলেটির উদ্দেশ্য ছিল আপনার মুখোমুখি হওয়া।
লাভ? তাকে কি আমার কাজে যোগ দিতে বলব?না, না, তা নয়, যাতে আপনাদের দুজনের মধ্যে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ঘৃণায় ব্লাস্টের মুখ বিকৃত হল। তিনি বললেন–একটা অপদার্থ।
পোয়ারো হাসি চেপে বললেন আপনার কিছু কিছু মতবাদ ওর অপছন্দের।
অ্যালিস্টেয়ার ব্লাস্ট নাক কুঁচকে বললেন–ওর মতো নোংরা চরিত্রের ছেলেকে আমি কখনো মেনে নেব না। অশিক্ষিত, অপদার্থ, আদর্শবাদের ধ্বজাধারী। দুষ্কর্ম ছাড়া ভদ্রজনোচিত কাজ তার দ্বারা সম্ভব নয়।
পোয়ারো কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে বসে রইলেন। দুই জনেই চুপচাপ। তারপর এক সময় পোয়ারো মাথা তুলে জানতে চাইলেন–আপনাকে যদি কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি তাহলে অনধিকার চর্চা বলে এড়িয়ে যাবেন না তো?
না, করুন। মি. ব্লাস্ট সংক্ষেপে উত্তর দিলেন।
–আপনার মৃত্যুর পর আপনার সম্পত্তি কে কে পাবে?
মি. ব্লাস্ট উষ্মার সুরে বললেন–এরকম প্রশ্ন করার মানে কি?
–মানে–এই ঘটনার সঙ্গে এই উত্তরটা ও তপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে।
বাজে কথা। কেউ আমাকে খুনের চেষ্টা করতে পারে না।
ধরুন, আপনার জন্মদিনে ফুলের মধ্যে টাইম বোমা ভরে উপহার দিল কেউ হয়তো। কোনো সভায় আপনি গিয়েছেন সেখানে আপনাকে লক্ষ্য করে কেউ গুলি ছোঁড়ে তাহলে?
–ওহ এই ব্যাপার। পৃথিবীতে যে ব্যক্তি অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে তার জীবনে এমন ঘটনা তো ঘটতেই পারে।
না, এমন হালকা ভাবে নেবেন না মি. ব্লাস্ট। এতে আপনার প্রাণহানির আশঙ্কা আছে। ব্লাস্ট বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বিহ্বল ভাব কাটিয়ে তিনি বললেন আমি বুঝতে পারলাম না। আমি জানতে চাইছি, আপনার অবর্তমানে কে বেশি লাভবান হবে?
ব্লাস্ট হেসে বললেন আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বেশিটাই দান করেছি ক্যানসার হাসপাতালে, অন্ধদের রয়্যাল ইনস্টিটিউটকে এবং এডওয়ার্ডস হাসপাতালকে। বাকি অর্থ দিয়েছি আমার বিবাহ সূত্রের ভগ্নী। মিসেস জুলিয়া অলিভেরা, তার কন্যা জেন অলিভেরাকে সম পরিমান অর্থ বেশ কিছু অর্থ দিয়েছি আমার এক দূর সম্পর্কের বোন হেলেন মন্ট্রেসরকে। সে আমার একমাত্র জীবিত আত্মীয়। তাকে দেখার মতো কেউ নেই। এবং আর্থিক দিক দিয়েও সে দুর্বল। তাই তাকে আমার এই কটেজে থাকতে দিয়েছি।
একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন ব্লাস্ট, আপনাকে বিশ্বাস করে এসব কথা বললাম দেখবেন আবার প্রচার না হয়।
–আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমি বিশ্বাসহানি করব না।
ব্লাস্ট মজা করে বললেন–মঁসিয়ে পোয়ারো, এবার হয়তো বলবেন, যে জুলিয়া বা জেন কিংবা হেলেন মসের আমাকে খুন করার ষড়যন্ত্র করছে।
–আমি এখন কিছুই বলব না, মি. ব্লাস্ট।
–তাহলে নার কাজটা আপনি করছেন?
মিস সেইনসবারি সীলকে খুঁজে বের করা? হ্যাঁ, আমি করব।
মি. ব্লাস্ট তৃপ্তির হাসি হেসে বললেন–ধন্যবাদ, মঁসিয়ে পোয়ারো। সত্যিই আপনি খাঁটি ইংরেজ এবং কাজের মানুষ।
পোয়ারো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন, দরজায় দাঁড়ানো ছিল দীর্ঘাঙ্গী জেন অলিভেরা। প্রায় তার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আর কি। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন তিনি ক্ষমা করবেন, মাদামোয়াজেল।
মিস অলিভেরা একটু সরে দাঁড়িয়ে বলল–আপনার সম্পর্কে আমার কি ধারণা জানেন, মঁসিয়ে পোয়ারো?
–কি, মাদামোয়াজেল?
–আমার ধারণা আপনি গুপ্তচর বৃত্তিতে পাকা, নীচ, আপনার ওই নোংরা বিশ্রী নাকটা সব ব্যাপারে গলিয়ে গণ্ডগোল সৃষ্টি করায় ওস্তাদ।
–আপনি শান্ত থাকুন, মাদামোয়াজেল।
জেন অলিভেরা প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলল–আমি জানি আপনি কি করতে পারেন আর না পারেন। আপনি কাকাকে মিথ্যে স্তোকবাক্য শুনিয়েছেন। আপনার কিছু করার ক্ষমতা নেই। আপনি কিছুই খুঁজে পাবেন না। কিছুতেই না! আমার প্রিয় কাকার ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। তিনি সম্পূর্ণ নিরাপদে আছেন। আপনাকে দেখলে আমার শরীর জ্বলে যায়। আপনি একজন সখের গোয়েন্দা ছাড়া আর কিছুই না। যাকে বলে বুর্জোয়া গোয়েন্দা।
পোয়ারো হতবাক, চোখ দুটি বিস্ফারিত, ভ্রুযুগল কুঞ্চিত। একবার তিনি গোঁফে হাত বুলিয়ে নিলেন।
বুর্জোয়া শব্দটি তাঁর খারাপ লাগেনি। জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী বুর্জোয়া সুলভই বটে, তাই এই কথাতে তিনি অপমানিত বোধ করেননি। কিন্তু জেন অলিভেরার অন্যান্য কটুক্তি তাঁকে আঘাত করেছে। সেসব ভাবতে ভাবতে তিনি ড্রয়িংরূমে এলেন।
সেখানে মিসেস অলিভেরা পেসেন্স খেলছিলেন।
পোয়ারোর পায়ের শব্দে মহিলা মুখ তুলে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে ছিল তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা। ওই নিষ্ঠুর চাহনি দেখে পোয়ারো চমকে উঠলেন। তিনি কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি ভাবলেন এখানে তিনি অবাঞ্ছিত।
তিনি বাগানে এলেন। বাতাসে সন্ধ্যামালতীর মিষ্টি সুবাস। খুশি মনে কেয়ারী করা পথ ধরে এগিয়ে চললেন তিনি।
বাগানের কোণে যেতেই তিনি দুটি ছায়া মূর্তি দেখতে পেলেন। তারা তাকে দেখে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। মনে হয় একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা প্রেম নিবেদনে ব্যস্ত। তিদি দ্রুত পায়ে সেখান থেকে এগিয়ে গেলেন। তিনি মি. ব্লাস্টের খোলা জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দেখলেন মি. ব্লাস্ট ও তার সেক্রেটারি কিছু নিয়ে আলোচনা করছেন।
শেষ পর্যন্ত এরকুল পোয়ারো নিজের জন্য বরাদ্দ ঘরটিতে প্রবেশ করলেন। এই ঘরটিতেই তাঁর রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিছানায় বসে তিনি চিন্তা করতে লাগলেন। সমস্ত ঘটনার অদ্ভুত পরম্পরার কথা তার মনে পড়ল।
সত্যিই কি টেলিফোনে মিসেস অলিভেরার কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন? না কি অন্য কারোর?
তাঁর মনের পর্দায় ভেসে উঠল সেই রহস্যময় মি. কিউ. এক্স ৯১২ ওরফে চ্যাপম্যানের কথা। মনে পড়ল সেই পরিচারিকা জ্যাগরোসের উদ্বিগ্ন দুটি চোখের চাহনি। মি. বার্নেসের সেই বৈচিত্র্যময় খোলাখুলি বলা কথাগুলি ভাবলেন।
সব ক্ষেত্রে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। সকলেই ইচ্ছে করে কিছু না কিছু গোপন করেছে। সেই সঙ্গে আর একটি সমস্যা হচ্ছে মিস সীলের অন্তর্ধান সূত্র পাওয়ার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে তাকে।