ছোটোগল্প
উপন্যাস
অন্যান্য

০৫. নতুন জীবনের শিক্ষা

০৫. নতুন জীবনের শিক্ষা

জাহাজ থেকে নামিয়ে বাক এবং তার চতুষ্পদ সঙ্গীদের নিয়ে যাওয়া হল খনি শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট একটি তাঁবুতে। ওইখানে বাক ও তার সঙ্গীরা এসে পড়ল এক ভয়ংকর পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে। তাবুর বাসিন্দা ছিল শতাধিক মানুষ। তাদের মধ্যে খুব কম লোকই ছিল পেরল্ট আর ফ্রাঁসোয়ার মতো ভদ্র ও সহৃদয় অধিকাংশই ছিল বদমেজাজি নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ এবং তাদের হাতে সর্বদাই থাকত চাবুক আর মুগুর। ওই লোকগুলোর সঙ্গে যে কুকুরগুলো ছিল, তাদের স্বভাব-চরিত্র ছিল মনিবদের চেয়েও খারাপ। বাক সবসময়ই প্রস্তুত থাকত অতর্কিত আক্রমণের মোকাবিলার জন্য। হাস্কি নামে অভিহিত ওই ভয়ংকর কুকুররা প্রতিপক্ষকে আত্মরক্ষার সুযোগ দিত না, নিঃশব্দে দ্রুত আঘাত হানত প্রতিপক্ষের উপর। বাক কোনোদিনই খুব নিরীহ জীব ছিল না, কিন্তু ওই হিংস্র বদমেজাজি জন্তুগুলোর সঙ্গে কলহে লিপ্ত হতে সে চাইত না। অতএব, যথাসম্ভব তাদের এড়িয়ে চলত সে।

মাত্র একদিনের জন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল বাক। পরের দিনই ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতার স্বাদ পেল সে। সে প্রসঙ্গে আসছি একটু পরে…

একদিন ফ্রাঁসোয়া অনেকগুলো চামড়ার ফিতে, বগলস প্রভৃতি সাজসজ্জা নিয়ে এল এবং ওই বস্তুগুলিকে বাক-এর শরীরে জড়িয়ে দিল। পূর্বোক্ত সাজ-সরঞ্জামের সঙ্গে বাক পরিচিত ছিল। তার পূর্বতন মনিব বিচারক মিলারের আস্তাবলে সে দেখেছিল যাত্রা করার আগে ঘোড়াদের ওইসব চামড়ার জিনিস দিয়ে সাজানো হত।

ঘোড়াকে যেভাবে গাড়িতে জুতে দেওয়া হয়, ঠিক সেইভাবেই একটা স্লেজগাড়ির সঙ্গে লাগাম, বন্ধনী প্রভৃতি জিনিসের সাহায্যে বাককে জুতে দেওয়া হল।

এইখানেই গল্প থামিয়ে স্লেজ সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। কারণ, বাংলাভাষী বালক বালিকাদের মধ্যে অনেকেই পূর্বোক্ত গাড়ি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে না। স্লেজগাড়ি তুষারবৃত উত্তরাঞ্চলের একমাত্র যান– গাড়িটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অন্যান্য গাড়ির মতো স্লেজের তলায় চাকা লাগানো থাকে না, চাকার বদলে থাকে দুটি সমান্তরাল ডাণ্ডা। রানার নামে অভিহিত ওই ডাণ্ডায় ভর দিয়ে কুকুর-টানা স্লেজ দ্রুতবেগে ছুটে যায় মাইলের পর মাইল অক্লেশে। ঘোড়ায় টানা গাড়ির চাকা এবং ঘোড়ার পা হালকা তুষারের উপর বসে যায় বলেই চক্রবিহীন স্লেজগাড়ি কুকুরের সাহায্যে চালানো হয়। কুকুরের দেহের ওজন ঘোড়ার চাইতে অনেক কম– সুতরাং তুষারমাখা কাদায় তাদের পা বসে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না এবং স্লেজের কাঠ অথবা ইস্পাত নির্মিত রানার তুষারের উপর দিয়ে পিছলে সবেগে ছুটতে পারে বলেই মানুষ ঘোড়ার বদলে কুকরবাহিত স্লেজ ব্যবহার করে উত্তর আমেরিকার তুষারবৃত অঞ্চলে। যে কুকুরগুলো স্লেজগাড়ি টানে, তাদের বিশেষভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়। শিক্ষিত কুকুর সহজেই চালকের ইঙ্গিত বুঝে বাঁদিকে বা ডানদিকে ঘুরে যায়, থামে, টানতে শুরু করে, সবচেয়ে বড়ো কথা, জমি যেখানে বিপজ্জনক, অর্থাৎ হালকা তুষারের তলায় যেখানে লুকিয়ে আছে। মৃত্যুফঁদের মতো অতল গহ্বর বা গভীর জলাশয় সেই মরণফাঁদের অস্তিত্ব চালকের চোখে ধরা পড়লেও শিক্ষিত কুকুর সেটা বুঝতে পারে এবং চলন্ত গাড়ি থামিয়ে দেয় চালকের ইঙ্গিত ছাড়াই! 

বাক-এর শিক্ষা শুরু হল ফ্রাঁসোয়ার হাতে। বুদ্ধিমান বাক খুব অল্পদিনের মধ্যেই স্লেজবাহী কুকুরের যাবতীয় নিয়মকানুন আয়ত্ত করে ফেলল। চতুষ্পদ স্লেজবাহকের শুধু গাড়ি টানার কৌশল শিখলে চলে না, যে ভয়ংকর পরিবেশের মধ্যে তাকে দিনযাপন করতে হয়, সেই অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন না থাকলে জীবনসংশয় অবশ্যম্ভাবী।

বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতোই এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার নিষ্ঠুর পরিণাম বাককে তার পারিপার্শ্বিক ভয়াল অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে তুলল। সেই কথাই বলছি..

বাক-এর সঙ্গিনী কার্লি নামে মেয়ে কুকুরটির কথা আগেই বলেছি। কার্লির শরীরটা প্রকাণ্ড হলেও স্বভাব ছিল খুব ভালো, অপরিচিত কুকুরদের সঙ্গে ঝগড়া করার চাইতে বন্ধুত্ব করার পক্ষপাতী ছিল সে। একদিন রাত্রে খাওয়ার পর কালি একটি স্লেজবাহী হাস্কি কুকুরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এগিয়ে গেল। হাস্কির দেহ ছিল কার্লির প্রায় অর্ধেক কিন্তু ওই ছোটোখাটো জন্তুটার স্বভাব যে কতটা হিংস্র ও ভয়ংকর হতে পারে, মুহূর্তের মধ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। কার্লিকে সতর্ক হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়েই হাস্কি লাফ দিল– দস্তাঘাতের একটা ধাতব শব্দ, বিদ্যুচ্চমকের মতো পরক্ষণেই আর এক লাফে হাস্কির প্রত্যাবর্তন- কার্লির চোখ থেকে চোয়াল পর্যন্ত বিদীর্ণ হয়ে জেগে উঠল এক সুগভীর রক্তাক্ত ক্ষতচিহ্ন!

বুনো নেকড়ে ওইভাবে লড়াই করে, কামড় বসিয়ে সরে যায়, শত্রুর দেহে কামড় বসিয়ে ধরে রাখে না- শত্রুকে বারংবার দংশনে রক্তাক্ত করে দেয় এবং পরিশেষে রক্তপাতে অবসন্ন শত্রুর শরীরে প্রাণঘাতী চরম আঘাত হানে। হাস্কি কুকুরেরা বুনো নেকড়ের মতোই ভয়ংকর, তাদের লড়াই-এর কৌশলও নেকড়ের মতো গৃহপালিত কুকুরের সঙ্গে স্বভাব-চরিত্রে তাদের কোনো মিল নেই।

নিতান্ত অকারণে সঙ্গিনীর উপর হাস্কি কুকুরের নির্দয় আক্রমণ বাককে আতঙ্কে বিহ্বল করে দিল, কিন্তু সশব্দে হেসে উঠল স্পিটজ।

এতক্ষণে যে হাস্কি কুকুরের দল চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছিল, তারা হঠাৎ ছুটে এসে কার্লি ও ক্ষুদ্রকায় হাস্কি কুকুরটিকে ঘিরে বসল এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের দিকে তাকিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে লাগল সাগ্রহে।

বিনাদোষে মার খেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল কার্লি, সে সক্রোধে ঝাঁপিয়ে পড়ল হাস্কির উপর। কিন্তু ক্ষুদ্রাকায় হাস্কি তার বিপুল বপু প্রতিদ্বন্দ্বীর আক্রমণ ব্যর্থ করে দিল একলাফে সরে গিয়ে–পরক্ষণেই আর এক লাফে কার্লির উপর পড়ে তীব্র দংশনে তাকে রক্তাক্ত করে দিয়ে সরে এল নাগালের বাইরে কার্লি একবারও শত্রুকে স্পর্শ করতে পারল না। হাস্কি কুকুরটার পরবর্তী আক্রমণে ভারসাম্য হারিয়ে মাটির উপর ছিটকে পড়ল কার্লি, সঙ্গেসঙ্গে চতুর্দিকে অপেক্ষমাণ হাস্কি কুকুরের দল সমবেত আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল ধরাশায়ী কার্লির উপর। অনেকগুলো দাঁতের নিষ্ঠুর আঘাতে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করল কার্লি…।

বাক বুঝল একদল হিংস্র বন্যপশুর সঙ্গে সে বাস করছে– গৃহপালিত হলেও স্বভাবে তারা বনবাসী শ্বাপদের মতোই রক্তলোলুপ, ভয়ংকর স্বজাতির মাংসে তাদের রুচি নেই কিছুমাত্র। দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ কোনো কুকুর মাটিতে ছিটকে পড়লে তার রক্ষা নেই ধরাশায়ী কুকুর ভূমিশয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ানোর আগেই তার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় সারমেয়-বাহিনীর সমবেত আক্রমণে। বাক মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামলেও সে কিছুতেই ভারসাম্য হারিয়ে ধরাশায়ী হবে না, কার্লির মতো অসহায়ভাবে সে মৃত্যুবরণ করবে না কখনোই। কার্লির শোচনীয় পরিণামে উল্লসিত স্পিটজের নিষ্ঠুর হাসির শব্দ তার মনের ভিতর ধ্বনিত হতে লাগল বারবার, পূর্বোক্ত ঘটনার পর থেকেই স্পিটজ সম্পর্কে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করতে লাগল বাক।

.

০৬. শীতার্তের আশ্রয়

তুষারাবৃত উত্তরাঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে সরকারি চিঠিপত্র সরবরাহ করার দায়িত্ব নিয়েছিল পেরল্ট। কার্লির মৃত্যুর ফলে কুকুরবাহী স্লেজগাড়ির গতি হল মন্থর, সুতরাং চিঠিপত্র যথাস্থানে যথাসময়ে পৌঁছনোর পরিবর্তে বিলম্বের সম্ভাবনা দেখা দিল। নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষা করতে পেরল্ট ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সেইজন্য অর্থব্যয় করতেও সে অসম্মত ছিল না- মধ্যাহ্নভোজনের পরেই দুটি নতুন কুকুর কিনে নিয়ে সে ফিরে এল তাঁবুতে।

ফ্রাঁসোয়া নবাগতদের পরীক্ষা করতে লাগল। কুকুর দুটি সহোদর ভাই হলেও তাদের স্বভাবে একটুও মিল ছিল না। বিলি ছিল মৃত কার্লির মতোই শান্ত নিরীহ, সর্বদাই সে অন্য কুকুরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহী কিন্তু তার ভাই জো ছিল অত্যন্ত বদমেজাজি– তার ঠোঁটের ফাঁকে ফাঁকে ধারাল দাঁতের সারি সবসময়ই কিছুটা বেরিয়ে থেকে প্রমাণ করত দাঁতের অধিকারী ওই অস্ত্রের ব্যবহার করতে বিলক্ষণ প্রস্তুত এবং অবরুদ্ধ ক্রোধের আগুনে তার দুই চক্ষু ছিল সর্বদাই জ্বলন্ত!

স্পিটজ তার স্বভাব অনুযায়ী নবাগতদের শিক্ষা দিতে এগিয়ে এল। বিলি বিনাযুদ্ধেই পরাজয় স্বীকার করল, তা সত্ত্বেও স্পিটজের নিষ্ঠুর দংশন বিলির দেহের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত ক্ষতের সৃষ্টি করল।

কিন্তু জো ভাই-এর মতো নিরীহ জীব নয়– হিংস্ৰদন্ত বিস্তার করে দুই চোখে ঘৃণা ও আক্রোশের আগুন জ্বালিয়ে সে এমন ভীষণভাবে রুখে দাঁড়াল যে, স্পিটজ বুঝল এই শত্রু কিছুতেই হার মানবে না– জীবন বিপন্ন করেও সে লড়াই করতে প্রস্তুত। এমন গোঁয়ার শত্রুর সঙ্গে মারামারি করতে চাইল না স্পিটজ, সে চটপট সরে পড়ল এবং মান বাঁচাতে এমন ভাব করল যেন সে জো নামে কুকুরটির সঙ্গে কখনোই লড়াই করতে চায়নি। গায়ের ঝাল মিটিয়ে নিতে সে আবার হামলা চালাল নিরীহ বেচারা বিলির উপর।

সেইদিনই নৈশভোজের আগে একটি লোক আরও একটি কুকুরকে তাবুতে নিয়ে এল। কুকুরটি লম্বা ও ছিপছিপে, তার ক্ষতবিক্ষত মুখ বহু রক্তাক্ত যুদ্ধের সাক্ষ্য দিচ্ছে এবং তার একটি চোখ অন্ধ (সম্ভবত কোনো যুদ্ধের পরিণাম)।

লোকটি পূর্বোক্ত কুকুরটিকে পেরন্টের কাছে বিক্রি করে দিল। ওর নাম সোল-লেকস, লোকটি বলল, কথাটার অর্থ হচ্ছে ক্রুদ্ধ পশু, বুঝলে?

কুকুরদের কাছে সোল-লেকস নামটির অর্থ ব্যাখ্যা করার দরকার হল না। এমন সার্থকনামা জীব বড়ো একটা দেখা যায় না। সে নির্বিকারভাবে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল দলের মাঝখানে। স্পিটজ নবাগতকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু একনজর তাকিয়েই সে বুঝতে পারল এই জটাও খুব সুবিধার নয়, এর সঙ্গে লাগতে গেলে বিপদ ঘটতে পারে- স্পিটজ আবার বসে পড়ল।

ডেভ নামে কুকুরটির মতোই সোল-লে ছিল শান্তিপ্রিয়, তবে কারও সঙ্গে বন্ধুত্বস্থাপনে সে ইচ্ছুক ছিল না– তাকে চুপচাপ থাকতে দিলেই সে খুশি। কিন্তু একটি বিষয়ে সে ছিল অতিশয় স্পর্শকাতর– তার যে চোখটা কানা, সেইদিক থেকে কোনো কুকুর তার নিকটবর্তী হলেই সে হিংস্র প্রতিবাদে চঞ্চল হয়ে উঠত।

নবাগত কুকুরটির চরিত্রগত দুর্বলতার বিষয় প্রথমেই সচেতন হল বাক এক রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে। প্রথম রাতেই বাক আগন্তুকের খুব কাছে এসে পড়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় সোল-লেকস-এর যে-চোখটা কানা, সেইদিকেই অবস্থান করছিল বাক। বিদ্যুত্বৎ ক্ষিপ্ত আক্রমণে বাক-এর কাঁধের মাংস হাড় পর্যন্ত কেটে নামিয়ে দিল সোল-লেকস। পেরল্ট তাড়াতাড়ি বাধা না দিলে তখনই একটা রক্তাক্ত বিপর্যয় ছিল অনিবার্য। ওই ঘটনায় দলের অন্য কুকুরগুলো সতর্ক হয়ে গেল। বেচারা বাক তার অজ্ঞতার প্রায়শ্চিত্ত করল রক্ত দিয়ে।

রাত্রি গভীর হওয়ার সঙ্গেসঙ্গে কাঁধের ক্ষত এবং ক্রমবর্ধমান শীত বাককে দারুণ অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিল। একটা তাঁবুর ভিতর জ্বলন্ত মোমবাতির আভাস পেয়ে এগিয়ে গেল বাক। তাঁবুর পর্দা ঠেলে ভিতরে গিয়ে সে দেখল সেখানে বসে আছে পেরল্ট ও ফ্রাঁসোয়া। কিন্তু তাবুর আরামদায়ক উত্তাপ ভোগ করতে পারল না বাক- পেরল্ট আর ফ্রাঁসোয়া হই হই শব্দে তাকে তাড়া করল, রান্নার যাবতীয় সামগ্রী অর্থাৎ হাঁড়িকড়াই-হাতা প্রভৃতি তুলে সজোরে ছুঁড়ে মারতে লাগল তার দিকে। এমন সাংঘাতিক অভ্যর্থনা থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য আবার বাক পালিয়ে এল তুষারাবৃত শীতার্ত প্রান্তরের বুকে। একটু উষ্ণ আশ্রয়ের সন্ধানে বাক যখন ইতস্তত পদচালনা করছে, সেইসময় তাকে আক্রমণ করতে এল একদল হিংস্র কুকুর। বাক দাঁত খিঁচিয়ে ধমক দিতেই তারা চটপট সরে পড়ল। ততক্ষণে তুষারপাত শুরু হয়েছে প্রবলবেগে, কাঁধের ক্ষতস্থানে আবার যন্ত্রণাবোধ করছিল ক্লান্ত ও অবসন্ন বাক…

হঠাৎ বাক-এর মস্তিষ্কে একটা নতুন চিন্তা চমকে উঠল বিদ্যুৎ চমকের মতো তার সঙ্গীদের বিশ্রামের জায়গা খুঁজে বার করতে পারলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। নতুন উদ্যমে শুরু হল অনসন্ধান পর্ব, কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি আর অনেক ঘোরাঘুরি করেও বাক তার সঙ্গীদের সন্ধান পেল না তারা যেন হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেছে তুষার-ঢাকা প্রান্তরের উপর থেকে!.. হতাশভাবে চলতে চলতে বাক যখন আবার মালিকদের তাবুর কাছে এসে পড়েছে, সেইসময়ে আচম্বিতে তার সামনের পা ঢুকে গেল বরফের মধ্যে এবং তার পায়ের তলা থেকে পিছলে সরে গেল কোনো একটি বস্তু! সভয়ে ছিটকে সরে এল বাক, তার গলা থেকে বেরিয়ে এল অস্ফুট ক্রুদ্ধ গর্জন কিন্তু একটা বন্ধুত্বসূচক শব্দে আশ্বস্ত হয়ে এগিয়ে এসে বাক দেখল বরফের মধ্যে একটা গর্ত খুঁড়ে শুয়ে আছে বিলি নামে নিরীহ কুকুরটি।

এবার আর কর্তব্য নির্ধারণে ভুল করল না বাকবরফের মধ্যে চটপট একটা গর্ত খুঁড়ে সে শুয়ে পড়ল তার শরীরের তাপে গর্তটা ক্রমশ গরম হয়ে উঠল আর সেই উষ্ণ আশ্রয়ের মধ্যে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল বাক ধীরে ধীরে…

.

০৭. পথে বিপথে

সারা রাত ধরে তুষারপাত চলল। পরের দিন সকালে মানুষ ও কুকুরের মিলিত শব্দে বাক-এর যখন ঘুম ভাঙল, তখন তুষারের স্তূপ তার শরীর ঢেকে ফেলেছে। গত রাত্রির কথা প্রথমে তার মনে পড়েনি, ঘুম ভাঙার পর যখন সে বুঝল জমাট তুষারস্তূপের তলায় সে শুয়ে আছে, তখনই তার মনে হল একটা বিপজ্জনক ফঁদের মধ্যে পড়ে গেছে সে। বাক গৃহপালিত কুকুর, খাঁচার সঙ্গে তার পরিচয় থাকলেও ফাঁদ নামক বস্তুটি তার অজানা কিন্তু বনবাসী পূর্বপুরুষের বন্য সংস্কার তাকে ফাঁদ সম্পর্কে সচেতন করে দিল- দারুণ আতঙ্কে এক লাফ মেরে স্তূপাকার তুষারের আবরণ ভেদ করে সূর্যের উজ্জ্বল আলোকধারার মধ্যে সে আত্মপ্রকাশ করল।

বাক-এর অভাবিত আবির্ভাবে উল্লসিত পেরল্ট ফ্রাঁসোয়াকে উদ্দেশ করে বলল, কুকুরটা খুব বুদ্ধিমান। দেখ, এক রাতের মধ্যেই সে সব কিছু শিখে ফেলেছে!

ইতিমধ্যে আরও তিনটি হাস্কি কুকুর কিনে ফেলেছে পেরল্ট। কুকুরের সংখ্যা এখন নয়। ওই নয়টি কুকুরকে স্লেজগাড়িতে জুতে নিয়ে একদিন অজানা পথে যাত্রা করল পেরল্ট ও ফ্রাঁসোয়া। বাক সবিস্ময়ে আবিষ্কার করল সোল-লেকস আর ডেভ নামে কুকুর দুটি চরিত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে যে-দুটি কুকুর নিঃসঙ্গ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল, তারা এখন সমবেতভাবে কর্তব্য করতে উৎসুক উৎসাহে, আবেগে তার যেন ছটফট করছে! যাত্রা শুরু হওয়ার পরে দেখা গেল ওই কুকুর দুটির স্লেজবাহক হিসাবে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে। বরফ-ঢাকা বিপজ্জনক পথে কেমন করে চলতে হয় তারা জানে। দলের অন্যান্য কুকুর ভুল করলে তারা ভীষণ বিরক্ত হত।

বাক প্রথম-প্রথম ভুল করত। সকলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে ছুটতে পারত না। অনেক সময়ে লাগামে পা জড়িয়ে সে বিভ্রাটের সৃষ্টি করত। গাড়িতে জুতে দেওয়ার সময় হলে সে চটপট হাজির হতে পারত না। ওই ধরনের বিপত্তি ঘটলেই সোল-লেকস অথবা ডেভ বাককে আক্রমণ করত, ধারাল দাঁতের কামড় বসত বাক-এর শরীরে। কিন্তু অকারণে তারা কখনো বাক-এর উপর হামলা করত না। বাক বুঝল কুকুর দুটি তার শত্রু নয়, শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তারা নিষ্ঠুর ব্যবহার করে। বাক বুদ্ধিমান জীব, খুব অল্পদিনের মধ্যেই সে পথ চলার কৌশল আয়ত্ত করে ফেলল। অন্য কুকুরদের মতোই মহা-উৎসাহে সে স্লেজ টানতে শুরু করল। সাধারণত ধাবমান স্লেজের সামনের পথের দিশারি হয়ে বরফ ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে যেত পেরল্ট তার বিশেষভাবে তৈরি জুতো দিয়ে অনুসরণকারী স্লেজবাহক কুকুরদের সে সাহায্য করত যথাসাধ্য। বরফ-ঢাকা পথের অভিজ্ঞ পথিক পেরল্ট একবার তাকিয়েই বুঝতে পারত তুষারের আবরণ কতটা পুরু এবং ওই আবরণ বা আস্তরণের উপর স্লেজগাড়ির নিরাপত্তা বা নিরাপত্তার অভাবও সে অনুমান করতে পারত নির্ভুলভাবে..

পেরল্ট নামে দ্বিপদ মালিক আর ডেভ ও সোল-লেকস নামে চতুষ্পদ সহকর্মী দুটির নেতৃত্বে খুব অল্পদিনের মধ্যেই বাক একজন অভিজ্ঞ ব্লেজবাহক হয়ে উঠল.. জমাট এবং গভীর বরফপ, বরফ ঢাকা মসৃণ পিচ্ছিল পথ বেয়ে দিনের পর দিন ছুটতে লাগল স্লেজবাহক কুকুরের দল… অবশেষে দেখা গেল একদিনে চল্লিশ মাইল পথ পার হয়ে এসেছে তারা! পেরল্ট ঘোষণা করল, এতদিন ধরে সে যতগুলো দলকে নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের মধ্যে বর্তমান কুকুর বাহিনী হচ্ছে সবচেয়ে দক্ষ, সকলের সেরা। বাক এখন খুব খুশি, সোল-লেকস আর ডেভ তার বন্ধু, মালিক পের তার আচরণে সন্তুষ্ট– শৃঙ্খলা মেনে দলের সঙ্গে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে শিখেছে বাক। পেরন্টের প্রশংসা আর একদিনে চল্লিশ মাইল পথ পেরিয়ে আসার কথা ভাবতে ভাবতে সেই রাতে ঘুমিয়ে পড়ল বাক।

.

০৮. আদিম সংগীত

বাক ক্ষুধার্ত। সর্বদাই সে ক্ষুধার্ত থাকে। তীব্র শীতার্ত আবহাওয়ায় মাইলের পর মাইল স্লেজ টেনে ছুটে চলার পরিশ্রম তার উদরে যে ক্ষুধার আগুন জ্বালিয়ে দেয়, পরিমিত মাপা খাদ্য সেই আগুন নিবিয়ে দিতে পারে না। দলের অন্য কুকুরদের চাইতে তাকে বেশি খাবার দেওয়া হত। মালিক দু-জন বুঝেছিল অন্য কুকুরদের চাইতে বাক-এর শরীর অনেক বড়, তাই তুলনামূলকভাবে তাকে বেশি খাবার না দিলে সে দুর্বল হয়ে পড়বে। সকলের জন্য বরাদ্দ ছিল এক পাউন্ড শুকনো স্যালমন মাছ, বাক-এর জন্য বরাদ্দ দেড় পাউন্ড। তবু তার পেট ভরত না। অন্য কুকুরদের দেহের আকার ছোটো, তার উপর তারা কঠিন পরিশ্রমে অভ্যস্ত, তাই কম খেয়েও তাদের স্বাস্থ্য বেশ ভালো ছিল। কিন্তু কঠিন পরিশ্রমে অনভ্যস্ত বাক-এর প্রকাণ্ড শরীর প্রয়োজনীয় খাদ্যের অভাব অনুভব করত প্রতি মুহূর্তে। এমনকী বরাদ্দ খাবারও তার ভাগ্যে অনেক সময় জুটত না, অন্য কুকুরেরা সুযোগ পেলেই তার খাবার খেয়ে ফেলত। বাক একসময়ে শৌখিন খাদ্যরসিক ছিল হাউমাউ করে সে খাবার গিলত না–রসিয়ে রসিয়ে সময় নিয়ে সে আহার্য গ্রহণ করত বনেদি বংশের সন্তানের মতো। কিন্তু এখনকার হ্যাংলা কুকুরগুলো ঝটপট নিজেদের খাদ্য গলাধঃকরণ করেই বাক-এর খাবারে ভাগ বসাত। বাক কিছুতেই তাদের বাধা দিতে পারত না। সে যখন দু-দুটো কুকুরের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত, তখন তৃতীয় কুকুরটি বাক-এর বরাদ্দ মাছটি নিয়ে সরে পড়েছে নিরাপদ দূরত্বে! এমন হাভাতে হ্যাংলা অসভ্য সঙ্গীদের কবল থেকে লড়াই করে খাবার বাঁচানো যায় না এদের ঠেকানোর একটাই উপায় এবং মাথা খাঁটিয়ে সেই উপায়টাই একসময়ে বার করে ফেলল বাক। সে খুব তাড়াতাড়ি খেতে শিখল- অন্য কুকুররা তাদের খাবার শেষ করে বাক-এর উপর হানা দিতে এসে দেখত বাক তার খাদ্য অনেক আগেই শেষ করে বসে আছে।

একটা প্রবাদ আছে, প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষ আবিষ্কার করে। কথাটা শুধু মানুষ সম্পর্কে নয়, কুকুর সম্পর্কেও প্রযোজ্য। বাক চুরি করতে শিখল। এমন সাবধানে সে চুরি করত যে, মনিবরা বুঝতেই পারত না কে চুরি করেছে। মাইক নামে কুকুরটি এবিষয়ে তার পথ-প্রদর্শক। একদিন পেরল্ট যখন রান্না করছে, সেইসময় তার পিছনে এসে নিঃশব্দে এক টুকরো মাংস নিয়ে সরে পড়ল মাইক। দৃশ্যটা বাক-এর চোখে পড়েছিল। বিচারক মিলারের পোষ্য বাক এতদিন চুরির কথা কল্পনাই করতে পারেনি, চুরি তো মহাপাপ! কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাইকের চৌর্যবৃত্তি তাকে উৎসাহিত করল এবং পরের দিনই পেরন্টের অজ্ঞাতসারে তার থালা থেকে একটা মস্ত বড়ো মাংসের চাই সরিয়ে ফেলল বাক। পেরল্ট মাইকের চুরি ধরতে পারেনি, কারণ অপহৃত মাংসের টুকরোটা ছিল খুব ছোটো কিন্তু বিরাট একখণ্ড মাংস উধাও হয়ে যেতেই ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল পেরল্ট। বাক-এর মতো সভ্যভব্য ভদ্র কুকুরকে চোর বলে ভাবতে পারল না সে, ডাব নামে একটি কুকুরকে সন্দেহ করে তার উপর সে চাবুক চালাল। বাক বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করল না, নিজের কৃতিত্বে দস্তুরমতো খুশি হল সে।

ক্রমশ কঠিন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল বাক। লোহার মতো শক্ত হয়ে উঠল তার দেহের মাংসপেশী। সাধারণ ব্যথা-বেদনা সে আর অনুভব করত না। তৃষ্ণার্ত হলে কেমন করে কঠিন বরফের নিরেট আবরণ ভেদ করে তলদেশে অবস্থিত শীতল জলে তৃষ্ণা নিবারণ করা যায়, নখের ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে থাকা বরফের টুকরো কেমন করে বার করতে হয়- সব কৌশল সে রপ্ত করে ফেলল। এখন যে-কোনো খাদ্য তা যত অখাদ্যই হোক– সে নির্বিকারভাবে উদরস্থ করতে পারে। তার সবল পরিপাকযন্ত্র নিতান্ত অখাদ্য থেকেও খাদ্যরস সংগ্রহ করে শরীরকে বলিষ্ঠ করে তুলতে সমর্থ। ওই সঙ্গে জন্মগত ঘ্রাণশক্তি হয়েছে আরও তীব্র, শ্রবণ-ইন্দ্রিয় হয়ে উঠেছে এমন তীক্ষ্ণ যে, ঘুমের মধ্যেও সাম্ভাব্য বিপদের ইঙ্গিত বুঝতে তার অসুবিধা হয় না।

শুধু অভিজ্ঞতা থেকেই সে শিক্ষালাভ করেনি, পূর্বপুরুষের আদিম সংস্কার তার রক্তে জেগে উঠছিল ধীরে ধীরে। গৃহপালিত কুকুরের শিক্ষা-দীক্ষা একসময়ে মুছে গেল তার চরিত্র থেকে, জাগ্রত হল পূর্বপুরুষের হিংস্র সত্তা, যুগযুগান্তরের বিস্মৃতির আবরণ ভেদ করে- যেমনভাবে একসময়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই করেছে বুনো নেকড়ের দল, ঠিক সেইভাবেই লড়তে শিখল বাক। নেকড়ের মতোই চাঁদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠত সে, অন্ধকার অরণ্যের বুকে বিষাদের শিহরন তুলে বাজাত সেই আদিম জান্তব সংগীত।

.

০৯. মৃত্যুর হানা

দলের নেতা স্পিটজ আর বাক-এর বিরোধ ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। বাক তার নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল, অনর্থক কলহে লিপ্ত হতে চাইত না সে। কিন্তু স্পিটজ ভুল বুঝল, সে ভাবল বাক ভয় পাচ্ছে। স্পিটজ আরও একটা ভুল করল- সে ধরে নিল শুধু বিশাল দেহের অধিকারী বলেই বাককে দলের কুকুরা সমীহ করে, আসলে বাক দুর্বল ও ভীরু লড়াই করতে সে ভয় পায়। লে বার্জ নামক হ্রদের ধারে যে রাতে স্লেজচালকদের তাবু পড়ল, সেই রাতেই বাক-এর সঙ্গে কলহে লিপ্ত হল স্পিটজ।

কনকনে ঠান্ডা বাতসের ভিতর দিয়ে বরফ ভেঙে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল ফ্রাঁসোয়া আর পেরল্ট, বাতাস যেন ধারাল ছুরির মতো ছোবল মারছিল তাদের শরীরে বাধ্য হয়ে অন্ধকার নেমে আসার অনেক আগেই দুই স্লেজচালক সেদিন তাঁবু খাঁটিয়ে ফেলল। একটা উঁচু পাথরের তলায় বরফ খুঁড়ে রাতের আস্তানা বানাল বাক। বরফের তলায় ওই সদ্যনির্মিত বাসা এত আরামদায়ক যে, সেই আশ্রয় ছেড়ে বাইরে আসতে সে আদৌ ইচ্ছুক ছিল না। ফ্রাঁসোয়া যখন কুকুরদের ডেকে তাদের বরাদ্দ মাছ বিতরণ করতে শুরু করল, তখন নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেবলমাত্র খাওয়ার জন্যই অমন চমৎকার আশ্ৰয়টা ছেড়ে খাদ্যগ্রহণের জন্য এগিয়ে গেল বাক।

চটপট আহার শেষ করেই বাক ফিরে গেল তার আস্তানার দিকে, কিন্তু গর্তের ভিতর সে ঢুকতে পারল না কারণ সেখানে বেশ আরাম করে শুয়েছিল স্পিটজ। বাক যখন খাদ্যগ্রহণে ব্যস্ত, সেইসময়ে তার তৈরি করা গর্তটাকে স্পিটজ অধিকার করেছে। সব কিছুরই শেষ আছে, স্বভাবে শান্ত হলেও বাক-এর ধৈর্য অসীম নয়- সগর্জনে সে ঝাঁপিয়ে পড়ল স্পিটজের উপর। দুজনে জড়াজড়ি করে ছিটকে বেরিয়ে এল গর্তের বাইরে, পরক্ষণেই দন্তবিস্তার করে দুই শত্রু পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করতে লাগল হিংস্র আগ্রহে।

কুকুরদের চরিত্র সম্পর্কে দস্তুরমতো অভিজ্ঞ ছিল ফ্রাঁসোয়া আর পেরল্ট, বাক এবং স্পিটজের চালচনল দেখে অনেক আগেই তাদের মনিব দু-জন বুঝতে পেরেছিল একটা ভয়ংকর লড়াই আসন্ন– এই কলহের একমাত্র ও অনিবার্য সমাধান হচ্ছে মৃত্যু!

বাক, হতভাগা স্পিটজকে ভালো রকম শিক্ষা দাও, চিৎকার করে উঠল পেরল্ট, ও একটা ছিঁচকে চোর।

কিন্তু দুই শত্রুর মৃত্যুপণ লড়াই শুরু হওয়ার আগেই বাধা এল-হঠাৎ তীব্রকণ্ঠে একটা কটু শপথ করে হাতের মুগুর সবেগে চালনা করল পেরল্ট– একটা বুনো কুকুর খাবারের বাক্সটার দিকে চুপি চুপি এগিয়ে আসছিল, পেরন্টের মুগুর সজোরে ও সশব্দে নেমে এল তার অস্থিসার দেহের উপর।

পরক্ষণেই খাবারের বাক্সটাকে আক্রমণ করল এক বিরাট সারমেয়-বাহিনী। চল্লিশ কিংবা পঞ্চাশটা বুনো কুকুর ছিল ওই দলে। তাদের সমবেত আক্রমণে বাক্সটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে খাবারগুলো ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে। ফ্রাঁসোয়া আর পেরল্টের মুগুরের আঘাত অগ্রাহ্য করে ক্ষুধার্ত জন্তুগুলো খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ডিম, রুটি, মাংস প্রভৃতি খাদ্যসামগ্রী অন্তর্ধান করল বুভুক্ষু কুকুরদের উদরে!

স্লেজবাহক কুকুরের দল সাগ্রহে দেখছিল বাক আর স্পিটজের দ্বন্দ্বযুদ্ধ; বুনো কুকুরদের হঠাৎ আবির্ভাব তাদের চমকে দিয়েছিল। প্রথমে তারা অবাক হয়ে আগন্তুকদের গতিবিধি লক্ষ করছিল। কিন্তু বুনো কুকুরদের দলটা যখন খাবার শেষ করেই পোষা কুকুরদের উপর হিংস্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন পোষা কুকুরগুলো বুঝল নিশ্চেষ্ট দর্শকের ভূমিকায় থাকলে মৃত্যু অবধারিত– প্রথম বিস্ময়ের চমক কেটে যেতেই তারা রুখে দাঁড়াল সমবেতভাবে। স্লেজবাহক কুকুররা ছিল বুনোদের চাইতে অনেক বড়ো এবং ওজনে ভারি– তার উপর নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণের ফলে তাদের দেহ হয়েছিল পেশীপুষ্ট, বলিষ্ঠ তাই এক-একটি স্লেজবাহক কুকুর দুদুটো অনশনক্লিষ্ট বুনো কুকুরকে অনায়াসেই মাটির উপর ঝেড়ে ফেলেছিল। কিন্তু বুনোদের সংখ্যা ছিল স্লেজবাহক কুকুরদের চাইতে অনেক বেশি, সুতরাং বুনোদের চাইতে শারীরিক ক্ষমতায় অধিকতর বলিষ্ঠ হলেও সংখ্যাগুরু শত্রুর আক্রমণে তাদের জীবন হয়ে উঠল বিপন্ন।

একসঙ্গে তিন-তিনটি শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে বাক দেখল আরও একটি কুকুর তাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছে। নবাগত শত্ৰু বাক-এর অপরিচিত নয়, সবিস্ময়ে সে দেখল বুনো কুকুরদের দলে যোগ দিয়ে স্পিটজ তার গলায় কামড় বসিয়ে দিয়েছে! দারুণ আক্রোশে সংহারমূর্তি ধারণ করল বাক- এমন ভয়ংকর, এমন তীব্র সেই আক্রমণ যে, মুহূর্তের মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল চার-চারটি শত্রু!

ইতিমধ্যে লড়াই করতে করতে পিছু হেঁটে জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করছিল স্লেজবাহক কুকুরের দল। বুনোরা তাদের অনুসরণ না করে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে গেল খাদ্যের সন্ধানে। পোষা কুকুররা সকলেই কম-বেশি আহত হয়েছিল। ডলি নামে মেয়ে কুকুরটির আঘাত ছিল মারাত্মক ধারাল দাঁতের কামড়ে তার গলায় ফুটে উঠেছিল বীভৎস ক্ষতচিহ্ন।

সারা রাত ধরেই পোষা কুকুরের দল তাদের রক্তাক্ত ক্ষতগুলোর পরিচর্যা করল, তারপর ভোরের আলো পৃথিবীতে উঁকি মারার সঙ্গেসঙ্গে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরে এল পরিত্যক্ত অঁবুতে।

বুনো কুকুররা তখন সরে পড়েছে। পেরল্ট আর ফ্রাঁসোয়ার মনের অবস্থা ভালো নয়। খাবার-দাবার যা ছিল তার অর্ধেক গেছে বুনোদের পেটে, বাকি অর্ধেক অতিকষ্টে বাঁচিয়েছে দুই বন্ধু। অনশনক্লিষ্ট ক্ষুধার্ত বুনো কুকুরের দল যা পেয়েছে তা-ই খেয়েছে লাগাম, জুতো কিছুই তারা বাদ দেয়নি।

ছিন্নভিন্ন লাগামগুলো মেরামত করে দুই বন্ধু যখন কুকুরগুলোকে স্লেজগাড়িতে জুতে নিয়ে আবার যাত্রা করার আদেশ দিল, তখনও আহত কুকুরদের শরীরে দস্তুরমতো যন্ত্রণা ছিল। কিন্তু কেউ বিদ্রোহ করল না, স্লেজটাকে টানতে টানতে তারা চলতে শুরু করল। কুকুররা কেউ তখন অসমাপ্ত লড়াইটার কথা ভাবছিল না, এমনকী দ্বন্দ্বযুদ্ধের দুই নায়ক স্পিটজ আর বাক-এর মনেও লড়াই-এর চিন্তা উঁকি দেয়নি মুহূর্তের জন্য।