পৃথিবীর ধর্মগুলি পর্যালোচনা করিলে আমরা সাধারণতঃ দুইটি সাধনপথ দেখিতে পাই। একটি ঈশ্বর হইতে মানুষের দিকে বিসর্পিত। অর্থাৎ সেমিটিক ধর্মগোষ্ঠীতে দেখিতে পাই—ঈশ্বরীয় ধারণা প্রায় প্রথম হইতেই স্ফূর্তিলাভ করিয়াছিল, অথচ অত্যন্ত আশ্চর্য যে, আত্মা সম্বন্ধে তাহাদের কোন ধারণা ছিল না। ইহা উল্লেখযোগ্য যে, অতি-আধুনিককালের কথা ছাড়িয়া দিলে প্রাচীন য়াহুদীদের মধ্যে জীবাত্মা-সম্পর্কে কোন চিন্তার স্ফুরণ হয় নাই। (তাহাদের মতে) মন ও কতিপয় জড়-উপাদানের সংমিশ্রণে মানুষের সৃষ্টি, তাহার অতিরিক্ত আর কিছু নয়; মৃত্যুতেই সব কিছুর পরিসমাপ্তি। অথচ এই জাতির মধ্যেই ঈশ্বর সম্বন্ধে অতি বিস্ময়কর চিন্তাধারার বিকাশ হইয়াছিল। ইহাও অন্যতম সাধনপথ। অন্য সাধনপথ—মানুষের ভিতর দিয়া ঈশ্বরাভিমুখে। এই দ্বিতীয় প্রণালীটি বিশেষরূপে আর্যজাতির, আর প্রথমটি সেমিটিক জাতির।
আর্যগণ প্রথমে আত্মতত্ত্ব লইয়া শুরু করিয়াছিলেন; তখন তাঁহাদের ঈশ্বরবিষয়ক ধারণাগুলি অস্পষ্ট, পার্থক্য-নির্ণয়ে অসমর্থ ও অপরিচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু কালক্রমে আত্মা সম্বন্ধে তাঁহাদের ধারণা যতই স্পষ্টতর হইতে লাগিল, ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণা সম অনুপাতে স্পষ্টতর হইতে লাগিল। সেইজন্য দেখা যায়, বেদসমূহে যাবতীয় জিজ্ঞাসাই সর্বদা আত্মার মাধ্যমে উত্থাপিত হইয়াছিল এবং ঈশ্বর সম্বন্ধে আর্যদিগের যত কিছু জ্ঞান সবই জীবাত্মার মধ্য দিয়াই স্ফূর্তি পাইয়াছে। সেইহেতু তাঁহাদের সমগ্র দর্শন-সাহিত্যে অন্তর্মুখী ঈশ্বরানুসন্ধানের বা ব্রহ্মজিজ্ঞাসার একটি বিচিত্র ছাপ অঙ্কিত রহিয়াছে।
আর্যগণ নিজেদের অন্তরেই চিরদিন ভগবানের অনুসন্ধান করিয়াছেন। কালক্রমে ঐ সাধনপ্রণালী তাঁহাদের নিকট স্বাভাবিক ও নিজস্ব হইয়া উঠিয়াছিল। তাঁহাদের শিল্পচর্চা ও প্রাত্যহিক আচরণের মধ্যেও ঐ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। বর্তমানকালেও ইওরোপে উপাসনারত কোন ব্যক্তির প্রতিকৃতি আঁকিতে গিয়া শিল্পী তাঁহার দৃষ্টি ঊর্ধ্বে স্থাপন করাইয়া থাকেন। উপাসক প্রকৃতির বাহিরে ভগবানকে অনুসন্ধান করেন, দূর মহাকাশের দিকে তাঁহার দৃষ্টি প্রসারিত রহিয়াছে—এইভাবে সেই প্রতিমূর্তি অঙ্কিত হয়। পক্ষান্তরে ভারতবর্ষে উপাসকের মূর্তি অন্যরূপ। এখানে উপাসনায় চক্ষুদ্বয় মুদ্রিত থাকে, উপাসকের দৃষ্টি যেন অন্তর্মুখী।
এই দুইটি মানুষের শিক্ষণীয় বস্তু—একটি বহিঃপ্রকৃতি, অপরটি অন্তঃপ্রকৃতি। আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর-বিরোধী হইলেও সাধারণ মানুষের নিকট বহিঃপ্রকৃতিও—অন্তঃপ্রকৃতি (বা চিন্তা-জগৎ) দ্বারা সম্পূর্ণরূপে গঠিত। অধিকাংশ দর্শনশাস্ত্রে, বিশেষতঃ পাশ্চাত্য দর্শনশাস্ত্রে, প্রথমেই অনুমিত হইয়াছে যে, জড়বস্তু এবং চেতন মন—দুইটি বিপরীতধর্মী। কিন্তু পরিণামে আমরা দেখি, উহারা বিপরীতধর্মী নয়; বরং ধীরে ধীরে উহারা পরস্পরের সান্নিধ্যে আসিবে এবং চরমে একত্র মিলিত হইয়া এক অন্তহীন অখণ্ড বস্তু সৃষ্টি করিবে। সুতরাং এই বিশ্লেষণ দ্বারা কোন একটি মতকে অপর মত হইতে উচ্চাবচ প্রতিপন্ন করা আমার অভিপ্রায় নয়। বহিঃপ্রকৃতির সাহায্যে সত্যানুসন্ধানে যাঁহারা ব্যাপৃত, তাঁহারা যেমন ভ্রান্ত নন, অন্তঃপ্রকৃতির মধ্য দিয়া সত্যলাভের যাঁহারা প্রয়াসী, তাঁহাদিগকেও তেমনি উচ্চ বলিয়া মনে করিবার কোন হেতু নাই। এই দুইটি পৃথক্ প্রণালী মাত্র। দুইটিই জগতে টিকিয়া থাকিবে; দুইটিরই অনুশীলন প্রয়োজন; পরিণামে দেখা যাইবে যে, দুইটি মতেরই পরস্পর মিলন হইতেছে। আমরা দেখি যে, মন যেমন দেহের পরিপন্থী নয়, দেহও তেমনি মনের পরিপন্থী নয়, যদিও অনেকে মনে করে, এই দেহটি একান্তই তুচ্ছ ও নগণ্য। প্রাচীনকালে প্রতিদেশেই এমন বহু লোক ছিল, যাহারা দেহকে শুধু আধি, ব্যাধি, পাপ ও ঐ জাতীয় বস্তুর আধাররূপেই গণ্য করিত। যাহা হউক, উত্তরকালে আমরা দেখিতে পাই, বেদের শিক্ষা অনুসারে এই দেহ মনে মিশিয়া গিয়াছে এবং মন দেহে মিশিয়া গিয়াছে।
একটি বিষয় স্মরণ রাখিতে হইবে, যাহা সমগ্র বেদে১ ধ্বনিত হইয়াছেঃ যথা, যেমন একটি মাটির ডেলা সম্বন্ধে জ্ঞান থাকিলে আমরা বিশ্বের সমস্ত মাটির বিষয়ে জানিতে পারি, তেমনি সেই বস্তু কি, যাহা জানিলে আমরা অন্য সবই জানিতে পারি? কম-বেশী স্পষ্টতঃ বলিতে গেলে এই তত্ত্বই সমগ্র মানব-জ্ঞানের বিষয়বস্তু। এই একত্ব উপলব্ধির দিকেই আমরা সকলে অগ্রসর হইতেছি। আমাদের জীবনের প্রতি কর্ম—তাহা অতি বৈষয়িক, অতি স্থূল, অতি সূক্ষ্ম, অতি উচ্চ, অতি আধ্যাত্মিক কর্মই হউক না কেন—সমভাবে সেই একই আদর্শ একাত্বানুভূতির দিকে আমাদিগকে লইয়া যাইতেছে। এক ব্যক্তি অবিবাহিত। সে বিবাহ করিল। বাহ্যতঃ ইহা একটি স্বার্থপূর্ণ কাজ হইতে পারে, কিন্তু ইহার পশ্চাতে যে-প্রেরণা—যে-উদ্দেশ্য রহিয়াছে, তাহাও ঐ একত্ব উপলব্ধির চেষ্টা। তাহার পুত্র-কন্যা আছে, বন্ধু-বান্ধব আছে; সে তাহার দেশকে ভালবাসে, এই পৃথিবীকে ভালবাসে এবং পরিণামে সমগ্র বিশ্বে তাহার প্রেম পরিব্যাপ্ত হয়। দুর্নিবার গতিতে আমরা সেই পূর্ণতার দিকে চলিতেছি—এই ক্ষুদ্র আমিত্ব নাশ করিয়া এবং উদার হইতে উদারতর হইয়া অদ্বৈতানুভূতির পথে। উহাই চরম লক্ষ্য; ঐ লক্ষ্যের দিকেই সমগ্র বিশ্ব দ্রুত-ধাবমান, প্রতি অণু-পরমাণু পরস্পরের সহিত মিলিত হইবার জন্য প্রধাবিত। অণুর সহিত অণুর, পরমাণুর সহিত পরমাণুর মুহুর্মুহুঃ মিলন হইতেছে, আর বিশালাকৃতি গোলক, ভূলোক, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহের উৎপত্তি হইতেছে। আবার উহারাও যথানিয়মে পরস্পরের দিকে বেগে ছুটিতেছে এবং এ-কথা আমরা জানি যে, চরমে সমগ্র জড়-জগৎ চেতন-জগৎ এক অখণ্ড সত্তায় মিশিয়া একীভূত হইবে।
নিখিল বিশ্বে বিপুলভাবে যে ক্রিয়া চলিতেছে, ব্যষ্টি-মানুষেও স্বল্পায়তনে সেই ক্রিয়াই চলিতেছে। বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের যেমন একটি নিজস্ব স্বতন্ত্র সত্তা আছে অথচ উহা নিয়তই একত্বের—অখণ্ডত্বের দিকে ধাবমান, আমাদের ক্ষুদ্রতর ব্রহ্মাণ্ডেও সেইরূপ প্রতি জীব যেন জগতের অবশিষ্টাংশ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া নিত্য নবজন্ম পরিগ্রহ করিতেছে। যে যত বেশী মূর্খ ও অজ্ঞ, সে নিজেকে বিশ্ব হইতে তত বেশী বিচ্ছিন্ন মনে করে। যে যত বেশী অজ্ঞ, সে তত বেশী মনে করে যে, সে মরিবে অথবা জন্মগ্রহণ করিবে ইত্যাদি—এ-সকল ভাব এই অনৈক্য বা ভিন্নতাকেই প্রকাশ করে অথবা বিচ্ছিন্ন ভাবেরই অভিব্যঞ্জক। কিন্তু দেখা যায়, জ্ঞানোৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্যত্বের বিকাশ হয়, নীতিজ্ঞান অভিব্যক্ত হয় এবং মানুষের মধ্যে অখণ্ড চেতনার উন্মেষ হয়। জ্ঞাতসারেই হউক বা অজ্ঞাতসারেই হউক, ঐ শক্তিই পিছনে থাকিয়া মানুষকে নিঃস্বার্থ হইতে প্রেরণা দেয়। উহাই সকল নীতিজ্ঞানের ভিত্তি; পৃথিবীর যে-কোন ভাষায় বা যে-কোন ধর্মে বা যে-কোন অবতারপুরুষ কর্তৃক প্রচারিত ধর্মনীতিতে ইহাই সর্বাপেক্ষা অপরিহার্য অংশ। ‘নিঃস্বার্থ হও,’ ‘নাহং, নাহং—তুঁহু, তুঁহু’—এই ভাবটি সকল নীতি ও অনুশাসনের পটভূমি। তুমি আমার অংশ, এবং আমিও তোমার অংশ। তোমাকে আঘাত করিলে আমি নিজেই আঘাতপ্রাপ্ত হই, তোমাকে সাহায্য করিলে আমার নিজেরই সাহায্য হইয়া থাকে, তুমি জীবিত থাকিলে সম্ভবতঃ আমরাও মৃত্যু হইতে পারে না—ইহার অর্থ এই ব্যক্তিভাবশূন্যতার স্বীকৃতি। যতক্ষণ এই বিপুল বিশ্বে একটি কীটও জীবিত থাকে, ততক্ষণ কিরূপে আমি মরিতে পারি? কারণ আমার জীবন তো ঐ কীটের জীবনের মধ্যেও অনুস্যূত রহিয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা এই শিক্ষাও পাই যে, কোন মানুষকে সাহায্য না করিয়া আমরা পারি না, তাহার কল্যাণে আমারই কল্যাণ।
এই বিষয়ই সমগ্র বেদান্ত এবং অন্যান্য ধর্মের মধ্য দিয়া অনুস্যূত। এ-কথা স্মরণ রাখিতে হইবে যে, সাধারণভাবে ধর্মমাত্রই তিন ভাগে বিভক্ত।
প্রথমাংশ দর্শন—প্রত্যেক ধর্মের মূলনীতি ও সারকথা। সেই তত্ত্বগুলি পুরাণের আখ্যায়িকা—মহাপুরুষ বা বীরগণের জীবন, দেবতা উপদেবতা বা দেব-মানবদের কাহিনীর মধ্য দিয়া রূপ পরিগ্রহ করে। বস্তুতঃ শক্তির প্রকাশনাই সকল পুরাণ-সাহিত্যের মূল ভাব। নিম্নস্তরের পুরাণগুলিতে—আদিমযুগের রচনায়—এই শক্তির অভিব্যক্তি দেখা যায় দেহের পেশীতে। পুরাণগুলিতে বর্ণিত নায়কগণ আকৃতিতে যেমন বিশাল, বিক্রমেও তেমনি বিপুল। একজন বীরই যেন সমগ্র বিশ্বজয়ে সমর্থ। মানুষের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তাহার শক্তি দেহ অপেক্ষা ব্যাপকতর ক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে মহাপুরুষগণ উচ্চতর নীতিজ্ঞানের নিদর্শনরূপে পুরাণাদিতে চিত্রিত হইয়াছেন। পবিত্রতা এবং উচ্চনীতিবোধের মধ্য দিয়াই তাঁহাদের শক্তি প্রকাশিত হইয়াছে। তাঁহারা স্বতন্ত্র-ব্যক্তিসম্পন্ন মহাপুরুষ—স্বার্থপরতা ও নীতিহীনতার দুর্বার স্রোত প্রতিরোধ করিবার সামর্থ্য তাঁহাদের আছে। সকল ধর্মের তৃতীয় অংশ—প্রতীকোপাসনা; ইহাকে তোমরা যাগযজ্ঞ, আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম বল। পৌরাণিক উপাখ্যান এবং মহাপুরুষগণের চরিত্রও সর্বস্তরের নরনারীর প্রয়োজন মিটাইতে পারে না। এমন নিম্নপর্যায়ের মানুষও সংসারে আছে, যাহাদের জন্য শিশুদের মত ধর্মের ‘কিণ্ডারগার্টেন’ প্রয়োজন। এভাবেই প্রতীকোপাসনা ও ব্যাবহারিক দৃষ্টান্তের হাতে-নাতে প্রয়োজনীয়তা উপস্থিত হইয়াছে; এগুলি ধরা যায়, বোঝা যায়—ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে জড়বস্তুর মত দেখা যায় এবং অনুভব করা যায়।
অতএব প্রত্যেক ধর্মেই তিনটি স্তর বা পর্যায় দেখা যায়; যথা—দর্শন, পুরাণ ও পূজা অনুষ্ঠান। বেদান্তের পক্ষে একটি সুবিধার কথা বলা যায় যে, সৌভাগ্যক্রমে ভারতবর্ষে ধর্মের এই তিনটি পর্যায়ের সংজ্ঞাই সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট হইয়াছে। অন্যান্য ধর্মের মূলতত্ত্বগুলি উপাখ্যান অংশের সহিত এমনভাবে জড়িত যে, একটিকে অপরটি হইতে স্বতন্ত্র করা বড় কঠিন। উপাখ্যানভাগ যেন তত্ত্বাংশকে গ্রাস করিয়া প্রাধান্য লাভ করিয়াছে এবং কয়েক শতাব্দীর মধ্যে সাধারণ মানুষ তত্ত্বগুলি একরূপ ভুলিয়া যায়, তত্ত্বাংশের তাৎপর্য আর ধরিতে পারে না। তত্ত্বের টীকা, ব্যাখ্যা প্রভৃতি মূলতত্ত্বকে গ্রাস করে এবং সকলে এগুলি লইয়াই সন্তুষ্ট থাকে ও অবতার, প্রচারক, আচার্যদের কথাই কেবল চিন্তা করে। মূলতত্ত্ব প্রায় বিলুপ্ত হয়—এতদূর লুপ্ত হয় যে, বর্তমানকালেও যদি কেহ যীশুকে বাদ দিয়া খ্রীষ্টধর্মের তত্ত্বসমূহ প্রচার করিতে প্রয়াসী হয়, তবে লোকে তাহাকে আক্রমণ করিতে চেষ্টা করিবে এবং ভাবিবে সে অন্যায় করিয়াছে এবং খ্রীষ্টধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করিতেছে। অনুরূপভাবে যদি কেহ হজরত মহম্মদকে বাদ দিয়া ইসলামধর্মের তত্ত্বগুলি প্রচার করিতে অগ্রসর হয়, তবে মুসলমানগণও তাহাকে সহ্য করিবে না। কারণ বাস্তব উদাহরণ—মহাপুরুষ ও পয়গম্বরের জীবনকাহিনীই তত্ত্বাংশকে সর্বতোভাবে আবৃত করিয়া রাখিয়াছে।
বেদান্তের প্রধান সুবিধা এই যে, ইহা কোন ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টি নয়। সুতরাং স্বভাবতঃ বৌদ্ধধর্ম, খ্রীষ্টধর্ম বা ইসলামের ন্যায় কোন প্রত্যাদিষ্ট বা প্রেরিত পুরুষের প্রভাব উহার তত্ত্বাংশগুলিকে সর্বতোভাবে গ্রাস অথবা আবৃত করে নাই। …
তত্ত্বমাত্রই শাশ্বত ও চিরন্তন, এবং প্রত্যাদিষ্ট পুরুষগণ যেন গৌণপর্যায়ভুক্ত—তাঁহাদের কথা বেদান্তশাস্ত্রে উল্লিখিত হয় নাই। উপনিষদসমূহে কোন বিশেষ প্রত্যাদিষ্ট পুরুষের বিষয় বলা হয় নাই, তবে বহু মন্ত্রদ্রষ্টা পুরুষ ও নারীর কথা বলা হইয়াছে। প্রাচীন য়াহুদীদের এই ধরনের কিছু ভাব ছিল; তথাপি দেখিতে পাই মোজেস্ হিব্রূ সাহিত্যের অধিকাংশ স্থান জুড়িয়া আছেন। অবশ্য আমি বলিতে চাই না যে, এই সিদ্ধ মহাপুরুষগণ কর্তৃক একটা জাতির ধর্মজীবন নিয়ন্ত্রিত হওয়া খারাপ। কিন্তু যদি কোন কারণে ধর্মের সমগ্র তত্ত্বাংশকে উপেক্ষা করা হয়, তবে তাহা জাতির পক্ষে নিশ্চয়ই ক্ষতিকর হইবে। তত্ত্বের দিক্ দিয়া বিভিন্ন জাতির মধ্যে অনেকটা ঐক্যসূত্র খুঁজিয়া পাইতে পারি, কিন্তু ব্যক্তিত্বের দিক্ দিয়া তাহা সম্ভব নয়। ব্যক্তি আমাদের হৃদয়াবেগ স্পর্শ করে; তত্ত্বের আবেদন উচ্চতর ক্ষেত্র অর্থাৎ আমাদের শান্ত বিচারবুদ্ধিকে স্পর্শ করে। তত্ত্বই চরমে জয়লাভ করিবে, কারণ উহাই মানুষের মনুষ্যত্ব। ভাবাবেগ অনেক সময়ই আমাদিগকে পশুস্তরে নামাইয়া আনে। বিচারবুদ্ধি অপেক্ষা ইন্দ্রিয়গুলির সহিতই ভাবাবেগের সম্বন্ধ বেশী; সুতরাং যখন তত্ত্বসমূহ সর্বতোভাবে উপেক্ষিত হয়, এবং ভাবাবেগ প্রবল হইয়া উঠে, তখনই ধর্ম গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতায় পর্যবসিত হয় এবং ঐ অবস্থায় ধর্ম এবং দলীয় রাজনীতি ও অনুরূপ বিষয়ে বিশেষ কোন পার্থক্য থাকে না। তখন ধর্মসম্বন্ধে মানুষের মনে অতি উৎকট ও অন্ধ ধারণার সৃষ্টি হয় এবং হাজার হাজার মানুষ পরস্পরের গলায় ছুরি দিতেও দ্বিধা করে না। যদিও এ-সকল প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষের জীবন সৎকর্মের মহতী প্রেরণাস্বরূপ, নীতিচ্যুত হইলে ইহাই আবার মহা অনর্থের হেতু হইয়া থাকে। এই প্রক্রিয়া সর্বযুগেই মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার পথে ঠেলিয়া দিয়াছে এবং ধরিত্রীকে রক্তস্নাত করিয়াছে। বেদান্ত এই বিপদ এড়াইয়া যাইতে সমর্থ, কারণ ইহাতে কোন প্রত্যাদিষ্ট পুরুষের স্থান নাই। বেদান্তে অনেক মন্ত্রদ্রষ্টার কথা আছে—‘ঋষি’ বা ‘মুনি’ শব্দে তাঁহারা অভিহিত। ‘দ্রষ্টা’ শব্দটিও আক্ষরিক অর্থেই ব্যবহৃত। যাঁহারা সত্য দর্শন করিয়াছেন, মন্ত্রার্থ উপলব্ধি করিয়াছেন—তাঁহারাই দ্রষ্টা।
‘মন্ত্র’ শব্দের অর্থ যাহা মনন করা হইয়াছে, যাহা মনে ধ্যানের দ্বারা লব্ধ; এবং ঋষি এই-সব মন্ত্রের দ্রষ্টা। এই মন্ত্রগুলি কোন মানব-গোষ্ঠীর অথবা কোন বিশেষ নর বা নারীর নিজস্ব সম্পত্তি নয়, তা তিনি যত বড়ই হউন। এমন কি বুদ্ধ বা যীশুখ্রীষ্টের মত শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষদেরও নিজস্ব সম্পত্তি নয়। এগুলি ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্রেরও যেমন সম্পত্তি, বুদ্ধদেবের মত মহামানবেরও তেমনি সম্পত্তি; অতি নগণ্য কীটেরও যেমন সম্পত্তি, খ্রীষ্টেরও তেমনি সম্পত্তি, কারণ এগুলি সার্বভৌম তত্ত্ব। এই মন্ত্রগুলি কখনও সৃষ্ট হয় নাই—চিরন্তন, শাশ্বত; এগুলি অজ—আধুনিক বিজ্ঞানের কোন বিধি বা নিয়মের দ্বারা সৃষ্ট হয় নাই, এই মন্ত্রগুলি আবৃত থাকে এবং আবিষ্কৃত হয়, কিন্তু অনন্তকাল প্রকৃতিতে আছে। নিউটন জন্মগ্রহণ না করিলেও জগতে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বিরাজ করিত এবং ক্রিয়াশীল থাকিত। নিউটনের প্রতিভা ঐ শক্তি উদ্ভাবন ও আবিষ্কার করিয়াছিল, সজীব করিয়াছিল এবং মানবীয় জ্ঞানের বিষয়বস্তুতে রূপায়িত করিয়াছিল মাত্র। ধর্মতত্ত্ব এবং সুমহান্ আধ্যাত্মিক সত্যসমূহ সম্পর্কেও ঐ-কথা প্রযোজ্য। এগুলি নিত্যক্রিয়াশীল। যদি বেদ, বাইবেল, কোরান প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ মোটেই না থাকিত, যদি ঋষি এবং অবতারপ্রথিত পুরুষগণ জন্মগ্রহণ না করিতেন, তথাপি এই ধর্মতত্ত্বগুলির অস্তিত্ব থাকিত। এগুলি শুধু সাময়িকভাবে স্থগিত আছে, এবং মনুষ্যজাতি ও মনুষ্যপ্রকৃতির উন্নতি সাধন করিবার উদ্দেশ্যে ধীর-স্থিরভাবে ক্রিয়াশীল থাকিবে। কিন্তু যাঁহারা এই তত্ত্বগুলি দর্শন ও আবিষ্কার করেন, তাঁহারাই অবতারপুরুষ—তাঁহারাই আধ্যাত্মিক রাজ্যের আবিষ্কারক। নিউটন ও গ্যালিলিও যেমন পদার্থবিজ্ঞানের ঋষি ছিলেন, অবতারপুরুষগণও তেমনি অধ্যাত্মবিজ্ঞানের ঋষি। ঐ-সকল তত্ত্বের উপর কোন বিশেষ অধিকার তাঁহারা দাবী করিতে পারেন না, এগুলি বিশ্বপ্রকৃতির সাধারণ সম্পদ্।
হিন্দুদের মতে বেদ অনন্ত। বেদের অনন্তত্বের তাৎপর্য এখন আমরা বুঝিতে পারি। ইহার অর্থ—প্রকৃতির যেমন আদি বা অন্ত বলিয়া কিছু নাই, এ-সকল তত্ত্বেরও তেমনি আরম্ভ বা শেষ বলিয়া কিছু নাই। পৃথিবীর পর পৃথিবী, মতবাদের পর মতবাদ উদ্ভূত হইবে, কিছুকাল চলিতে থাকিবে এবং পরে আবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে; কিন্তু বিশ্বপ্রকৃতি একরূপই থাকিবে। লক্ষ লক্ষ মতবাদের উদ্ভব হইতেছে, আবার বিলয় হইতেছে। কিন্তু বিশ্ব একইভাবে থাকে। কোন একটি গ্রহ সম্পর্কে সময়ের আদি-অন্ত হয়তো বলা যাইতে পারে, কিন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে ঐরূপ সীমানির্দেশ একেবারে অর্থহীন। নৈসর্গিক নিয়ম, জড়বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ও অধ্যাত্ম-বিজ্ঞানের তত্ত্বাদি সম্পর্কেও ঐ কথা সত্য। আদি-অন্তহীন কালের মধ্যে তাহারা বিরাজমান, এবং মানুষ অতি-সম্প্রতি, তুলনামূলকভাবে বলিতে গেলে জোর কয়েক হাজার বৎসর যাবৎ মানুষ এগুলির স্বরূপ-নির্ধারণে সচেষ্ট হইয়াছে। অজস্র উপাদান আমাদের সম্মুখে রহিয়াছে। অতএব বেদ হইতে একটি মহান্ সত্য আমরা প্রথমেই শিক্ষা করি যে, ধর্ম সবেমাত্র শুরু হইয়াছে। আধ্যাত্মিক সত্যের অসীম সমুদ্র আমাদের সম্মুখে প্রসারিত। ইহা আমাদিগকে আবিষ্কার করিতে হইবে, কার্যকর করিতে হইবে এবং জীবনে রূপায়িত করিতে হইবে। সহস্র সহস্র প্রত্যাদিষ্ট পুরুষের আবির্ভাব জগৎ প্রত্যক্ষ করিয়াছে, ভবিষ্যতে আরও লক্ষের আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করিবে।
প্রাচীন যুগে প্রতি সমাজেই অনেক প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষ ছিলেন। এমন সময় আসিবে, যখন পৃথিবীতে প্রতি নগরের পথে পথে প্রত্যাদিষ্ট পুরুষের সাক্ষাৎ পাওয়া যাইবে। বস্তুতঃ এমনও বলা চলে যে, প্রাচীনযুগের সমাজ-ব্যবস্থায় অসাধারণ ব্যক্তিগণই অবতাররূপে চিহ্নিত হইতেন। সময় আসিতেছে, যখন আমরা উপলব্ধি করিতে পারিব যে, ধর্মজীবন লাভ করার অর্থই ঈশ্বরকর্তৃক প্রত্যাদেশ লাভ করা এবং নর বা নারী সত্যদ্রষ্টা না হইয়া কেহই ধার্মিক হইতে পারে না। আমরা বুঝিতে পারিব যে, ধর্মতত্ত্ব শুধু মানসিক চিন্তা বা ফাঁকা কথার মধ্যে নিহিত নয়; পরন্তু বেদের শিক্ষা এই তত্ত্বের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি, উচ্চ হইতে উচ্চতর তত্ত্বের উদ্ভাবন ও আবিষ্কার এবং সমাজে উহার প্রচারের মধ্যেই ধর্মের মূল রহস্য নিহিত। প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ বা ঋষি গড়িয়া তোলাই ধর্মচর্চার উদ্দেশ্য এবং বিদ্যায়তনগুলিও সেই উদ্দেশ্যসাধনের জন্যই গড়িয়া উঠিবে। সমগ্র বিশ্ব প্রত্যাদিষ্ট পুরুষগণে পূর্ণ হইবে। যতদিন মানুষ সত্যদ্রষ্টা বা প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ না হয়, ততদিন ধর্ম তাহার নিকটে শুধু কথার কথা হইয়া দাঁড়ায়। দেওয়ালকে যেমন দেখি, তাহা অপেক্ষাও সহস্রগুণ গভীরভাবে ধর্মকে আমরা প্রত্যক্ষ করিব, উপলব্ধি করিব—অনুভব করিব।
ধর্মের এ-সকল বিবিধ বহিঃপ্রকাশের অন্তরালে একটি মূলতত্ত্ব বিদ্যমান এবং আমাদের জন্য তাহা পূর্বেই বিশদরূপে বর্ণিত হইয়াছে। প্রত্যেক জড়বিজ্ঞান ঐক্যের সন্ধান পাইলেই শেষ হইবে, কারণ ইহার বেশী আর আমরা যাইতে পারি না। পূর্ণ ঐক্যে পৌঁছিলে তত্ত্বের দিক্ দিয়া বিজ্ঞানের আর বেশী কিছুই বলিবার থাকে না। ব্যাবহারিক ধর্মের কাজ শুধু প্রয়োজনীয় খুঁটিনাটিগুলির ব্যবস্থা করা। উদাহরণস্বরূপ, যে-কোন একটি বিজ্ঞানশাখা—যথা রসায়নশাস্ত্রের কথা ধরা যাইতে পারে। মনে করুন, এমন একটি মূল উপাদানের সন্ধান পাওয়া গেল, যাহা হইতে অন্যান্য উপাদানগুলি প্রস্তুত করা যাইতে পারে। তখনই বিজ্ঞান-হিসাবে রসায়নশাস্ত্র চরম উৎকর্ষ লাভ করিবে। তারপর বাকী থাকিবে প্রতিদিন ঐ মূল উপাদানটির নব নব সংযোগ আবিষ্কার করা এবং জীবনের প্রয়োজনে ঐ যৌগিক পদার্থগুলি প্রয়োগ করা। ধর্ম সম্বন্ধেও সেই কথা। ধর্মের মহান্ তত্ত্বসমূহ, উহার কার্যক্ষেত্র ও পরিকল্পনা সেই স্মরণাতীত যুগেই আবিষ্কৃত হইয়াছিল, যে-যুগে জ্ঞানের চরম এবং পরম বাণী বলিয়া কথিত—বেদের এই ‘সোঽহম্’ তত্ত্বটি মানুষ লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছিল। সেই ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’-এর মধ্যে এই সমগ্র জড়জগৎ ও মনোজগৎ সমন্বিত, ইঁহাকে কেহ ঈশ্বর, কেহ ব্রহ্ম, কেহ আল্লা, কেহ যিহোবা অথবা অন্য কোন নামে অভিহিত করিয়া থাকে। এই মহান্ তত্ত্ব আমাদের জন্য পূর্বেই বিশদরূপে বর্ণিত হইয়াছে; ইহার বাহিরে যাওয়া আমাদের সাধ্য নাই। আমাদের কর্মে, আমাদের জীবনের প্রত্যেক ব্যাপারে উহাকে সার্থক করিতে হইবে, পূর্ণ করিতে হইবে। এখন আমাদিগকে কাজ করিতে হইবে—যেন আমরা প্রত্যেকে প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ হইতে পারি। আমাদের সম্মুখে বিরাট কাজ।
প্রাচীনকালে প্রত্যাদিষ্ট পুরুষের তাৎপর্য অনেকে উপলব্ধি করিতে পারিত না। সে-কালে প্রত্যাদিষ্ট পুরুষকে একটি আকস্মিক ব্যাপার বলিয়া মনে করা হইত। তাহারা মনে করিত, প্রবল ইচ্ছাশক্তি বা তীক্ষ্ণবুদ্ধির প্রভাবে কোন ব্যক্তি উচ্চতর জ্ঞানের অধিকারী হইতেন। আধুনিক কালে আমরা প্রমাণ করিতে প্রস্তুত যে, প্রত্যেক জীবের—সে যে-ই হউক বা যেখানেই বাস করুক—এই জ্ঞানে জন্মগত অধিকার। এই জগতে আকস্মিক ব্যাপার বলিয়া কিছু নাই। যে-ব্যক্তি আকস্মিকভাবে কিছু লাভ করিয়াছে বলিয়া আমরা মনে করি, সেও ইহা পাইবার জন্য যুগযুগব্যাপী ধীর ও অব্যাহত তপস্যা করিয়াছে। সমগ্র প্রশ্নটি আমাদের উপর নির্ভর করে; আমরা কি সত্যই ঋষি বা প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ হইতে চাই? যদি চাই, তবে অবশ্যই আমরা তাহা হইব।
প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ গড়িবার এই বিরাট কাজ আমাদের সম্মুখে বর্তমান। জ্ঞাতসারেই হউক আর অজ্ঞাতসারেই হউক, জগতের প্রধান ধর্মগুলি এই মহৎ উদ্দেশ্যে কাজ করিয়া যাইতেছে। পার্থক্য শুধু এই যে, দেখিবে বহু ধর্মমত ঘোষণা করেঃ আধ্যাত্মিক সত্যের এই প্রত্যক্ষ অনুভূতি এ-জীবনে হইবার নয়, মৃত্যুর পর অন্য জগতে এমন এক সময় আসিবে, যখন সে সত্য দর্শন করিবে, এখন তাহাকে বিশ্বাস করিতে হইবে। কিন্তু যাহারা এ-সব কথা বলে, তাহাদিগকে বেদান্ত জিজ্ঞাসা করেঃ অবস্থা যদি বাস্তবিক এইরূপই হয়, তবে আধ্যাত্মিক সত্যের প্রমাণ কোথায়? উত্তরে তাহাদের বলিতে হইবে সর্বকালেই কতকগুলি বিশিষ্ট মানুষ থাকিবেন, যাঁহারা এ জীবনেই সেই অজ্ঞেয় ও অজ্ঞাত বস্তুসমূহের আভাস পাইয়াছেন।
অবশ্য ইহাতেও সমস্যার সমাধান হইবে না। যদি ঐ-সকল ব্যক্তি অসাধারণই হইয়া থাকেন, যদি অকস্মাৎই তাঁহাদের মধ্যে ঐ শক্তির উন্মেষ হইয়া থাকে, তবে তাঁহাদিগকে বিশ্বাস করিবার অধিকার আমাদের নাই। যাহা দৈবাৎ-লব্ধ তাহা বিশ্বাস করাও আমাদের পক্ষে পাপ, কারণ আমরা তাহা জানিতে পারি না। জ্ঞান কাহাকে বলে? জ্ঞানের অর্থ—বিশেষত্ব বা অদ্ভুতত্বের বিনাশ। মনে করুন, একটি বালক রাস্তায় বা কোন পশু-প্রদর্শনীতে গিয়া অদ্ভুত আকৃতির একটি জন্তু দেখিতে পাইল। সেই জন্তুটি কি—সে চিনিতে পারিল না। তারপর সে এমন এক দেশে গেল, যেখানে ঐ জাতীয় জন্তু অসংখ্য রহিয়াছে। তখন সে উহাদিগকে একটি বিশেষ শ্রেণীর জন্তু বলিয়া বুঝিল এবং সন্তুষ্ট হইল। তখন মূল তত্ত্বটি জানার নামই হইল জ্ঞান। তত্ত্ব-বর্জিত কোন একটি বস্তুবিশেষের যে জ্ঞান, তাহা জ্ঞান নয়। মূল সত্যটি হইতে বিচ্ছিন্ন কোন একটি বিষয় অথবা অল্প কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে আমরা যখন জ্ঞান লাভ করি, তখন আমাদের জ্ঞান হয় না, আমরা অজ্ঞানই থাকি। অতএব যদি এই প্রত্যাদিষ্ট পুরুষগণ বিশেষ ধরনের ব্যক্তিই হইয়া থাকেন, যদি সাধারণের আয়ত্তের বাহিরে যে-জ্ঞান, তাহা লাভ করিবার অধিকার শুধু তাঁহাদেরই হইয়া থাকে এবং অন্য কাহারও না থাকে, তবে তাঁহাদিগের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত নয়। কারণ তাঁহারা বিশেষ ধরনের দৃষ্টান্ত মাত্র, মূলতত্ত্বের সহিত তাঁহাদের সম্পর্ক নাই। আমরা নিজেরা যদি প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ হই, তবেই আমরা তাঁহাদের কথা বিশ্বাস করিতে পারিব।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত সমুদ্র-নাগিনী সম্পর্কে নানা কৌতুকাবহ ঘটনার কথা তোমরা শুনিয়াছ; কৌতুকাবহ কেন? কারণ দীর্ঘকাল অন্তর কয়েকজন মানুষ আসিয়া লোকসমাজে ঐ সমুদ্র-নাগিনীদের কাহিনী প্রচার করেন, অথচ অন্য কেহ কখনও উহাদিগকে দেখে নাই। তাহাদের উল্লেখযোগ্য কোন বিশেষ তত্ত্ব নাই; কাজেই জগৎ উহা বিশ্বাস করে না। বস্তুতঃ ঐ-সকল কাহিনীর পশ্চাতে কোন শাশ্বত সত্য নাই বলিয়াই জগৎ উহা বিশ্বাস করে না। যদি কেহ আমার সম্মুখে আসিয়া বলে যে, একজন প্রত্যাদিষ্ট পুরুষ তাঁহার স্থূলশরীর সহ অকস্মাৎ ব্যোমপথে অদৃশ্য হইয়া গেলেন, তাহা হইলে সেই অসাধারণ ব্যাপারটি দর্শন করিবার অধিকার আমার আছে। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করি—‘তোমার পিতা কিংবা পিতামহ কি দৃশ্যটি দেখিয়াছিলেন?’ সে উত্তরে বলে, ‘না, তাঁহারা কেহই দেখেন নাই, কিন্তু পাঁচহাজার বৎসর পূর্বে ঐরূপ ঘটনা ঘটিয়াছিল।’—আর ঐরূপ ঘটনা যদি আমি বিশ্বাস না করি, তবে অনন্তকালের জন্য আমাকে নরকে দগ্ধ হইতে হইবে।
এ কী কুসংস্কার! আর ইহারই ফলে মানুষ তাহার দেব-স্বভাব হইতে পশু-স্বভাবে অবনত হইতেছে। যদি আমাদিগকে সবকিছু অন্ধভাবেই বিশ্বাস করিতে হয়, তবে বিচারবুদ্ধি আমরা লাভ করিয়াছি কেন? যুক্তিবিরোধী কোন কিছু বিশ্বাস করা কি মহাপাপ নয়? ঈশ্বর যে উৎকৃষ্ট সম্পদটি আমাদিগকে দান করিয়াছেন, তাহা যথাযথ-ভাবে ব্যবহার না করিবার কী অধিকার আমাদের আছে? আমার নিশ্চিত বিশ্বাস এই যে, ঈশ্বরদত্ত শক্তির ব্যবহারে অক্ষম অন্ধবিশ্বাসী অপেক্ষা যুক্তিবাদী অবিশ্বাসীকে ভগবান্ সহজে ক্ষমা করিবেন। অন্ধবিশ্বাসী শুধু নিজের প্রকৃতিকে অবনমিত করে এবং পশুস্তরে অধঃপাতিত হয়—বুদ্ধিনাশের ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যুক্তিবিচারের আশ্রয় আমরা অবশ্য গ্রহণ করিব এবং সকল দেশের প্রাচীন শাস্ত্রে বর্ণিত এই-সকল ঈশ্বরের দূত বা মহাপুরুষের কাহিনীকে যখন যুক্তিসম্মত বলিয়া প্রমাণ করিতে পারিব, তখন আমরা তাঁহাদিগকে বিশ্বাস করিব। যখন আমাদের মধ্যেও তাঁহাদের মত প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষকে দেখিতে পাইব, তখনই তাঁহাদিগকে বিশ্বাস করিব। তখন আমরা দেখিব যে, তাঁহারা বিচিত্র ধরনের কোন জীব নন, পরন্তু কতকগুলি তত্ত্বের জীবন্ত উদাহরণ মাত্র। জীবনে তাঁহারা তপস্যা করিয়াছেন, কর্ম করিয়াছেন, ফলে ঐ নীতি বা তত্ত্ব স্বতই তাঁহাদের মধ্যে রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। আমাদিগকে ঐ অবস্থা লাভ করিতে হইলে অবশ্য কর্ম করিতে হইবে। যখন আমরা প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষ হইব, তখনই আমরা তাঁহাকে চিনিতে পারিব। তাঁহারা মন্ত্রদ্রষ্টা ছিলেন, ইন্দ্রিয়ের পরিধি অতিক্রম করিয়া অতীন্দ্রিয় সত্য দর্শন করিতেন—এ-সকল কথা আমরা তখনই বিশ্বাস করিব, যখন ঐরূপ অবস্থা নিজেরা লাভ করিতে সমর্থ হইব, তৎপূর্বে নয়।
বেদান্তের ইহাই একমাত্র মূলনীতি। বেদান্ত ঘোষণা করেন যে, প্রত্যক্ষ এবং জাগ্রত উপলব্ধিই ধর্মের প্রাণ; কারণ ইহকাল ও পরকাল, জন্ম ও মৃত্যু, ইহলোক ও পরলোকের প্রশ্ন, সবই সংস্কার ও বিশ্বাসের প্রশ্ন মাত্র। কাল অনন্ত, মানুষ তাহাকে খণ্ডিত করিতে চেষ্টা করে, কিন্তু সামান্য প্রাকৃতিক পরিবর্তন ভিন্ন দশ ঘটিকা এবং বার ঘটিকা সময়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। কালপ্রবাহ অন্তহীন গতিতে চলিয়াছে। সুতরাং এই জীবন বা জীবনান্তরের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? উহা সময়ের প্রশ্ন মাত্র এবং সময়ের হিসাবে যেটুকু ক্ষতি হয়, কর্মের গতিবৃদ্ধিতে তাহার পূরণ হইয়া থাকে। অতএব বেদান্ত ঘোষণা করিতেছেন—ধর্ম বর্তমানেই উপলব্ধি করিতে হইবে এবং তোমাকে ধার্মিক হইতে হইলে সংস্কারমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন মন লইয়া কঠোর শ্রমের সহিত অগ্রসর হইতে হইবে, তত্ত্ব উপলব্ধি করিতে হইবে। প্রত্যেকটি বিষয় স্বয়ং দর্শন করিতে হইবে; তাহা হইলে যথার্থ ধর্মলাভ করিবে। ইহার পূর্বে তুমি নাস্তিক ছাড়া আর কিছু নও, অথবা নাস্তিক অপেক্ষাও নিকৃষ্ট; নাস্তিক তবু ভাল, কারণ সে অকপট। অকপট ভাবেই সে বলে, ‘আমি এ-সব জানি না।’ আর অপর সকলে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা সত্ত্বেও নিজেদের জাহির করিয়া বলে, ‘আমরা অতি ধার্মিক।’ কেহ জানে না, তাহার ধর্ম কি, কারণ প্রত্যেকে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র কতকগুলি আজগবি কাহিনী গলাধঃকরণ করিয়াছে, পুরোহিতেরা তাহাদিগকে সেগুলি বিশ্বাস করিতে বলিয়াছে; না করিলে তাহাদের উদ্ধার নাই। যুগে যুগে এই ধারাই চলিয়া আসিতেছে।
ধর্মের প্রত্যক্ষানুভূতিই একমাত্র পথ। আমাদের প্রত্যেককেই সেই-পথটি আবিষ্কার করিতে হইবে। প্রশ্ন উঠিবে, বাইবেল-প্রমুখ শাস্ত্রসমূহের তবে মূল্য কি? শাস্ত্রগুলির মূল্য অবশ্য যথেষ্টই আছে, যেমন কোন দেশকে জানিতে হইলে তাহার মানচিত্রের প্রয়োজন। ইংলণ্ডে আসিবার পূর্বে আমি ইংলণ্ডের মানচিত্র অসংখ্যবার দেখিয়াছি। ইংলণ্ড সম্বন্ধে মোটামুটি একটি ধারণা পাইতে মানচিত্র আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছে, তথাপি যখন এদেশে আসিলাম, তখন বুঝিলাম মানচিত্রে ও বাস্তবদেশে কত প্রভেদ! উপলব্ধি এবং শাস্ত্রের মধ্যেও তেমনি পার্থক্য। শাস্ত্রগুলি মানচিত্র মাত্র—এগুলি অতীত মহাপুরুষগণের অনুভূতি বা অভিজ্ঞতা। এগুলি আমাদিগকে একইভাবে একই অভিজ্ঞতা বা অনুভূতিলাভে সাহস দেয় ও অনুপ্রাণিত করে।
বেদান্তের প্রথম তত্ত্ব এই—অনুভূতিই ধর্ম; অনুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তিই ধার্মিক, অনুভূতিহীন ব্যক্তিতে ও নাস্তিকে কোন পার্থক্য নাই। বরং নাস্তিক ভাল, কারণ সে নিজের অজ্ঞতা অকপটে স্বীকার করে। আবার ধর্মশাস্ত্রসমূহ ধর্মানুভূতিলাভে প্রভূত সাহায্য করে। এগুলি শুধু আমাদের পথ-প্রদর্শক নয়, পরন্তু আমাদিগকে সাধনপ্রণালীর উপদেশ দেয়। প্রত্যেক বিজ্ঞানেরই নিজস্ব অনুসন্ধান-প্রণালী আছে। এ-জগতে এমন বহুলোক আছেন, যাঁহারা বলেন, ‘আমি ধার্মিক হইতে চাহিয়াছিলাম, সত্য উপলব্ধি করিতে চাহিয়াছিলাম, কিন্তু পারি নাই; সুতরাং আমি কিছু বিশ্বাস করি না।’ শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যেও এইরূপ লোক দেখিতে পাইবে। বহুলোক তোমাকে বলিবে, ‘আমি ধার্মিক হইবার জন্য চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু আজীবন দেখিয়াছি, উহার মধ্যে কিছু নাই।’ আবার সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যাপার দেখিবেঃ মনে কর, একজন রাসায়নিক—বড় বৈজ্ঞানিক তোমার নিকট আসিয়া রসায়নশাস্ত্রের কথা বলিলেন। যদি তুমি তাঁহাকে বল, ‘আমি রসায়নবিদ্যার কিছুই বিশ্বাস করি না, কারণ আজীবন রাসায়নিক হইতে চেষ্টা করিয়াছি, কিন্তু উহার মধ্যে কিছুই পাই নাই।’ তখন বৈজ্ঞানিক তোমাকে প্রশ্ন করিবেন, ‘কখন তুমি ঐরূপ চেষ্টা করিয়াছিলে?’ তুমি বলিবে, ‘যখন ঘুমাইতে যাইতাম, তখন পুনঃপুনঃ এই কথা উচ্চারণ করিতাম—হে রসায়নশাস্ত্র, আমার নিকট এস। কিন্তু সে কখনও আসে নাই।’ উত্তরে বৈজ্ঞানিক হাসিবেন ও বলিবেন, ‘না, উহা যথার্থ প্রণালী নয়। কেন তুমি পরীক্ষাগারে গিয়া ক্ষাররস, অম্লরস প্রভৃতি মিশাইয়া দিনের পর দিন গবেষণায় তোমার হাত পোড়াও নাই? ঐ প্রণালীতেই তুমি ধীরে ধীরে রসায়নশাস্ত্রে জ্ঞান লাভ করিতে পারিতে।’ ধর্মের বেলায়ও ঠিক তেমনি। ধর্ম সম্বন্ধে ঐরূপ শ্রম স্বীকার করিতে কি প্রস্তুত আছ? প্রত্যেক বিজ্ঞানশাখারই যেমন শিক্ষার একটি বিশিষ্ট প্রণালী আছে, ধর্মানুশীলনেরও সেরূপ আছে। ধর্মেরও নিজস্ব পদ্ধতি আছে। এই বিষয়ে পৃথিবীর প্রাচীন প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষগণের, যাঁহারা ধর্ম উপলব্ধি করিয়াছেন এবং কিছু লাভ করিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট হইতে অবশ্য আমরা ধর্মলাভের কোন-না-কোন শিক্ষা পাইতে পারি এবং পাইব। তাঁহারা আমাদিগকে ধর্মের বিবিধ প্রণালী, বিশেষ পদ্ধতি শিখাইবেন, এবং এগুলির সাহায্যেই আমরা ধর্মের নিগূঢ় সত্যসমূহ উপলব্ধি করিতে সমর্থ হইব। তাঁহারা আজীবন সাধনা করিয়াছেন, মনকে সূক্ষ্মতম অনুভূতির উপযোগী করিয়া মানসিক উৎকর্ষের বিশেষ পদ্ধতি আবিষ্কার করিয়াছেন এবং এই সূক্ষানুভূতির সহায়তায় ধর্মতত্ত্ব উপলব্ধি করিয়াছেন। ধার্মিক হইতে হইলে, ধর্মকে উপলব্ধি ও অনুভব করিতে হইলে, প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষ হইতে হইলে তাঁহাদের প্রদর্শিত পদ্ধতি গ্রহণ করিতে হইবে এবং তদনুযায়ী সাধন করিতে হইবে। তারপরও যদি কিছু না পাওয়া যায়, তখন অবশ্য এ-কথা বলিবার অধিকার আমাদের হইবে, ‘ধর্মের মধ্যে কিছুই নাই, কারণ আমি পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি এবং বিফল হইয়াছি।’
ইহাই সকল ধর্মের ব্যাবহারিক দিক্। জগতের সকল ধর্মগ্রন্থেই ইহা পাইবে। কতকগুলি মত ও নীতিকথাতেই ধর্মশিক্ষা হয় না, পরন্তু মহাপুরুষদের জীবনে ধর্মের আচরণ বা তপস্যা দেখিতে পাও। যে-সকল আচার-আচরণের বিষয় হয়তো শাস্ত্রে পরিষ্কারভাবে লিখিত নাই, সেগুলিও এই-সকল মহাপুরুষের প্রাত্যহিক জীবনে—আহারে ও বিহারে প্রতিপালিত এবং অনুসৃত হয় দেখিতে পাইবে। মহাপুরুষদের সমগ্র জীবন, আচরণ, কর্ম-পদ্ধতি প্রভৃতি সব কিছুই জনসাধারণের জীবনধারা হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং সেইজন্যই তাঁহারা উচ্চতর জ্ঞান ও ভগবদ্দর্শনের অধিকার লাভ করিয়াছেন। আর আমরাও যদি ঐরূপ দর্শন লাভ করিতে চাই, তবে আমাদিগকেও অনুরূপ পদ্ধতি গ্রহণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। তপস্যা ও অভ্যাস-যোগের দ্বারাই আমরা ঐরূপ অবস্থায় উন্নীত হইতে পারিব। সুতরাং বেদান্তের পদ্ধতি এইঃ প্রথমে ধর্মের মূলনীতিগুলি নির্ধারিত করিতে হয়, লক্ষ্যবস্তুটি চিহ্নিত করিতে হয়, তারপর যে-প্রণালী সহায়ে ঐ লক্ষ্যে পৌঁছান যায়, সেই নীতি শিখিতে হয়—বুঝিতে হয় এবং উপলব্ধি করিতে হয়।
আবার এ-সকল প্রণালীও বহুমুখী হওয়া প্রয়োজন। আমাদের প্রকৃতি পরস্পর হইতে এত স্বতন্ত্র যে, একই প্রণালী আমাদের একাধিক ব্যক্তির পক্ষে ক্বচিৎ সমভাবে প্রযোজ্য হইতে পারে। আমাদের প্রত্যেকের রুচি ও প্রকৃতি পৃথক্, সুতরাং প্রণালীও ভিন্ন হওয়া উচিত। দেখিবে কেহ কেহ অত্যন্ত ভাবপ্রবণ, কেহ কেহ দার্শনিক ও যুক্তিবাদী, কেহ বা আনুষ্ঠানিক পূজা-অর্চনার পক্ষপাতী—স্থূলবস্তুর সহায়তা পাইতে চান। আবার দেখিবে কেহ কেহ কোনপ্রকার রূপ, মূর্তি বা পূজা-অনুষ্ঠান পছন্দ করে না—ঐ-সব তাহাদের পক্ষে মৃত্যুতুল্য। আবার আর একজন একবোঝা তাবিজ, কবচ সারা শরীরে ধারণ করে; সে এই-সকল প্রতীকের প্রতি এত অনুরাগী! আর একজন ভাবপ্রবণ ব্যক্তি দানধ্যানের পক্ষপাতী; সে কাঁদে, ভালবাসে, আরও কত প্রকারে অন্তরের ভাব ব্যক্ত করে। অতএব এই-সকল ব্যক্তির জন্য কখনও এই প্রণালী উপযোগী হইতে পারে না। যদি ধর্মজগতে সত্যলাভের জন্য একটি মাত্র পথ নির্দিষ্ট থাকিত, তবে ঐ পথ যাহাদের উপযোগী নয়, তাহাদের পক্ষে উহা অনিষ্টের কারণ হইত, মৃত্যুতুল্য হইত। সুতরাং সাধনপ্রণালী বিভিন্ন হইবে। বেদান্ত সেইজন্য রুচির বৈচিত্র্য অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন পথের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং তদনুযায়ী নির্দেশ দিয়া থাকেন। তোমার রুচি অনুযায়ী যে-কোন একটি পথ গ্রহণ কর। একটি তোমার উপযোগী না হইলে অন্য একটি হয়তো উপযোগী হইবে।
এই দৃষ্টিভঙ্গী হইতে বিচার করিলে আমরা দেখি যে, জগতে প্রচলিত একাধিক ধর্ম আমাদের পক্ষে কত গৌরবের বিষয়! বহুলোকের মনোমত মাত্র একজন আচার্য ও প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষ না হইয়া বহু ধর্মগুরুর আবির্ভাব কত কল্যাণকর! মুসলমানগণ সমস্ত পৃথিবীকে ইসলামধর্মে, খ্রীষ্টানগণ খ্রীষ্টধর্মে এবং বৌদ্ধগণ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করিতে চান; কিন্তু বেদান্তের ঘোষণা এইঃ জগতের প্রত্যেকটি নরনারী নিজ নিজ পৃথক্ মতে বিশ্বাসী হউক। মতগুলির পশ্চাতে একই তত্ত্ব, একই একত্ব বিদ্যমান। যত অধিক সংখ্যায় প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষের আবির্ভাব হইবে, যত বেশী শাস্ত্র থাকিবে, যত বেশী মন্ত্রদ্রষ্টা থাকিবেন, যত মত ও পথ থাকিবে, জগতের পক্ষে ততই মঙ্গল।
যেমন সামাজিক ক্ষেত্রে সমাজে যত বেশী বৃত্তির সংস্থান থাকে, জনসাধারণের পক্ষে তত অধিক পরিমাণে কর্মলাভের সুযোগ হয়, ভাবজগতে এবং ধর্মজগতেও সেইরূপ হইয়া থাকে। বর্তমানকালে বিজ্ঞানের বহুমুখী বিকাশ হওয়াতে মানসিক উৎকর্ষের কী বহুবিধ সুযোগ মানুষের সম্মুখে উপস্থিত হইয়াছে! জাগতিক ক্ষেত্রেও প্রয়োজন এবং রুচি অনুসারে নানা সামগ্রী আয়ত্তের মধ্যে পাইলে মানুষের পক্ষে কত বেশী সুবিধা হয়! ধর্মজগতেও সেইরূপ। ইহা ভগবানেরই এক মহিমময় বিধান যে, জগতে বহু ধর্মমতের উদ্ভব হইয়াছে। প্রার্থনা করি, এই ধর্মমতের সংখ্যা উত্তরোত্তর বর্ধিত হউক এবং কালক্রমে প্রত্যেক ব্যক্তি তাহার সংস্কার অনুযায়ী স্বতন্ত্র ধর্মমতের অনুবর্তী হইবার সুযোগ লাভ করুক।
বেদান্ত এই নিগূঢ় প্রয়োজন উপলব্ধি করিয়া এক সত্য প্রচার করেন এবং একাধিক সাধনপ্রণালী স্বীকার করেন। তুমি খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, য়াহুদী বা হিন্দু হও না কেন, যে-কোন পুরাণ-শাস্ত্রে বিশ্বাসী হও না কেন, নাজারেথের ঈশদূত, মক্কার প্রেরিতপুরুষ মহম্মদ, ভারতের বা অন্য কোন স্থানের অবতার ও প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষের প্রতি আনুগত্য স্বীকার কর না কেন, তুমি নিজেই একজন সত্যদ্রষ্টা হও না কেন, বেদান্ত এ-সম্বন্ধে কিছুই বলিবে না। বেদান্ত শুধু সেই শাশ্বত নীতি প্রচার করেন, যাহা সকল ধর্মের ভিত্তি এবং যাহার জীবন্ত উদাহরণ ও প্রকাশরূপে অবতারপুরুষ ও মুনি-ঋষিগণ যুগে যুগে আবির্ভূত হন। তাঁহাদের সংখ্যা যতই বর্ধিত হউক, তাহাতে বেদান্ত কোন আপত্তি উত্থাপন করিবে না। বেদান্ত শুধু তত্ত্বটি প্রচার করে এবং সাধনপ্রণালী তোমার উপর ছাড়িয়া দেয়। যে কোন পথ অনুসরণ কর, যে-কোন প্রত্যাদিষ্ট মহাপুরুষের অনুগামী হও—তাহাতে কিছু আসে যায় না। শুধু লক্ষ্য রাখিও সাধনপথটি যেন তোমার সংস্কার অনুযায়ী হয়, তাহা হইলেই তোমার উন্নতি নিশ্চিত।