আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছি। আমার হাতে একটা সাদা তোয়ালে, আমি সেটা দিয়ে আমার হাতটা মোছার চেষ্টা করছি। আমাকে ঘিরে অন্য চার জন বসে আছে। নুবা বলল, রিকি, তোমার সত্যি আর হাতটা মোছার প্রয়োজন নেই।
হ্যাঁ। হিশান বলল, হাতে শ্যালক্স গ্রুনের যেটুকু চিহ্ন ছিল মুছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আমি জানি। আমি এর মাঝে কম করে হলেও দশবার হাত ধুয়ে এসেছি তবুও কেমন জানি গা ঘিনঘিন করছে, মনে হচ্ছে কিছু অশুভ একটা কিছু ঘটে গেছে। ব্যাপারটা আমি ঠিক বোঝাতে পারব না, আমার কখনো এ রকম হয় নি।
নুবা নরম গলায় বলল, রিকি। আমার মনে হয় তুমি বাইরে থেকে ঘুরে আস।
হ্যাঁ।
হিশান আর ইগা একসাথে মাথা নাড়ে। তোমার কাজ তুমি করেছ, তুমি এখন এক দিনের জন্যে ছুটি নাও।
কিন্তু আমাদের সময় নেই–
আমি জানি। কিন্তু তুমি সত্যি এখন কোনো কাজে আসছ না। একজন মানুষ হাত থেকে অদৃশ্য কিছু মুছে ফেলার চেষ্টা করছে–ব্যাপারটা দেখা খুব মজার ব্যাপার না।
আমি সবার মুখের দিকে তাকালাম, সত্যি তোমরা মনে কর আমি এখন যেতে পারি?
হ্যাঁ, সত্যি আমরা মনে করি।
আমি সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালাম, আমার সত্যিই খানিকক্ষণের জন্যে এই জীবনটির কথা ভুলে যাওয়া দরকার।
.
বিজ্ঞান পরিষদের বিশাল ভবন থেকে বের হয়ে আমি খানিকক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকি। পাশে বড় রাস্তা, তার বিভিন্ন স্তরে নানা আকারের বাই ভার্বাল যাচ্ছে আসছে। দুপাশে বড় বড় আলোকোজ্জ্বল ভবন। রাস্তায় নানা ধরনের মানুষ। এটি শহরের ভালো এলাকাটি, মানুষগুলোর চেহারায়, পোশাকে তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। অপরিচিত মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করতে আমার খুব ভালো লাগে। আমি আগেও দেখেছি শহরের দরিদ্র এবং অবস্থাপন্ন অঞ্চলের মানুষের অনুভূতির মাঝে খুব বেশি তারতম্য নেই।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষজনকে লক্ষ করতে করতে হঠাৎ দুজন তরুণ–তরুণীকে হাত ধরে হেঁটে যেতে দেখলাম। তরুণীটির চেহারার সাথে কোথায় জানি ত্রিশার চেহারার মিল রয়েছে, আমার হঠাৎ করে কেমন জানি বিষণ্ণ লাগতে থাকে। আমি বুকের ভিতরে এক ধরনের নিঃসঙ্গতা অনুভব করি, ঘনিষ্ঠ একজনের সাথে কথা বলার জন্যে হঠাৎ বুকটি হা হা করতে থাকে। কিন্তু আমার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেই।
আমি ক্লান্ত পায়ে রাস্তা ধরে কয়েক পা হেঁটেছি আর ঠিক তখন আমার পাশে অত্যন্ত সুদৃশ্য একটি বাই ভার্বাল এসে দাঁড়াল।
দরজা খুলে কমবয়সী একটি মেয়ে লাফিয়ে নেমে এসে বলল, মহামান্য রিকি!
আমাকে বলছ?
অবশ্যি! কোথায় যাবেন আপনি?
আমাকে নিয়ে যাবে তুমি?
অবশ্যি!
ঠিক তখন আমার মনে পড়ল আজ সকালে আমার জীবন পাল্টে গেছে, আমি পৃথিবীর এক শ সতের জন লাল কার্ডের অধিকারীদের এক জন। আমি একবার ভাবলাম মেয়েটিকে চলে যেতে বলি, কিন্তু কী মনে করে আমি বাই ভার্বালে উঠে বসলাম।
কোথায় যাবেন মহামান্য রিকি?
তোমার আমাকে মহামান্য রিকি ডাকার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাকে শুধু রিকি ডাকতে পার।
মেয়েটি খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না।
বাই ভার্বালটি নিঃশব্দে উপরে উঠে একটা নির্দিষ্ট গতিপথে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। আমি প্রায় মুগ্ধ হয়ে এই যন্ত্রটিকে দেখছিলাম, তখন মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় যাবেন?
আমি জানি না।
মেয়েটি হেসে ফেলল, যেন খুব মজার কথা একটা শুনেছে। হাসতে হাসতে বলল, জাতীয় শিক্ষকেন্দ্রে খুব সুন্দর একটি নৃত্যানুষ্ঠান হচ্ছে।
না, আমি মাথা নাড়লাম, আমার মানুষের ভিড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।
তাহলে কি জাতীয় মিউজিয়ামে–
না। আমার মস্তিষ্কটিকে একটু বিশ্রাম দিতে হবে। খুব কষ্ট হয়েছে আজ। মিউজিয়ামে গেলে বিশ্রাম হবে না।
আপনাকে কি তাহলে বাসায় নিয়ে যাব?
না। বাসাতেও যেতে ইচ্ছে করছে না।
আপনার কোনো বন্ধুর বাসায়?
আমার বন্ধু বলতে গেলে নেই। আমি যে অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি সেখানে যারা ছিল তাদের সাথে খানিকটা যোগাযোগ আছে।
যাবেন তাদের বাসায়?
মন্দ হয় না। এই বাই ভার্বাল নিয়ে যাওয়া যাবে না। শহরের সবচেয়ে দুস্থ এলাকায় থাকে তারা!
সেটি নিয়ে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।
সত্যি সত্যি সেটা নিয়ে আমার কোনো চিন্তা করতে হল না। মেয়েটি কীভাবে কীভাবে জানি দুস্থ এলাকার সরু একটা রাস্তার পাশে বিল বাই ভার্বালটি নামিয়ে ফেলল।
আমি দরজা খুলে বের হতেই মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, আমি কি আপনার জন্যে অপেক্ষা করব?
মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? বাড়ি যাও এখন। মেয়েটি আমাকে অভিবাদন করে বাই ভার্বালের মাঝে ঢুকে যায়, আমার কেন যেন সন্দেহ হতে থাকে মেয়েটি আসলে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকবে।
আমার অনাথ আশ্রমের যে বন্ধুটির সাথে আমি দেখা করতে এসেছি তার নাম রিহাস। সে শক্তসমর্থ বিশাল একটি মানুষ, কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তা অপরিণতবয়স্ক কিশোরের মতো। তার ভিতরে এক ধরনের সারল্য আছে যেটা আমাকে বরাবর মুগ্ধ করে এসেছে।
আমি তার দরজায় শব্দ করতেই সে দরজা খুলে দিল। আমাকে দেখে সে একই সাথে বিস্মিত এবং আনন্দিত হয়ে ওঠে। সে দুই হাতে শক্ত করে আমার হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, কী আশ্চর্য! রিকি তুমি এসেছ আমার বাসায়! কী আশ্চর্য!
আমি তার ঝাঁকুনি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে করতে বললাম, এর মাঝে আশ্চর্য হবার কী আছে? আমি কি তোমার বাসায় আগে কখনো আসি নি?
কিন্তু আজকেই আমি তোমার বাসায় খোঁজ করেছিলাম!
সত্যি?
হ্যাঁ। ভারি মজার ব্যাপার হয়েছে আজ। ভারি মজা!
কী?
তোমার বাসায় খোঁজ করেছি, যোগাযোগ মডিউলটি ধরেছে তোমার রবোট!
কিটি?
হ্যাঁ। কিটি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, রিকি কোথায়? সে কী বলল জান?
কী?
হাঃ হাঃ হাঃ। তুমি শুনলে বিশ্বাস করবে না, সে বলল রিকিকে বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক মহামান্য ইয়োরন রিসি ডেকে পাঠিয়েছেন! রিহাস আবার বিকট স্বরে হাসতে শুরু করল!
তাই বলল?
হ্যাঁ। রিহাস অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে তার চোখ মুছে বলল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন ডেকেছে রিকিকে? সে কী বলল জান?
কী?
বলল, মনে হয় পৃথিবীর কোনো সমস্যা হয়েছে। রিকি তার সমাধান করবে! রিহাস আবার হাসতে শুরু করে। তার দিকে তাকিয়ে আমিও হাসতে শুরু করি। মুহূর্তে আমার মনের সমস্ত গ্লানি কেটে যায়, বুকের ভিতর এক ধরনের সজীব আনন্দ এসে ভর করে।
রিহাস আমার হাত ধরে আমাকে টেনে ঘরের ভিতরে নিয়ে আসে। আমি তার প্রবল আপ্যায়ন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে করতে বললাম, তুমি আমাকে খোঁজ করছিলে কেন?
অনেকদিন থেকে দেখা নেই তাই ভাবলাম একটু খোঁজ নিই। তাছাড়া
তাছাড়া কী?
রিহাস লাজুক মুখে বলল, লানার কথা মনে আছে?
লানা? তোমার বান্ধবী?
হ্যাঁ। আমি আর লানা ঠিক করেছি বিয়ে করব। এই বসন্তেই।
সত্যি? আমি কনুই দিয়ে রিহাসের পেটে চা দিয়ে বললাম, সত্যি?
রিহাস দাঁত বের করে হেসে বলল, সত্যি! লানাকে আজ আমি খেতে আসতে বলেছি, তাই ভাবছিলাম তোমাকেও ডাকি! কী আশ্চর্য সত্যি সত্যি তুমি এসে হাজির! এটাকে যদি ভাগ্য না বল তাহলে ভাগ্যটা কী?
আমি মাথা নেড়ে রিহাসের কথায় সায় দিলাম। রিহাস আমার হাত ধরে বার কয়েক ঝাঁকুনি দিয়ে ঘরের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল। ভিতরে খানিকক্ষণ নানা ধরনের শব্দ হয়, সম্ভবত কিছু একটা রান্না হচ্ছে। একটু পরেই সে ফিরে এসে বলল, তোমার খিদে পেয়েছে তো? মাংসের স্টু রান্না হচ্ছে। কৃত্রিম মাংস নয়, একেবারে পাহাড়ি ভেড়ার রান! অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি।
রিহাসের ঘরে আসবাবপত্র বিশেষ নেই, কিন্তু যেটুকু আছে সেটুকু খুব সাজানো গোছানো। ঘরের একপাশে ছোট টিউব। আমি সেদিকে তাকাতেই রিহাস মাথা নেড়ে বলল, টিউবটা এক সপ্তাহ থেকে নষ্ট হয়ে আছে। বিশ্বাস কর, কম করে হলেও তিনবার খবর পাঠিয়েছি, কারো কোনো গরজ নেই।
আমি অন্যমনস্কতাবে টিউবটার সুইচ স্পর্শ করতেই সেটা চালু হয়ে ঘরে হলোগ্রাফিক ছবি ভেসে আসে। রিহাস অবাক হয়ে বলল, আরে! ঠিক হয়ে গেছে দেখি! কেমন করে ঠিক হল?
আমি জানি না।
কী আশ্চর্য! আমি একটু আগে চেষ্টা করলাম কিছুতেই চালু হল না।
টিউবে জেনারেল জিক্লোকে সমাহিত হবার খবরটি দেখানো হচ্ছিল। কীভাবে মারা গেছেন সেটি ব্যাখ্যা করা হয় নি, একটি দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। একটু আগে আমরা এই শব্দটি ঠিক করে দিয়েছিলাম–শ্যালক্স গ্রুনের কথা এই মুহূর্তে কাউকে বলা সম্ভবত সুবিবেচনার কাজ নয়।
রিহাস ঘরের একপাশে হিটারের কাছে দাঁড়িয়ে বাতাসের উত্তাপ পরীক্ষা করতে করতে বলল, আশ্চর্যের পর আশ্চর্য!
কী হয়েছে?
গরম বাতাসের হিটারটি নষ্ট হয়েছিল সেটাও ঠিক হয়ে গেছে! দেখ কী চমৎকার উষ্ণ বাতাস!
আমি রিহাসের কাছে দাঁড়িয়ে বাতাসের প্রবাহে হাত রেখে উষ্ণতাটা অনুভব করতে করতে বললাম, ভারি চমৎকার।
কিন্তু কেমন করে হল এটা?
আমি জানি না। মাথা নেড়ে বললাম, জানি না।
আমি রিহাসের মুখের দিকে তাকালাম, তার চেহারায় একটি অল্পবয়স্ক বালকের ছাপ। রয়েছে। আমরা যখন অনাথ আশ্রমে ছিলাম সে সবসময় আমাকে অন্য দুরন্ত শিশুদের হাত থেকে রক্ষা করত। আমি সবসময় রিহাসের জন্যে এক ধরনের মমতা অনুভব করে এসেছি। আজকেও তার কিশোরসুলভ মুখের দিকে তাকিয়ে আমি এক ধরনের গভীর ভালবাসা অনুভব করি। আমি তার হাত স্পর্শ করে বললাম, রিহাস
কী হল?
তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
কী কথা?
তোমার কি মনে হয় মানুষের জীবন অর্থহীন?
রিহাস ভেবাচেকা খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমার প্রশ্নটি সে ধরতে পেরেছে মনে হয় না। প্রাণপণ চেষ্টা করে বোঝার চেষ্টা করতে থাকে আমি তার সাথে কোনো ধরনের রসিকতা করার চেষ্টা করছি কি না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, কী বললে?
বলেছি, তোমার কি মনে হয় বেঁচে থাকার কোনো অর্থ আছে?
অর্থ থাকবে না কেন?
এই যে, কী কষ্টের একটা জীবন! তুমি আর আমি অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছি–বাবা মা নেই, আদর করে কথা বলার একটি মানুষ নেই। বেঁচে থাকার জন্যে কী কষ্ট, সূর্য ওঠার আগে তুমি ঘুম থেকে উঠে সুড়ঙ্গে করে কাজ করতে যাও, ফিরে আস সন্ধেবেলা, খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে
কী হল তোমার? রিহাস আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কি গোপন রাজনীতির দলে নাম লিখেছ?
না।
তাহলে?
তাহলে কী?
তাহলে এ রকম মন খারাপ করা কথা বলছ কেন? অনেক কষ্ট করতে হয় সত্যি– কিন্তু সবাই কষ্ট করে। তুমি শুধু কষ্টটা দেখছ কেন? ভালো জিনিসটা দেখছ না কেন?
ভালো কোন জিনিসটা?
কত কী আছে। লানার কথা ধর–লানার সাথে আমি যখন থাকি তখন আমার মনে হয় আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
আমি রিহাসের চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বললাম, রিহাস, যদি মনে কর কেউ এসে বলে তোমার জীবন তুচ্ছ, তুমি তুচ্ছ, তোমার বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই, তুমি কী বলবে?
আমি?
হ্যাঁ, তুমি।
আমি এক ঘুসিতে তার মুখের ছয়টা দাঁত খুলে নিয়ে বলব, জাহান্নামে যাও!
আমি রিহাসের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। রিহাস খানিকক্ষণ আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার আজকে কী হয়েছে? রাজনীতির লোকদের মতো কথা বলছ কেন?
আর বলব না!
সেটাই ভালো–সে আরো কী একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল। নিশ্চয়ই লানা এসেছে।
রিহাস যেরকম বিশাল, লানা ঠিক সেরকম ছোটখাটো। তার লাল চুল শক্ত করে পিছনে টেনে বাধা। ঠিক সুন্দরী বলতে যা বোঝায় লানা তা নয়, কিন্তু তার চেহারায় এক ধরনের স্নিগ্ধ কমনীয়তা রয়েছে। লানা তার ভারী কোট খুলে দু হাত ঘষে উষ্ণ হতে হতে বলল, খুব একটা অবাক ব্যাপার হয়েছে বাইরে।
কী হয়েছে?
বিশাল একটা বাই ভার্বাল দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। শুধুমাত্র ছবিতে এ রকম বাই ভার্বাল দেখা যায়–চিত্রতারকারা এ রকম বাই ভার্বালে করে যায়।
আমি একটু এগিয়ে এলাম, কী হয়েছে সেই বাই ভার্বালে?
ভিতরে একটা মেয়ে, কী সুন্দর দেখতে গায়ের রং কী উজ্জ্বল!
কী হয়েছে সেই মেয়ের?
আমাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি লানা?
রিহাস অবাক হয়ে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ। আমি বললাম হ্যাঁ, আমি লানা। তখন আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আর রিহাস এই বসন্তকালে বিয়ে করবে? আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি কে? তুমি কেমন করে জান? মেয়েটি হেসে বলল, আমি সব জানি। এই নাও তোমাদের বিয়ের উপহার। আমার হাতে একটা ছোট খাম ধরিয়ে দিল। আমি নিতে চাচ্ছিলাম না, যাকে আমি চিনি না, কেন তার থেকে উপহার নেব? মেয়েটা তখন কী বলল জান?
কী?
বলল, তুমি আর রিহাস পৃথিবীর খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষকে খুব খুশি করেছ। আমরা তার পক্ষ থেকে উপহার দিচ্ছি। তোমাকে নিতে হবে।
তাই বলল?
হ্যাঁ।
রিহাস এগিয়ে গিয়ে খামটা হাতে নিয়ে বলল, দেখি কী আছে খামে। খামটা খুলে সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে।
অনেকক্ষণ পর সাবধানে বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে বলল, নিশ্চয়ই কিছু একটা ভুল হয়েছে কোথাও।
কেন? কী আছে খামে?
আমাদের দুজনের জন্যে দক্ষিণের সমুদ্রোপকূলে দু সপ্তাহের জন্যে একটি কটেজ। যাতায়াতের খরচ। সরকারি ছুটি, হাতখরচের জন্যে ভাউচার।
লানা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। সত্যি?
হ্যাঁ, এই দেখ। নিশ্চয়ই কিছু একটা ভুল হয়েছে।
লানা মাথা নাড়ল, বলল, না ভুল হয় নি। মেয়েটি আমাকে স্পষ্ট বলেছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ দিয়েছে। এত গুরুত্বপূর্ণ যে তার লাল কার্ড রয়েছে।
লাল কার্ড?
হা। রিহাস জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকাল, রিকি, শুনেছ, লাল কার্ডের একজন মানুষ আমাকে আর লানাকে বিয়ের উপহার দিয়েছে। শুনেছ?
আমি জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে আনি, শুনেছি।
মানুষটা কে? কখন আমি তাকে খুশি করেছি? কীভাবে করেছি?
আমি রিহাসের হাত স্পর্শ করে বললাম, রিহাস, একজন মানুষ যখন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় তখন তাকে আর বোঝা যায় না। তোমরাও কোনোদিন এই মানুষটিকে বুঝবে না। কোনোদিন তাকে খুঁজেও পাবে না!
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি না। আন্দাজ করছি।
রিহাস আমার দিকে তাকিয়ে বলল, রিকি, তুমি আমার জন্যে আজকে সৌভাগ্য নিয়ে এসেছ। প্রথমে টিউব ঠিক হয়ে গেল, তারপর গরম বাসের হিটার, এখন এই সাংঘাতিক উপহার! তাই না লানা?
লানা মিষ্টি করে হেসে বলল, হ্যাঁ। কিছু কিছু মানুষ হয় এ রকম। তারা সবার জন্যে সৌভাগ্য নিয়ে আসে। আমি আগেও দেখেছি রিকি সবসময় সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে।
আমি মনে মনে বললাম, তোমার কথা সত্যি হোক লানা। শ্যালক্স গ্রুনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সেটা হচ্ছে সৌভাগ্য। অনেক অনেক সৌভাগ্য।
.
গভীর রাত্রিতে আমার হঠাৎ ত্রিশার কথা মনে হল। কোথায় আছে এখন? কী করছে? তাকে একটিবার দেখার জন্যে আমার বুক হাহাকার করতে থাকে। আমি বিছানায় দুই হাঁটুর মাঝে মুখ রেখে চুপ করে বসে থাকি। টেবিলের উপর আমার লাল কার্ডটি পড়ে রয়েছে। আমি সেটা স্পর্শ করে ত্রিশার খোঁজ নিতে পারি, তাকে দেখতে পারি, আমার কাছে নিয়ে আসতে পারি।
কিন্তু আমি কিছুই করলাম না। চুপ করে বসে রইলাম।