দিন দুই পরে কিরীটী আবার আমাকে ডেকে বলল, কৃষ্ণার কথা শুনে কিন্তু তুই চুপ করে বসে থাকিস না সুব্রত। মিত্রা সেনের সমস্ত সংবাদটা আমার চাই।
বললাম, তথাস্তু।
কিন্তু বললাম তো তথাস্তু। কিন্তু কেমন করে তা সম্ভব! শ্রীমতী মিত্রা সেন সম্পর্কে যতটুকু জানি বা জানবার সৌভাগ্য হয়েছে, তিনি গভীর জলের মৎস্যকন্যা! এমন একটা পরিবেশের মধ্যে তাঁর বিহার যে সেখানে আমার মত একজন নগণ্য অসামাজিক রসকষহীন ব্যক্তির পক্ষে মাথা গলানো শুধু দুঃসাধ্যই নয়, অসম্ভব। তিনি থাকেন অভিজাত পল্লীর প্রাসাদোপম পিতৃ-নিবাসের তিনতলার একটি নির্জন কক্ষে। সিঙ্গল করা মাথার চুল, কপাল কপোল ও ওষ্ঠ থেকে শুরু করে পদাঙ্গুলির নখাগ্র পর্যন্ত এমন সুচারুভাবে এনামেলিং করা যে, ত্রিশোত্তীর্ণ হয়েও আজ তিনি চিত্তবিমোহিনী, স্থিরযৌবনা, মনোলোভা।
অতএব দুদিন ধরে কেবল ভাবলামই। তারপর বিদ্যুৎ-চমকের মতই হঠাৎ যেন ভাবতে ভাবতে মানসপটে একখানি মুখ ভেসে উঠল।
সুধীরঞ্জন মিত্র।
হ্যাঁ, ঠিক। সুধীর ওখানে গিয়ে হানা দিতে হবে। সে হয়তো একটা পথ বাতলে দিতে পারবে। কলকাতা শহরে সত্যিকারের পুরাতন এক বনেদী ঘরের ছেলে সুধী। ওদেরই এক পূর্বপুরুষ হেস্টিংসের আমলে বেনিয়ানগিরি করে মা লক্ষ্মীকে এনে গৃহে তুলেছিলেন। তারপর দুই পুরুষ ধরে নর্তকী ও সুরার বিলাসিতায় সেই লক্ষ্মীর রস শোষণ করেও যা বাকি ছিল সুধীর জীবনে, ইচ্ছে করলে সুধী তার একটা জীবন হেসেখেলে পায়ের উপরে পা দিয়েই কাটিয়ে যেতে পারত। কিন্তু সুধী তার পূর্বপুরুদেরও যেন নারী ও সুরার ব্যাপারে ডিঙিয়ে গেল। এবং পিতার মৃত্যুর পর দশটা বছর যেতে না যেতেই হাটখোলার শেষ বসতবাটিটুকুও বন্ধক দিয়ে সে আজও নাকি পূর্বের মত না হলেও মেজাজেই দিন কাটাচ্ছে।
সুধীর আরও দুইটি বিশেষ গুণ ছিল যেটা তার বাপ-পিতামহ বা তস্য পিতা কোনদিনই আয়ত্ত করতে পারেননি। সুধী ইংরাজী সাহিত্যে এম.এ পাস করেছিল এবং সর্বাপেক্ষা বেশী নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণীর প্রথম স্থানটি অধিকার করে। পড়াশুনার বাতিকও তার ছিল প্রচণ্ড। আর বেহালা বাজানোয় সে ছিল অদ্বিতীয়। এবং সেই বিশেষ গুণটির জন্যই তথাকথিত ইউরোপীয় ভাবধারায় সমৃদ্ধ নতুন দিনের কালচার্ড সোসাইটির মধ্যেও সে পেয়েছিল অনায়াস প্রবেশাধিকার। এবং আজও সে অবিবাহিত। সুধীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বছর চারেক আগে এক পাটিতে।
সুধীরঞ্জনের কথা মনে হতেই পরদিন সকাল-সকালই বের হয়ে পড়লাম তার গৃহের উদ্দেশে।
সুধীর কথাই ভাবতে ভাবতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম।
পার্টিতে সে-রাত্রে সুধীর বেহালা বাজানো শুনে মুগ্ধই হয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। তারপর পরিচয় হয়ে তার পড়াশুনা ও জ্ঞান দেখে আরও বেশী করে মুগ্ধ হই। বেশ কিছুদিনে আলাপও জমে উঠেছিল। তারপরই তার নারী ও সুরাপ্রীতির সন্ধান পেয়ে কি জানি কেন হঠাৎ তার প্রতি মনটা আমার বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠায় ধীরে ধীরে এক সময় তার কাছ থেকে সরে এসেছিলাম।
তারপর অবিশ্যি কালে-ভদ্রে কচিৎ কখনও যে দেখা হয়নি সুধীরঞ্জনের সঙ্গে তা নয়। তবে পূর্বের মত আর ঘনিষ্ঠ হতে পারিনি। সে-ও চায়নি হতে।
বিরাট সেকেলে প্যাটার্নের পুরাতন স্ট্রাকচারের বাড়ি। অন্দরমহলে বহু ভাড়াটে এসে বসবাস করছে। বহির্মহলেরই চারখানা ঘর নিয়ে সুধী থাকে। এখনো অবিশ্যি তার চাকর ঠাকুর দারোয়ান সোফার আছে। আর আছে আপনার জন বলতে সুধীর এক বিধবা সত্তর বৎসরের পিসী মৃন্ময়ী। ঘুম থেকে উঠে সুধী চা-পান কবতে বসেছিল, এমন সময় ভৃত্যের মুখে আমার আসার সংবাদ পেয়ে আমাকে সোজা একেবারে তার শয়নঘরেই ডেকে পাঠাল।
একটা চেয়ারের উপর বসে সুধী চা-পান করছিল। আমাকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে বললে,এস, এস সুব্রত। হঠাৎ কি মনে করে? পথ ভুলে নাকি?
না। মনে করেই এসেছি।
বটে! কি সৌভাগ্য! বলেই ভৃত্যকে চা আনতে আদেশ দিল।
সামনেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।
একটু পরেই ভৃত্য চা নিয়ে এল। চা-পান করতে করতে ভাবছিলাম কি ভাবে বক্তব্যটা আমার শুরু করা যায়।
সুধীই প্রথমে কথা বললে, তারপর হঠাৎ উদয় কেন বল তো?
তোমার কাছে একজনের কিছু সংবাদ পাই যদি সেই আশায়—
সংবাদ! আমি ভাই সংবাদ দিতে পারি নারীমহলের, অন্য মহলের সংবাদ—
একজন নারী সম্পর্কেই জানতে চাই।
বল কি! ভূতের মুখে রামনাম! কি ব্যাপার বল তো হেঁয়ালি রেখে?
হেঁয়ালি নয়, সত্যিই কোন এক বিশেষ নারী সম্পর্কেই—
সত্যি বলছ? Are you serious?
নিশ্চয়ই।
হুঁ। বল শোনা যাক।
মিত্রা সেনকে চেনো?
নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই যেন চমকে সুধীরঞ্জন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষণকাল নিষ্পলক হয়ে রইল।
কি? চেনো নাকি?
এককালে চিনতাম।
এখন?
দেখাশুনা হয় এইমাত্র। কিন্তু বন্ধু, সাবধান! ও হচ্ছে বহ্নি-পতঙ্গ। ও পতঙ্গের দিকে হাত বাড়ালে হাতই পুড়বে, পতঙ্গ ধরা দেবে না।
সুধীরঞ্জনের কণ্ঠস্বরে শেষের দিকে কেমন যেন একটা চাপা বেদনার আভাস পেলাম বলে মনে হল। চমকে তাকালাম ওর মুখের দিকে। মেঘে ঢাকা আলোর মত কি একটা বিষণ্ণতা যেন ওর চোখে-মুখে ক্ষণেকের জন্য ছায়া ফেলে গেল।
এখন দেখাশুনা হয় বললে তো, সেটা কিরকম?
বৈকালী সঙ্ঘের নাম শুনেছ?
চমকে উঠলাম আবার সুধীরের কথায়। বললাম, হ্যাঁ, সেইখানেই নাকি?
হ্যাঁ। বলতে পার বৈকালী সঙ্ঘের তিনিই মক্ষীরাণী!
.
সুধীরঞ্জনের শেষের কথায় বেশ যেন একটু ঔৎসুক্যই অনুভব করি। নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলাম। তারপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, তোমার তাহলে বৈকালী সঙ্ঘে যাতায়াত আছে বল?
এককালে খুবই ছিল। তবে এখন কখনও-সখনও গিয়ে থাকি।
শেষ কবে গিয়েছিলে?
এই তো গত পরশুই গিয়েছিলাম।
হুঁ। আচ্ছা ব্যারিস্টার অশোক রায়ের নাম—
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এবারে সুধীরঞ্জন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, ব্যাপারটা সত্যি করে কি বল তো সুব্রত? প্রথমেই করলে মিত্রা সেনের নাম, তারপরই করছ অশোক রায়ের নাম! রহস্যের যেন একটা গন্ধ পাচ্ছি!
ব্যাপারটা তাহলে তোমাকে খুলেই বলি সুধী। আমি বিশেষ করে ঐ দুজনের সম্পর্কে ও বৈকালী সংঘ সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। আর তোমার কাছে সে ব্যাপারেই কিছু সাহায্য চাই।
তাই তো সুব্রত! তুমি যে আমায় চিন্তায় ফেললে!
কেন?
কারণ বৈকালী সঙ্ঘ হচ্ছে এমন একটি সঙ্ঘ সেখানে একমাত্র সেই সঙ্ঘের মেম্বার ছাড়া প্রবেশ একেবারে strictly prohibited। একেবারে দুঃসাধ্য।
কিন্তু তার কি কোন পথ নেই?
সে আরও দুঃসাধ্য ব্যাপার।
কি রকম?
তিনজন সঙ্ঘের মেম্বারের রেকমেণ্ডেশন না পেলে কারও মেম্বারশিপ সেখানে গ্রাহ্যই করা হয় না।
তুমি তো একজন আছ। আর দুজনের রেকমেণ্ডেশন তুমি যোগাড় করে দিতে পারবে না?
কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে চেষ্টা করে একবার দেখতে পারি।
দেখাদেখি নয় ভাই। যে করে থোক তোমাকে করে দিতেই হবে।
কিন্তু ভাই তোমার বেলায় আরও একটা যে মুশকিল আছে।
কেন?
এককালে তুমি পুলিসের চাকরি করতে। শুধু তাই নয়, তুমি আবার কিরীটী রায়ের সাক্ষাৎ দক্ষিণহস্ত–দুনিয়া-সমেত সকলেই জানে। তোমায় কমিটি নিতে চাইবে কিনা সেও একটা ভাববার কথা।
কিন্তু কেন নেবে না? যতদূর শুনেছি, বৈকালী সঙ্ঘ তো অভিজাত ধনিক সম্প্রদায়ের একটি মিলন-কেন্দ্র, তাহলে আমাদের যদি বর্তমানে বা অতীতে কখনও পুলিসের সঙ্গে যোগাযোগ থাকেই, সেখানে প্রবেশাধিকার পাব না কেন? তবে কি তুমি বলতে চাও সেখানে এমন কিছু ব্যাপার ঘটে থাকে যাতে ঐ দিক থেকে তাদের ভয়ের বা আশঙ্কার কারণ আছে?
সুধীরঞ্জন প্রত্যুত্তরে হেসে বললে, তা জানি না ভাই, তবে পুলিস বা পুলিস-সংক্রান্ত লোকেদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই।
হেতু?
হেতু আর কি! ওরা এমন কি যেখানে যাবে, সেখানেই একটা না একটা মামলা বাধা চাই। শোনা যায় স্ত্রীর সঙ্গেও নাকি মন খুলে কথা বলে না!
তাহলে উপায়? উপায় নেই?
তাই তো বলছিলাম—
আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না?
বল?
এই কথা—আসল নামে আমি যাব না। ছদ্মনাম নেব। ধর কোন জমিদারনন্দনের পরিচয়ে! কিন্তু তোমার ওই চেহারাটির সঙ্গে যে অনেকেরই পরিচয়-সৌভাগ্য আছে ভাই।
ভয় নেই। একেবারে অন্য চেহারায় ও বেশে—
বল কি! যদি ধরা পড়?
ধরা পড়ব। হুঁ! আরে তুমিই দেখে চিনতে পারবে না তো অন্যে পরে কা কথা।
সুধীরঞ্জন অতঃপর কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল। তারপর বললে, বেশ, দিন পাঁচেক বাদে এস। আজ কি নাম নেবে সেইটেই শুধু বলে যাও। একবার চেষ্টা করে দেখব।
তুমিই বল না, কি নাম নেওয়া যায়?
ছদ্মবেশ ও নাম তুমি নেবে, আর বলব আমি!
আচ্ছা নাম বলছি। মুহূর্তকাল ভাবলাম। বললাম, সত্যসিন্ধু রায়। চক্রধরপুর কোল মাই-এর মালিক।
বেশ। নাম ও পরিচয়টা জোরালো দিয়েছ বটে।
সেদিনকার মত বিদায় নিয়ে সুধীরঞ্জনের ওখান থেকে বের হয়ে এলাম।
সুধীর কাছে গিয়ে এতটা যে সুবিধা হবে যাত্রার পূর্বমুহূর্তেও ভাবিনি।
.
সুধীরঞ্জনের চেষ্টাতেই সত্যসিন্ধু রায় বৈকালী সঙ্ঘে প্রবেশাধিকার পেল। এবং যথাসময়ে একটি গোলাকার সাদা আইভরি ডিস্কের উপরে বৈকালী সঙ্ঘের সাংকেতিক-চিহ্ন-অঙ্কিত প্রবেশপত্রও হাতে এসে পৌঁছল।
তারও দিন-পাঁচেকবাদে একদিন রাত্রি নটায় প্রথম বৈকালী সঙ্ঘের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। গেটের দারোয়ান দেখলাম অত্যন্ত সজাগ ও চতুর।
আমাকে দেখেই প্রশ্ন করলে, পাস দেখলাইয়ে।
বৈকালী সঙ্ঘের প্রবেশপত্র হিসাবে যেটি আমার হস্তগত হয়েছিল, সেটি হচ্ছে ক্ষুদ্র টাকার আকৃতির একটিগোলাকার আইভরিডিস্ক। তারমধ্যে একটি লাল বৃত্তের মধ্যে অঙ্কিত অপূর্বসুন্দর একখানি নারীমুখ ও অন্য দিকে লেখা বৈকালি কথাটি। আইভরি ডিস্কটি পকেট থেকে বের করে প্রহরীর সামনে ধরলাম।
সঙ্গে সঙ্গে প্রহরী এক দীর্ঘ সেলাম দিয়ে সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিয়ে বললে, যাইয়ে সাব। মৃদু হেসে এগিয়ে গেলাম আমি। সামনেই সরু করিডোর। অল্পদূর এগিয়েই সামনে পড়ল চকচকে আলো-পিছলে-যাওয়া বম টিকের ফ্রেমে ওপেইক গ্লাস বসানো ভারি মজবুত দরজা। দরজার গায়ে একটি সাদা কাঁচের নব ও তার নীচে একটা সাদা চাকতিতে কালো ইংরাজী অক্ষরে লেখা: PULL। মুহূর্তকাল ইতস্তত করে দরজার নষ্টা ধরে টানতেই নিঃশব্দে একপাল্লাওয়ালা দরজার কপাটটা সরে এল। পাইরিথ্রাম মেনথল-ইউক্যালিপটাস-মিশ্রিত মৃদু গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা দিল সঙ্গে সঙ্গে। প্রবেশ করলাম একটা হলঘরে। মেঝেতে পুরু রবার কার্পেট বিছানা। সমস্ত হলঘরটা মৃদু একটা নীলাভ আলোয় যেন থমথম করছে। সামনেই কার্পেট-মোড়া একটা সিঁড়ি। বুঝলাম দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি সেটা।
হলঘরে প্রবেশ করতেই সাদা উর্দি পরিহিত একজন বেয়ারা সামনে এসে সেলাম দিয়ে দাঁড়াল। এবং মুহূর্তকাল আমার মুখের ও চেহারার দিকে তাকিয়ে বললে, কার্ড?
বুঝলাম সতর্ক প্রহরার এটি দ্বিতীয় ঘাঁটি। অপরিচিতকে এখানেও পরিচয়পত্র দাখিল করতে হবে। যথারীতি আমাকে সাংকেতিক-চিহ্ন-অঙ্কিত প্রবেশ-চাকতিটি বের করে আবার দেখাতে হল।
সঙ্গে সঙ্গে আবার সেলাম।
Upstairs please! এবারের নির্দেশ ইংরাজীতেই।
সামনেই সিঁড়ি। এগিয়ে গেলাম। কার্পেটে মোড়া সিঁড়িটা আধাআধি উঠে ডানদিকে একটু কার্ড নিয়ে আবার উপরে উঠে গিয়েছে। সিঁড়ির পথেও নীলাভ আলো।
সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে তার সামনেই আবার দরজা। এ দরজাটিও একটি পাল্লার এবং কাটগ্লাসের। পূর্ব দরজার মত এ দরজার গ্লাসেও নির্দেশ লেখা: PUSH।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল বিরাট একটি হলঘর। নীচের হলঘরের প্রায় দিগুণ এবং মিশ্রিত হাসি ও মৃদু আলোকের একটা গুঞ্জরণের সঙ্গে সঙ্গে নাসারন্ধ্রে এসে প্রবেশ করল মৃদু একটা ল্যাভেণ্ডারের মিষ্টি গন্ধ। দেওয়ালের গায়ে গায়ে অদৃশ্য আলো থেকে আলোকিত ঘরটি। এবং সে আলো নীলাভ হলেও বেশী স্পষ্ট। ঘরের মধ্যে টেবিল-চেয়ার, সোফা-কাউচ পাতা। সেইসব সোফা-কাউচে বসে এবং দাঁড়িয়ে থাকতে অনেককে দেখলাম। বিভিন্ন বয়সের দশ-পনের জন নরনারী। বিভিন্ন দামী বেশভূষা গায়ে। প্রত্যেকেই তাদের মধ্যে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে হাসি-গল্প করছে। আমি ঘরে সম্পূর্ণ একজন অপরিচিত ব্যক্তি। হঠাৎ প্রবেশ করা সত্ত্বেও কে আমার দিকে বারেকের জন্যও ফিরে তাকাল না। বুঝলাম তারা নিজেদের সম্পর্কে সেখানে কত নিশ্চিন্ত যে, আচমকা কোন অপরিচিত তৃতীয় ব্যক্তি সেখানে প্রবেশ করলেও তারা জানে সে এমন একজন কেউ যে তাদের দ্বারাই সেখানে প্রবেশধিকার পেয়েছে।
মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে আমি ঘরের চারপাশটা তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টিতে একবার দেখে নিলাম যথাসম্ভব আড়চোখে।
হলঘরটা দৈর্ঘ্যে যতটা প্রস্থে তার অর্ধেকের কিছু বেশিই হবে। যে দরজা-পথে ঘরে প্রবেশ করেছিলাম সে দরজা ছাড়াও দুদিকে আরও চারটি অনুরূপ কাটগ্লাসেরই এক পাল্লাওয়ালা দরজা চোখে পড়ল। এবং দরজাগুলোর মাথায় ইংরাজী অক্ষরে দেখলাম লেখা আছে 1,2,3,4; ঘরের ঐ দরজা ছাড়া আরও চারটি জানালা চোখে পড়ল কিন্তু সেগুলো একটু বেশ উঁচুতেই এবং প্রত্যেক জানালায় ভারি নীল রঙের পর্দা টাঙানো। তার উপরে চারদিকে চারটি ভেনটিলেটার। এ ছাড়াও ঘরে চারটি ফ্যান আছে। তবে সেগুলি বন্ধই ছিল, মাত্র একটি ছাড়া। দেওয়ালের চারিদিকেই আলো, তবে সেগুলো অদৃশ্য। নীলাভ কাঁচের আবরণে ঢাকা। ঘরের দেওয়াল একেবারে দুধ-সাদা। সম্পূর্ণ নিরাবরণ। কোথাও একটি ক্যালেণ্ডার বা ছবি পর্যন্ত নেই।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত নর-নারীরা সকলেই যে গল্প করছিল তা নয় —দুটো টেবিলে জনাপাঁচেক বসে তাসও খেলছিল। আরও একটি জিনিস নজরে পড়ল, ঘরে একটি বিলিয়ার্ড টেবিল। কিন্তু কাউকেও বিলিয়ার্ড খেলতে দেখলাম না। সকলেই যে যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। কি করব ভাবছি, হঠাৎ এমন সময় আমার ডাইনে 2 নম্বর দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল ও দীর্ঘকায় এক বৃদ্ধ, পরিধানে দামী নেভি-ব্লু ট্রপিক্যাল স্যুট-ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন। এবং আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর চাপা কণ্ঠে বললেন, আসুন সত্যসিন্ধুবাবু! নমস্কার।
আমার নামটা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম একসঙ্গে উপস্থিত ঘরের সকলেরই অনুসন্ধানী দৃষ্টি যেন একঝাঁক তীরের মতই আমার সর্বাঙ্গে এসে বিদ্ধ করল।
আগন্তুক তখন ঘরে উপস্থিত সকলকে লক্ষ্য করে বললেন-Ladies and gentlemen! আসুন আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই আমাদের বৈকালী সঙ্ঘের নতুন সভ্য শ্রীযুক্ত সত্যসিন্ধু রায়ের সঙ্গে। ইনি চক্রধরপুরের একজন বিখ্যাত কোল মার্চেন্ট।
অতঃপর প্রত্যেকের সঙ্গে নাম করে করে আলাপ করিয়ে দিতে লাগলেন আগন্তুক: ইনি সলিসিটার সানু ভৌমিক, ইনি অ্যাডভোকেট নীলাম্বর মিত্র, ইনি মার্চেন্ট শ্ৰীমন্ত পাল, ইনি ব্যারিস্টার অশোক রায়, ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রতিবারেই আগন্তুকের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। দীর্ঘকায়, বয়স মনে হয় পঞ্চাশোত্তীর্ণ, ষাটের কাছাকাছিই হবে। মাথার চুল কোঁকড়ানো, ব্যাকব্রাশ করা এবং একেবারে সাদা। চোখে একটি কালো কাঁচের চশমা। পুরু ওষ্ঠ এবং উপরের পাটির দাঁতের সামনের দুটো দাঁত যেন একটু বেশী বড়। গাল সামান্য তোবড়ানো, বোঝা যায় মাড়ির দাঁত নেই। মুখে সাদা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সামান্য একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়ান। গলাটা ভারী এবং গম্ভীর হলেও কেমন যেন একটা অদ্ভুত মিষ্টত্ব আছে কণ্ঠস্বরে।
আচ্ছা, তাহলে আমি চললাম। Make yourself comfortable Mr. Roy। বলেই বললেন, আশ্চর্য, দেখুন সবার পরিচয় দিলাম অথচ নিজের পরিচয়টাই আপনাকে দিলাম না! আমার নাম রাজেশ্বর চক্রবর্তী।
ওঃ, আপনিই তাহলে এখানকার প্রেসিডেন্ট! বললাম এবার আমিই।
তাই। আচ্ছা চলি।
রাজেশ্বর চক্রবর্তী অতঃপর যে দ্বারপথে প্রবেশ করেছিলেন সেই দ্বারপথেই প্রস্থান করলেন।
এক নম্বর দরজাটি এবারে খুলে গেল এবং একজন ওয়েটার হলঘরে প্রবেশ করল। দৃষ্টি পড়বার মত লোকটা। দৈর্ঘে ছ ফুটেরও বেশী হবে। যে অনুপাতে ঢ্যাঙা লোকটা সে অনুপাতে কিন্তু শরীর নয়। অনেকটা তাই হাড়গিলে প্যাটার্নের মনে হয়।
লোকটার পরিধানে ছিল সাদা লংস ও গলা-বন্ধ সাদা কোট। মাথার চুলগুলো ছোট ছোট করে কদম-ছাঁট দেওয়া। ছোট কপাল। বাঁশির মত ধারালো নাক। নিখুঁতভাবে কামানো গোঁফ।
লোকটা ঘরে ঢুকতেই একজন বললেন, মীরজুমলা, একটা বড় জিন অ্যাণ্ড লাইম দাও। অন্য একজন বললে, একটা হুইস্কি ছোটা পেগ। আর একজন বললে, একটা রাম অ্যাণ্ড লাইম।
সকলের নির্দেশেই মীরজুমলা মৃদু হেসে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানায়।
এমন সময় হঠাৎ একটা মিহি নারী কন্ঠের আওয়াজে চমকে সেই দিকে তাকালাম। তিন নম্বর দরজাটার পাল্লাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর তার গোড়ায়ই দাঁড়িয়ে অপরূপ সুন্দরী একনারীমূর্তি। তিনি মীরজুমলার দিকে তাকিয়ে বললেন, মীরজুমলা, কোল্ডলিমন-জুস।
শুধু আমিই নয়, হলঘরে সেই নারীমূর্তির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উপস্থিত সকলেরই কর্ণে সে কণ্ঠস্বর প্রবেশ করায় সকলেই একসঙ্গে হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে সাদর আহ্বান জানালেন তাকে এবং Hail beautious stranger of the grove বলে তাঁদের মধ্যে শ্রীমন্ত পাল এগিয়ে আসেন।
আর একটি সুবেশ প্রৌঢ় ব্যারিস্টার অমিতাভ মৈত্রও এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, Good evening Miss Sen!
সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল, আশ্চর্য! এ তো সেই মুখ। কত কাগজে দেখেছি। মিস মিত্রা সেন!
বৈকালী সঙ্ঘের সুধীরঞ্চন-বর্ণিত মক্ষীরানী।