দরজার দিকে এগোচ্ছিল কিরীটী; কিন্তু জয়ন্ত চৌধুরী বাধা দিলে, বললে, না, ও দরজা দিয়ে নয়। আসুন, এইদিকে।
কিরীটিকে নিয়ে জয়ন্ত শয়নঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল।
শয়নঘরের মধ্যে আর একটি দরজা ছিল।
কিরীটী ভেবেছিল, সে দরজাটা বুঝি পাশের ঘরে যাবার জন্য, কিন্তু দরজাটা খুলতেই দেখা গেল, তার অনুমান ভুল-ঘর নয় সরু একটা বারান্দা। বারান্দাটা অন্ধকার ছিল— সুইচ টিপে বারান্দার আলোটা জুেলে দিল জয়ন্ত চৌধুরী।
জয়ন্ত চৌধুরী আগে আগে চলল, কিরীটী তাঁকে অনুসরণ করে নিঃশব্দে। বারান্দার শেষপ্রান্তে সিঁড়ি। সিঁড়িটাও অন্ধকার ছিল। সিঁড়ির আলোটা জেলে দিল জয়ন্ত চৌধুরী।
সিঁড়িটা খুব চওড়া নয়। এবং দেখলেই বোঝা যায় সিঁড়িটা বহুদিন ব্যবহৃত হয়নি— ধাপে ধাপে ধুলো জমে আছে, আর বদ্ধ হাওয়ায় একটা ভ্যাপসা গন্ধ।
আগে আগে জয়ন্ত চৌধুরী, পশ্চাতে কিরীটী ধাপের পর ধাপ বেয়ে উঠতে থাকে। জয়ন্ত চৌধুরীই একসময় বলে, যে-ঘরে আপনাকে থাকতে দেওয়া হয়েছে, সেটা আগে গেস্টরুম ছিল না। ওই ঘরেই যে সব বাঈজী ইন্দ্ৰালয়ে মুজরা নিয়ে আসত, রায় বাহাদুর হরপ্রসাদের আমলে তাদের থাকবার ব্যবস্থা ছিল। এবং এই সিঁড়িপথেই রাত্রে প্রয়োজন হলে হরপ্রসাদ শোনা যায় নাকি সবার চোখের আড়ালে ওই ঘরে যাতায়াত করতেন।
এবং এখন আর ব্যবহার হয় না—তাই না? কিরীটী মৃদু হেসে বলে।
না। রায় বাহাদুরের মৃত্যুর দুবছর আগেই ও-পাট শেষ হয়ে গিয়েছিল।
কেন?
জীবনের শেষ দুটো বছর তো পক্ষাঘাতে একেবারে পঙ্গু হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে ছিলেন তিনি যে!
পক্ষাঘাত?
হ্যাঁ। সারাটা জীবন ধরে যেমন প্রচুর অর্থে পার্জন করেছিলেন ব্যবসা করে, তেমনি উচ্ছঙ্খলতারও চরম করে গিয়েছেন। গানের নেশা ছিল—নিজে যেমন গাইতে পারতেন, তেমনি শুনতেও ভালবাসতেন, আর সেই সঙ্গীতের নেশার পথ ধরেই দুটি জিনিস তাঁর জীবনে এসেছিল—সুরা আর নারী।
কিরীটী সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে শুনতে থাকে।
এবং সেই সুরা আর নারী শেষটায় তঁকে বুঝি গ্রাস করেছিল এবং পরবতীকালে একই ব্যাপারের পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। জিতেন্দ্ৰ চৌধুরীর বেলাতেও।
জয়ন্ত চৌধুরী বলতে থাকে; তবু একটা কথা কি আমার মনে হয় জানেন মিস্টার রায়?
কি? কিরীটী তাকাল জয়ন্ত চৌধুরীর দিকে।
জয়ন্ত চৌধুরী বলে, মনে হয় জিতেন্দ্ৰ চৌধুরী যা হয়েছিলেন, হয়তো তিনি তা হতেন না—সম্পূর্ণ অন্য মানুষ একজন হতে পারতেন, যদি না রায় বাহাদুরের কন্যা চিত্রাঙ্গদা দেবীর সঙ্গে তার বিবাহ হত।
একথা বলছেন কেন?
কিরীটীর প্রশ্নের আর জবাব দেওয়া হল না—সিঁড়ি শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং সিঁড়ির শেষ ধাপে পা দিয়ে জয়ন্ত বলে, এই যে আমরা এসে গিয়েছি।
জয়ন্ত চৌধুরীর কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটীর নজরে পড়লো—সিঁড়ির শেষ সরু একটা ল্যাণ্ডিং আর তার পরেই বন্ধ একটা দরজা।
পকেট থেকে একটা চাবি বের করে জয়ন্ত চৌধুরী দরজার ফোকরে চাবি ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল।
সরু একফালি বারান্দা সামনেই।
আসুন!
কিরীটী এগিয়ে গেল। জয়ন্ত চৌধুরী পুনরায় আবার দরজাটা বন্ধ করে দিলে।
বারান্দাটা অন্ধকার।
একটু এগুতেই বাড়ির পশ্চাৎভাগ চোখে পড়ল।
অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাড়ির পশ্চাৎভাগে বাগান—তার মধ্যে মধ্যে যে খোলা জায়গা, সেই সব জায়গা জুড়ে সব তাঁবু পড়েছে।
তাঁবুতে তাঁবুতে আলো জ্বলছে।
বাগানের মধ্যে ওই সব তাঁবু কেন?
কিরীটী প্রশ্ন করে। বড়মার জন্মতিথি উৎসবের জন্য সব তাঁবু খাটানো হয়েছে, আসুন।
বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে সামনেই একটা বন্ধ দরজার গায়ে ঠক ঠক করে কয়েকটা মৃদু টোকা দিল জয়ন্ত চৌধুরী।
সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় দরজাটা খুলে গেল।
জয়ন্ত চৌধুরী আহ্বান জানাল, আসুন মিস্টার রায়।
কিরীটী ভেতরে পা দিল।
পায়ে চপ্পল থাকলেও পায়ের তলায় একটা নরম কোমল স্পর্শ পায় কিরীটী। দামী পুরু কর্পেটে পা যেন ড়ুবে গিয়েছে।
উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল। ঘরের মধ্যে। সেই আলোতেই ঘরের চতুর্দিকে একবার দৃষ্টিপাত করল। কিরীটী। মনে হল তার ঘরটা বসবার ঘর।
চারদিকে পুরনো আমলের ভারী ভারী সব সোফা ও কাউচ। গোটা দুই আধুনিক ডিভানও আছে সেই সঙ্গে। জানলায় জানলায় সব হাফ গোলাপী রঙের পর্দা ও ভারি পর্দা ঝুলন্ত ক্রীম রঙের।
ঘরের আবহাওয়া বেশ উষ্ণ ও আরামদায়ক-কিরিটী চেয়ে দেখলো ঘরের মধ্যে ফায়ার-প্লেসে আগুন জ্বলছে।
পাশেই একজন বয়স্ক দাসী দাঁড়িয়ে ছিল। সে-ই ঘরের দরজা খুলে দিয়েছিল। তার দিকে তাকিয়েই জয়ন্ত প্রশ্ন করল, সুরতিয়া, বড়মা কোথায়?
আপনারা বসুন, রাণীমা গোসলঘরে ঢুকেছেন—গোসল হয়ে গেলেই আসবেন।
অদ্ভুত মিষ্টি ও সুরেলা কণ্ঠস্বর যেন সুরতিয়ার। কথা তো বলল না, কিরীটীর মনে হল, যেন সে গান গেয়ে উঠল। কারো সামান্য কথাও এমন মিষ্টি সুরেলা হতে পারে এ যেন কিরীটীর ধারণার বাইরে এবং সেই কারণেই বোধ হয় সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সুরতিয়ার মুখের দিকে তাকিয়েছিল।
সুরতিয়ার বয়স হয়েছে। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের নীচে নয় বলেই মনে হয়। গায়ের বর্ণ শ্যাম হলেও দেহের গড়নটি কিন্তু ভারি চমৎকার। এবং এখনো বেশ আটসঁটি। মুখের কোথায়ও যেন এখনো বয়সের ছাপ তেমন পড়েনি। বেশভুষা, রাজপুতানী মেয়েদের মত।
সুরতিয়া ওদের বসতে বলে মধ্যবতী দরজাপথে অন্তৰ্হিত হল।
বসুন মিস্টার রায়।
কিরীটী বসে না। ঘরের দেওয়ালে যে খানতিনেক বড় বড় অয়েল-পেন্টিং ছিল, সেইগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল।
ওই অয়েল-পেন্টিংগুলো কাদের?
কিরীটীর প্রশ্নে জয়ন্ত চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে একটি ছবির সামনে দাঁড়াল এবং বললে— এ হচ্ছে রায় বাহাদুর হরপ্রসাদ ব্যানার্জির তৈলচিত্র। দক্ষিণ দিককার দেওয়ালে ওটা চিত্রাঙ্গদা দেবীর মা-সারদা দেবী। আর ওই যে উত্তরের দেওয়ালে উনি আমাদের বড় জেঠামশাই জিতেন্দ্ৰ চৌধুরী।
ওদের কথাবাতাঁর মধ্যে চিত্রাঙ্গদা দেবী ঘরে এসে ঢুকলেন।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর দিকে তাকিয়ে কিরীটী যেন সত্যিই মুগ্ধ হয়ে যায়। গায়ের রঙটা একেবারে টকটকে গৌর। মুখের ও দেহের গঠনটি যেন সত্যিই অনিন্দনীয়। পরনে শ্বেতশুভ্র দামী সিল্কের থান। অনুরূপ ফুলহাতা ব্লাউজ গায়ে। সম্পূর্ণ নিরাভরণা। কিন্তু তথাপি তাঁর চেহারার মধ্যে এমন একটা আভিজাত্য আছে যে, মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।
চোখে সোনার ফ্রেমের সৌখীন চশমা। চোখের দৃষ্টি যেন অন্তর্ভেদী।
বাঁ হাতে একটা সাদা হাতাঁর দাঁতের বাঁটওয়ালা লাঠি।
গত কয়েক বছর ধরে বাতে ভুগছেন, বেশী হাঁটা-চলা করতে পারেন না। এবং হাঁটাচলা যতটুকু করেন, তাও ওই লাঠির সাহায্যেই।–
বড়মা!
জয়ন্ত চৌধুরীই সসম্রামে ডাকে।
চিত্রাঙ্গদা দেবী কিরীটীর মুখের দিকে চেয়েছিলেন।
বড়মা, ইনিই মিস্টার রায়। জয়ন্ত চৌধুরী কথাটা শেষ করে—মানে, অর্জন মিশ্র। নমস্কার। হাত তুলে নমস্কার জানালেন চিত্রাঙ্গদা দেবী।
কিরীটীও প্রতিনমস্কার জানায়।
বসুন। বসো জয়ন্ত।
সকলেই উপবেশন করে, মুখোমুখি সোফায়।
জয়ের কাছে শুনেছেন নিশ্চয়ই সব কথা, মিস্টার মিশ্র?
হ্যাঁ।
আপনি অন্য নামে, অন্য পরিচয়ে এসেছেন, আমি খুব খুশী হয়েছি মিস্টার মিশ্র। বলে চিত্রাঙ্গদা দেবী জয়ন্তর দিকে তাকালেন ঃ ওরা যেন কোন রকম অসুবিধা না হয়, তুমি কিন্তু দেখো জয়ন্ত।
আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না। বড়মা। জয়ন্ত বলে।
তুমি কটা দিন এখানে থাকাছ তো? চিত্রাঙ্গদা দেবী শুধালেন।
উৎসব পর্যন্ত আছি।
কেন, কটা দিন বেশি থাক না?
না বড়মা, ঐ সময় আমার পক্ষে বেশি দিন থাকা—
জয়ন্ত চৌধুরীর কথা শেষ হল না, সুরতিয়া এসে ঘরে ঢুকল, রাণীমা!
কি? ভু কুঁচকে তাকালেন চিত্রাঙ্গদা দেবী সুরতিয়ার দিকে।
সুধন্য এসেছে।
কে-কে এসেছে?
সুধন্য। বললাম, রাণীমা এখন ব্যস্ত আছেন, দেখা হবে না। কিন্তু কিছুতেই আমার কথা শুনছে না
সুরতিয়ার কথা শেষ হল না, খোলা দরজাপথে একজন এসে ঘরে ঢুকে পড়ল ঐ সময়।
সকলেরই দৃষ্টি একসঙ্গে গিয়ে আগস্তুকের ওপর পড়ে।
আগস্তুকের চেহারা ও বেশভূষা সত্যিই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রোগা পাতলা চেহারা। এককালে গায়ের রঙটা হয়ত অত্যন্ত ফর্সাই ছিল, এখন কেমন যেন তামাটে বর্ণ হয়েছে।
একমাথা ঝাঁকড়া ঝাকড়া চুল-লালচে তৈলহীন রুক্ষ। কতকাল যে তেলের সঙ্গে সম্পর্ক নেই কে জানে! ছোট ছোট পিঙ্গল চোখ, উন্নত নাসা, ঠোঁট দুটো একটু পুরু। মুখভর্তি খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল ও দাড়ির রঙ তামাটে। পরনে একটা কালো গরম প্যান্ট ও গায়ে গলাবন্ধ খয়েরি রঙের গরম কোট। হাতে একটা ফেল্ট ক্যাপ। পায়ে বুট জুতো।
নমস্তে রাণীমা। আগন্তুকই প্রথমে কথা বললে।
আবার কেন এসেছি? তীক্ষ্ম কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন আগন্তুককে চিত্রাঙ্গদা দেবী।
কি করি বলুন, পকেট যে খালি হয়ে গেল!
কথাগুলো বলত বলতে আগন্তুক হাসল। ময়লা একসারি দাঁত যেন বিকিয়ে উঠল। বিরক্তি ভরা কণ্ঠে চিত্রাঙ্গদা বললেন, তুমি না বলেছিলে সেদিন টাকা নেবার সময় আর ছমাসের মধ্যে টাকা চাইতে আসবে না?
বলেছিলাম তো। লেকিন টাকা যে সব ফুরিয়ে গেল।
একটি পয়সাও আর তোমাকে আমি দেব না। যাও বের হয়ে যাও।
গোসা করছেন কেন রাণীমা! সুধন্য is a poor man—তার ওপর গোসা করে কি ফায়দা বলুন! তাছাড়া আপনার কাছে দু-পাঁচশ তো nothing-কিছুই না। কিছু টাকা দিয়ে দিন, চলে যাই। জানি, আমার এ সুরৎ আপনি দেখতে চান না। টাকা দিন কিছু চলে যাই।
একটা পয়সাও আর দেব না তোমাকে আমি। কঠিন কণ্ঠে বলে ওঠেন চিত্রাঙ্গদা দেবী।
দেবেন—দেবেন। আমি জানি, শেষ পর্যন্ত আপনি দেবেনই।
সুরতিয়া? চিত্রাঙ্গদা দেবী ডাকলেন।
রাণীমা! সুরতিয়া এগিয়ে এল।
সুধন্য তাড়াতাড়ি সুরতিয়ার দিকে চেয়ে বলে ওঠে, তুমি যাও সুরতিয়া—অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি, বহুত পিয়াস লেগেছে, এক কাপ গরম চা তৈরী করে আনো। আরো কিছু মিঠাই—ভুক ভি লেগেছে।
ব্যাপারটাকে যেন অত্যন্ত লঘু করে সুধন্য সুরতিয়ার দিকে চেয়ে কথাগুলো বললে।
ওকে এখান থেকে বের করে দে সুরতিয়া! চিত্রাঙ্গদা দেবী সুরতিয়ার দিকে চেয়ে বললেন।
সুরতিয়া কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকে। বিব্রত, কেমন যেন মুহ্যমান তাকে মনে হয়।
যাও সুরতিয়া, চা আর মিঠাই নিয়ে এস। সুধন্য আবার বলে সুরতিয়ার দিকে চেয়ে।
সুরতিয়া! তীক্ষ কষ্ঠে আবার ডাকেন চিত্রাঙ্গদা দেবী। কি বললাম শুনতে পাচ্ছিস না!
সুধন্য এবার হঠাৎ এগিয়ে এসে একটা সোফার ওপর বসে পড়ল। এবং এতক্ষণে বোধ হয় তার ঘরের মধ্যে উপস্থিত কিরীটী ও জয়ন্তর দিকে নজর পড়ল।
তাড়াতাড়ি সে আবার সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল, ওঃ, আপনারা এখানে আছেন! আচ্ছা, তাহলে আমি পাশের ঘরেই যাচ্ছি। আপনার কাজ সেরে আপনি আসুন রাণীমা।
সুধন্য কথাগুলো বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সুরতিয়া আর চিত্রাঙ্গদা দেবী দুজনেই যেন পাথর। অদ্ভূত একটা স্তব্ধতা যেন ঘরের মধ্যে থমথম করে।
কারো মুখে কোন কথা নেই। আকস্মিক ঘটনাটা যেন সকলকেই কেমন স্তব্ধ করে দিয়েছে।