০৫. তিস্তা ব্রিজের দিকে

সাড়ে আটটা নাগাদ অর্জুন শহর ছেড়ে তিস্তা ব্রিজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ডরোথিকে নিয়ে বিকেলে যাওয়ার আগে তাকে একবার পূর্বদহ থেকে ঘুরে আসতেই হবে। তার সামনে ডরোথি এমন কোনও কাজ করবে না বা বলবে না, যাতে ওর উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়। তারিণী সেনের সঙ্গে তাই আগেভাগে কথা বলে আসতে চায় সে। হয়তো কোনও লাভ হবে না। ডাক্তারবাবু বলেছেন আজ দুপুরের আগে তারিণী সেন কথা বলার মতো অবস্থায় নাও থাকতে পারেন, তবু একটা চেষ্টা করতে দোষ কী! ময়নাগুড়ি থেকে কিছু ফল কিনে নিয়ে হুচলুডাঙা হয়ে পূর্বদহর দিকে যেতে যেতে সে বাইক দাঁড় করাল। ডাক্তারবাবু আসছেন সাইকেল চালিয়ে। ওকে দেখে তিনি নেমে দাঁড়ালেন। হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার বলুন তো?

এই এলাম। অর্জুনও হাসল।

না, না। আপনার কথা বলছি না। হঠাৎ দেখছি তারিণী সেনকে নিয়ে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। একটু আগে বিডিও সাহেব লোক পাঠিয়েছিলেন। তারিণী সেন যদি অসুস্থ হয়ে থাকেন তা হলে তাঁকে এক্ষুনি ময়নাগুড়ি নয়, জলপাইগুড়ি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। আমার কাছে। জানতে চেয়েছেন। আমি বলে দিলাম আজ উনি একটু সুস্থ। তবু ভাবলাম বিডিও সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাই।

বিডিও সাহেব জানলেন কী কবে?

আমি ভাবলাম আপনারাই জানিয়েছেন। ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত। এত বছর মানুষটা নানান অসুখে ভুগেছে, আধপেটা খেয়ে কোনওমতে বেঁচে আছে, অথচ কেউ কোনও খবর নেয়নি। হঠাৎ এখন ভি আই পি ট্রিটমেন্ট পাওয়ার কারণটা কী?

অর্জুন মাথা নাড়ল, না। আমরা বিডিওকে কিছু জানাইনি।

আর একটা ব্যাপার। বিডিও সাহেব আমাকে দেখা করতে বলেছেন।

কেন?

সেটা না গেলে জানতে পারব না।

বেশ। আপনি ঘুরে আসুন। আপনার না ফেরা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব।

ডাক্তারবাবু সাইকেলে চেপে চলে গেলে অর্জুন খানিকক্ষণ সেই মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইল। ব্যাপারটা অবাক হওয়ার মতোই। গ্রামের এককোণে পড়ে থাকা এক অথর্ব বৃদ্ধ যদি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠে, তা হলে লোকে তো অবাক হবেই। কিন্তু বিডিও কেন এমন উৎসাহী হলেন? তারিণী সেনকে হাসপাতালে ভর্তি করলে কার লাভ হবে?

মন্দিরের সামনে এসে গতকালের সেই লোকটাকে দেখতে পেল অর্জুন। দু হাত জড়ো করে নমস্কার করল সে। অর্জুন বাইক থেকে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করল, কী খবর?

আমাদের আর খবর! এখন তো তারিণী জ্যাঠার কপাল খুলল। আজ সরকার থেকে লোক এসেছিল ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। গতকাল আপনারা না এলে এটা হত না।

উনি কেমন আছেন?

কাল ওষুধ পড়ায় আজ বেশ ভাল। মেমসাহেব আসেননি কেন?

বিকেলে আসবেন। চলুন।

হঠাৎ যেন গুরুত্ব পেল লোকটি। জিজ্ঞেস করল পাশে হাঁটতে-হাঁটতে, ওটা কী?

আঙুর, মুসুম্বি।

বাব্বা! আমি কখনও ওসব খেয়েছি কিনা মনে পড়ে না।

অর্জুন জবাব দিল না। গ্রামের মানুষদের দুবেলা ভাত জোটাতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে এইসব ফল তো নাগালের বাইরে থাকবেই।

হঠাৎ লোকটি জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা বাবু, হঠাৎ আপনারা জ্যাঠাকে নিয়ে এত ভাবছেন কেন বলুন তো? আমি তো জ্ঞান হওয়া ইস্তক জ্যাঠার কাছে কাউকে আসতে দেখিনি। আগে মাঝে-মাঝে ময়নাগুড়িতে যেত। এখন তো সেই ক্ষমতাও নেই।

তোমার কীরকম জ্যাঠা হয়?

জ্ঞাতি সম্পর্কের।

ওঁর সম্পর্কে কিছু জানো?

শুনেছি এককালে ডাকাতি করত। সেইজন্যে ইংরেজরা ওর হাত কেটে দিয়েছিল। এসব শোনা কথা।

ওরা তারিণী সেনের বাড়ির সামনে পৌঁছে গিয়েছিল। দূর থেকেই অর্জুন দেখতে পেল তারিণী সেন দাওয়ার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছেন। বৃদ্ধাদের মধ্যে যাঁর বয়স বেশি, তিনি একটা বাটিতে কিছু দিলেন তারিণী সেনের সামনে। দ্বিতীয়া বৃদ্ধাকে দেখা গেল। লোকটি কাছে গিয়ে চিৎকার করল, অ জ্যাঠা, কাল যে বাবুটি এসেছিলেন তিনি আবার এসেছেন।

তারিণী সেন চোখ পিটপিট করলেন। ওঁকে আজ একটু ভাল দেখাচ্ছে। অর্জুন পা ঝুলিয়ে দাওয়ায় বসে প্যাকেটটা এগিয়ে দিল, আপনার জন্যে নিয়ে এলাম। অসুখের সময় খেলে ভাল লাগবে।

তারিণী সেন প্যাকেটটার দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। অর্জুন দেখল বাটিতে মুড়ি রয়েছে খানিকটা। অর্জুন বৃদ্ধাকে বলল, ওর মধ্যে আঙুর আছে। একটু ওঁকে দিন। মিষ্টি আঙুর। আর মুসুম্বির রস করে দেবেন।

লোকটি হাসল, রাজভোগ গো জেঠি। আমাকে একটু দিয়ো। জীবন সার্থক করি।

বৃদ্ধা যেন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে এমন ভঙ্গিতে প্যাকেটটা তুলে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আজ কেমন আছেন?

ভাল। মিনমিনে আওয়াজ বের হল তারিণী সেনের গলা থেকে।

আমি জলপাইগুড়িতে থাকি। অর্জুন কথা খুঁজছিল।

লোকটি বলে উঠল, খুব ভাল মানুষ। আপনার জন্যে ফল এনেছেন। হাসপাতালে ভর্তি করার ব্যবস্থা করেছেন।

হঠাৎ ঘন-ঘন মাথা নাড়তে লাগলেন তারিণী সেন। সরু গলায় কান্নার সুরে বলতে লাগলেন, না, না। যাব না। আমি হাসপাতালে যাব না।

লোকটি জিজ্ঞেস করল, কেন যাবেন না?

আমি কোথাও যাব না। এখান থেকে কোথাও না। তারিণী সেন প্রতিবাদ করছিলেন।

অর্জুন ভয় পেল, বৃদ্ধ এর ফলে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। সে বলল, আপনাকে কেউ হাসপাতালে নিয়ে যাবে না। আপনি এখানেই থাকুন। ওষুধ খান ঠিকমতো। খাবেন তো?

বৃদ্ধ শিশুর মতো মাথা নাড়লেন।

আজও কিছু কুচো উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তবে গতকাল ডরোথি সঙ্গে থাকায় যে ভিড় জমেছিল, তা আজ হয়নি। অর্জুন লোকটিকে বলল, আপনি একটু মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াবেন? ডাক্তারবাবু ফিরে আসামাত্র ওঁকে এখানে নিয়ে আসবেন।

লোকটি ভেতরের দিকে তাকাল। সেখান থেকে বৃদ্ধা একটা ভাঙা প্লেটে অনেকটা আঙুর নিয়ে বের হয়ে এলেন। বৃদ্ধের সামনে রেখে বললেন, খান।

অর্জুন দেখল লোকটির চোখ চকচক করছে। ওকে সরাতে হলে একটু আঙুর দেওয়া দরকার। সে কিছু বলার আগেই বৃদ্ধা তাঁর বাঁ হাতের মুঠো আলগা করে লোকটার সামনে ধরতেই সে খপ করে সেখান থেকে গোটা চারেক আঙুর তুলে নিল। একটা মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল, আহা! অমৃত।

এবার তা হলে যান? অর্জুন হেসে বলল।

মাথা নেড়ে লোকটা যেতে-যেতে বাচ্চাদের ধমকে দিল, অ্যাই। হাট-হ্যাট। যা এখান থেকে। কেউ কাছে যাবি না। যাঃ।

তারিণী সেন কিছুই খাচ্ছিলেন না। অর্জুন বৃদ্ধাকে বলল, আপনি ওঁকে খাইয়ে দিন। বৃদ্ধা যেন লজ্জা পেলেন। তারপর পাশে উবু হয়ে বসে প্লেট থেকে একটা আঙুর তুলে তারিণী সেনের মুখে গুঁজে দিলেন। শেষ পর্যন্ত তারিণী সেনের চোয়াল নড়তে লাগল। রসের স্বাদ পেতে নিজেই হাত বাড়ালেন। অর্জুন অদ্ভুত দৃশ্যটি দেখল। হাতে পাঞ্জা নেই। কবজির কাছেই তা আচমকা শেষ। অথচ সেই দুটো হাত একত্রিত হয়ে দুটো আঙুর তুলে নিল অদ্ভুত কায়দায়। জাপানিরা কাঠি দিয়ে ভাত খায়। তারিণী সেন কবজিবিহীন দুই হাতে আঙুর তুলছেন আর মুখে পুরছেন। হয়তো ওইভাবে ইনি ভাত অথবা মুড়িও খেতে পারেন। অভ্যেসে মানুষ কী না করতে পারে। সে চেষ্টা করলেও কাঠি দিয়ে দুটো দানার বেশি ভাত তুলতে পারবে না একবারে!

অর্জুন তারিণী সেনের দিকে তাকাল। ইনি এমন একটা বয়সে পৌঁছে গেছেন, যেখানে গেলে কোনও বিষয় নিয়ে আর তেমন আগ্রহ থাকে না বলে অর্জুন শুনেছে। ওঁর বসার ভঙ্গি, তাকানো যেন সেই কথাই বলে। হঠাৎ তারিণী সেন বললেন, আজ শরীর ভাল।

কথাটা লুফে নিল অর্জুন, আপনাকে দেখে তাই মনে হচ্ছে।

খেতে পাই না, পরতে পাই না, তবু বেঁচে আছি। এই লুঙ্গিটাও ছিড়ে গেছে।

এমন কথার পেছনে কোনও কথা মুখে আসে না। অর্জুন কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। একটা কাক দাওয়ার কাছে এসে খুব চেঁচাচ্ছিল। তারিণী সেন হাত তুললেন, যাঃ, যাঃ।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, পুরনো দিনের কথা আপনার মনে পড়ে?

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন তারিণী সেন। তারপর ফোকলা দাঁতে হাসলেন, আমি তখন ডাকাত ছিলাম। সবাই ভয় পেত।

একেবারে শিশুর মতো কথা। ডাকাতি যে অপরাধকর্ম, তাও খেয়াল নেই।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনি ডাকাতি করতেন কেন? কাজটা তো ভাল না।

তারিণী সেন চোখ বন্ধ করলেন। যেন কিছু ভাবলেন। তারপর বললেন, এক কাহন বলতে গেলে সাত কাহন গাইতে হবে। আঙুরগুলো খুব মিষ্টি ছিল। অ্যাই দাও না, আর একটু আঙুর দাও না। বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বায়না করলেন তিনি।

অর্জুন বলল, বাকিটা বিকেলে খাবেন। আমি আরও এনে দেব।

তারিণী সেন বললেন, দেবে তো? ঠিক? মনে করে দিয়ে। তুমি ছেলেটা দেখছি বেশ ভাল। আমাকে অনেক বছর কেউ কিছু দেয়নি।

ওই ডাকাতির ব্যাপারটা! অর্জুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল।

বাপ গরিব ছিল। খুব গরিব। আমি চাষ করতাম। তাতে পেট ভরত। কত বয়স হবে তখন? বড়জোর এক কুড়ি। বোনের বিয়ে ঠিক হল ধুপগুড়িতে। ধারধোর করে বাপ তাদের খাঁই মেটালো। কিন্তু বিয়ের দিন বরের বাপ জানালো সাইকেল দিতে হবে, নইলে ছেলে আসবে না। সাইকেল কোথায় পাব? মড়াকান্না শুরু হয়ে গেল। হাঁটতে-হাঁটতে ধুপগুড়ি গেলাম। বরের বাপের পায়ে পড়লাম। সে কসাই, রাজি হয় না কিছুতেই। ফিরে আসছি, এমন সময় দেখলাম একজন সাইকেল চালিয়ে আসছে নির্জন রাস্তা ধরে। রোগা লোক। মনে হল বোনের সম্মান বাঁচাতে ওটাই নিয়ে নিই। কোনও দিন অমন কম্ম করিনি। কিন্তু সেদিন করে ফেললাম। সাইকেল পৌঁছে দিয়ে এলাম বরের বাড়িতে। লোকটাকে একটু বেশি মারতে হয়েছিল। অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল পথের ধারে। কিন্তু বোনের বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু কী করে জানি লোকটা আমায় চিনে ফেলেছিল। তিন দিন বাদে পুলিশ এল আমাকে ধরতে। আমি পালালাম। জঙ্গলে যখন লুকিয়ে আছি তখন আলিবক্সের দলের সঙ্গে যোগাযোগ হল। নিজেকে বাঁচাতে তার দলে যোগ দিলাম। ওই আলিবক্স আমাকে শিখিয়ে দিল কী করে লাঠি, ছুরি চালাতে হয়, এক কোপে গলা নামাতে হয়। মনে দয়া রাখলে সেটাই যে কাল হবে, তাও শিখলাম। আলিবক্স মারা গেলে আমাকেই সদার বানানো সবাই। গরিবদের কিছু বলতাম না। কিন্তু যার বেশি আছে তাকে ছাড়তাম না। ওই বার্নিশ পর্যন্ত আমাকে ভয় পেত না এমন মানুষ খুঁজে পাবে না। আমার একটা সাদা টাট্ট ঘোড়া ছিল। তার আওয়াজ শুনলেই সবাই ঝাঁপ দিত ঘরে। ওই যে আমার বউ, ও হল প্রথম পক্ষের। বাপ দিয়েছিল এনে। ওর সঙ্গে ঘর করতে পারিনি কত বছর। দ্বিতীয় বউটাকে বিয়ে করতে হল চাপে পড়ে। ওকে চিনতাম না। বিয়ের ঠিক করেছিল ওর বাপ এক পাষণ্ডের সঙ্গে। পাওনাগণ্ডা পায়নি বলে বিয়ের দিন আসেনি। আমি সে সব জানতাম না। বিয়েবাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে শুনি এই অবস্থা। সঙ্গে সঙ্গে বরকে ধরতে লোক পাঠালাম। সে ব্যাটা আমি গিয়ে পড়েছি শুনে একেবারে হাওয়া। এবার মেয়ের কী হবে? আমি বললাম, ঠিক আছে, আমিই নাহয় উদ্ধার করছি। সে বড় ভাল দিন ছিল।

জোরে-জোরে শ্বাস নিচ্ছিলেন তারিণী সেন।

অর্জুন তাঁকে একটু সময় দিয়ে বলল, বিপ্লবীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না?

না। ও-ব্যাটারা যে কী চায় তাই বুঝতাম না। কোনও কালে যোগ না থাকলে ভালই হত। একবার লাটাগুড়ির জঙ্গলে একজনকে ধরলাম। মুখে দাড়ি, খেতে পায়নি অনেকদিন। বলল সে বিপ্লবী। ইংরেজদের তাড়াতে চায়। বলল, দেশকে স্বাধীন করবে। শুনতে-শুনতে কী রকম যেন হল। ওকে সঙ্গে নিয়ে কদিন ঘুরলাম। শিক্ষিত মানুষ। রোজগারপাতি না করে দেশ উদ্ধার করতে পুলিশের তাড়া খেয়ে বনবাদাড়ে ঘুরছে কেন, সেটাই বুঝতে চাইলাম। আর তাই ধরা পড়ে গেলাম পুলিশের হাতে।

কী করে?

অমন লোক দলের সঙ্গে ঘুরুক তা কেউ-কেউ পছন্দ করছিল না। মাঝে-মাঝে লোকটা বার্নিশে যেত তার কাজে। আবার ফিরেও আসত। একদিন খোচড় এসে দেখে গেল ওর পিছু পিছু। তারপর পুলিশ এল ওকে ধরতে। ওকে বাঁচাতে গিয়ে আমি ধরা পড়ে গেলাম। তা ধরে করবে কী? নিয়ে গেল জলপাইগুড়ি। পুরে রাখল কদিন। কিন্তু কেউ সাক্ষী দিতে এল না আমার বিরুদ্ধে। আমি বেকসুর খালাস।

আপনি এরপরে ডাকাতি করা ছেড়ে দেন কেন?

সেই লোকটার জন্যে। ওই নাকি আমার জন্যে উকিল দিয়েছিল। সেই উকিলবাবু আমার ছাড়া পাওয়ার সময় বলেছিল আর ওসব করবেন না। অনেক তো হল। কথাটা মনে লেগে গেল। দলের লোকজন চাইত না আমি বসে যাই। তারা আমাকে খুব উসকাতো। কিন্তু সেই লোকটা আমার সব খবর রাখতো। আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইত।

ওই লোকটা মানে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামী, যাদের বিপ্লবী বলা হত?

অর্জুনকে অবাক করে তারিণী সেন ঘাড় নাড়লেন, না, না। ওরা আলাদা লোক। একজন এদেশি আর অন্যজন সাহেব। লাল গোরা। পুলিশরা সেলাম করত।

এই লাল গোরার নাম কি ম্যাকসাহেব?

হ্যাঁ। তুমি কী করে জানলে? তখন তো জন্মাওনি বাপ!

শুনেছি। আর যিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন তাঁর নাম কী?

কমলবাবু। লোকটা ভাল ছিল গো।

তা আপনাকে ছাড়াল কে?

ওই গোরাসাহেব। ওই উকিল ঠিক করে দিয়েছিল।

গোরাসাহেব দেশের শত্রু ছিলেন। তা ছাড়া তাঁর কাজ ছিল অপরাধী ধরা। তিনি কেন আপনাকে বাঁচাতে গেলেন?

তারিণী সেন মাথা নাড়তে লাগলেন, সঙ্গে ফিকফিক হাসি, সাহেবের খুব লোভ ছিল, তাই।

কিসের লোভ?

বাটপাড়ি করার লোভ। চোরের ওপর বাটপাড়ি। সাহেব জানত, আমি অনেক ডাকাতি করেছি। অনেক সোনাদানা। একবার তিব্বতের, ওই যে কী বলে, তিব্বতের সাধুদের একটা দল যাচ্ছিল, তাদের ওপর ডাকাতি করে অনেক ধনসম্পত্তি পেয়েছিলাম। সোনাদানা ছাড়াও কালো পাথরের ভারী মূর্তি ছিল ওদের সঙ্গে। দুটো লোককে খুন না করে তার দখল পাইনি। গোরাসাহেব ওই মূর্তির জন্যে আমার কাছে আসত। ওই বার্নিশের জঙ্গলে সে দেখা করত আমার সঙ্গে। আমাকে যখন পুলিশ ধরল, তখন সে ছাড়িয়েছিল ওই এক শর্তে। ছাড়া পাওয়ার লোভে আমি তখন রাজি হই। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে মনে হল যদি মূর্তিটা দিয়ে দিই, সাহেব আমাকে ছিড়ে খাবে।

মূর্তিটা বিক্রি করে দিয়েছিলেন?

কে কিনবে? অদ্ভুত মূর্তি। দেবদেবীর না। সোনাদানা সব ফক্কা হয়ে গিয়েছিল।

মূর্তিটা নিয়ে কী করলেন?

পুঁতে রেখেছি।

অর্জুন এবার সোজা হয়ে বসল, আপনার হাত দুটো কাটা গেল কী করে?

হঠাৎ কেমন অবসন্ন দেখাল তারিণী সেনকে। সম্ভবত অনেকক্ষণ কথা বলার ধকল তিনি সামলাতে পারছিলেন না। দেওয়ালে হেলান দিয়ে বললেন, ম্যাকহেব কেটে দিয়েছে।

সে কী! আমরা শুনেছিলাম বিপ্লবীরা বদলা নিয়েছে। আপনি তাদের ধরিয়ে দিতেন।

মিথ্যে কথা! কমলাকান্তকে দোমহনির সরকারি বাড়িতে প্রচণ্ড মার মেরেছিল ম্যাকসাহেব। আমি তাকে লুকিয়ে দু হাতে নিয়ে ছুটে যাই তিস্তার নৌকো ধরতে। সেই অপরাধে ম্যাকসাহেব আমাকে বলল, যদি আমি মূর্তিটা ওকে না দিই তা হলে আমার হাত কেটে দেওয়া হবে। লোকটা যত আমার কাছে মূর্তিটা চাইত, তত আমার রোখ চেপে যেত। আমি রাজি হলাম না। ও আমার হাত কেটে দিল দোমহনির লালকুঠিতে ধরে নিয়ে গিয়ে।

যেন সহজ-সরল একটা কাজের কথা বললেন তারিণী সেন।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ম্যাকসাহেব মূর্তিটার কথা জানলেন কী করে?

তিব্বতিরা বলেছে।

ঠিক আছে। আপনি এখন বিশ্রাম করুন। অর্জুন উঠে দাঁড়াল।

কাল নাকি এক গোরা মেম এসেছিল?

হ্যাঁ। মেয়েটি ম্যাকসাহেবের নাতনি। আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে।

অদ্ভুত মুখ করে তাকালেন তারিণী সেন। তারপর বললেন, গোরাসাহেবের নাতনি আমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে? হায় ভগবান। এমনও হয়?

অর্জুন বলল, আমাকে তো তাই বলেছে। আচ্ছা, ও যদি আপনার কাছে মূর্তিটার হদিস চায় তা হলে ওকে তা দেবেন?

তারিণী সেন হাসলেন। রহস্যময় তাঁর হাসি। ছড়া কেটে বললেন, কালোর সঙ্গে লাল আর লালের মধ্যে কালো/ ভক্তিভরে তারে নমো করাই ভালো। আমি ভুলেই গেছি কোথায় রেখেছি।

অর্জুন দেখল সেই লোকটির সঙ্গে ডাক্তারবাবু আসছেন। সে জিজ্ঞেস করল, কথা হল?

হ্যাঁ। এই যে তারিণীবাবু, কেমন আছেন? নাড়িটা দেখি?

ভদ্রলোক নিজেই বৃদ্ধের হাত তুলে নিলেন, একটু দুর্বল দেখছি। খুব কথা বলেছেন মনে হচ্ছে। যান, ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়ন। আমি ওষুধ এনেছি, কোনও চিন্তা নেই।

অর্জুন বলল, হাসপাতালে যেতে হবে না, এই তো?

তাই তো বলে এলাম। বিডিও সাহেব খুব বলছিলেন। তাঁকে টেলিফোন করেছে শিলিগুড়ির এক ইনফ্লুয়েনশিয়াল ব্যবসায়ী। উনি যে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী, তাই বিডিও সাহেব জানতেন না। এরকম একটা লোক বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন তা হতে দেওয়া যায় না। মুশকিল হল, আমিও জানতাম না উনি স্বাধীনতা সংগ্রামী। বিডিও সাহেবকে বলে এলাম যদি বুঝি দরকার, সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাব। একটু রিস্ক নিয়ে ফেললাম।

অর্জুন বলল, উনি নিজেও জানেন না যে ওঁকে স্বাধীনতা সংগ্রামী বলা হচ্ছে। যাকগে, আপনি কাল চা খাওয়াবেন বলেছিলেন, আজ আমি যেচে খেতে চাইছি।

সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারবাবু চঞ্চল হলেন, আরে, এ কী কথা! নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। চলুন। এ তো আমার সৌভাগ্য! ওরা তারিণী সেনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।

ডাক্তারবাবুর বাড়ি বেশি দূরে নয়। চেম্বারের সামনে কিছু রুগী বসে আছে। তাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে অর্জুনকে নিয়ে চেম্বারে ঢুকলেন তিনি। বোঝা যাচ্ছে বসার ঘরই চেম্বার। চায়ের হুকুম দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, এবার আমাকে বলুন তো ব্যাপারটা কী? আপনার মতো মানুষ এমন অজ গাঁয়ে বিনা কারণে আসতে পারেন না।

অর্জুন জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। ফাঁকা মাঠ, মাঠের বুকে বড় মন্দিরটা দেখা যাচ্ছে। সে হেসে বলল, গতকাল আমি এসেছিলাম নেহাতই কর্তব্য করতে। ওই ইংরেজ মেয়েটি তারিণী সেনকে দেখতে চেয়েছিল, তাই ওকে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আজ পরিস্থিতি বদলে গেছে।

কীরকম? ডাক্তারবাবু ঝুঁকে বসলেন।

আজ মনে হচ্ছে তারিণী সেনের জীবন বিপন্ন। না, অসুখের জন্যে নয়, ওব্যাপারে আপনি আছেন। বিপন্ন তাঁর অতীতের কিছু কাজের জন্যে।

বিপন্ন কী করে বুঝলেন?

আচ্ছা ডাক্তারবাবু, যে-লোকটার খোঁজ কাল সকাল পর্যন্ত কেউ করত না, সে আজ বেশ ভি আই পি হয়ে গেল কী করে? আপনাকে বিডিও ডেকে পাঠাচ্ছেন ওঁর সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে। এখানকার গ্রামে-গ্রামে এমন অনেক বৃদ্ধ অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন, কই, তাঁদের সম্পর্কে তো খোঁজ নেওয়া হচ্ছে না?

ঠিক। এটা আমাকে অবাক করেছে।

একজন ইংরেজ মহিলা এত দূরে কী কারণে আসবে, যদি না তার স্বার্থ থাকে?।

ঠিকই। কিন্তু এর সঙ্গে জীবন বিপন্ন হওয়ার কারণ কী?

তারিণীবাবু এমন কিছু জানেন, যা জানতে এখন অনেকেই উৎসুক। বিডিও সাহেব স্রেফ অনুরোধে খোঁজখবর নিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে যিনি অনুরোধ করেছেন, তিনি হয়তো উৎসাহী। তারিণী সেনকে এখান থেকে তুলে নিয়ে গেলে চাপ দিলে হয়তো খবরটা পাওয়া যাবে বলে ওদের ধারণা হতে পারে। এখন কথা হচ্ছে, তারিণী সেনকে বাইরের মানুষের চোখের আড়ালে রাখা উচিত। সেটা কীভাবে সম্ভব তা আপনারাই বলতে পারবেন।

ডাক্তারবাবু বললেন, কী সেই গোপন কথা, যা উনি জানেন বলে এসব হচ্ছে?

সেটা উনিই জানেন।

হঠাৎ দূরে মাঠের প্রান্তে ধুলো উড়তে দেখা গেল। একটু ঠাওর করতেই অর্জুন বুঝতে পারল একটা গাড়ি আসছে এদিকে। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আপনাদের গ্রামে প্রায়ই গাড়ি আসে?।

কালেভদ্রে। কেউ-কেউ মন্দির দেখতে আসে।

এবার কালো অ্যাম্বাসাডারটা নজরে এল। অর্জুন একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, ডাক্তারবাবু, আমার মনে হচ্ছে এরা মন্দির দেখতে আসেনি। আপনার এখান থেকে পেছন দিক দিয়ে তারিণী সেনের বাড়িতে যাওয়ার কোনও পথ আছে?

হ্যাঁ আছে। কেন?

ওরা তারিণী সেনের খোঁজে এসেছে। আমি লোকটার জন্যে ভয় পাচ্ছি।

ডাক্তারবাবু উঠে দাঁড়ালেন, আমি দেখছি। ওরা যাতে দেখা না করতে পারে তার ব্যবস্থা করব। ডাক্তারবাবু দুত বেরিয়ে যেতে অর্জুনের খেয়াল হল তার বাইকটা মন্দিরের সামনেই পড়ে আছে। ওরা এমন একটা অজ পাড়াগায়ে বাইক দেখতে পেলে সন্দিগ্ধ হলেও হতে পারে। কালো অ্যাম্বাসাডার মন্দিরের সামনে দাঁড়ালে সেই গ্রাম্য লোকটি এগিয়ে গিয়ে নমস্কার করে মন্দির দেখিয়ে কিছু বলতে লাগল। অর্জুন বুঝল ও ওর কাজ করছে। গাড়ি থেকে নামল দুজন মানুষ। দুজনেই স্বাস্থ্যবান। একজনকে বিদেশি বলেই মনে হচ্ছিল। সে ক্যামেরা বের করে টপাটপ মন্দিরের ছবি তুলতে লাগল। দ্বিতীয়জন লোকটির সঙ্গে কথা বলছিল। এবার ডাক্তারবাবুকে এগিয়ে যেতে দেখল সে। লোকটির সঙ্গে ডাক্তারবাবুর কথা হচ্ছে। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে লোকটি ডাক্তারবাবুকে দিল। ডাক্তারবাবু সেটা পড়ে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না, কারণ তিনি ঘন-ঘন এদিকে তাকাচ্ছিলেন। তারপর গ্রাম্য লোকটিকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে ডাক্তারবাবু কিছু বলতেই সে ছুটে এদিকে আসতে লাগল। অর্জুন বুঝল ভদ্রলোক তার সঙ্গে পরামর্শ করতে চান, কিন্তু যে-কোনও বুদ্ধিমান মানুষ এই চালাকি ধরে ফেলবে। অথচ এখন কিছু করার নেই। লোকটি ঘরের দরজায় এসে বলল, ওরা শিলিগুড়ি থেকে এসেছে। কেউ যেন তারিণী জ্যাঠার চিকিৎসার জন্যে এক হাজার টাকা পাঠিয়েছে। টাকাটা জ্যাঠার হাতে না দিতে পারলে ফেরত নিয়ে যাবে। ডাক্তারবাবু জিজ্ঞেস করছেন কী করবেন?

অর্জুন বলল, ডাক্তারবাবুকে বলল ওদের সঙ্গ না ছাড়তে আর কথা বলতে দিতে।

লোকটি আবার দৌড়ে চলে গেল। ওকে দেখে ডাক্তারবাবু এগিয়ে এসে মাথা নামিয়ে বক্তব্য শুনে ওদের ইশারা করলেন অনুসরণ করতে। একটু পরেই ওরা চোখের আড়ালে চলে গেল।

 

তারিণী সেনের কাছে একটি মূর্তি ছিল। কালো পাথরের মূর্তি, যা লোকটা তিব্বতি লামাদের ওপর ডাকাতি করে পেয়েছিল। ওই মূর্তি তারিণী সেন বিক্রি করতে পারেনি, কারণ সে-সময় ওই অঞ্চলে কোনও হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি ছাড়া অন্য মুর্তির চাহিদা ছিল না। অথচ বোঝা যাচ্ছে ওই মূর্তি যথেষ্ট মূল্যবান। মূল্যবান বলেই রিচার্ড ম্যাকডোনাল্ড ওটাকে পেতে চেয়েছিলেন। তারিণীকে হাতে রেখে ওটার হদিস পাওয়ার চেষ্টাও করেছেন। দেশে ফিরে গিয়ে নিজের ডায়েরিতে ওই মূর্তির কথা লিখে রেখে গেছেন, যা ডরোথি পড়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, ওই মূর্তির লোভেই সে গতবার দিল্লিতে এসে কয়েক জনের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আর নেহাতই কাকতালীয়ভাবে অমল সোমের কাছে পৌঁছে গিয়ে তার নামে চিঠি লিখিয়ে নেয়। ডরোথি হয়তো এখনও জানে না তার পেশা কী। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে ক্ষমা চাইতে আসার গল্প নেহাতই একটা আড়াল মাত্র। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে ও এবং ওর দলের লোকজন বেশ সক্রিয়। ইতিমধ্যে শিলিগুড়ি থেকে বিডিওকে ফোন করাবার মতো লোককে ওরা পেয়ে গেছে। এই যে হাজার টাকা দিতে আসা, এটাও একটা চাল। তারিণী সেনকে সচক্ষে দেখে নিতে চায় ওরা, যাতে লোকটাকে এখান থেকে তুলে নিয়ে যেতে অসুবিধে না হয়।

এখন কী করা যায়? মুর্তিটা কোথায় আছে, তা তারিণী সেন ছাড়া আর কেউ বলতে পারবে না। টাকার লোভে লোকটা কি বলে দেবে? অবশ্য টাকার লোভ থাকলে এত বছর প্রচণ্ড অভাবে থেকেও তারিণী সেন মূর্তিটার কথা কাউকে বলেনি। কেন?

কিছুক্ষণ পরে ওদের আবার দেখতে পেল অর্জুন। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ওরা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল গ্রাম থেকে ধুলো উড়িয়ে।

অর্জুন বেরিয়ে এল। মন্দিরের দিকে কয়েক পা হাঁটতেই ডাক্তারবাবু এবং লোকটির মুখোমুখি হল। ডাক্তারবাবু বললেন, ওরা চিকিৎসার জন্যে এক হাজার টাকা দিয়ে গেল।

অর্জুন বলল, ভালই তো! তারিণীবাবুর উপকার হবে।

লোকটি বলল, অত টাকা আমি জীবনে একসঙ্গে ধরিনি। তারিণী জ্যাঠার কপাল বটে! টাকা দেখে বুড়ো কিন্তু একুটও হইচই করল না। জেঠিকে দিয়ে দিল। ওরা ফোটো তুলল। দু-চারটে কথা বলল, কিন্তু জ্যাঠা কোনও জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। কী মানুষ রে বাবা।

ডাক্তারবাবু এসব কথায় কান দিচ্ছিলেন না। সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, কী করা যায়?

লক্ষ রাখবেন। এই আর কি। ওরা কি শহরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল?

না। সেসব কিছু বলেনি।

আমি তো আবার বিকেলে আসছি মেমসাহেবের সঙ্গে। সে রকমই কথা হয়ে আছে। অর্জুন সোজা বাইকে গিয়ে বসল। সে যখন নিজেই কিছু বুঝতে পারছে না তখন ডাক্তারবাবুকে কী বলবে! অনেকটা দূরে এসে মুখ ফিরিয়ে সে দেখল মন্দিরটাকে দেখা যাচ্ছে। পাশের ছোট লাল মন্দিরটাও এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে। রাজারাজড়াদের তৈরি করা এইসব মন্দির দেখতে এখনও কেউ-কেউ আসেন। কিছু কিছু মূর্তি পশ্চিমবঙ্গ সরকার পুরাতত্ত্ব সংগ্রহশালায় নিয়ে গিয়েছেন। মন্দির দেখাবার সময় গতকাল লোকটি বলেছিল কুবের মূর্তি এবং বিষ্ণুপট্ট এখন সরকারের হেফাজতে। এখন তারিণী সেনের লুকিয়ে রাখা মূর্তি যদি পাওয়া যায় তা হলে তার স্থান হওয়া উচিত পুরাতত্ত্ব সংগ্রহশালা।

আবার চলতে শুরু করল অর্জুন। একটানা অনেক কথা বলে গেলেন তারিণী সেন। অত বছর আগের কথা ঠিকঠাক একজন অসুস্থ বৃদ্ধ বলবেন, এমন আশা করা ঠিক নয়। কিন্তু ওঁর হাতের পাঞ্জা ম্যাকহেব কেটে ফেলেছিলেন, এটা অবশ্যই নতুন তথ্য। দৃশ্যটি অবশ্যই ভয়ঙ্কর। নাৎসিদের অত্যাচার তো অমনই ছিল। সেই একই অত্যাচার করেছেন ডরোথির দাদু। সেটা কমলাকান্ত রায়কে সাহায্য করার জন্য না মূর্তি বের করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে, তা এখন আর জানা যাবে না। হয়তো মাথাগরম করেই, হাল ছেড়ে দিয়েই কাজটা করেছিলেন ম্যাকসাহেব। কিন্তু তাঁর যে আক্ষেপ থেকে গিয়েছিল, তা বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা ডায়েরিতে লিখে রাখায়। আর এতদিন পরে তাঁর নাতনি এসেছে ওই একই বস্তুর সন্ধানে।

ময়নাগুড়ির বাইপাসে এসে অর্জুন একবার ভাবল বিডিও সাহেবের সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটা জানিয়ে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে জলপাইগুড়িতে চলে এল। এখন ভর দুপুর। সোজা থানায় এসে দেখল অবনীবাবু দুটো লোককে প্রশ্ন করে চলেছেন। এরা চোরাশিকারি। জঙ্গলে ঢুকে অবৈধভাবে জন্তু-জানোয়ার মারে। অর্জুনকে দেখে ওদের সরিয়ে নিয়ে যেতে বলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর?

পুলিশের সবাইকে মন খুলে সব কথা বলা যায় না। কিন্তু অবনীবাবু অন্য রকমের মানুষ, অনেক বার তার প্রমাণ পেয়েছে অর্জুন। অতএব আজ সকাল থেকে যা-যা ঘটেছিল সব সে বলে গেল।

শোনা শেষ হলেই অবনীবাবুকে উত্তেজিত দেখাল, এর পরেও বৃদ্ধ লোকটাকে ওখানে ছেড়ে এলেন? না, না। এটা ঠিক কাজ হয়নি।

এখন কিছু করার নেই। আমার মনে হয় ডরোথি যাওয়ার আগে কিছু করবে না ওরা।

মেমসাহেবকে নিয়ে আবার তা হলে যাচ্ছেন?

অবশ্যই।

অবনীবাবু একটু চিন্তা করলেন। তারপর উঠে গেলেন একটা আলমারির কাছে। এই বই সেই খাতা খুলে দেখতে লাগলেন কিছু। অর্জুন লক্ষ করছিল ভদ্রলোককে। মিনিট পাঁচেক পরে ফিরে এসে অবনীবাবু বললেন, নাঃ। হাতের কাছে নেই। ওপরে হয়তো পাব। পুরনো ইতিহাস ঘাঁটতে-ঘাঁটতে একবার যেন পড়েছিলাম তিব্বতি লামাদের আনা একটা মূর্তি ডাকাতির পর আর পাওয়া যায়নি খুঁজে। সেই সময় ব্রিটিশরা দাম দিয়েছিল হাজার পাউন্ড। এখনকার টাকায় প্রায় পঞ্চাশ হাজার। পঞ্চাশ বছরে ওর দাম গিয়ে দাঁড়াবে এক কোটিতে। আপনার তারিণী সেন সেই মূর্তিটি কজা করে ভিখিরির মতো বাস করবেন, এমন মনে হয় না।

মূর্তিটা থেকে অত টাকা পাওয়া যাবে এমন আন্দাজ বৃদ্ধ মানুষটার নেই।

কিন্তু এটা যে মূল্যবান, তা নিশ্চয়ই জানত, নইলে পুঁতে রাখবে কেন?

ম্যাকসাহেব চাইছেন, দিয়ে দিলেই প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে, নিজেকে দামি করতে তারিণী সেন মূর্তি হাতছাড়া করতে চাননি। হঠাৎ তারিণী সেনের বলা ছড়া মনে পড়ে গেল অর্জুনের। সে টেবিল থেকে একটা কাগজ নিয়ে ঠিকঠাক লেখার চেষ্টা করল।

অবনীবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী লিখলেন?

অর্জুন কাগজটা এগিয়ে দিল। অবনীবাবু পড়লেন, কালোর সঙ্গে লাল আর লালের মধ্যে কালো, ভক্তিভরে তারে নমো করাই ভালো। এর মানে কী?

আমি জানি না। মূর্তিটা কোথায় পুঁতেছেন জানতে চাইলে, বললেন ভুলে গিয়েছি। তার আগে ওই কথাগুলো সুরে বললেন।

বেশ হেঁয়ালি মনে হচ্ছে। কোনও মানে পেয়েছেন?

এখনও না।

দুর মশাই। এটা তো সিম্পল। কালোর সঙ্গে লাল। তারিণী সেনের গায়ের রঙ নিশ্চয়ই কালো আর ম্যাক সাহেবের অবশ্যই লাল। তাই কালোর সঙ্গে লাল। ম্যাকসাহেব তারিণীর সঙ্গে আছেন। আর লালের মধ্যে কালো। তারিণী ম্যাকের মধ্যে আটকে গেছে। এক্ষেত্রে সাহেবকে শ্রদ্ধা করলে প্রাণ বাঁচবে। এই তো।

অর্জুন হেসে ফেলল, এর সঙ্গে মূর্তির কী সম্পর্ক?

অবনীবাবু গম্ভীর হলেন, । তা অবশ্য। তবে লাল কালো মানে ইংরেজ এবং আমরা।

আমার তো মনে হয় না। তারিণী সেন একজন রাজবংশী। ওঁর গায়ের রং এই বয়সেও বেশ ফরসা। কালো কখনই বলা যাবে না।

আহা, ইংরেজদের তুলনায় তো কালো?

আমি উঠলাম। অর্জুন উঠে পড়ল।

আপনি কি ফিরে এসে থানায় ঢ়ুঁ মারবেন?

বলতে পারছি না। আপনি কি ময়নাগুড়ি থানায় আমার কথা বলে রাখবেন? ইন কেস অফ এনি হেল্প। আজ রাত্রে প্রকার হলেও হতে পারে।

নিশ্চয়ই। তা ছাড়া ওখানকার ও সি আপনাকে বিলক্ষণ চেনেন। আমার জুরিসডিকশন নয়, তবু মনে হচ্ছে যেতে পারলে ভাল লাগত।

আসুন না! অর্জুন বেরিয়ে এল।

 

স্নান-খাওয়া সেরে অর্জুন প্রথমে সুধীর মৈত্রের বাড়িতে গেল। ভদ্রলোক তাঁর পড়ার ঘরেই ছিলেন। চশমা তুলে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপার কী?

অসময়ে এলাম!

আমার কাছে সবসময়ই ঠিক সময়। শুধু রাতদুপুর ছাড়া।

কেউ আর বিরক্ত করেনি তো?

না।

আচ্ছা, জলপাইগুড়ির পুরনো দিনের মূর্তি নিয়ে আপনি নিশ্চয়ই কিছু জানেন।

না। আমি আলাদা করে কিছু জানি না। বইয়ের পাতায়-পাতায় যা লেখা আছে, তাই জেনে নিই। অন্য লোকে পড়ে না তেমন করে, তাই জানে না। কী বক্তব্য?

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগে একটি তিব্বতি দল তিস্তার ধারেকাছে ডাকাতদের হাতে পড়ে। ওদের সঙ্গে একটি মূল্যবান মূর্তি ছিল। মূর্তিটি আর পাওয়া যায়। এব্যাপারে কিছু জানা থাকলে বলুন। অর্জুন সরাসরি জানতে চাইল। অবলোকিতেশ্বর বৌদ্ধমূর্তি?

আমি জানি না। হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি নয়।

আশ্চর্য! এর সঙ্গে জলপাইগুড়ির পুরাকীর্তির কী সম্পর্ক? ঠিকঠাক প্রশ্ন করতে পারো না কেন? হ্যাঁ। এই সেদিন সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ সালে, ওরকম একটা ডাকাতির পর হইচই হয়েছিল খুব। মূর্তিটা নাকি খুব দামি। কত দামি, তা কেউ বলতে পারেনি। ইংরেজরা বলেছিল, কয়েক হাজার পাউন্ড। যে জিনিস চোখে দেখিনি বা কোনও বিশেষজ্ঞ দ্যাখেননি তার দাম অনায়াসে বাড়িয়ে দেওয়া যায়। এরকম বুনো হাঁসের পেছনে ছুটতে আমি রাজি নই। ওরা তো মিথ্যে কথাও বলতে পারে।