মিটিয়া নামে কমান্ডের ডাক্তার মেয়েটি য়ুহার ওপর ঝুঁকে পড়ে তার কপালের পাশে একটা প্রোব লাগাচ্ছিল। মেয়েটি বেশ হাসিখুশি, দুক্ষ হাতে কাজ করতে করতে সে গুনগুন করে একটা ভালোবাসার গান গাইছে। প্রিয় মানুষটি মহাকাশে হারিয়ে গেছে, ভালোবাসার মেয়েটি জানালা দিয়ে দূর আকাশের একটি নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, এটি কি তার প্রিয় মানুষের মহাকাশযান-গানের কথাগুলো এ রকম।
য়ুহা বলল, তুমি খুব সুন্দর গাইতে পার।
মিটিয়া হেসে বলল, তার অর্থ তুমি কখনো গান বা সঙ্গীত শোনো না! সে জন্যে বলছ আমি সুন্দর গাইতে পারি।
য়ুহা বলল, শুনি। সে জন্যেই বলছি। তোমার গলা খুব সুন্দর।
ধন্যবাদ।
কমান্ডের এই কঠিন কাজ করতে করতে তুমি গান গাইবার সময় পাও?।
পাই না। তাই কাজ করার সময় গুনগুন করি।
তুমি এখন কী করছ মিটিয়া।
মিটিয়া মাথা নেড়ে বলল, বিশেষ কিছুই না। তুমি যেহেতু প্রথমবার যাচ্ছ তাই তোমাকে নিয়ে আমরা একটু বেশি সতর্ক থাকছি, আর কিছু না।
আমাকে নিয়ে তোমাদের ব্যস্ত হতে হবে না। প্রশিক্ষণের সময় আমাকে খুব ভালোভাবে প্রস্তুত করে দিয়েছে।
প্রশিক্ষণ ক্যাম্প আর আসল মহাকাশযানে অনেক পার্থক্য। প্রশিক্ষণ ক্যাম্প সবকিছু হয় নিয়মমাফিক। রুটিনমাফিক। সত্যিকারের মহাকাশযানে বিচিত্র বিচিত্র ঘটনা ঘটে। প্রত্যেকটা অভিযান হচ্ছে নতুন, প্রত্যেকটা অভিযান হচ্ছে বিচিত্র! এখন পর্যন্ত একটা অভিযানে আমি যাইনি যেখানে নতুন একটা কিছু ঘটেনি।
য়ুহা মাথা ঘুরিয়ে মিটিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কী মনে হয়? এই অভিযানেও কী নতুন কিছু ঘটবে?
ঘটতেই পারে?
কী ঘটতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
মিটিয়া খিল খিল করে হেসে বলল, সেটা আমি আগে থেকে কেমন করে বলব? তুমি যেহেতু নতুন মানুষ তুমি কিছু একটা কর।
য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, সেটা তুমি খারাপ বলনি! আমারই কিছু একটা করা দরকার।
মিটিয়া বড় বড় দুটি বেল্ট হাতে নিয়ে বলল, এখন তুমি কয়েক মিনিট চুপ করে বস, তোমাকে এই সিটের সাথে এখন শক্ত করে বেঁধে ফেলতে হবে!।
য়ুহা নিঃশব্দে বসে রইল, মিটিয়া তার দক্ষ হাতে তাকে আরামদায়ক চেয়ারটায় আটকে ফেলে বলল, চমৎকার! এখন তুমি ইচ্ছে করলেও কোনো বিপদ ঘটাতে পারবে না।
য়ুহা বলল, আমার বিপদ ঘটানোর কোনো ইচ্ছে নেই!
শুনে খুশি হলাম। মিটিয়া য়ুহার হাত ধরে বলল, তোমার শরীরের সকল কাজকর্ম এখন কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করছে। তোমার কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। তার পরেও যদি মনে করো তোমার কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে তাহলে এই লাল লিভারটা টেনে ধরো।
ঠিক আছে।
তুমি এখন চুপচাপ শুয়ে থাক। কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা রওনা দেব।
চমৎকার। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মিটিয়া।
ধন্যবাদ য়ুহা।
মিটিয়া চলে যাবার পর য়ুহা আরামদায়ক চেয়ারটাতে সমস্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় অপেক্ষা করতে থাকে। তার এখনো বিশ্বাস হয় না যে সে সত্যি সত্যি একটি মহাকাশ অভিযানে যাচ্ছে। পদার্থ প্রতি পদার্থের বিক্রিয়ায় যে প্রচণ্ড শক্তির সৃষ্টি হবে সেই শক্তিতে এই মহাকাশ্যানটি তীব্র গতিতে ছুটে যাবে। সেই গতির কারণে সময় স্থির হয়ে যেতে চাইবে–সেই মুহূর্তগুলো কি সে অনুভব করতে পারবে? য়ুহা এক ধরনের উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
ক্যাপ্টেন ক্ৰবের গলায় একটা ঘোষণা শুনতে পেল য়ুহা, শান্ত গলায় বলছে, মহাকাশযানের সবাইকে যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হতে বলছি। আমি ইঞ্জিন দুটো শুরু করছি এখন।
য়ুহা একটা চাপা গুমগুম শব্দ শুনতে পেল। হঠাৎ করে মহাকাশযানটি থরথর করে কাঁপতে থাকে। কিছু একটা হঠাৎ ঘটে গেল, য়ুহার মনে হতে থাকে অদৃশ্য কোনো একটা শক্তি তাকে যেন তার চেয়ারে প্রচণ্ড শক্তিতে চেপে ধরেছে! য়ুহা প্রাণপণে নিজেকে সেখান থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে চায়, সে বড় বড় মুখ করে নিঃশ্বাস নেয়, ৩ মনে হয় সে বুঝি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।
মহাকাশযানের মাঝে একটা লাল আলো কিছুক্ষণ পর পর ঝলকানি দিতে থাকে। একটা চাপা যান্ত্রিক শব্দ ভেসে আসে। পুরো মহাকাশযানটি থরথর করে এমনভাবে কাঁপতে থাকে যে য়ুহার মনে হতে থাকে পুরো মহাকাশযানটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। যতই সময় যেতে থাকে য়ুহার মনে হয় অদৃশ্য শক্তিটা বুঝি তাকে আরো জোরে চেপে ধরছে। তার মনে হতে থাকে সে বুঝি তার চোখের পর্দাটাও আর খুলতে পারবে না। মাথায় এক ধরনের ভোতা যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকে, চোখের ওপর একটা লাল পর্দা খেলা করতে থাকে। মুখের ভেতরটা শুকিয়ে গেছে, সে প্রবল এক ধরনের তৃষ্ণা অনুভব করে। য়ুহার মনে হতে থাকে সে বুঝি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে, কিন্তু যে কোনো মূল্যে সে জেগে থাকতে চায়। য়ুহা প্রচণ্ড গতির সেই বিস্ময়কর শুরুটুকু নিজের চোখে দেখতে চায়, নিজের ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে চায়। প্রাণপণে সে চোখ খোলা রেখে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকে। সে বিড়বিড় করে নিজেকে বলল, আমি অচেতন হব না। কিছুতেই অচেতন হব না। কিছুতেই হব না?
য়ুহা দাঁতে দাঁত কামড় দিয়ে শক্ত হয়ে বসে থাকে। সে অনুভব করতে থাকে তার শরীরের মাংসপেশিতে ভোতা এক ধরনের যন্ত্রণা। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, মনে হচ্ছে কেউ যেন টেনে তার মুখের মাংসপেশি পেছন দিকে সরিয়ে নিয়েছে, মুখ থেকে দাঁতগুলো বের হয়ে আসছে, চেষ্টা করেও সে সেটা বন্ধ করতে পারছে না। এটি একটি অভূতপূর্ব অনুভূতি। য়ুহা নিজেকে বোঝাল, পৃথিবীর খুব বেশি মানুষের এই অনুভূতিটি অনুভব করার সৌভাগ্য হয়নি। আমি নিঃসন্দেহে একজন সৌভাগ্যবান মানুষ। অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মানুষ।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি য়ুহা এক সময় এই ভয়ঙ্কর পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেল। সে অনেক কষ্ট করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। কোনো একটা বিচিত্র কারণে সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছিল না, মাথার ভেতরে কিছু একটা দপদপ করছে, সে তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে অপেক্ষা করছে কখন এটি শেষ হবে। বুকের ওপর চেপে বসে থাকা অদৃশ্য পাথরটি সরে যাবে, আবার সে উঠে বসতে পারবে।
য়ুহার কাছে যখন মনে হয় বুঝি অনন্তকাল কেটে গেছে তখন হঠাৎ করে মহাকাশযানের ত্বরণ কমে আসতে শুরু করে। য়ুহার হঠাৎ করে মনে হতে থাকে তার সারা শরীর বুঝি পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে আসছে। যখন মিটিয়া এসে তার বেল্টটি চাপ দিয়ে খুলে তাকে বের করে আনল, তখন য়ুহা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, অনেক ধন্যবাদ মিটিয়া, আমার মনে হচ্ছিল, আমি বুঝি আর কখনো এই অদৃশ্য দানবের হাত থেকে মুক্তি পাব না!
মিটিয়া য়ুহার দিকে তাকিয়ে বলল, প্রথমবার হিসেবে তুমি চিৎকার করেছ য়ুহা। তোমাকে নিয়ে আমাদের রীতিমত গর্ব হচ্ছে।
ধন্যবাদ মিটিয়া।
এরপরের ধাপে তুমি নিশ্চয়ই আরো ভালো করবে!
পরের ধাপ?
হ্যাঁ। এর পরের ধাপ!
য়ুহা ভুরু কুঁচকে বলল, এর পরের ধাপ মানে কী?
মহাকাশযানটি ক্রমাগত তার গতিবেগ বাড়িয়ে চলে। একবারে তো করা যায় না, তাই এটাকে ধাপে ধাপে করতে হয়। প্রত্যেকবারই তার গতিবেগ আগের থেকে বাড়িয়ে তোলা হয়। মাঝে মাঝে আমরা বিরতি দিই, তখন দৈনন্দিন কাজগুলো সেরে নিতে হয়। খাওয়া-দাওয়া করি।
য়ুহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, আবার মহাকাশযানের গতি বাড়ানো হবে? আবার আমাকে মহাকাশযানের চেয়ারে বেল্ট দিয়ে বেঁধে বসতে হবে?
হ্যাঁ। মিটিয়া মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, একবার নয়, অনেকবার।
অনেকবার?
হ্যাঁ। প্রত্যেকবারই আগেরবার থেকে বেশি তীব্রতায় এবং বেশি সময় ধরে।
য়ুহা ফ্যাকাসে মুখে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি। তবে ভয় নেই-তুমি দেখবে ধীরে ধীরে পুরো ব্যাপারটায় তুমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছ!
তার মানে আমার আর কষ্ট হবে না?
মিটিয়া য়ুহার হাত স্পর্শ করে বলল, আমি সেটা বলিনি। কষ্ট যেটুকু হবার সেটা তো হবেই।
তাহলে?
কষ্ট সহ্য করা শিখে যাবে।
ঘণ্টা দুয়েক পর য়ুহা আবার আবিষ্কার করল, তাকে মহাকাশযানের আরামদায়ক চেয়ারটিতে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হয়েছে। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে। বিশাল মহাকাশযানটি আবার ঝটকা দিয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। মহাকাশযানের ভেতর একটা লাল আলোর ঝলকানি দেখা যায়, য়ুহার মনে হতে থাকে তার বুকের ওপর একটা অদৃশ্য পাথর ধীরে ধীরে চেপে বসেছে। হব না। আমি অচেতন হব না। য়ুহা বিড়বিড় করে বলল, আমি কিছুতেই অচেতন হব না।
য়ুহা তার সমস্ত স্নায়ুকে শক্ত করে পাথরের মতো বসে থাকে। মনে হতে থাকে বুঝি অনন্তকাল কেটে যাচ্ছে।