০৫. ঠিক পৌনে পাঁচটার সময়

ঠিক পৌনে পাঁচটার সময় অর্জুন চার্লসের সঙ্গে যেখানে গিয়ে দাঁড়াল সেই জায়গাটাকে সবুজ উপত্যকা বলা যেতে পারে। একটা ব্যাপারে অর্জুনের কিছুটা উদ্বেগ ছিল। খবর দেওয়া সত্ত্বেও পুলিশ এখনও গ্রামে আসেনি। পুলিশ না এলে বৃদ্ধের পারলৌকিক কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। একটু আগে ডেরেক তার গাড়ি নিয়ে রওনা হয়েছে থানার উদ্দেশে।

চার্লস গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, থানায় যাওয়ার পথটা কোনদিকে? ডেরেক তো থানা থেকে ফিরবে।

ওই পথ ও-পাশ দিয়ে গিয়েছে। এদিক দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ। কিন্তু আমার খুব ভয় করছে, যদি ধরা পড়ে যাই?

লিস্ট দেখে ওরা কিছু বুঝতেই পারবে না। এই গ্রামের শিশুদের খবর আপনার চেয়ে ওদের ভাল জানার কথা নয়।

অর্জুন চারপাশে তাকিয়ে একটা ঘন ঝোপের কাছে চলে এল। ঝোপটার ভেতর ঢুকে গেলে বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারবে না। সে বলল, আপনি একটু ওপাশে অপেক্ষা করুন। আমি এই ঝোপের মধ্যে রয়েছি।

চার্লস মাথা নেড়ে এগিয়ে যেতেই অর্জুন মত পালটাল। দ্রুত সরে গিয়ে দুটো বড় পাথরের খাঁজে শরীরটাকে ঢুকিয়ে দিল সে। এখানে যদিও তাকে আড়ষ্টভাবে পড়ে থাকতে হবে তবু কোনও ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। চার্লস যে এখনও তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই।

দশ সেকেন্ডকে দশ মিনিটের মতো মনে হচ্ছিল অর্জুনের। সামনের উপত্যকায় এখন একটু-একটু কুয়াশা জমছে। দিনের আলো কমতে শুরু করলেও অন্তত পঁয়তাল্লিশ মিনিটের আগে অন্ধকার নামবে না। সূর্যদেব এখানে চোখের আড়ালে চলে গেলেও কিছুটা নরম আলো অনেকক্ষণ রেখে যান।

আজ চার্লসের সঙ্গে কথা বলার পর থেকে অর্জুন ভেবেছে। তিব্বতি বৌদ্ধরা তাদের গুরুর সন্ধানে পৃথিবী চষে ফেলে বলে সে শুনেছে। কিছুদিন আগে একটি আমেরিকান শিশুর মধ্যে সেইসব লক্ষণ দেখে তারা মনেস্টারিতে নিয়ে এসেছে তাকে। বৌদ্ধধর্মের আচার-অনুষ্ঠান রপ্ত করাচ্ছে ভক্তিভরে। শিশুটির হাবভাব দেখে কখনওই মনে হচ্ছে না সে জন্মসূত্রে বৌদ্ধ ছিল না। অত্যন্ত প্রাজ্ঞ ধর্মগুরুর মতোই সে আচরণ করছে। এ থেকে প্রমাণ করা যেতে পারে তিব্বতিদের সন্ধান এবং নির্বাচন ভ্রান্ত নয়। কিন্তু মধ্য এশিয়ার কোনও সম্প্রদায়ের মানুষ হিমালয়ের পাহাড়ে তাদের সদ্য জন্মানো ধর্মগুরুর সন্ধানে আসবে, এটা কল্পনা করা খুবই কষ্টকর। গনৎকারের নির্দেশমতো ওরা যেভাবে সন্ধান চালিয়েছে তা অবশ্যই ব্যয়বহুল। এই ধনী লোকগুলোর সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা ডেরেকদের নেই। অমল সোম রবিবারে আসবেন। তার আগে যেন কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে।

এখন কেবলই তার চোখে সেই শিশুটির মুখ ভেসে উঠছিল। ওরা যে শিশু চাইছে তার বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। বাচ্চাটাকে দেখলেই বোঝা যায় সে ওই বয়সের শিশুদের চেয়ে অনেক বেশি বোঝে, অনেক গম্ভীর এবং মুখে একটা চাপা কৌতুকের প্রকাশ আছে। ওই লোকগুলো কি ওরই উদ্দেশ্যে এসেছে?

হঠাৎ অর্জুনের কানে গুম-গুম শব্দ ভেসে এল। ঠিক গত রাতের শব্দের মতো। সে দ্রুত ঘড়িটা বের করে মুঠোয় ধরল। পাথরের আড়ালে থাকায় শরীর নাড়ানো যাচ্ছে না বটে, তবে আক্রান্ত হলে আঙুলের চাপে ঘড়িটির শক্তি প্রয়োগ করতে তৈরি হয়ে রইল। শব্দটা এগিয়ে আসছে।

একটু পরেই আকাশে একটা কালো বিন্দুকে বড় হতে দেখল অর্জুন। বিন্দুটা ক্রমশ ডানা মেলল। শেষপর্যন্ত বোঝা গেল ওর ধরন অনেকটা গ্লাইডারের মতো কিন্তু তাতে এঞ্জিন বসানো আছে। স্বচ্ছন্দে চল্লিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটার উঠে যেতে পারে। গত রাত্রে এই ধরনের বেশ কয়েকটা গ্লাইডার উলটোদিকের পাহাড়ের ওপরে নেমেছিল। অর্থাৎ চার্লসের সঙ্গে কথা বলতে যারা আসছে তারাই পাহাড়ের জঙ্গলে আগুন জ্বালায়। কেন জ্বালায়?

গ্লাইডারে মাটিতে নামলে কিছুক্ষণ দৌড়তে হয়। কিন্তু যন্ত্র চলছে বলে ওটা স্থির হয়ে রইল এক জায়গায়, তারপর প্রায় হেলিকপ্টারের মতো ধীরে ধীরে মাটিতে নামল। অর্জুন দেখতে পাচ্ছিল। চার্লস যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখান থেকে একটুও নড়েনি। একটা লোক, সবুজ রঙের সালোয়ার কুর্তা পরনে, গ্লাইডার থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে এল। লোকটার কাঁধ থেকে একটা অস্ত্র ঝুলছে।

চার্লস নড়ছে না দেখে ভাল লাগল অর্জুনের। সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে চার্লসের দূরত্ব খুব বেশি নয়, কিন্তু নিচুগলায় কথা বললে সে কিছুতেই শুনতে পারবেনা। এই লোকটা এসেছে দোভাষী সঙ্গে নিয়ে। তা হলে চার্লসের সঙ্গে কীভাবে কথা বলবে ও?

লোকটা চার্লসের সামনে পৌঁছে হাত বাড়াল।

চার্লস তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সেই হাতে তুলে দিল। লোকটা কাগজে চোখ রাখল। অর্জুন দেখল দু-দুবার লোকটা কাগজে চোখ বোলাল। তারপর ওর চোখ-মুখে ক্রোধ ফুটে উঠল। কুটিকুটি করে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে চার্লসকে যা বলল, তা অর্জুনের কানে গেলেও সে বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারল না।

চার্লস হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। বোকার মতো হাত কচলাচ্ছে। লোকটা ওর জামার কলার ধরে ঝাঁকিয়ে অনর্গল কিছু বলে যাচ্ছিল। তারপর এক ঝাঁকুনি দিতে চার্লস ছিটকে খানিকটা দূরে পড়ে গেল। চার্লসের মতো স্বাস্থ্যবান মানুষকে যে ওভাবে ফেলে দিতে পারে, তাকে সমীহ না করে উপায় নেই।

লোকটা যেরকম ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছে তাতে চার্লসকে মেরেও ফেলতে পারে বলে মনে হল অর্জুনের। কিন্তু লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। কুর্তার পকেট থেকে কিছু একটা বের করে কানে চাপল। ওটা কি সেলুলার ফোন? মন দিয়ে শুনে ওর ঠোঁট নড়ল। তারপর এগিয়ে গিয়ে চার্লসের হাতে যন্ত্রটা তুলে দিয়ে ইশারা করল শুনতে।

অর্জুন দেখল চার্লস যন্ত্রটা কানে লাগিয়ে কিছু কথা শুনে জবাব দিল। দু-তিনবার ওইরকম হওয়ার পর যন্ত্রটা ফেরত নিয়ে লোকটা ফিরে গেল গ্লাইডারের কাছে। তারপরেই গুম-গুম শব্দ শুরু হল। প্রায় হেলিকপ্টারের মতো ঘুরে গিয়ে গ্লাইডারটা আবার আকাশে উঠে মিলিয়ে গেল।

এতক্ষণে অর্জুন নিঃসন্দেহ হল চার্লস তার কথা রেখেছে। লোকটা যে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, তা বোঝাই যাচ্ছে। নিজেকে টেনে-হিচড়ে বের করে আনতেই সে চার্লসের চোখে পড়ে গেল।

অর্জুন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, মনে হল ওই ঝোপের চেয়ে এই পাথরের খাঁজে লুকোনো ভাল। যাকগে, কার সঙ্গে কথা বললে?

দোভাষীর সঙ্গে। সে বলল, ওই শিশুদের মধ্যে গম্ভীর প্রকৃতির কেউ আছে। তাকে ওদের চাই। যদি আমি সাহায্য না করি তা হলে মিস্টার মুরহেডের সঙ্গে আমাকেও কফিনে যেতে হবে। বেশ ভয় পাওয়া গলায় বলল চার্লস।

কী সাহায্য চাইল ওরা?

চার্লস বলল, একটি গম্ভীর প্রকৃতির অথচ সুন্দর দেখতে শিশু নাকি আমাদের গ্রামে রয়েছে। তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।

তারপর?

রবিবারে ওরা গ্রামে আসবে। কিন্তু ওই লোকটা ঠিক সেই সময় আমার জন্যে এখানে অপেক্ষা করবে। বাচ্চাটাকে সকলের চোখ এড়িয়ে এনে ওর হাতে তুলে দিলেই আমাকে টাকাটা দিয়ে দেবে। আমি এখন কী করব?

আপনি কী বলেছেন?

আমাকে তো আচ্ছা বলতেই হল।

চলুন। ফিরে যাই।

ফেরার পথে ওরা কথা বলছিল না। যারা বাচ্চাটাকে নিতে এখানে এসেছে তারা যে ভারতীয় নয়, তা স্পষ্ট। কিন্তু লোকগুলো নিশ্চয়ই এখান থেকে খুব বেশি দূরে ঘাঁটি গাড়েনি। হয়তো সেটা ভারতীয় এলাকা নয়। ভুটান এবং নেপাল সীমান্ত এখান থেকে মাইল কুড়ির মধ্যে। সেসব দেশের যে-কোনও পাহাড়ি জঙ্গুলে জায়গায় ওরা স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে। এই যে যন্ত্রচালিত গ্লাইডারে ওরা উড়ে আসছে তা লোকালয় থেকে সম্ভব নয়।

এগারোজনের দশজনকে এখন বাড়ি চলে যেতে বললে পারত অর্জুন। কিন্তু তাতে ওই বিশেষ শিশুটির মা-বাবা বেশি নার্ভাস হয়ে যাবেন। তার কর্তব্য বাচ্চাটাকে রবিবার পর্যন্ত রক্ষা করা। অর্জুনের হঠাৎ মনে হল, ওই বাচ্চার মা বাবা যদি শোনেন, তাঁদের সন্তান একটি ধনী এবং শক্তিশালী সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু হবে তা হলে কি আনন্দিত হয়ে ওদের হাতে তুলে দেবেন? যদি দিতে চান তা হলে তো কোনও সমস্যাই থাকবে না। কিন্তু একথা ওঁদের জিজ্ঞেস করবে কী করে?

গ্রামে ঢোকার সময় চার্লস জিজ্ঞেস করল, আমি কাল কী করব?

ভেবে দেখছি।

আপনি বলেছিলেন জঙ্গলে যাবেন?

হ্যাঁ। আজ রাত্রে। এই ধরুন আটটা নাগাদ। আপনি ভিলেজ সেন্টারে চলে আসবেন। অর্জুন বৃদ্ধ ফোটোগ্রাফারের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল একা।

সেখানে তখন বেশ ভিড়। পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে আছে। দুজন সেপাইকে নিয়ে একজন সাব-ইনস্পেক্টর ডেরেকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তাকে ডেকে অফিসারকে কিছু বলতেই ভদ্রলোক অবাক হয়ে তাকালেন। অর্জুন কাছে যেতে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, আপনিই অর্জুন? আপনার কথা আমি অনেক শুনেছি।

ধন্যবাদ। আপনি এই খুনের ব্যাপারে সব তথ্য পেয়েছেন?

হ্যাঁ। শুনলাম। মুশকিল হল এদের সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই ছিল না। এই গ্রামকে লোকে সাহেবগ্রাম বলে। বিহারে সাহেবগঞ্জ বলে যে জায়গা রয়েছে তার যেমন কোনও বিশেষত্ব নেই, তেমনই এই সাহেবগ্রাম বলে ভেবেছিলাম আমি। অথচ শুনলাম, এদের কাছে নাকি শেক্সপিয়রের নাটক আছে যা তিনশো বছর আগে ছাপা হয়েছিল। ভাবা যায়! অফিসারের মুখ-চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

না, ভাবা যায় না। আমিই প্রথম শুনলাম। কিন্তু মিস্টার মুরহেড খুব ভালমানুষ ছিলেন। কেউ ওঁকে যে খুন করতে পারে তা এঁরা ভাবতে পারেন না। খুনিকে বের করা দরকার। অর্জুন কথাগুলো বলতেই সবাই সমর্থন জানাল।

একদিনের ব্যাপার। খুনি এখানকারই লোক। জেরা করলেই বেরিয়ে যাবে।

কয়েকশো মানুষকে একদিনে জেরা করা সম্ভব নয় অফিসার। তা ছাড়া খুনি কেন বাইরের লোক হবে না, তাও আমি বুঝতে পারছি না। অর্জুন বলল।

বাইরে থেকে এসে খুন করেছে বলছেন?

অসম্ভব নয়।

বাইরের লোক এখানে ঢুকতে সাহস পাবে?

আপনি-আমি তো ঢুকেছি।

আমাকে ডেকে আনা হয়েছে। আপনি?

আমিও তাই।

আশ্চর্য! আপনার খবর এরা পেল কী করে? খুন হওয়ার পর এত তাড়াতাড়ি আপনি চলে এলেন কী করে? অফিসার প্রশ্ন করলেন?

আমি এসেছি কয়েকদিন হল। এখানকার পাহাড়ে-পাহাড়ে মাঝে-মাঝেই আগুন জ্বলে কেন। কেন জ্বলে, সেটা জানতে এসেছি।

ও এমন কিছু নয়। পাহাড়ে অনেক সময় এরকম হয়। কেউ-কেউ আগুন জ্বালিয়েও দেয়। তা আপনি যখন এখানে আছেন তখন খুনিকে খুঁজে দিন না!

আমরা সবাই চেষ্টা করছি। কিন্তু মিস্টার মুরহেডের দেহ কবে পাওয়া যাবে?

এটাই তো মুশকিল। পোস্টমর্টেম করতে ওঁকে শিলিগুড়িতে পাঠাতে হবে। এখন থানায় কোনও ভ্যান নেই যে তাতে পাঠাব। জিপে করে বডি নিয়ে যাওয়ার কোনও চান্স নেই। আমার একটাই জিপ। ওখানে কবে পোস্টমর্টেম হবে তাও বলতে পারছি না। তদ্দিনে বডি ডিফর্মড হয়ে যাবে।অফিসার খুব চিন্তিত গলায় বললেন।

সেটা অসম্ভব ব্যাপার। এঁরা শ্রদ্ধার সঙ্গে ওঁর পারলৌকিক কাজ করতে চান।

ভদ্রলোকের মাথার পেছনে একটা ক্ষতচিহ্ন দেখলাম। অর্থাৎ ওঁকে পেছন থেকে মাথায় আঘাত করা হয়েছে। আপনার কি তাই ধারণা?

হ্যাঁ।

তা হলে পোস্টমর্টেম রিপোর্টও একই কথা বলবে, সঙ্গে একটু মেডিক্যাল কথাবার্তা থাকবে। ঠিক আছে। একটু বেআইনি হয়ে যাচ্ছে অবশ্য, তবে স্থানকাল-পাত্র বলে একটা কথা আছে। সেদিকটাও দেখা দরকার। আমি বডি নিয়ে যাচ্ছি না।

অফিসার কথাটা বলামাত্র জনতা উল্লসিত হয়ে উঠল। মিস্টার জোন্স অফিসারের সঙ্গে করমর্দন করলেন। যে চলে গেছে তার শরীরটাকে বীভৎস দেখতে হল না বলে সবাই খুশি। বিকেল শেষ। সন্ধে নেমে গেছে। মিস্টার মুরহেডের পারলৌকিক কাজ আগামীকাল সম্পন্ন হবে। অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, হত্যার মোটিভ কিছু পেয়েছেন?

অর্জুন বলল, ভদ্রলোক ফোটোগ্রাফার ছিলেন। ছবি তুলে বেড়ানোই ওঁর শখ ছিল। সেটা করতে গিয়ে নিশ্চয়ই এমন কোনও ছবি তুলে ফেলেছেন যা আততায়ী পছন্দ করেনি।

ইন্টারেস্টিং গল্পের মতো মনে হচ্ছে।

আপনারা যেখানে যান সেখানেই তো গল্প থাকে।

তা অবশ্য। অফিসার হাসলেন। তারপরই গলা নামালেন, আপনার যদি কাউকে সন্দেহ হয়ে থাকে তা হলে বলুন, এখনই অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাচ্ছি।

তা হলে আমাকে অ্যারেস্ট করতে বলতে হয়।

তার মানে?

আমি নিঃসন্দেহ, কাজটা গ্রামের কেউ করেনি। এদের জীবন এত জটিল নয় যে, একটা ফোটোগ্রাফকে ভয় করবে এবং তার জন্যে একটি শান্ত বৃদ্ধকে খুন করবে। কাজটা যে করেছে সে বাইরের লোক। অর্জুন বলল।

বাইরের লোক এখানে এলে কেউ জানবেনা?

রাত্রে আসতে পারে। তা ছাড়া, অফিসার, আপনি কি জানেন, গ্লাইডারে চেপে আকাশে কিছু মানুষ এই এলাকায় ওড়াওড়ি করে?

গ্লাইডার? তাই নাকি? ও হ্যাঁ। আমার কাছে খবর এসেছিল খুব বড় চেহারার পাখিকে নাকি আকাশে উড়তে দেখা গিয়েছে। আমি পাত্তা দিইনি। এইসব পাহাড়ের লোকগুলো তিলকে তাল বানিয়ে দেয়। আপনি যখন বলছেন গ্লাইডার, তখন মনে হচ্ছে ওরা মিথ্যে বলেনি। আজই আমি এস পি-কে জানিয়ে দিচ্ছি।

না। আমার মনে হয় রবিবার পর্যন্ত আপনার অপেক্ষা করা উচিত।

রবিবার? কেন?

আমার মনে হয় সেদিন অপরাধীকে দেখতে পাব।

আপনি খুব হেঁয়ালি করছেন।

অর্জুন হেসে ফেলল, সেদিন অমল সোম আসবেন। ওঁকে সম্ভবত আপনার এস পি চেনেন। আমি মিস্টার সোমের কাছেই কাজ শিখেছি।

আরে হ্যাঁ। আমি ওঁর নাম শুনেছি। অফিসার উত্তেজিত।

তা হলে রবিবার সকালেই চলে আসুন।

অফিসার জিপ নিয়ে বেরিয়ে গেলে ভিড় হালকা হয়ে গেল। এবং তখন অর্জুন টের পেল তার বেশ খিদে পাচ্ছে। কিন্তু এরা যদি সারাদিন না খেয়ে থাকে তা হলে কি তার খাওয়া উচিত হবে?

সে ভিলেজ সেন্টারে ফিরে এল। মিস্টার মুরহেড খুন হয়েছেন বলেই সম্ভবত সেন্টারে পাহারা দেওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। অর্জুনের মনে হল, তাকেও ওরা সন্দেহের চোখে দেখছে। ঘরে ঢুকে ওই অসময়েও স্নান করে নিল সে। সারাদিন ধরে নানা টেনশনে কাটিয়ে মনে হল শুয়ে পড়লে ভাল হয়। খিদে শরীরটাকে আরও ক্লান্ত করে তুলেছে। এই সময় পলের সঙ্গে মিসেস বেনসন দরজায় এলেন, অৰ্জুন, আমি জানতে পারলাম আপনি আমাদের মতো আজ কিছু খাননি। এটা আপনার ভদ্রতা। কিন্তু আপনি আমাদের জন্যে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন ভাবতে খারাপ লাগছে। আপনি আমাদের অতিথি। তাই অনুগ্রহ করে খেয়ে নিন।

পল খাবারের ট্রে নামিয়ে রাখল টেবিলে।

অর্জুন আর আপত্তি করল না। খাওয়া শুরু করে বলল, পল, তুমি কি এখনও রেগে আছ?

পল সংকোচে পড়ল। মিসেস বেনসনের সামনে সে ওই বিষয়ে কথা বলতে চায় না, তাই বলল, না, না। ঠিক আছে।

মিসেস বেনসন জিজ্ঞেস করলেন, পল কেন আপনার ওপর রাগতে যাবে?

ওর রান্না ভাল নয় বলেছিলাম।

ওঃ। এটা কিন্তু আমার মেয়ে বেঁধেছে।

খুব ভাল। দারুণ। পল তুমি ওর কাছে শিখে নাও।

পল লজ্জা পেল। কিছু বলল না।

খাওয়ার পর অর্জুন মিসেস বেসনের সঙ্গে হলঘরে এল। এখন রাত নেমে গেছে বলেই বেশিরভাগ বাচ্চা চুপচাপ। কোনও কোনও মা ঘুমপাড়ানিয়া গান গাইছেন। অর্জুন দেখল সেই শিশুটি মায়ের পাশে বসে তাকে দেখছে।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, মিসেস বেনসন, ওই বাচ্চাটি অত গম্ভীর কেন?

মহিলা বললেন, ও একটু ওইরকম। ওর ঠাকুরদা খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন। গ্রামের প্রত্যেকের জন্যে প্রার্থনা করতেন। ওর বাবাও ঠাকুরদার স্বভাব কিছুটা পেয়েছে। বিয়ের পর বেশ কিছুদিন ওদের সন্তান হয়নি। শেষপর্যন্ত ওরা তিনদিন ধরে চার্চে গিয়ে ধরনা দেয়। ওই তিনদিন ওদের জল পর্যন্ত খাওয়ানো যায়নি। তৃতীয় রাত্রে ওরা দুজনে একই স্বপ্ন দ্যাখে। স্বপ্নে মাদার নাকি তাদের আশীর্বাদ করছেন। তখন ওরা বাড়িতে ফিরে যায়। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, তার ঠিক ন মাস পরে ওই বাচ্চাটি পৃথিবীতে আসে।

বাচ্চাটি জন্মানোর পর কোনও অলৌকিক কাণ্ড করেছে?

না তো! সবকিছুই স্বাভাবিক। শুধু বড় বেশি চুপচাপ। কেন বলুন তো?

আমার সন্দেহ হচ্ছে যারা রবিবার আসবে তারা ওর জন্যেই আসছে।

মাই গড!

আচ্ছা ধরুন, কোনও সম্প্রদায় যদি ওকে তাদের ধর্মগুরু করে নিয়ে যেতে চায় তা হলে কি ওর মা রাজি হবে?

কখনও না। ঈশ্বরের আশীর্বাদে যার জন্য তাকে আমরা ত্যাগ করব না।

ঠিক আছে। আপনাকে অনুরোধ, এই কথাগুলো ওর মাকে জানাবেন না।

আপনি কী করে জানলেন ওকেই ওরা চায়?

আমার অনুমান, এখানে একমাত্র ওরই বিশেষত্ব আছে। বিশেষত্ব আছে বলেই চাহিদা তৈরি হয়েছে। আচ্ছা, আমি একটু ঘোরাঘুরি করে আসি৷ অর্জুন হাসল।

মিসেস বেনসন বললেন, আচ্ছা। কিন্তু সাবধানে থাকবেন।

পাহাড়ে উঠতে-উঠতে চার্লস জিজ্ঞেস করল, এই অন্ধকারে আমরা কেন যাচ্ছি?

যদিও আজ আকাশে মেঘ না থাকায় এবং দেরিতে চাঁদ উঠলেও পথ দেখা যাচ্ছিল। অর্জুন বলল, যে প্রাণীটি ওই শক্ত খোল ভেঙে বেরিয়ে পড়েছে তাকে দেখতে চাই।

আশ্চর্য! তাকে কোথায় এই বিশাল জঙ্গলে খুঁজে পাবেন? চার্লস দাঁড়িয়ে গেল।

আজ আর কাল তবু একটা সুযোগ থাকবে। মনে হয় ও বেশিদূরে যেতে সাহস পাবে না। দেখাই যাক না! অর্জুন হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিল।

চার্লস আবার দৌড়ে সঙ্গ ধরল। কিন্তু আমার কাছে কোনও অস্ত্র নেই। যদি আক্রান্ত হই তা হলে নির্ঘাত মরে যেতে হবে। ওর পায়ের চিহ্ন যেরকম, তাতে…।

আক্রমণ না-ও করতে পারে। সবে একদিনের শিশু।

শিশুর ওইরকম পায়ের দাগ?

ও ক্রমশ পাহাড়ের ওপরে উঠে এল। জঙ্গল এখান থেকে ঘন হয়েছে। এখন অন্ধকার একটু গাঢ় হওয়ায় সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। পোড়া জায়গাটার কাছে এসে ওরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।

চার্লস ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, আমরা নিশ্চয়ই নীচে নামছি না?

অর্জুন বলল, নামছি। দড়িটা ওইজন্যেই তখন খুলে নিয়ে যাইনি।

নীচে নামতে এবার তেমন অসুবিধে হল না। এখানে অন্ধকার বেশ ঘন। ঘড়িটা বের করে অর্জুনের মনে হল চার্লস এটার কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক হবে। কিন্তু কিছু করার নেই। সঙ্গে টর্চ আনা উচিত ছিল। আলোর রেখা ডালপালা কেটে পথ করে দিচ্ছে। চার্লস অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, এটা কী হচ্ছে?

এটা অদ্ভুত অস্ত্র। আমার পেছন পেছন আসুন।

অদ্ভুত! অদ্ভুত! আচ্ছা, আপনি কেন আমাকে সঙ্গে আনলেন? ডেরেককে বললে তো…।

ডেরেক বিশ্বাসঘাতকতার পথে যায়নি। আপনি যা করেছেন তার জন্যে কিছুনা-কিছু শাস্তি তো পেতেই হবে। ওরা সেই শক্ত বস্তুটির কাছে পৌঁছতেই শেয়াল জাতীয় দুটি প্রাণী দৌড়ে সরে গেল। অর্জুন ঘড়ির বোতাম টিপে আলোর রেখা নিভিয়ে দিল। একটু পরেই জঙ্গলের নিজস্ব শব্দ শুরু হয়ে গেল। চার্লস বলল, এতবড় জঙ্গলের কোথায় আছে আপনি জানবেন কী করে?

অর্জুন জবাব দিল না। কেউ কি বিশ্বাস করবে কোনও আদিম প্রাণীর শরীর থেকে বেরিয়ে আসা ডিম হাজার হাজার বছর ধরে ফসিল হয়ে থাকার পর তার জণ আবার প্রাণ ফিরে পেয়ে এই জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরকম একটা প্রাণীকে কলকাতার চিড়িয়াখানায় না নিয়ে যেতে পারলে বেঁচে থাকাই অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে এখন। অমল সোমের দেওয়া ঘড়িটার দ্বিতীয় বোম এখন তার ভরসা।

হঠাৎ একটা শব্দ কানে আসতেই চার্লস তার হাত চেপে ধরল। গাছের ডাল ভাঙার শব্দ। শব্দ লক্ষ্য করে অর্জুন এগিয়ে যেতেই মাথার ওপর গুম গুম আওয়াজ শুরু হল। সেটা থেমে যাওয়ামাত্র অর্জুন চার্লসকে বলল, এবার আমাদের লুকোতে হবে।

চারপাশেই তো অন্ধকার, চেষ্টা করলেও তো দেখতে পাবে না। চার্লস বলল, কিন্তু ওই শব্দটা আমি শুনেছি। ও হ্যাঁ, আজ বিকেলেই তো–।

অর্জুন ওর কথা কানে না নিয়ে টেনে নিয়ে গেল একপাশে। বেশ বড় একটা গাছের আড়ালে। তারও মিনিটআটেক পরে সে আলো দেখতে পেল। জোরালো টর্চলাইট ওপর থেকে নীচে নেমে আসছে। চারটে আলো এবং সেগুলো বেশ উঁচুতে ধরা। তারপরেই বুঝতে পারল, হাতে নয়, কয়লাখনির কর্মীদের মতো হেলমেটে আলোগুলো আটকানো, যাতে হাত খালি থাকে।

বেশ খানিকটা খোঁজাখুঁজির পর ওরা সেই কঠিন বস্তুটির কাছে পৌঁছে গেল। এখান থেকে ওদের কথা বোঝা যাচ্ছে না এবং কাউকেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তবে লোকগুলো যে হতাশ হয়েছে বোঝা যাচ্ছিল। ওইসময় ওরাও ডাল ভাঙার শব্দ শুনতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে চারজন সতর্ক হয়ে একটু আগে অর্জুন যে পথে এগোচ্ছিল সেই পথ ধরল। ওরা চোখের আড়ালে চলে যেতেই অর্জুন বলল, এই অন্ধকারে অনুসরণ করে লাভ নেই। অন্ধকারে হোঁচট খেতে হবে, নয় সাপের কামড়ে প্রাণ যাবে। বরং ওদের ফিরতে হবে এই পথেই। এখানে অপেক্ষা করাই ভাল।

হঠাৎ গুলির শব্দ শোনা গেল। পরপর বেশ কয়েকটা একটানা। তারপরই দেখা গেল জঙ্গল ভেঙে চারজন পড়ি কি মরি করে ছুটে আসছে আর তার পেছনে জঙ্গল ভাঙতে ভাঙতে প্রায়.ঝড়ের আওয়াজ এদিকেই এগিয়ে আসছে।

লোকগুলো চোখের আড়ালে চলে যাওয়ামাত্র অর্জুনের মনে হল, প্রায় হাতির মতো আকারের এক অন্ধকার এগিয়ে আসছে। জন্তুটার মুখ, চোখ, শরীর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটা উঁচু ঢিপির মতো কিছু দুলতে-দুলতে আসছে। সে ঘড়িটা তুলে দ্বিতীয় বোতাম টিপল। হঠাৎ প্রাণীটি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর ওটাকে নিচু হয়ে যেতে দেখল অর্জুন। এক মিনিট সময় চলে গেল, তবু নড়ছে না।

অমল সোম বলেছিলেন, হাতির মতো প্রাণীকেও ওই বোতাম টিপে অবশ করে ফেলা যায়, কিন্তু কতক্ষণ যায় তা বলেননি। বাঁ দিকে আলো দেখা গেল। যারা দৌড়ে পালিয়েছিল তারা আবার ফিরে আসছে প্রাণীটির সাড়াশব্দ না পেয়ে। দূর থেকে টর্চের আলো পড়ল প্রাণীটির শরীরে। অর্জুন দেখল বেচারা তার বিশাল চেহারা সত্ত্বেও পাশ ফিরে শুয়ে রয়েছে। লোকগুলো দৌড়ে চলে এল কাছে। সম্ভবত ওরা ভেবেছে, ওদের গুলিতেই প্রাণীটি মারা পড়েছে।

তারপরের আধঘণ্টা প্রচণ্ড ব্যস্ততায় কাটাল ওরা। ওপর থেকে নীচে কয়েকবার আসা-যাওয়া করে প্রাণীটিকে বেঁধে ফেলল ওরা। তারপরই হু-হুস শব্দ শুরু হল। অর্জুন বুঝল গ্লাইডার বা কপ্টারের সঙ্গে দড়ি বেঁধে এটাকে ওপরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু প্রাণীটি এত ভারী যে, একে সহজে তুলতে পারছে না যন্ত্র। অর্জুন নিঃশব্দে চার্লসকে নিয়ে দ্বিতীয় পথটা ধরে ওপরে উঠে আসতে লাগল। একেবারে শেষ ধাপে পৌঁছে দেখতে পেল গ্লাইডারের চেয়ে বড় একটি আকাশযানে দড়ি ওপরে টানছে। নীচে দাঁড়িয়ে একজন নির্দেশ দিচ্ছে। অর্থাৎ এখানে মাত্র দুজন মানুষ রয়েছে।

ওরা আড়াল রেখে উঠে এল।

প্রায় আধঘণ্টার চেষ্টায় প্রাণীটিকে ওপরে তুলল যন্ত্র। নীচের চারজন ইতিমধ্যে উঠে এসেছে। ছবির পর ছবি তুলছে ওরা। তারপর নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করল। ওদের ভাষা কিছুই বুঝতে পারছিল না অর্জুন। তার চোখ এখন প্রাণীটির দিকে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। প্রাণীটির কাঁধ থেকে লেজ পর্যন্ত পিঠ জুড়ে ছোট-ছোট শক্ত পাখা উঁচু হয়ে রয়েছে। এই ধরনের প্রাণী একসময় উত্তর আমেরিকায় দেখা যেত। বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন স্টেগোসর। প্রচণ্ড শক্তিধর হলেও এই প্রাণীর ঘিলুর ওজন মাত্র আড়াই আউন্স। স্টেগোসরের ছবি সে দেখেছে। এরা মূলত তৃণভোজী এবং ডিম পাড়ত। কিন্তু কয়েক লক্ষ বছর আগে যে প্রাণী অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, তার ফসিল হওয়া ডিম থেকে এই জীব বেরিয়ে এসেছে, কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। অবশ্য পৃথিবীতে রহস্যময় ঘটনা তো ঘটেই চলেছে।

হঠাৎ প্রাণীটি নড়ে উঠল। আলোচনায় ব্যস্ত থাকা লোকগুলো প্রথমে দেখেনি। অর্জুন দেখল এবার প্রাণীটি কাত হয়ে উঠে বসতে চেষ্টা করছে। এইসময় লোকগুলো চেঁচিয়ে উঠল। দ্বিতীয় বোতামটা টিপতে গিয়েও থেমে গেল অর্জুন। দেখাই যাক না! লোকগুলোর চিৎকারে ঘাবড়ে গিয়ে লেজ নাড়ল প্রাণীটি। সঙ্গে পাশে দাঁড় করানো যন্ত্রটি দুমড়ে ভেঙে পড়ল ওর ওপর। লোকগুলো মরিয়া হয়ে গুলি চালাতে লাগল। কিন্তু কোনও গুলিই প্রাণীটির চামড়া ভেদ করতে পারছে। না। তার বদলে কপ্টারের ট্যাঙ্কে আগুন ধরে গেল। সেই জ্বলন্ত পেট্রল প্রাণীটির শরীরে পড়ামাত্র বীভৎস ঘটনা ঘটল। জ্বলন্ত প্রাণীটি ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকগুলোর ওপর। একজন প্রাণভয়ে পালিয়ে আসছিল এদিকে। অর্জুন তাকে আঘাত করতে সে মাটিতে পড়ে গেল। আর তৎক্ষণাৎ চার্লস হাত চালিয়ে তাকে অজ্ঞান করে ফেলল।

কিছু করার ছিল না। চোখের সামনে প্রাণীটির সকার হয়ে গেল। যাওয়ার আগে সে অবশ্য চার-পাঁচ শত্রুকে মেরে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। পরে, অর্জুন শুধুই আক্ষেপ করেছে, এই প্রাণীটিকে বাঁচাতে পারেনি বলে। দ্বিতীয়বার বোতাম টিপে অজ্ঞান করে দিলে হয়তো সেই সুযোগ পাওয়া যেত। পাঁচটি মৃতদেহের পাশে একটা ঝলসানো মাংসের স্থূপ পড়ে আছে। যা হয়তো বৈজ্ঞানিকদের সাহায্য করবে, সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হবে।

লোকটিকে বয়ে নিয়ে এল ওরা। জ্ঞান হওয়ার পরও ওর পক্ষে হাঁটা সম্ভব ছিল। তখন গ্রামের মানুষ ঘুমিয়ে পড়েছে। ভিলেজ সেন্টারে নিয়ে এসে মিস্টার জোন্সকে খবর দিল অর্জুন। সেই রাতেই ভিড় জমে গেল সেন্টারের সামনে। পাহাড়ে যারা আগুন জ্বালে তাদের একজনকে ধরা গেছে। দেখার কৌতূহল প্রত্যেকের। অনেক কষ্টে সবাইকে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হল। অর্জুন ডেরেককে বলল তাদের ডাক্তারের কাছ থেকে সেই পুরিয়া এনে লোকটাকে খাওয়াতে। ওকে একটা ঘরে বন্দি করে রাখা হল।

পরদিন সকালে লোকটাকে একটু সুস্থ মনে হল। প্রথমে লোকটা এমন ভান করছিল, যাতে মনে হচ্ছিল সে ভাষা বুঝতে পারছে না। কিন্তু অর্জুন ওকে চিনতে পেরেছিল। সেই লোকটাই বিকেলে গ্লাইডারে উড়ে এসে চার্লসের সঙ্গে কথা বলেছে। ইশারায় কথা বললেও চার্লসের লেখা পড়েছে। যে ইংরেজি পড়তে পারে, সে কথা বলতে পারবে না? ভাঙা-ভাঙা হলেও তো পারা উচিত। অর্জুন চাপ দিতে লাগল। শেষপর্যন্ত মুখ খুলল লোকটা।

আমরা আছি এখান থেকে তিরিশ মাইল দূরে ভুটানের জঙ্গলে। আমাদের ধর্মগুরু মারা যাওয়ার পর শয়তানের অভিশাপ নেমে আসছিল। ধর্মগুরু বলেছিলেন তাঁর পুনর্জন্ম হবে ভারতবর্ষে, কিন্তু ভারতীয়দের মধ্যে নয়। আমাদের গনকাররা বলেছিল ধর্মগুরু সেই জায়গায় জন্মেছেন, যেখানে এখন পৃথিবীর আদিম প্রাণীর অস্তিত্ব আছে। আমরা অনেক খুঁজেছি গত দুবছর ধরে। শেষপর্যন্ত ওই পাহাড়ে আমরা অভিযান চালাই। আমরা একটা জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে চারপাশ খুঁজতাম। এই গ্রামের অস্তিত্ব জানার পর আমরা নিঃসন্দেহ হই ঠিক জায়গায় এসেছি। কদিন আগে হঠাৎই একটা আদিম গাছের ভেতর ডিমটাকে আবিষ্কার করি। এটাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় অসাবধানে নীচে পড়ে যায়। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি ওটা থেকে বাচ্চা বেরিয়ে সেটা এত বড় হয়ে যাবে কেউ কল্পনা করিনি! লোকটা কাতর গলায় বলল।

এখন আপনার কী চাই?

এই গ্রামে আমাদের ধর্মগুরু আছেন। তাঁকে সসম্মানে নিয়ে যেতে চাই।

আপনি যাকে ধর্মগুরু বলছেন সে দু বছরের শিশু। তার কোনও চৈতন্য হয়নি। সে তার মাকে এবং মা তাকে ছেড়ে কী করে থাকবে? কোনও মা কি সন্তানকে ছেড়ে থাকতে পারে, ছেড়ে দেয়?

আমরা ওর মাকেও নিয়ে যেতে পারি, যদি যেতে চান।

আপনারা পাগলামি করছেন। মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে মানুষের অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যায়। তখন তার স্মৃতি পড়ে থাকে।

না। আমরা বিশ্বাস করি তিনি আবার জন্মেছেন।

কিছু প্রমাণ আছে?

আছে। সেই শিশুর দুই ভুরু জোড়া হবে এবং ডান হাতে রেখা থাকবে না।

অর্জুন কথা না বাড়িয়ে ওপরে চলে এল। প্রথমেই সে গম্ভীর শিশুটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অর্জুনের সঙ্গে ডেরেক এবং মিসেস বেনসন আছেন। শিশুটির ভুরু জোড়া নয়।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সে। একে-একে সবকটি ছেলেকে দেখা হল। না, কারও সঙ্গে ওই বর্ণনার মিল নেই। চলে আসছিল অর্জুন। হঠাৎ বাকি দুটি মেয়ের একজনের দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেল। শিশুটির ভুরু জোড়া। কাছে গিয়ে ওর ডান হাত তুলে মুঠো খুলতেই দেখতে পেল হাতে কোনও রেখা নেই।

মিসেস বেনসন আর্তনাদ করে উঠলেন। সেই বাচ্চার মা দু হাতে জড়িয়ে ধরলেন তাঁর সন্তানকে। অর্জুন তাঁকে বলল, ভয় পাবেন না। ভয় পাওয়ার মতো কিছু হয়নি।

সেই দুপুরে মিস্টার মুরহেডের পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন করা হল।

সেই সকাল থেকেই বন্দির শরীর অসুস্থ হল। তার গায়ে বেশ জ্বর। ওকে জেরা করার অবকাশ পাওয়া যায়নি।