টুপুরকে চমকে দিয়ে সেই রাত্রেই কেসটা থেকে হাত ধুয়ে ফেলল মিতিন। ফোন করেছিল উৎপল ক্রিস্টোফার, তাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিল ঘটনাটা তার মোটেই চ্যালেঞ্জিং বলে মনে হচ্ছে না। সুরজমল অগ্নিদেবের সঙ্গে মোলাকাতেও সে মোটেই আগ্রহী নয়। শুনে বুঝি আহত হয়েছে উৎপল, আর তার কোনও সাড়াশব্দ নেই।
টুপুর রীতিমত হতাশ। ভেবেছিল এবারও মিতিনমাসির তদন্তে সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে থাকবে, জম্পেশ করে লিখবে রহস্য উদঘাটনের কাহিনী। কী কপাল, শুরুতেই জল পড়ে গেল! অগত্যা আর কী করা, টুপুর এখন ভূতের মতো বসে থাকছে সারাদিন। পুরনো কলকাতার ওপর আরও খানচারেক বই এনেছে পার্থমেসো, ইচ্ছে হলে দেখছে উলটেপালটে। সবকটা বইই পার্থমেসোর ভাষায় হাইলি ইন্টারেস্টিং। আজব আজব তথ্যে ঠাসা। কীভাবে লটারি কমিটি করে তৈরি হয়েছিল কলকাতার রাস্তাঘাট, কত কিসিমের ঘোড়ার গাড়ি চলত শহরে, কবে থেকে চালু হয়েছিল ঘোড়ায় টানা ট্রাম, বিদ্যুৎই বা কলকাতায় এল কোন সালে, এরকম হাজারো খবর। পড়তে তো ভালই লাগে টুপুরের, কিন্তু কিছুতেই সেভাবে মন বসে না। হঠাৎ হঠাৎ ভারী হয়ে যায় বুকটা। ইশ, গরমের ছুটিটা এ বছর মাঠে মারা গেল!
টুপুরকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য রোববার নামি চাইনিজ রেস্তরাঁয় জব্বর খাওয়াল পার্থমেসো। হালকা মশলাদার খাঁটি চিনা খাবার। চিংড়ি আর কাঁকড়া মিশ্রিত লোভনীয় ফ্রায়েড রাইস, ব্যাঙের ছাতা সহ লেমন চিকেন, গার্লিক প্রন। সঙ্গে খিদে বাড়ানোর ডিশ হিসেবে মুচমুচে পালংশাক ভাজা। মিতিনমাসিও একদিন ঘুরিয়ে আনল সায়েন্স সিটি থেকে। সেখানে ডায়নোসর দেখে আর টাইমমেশিনে চড়ে বুমবুম দারুণ পুলকিত। বিশাল গম্বুজাকৃতি পরদায় অ্যাসট্রাভিশনে সেরেঙ্গেটির জঙ্গল দর্শন করে টুপুরও রোমাঞ্চিত। ওই একটা দিনই যা টুপুর বুমবুমকে নিয়ে ঘুরল মিতিনমাসি। বাকি সবকটা দিনই তো দুপুরে খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, ফিরছে সেই সন্ধেবেলা। কম্পিউটার চালানোর কী একটা ক্র্যাশ কোর্স করছে। নিজস্ব একটা যন্ত্ৰগণক কেনার খুব ইচ্ছে মিতিনমাসির, তারই পূর্ব প্রস্তুতি।
হঠাৎই নিস্তরঙ্গ পুকুরে ঢিল পড়ল।
সেদিন বিকেলবেলা জোর একটা কালবৈশাখী হয়ে গেছে, সঙ্গে ঝমঝমাঝম বৃষ্টি। জৈষ্ঠ্যের উত্তাপ কমে গিয়ে মৃদুমন্দ সমীরণ বইছিল সন্ধেবেলা। টুপুর একটু বই-খাতা নিয়ে বসেছিল। ছুটির আগে নতুন ক্লাস আরম্ভ হয়ে গেছে, টুকটাক হোমওয়ার্ক আছে কিছু, টাস্কগুলো সেরে নিচ্ছিল। প্রথমে হাত দিয়েছে অ্যালজেব্রায়। সহজ অঙ্কগুলো কষে ফেলছে তাড়াতাড়ি, কঠিনগুলো জমিয়ে রাখছে পার্থমেসোর জন্যে। মিতিনমাসি ফিরেছে সবে, গা ধুয়ে ঢুকেছে রান্নাঘরে।
তখনই হঠাৎ উৎপলের আবির্ভাব। মুখেচোখে প্রবল উত্তেজনা।
প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ম্যাডাম, গ্রেভ ডেঞ্জার। অদ্ভুত কাণ্ড ঘটছে। আমি মাথামুণ্ডু কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।
মিতিনকে তেমন একটা অবাক দেখাল না, সহজভাবে বলল, কী হল আবার?
বলছি। আগে এক গ্লাস জল খাওয়ান।
এক গ্লাস নয়, পর পর দুগ্লাস ঠাণ্ডা জল খেল উৎপল। খানিকটা থিতু হয়ে যা শোনাল তা রীতিমতো রোমহর্ষক। জোনাথন মাইকেলের বাড়িতে নাকি আপনাআপনি সব কাচ ভাঙতে শুরু করেছে। টিউবলাইট ফাটছে ফটাফট, বা উড়ে যাচ্ছে, খসে খসে পড়ছে দেওয়াল-আলমারির কাচ! কত যে কাচের ফার্নিচার চৌচির হয়ে গেছে।
মিতিনের ভুরু কুঁচকেছে সামান্য। জিজ্ঞেস করল, কবে থেকে শুরু হল এসব?
পরশু। আই মিন শনিবার সন্ধে থেকে।
প্ৰথম কী ভেঙেছে?
টিউবলাইট। ড্যাডির ঘরে। মিসেস জোনস বাড়ি যাওয়ার আগে ঘরদোরের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে যান। পরশুও নিয়মমাফিক লাইটগুলো অন করেছিলেন, হঠাৎই নাকি শব্দ করে…
নাকি বলছেন কেন? আপনি বুঝি স্পটে ছিলেন না?
মির্না আর আমি তো তখন জিমনাস্টিক্স ক্লাসে।
ও। আপনারা মিসেস জোনসের মুখে খবর পেলেন?
হ্যাঁ। বেচারি ছুটতে ছুটতে এসে জানালেন সব কটা লাইটই নাকি জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে দুমদাম ফেটে যাচ্ছে। ড্রয়িংরুমের টিউব ফাটার পর বালদুটো জ্বালিয়েছেন, দুটোই গন। বালবের কাচ ঝরে গিয়ে ফিলামেন্ট ঝুলছে। বলতে বলতে মিসেস জোনসের তো প্রায় কেঁদে ফেলার দশা।
তো আপনারা তখন কী করলেন?
মির্না তো শুনেই কাঁপছে। আমি প্রথমে অতটা গা করিনি। মিসেস জোনসের তো একটু তিলকে তাল করার বাতিক আছেই, উনি তো কথায় কথায় হোলি স্পিরিট দেখেন। ভেবেছিলাম হয়তো একটা-দুটো লাইট কেটে যেতেই উনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন। ও জিসাস, গিয়ে দেখি ব্যাপারটা সত্যিই সিরিয়াস। বারান্দার আলোটা জ্বলছে বটে, কিন্তু ঘরগুলো অন্ধকার। ড্যাডি মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে ঠকঠক কাঁপছেন। ড্যাডিকে সাহস দেওয়ার জন্য আমাদের ঘরে সুইচ মারলাম। বিশ্বাস করবেন না, তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে টিউব ফটাস। বালবটা তো পনেরো সেকেন্ডও টেকেনি। ডিকের ঘরেও সেম কেস। ফটাস শব্দ, টুকরো টুকরো হয়ে ঘরময় ছড়িয়ে যাচ্ছে কাচ।
টুপুর খাড়া হয়ে বসল, তারপর?
স্টোররুমে দু-তিনটে নতুন বান্ধ রাখা ছিল, একটা এনে ড্রয়িংরুমে লাগালাম। এগেন সেম ইন্সিডেন্ট। তখন আমারও একটু নার্ভাস নাভাস লাগল। আর কিছু করলাম না, ঠিক করলাম রাতটা যাক, সকালে দেখছি। বোধ হয় আধ ঘণ্টাও কাটেনি, আর এক কাণ্ড! ডিকের ঘরে ঝনঝন! গিয়ে দেখি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডিক, তার দেওয়াল-আলমারির কাচ খসে পড়েছে মাটিতে। ডিক জাস্ট পাল্লাটা টেনেছিল, তাতেই নাকি…
ও। সন্ধেবেলা বালব-টিউব ফাটার সময়ে ডিক কোথায় ছিল। বাড়িতেই?
ডিক কখন কোথায় থাকে লর্ড জিসাসই জানেন। তবে বাড়িতে ছিল না এটুকু বলতে পারি।
ডিক বাড়ি ঢোকার পর পরই কি কাচটা ভাল?
মিনিট পনেরো পরা এসে বালব-টিউবের ঘটনাটা শুনে লাইন চেক করানোর উপদেশ দিয়ে সবে নিজের ঘরে গেছে, তার পর পরই….
তারপর কী করল ডিক?
একটুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। দেন ডিনার টিনার সেরে হোটেল। নাইট ডিউটি।
কোনও ওপিনিয়ন দেয়নি?
না। কেমন গুম মেরে গেছিল।
হুম। তা লাইট আর দেওয়াল-আলমারি ছাড়া আর কী ভাঙল?
অনেক কিছু। আমাদের ঘরের শোকেস, ড্যাডির ওয়াল আলমিরা, ড্রয়িংরুমের ডিসপ্লে ক্যাবিনেটের নীচের তাকে কাচ বসানো ছিল, সেটাও টিউব বা দিনের বেলা দিব্যি জ্বলছে, নো প্রবলেম। যেই না সন্ধে হল, অমনি প্রথমে গেল আলো, তারপর একে একে ওই সব কাচ। আমাদের সে এক দিশেহারা অবস্থা ম্যাডাম। অন্ধকারে একবার এ ঘরে ছুটছি, একবার ও ঘরে।
টুপুর ফস করে জিজ্ঞেস করল, আর সেই ফার্নিচার রুমের কী খবর? সেখানে কিছু ভাঙছে না?
খুলে দেখার সাহস পাইনি। ড্যাডি নিজেও আর ও ঘরে ঢুকছেন না, আমাদেরও ঢুকতে দিচ্ছেন না। চাবি আগলে রেখে দিয়েছেন।
ভেতরে আর আওয়াজ হচ্ছে?
মাঝে খানিকটা কমেছিল। লাস্ট উইকে মাত্র একদিন…. পরশুও কিছু হয়নি। তবে কাল রাত্তিরে আবার প্রবল দাপাদাপি। পিয়ানো এক বার শব্দ করে থামল না, বাজতেই লাগল। মনে হচ্ছিল ভারী ভারী আলমারি দুটোয় কেউ ধাক্কা মারছে। গোটা ঘর জুড়ে চলছে যেন তাণ্ডব। ড্যাডি সারারাত ঠায় বিছানায় বসে ছিলেন সিঁটিয়ে। প্রায় কোলাপস করার দশা। রাত্তিরে কতবার বললাম, চাবিটা দিন, একবার খুলে দেখি, মনে হয় বেড়ালটা বেকায়দায় আটকা পড়ে গেছে….. ড্যাডি কিছুতেই রাজি হলেন না, উৎপল থামল একটু, তারপর ফ্যাকাশে হেসে বলল, হাঁ ম্যাডাম, আপনার কথায় আমিও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম ও ঘরে বেড়ালই ঢোকে। আমার সার্কাসের অভিজ্ঞতাও বলছিল বেড়াল জাতীয় প্রাণীরা অসম্ভব নিঃসাড়ে আর ক্ষিপ্ৰ গতিতে চলাফেরা করতে পারে। এখন কিন্তু আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে ম্যাডাম।
মিতিন বলল, অর্থাৎ এখন আপনারও মনে হচ্ছে ভূত?
তা ছাড়া আর কী হতে পারে বলুন? বেড়াল তো লাইট কাচ ভাঙছে না!
কেন, সুরজমলের কথা আর আপনার মাথায় আসছে না?
বুঝতে পারছি না ম্যাডাম, কিছু মাথায় ঢুকছে না, উৎপল দুদিকে মাথা নাড়ল, সূরজমলকে আর সন্দেহ করব কোন যুক্তিতে? তবে হাঁ….। উৎপল সামান্য থমকে থেকে বলল, একটা কথা এখনও আপনাকে বলা হয়নি। উত্তেজনার মাথায় মিস করে গেছি। সুরজমল কিন্তু এর মধ্যে আরও এক বার ড্যাডির কাছে এসেছিল।
তাই নাকি? কবে?
ওই পরশুই। সকালবেলা।
হঠাৎ?
সুরজমল তো মহা ঘোড়েল, ড্যাডিকে এবার ভুজুংভাজুং দিয়ে কায়দা করতে চাইছিল। চেলাচামুণ্ডা আনেনি, সঙ্গে এসেছিলেন সুরজমলের খোদ গুরুদেব। এসেই নাকি সুরজমল বলতে থাকে, ড্যাডিই তাকে ডিড সেটল করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন। ড্যাডি অবশ্য গুলগল্পে আমল দেননি, সোজা হাঁকিয়ে দিয়েছেন।
টুপুর চোখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, সুরজমলের গুরুদেবও আছেন?
সুরজমলদেরই তো গুরুদেব থাকে মাই ডিয়ার ইয়াং লেডি। অধৰ্ম করতে গেলে ধর্মের আড়ালটা তো চাই। সুরজমলের গুরুদেবটি শুনেছি বাঙালি। নাম মুক্তকেশানন্দ। ইয়া লম্বা চুল আছে। সর্বদা খোলা থাকে চুল। ওই চুলেই নাকি তাঁর যত তেজ।
স্যামসনের মতো? টুপুর ঠাট্টা জুড়ল, তা সেই গুরুদেবই কোনও তুকতাক করে দিয়ে যাননি তো? হয়তো তাঁর ….. ওই যে, কী যেন বলে,…. ঐশীশক্তির প্রভাবে….
উৎপলের মুখচোখ পালটে গেছে সহসা। যেন শুকনো মুখ থেকে কেউ রক্তটুকুও শুষে নিল। কাঁপা কাঁপা গলায় উৎপল বলল, এ লাইনে তো ভেবে দেখিনি! শুনেছি বটে অনেক হিন্দু সাধু যোগবলে অলৌকিক কাণ্ডকারখানা ঘটাতে পারেন। কাচ ভাঙা হয়তো ওই সাধুর জাদুতেই… উৎপল অসহায় চোখে মিতিনের দিকে তাকাল, এরকমটাও তো হতে পারে, না ম্যাডাম?
পারে হয়তো কোনও বিশেষ শক্তি যে কাজগুলো করছে তাতে আমারও কোনও সন্দেহ নেই।
বলছেন? বলছেন সুরজমলের কাজ? ও গড, ড্যাডির তো তা হলে সমূহ বিপদ।
উতলা হবেন না। দেখছি কী করা যায়। বাই দা বাই, বাড়ির ইলেকট্রিক লাইন চেক করিয়েছেন?
ডিকই ইলেকট্রিশিয়ান ডেকে এনেছিল। আজই বিকেলে। উৎপল ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল, আগাপাশতলা টেস্ট হয়েছে। লাইনে কোথাও গণ্ডগোল নেই। নো শর্টসার্কিট, নো লিকেজ, নাথিং।
আপনাদের ওখানে ভোল্টেজ ফ্লাকচুয়েশান কীরকম?
ইউজুয়াল। নাথিং এক্সট্রা অরডিনারি। ভোল্টেজের প্রবলেম হলে তো আমার জিমনাসিয়ামেও হত।
আর একটা কথা। বাড়ির কোনও পয়েন্টের কোনও আলোই কি টিকছে না?
বারান্দার লাইট ঠিক আছে। বাইরের ভেতরের। কিচেনবাথরুমেও প্রবলেম নেই। শুধু রুমগুলোতেই..। আজ বলে এসেছি, যেন কোনও ঘরেরই আলো জ্বালানো না হয়।
আর একটা কথা। কাচ ভাঙার কথা ইনফর্ম করতে দু-দিন লেট করলেন কেন?
ফ্র্যাংকলি স্পিকিং, প্রথমেই আপনার কথা মনে হয়েছিল। কিন্তু হেজিটেট করছিলাম। আজ মির্না ছাড়ল না, জোর করে ঠেলে পাঠাল।
হুম, মিতিন পলক ভাবল কী যেন। তারপর বলল, এক কাজ করুন না। এক্সট্রা চেয়ার-টেবিলগুলো আবার আগের জায়গায় বের করে দিন।
কী বলছেন? উৎপল থতমত খেয়ে গেল, তাতে কী লাভ হবে? ভূতই হোক, কি মানুষ, সে তো এখন বাইরে কাজ আরম্ভ করেছে।
তবু বের করে দিন। অনর্থক জেদ করবেন না। এতে হয়তো আপনার শ্বশুরমশাইয়ের কনফিডেন্স একটু বাড়লেও বাড়তে পারে।
বলছেন যখন, দেব। উৎপলকে ঈষৎ অপ্রসন্ন দেখাল। পলকের জন্য। তারপর অল্প হেসে বলল, মনে হচ্ছে আপনিও ভূতে বিশ্বাস করে ফেলেছেন ম্যাডাম?
বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি! মিতিনও হাসল, আপনি তো মিস্ট্রির সল্যুশান চান। তাই না? আর যদি সত্যিই শেষ পর্যন্ত আমি ভূতই আবিষ্কার করি, আপনি নিশ্চয়ই অখুশি হবেন না?
উৎপল এক মুহূর্ত চুপ। পরমুহূর্তে শার্টের বুকপকেট থেকে একটা চেক বার করেছে। বিনীত ভঙ্গিতে বলল, এটা রাখুন ম্যাডাম। আপনার ফিজ তো জানি না, জাস্ট একটা টোকেন অ্যাডভান্স।
মিতিন নিয়ে নিল চেকটা। আলগা চোখ বোলাতে বোলাতে আজব প্রশ্ন ছুড়ল, মিস্টার বিশ্বাস, আপনার বাড়ির ল্যাপটডটা কি ককার স্প্যানিয়াল?
প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ বদলে যাওয়ায় উৎপল ক্ষণিকের জন্য থতমত। বিস্ময়ের সুরে বলল, না। আমার তো লাসা। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে আমার কুকুর আছে?
মিতিন মুচকি হাসল, বলুন তো কী করে?
এক মুহূর্ত চিন্তা করে উৎপলও হেসে ফেলেছে। বলল, বুঝেছি। আপনাকে সেদিন যখন ফোন করছিলাম, তখন আপনি টিপসির ডাক শুনেছেন।
রাইট। আপনি কি ডগলাভার?
কুকুরের মতো বিশ্বস্ত প্রাণীকে না ভালবেসে পারা যায়?
আপনার মিসেসও ভালবাসেন?
অবশ্যই। তবে আমার সঙ্গগুণে।
টুকটাক কথা বলতে বলতে উৎপলের সঙ্গে দরজা অবধি এসেছে। মিতিন হালকা ভাবে বলল, এখন কি আবার শ্বশুরবাড়ি?
একবার তো ঢুঁ মারতেই হবে। তারপর ভাবছি আজ বাড়ি ফিরে যাব। পর পর দুরাত্তির ঘুম হয়নি, চোখটা টানছে।
মিস্টার মাইকেলের কাছে আজ তা হলে কে থাকবেন? মির্না?
থাকতেও পারে। তবে মির্নাও মেন্টালি খুব এগজসটেড। ওরও একটু ঘুম দরকার। তেমন বুঝলে ড্যাডিকেও আজ একটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে আসব।
হ্যাঁ, আপনাদের সবারই ঘুম দরকার। যা ঝড়টা যাচ্ছে।
উৎপল চলে যেতেই টুপুর প্রায় লাফিয়ে উঠেছে, দেখেছ তো, তোমার বেড়াল থিয়োরি খাটল না?
আমি তো জানতামই খাটবে না। মিতিন সোফায় হেলান দিল, তা ঐন্দ্ৰিলা, তোমার কী রিডিং? রিগার্ডিং দিস নতুন মোচড়?
প্রোমোটারের গুরুদেবের হাত থাকলেও থাকতে পারে।
তুকতাক? তার এফেক্টে বাড়ির কাচ ভেঙে পড়ছে?
টুপুর ঈষৎ মিইয়ে গেল। করুণ মুখে বলল, কিন্তু ভূত বলে তো কিছু নেই মিতিনমাসি।
বুঝেছি। ভূতের আইডিয়াটা তোর পছন্দ নয়। তুই এমন কিছু চাস যা ধরাছোঁয়ার মধ্যে পাওয়া যায়।
বুমবুম পাশের ঘরে ভারতীর সঙ্গে লুডো খেলছিল। কখন যেন এসেছে দরজায়, গোল গোল চোখে গিলছে মা আর টুপুরদিদির সংলাপ। কৌতূহলী মুখে জিজ্ঞেস করল, কোথায় ভুত আছে মা?
ভূত যেখানে থাকে। তোমার মাথায়।
গোমড়া মুখে বুমবুম বলল, না। আমার মাথায় ভূত নেই। বুদ্ধি আছে।
কাঁচকলা আছে। ভারতী পিছন থেকে ফুট কাটল, মাথায় ভূত চাপে বলেই তো খেলার সময়ে বার বার সাপলুডো উলটে দাও।
এহ্, আমি কেন বারবার সাপের মুখে পড়ব? বুমবুম দুষ্টু হেসে মিতিনকে বলল, মা, একটা কাজ করা যায় না? সাপের মুখে পড়ে লেজে নেমে না এসে যদি লেজ থেকে মুখে উঠে যাই?
টুপুর বলল, এই বিটকেল বুদ্ধিগুলোকেই তো বলে ভূতের বুদ্ধি।
মিতিন বলল, যেমন বন্ধ ঘরে সুবিধে করতে না পেরে এখন জোনাথনের বাড়ির কাচ ভাঙতে শুরু করেছে ভূত।
তাই কি? টুপুর মাথা নেড়ে ফের আলোচনায় ফিরল, আচ্ছা মিতিনমাসি, যদি ধরেও নিই ভূত আছে, তা হলে সে তো অশরীরী। যার শরীরই নেই, সে তো কিছু ধরতেও পারবে না, ধাক্কাও মারতে পারবে না। নয় কি?
মিতিন হাসল, বুঝলাম। ভূতের থিয়োরিটা তোর একদমই মনে ধরছে না।
তুমিই ভেবে দ্যাখো না, একটা বাড়ি তৈরি হয়েছে প্রায় দেড়শো বছর আগে, সেখানে একজন কতকাল আগে সুইসাইড করেছেন। মাঝে তো কখনও ভূতের উপদ্ৰবের কথা শোনা যায়নি?
তা কেন। মিসেস জোনস তো বললেন, মিসেস মাইকেল মারা যাওয়ার সময়ে তিনি আত্মার উপস্থিতি টের পেয়েছেন।
মিসেস জোনস বড় বেশি ধর্মপ্রাণা। এমন মহিলার তো মনের ভুল হতেই পারে। ওঁর কথাটাকে বেদবাক্য বলে ধরবে কেন? কিছু একটা গড়বড় চলছে।
কীরকম?
তা আমি কী করে বলব! ভূত না মুক্তকেশানন্দ, সে তো বার করবে তুমি।
কথার মাঝেই ডোরবেল। পার্থ ফিরল।
মেসো ঘরে ঢুকতে না ঢুকতে তড়বড় করে তাকে কাচভাঙা এপিসোডের বিস্তৃত ধারাবিবরণী দিয়ে দিল টুপুর।
শুনে পার্থ রীতিমতো উৎফুল্ল, আইব্বাস, এ যে রিয়েল ভূত রে। এমন একটা ভূতের বাড়ি তো স্বচক্ষে দেখে আসতে হয়।
টুপুর বলল, তুৎ, তুমিও ভূত ভাবছ? ভূত তো নেহাতই মানুষের কল্পনা।
ডেঁপোমি করিস না। জানিস, কলকাতায় এখনও কতগুলো ভূতের বাড়ি আছে? খোদ মহাকরণই তো ভূতেদের সদর দপ্তর। এখনও গভীর রাতে রাইটার্স বিল্ডিং-এ টাইপরাইটারের খটখট শোনা যায়।
মিতিন ফোড়ন কাটল, ভূতরা টাইপ করে? কেন? কোথায় কী ভূতুড়ে কাণ্ড করতে হবে তার অর্ডার পাঠানো হয় বুঝি তখন?
বিদ্রূপ কোরো না। কটা খবর রাখো? জানো, প্রতি পূর্ণিমায় রাজভবন থেকে এখনও একটা চেরোট বেরোয়? চেরোট, মানে চ্যারিয়ট। বিশাল সাইজের ঘোড়ার গাড়ি। সেই চেরোট গিয়ে থামে গঙ্গার ধারে, ইডেন গার্ডেনের পশ্চিমগেটে। গাড়ি থেকে নেমে জ্যোৎস্যরাতে স্ট্যান্ডে হাওয়া খান এক সাহেব। অনেকেই দেখেছে। ব্র্যান্ড মানে জানো তো? ইডেনের পশ্চিমগেটের ভেতরে যে উঁচু ধাপিটা আছে সেটাকে বলে স্ট্র্যান্ড।
ইয়েস। ওই স্ট্র্যান্ডের নামেই ততা গঙ্গার ধারের রাস্তাটার নাম স্ট্র্যান্ড রোড।
রাইট। …তারপর ধরো, রাসেল স্ট্রিটের ওই পুরনো বাড়িটা, যেখানে আগে কলকাতার বিশপ থাকতেন। বাড়িটার পেছনে প্রকাণ্ড, এক দিঘি ছিল, চৌরঙ্গির সাইডে। ওই দিঘিতে ড়ুবে মারা গেছিলেন এক বিশপ। তাঁর আত্মা এখনও রাসেল স্ট্রিটের বাড়িটায় ঘুরপাক খায়। তিনি যখন আসেন, একটা মোমপোড়া গন্ধ ভাসতে থাকে বাতাসে। উৎপলের বাড়িতেও সেরকমই কেউ আবির্ভূত হচ্ছেন কিনা সেটা কি জোর দিয়ে…?
আচমকা কথা থামিয়ে দিল পার্থ। চোখ আটকেছে সেন্টার টেবিলে। খপ করে তুলে নিল চেকটা। উদ্ভাসিত মুখে বলল, যাক, উৎপলের জ্ঞানগম্যি হয়েছে তা হলে!
টুপুর বলল, ভাল অ্যামাউন্ট দিয়ে গেছেন। সাড়ে সাত হাজার।
পার্থ বিজ্ঞের মতো বলল, খুব তো টিকটিকির চামচে হয়েছিস, বল তো এই চেক দেখে উৎপলের চরিত্র সম্পর্কে কী আন্দাজ করা যায়?
আর এক বার চেকটা দেখে নিয়ে টুপুর বলল, সইটা খুব সিম্পল। অর্থাৎ উৎপলবাবুর মধ্যে তেমন প্যাঁচ নেই।
কিছুই শিখিসনি। পার্থ আলগা চাঁটি মারল টুপুরের মাথায়, শোন, উৎপল মহা কিপটে। ব্যাটার ইচ্ছে ছিল পাঁচ হাজার দেওয়ার। পরে মনে হয়েছে দশ হাজারের কম দিলে খারাপ দেখাবে, তাই শেষ পর্যন্ত তানানানা করে সাড়ে সাত গলিয়েছে। অর্থাৎ কৃপণ উৎপল এখন একজন দ্বিধাগ্রস্ত মানুষ। পার্থ টেরচা চোখে মিতিনকে দেখল, অ্যাম আই রাইট শ্রীমতী প্রজ্ঞাপারমিতা?
চমৎকার ডিটেকশান। মিতিন ঠোঁট টিপে হাসল, তবে একটা তুচ্ছ জিনিস তোমাদের নজরে আসেনি। সইটা ইউ বিশ্বাসের নয়, এম বিশ্বাসের। অর্থাৎ মির্নার। চেকটাও মির্না লিখেছে, উৎপল নয়।