জিপগাড়ির লোকদুটোকে দেখে জোজো দৌড় লাগালেও সন্তু দাঁড়িয়ে রইল এক জায়গায়। অরিন্দম সন্তুর হাত ধরে টানতে লাগল। সন্তু একঝলক তাকিয়ে দেখল, জোজো নিজের বাড়ির দিকে না গিয়ে চলে যাচ্ছে বড় রাস্তার দিকে।
লোক দুটো জোজোকেও তাড়া করে গেল না। সন্তুদের সামনে এল না, ডান দিকে একটু বেঁকে গিয়ে রাস্তার মাঝখানে নাচতে লাগল দুহাত তুলে।
সন্তু হো হো করে হেসে উঠল।
জোজো যাদের স্পাই ভেবে ভয় পেয়ে পালাল, সেই লোক দুজন আসলে একটা ঘুড়ি ধরবার জন্য লাফাচ্ছে। একটা কালো রঙের চাঁদিয়াল ঘুড়ি কেটে এসেছে। দুলতে-দুলতে নামছে নীচের দিকে।
সন্তুরও ঘুড়ি ওড়াবার খুব শখ। এই বিশ্বকর্মা পূজার দিনেও সে সারাদিন ঘুড়ি উড়িয়ে চোখ লাল করেছে। রাস্তায় চলতে চলতে আকাশে ঘুড়ির প্যাঁচ চলতে দেখলে তার চোখ আটকে যায়। কিন্তু এরকম বয়স্ক দুজন লোককে ঘুড়ি ধরার জন্য রাস্তার মাঝখানে লাফাতে সে আগে কখনও দেখেনি।
আরও দুতিনটে বাচ্চাকাচ্চা ছেলেও সেখানে ছুটে গেছে ঘুড়িটা ধরার লোভে। তাদের হাতে কঞ্চি ও আঁকশি। সেইরকম একটা ছেলের আঁকশিই। প্রথম ঘুড়িটাকে ছোঁয়, কিন্তু জিপগাড়ির লোকদুটির মধ্যে যে বেশি লম্বা সে লাফিয়ে ঘুড়িটাকে ধরে নেয়।
তারপর ওদের সঙ্গে বাচ্চা ছেলেদের ঝগড়া লেগে যায়।
সন্তুর আবার হাসি পায়। জোজো এই লোকদুটোকে স্পাই ভেবেছিল!
অরিন্দমকে সে বলল, দেখলি জোজোর কাণ্ডটা?
জোজো রাস্তার মোড়ে চলে গিয়ে একটা দোকানের আড়ালে দাঁড়িয়ে উঁকি মারছে। এবারে ওদের দেখে হাতছানি দিল।
সন্তু অরিন্দমকে আবার বলল, জোজোর এই সব কায়দার মানে কী, বুঝলি তো? ও আমাদের ওর বাড়ির মধ্যে নিয়ে যেতে চায় না।
অরিন্দম বলল, তুই ঠিক বলেছিস, সন্তু। এর আগে আমি দুতিনবার জোজোর কাছে এসেছি। প্রত্যেকবারই জোজো আমার সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছে। কেন এরকম করে বল্ তো?
সন্তু বলল, তার মানে, জোজো চায় না ওর বাবার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে যাক। ও যত গুলটুল মেরেছে, সব তা হলে ধরা পড়ে যাবে।
অরিন্দম মোড়ের মাথায় এসে বলল, এই জোজো, তুই আমাদের স্পাই-এর মুখে ফেলে পালিয়ে এলি?
জোজো চোখ বড়বড় করে বলল, চুপ! আস্তে। সাবধানের মার নেই। বুঝলি? শাইরা কখন কী সেজে থাকে, কিছু বলা যায় না। তোরা সঙ্গে আছিস বলেই ওই লোকদুটো অন্যরকম হয়ে গেল। নইলে আমি ডেফিনিট যে, ওরা আমাদের বাড়ির ওপরেই নজর রাখছে!
অরিন্দম বলল, তা বলে দিনের বেলা তোর বাড়ির সামনে থেকে তোকে ধরে নিয়ে যাবে? তুই কি বাচ্চা, না এটা মগের মুল্লুক?
জোজোদের পাশের বাড়ি থেকে এক ভদ্রলোক আর এক ভদ্রমহিলা বেরিয়ে জিপ গাড়িতে উঠলেন। তারপরেই গাড়িটা স্টার্ট দিল।
সন্তু বলল, ওই যে চলে গেল স্পাইদের গাড়ি!
জোজো তখনও বলল, তোরা আমার কথা বিশ্বাস করছিস না? আমাদের ওই পাশের বাড়িটা কী ডেঞ্জারাস না, জানিস না তো! প্রত্যেক মাসে ওই বাড়িতে ভাড়াটে পাল্টায়। কেন জানিস, আমাদের বাড়ির ওপর নজর রাখবার জন্য! একদিন দেখি যে, ওরা ওদের ছাদের ওপর একটা র্যাডার বসাচ্ছে। আমাদের বাড়ির ছবিটবি সব তুলে নেবে ভেবেছে!
সন্তু বলল, র্যাডার? পাশের বাড়ির ছবি তোলার জন্য র্যাডার লাগে বুঝি?
জোজো বলল, আজকাল সায়েন্সের কতরকম উন্নতি হয়েছে তোরা জানিস না! অন্ধকারে ছবি তোলা যায়। শুধু শব্দ শুনে তা থেকে ছবি ফুটিয়ে তোলা যায়। রেডিও ফোটো কী ভাবে আসে? সাউন্ডে আসে।
অরিন্দম বলল, তা হলে তোদের বাড়ির সব ছবি পাশের বাড়ি থেকে তুলে নিল! তুই গিয়ে কয়েকখানাছবি চাইলেই পারিস।
জোজো বলল, আমাদের সঙ্গে অত সস্তায় বাজিমাত করা যায় না। বারুইপুরের পিসেমশাইকে খবরটা দিতেই উনি একখানা অ্যান্টিরাডার যন্ত্র ফিট করে দিলেন আমাদের বাড়ির কাছে। ব্যস, এখন ওদের সব ছবি ভুল উঠবে।
সন্তু বলল, যাক্ গে, এসব কথা শুনে আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছে। আসলে যে কাজের জন্য এসেছি, তোর বারুইপুরের পিসেমশাই-এর ঠিকানাটা লিখে দে।
জোজোর কাছে কাগজ নেই, অরিন্দমের পকেটের একটা নোট বই থেকে পাতা ছিঁড়ে জোজো লিখে দিল ঠিকানাটা।
তারপর ফিসফিস করে বলল, এটা খুব সিক্রেট। আর কাউকে দেখাসনি?
সন্তু আর অরিন্দম দুজনেই হেসে ফেলল আবার। ওরা বারুইপুরে অংশুমান চৌধুরীর বাড়ি দেখে এসেছে। ঠিকানাটা অতি সাধারণ চৌধুরী লজ, বারুইপুর, এটা এমন কী গোপন ব্যাপার হতে পারে।
সন্তু বলল, ঠিক আছে, আর কাউকে বলব না। এবারে যাই।
জোজো বলল, তোরা এই দুপুর রোদ্দুরে এসেছিস, চল, তোদের কপিলের শরবত খাওয়াই। আমাদের পাড়ার এই শরবত ওয়ার্ল্ড ফেমাস। পেলে যখন কলকাতায় ফুটবল খেলতে এসেছিল, তখন তাকে এই শরবত খাওয়ানো হয়েছিল। মস্ত বড় সার্টিফিকেট দিয়ে গেছে।
সন্তুদের বাড়িতে তার কোনও বন্ধু এলে সন্তুর মা-ই শরবত বানিয়ে দেন কিংবা অন্য খাবারটাবার দেন। কিন্তু জোজোর ব্যাপারই আলাদা। সে বন্ধুদের খাওয়াতে নিয়ে এল একটা দোকানে।
দোকানটি তেমন বড় নয়, সেরকম সাজানো-গোছানোও নয়। দেওয়ালে ঝুলকালি জমে আছে। কাউন্টারে যিনি বসে আছেন তাঁর খালি গা। দেওয়ালে একটি মা কালীর ছবি আর একটি লম্বা তালগাছের।
শরবত অবশ্য খেতে মন্দ না।
অরিন্দম জিজ্ঞেস করল, পেলের সার্টিফিকেটটা কোথায় রে? দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখেনি?
জোজো মুখটা ঝুঁকিয়ে এনে বলল, তুই কি পাগল হয়েছিস? পেলে এই দোকানে আসবে? পেলে এসেছিল আমার বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমাদের বাড়িতে। এই দোকান থেকে বানিয়ে তাকে শরবত খাওয়ানো হয়েছিল। পেলে এত মুগ্ধ হয়ে গেল যে তক্ষুনি লম্বা সার্টিফিকেট লিখে দিল। এমন দামি জিনিস কি হাতছাড়া করা যায়? সেটা আমরাই রেখে দিয়েছি। এই দোকানের মালিককে দিইনি। মাঝে মাঝে দেব দেব বলি অবশ্য।
সন্তু বলল, তোর সঙ্গে দেখা হলে সময়টা বেশ কেটে যায় রে!
আরও কিছুক্ষণ গল্প করার পর সন্তু বাড়ি চলে এল। বিকেলবেলা তার পাড়ার ক্লাবে ব্যাডমিন্টন খেলার কথা।
কিন্তু সন্ধের আগেই বৃষ্টি নেমে গেল। মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল খেলা। ক্লাবঘরে সন্তু খানিকটা বসে রইল। যদি বৃষ্টি থামে। তা আর হল না, সেই যে আকাশ অন্ধকার হয়ে গেল আর আলো ফুটল না, বৃষ্টিও থামল না।
বৃষ্টিতে ভিজতে সন্তুর খুব ভাল লাগে। র্যাকেটটা ক্লাবে জমা রেখে সন্তু বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। বৃষ্টির তেজ কম। সন্তুদের বাড়ি মাত্র পাঁচ সাত মিনিটের পথ। বাড়ির কাছাকাছি এসে সন্তু দেখল, তাদের বাড়ির দরজার কাছে দুটি লোক দাঁড়িয়ে আছে, আর তার কুকুরটা এক টানা ডেকে চলেছে।
সন্তু জোরে পা চালিয়ে এসে পড়তেই অবাক হয়ে দেখল, এই লোকদুটি দুপুরবেলার সেই ঘুড়ি ধরা লোক দুটি, কাছেই দাঁড়িয়ে আছে একটা নীল রঙের জিপ গাড়ি।
লম্বা লোকটি বলল, আচ্ছা ভাই, তোমার নামই তো সন্তু? তোমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি। তোমার জন্য একটা খবর আছে।
সন্তু গম্ভীরভাবে বলল, বলুন!
লম্বা লোকটি বলল, রাজা রায়চৌধুরী তোমার কাকা হন তো?
সন্তু মাথা হেলাল।
অন্য লোকটি বলল, উনি একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এক জায়গায়। তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এ-কথাটা অন্য কাউকে বলতে বারণ করেছেন। তুমি বাড়িতে ছিলে না, তাই আমরা অপেক্ষা করছি।
সন্তুর ভুরু কুঁচকে গেল। এটা এমন একটা সস্তা কায়দা যে আজকাল এসব কেউ বিশ্বাস করে না। কলকাতা শহরের মধ্যে কাকাবাবু এক জায়গায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আর সন্তুকে ডেকে পাঠিয়েছেন? কলকাতায় কি কাকাবাবুর চেনাশুনো মানুষের অভাব? তিনি এইভাবে অচেনা লোককে দিয়ে ডেকে পাঠাবেন কেন?
সন্তু জিজ্ঞেস করল, উনি কোথায় আছেন?
লম্বা লোকটি বলল, উনি ন্যাশনাল লাইব্রেরির কাছে বাসে উঠতে গিয়ে পড়ে গেছেন, কোমরে চোট লেগেছে। ওঁর চেনা একজন লোক দেখতে পেয়ে আলিপুরের একটা নার্সিংহোমে ভর্তি করে দিয়েছেন। টেলিফোনে তোমাদের বাড়িতে খবর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু লাইন পাওয়া যায়নি।
ন্যাশনাল লাইব্রেরির কথা শুনে সন্তু একটু বিচলিত হল। কাকাবাবু প্রায় রোজই এখন ওখানে যাচ্ছেন। এই লোকদুটো সেই খবর রাখে।
কাকাবাবু সন্তুকে পরিষ্কার করে দিয়েছেন, এইরকমভাবে কোনও অচেনা লোক এসে কাকাবাবুর নাম করে সন্তুকে কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে সে যেন কখনও না যায়। কিন্তু কাকাবাবুর তো সত্যি কোনও দুর্ঘটনা হতে পারে হঠাৎ! বাস থেকে পড়ে গিয়ে যদি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন…
সে জিজ্ঞেস করল, নার্সিংহোমটার নাম কী বলুন তো?
লম্বা লোকটা সঙ্গে সঙ্গে বলল, প্যারাডাইস নার্সিংহোম, তেইশ নম্বর আলিপুর রোড সাত নম্বর কেবিন!
সন্তু বলল, আপনারা একটু দাঁড়ান, আমি বাড়ির ভেতর থেকে আসছি।
ভেতরে ঢুকে সে তার কুকুরটাকে চুপ করাল। মা ছাড়া বাড়িতে আর কেউ নেই। মাকে কি এই ঘটনাটা জানানো উচিত। মা শুধুশুধু চিন্তা করবেন। মা সন্তুকে একা যেতে দিতে রাজি হবেন না। পুলিশে খবর দিতে চাইবেন।
কিন্তু বিপদ সন্তুকে হাতছানি দেয়। এই লোকদুটো কী মতলবে এসেবে তা জানার জন্য সন্তুর দারুণ কৌতূহল হল। সে আর দেরি করতে পারছে না।
সে এই ব্যাপারটা সংক্ষেপে একটা কাগজে লিখে ফেলল খসখস করে। তারপর কাগজটা চাপা দিয়ে রাখল কাকাবাবুর টেবিলে।
সিড়ি দিয়ে আবার নামতে নামতে সে চেঁচিয়ে বলল, মা, আমি একটু ঘুরে আসছি।
মা বাথরুমে। তিনি বললেন, এই মাত্র ফিরেই আবার বেরুচ্ছিস যে, কোথায় যাচ্ছিস?
সন্তু বলল, আসছি, একটু বাদেই আসছি।
বাইরে এসে সে লোকদুটির সঙ্গে জিপ গাড়িতে চড়ে বসল। তারপর সে লম্বা লোকটিকে বলল, আপনাদের আমি দুপুরে এক জায়গায় দেখেছি। সত্যিকারের ব্যাপারটা কী বলুন তো?
লম্বা লোকটি হেসে সন্তুর কাঁধ চাপড়ে বল, আমরা ভাল লোক। তোমার কোনও ভয় নেই। তোমার কোনও বিপদ হবে না।
সত্যিই আলিপুরের একটা নার্সিংহোমের সামনে এসে থামল জিপ গাড়িটা। বৃষ্টি এখনও পড়ে চলেছে। লোডশেডিং-এর জন্য রাস্তাঘাট ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু গাড়ির হেড লাইটে দেখা যায় এই বৃষ্টির মধ্যেও রাস্তায় লোকজনের আসা যাওয়ার বিরাম নেই।
সন্তুর খিদে পেয়ে গেছে বেশ। ব্যাডমিন্টন খেলার পরেই বাড়ি ফিরে তার কিছু খাওয়া অভ্যেস। এখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। সেই দুপুরবেলা জোজো এক গেলাস শরবত খাইয়েছিল, তারপর আর কিছু খাওয়া হয়নি। সেই শরবতটা নাকি হজমি শরবত, তাতে পেটের সব কিছু হজম হয়ে গেছে!
গাড়িটা পার্ক করার পর লম্বা লোকটি সন্তুকে বলল, নেমে এসো ভাই; খুব বেশি দেরি হয়নি, কী বলল? আশা করি, তোমার কাকাবাবু ভাল আছেন।
নার্সিংহোমের সামনেই খয়েরি রঙের সুট পরা একজন বেশ রাশভারী চেহারার লোক দাঁড়িয়ে। লম্বা লোকটি তার কাছে গিয়ে বলল, ছেলেটিকে নিয়ে এসেছি, স্যার। কোনও ঝঞ্ঝাট হয়নি।
লোকটি সন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, এসো আমার সঙ্গে। তোমার কাকাবাবু ভাল আছেন।
লম্বা লোকটি বলল, আমাদের কাজ শেষ ততো স্যার? এবার আমরা যেতে পারি?
হ্যাঁ, ঠিক আছে। আমাদের টাকাটা স্যার?
স্যুট-পরা লোকটি পকেট থেকে একটা খাম বার করে লোকটির হাতে দিয়ে বলল, এই নাও, তোমাদের পুরো পেমেন্ট আছে।
কাল আবার লাগবে?
না, আপাতত লাগবে না। আবার দরকার হলে তোমাদের খবর দেব। লম্বা লোকটি সন্তুর দিকে হাত নেড়ে বলল, চলি ভাই!
স্যুট-পরা লোকটি ভুরু কুঁচকে হাতের ঘড়ি দেখল। যেন সে আর কারও জন্য অপেক্ষা করছে।
কাকাবাবুর সঙ্গে অনেক জায়গা ঘুরে, অনেকরকম মানুষজন দেখে সন্তু খানিকটা লোক চিনতে শিখেছে। কোন্ মানুষটা ভাল আর কোন্ মানুষটার মন হিংসে আর লোভে ভরা, তা সন্তু প্রথম দেখেই বুঝতে পারে। এই স্যুট-পরা লোকটিকে তার খারাপ লোক বলে মনে হল না।
কিন্তু এর পরেই সে লোকটির মুখ থেকে এক আশ্চর্য কথা শুনল।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু কত নম্বর ক্যাবিনে আছেন? কোন্ তলায়?
লোকটি সন্তুর মুখের দিকে তাকিয়ে একটুখানি, হেসে বলল, তোমার কাকাবাবু এখানে নেই। তোমাকে একটা মিথ্যে কথা বলে এখানে আনানো হয়েছে। ভয়ের কিছু নেই। তোমার সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার করবে না।
সন্তু প্রায় স্তম্ভিত হয়ে গেল। এই লোকটা বলে কী? কলকাতা শহরের রাস্তায় সন্ধেবেলা দাঁড়িয়ে বলছে যে, সন্তুকে সে মিথ্যে কথা বলে নিয়ে এসেছে? সন্তু এক্ষুনি চেঁচিয়ে উঠে লোক জড়ো করে লোকটাকে ছেলে ধরা বলে ধরিয়ে দিতে পারে!
সন্তু ততটা বাচ্ছা নয় যে, তাকে ছেলেধরায়, ধরে আনবে। সন্তু এক্ষুনি চলে যেতে চাইলে এই লোকটার সাধ্য আছে ধরে রাখার?
সন্তু বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, তার মানে? আমাকে মিথ্যে কথা বলে এখানে নিয়ে আসার কারণটা কী?
লোকটি বলল, ঠিক মিথ্যে কথাও নয়। তোমার কাকাবাবুর এখানে এসে পড়ার কথা ছিল। দুজন লোক পাঠিয়েছিলাম ওঁকে নিয়ে আসার জন্য। উনি যদি সহজে আসতে রাজি না হন, যদি ধস্তাধস্তি হয়, উনি গায়ে-মাথায় চোট পান, তা হলে এই নার্সিং হোমে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করে রেখেছিলাম। কিন্তু উনি এলেন না, লোকদুটো ফিরল না। কী যে হল বুঝতে পারছি না। আজকাল এইসব লোকজনও অপদার্থ! টাকাও নেবে, কাজও করবে না!
সন্তুর ক্রমশ ভুরু ওপরে উঠে যাচ্ছে। ঠাণ্ডাভাবে এসব কী বলছে লোকটা?
কাকাবাবুকে জোর করে ধরে আনতে পাঠিয়েছেন? কেন?
কোনও খারাপ মতলবে নয়। এই একটু কথাবার্তা বলার জন্য। এখন কী করা যায় বলো তো?
কিছু মনে করবেন না, আপনি কি পাগল?
একথা কেন জিজ্ঞেস করছ ভাই? আমাকে দেখে কি পাগল মনে হয়!
অন্ধকারে আপনাকে ভাল দেখতে পাচ্ছি না। প্রথমে তো ভালই মনে হয়েছিল কিন্তু এখন আপনার কথাবার্তা শুনে…কাকাবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা বলার জন্য তো আমাদের বাড়িতে গেলেই পারতেন। তার বদলে জোর করে ধরে আনা..
তোমার কাকাবাবু যে বড্ড গোঁয়ার। এমনিতে কথাবার্তা শুনতে চান।
আমি চলি!
কোথায় যাবে?
বাড়ি ফিরে যাব। এখান থেকে ভবানীপুরে কত নম্বর বাস যায়?
লোকটি আবার ঘড়ি দেখল। একটা দোকানের আলো একটু একটু রাস্তায় পড়েছে, ঘড়ি দেখবার জন্য লোকটিকে সেই আলোর কাছে যেতে হল। তারপর ফিরে এসে চিন্তিতভাবে বলল, তুমি যদি যেতে চাও, যেতে পারো। কোন্ বাস যায় আমি ঠিক বলতে পারব না। বাসস্ট্যান্ডে ফিরে জেনে নাও। তবে, আমার মনে হয় তোমার কাকাবাবুকে হাওড়া স্টেশনেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সন্তু আবার চমকে উঠে বলল, হাওড়া স্টেশনে, কেন?
কথা ছিল, তোমার কাকাবাবুকে এখানে আনা হবে প্রথমে, তোমাকেও আনিয়ে নেওয়া হবে। তারপর সবাই মিলে হাওড়া যাওয়া হবে। ট্রেনের টিকিট কাটা আছে। এখন মনে হচ্ছে, কোনও কারণে ওরা সোজাসুজি হাওড়াতেই চলে গেছে।
আমাদের ট্রেনে করে কোথায় নিয়ে যাবেন?
তা বেশ দূর আছে।
কাকাবাবু তো আমায় বাইরে যাওয়ার কথা কিছু বলেননি?
উনি কি আর এমনি যেতে চাইবেন? ওঁকে অজ্ঞান করে নিয়ে যাওয়া হবে। তোমাকে অবশ্য অজ্ঞান করবার দরকার নেই। কাকাবাবু সঙ্গে থাকলে তুমি এমনি এমনিই যেতে চাইবে।
আপনার সমস্ত কথাই আমার গাঁজাখুরি মনে হচ্ছে।
তুমি বাড়ি চলে যেতে পারো। আসলে তোমাকে আমাদের সে রকম কোনও দরকারই নেই। তোমার পড়াশুনা নষ্ট করে শুধু শুধু অনেকগুলো দিন বাইরে কাটাবার কোনও মানে হয় না। এই কথাই আমি সবাইকে বলেছিলাম। তা ওরা বলল, তুমি নাকি তোমার কাকাবাবুর সঙ্গে সব জায়গায় যাও। তুমি সঙ্গে না থাকলে ওঁর অসুবিধে হবে। সেই জন্যই তোমাকে আনা।
লোকটি আর একবার ঘড়ি দেখে বলল, না, আর দেরি করা যায় না। আমাকে হাওড়া স্টেশনে যেতেই হবে। আর এক ঘণ্টার মধ্যে ট্রেন ছাড়বে। তোমার কাকাবাবুকে আমি বলব, তুমি আসতে রাজি হওনি।
কাকাবাবুকে অজ্ঞান করে ধরে নিয়ে যাওয়া এত সোজা ভেবেছেন?
আপনাদের মাথা খারাপ?
একটা ইঞ্জেকশানের তো মামলা। অন্ধকার রাস্তায় পেছন থেকে টপ করে একটা ইঞ্জেকশান দিয়ে দিলে উনি আর কী করবেন? তবে ওঁর কোনও ক্ষতি হবে না, এটা আমি বলে দিচ্ছি। তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যেতে পারো।
আপনারা কোন ট্রেনে যাবেন?
নটা পাঁচের ট্রেনে।
আমি হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে দেখতে চাই আপনার কথা সত্যি কি!
আমি একদম মিথ্যে কথা বলি না। যেতে চাও, চলো! কাছেই দাঁড়ানো একটা গাড়ির দরজা খুলে লাকটি বলল, এসো!
একটু আগেই সন্তু ভেবেছিল, সে মানুষ চেনে। এখন সে এই লোকটিকে কিছুই বুঝতে পারছে না। লোকটির কথাবাতা মোটেই গুণ্ডা বদমাশদের মতন নয়। লেখাপড়াজানা ভদ্রলোকের মতন, অথচ সে ঠাণ্ডা মাথায় কাকাবাবুকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া, অজ্ঞান করা এই সব বলছে!
সন্তু আরও ভাবল, এই লোকটি তাকে এখন জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে না। সে যাচ্ছে নিজের ইচ্ছেতে। কিন্তু না গিয়েই বা উপায় কী? এইসব কথা শুনে নিশ্চিন্তভাবে বাড়িতে ফিরে যাওয়া যায়?
ড্রাইভার নেই, গাড়ি চালাচ্ছে লোকটি নিজেই। কিছুদূর আসবার পর, লোডশেডিং-এর এলাকা ছাড়িয়ে আলো-ঝলমল একটা পাড়ায় এসে লোকটি বলল, কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস কিনে নিয়ে যেতে হবে। সামনেই একটা বড় দোকান আছে। তোমার কাকাবাবু চা বেশি ভালবাসেন, না কফি?
সন্তু বলল, কফি।
উনি চিনি খান নিশ্চয়ই। মিষ্টি বিস্কুট না নোনতা বিস্কুট? তুমি চকোলেট ভালবাস নিশ্চয়ই?
লোকটি এমনভাবে কথা বলছে যেন সে সন্তু কাকাবাবুর কোনও আত্মীয়। গাড়ি থামিয়ে একটা দোকানে ঢুকে লোকটি বেশ অনেকক্ষণ দেরি করল। এদিকে বলছিল ট্রেনের সময়ের আর বেশি দেরি নেই।
একটা মস্ত বড় প্যাকেট নিয়ে ফিরে এসে লোকটি বলল, যা সব কিছুই পাওয়া গেছে। আর কোনও চিন্তা নেই। তুমি একটা চকোলেট খাবে নাকি এখন?
লোকটি পকেট থেকে একটা চকোলেট বার বার করে এগিয়ে দিতে সন্তু আর আপত্তি করল না। তার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে।
হাওড়া স্টেশনে ট্র্যাফিক জ্যাম। সন্তুরই উদ্বেগ হতে লাগল। যদি ট্রেন ছেড়ে যায়। লোকটি কিন্তু গাড়ির ইঞ্জিন থামিয়ে নিশ্চিন্তে একটা সিগারেট ধরিয়ে তারপর বলল, তুমি রাত্তিরে বাড়ি না ফিরলে তোমার মা চিন্তা করবেন তো? ঠিক আছে, আমরা তোক দিয়ে খবর পাঠিয়ে দেব।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, ট্রেন ছাড়তে আর কত দেরি?
আর দশ মিনিট আছে। তবে, আমি না পৌঁছলে ট্রেন ছাড়বে না। আমাদের লোক আছে, চেন টেনে দেবে।
একটু বাদেই আবার গাড়ি চলল। লোকটি নিজের গাড়ি নিয়ে ঢুকে গেল স্টেশনের মধ্যে। তারপর নেমে পড়ে বলল, ন নম্বর প্ল্যাটফর্ম!
দুজনকে দৌড়তে হল এবার। আর মাত্র এক মিনিট বাকি। ফার্স্টক্লাস কামরার সামনে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, স্যুট-পরা লোকটিকে দেখে তারা হাত তুলল।
লোকটি জিজ্ঞেস করল, তোমরা সরাসরি এখানে চলে এসেছ? নার্সিং হোমের সামনে আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি!
অন্য লোকটি বলল, কী করব, প্ল্যানটা যে পাল্টে গেল।
এখন সব ঠিকঠাক আছে?
হ্যাঁ।
মিঃ রাজা রায়চৌধুরী, মানে, এই ছেলেটির কাকাবাবুকে আনা হয়েছে?
হ্যাঁ স্যার।
ঠিক আছে, গাড়ির চাবি নাও। গাড়ি গ্যারাজে তুলে রাখবে। যাওয়ার পথে মিঃ চৌধুরীর বাড়িতে একটা খবর দিয়ে যাবে। বলবে যে, সন্তু সম্পর্কেও চিন্তা বা ভয়ের কিছু নেই। দিন দশেকের মধ্যেই ফিরে আসবে।
স্যুট-পরা লোকটি সন্তুর দিকে তাকাতেই সন্তু বলল, আমি আগে একবার দেখতে চাই কাকাবাবু সত্যি আছেন কি না!
ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি ওঠো। গার্ড হুইশ্ল দিয়েছে।
ট্রেনে উঠে লোকটি বলল, একদম ধারের কুপে। নম্বর হল এক।
সন্তু দৌড়ে গেল সে দিকে। ট্রেন নড়তে শুরু করে দিয়েছে। এখনও সন্তু ইচ্ছে করলে লাফিয়ে নেমে পড়তে পারে। এক নম্বর কুপেটির দরজা বন্ধ। সন্তু ভোলার জন্য টানাটানি করতে লাগল। দরজায় দুমদুম করে ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগল, কাকাবাবু! কাকাবাবু! ভেতরে কে, খুলুন, খুলুন!
ট্রেন ততক্ষণ প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে গিয়ে স্পিড নিয়েছে।
কুপের দরজা খুলল একজন মোটাসোটা মাঝবয়েসী লোক। খাকি প্যান্টের ওপর সাদা হাওয়াই শার্ট পরা, মুখভর্তি দাড়ি। সন্তুর সঙ্গে যেন অনেক দিনের চেনা, এইভাবে বলল,এসো!
দরজা খোলা মাত্র সন্তু ভেতরটায় চোখ বুলিয়ে নিয়েছে। একদিকের সিটে কে যেন চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে, কিন্তু কাকাবাবু নন। কাকাবাবু লম্বা-চওড়া মানুষ, যে শুয়ে আছে সে মোটামুটি সন্তুর সমান। মুখটা চেনা যাচ্ছে না।
কাকাবাবু এখানে নেই! সন্তুকে মিথ্যে কথা বলে নিয়ে আসা হয়েছে!
প্রথম থেকেই সন্তুর এরকম সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু আলিপুরে যে লোকটির সঙ্গে দেখা হল, যে গাড়ি করে সন্তুকে হাওড়া স্টেশনে নিয়ে এল, তাকে সন্তুর খারাপ লোক বা মিথ্যেবাদী বলে মনে হয়নি। তা হলে সন্তুর এতটা ভুল হল।
সন্তু পেছন ফিরে তাকাল। ট্রেন বেশ জোরে চলতে শুরু করেছে। এখন আর লাফিয়ে নেমে পড়া যায় না।
একটুও ভয় না পেয়ে সন্তু রাগী গলায় জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? কাকাবাবু কোথায়?
খাকি প্যান্ট পরা লোকটি অবাকভাবে বলল, কাকাবাবু? কে ভাই তোমার কাকাবাবু?
সন্তু আবার জোর দিয়ে বলল, আমার কাকাবাবুর নাম রাজা রায়চৌধুরী, তিনি কোথায়?
আমি তো ভাই তোমার কাকাবাবুকে চিনি না। তিনি কোথায় তা আমি জানব কী করে? তুমি এসো ভেতরে এসে বোসো!
তা হলে কি কাকাবাবু অন্য কোনও কুপেতে আছেন?
তাও তো আমি জানি না। তোমার কাকাবাবু এই ট্রেনে চেপেছেন বলে মনে হয় না। তা হলে আর আমাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হবে কেন?
সন্তু অন্য কুপেগুলিতে উঁকি মেরে এল। সব কটারই দরজা খোলা। তার মধ্যে দুটি একদম খালি। অন্যগুলোতে অন্য যাত্রীরা রয়েছে। যে লোকটি সন্তুকে হাওড়ায় নিয়ে এসেছে। সেও এই কামরায় কোথাও নেই। সে ওঠেনি। দরজার কাছে খাবারদাবারের প্যাকেট পড়ে আছে।
খাকি প্যান্ট পরা লোকটি সেই প্যাকেটটি তুলে নিয়ে সন্তুকে বলল, এসো। কিছু খেয়েটেয়ে নেওয়া যাক।
সন্তুর মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে। তাকে এইভাবে মিথ্যে কথা বলে ট্রেনে তোলা হল কেন? কারা এসব করছে। এতে তাদের কী লাভ? সন্তু কি ছেলেমানুষ নাকি? সে তো পরের স্টেশনেই নেমে পড়তে পারে। তাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সে অন্য যাত্রীদের কাছে সাহায্য চাইবে।
সে খাকি প্যান্ট পরা লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, ব্যাপারটা কী আমি জানতে চাই। আমাকে কেন এই ট্রেনে ভোলা হল?
খাকি প্যান্ট পরা লোকটি হেসে বলল, আমার ওপর রাগ করছ কেন?
আমি ব্যাপার স্যাপার কিছুই জানি না। আমাকে প্রশ্ন করলেও উত্তর দিতে পারব না।
আমার ওপর শুধু ভার পড়েছে তোমাদের দুজনকে এক জায়গায় পৌঁছে দেওয়া। তোমাদের কোথাও অযত্ন হবে না।
কোথায় পৌঁছে দেওয়া?
সেটা বলতে পারি। এখন বলতে কোনও ক্ষতি নেই। সম্বলপুরে।
সম্বলপুরে? সেখানে গিয়ে আমি কী করব?
তা তো ভাই আমি জানি না। সম্বলপুরে তোমাদের নিতে অন্য লোক আসবে। আমি তোমাদের হ্যান্ডওভার করেই ফেরত ট্রেনে চলে আসব। সুতরাং সম্বলপুরে গিয়ে তুমি কী করবে, তা তো আমি জানি না।
সম্বলপুরে আমি যাব কেন? আমি পরের স্টেশনেনেমে যাব।
লোকটি কয়েক পলক সন্তুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর নিজের দাড়ি চুলকে বলল, সেটা একটা কথা বটে। তুমি যদি যেতে না চাও, তা হলে কি আমি তোমাকে জোর করে আটকে রাখব? সেরকম কোনও কথা তো আমাকে বলা হয়নি। আর অল্পবয়েসী ছেলেদের ওপর জোরজার করা আমি পছন্দ করি না। তোমার যেতে ইচ্ছে না হলে যেও না। আমি সম্বলপুরে গিয়ে বলব দুজনের বদলে একজন এসেছে!
আর একজন কে?
নামটাম কিছু জানি না। তোমার নামও তো জানি না। ওই ওখানে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। পরের স্টেশন তো খঙ্গাপুর, পৌঁছতে অনেক দেরি আছে। ততক্ষণ তুমি ভেতরে এসে বোসো!
সন্তু ভেতরে এসে চাদর ঢাকা লোকটির দিকে তাকাল। তার মুখটা দেওয়ালের দিকে। অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
খাকি প্যান্টপরা লোকটি খাবারের প্যাকেটটি খুলে বলল, বাঃ বাঃ, অনেক কিছু দিয়ে দিয়েছে। ভাল স্যান্ডউইচ আছে। এই যে ভাই, খাবে নাকি? খাও, খাও, খাবারের ওপর রাগ করতে নেই।
একখানা চকোলেট খেয়ে সন্তুর খিদে মেটেনি। খাবার দেখেই তার খিদে আবার বেড়ে গেল। কিন্তু এদের খাবার কি খাওয়া উচিত?
বেশি চিন্তা না করে সন্তু দুখানা স্যান্ডউইচ হাতে তুলে নিল।
লোকটি জিজ্ঞেস করল, পরের স্টেশনে নেমে তুমি কি বাড়ি ফিরে যাবে? ট্রেনের টিকিট কাটার সময় আছে?
সে আমি বুঝব!
আমি তোমাকে গোটা দশেক টাকা দিতে পারি। ধার হিসেবেই নিও। আমার ঠিকানা দিয়ে দেব। যদি পারো কখনও ফেরত পাঠিও!
সন্তুর আবার খটকা লাগল। এ কী ধরনের লোক এরা? মিথ্যে কথা বলে, অন্যায়ভাবে তাকে ট্রেনে চাপিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি কিংবা কোনওরকম জোরও করেনি। এমনকী সন্তু ফিরে যেতে চাইলে ট্রেনের টিকিট কাটার পয়সা দিয়ে দেবে বলছে?
স্যান্ডউইচ দুটো খেয়ে নিয়ে সন্তু জিজ্ঞেস করল, আপনি কে, তা কি জানতে পারি?
লোকটি বলল, হ্যাঁ, কেন জানতে পারবে না। আমি তো চার-ডাকাত নই। যে নাম লুকোব। আমার নাম মনোহর দাস। একটা সিকিউরিটি সার্ভিস অফিসে কাজ করি। আমাদের কাজ হল, লোকের দামিদামি জিনিসপত্র পাহারা দেওয়া। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা আনা, কোনও লোক হারিয়ে গেলে খুঁজে বার করা, এইসব। এখন আমার ডিউটি পড়েছে, তোমাদের দুজনকে ভালভাবে সম্বলপুরে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু জোর করে ধরে নিয়ে যেতে হবে, সেরকম কোনও ইনস্ট্রাকশান দেওয়া হয়নি। তোমাকে কি কেউ জোর করে ট্রেনে তুলেছে? তুমি তো একাই এসেছ দেখছি।
আমাকে মিথ্যে কথা বলে আনা হয়েছে।
সে তোমায় কে কী বলেছে, তা বাপু আমি জানি না। খুপুরেই নেমে পড়ো তাহলে। এখনও ফেরার অনেক ট্রেন পাবে।
ঘুমন্ত লোকটি একটা শব্দ করে পাশ ফিরল। এবারে সন্তু এমন চমকে গেল যে তার বুকটা কাঁপতে লাগল ভূমিকম্পের মতন।
মুখ থেকে চাদরটা সুরে গেল। ঘুমন্ত লোকটি আর কেউ নয়, তার বন্ধু জোজো!
সন্তু ভাবল, তা হলে এই সব কি জোজোর কারসাজি? জোজো এইভাবে কোনও প্র্যাকটিক্যাল জোক করেছে! জোজোটাকে নিয়ে আর পারা যায় না।
সে উঠে গিয়ে জোজোর বুকে হাত দিয়ে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলল, এই জোজো, ওঠ! ওঠ! মটকা মেরে আর কতক্ষণ থাকবি।
জোজো কোনও সাড়া দিল না।
দুতিনবার ঝাঁকুনি দেওয়ার পর সন্তু বুঝতে পারল, জোজো ঘুমের ভান করে নেই। তার শরীরটা অসাড়, তার জ্ঞান নেই। সন্তু এবারে ভয় পেয়ে গেল।
সন্তু মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ওর কী হয়েছে?
মনোহর দাস উঠে এসে জোজোর নাকের কাছে হাত দিয়ে নিশ্বাস পরীক্ষা করে দেখল। জোজোর নাড়ি দেখল। তারপর বলল, না, চিন্তার কিছু নেই। অজ্ঞান হয়ে আছে। আমিও সেইরকম সন্দেহ করেছিলুম। ওরা ঘুমন্ত অবস্থায় শুইয়ে দিয়ে গেল। এমন অবেলায় কেউ কি অঘোরে ঘুমোতে পারে? ছিঃ, এইটুকু লোককে কি কারুর অজ্ঞান করা উচিত?
মনোহরবাবু, ওর কখন জ্ঞান ফিরবে?
তা তো বলতে পারব না ভাই। আমি তো ডাক্তার নই। তবে ঘণ্টা দুএকের বেশি লাগবে না মনে হয়।
সন্তু দ্রুত চিন্তা করতে লাগল। খঙ্গপুর পৌঁছবার আগে যদি জোজোর জ্ঞান ফেরে তা হলে সে নামবে কী করে? জোজোকে ফেলে চলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। কে কোন মতলবে তাকে আর জোজোকে একসঙ্গে ধরে নিয়ে যেতে চায়?
মনোহর দাস একটার পর একটা খাবার খেয়ে যাচ্ছে। একটু পরে সে বলল, এখন এক কাপ চা পেলে বেশ জমত। দেখা যাক খড়গপুরে চা-ওয়ালা পাওয়া যায় কি না। আমি এক কাজ করব, বুঝলে! খড়গপুরে অনেকক্ষণ ট্রেন থামবে। আমি এক কাপ চা খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ব তুমি তার পরে নেমে যেও। আমি সম্বলপুরে পৌঁছে বলব আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। সেই একফাঁকে একটি ছেলে নেমে গেছে। ব্যাস আমার আর কোনও দায়িত্ব রইল না। আমি ঘুমোতে পারব না, এরকম তো কোনও কথা নেই।
সন্তু বলল, কিন্তু আমার বন্ধুকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে আমি তো একলা নামতে পারি না।
এই লোকটি তোমার বন্ধু বুঝি?
হ্যাঁ, আমরা এক কলেজে পড়ি। কালকে ক্লাস আছে। আমাদের দুজনেরই আজ রাত্তিরেই বাড়ি ফেরা দরকার।
তোমরা দুজনেই চলে গেলে…সে বড় খারাপ ব্যাপার হয়ে যাবে। তাহলে আর আমার চাকরি থাকবে না। দুজনকে পৌঁছে দেওয়ার কথা, তার মধ্যে একজনও পৌঁছল না, তা কি হয়? তুমি শুধু তোমার দায়িত্ব নাও!
আপনি বুঝি আপনার কোনও বন্ধুকে এরকম অবস্থায় ফেলে পালাতে পারেন?
এটা বড্ড শক্ত প্রশ্ন করলে, ভাই। উত্তর দেওয়া খুব শক্ত। আমি এটা বুঝব কী করে, আমার তো কোনও বন্ধুই নেই। অফিসে যাদের সঙ্গে কাজ করি, তারা চান্স পেলেই ল্যাং মারে।
আপনি বলছেন, আপনি সিকিউরিটির লোক, তার মানে কি পুলিশ?
না, না। প্রাইভেট, প্রাইভেট কোম্পানি আমাদের। লোকে আমাদের ভাড়া করে। মনে করো, আমরা হচ্ছি ভাড়াটে দারোয়ান।
এরকম বিচ্ছিরি চাকরি করেন কেন?
অন্য চাকরি কে দেবে? তুমি দেবে? তোমার বাবাকে বলে দেবে তো?
আপনার সঙ্গে আর্মস আছে?
তা আছে ছোটখাটো। তবে বিশেষ কাজে লাগে না।
ছোটখাটো মানে? ছুরি না রিভলভার?
ধরে নাও দুটোই। রিভলভারের লাইসেন্স আছে বটে। কিন্তু এ পর্যন্ত একটাও গুলি ছুঁড়িনি। গুলির যা দাম!
ছুরি ব্যবহার করেছেন তা হলে?
ছুরিটা কাজে লাগে দড়িফড়ি কাটবার জন্য। এসব কথা জিজ্ঞেস করছ কেন? তোমাদের ওপর আমি ছুরি গোলাগুলি চালাব ভেবেছ? কখনও না! শেষকালে খুনের দায়ে পড়ি আর কী! তুমি তোমার বন্ধুকে নিয়েও যদি পালাতে চাও, তাতেও বাধা দেব না। চাকরি যায় যাক।
খড়গপুর স্টেশন এসে গেল। সন্তু আবার জোজোকে ধাক্কা মারল কয়েকবার। জোজোর জ্ঞান ফেরার কোনও চিহ্নই নেই। সন্তু অসহায়ভাবে তাকাতে লাগল এদিক-ওদিক। এখন সে কী করবে?
মনোহর দাস চা-ওয়ালা ডেকে পরপর দুভাঁড় চা খেল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সন্তুর দিকে সে আড়চোখে দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে।
একটু পরে সে বলল, যতদূর মনে হচ্ছে, বন্ধুকে ছেড়ে তুমি একলা যাবে! চমৎকার, এই তো চাই। এমন না হলে আর কিসের বন্ধুত্ব! বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। তুমি এক কাপ চা খাবে নাকি?
ট্রেন আবার চলতে শুরু করল।