০৫. জল্লাদের আবির্ভাব
জয়দ্রথের সর্বাঙ্গ তখন লৌহদস্তানার মুষ্টিপ্রহারে জর্জরিত। মাটির উপর অর্ধশায়িত অবস্থায় কোনোরকমে সে মুখ আর মাথা রক্ষা করছে।
অকস্মাৎ তার কানে এল কিঞ্জলের কণ্ঠস্বর, সরে যাও। তোমাদের কর্ম নয়। এই বজ্রমুষ্টিতে আমি দুষ্ট মল্লযোদ্ধার মস্তক চূর্ণ করব।
কাঁধের সুদৃঢ় মাংসপেশীর আড়াল থেকে গ্রীবা ঘুরিয়ে জয়দ্রথ দেখল তার মুখ লক্ষ্য করে উদ্যত হয়েছে কিঞ্জলের লৌহময় মুষ্টি। পরক্ষণেই সেই মুষ্টি সবেগে নামল তার মুখ লক্ষ্য করে। হাত তুলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করল জয়দ্রথ বাহুর মাংসপেশীর উপর পিছলে কিঞ্জলের লৌহদস্তানা শত্রুর মুখে আঘাত হানল। আঘাতের বেগ বাহুতে লেগে কিছুটা কমে গেল বটে, কিন্তু যেটুকু লাগল তাতেই চোখে অন্ধকার দেখল জয়দ্ৰথ। ক্রমাগত লৌহদস্তানার প্রহারে যে অবসন্ন হয়ে পড়েছিল, কিঞ্জলের মুষ্ট্যাঘাত এবার তার চেতনাকে প্রায় অবলুপ্ত করে দিল তার হাত সরে গেল মুখের উপর থেকে, মাথা ঝুঁকে পড়ল মাটির দিকে।
দ্বিপদ নেকড়ের দল হর্ষধ্বনি করে উঠল। কিঞ্জলের বাম হস্তের লৌহ-আবৃত বজ্রমুষ্টি শূন্যে দুলে উঠল নিষ্ঠুর পুলকে!
কিন্তু চরম আঘাত হানার আগেই তার বাম বাহু অসহ্য যাতনায় অসাড় হয়ে গেল। আর্তনাদ করে ডান হাত দিয়ে বাম বাহু চেপে ধরে কিঞ্জল সম্মুখে দৃষ্টিপাত করল।
আঘাতের কারণ আবিষ্কার করতে বিলম্ব হল না। কিঞ্জলের সঙ্গীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে এক কিশোর তার বাঁহাতে সুদীর্ঘ ছুরিকা নৃত্য করছে জীবন্ত বিদ্যুৎশিখার মত! সঙ্গে সঙ্গে দুর্বৃত্তদের মধ্যে জেগে উঠছে আর্তনাদের পর আর্তনাদ!
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই প্রত্যেকটি দুবৃত্তের বাঁহাত ছুরিকাঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গেল– ফলে অকর্মণ্য হয়ে গেল লৌহ-দস্তানার হিংস্র আস্ফালন!
এই বিদ্যুৎচকিত আক্রমণে স্তম্ভিত হয়ে গেল চারটি দুবৃর্ত। ডানহাত দিয়ে বাঁহাতের রক্তাক্ত ক্ষতস্থান চেপে ধরে তারা আক্রমণকারীর দিকে দৃষ্টিপাত করল।
শূন্যে রক্তাক্ত ছুরিকা আন্দোলিত করে কিশোর বলল, শোনো! সামান্য আঘাত দিয়ে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিলাম। এখনই স্থানত্যাগ না করলে আমার ছুরিকা বাহু ছেড়ে বক্ষে বিদ্ধ। হবে।
কিঞ্জলের এক সঙ্গী তাকে মৃদুস্বরে বলল, এই কিশোরের পিছনে নিশ্চয়ই অন্য লোক আছে। একাকী আমাদের আক্রমণ করতে ও সাহস পেত না।
কিঞ্জল ক্রুদ্ধস্বরে বলল, সপশিশু এমন অতর্কিতে ছোবল মারল যে, কিছু করার সুযোগ পেলাম না। আমার বাঁহাত ছুরিকাঘাতে অবশ হয়ে গেছে।
আর এক দুর্বৃত্ত বলল, আমার অবস্থাও তোমার মতো।
চতুর্থ ব্যক্তি বলল, আমার বাঁহাতও সম্পূর্ণ অকর্মণ্য। ছুরি হাড় পর্যন্ত কেটে বসে গেছে। কিঞ্জল এখন কি করব?
কিশোরের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, যাও। শীঘ্র স্থানত্যাগ করো।
কিঞ্জলের সঙ্গীরা আদেশের অপেক্ষায় তার মুখের দিকে চাইল।
এক দুর্বৃত্ত জিজ্ঞাসা করল, কিঞ্জল আমরা কি তবে চলে যাব?
হিংস্র হাস্যে কিঞ্জলের ওষ্ঠাধর বিভক্ত হয়ে উঁকি দিল দন্তের সারি, অবশ্যই চলে যাব। কিন্তু যাওয়ার আগে বালকের কোমল মাংসে পথবাসী কুকুরের ক্ষুধা নিবারণের ব্যবস্থা করব।
পরক্ষণেই তার কটিবন্ধনের কোষ থেকে সশব্দে বিদ্যুৎবর্ষণ করে চমকে উঠল নগ্ন তরবারি।
এক সঙ্গী উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল, কিঞ্জল! তুমি কি অসি ব্যবহার করবে?
কিঞ্জল বলল, অগত্যা! আমার বামবাহু ছুরিকাঘাতে বিদীর্ণ করে এই বালক নিজের দেহের উপর তরবারির আঘাত ডেকে এনেছে। বালক সশস্ত্র; অতএব তরবারি ব্যবহার করলে শ্রাবস্তীর আইন অনুসারে আমি অপরাধী বলে গণ্য হব না। লৌহ-দস্তানার পরিবর্তে এইবার রক্তপান করবে শাণিত তরবারি।… ওহে বালক! তরবারি কোষমুক্ত করো।
কিশোর কণ্ঠে ধ্বনিত হল দর্পিত ঘোষণা, তরবারির প্রয়োজন নেই। তোমাকে শিক্ষা দেবার জন্য এই ছুরিকাই যথেষ্ট।
ভীষণ গর্জন করে তরবারি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল কিঞ্জল। তীব্র ঝনকার শব্দে অসি প্রতিহত হল। একবার নয়, পর পর দুইবার। বিদ্রুপের হাসি ফুটল কিশোরের মুখে, অত সহজ নয় হে কিঞ্জল, অত সহজ নয়।
জনতার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে কিঞ্জলের অসি বারংবার ব্যর্থ আক্রোশে কিশোর-যোদ্ধার চতুর্দিকে ক্রুদ্ধ ভীমরুলের মতো গুঞ্জন করে ফিরতে লাগল, তীব্র ধাতব শব্দে ঝঙ্কার তুলল ছুরিকায় প্রতিহত হয়ে– কিন্তু কিশোরের অঙ্গ স্পর্শ করতে পারল না।
একজন নাগরিক উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে মন্তব্য করল, ছুরিকার সাহায্যে অসিধারীর আক্রমণ রোধ করছে ওই কিশোর! ধন্য শিক্ষা।
গেরুয়াধারী বক্তার দিকে দৃষ্টিপাত করল, দূরে দাঁড়িয়ে প্রশংসার মূল্য কি? যাও, অস্ত্রহাতে কিশোরের পাশে দাঁড়াও। শ্রাবস্তীর নাগরিকবৃন্দ যদি সশস্ত্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে নেকড়ের দল এখনই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।
আর একটি নাগরিক বলল, আমরা শান্তিপ্রিয় নাগরিক। প্রয়োজন হলে অস্ত্রধারণ করতে জানি বটে, কিন্তু আমরা ওদের মতো সংঘবদ্ধ নই। ওরা বনবাসী নেকড়ের মতো হিংস্র, নেকড়ের মতোই নিষ্ঠুর। অকারণে অথবা সামান্য কারণে ওরা নরহত্যা করতে পারে। আমরা ওদের ভয় পাই।
আচম্বিতে রাজপথের উপর জেগে উঠল তীব্র আর্তনাদ! তরবারি ফেলে দুই হাত দিয়ে রক্তাক্ত পাঁজর চেপে ধরল কিঞ্জল, তারপর পড়ে গেল মাটির উপর।
রক্তাক্ত ছুরিকা তুলে কিশোর কঠিনস্বরে বলল, তুমি মরবে না কিঞ্চল। তবে কয়েকটা দিন তোমাকে শুয়ে থাকতে হবে।
এইবার অকুস্থলে আত্মপ্রকাশ করল রত্নাকর বণিক, তীক্ষ্ণস্বরে চিৎকার করে বলল, নেকড়ের দল কি নখদন্তহীন? যাও, সবাই একসঙ্গে আক্রমণ করো।
কিঞ্জলের সঙ্গীরা হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা প্রথমে ভেবেছিল অসিধারী কিঞ্জলের হাতে অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করবে দুঃসাহসী কিশোর। ছুরিকার সাহায্যে তরবারির আক্রমণ রোধ করে কোনো ব্যক্তি যে অসিধারীকে আহত করতে পারে এমন অসম্ভব ব্যাপার তারা কল্পনাও করতে পারে নি। এখন রত্নাকর বণিকের আহ্বানে তারা সংবিৎ ফিরে পেল। খাপ থেকে তলোয়ার টেনে নিয়ে গর্জে উঠল কিঞ্জলের তিন সহচর, হারে-রে-রে!
বাঁহাতের ছুরিকাকে অগ্রবর্তী করে কিশোর প্রস্তুত হল চরম মুহূর্তের জন্য। সে বুঝেছিল আজ তার শেষ দিন। ডানহাত এখনও অবশ, ওই হাতে অসিধারণে সে অসমর্থ বাঁহাতে ছুরির সাহায্য তিন-তিনটি রক্তলোপ তরবারির আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। অতএব, মৃত্যু আজ সুনিশ্চিত। কিন্তু বন্যমার্জার যেমন মৃত্যু অবধারিত জেনেও অসহায়ভাবে দলবদ্ধ নেকড়ের মুখে আত্মসমর্পণ করে না, হিংস্র নখরে শত্রুর দেহ ও মুখ বিদীর্ণ করতে করতে মৃত্যুবরণ করে– এই ছুরিকাধারী কিশোরও তেমনি ভাবে প্রস্তুত হল অবধারিত মৃত্যুর জন্য।
মুক্ত তরবারি হস্তে এগিয়ে এল তিন দুর্বৃত্ত। কিশোর হঠাৎ বাঁদিকে ঘুরল এবং পলকে গতি সংযত করে ছুটল ডানদিকে। অকস্মাৎ গতি পরিবর্তনের ফলে মধ্যস্থলে দণ্ডায়মান দুই ব্যক্তির তলোয়ার ধাবমান শিকারকে স্পর্শ করতে পারল না। ডানদিকে যে ব্যক্তি দাঁড়িয়েছিল, সে সম্মুখবর্তী কিশোরকে লক্ষ্য করে সজোরে অসির আঘাত হানল।
কিশোর ছুরির সাহায্যে আক্রমণ প্রতিরোধের চেষ্টা করল না। অদ্ভুত কৌশলে মাটিতে বসে পড়ে সে শত্রুর আঘাত ব্যর্থ করে দিল! পরক্ষণেই এক সুদীর্ঘ লম্ফত্যাগ করে সে চলে গেল তিনটি তরবারির নাগালের বাইরে।
ক্ষিপ্রপদে তাকে লক্ষ্য করে ধেয়ে এল তিন দুর্বৃত্ত।
একটি বৃহৎ অট্টালিকার স্তম্ভে পিঠ দিয়ে উদ্যত ছুরিকা হাত অপেক্ষা করতে লাগল কিশোর।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এল তিন দুর্বৃত্ত। কোণঠাসা শিকারের সামনে গিয়েই তাদের গতি মন্থর হয়ে পড়েছে। বেপরোয়া ভাবে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস তাদের নেই। কিশোরের হাতের ছুরিকা যে প্রাণঘাতী আঘাতে অসিধারী প্রতিদ্বন্দ্বীকেও বিপর্যস্ত করতে পারে, সে কথা ভালো ভাবেই বুঝে নিয়েছে দ্বিপদ নেকড়ের দল–
ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে তারা শিকারকে ঘিরে ফেলল, অপরাহ্নের ম্লান সূর্যালোকে জ্বলে উঠল তিনটি রক্তলোলুপ তরবারি…
আচম্বিতে দুর্বৃত্তদের কানে ভেসে এল রত্নাকর বণিকের আর্তস্বর, মাধব! কবুর! গণপতি! এই মুহূর্তে অস্ত্র সংবরণ করো। তোমরা অসি কোষবদ্ধ না করলে আমার প্রাণসংশয় অবশ্যম্ভাবী।
সচমকে ফিরে তাকাতেই তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠল এক অত্যন্ত অভাবিত দৃশ্য! স্থূলকায় রত্নাকরকে শূন্যে তুলে ধরেছে এক বিপুল বপু গেরুয়াধারী ব্যক্তি!
গেরুয়াধারী হাঁক দিয়ে বলল, ওহে নেকড়ের দল! অসি কোষবদ্ধ না করলে তোমাদের প্রভু রত্নাকরকে আমি সজোরে রাজপথে নিক্ষেপ করব। অতএব তোমরা–
গেরুয়াধারীর বাক্য সমাপ্ত না হতেই রাজপথের উপর প্রচণ্ড শব্দে জাগ্রত হল এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর, এখানে কি হচ্ছে?
সকলে চমকে উঠল- রাজপথের উপর আবির্ভূত হয়েছে একদল সশস্ত্র অশ্বারোহী! যে ব্যক্তি তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে, প্রশ্নটা এসেছে তারই কণ্ঠ থেকে, এখানে কি হচ্ছে?
কিশোরকে যারা আক্রমণ করেছিল, তাদের মধ্যে একজন সভয়ে বলে উঠল, সর্বনাশ! নগর-কোটাল কলভবর্মা! শীঘ্র অসি কোষবদ্ধ করা।
তৎক্ষণাৎ তিনটি তরবারি সশব্দে খাপের ভিতর প্রবেশ করল। নগর-কোটাল কলভবর্মা আবার প্রশ্ন করলেন, কি ব্যাপার? এখানে কি হচ্ছে?
কোনো উত্তর না পেয়ে কলভবর্মা গেরুয়াধারীর দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। গেরুয়াধারী তখন রত্নাকর বণিককে মাটিতে নামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বণিকের একটি হাত সে চেপে ধরেছে শক্ত মুঠিতে।
কলভবর্মা কঠোর স্বরে বললেন, কেউ কথা কইবে না মনে হচ্ছে। তবে এখানে যে শান্তিভঙ্গের কারণ ঘটেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আপনি দেখছি গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী, আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। সন্ন্যাসীর কর্তব্য সম্পর্কে আমি বিশেষ অবহিত নই বটে, তবে স্থূলোদর বণিককে শূন্যে উত্তোলন করা সন্ন্যাসীর কর্তব্যকর্মের অন্তর্গত বলে মনে হয় না। এ বিষয়ে আপনি কি বলেন?
গেরুয়াধারী বলল, আমি বলি সকল অনর্থের মূল এই রত্নাকর বণিক!
অদূরে আহত জয়দ্রথ তখন প্রহার-জর্জরিত দেহটাকে টেনে নিয়ে শায়িত অবস্থা থেকে উপবিষ্ট অবস্থায় উন্নীত করেছে। সেই দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বলল, ওই যে ব্যাঘ্রচর্মে সজ্জিত এক ব্যক্তি ধরাশয্যা ত্যাগ করার চেষ্টা করছে, তার প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করুন।
কলভবর্মা পূর্ববৎ কঠোর স্বরে বললেন, করেছি। কিন্তু আমার দর্শন-ইন্দ্রিয় আপনার সহায্যপ্রার্থী নয়। অনুগ্রহপূর্বক কিছু বচনসুধা পরিবেশনে আমার তৃষিত শ্রবণ-ইন্দ্রিয়কে তৃপ্ত করুন যোগিবর!
বিলক্ষণ, বিনীত হাস্যে বিগলিত হল গেরুয়াধারী, আপনার তীক্ষ্ণদৃষ্টি সম্পর্কে অধমের অজ্ঞানতা নিজগুণে মার্জনা করবেন প্রভু! আচ্ছা, এইবার সব কথা খুলে বলছি..
যা কিছু ঘটেছে তার আদ্যোপান্ত বিবরণী দিয়ে গেরুয়াধারী সহাস্যে বলল, সমস্ত ঘটনা তো শুনলেন। এখন বলুন শান্তিভঙ্গের জন্য কে দায়ী? আমি? ওই পুরস্কার লোভী মল্ল? দুঃসাহসী কিশোর? না, এই বণিক আর তার অনুগত নেকড়ের দল?
–হুম! কিন্তু সেই কিশোরটি কোথায়? আমি তাকে দেখতে চাই।
আমাকে কিছু বলছেন? কলভর্মার কথার উত্তর দিয়ে এগিয়ে এল কিশোর। এর মধ্যেই তার হাতের ছুরি খাপের ভিতর আত্মগোপন করেছে।
কলভবর্মা মাথা নেড়ে সায় দিলেন; কথা বললেন না। তাঁর দুই চক্ষের শ্যেনদৃষ্টি সম্মুখবর্তী কিশোরের সর্বাঙ্গ লেহন করতে লাগল। রাজ্যে প্রবাদ আছে, কলভবর্মা নাকি মানুষের গোপন অভিসন্ধি ইচ্ছা করলেই জানতে পারেন। প্রবাদের মুলে কতটা সত্য আছে বলা যায় না। তবে কলভবর্মার দৃষ্টিবাণ অগ্রাহ্য করে অবিচিলত ভাবে অবস্থান করতে পারে রুদ্রদমনের রাজ্যে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম।
কিন্তু কিশোরের আচরণে ভাব-বৈলক্ষণ্য প্রকাশ পেল না। সে হাসিমুখে ঈষৎ নতদৃষ্টিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কলভবর্মার সামনে।
নগর-কোটাল নির্বাক, কিন্তু তার চক্ষু ও মস্তিষ্ক তখন তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণে সক্রিয়–
দীর্ঘাকার লঘুদেহ, কিন্তু পেশীবদ্ধ, প্রাণসার;… পায়ের আঙ্গুলে দেহভার রেখে চলাফেরা ও দাঁড়ানোর ভঙ্গি দাঙ্গা-হাঙ্গামায় অভ্যস্ত অসিযোদ্ধার মতন… মুখশ্রী সুন্দর, ললাট বুদ্ধিদীপ্ত… চক্ষে কিঞ্চিৎ উগ্রতার আভাস, তবে কৈশোরের রক্তে অগ্নির অস্তিত্ব স্বাভাবিক… ঊর্ধ্বাঙ্গের নীলাভ আঙরাখা ও নিম্নাঙ্গের ধূলিধূসরিত অথচ দৃঢ়বদ্ধ শ্বেতবস্ত্রে দারিদ্র্যের ছাপ না থাকলেও সচ্ছলতার চিহ্ন নেই… কটিদেশে এই বয়সেই অসি ও ছুরিকার অস্তিত্ব দেখে, আর যেটুকু ঘটনার বিবরণ ইতিমধ্যেই শ্রুতিগোচর হয়েছে, তা থেকে মনে হয় অস্ত্রচালনায় সুদক্ষ এই দুঃসাহসী কিশোর অসি ও ছুরিকা মাত্র সম্বল করে দুনিয়ার দরবারে নিজের ভাগ্যঅন্বেষণ করতে চলেছে..
অবশেষে একসময়ে কলভবর্মার তীব্র দৃষ্টি প্রসন্নতায় সহজ হয়ে উঠল, ওষ্ঠাধারেও দেখা দিল মৃদু হাসির আভাস, তুমিই সেই কিশোর, যার কথা বলছিলেন গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী? তুমি একাকী ছুরিকামাত্র সম্বল করে অসিধারী কিঞ্জল ও তার সহচর তিন দুৰ্বত্তের সম্মুখীন হয়েছিল? বণিক রত্নাকর ও তার কুখ্যাত নেকড়ে-বাহিনীর বহু অপকীর্তির কথা আমার কানে এসেছে, কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ পাইনি বলেই আজ পর্যন্ত দুর্বৃত্তদের দণ্ডবিধানের ব্যবস্থা করতে পারি নি।
একবার রত্নাকর বণিক ও তার সহযোগী তিনটির দিকে তাকালেন কলবর্মা, তারপর গম্ভীরস্বরে বললেন, আজ ওদের হাতে পেয়েছি। এখনই ওদের বন্দি করব। তোমরা তিনজন কোতোয়ালিতে গিয়ে সকল ঘটনা লিপিবদ্ধ করবে। কল্যপ্রভাতেই বিচারালয়ে অপরাধীদের বিচার হবে। বিচারক নহুষ শর্মা শক্ত মানুষ। তোমাদের সাক্ষ্য শুনলে তিনি রত্নাকর ও তার দলবলকে কঠিন শাস্তি দেবেন।
কিশোরের মুখের উপর মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠল আতঙ্কের কালোছায়া, অস্ফুটস্বরে আপনমনেই সে বলে উঠল, নহুষ শর্মা! সর্বনাশ!
তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে সে কলভবর্মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল, কোতোয়াল মহাশয়। কাল আমি বিচারালয়ে উপস্থিত থাকতে পারব না। বিশেষ কাজে আমাকে কাল অন্যত্র গমন করতে হবে।
নগরকোটাল কলবর্মার ভ্রু কুঞ্চিত হল, নির্বোধ! তুমি উপস্থিত না থাকলে অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তোমাকে উপস্থিত থাকতেই হবে।
–ক্ষমা করবেন। কোনোমতেই পূর্বোক্ত ব্যবস্থার অন্যথা হতে পারে না।
–আইন অনুসারে অবশ্য আমি তোমাকে জোর করতে পারি না। তুমি যদি অভিযোগ না জানাও তাহলে রাজপুরুষের কিছু করার নেই। অভিযুক্ত ব্যক্তির উপরই আমরা জোর খাটাতে পারি। তবে বুঝতে পারছি রত্নাকর আর তার নেকড়ে-বাহিনী আরও বেশ কিছুদিন নাগরিকদের উপর অত্যাচার চার্লিয়ে যাবে। এবারও রত্নাকর নিষ্কৃতি পেয়ে গেল। আর মল্লযোদ্ধা জয়দ্রথ বঞ্চিত হল প্রাপ্য পুরস্কার থেকে।
-কোতোয়াল মহাশয়। বিশ্বাস করুন আমি নিরুপায়।
শোনো ভাই, জয়দ্রথ এগিয়ে এসে কিশোরের কাঁধে হাত রাখল, তুমি সাক্ষ্য দিলে আমি সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পাব। প্রতিজ্ঞা করছি ওই অর্থের এক তৃতীয়াংশ তোমাকে দেব। তুমি প্রাণবিপন্ন করে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলে, এখন শেষরক্ষা করবে না?
আমি অর্থের প্রত্যাশী নই, কিশোর মৃদুস্বরে বলল, একটু আগেই তোমাকে ক্রীড়া-প্রদর্শনের জন্য একটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছি, ভুলে যেও না।
–ভুলি নি। কিন্তু একটি বা দুটি স্বর্ণমুদ্রার প্রশ্ন তো নয়, সহস্র স্বর্ণমুদ্রা বলে কথা।
যদি আমার কথা শোনো, তবে তোমাকে আমি প্রচুর অর্থের সন্ধান দিতে পারি। সেই সম্পদের কাছে সহস্র স্বর্ণমদ্রা তুচ্ছ।
এখন আমাকে বিচারালয় থেকে তুচ্ছসহস্র স্বর্ণমুদ্রা পেতে সাহায্য করে। প্রচুর অর্থের কথা পরে চিন্তা করা যাবে।
কিশোর বিচলিত হয়ে পড়ল। যেভাবেই হোক তাকে জয়দ্রথের বিশ্বাস অর্জন করতেই হবে। কিন্তু বিচারশালায় গিয়ে তাকে সাহায্য করা সম্ভব নয়। সেখানে মূর্তিমান বিপ্নের মতো অবস্থান করছেন বিচারক নহুষ শর্মা।
কিশোর মনে মনে বলল, বিচারক নহুষ শর্মার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আমার অস্তিত্ব তো বিপন্ন হবেই, আর সমস্ত পরিকল্পনাও হবে পণ্ড। রত্নাকরের সমবেত নেকড়ে-বাহিনীর চাইতে নহুষ শর্মার উপস্থিতি আমার পক্ষে অনেক বেশি বিপজ্জনক। কিন্তু জয়দ্রথকে হতাশ করলে সে কি আমার কোনো কথায় কর্ণপাত করবে?… তাকেও যে প্রয়োজন!… মহাসমস্যায় পড়লাম!
কলভবর্মা হাঁক দিলেন, কিশোর! মনস্থির করো। বলো, কাল তুমি বিচারালয়ে সাক্ষ্য দিতে রাজি?
বিদ্যুৎচমকের মতো একটি চিন্তা তার মস্তিষ্কে সাড়া দিল- কিশোর অনুভব করল এতক্ষণ পরে তার ডানহাতে রক্ত চলাচল শুরু হয়েছে, এখন সে অসি ধারণে সমর্থ।
জয়দ্রথের বিশ্বাস অর্জনের এই হচ্ছে সুবর্ণ সুযোগ!
অতএব–
স্মিতমুখে কিশোর বলল, কোতোয়াল মহাশয়! আমি আজ রাত্রে বিশেষ কার্যে অন্যত্র গমন করব। কিন্তু বিচারালয়ে না গিয়ে অন্য উপায়ে বর্তমান সমস্যার সমাধান বোধহয় সম্ভব। শুনেছি, এই রাজ্যের আইনে অস্ত্রের সাহায্যে বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান আছে। উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে রাজপ্রতিনিধির সম্মুখে সংঘটিত যুদ্ধে বিজয়ীপক্ষের দাবি মেনে নেওয়া হয়। আমি জয়দ্রথের পক্ষ থেকে বিরোধীপক্ষের সমবেত শক্তিকে একাকী যুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছি।
স্তম্ভিত কলবর্মা কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। রাজপথে দণ্ডায়মান নগরবাসীরাও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল– বলে কি!
কয়েক মুহূর্ত পরেই নীরবতা ভঙ্গ করে জাগল জয়দ্রথের ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর, কিশোর। তুমি কি ভেবেছ? আমার স্বার্থরক্ষার জন্য তুমি একাকী তিনটি তরবারির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই করবে আর আমি হীনবী কাপুরুষের মতো নিশ্চেষ্ট হয়ে সেই যুদ্ধ দেখব? তোমার প্রাণের মুল্যে আমি লাভ করতে চাইব স্বর্ণমুদ্রা?… না, কিশোর; আমি দরিদ্র হলেও এমন হীনচেত নই। প্রয়োজন হলে আমি স্বর্ণমুদ্রার দাবি প্রত্যাহার করব। কিন্তু অপরের জীবন বিপন্ন করে অর্থলাভ করার হীন মনোবৃত্তি আমার নেই।
জয়দ্রথ। আমি জানি তুমি হীনচেতা নও। জানি, তোমার বিশাল বক্ষের নীচে অবস্থান করছে উদার প্রশস্ত অন্তঃকরণ। তোমার প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির প্রমাণও আমি পেয়েছি। কিন্তু এ হচ্ছে অস্ত্রের মুখে প্রাণ নিয়ে খেলা। অস্ত্র নিয়ে মরণ-খেলার খেলোয়াড় তুমি নও। তাই তোমাকে আমি এই যুদ্ধে ডাকছি না। তুমি বিশ্বাস করো জয়দ্রথ–ওই তিন ব্যক্তির সম্মুখে আমি খুব অসহায় নই। মৃত্যু নিশ্চিত জানলে আমি কি ওই প্রস্তাব দিতাম? ছুরিকামাত্র সম্বল করে আমি কিঞ্জলকে কত অনায়াসে পরাস্ত করেছি সেকথা ভুলে যেও না।
আমার আত্মমর্যাদাবোধ আছে। তোমার কোনো কথাই আমি শুনব না। হয় আমরা দুজনেই লড়ব, আর না হয়তো এ লড়াই হবে না। আমি পুরস্কারের দাবি প্রত্যাহার করব।
-আমি যোদ্ধা। একবার যখন যুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছি, তখন আর পিছিয়ে যাব না। বেশ.. তোমার কথাই রইল। কিন্তু জয়দ্ৰথ, তোমার অস্ত্র?
–সে বিষয়ে চিন্তা করে তোমার মস্তিষ্ককে বিব্রত করো না। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।
আচম্বিতে সমবেত জনমণ্ডলীকে চমকিত করে জাগল কভবর্মার প্রচণ্ড কণ্ঠস্বর, কিশোর! দুঃসাহসেরও সীমা আছে। আমি গেরুয়াধারীর মুখে পূর্ববর্তী ঘটনার বিবরণী শুনে বুঝলাম তুমি অস্ত্রচালনায় অতিশয় নিপুণ। কিন্তু তোমার সঙ্গী অস্ত্রে অনভিজ্ঞ মল্লযোদ্ধা। অসিচালনায় দক্ষ তিন দুবৃত্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে তোমাদের মৃত্যু অনিবার্য।
নগর-কোতোয়াল। আপনার ধারণা ভুল, সামনে এগিয়ে এসে গর্বিত কণ্ঠে জয়দ্রথ বলল, আমি অসিযুদ্ধে অনভিজ্ঞ হলেও যুদ্ধে আমাকে পরাজিত করা সহজ নয়।
যে লৌহদণ্ড একটু আগে তার হাতের চাপে প্রায় গোলাকার বস্তুতে পরিণত হয়েছিল, সেই দণ্ডটি এবার সে মাটি থেকে তুলে নিল, ক্রীড়া-প্রদর্শনের সময়ে এই লৌহদণ্ড আমি বক্র করেছিলাম, এইবার এটাকে আমি অস্ত্রের উপযোগী করে নিচ্ছি। দেখুন…।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল গোলাকৃতি বস্তুটি দীর্ঘ ও সরল এক সুদৃঢ় লৌহদণ্ড হয়ে বিরাজ করছে জয়দ্রথের হাতে।
জয়দ্রথ কলভবর্মাকে উদ্দেশ করে বলল, কোতোয়াল মহাশয়! এই লৌহদণ্ডের সাহায্যে আমি অনায়াসে তিনটি তরবারির আক্রমণ প্রতিহত করতে পারব।
তিনটি নয়, চারটি! বলতে বলতে জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ করল কিঞ্জল। তার বিদীর্ণ পঞ্জর থেকে রক্ত ঝরে পরিধেয় বস্ত্র লাল হয়ে উঠেছে, কিন্তু সেদিকে তার দৃষ্টি নেই।
বিস্মিত জনতার ভিতর থেকে জাগল গুঞ্জনধ্বনি, কিঞ্জল! কিঞ্জল!
হ্যাঁ, আমি কিঞ্জল, ক্রুদ্ধস্বরে কিঞ্জল বলল, ছুরিকাঘাতের ফলে দারুণ যাতনায় কিছুক্ষণ। মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিলাম। এখন জ্ঞান ফিরে এসেছে এবং আমিও উঠে এসেছি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে।
কিঞ্জলের দুই চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি ফিরল কিশোরের দিকে, নির্বোধ বালক! তুমি সাধ করে ফাঁদে পা দিয়েছ। এখন আমি ন্যায়যুদ্ধে তোমাকে হত্যা করব। স্বয়ং নগর-কোটালও আমাকে বাধা দিতে পারবেন না।
কলবভর্মা ভগ্নস্বরে বললেন, সত্য বটে! এই যুদ্ধে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। এই রাজ্যের আইন অনুসারে কে? জল্লাদ! তুমি এখানে কি চাও?
জনতার ভিতর থেকে সকলের সামনে আত্মপ্রকাশ করল একটি ভীষণদর্শন মানুষ। তাকে দেখামাত্র দণ্ডায়মান দর্শকদের ভিতর জাগল ভয়ার্ত কণ্ঠের অস্ফুট গুঞ্জরন– অর্থাৎ, মানুষটি নগরবাসীর কাছে সুপরিচিত!
লোকটি ধীরপদে এসে দাঁড়াল কিঞ্জলের পাশে। তার কপালের উপর থেকে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন বামচক্ষুকে বিলুপ্ত করে গণ্ডদেশ পর্যন্ত নেমে এসেছে। ডানদিকের একটিমাত্র চক্ষু ও মুখের উপর এমন এক নিষ্ঠুর হিংসার ছায়া পরিস্ফুট যে, সেদিকে তাকালে যে-কোনো ভদ্ৰব্যক্তির বুকের ভিতর জেগে ওঠে আতঙ্কের শীতল শিহরন! লোকটির কটিবন্ধে রয়েছে দীর্ঘ তরবারি। তার চেহারা ও চালচলনে বোঝা যায় ওই তরবারি ব্যবহারের জন্য সে সর্বদাই উদগ্রীব।
পূর্বোক্ত ব্যক্তিকেই জল্লাদ নামে সম্বোধন করেছিলেন কলভবর্মা। এমন সার্থকনামা মানুষ খুব কমই দেখা যায় সন্দেহ নেই।
জল্লাদ হাসল, এই যুদ্ধে আমি কিঞ্জলের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে চাই। রাজ্যের আইন অনুসারে বিবদমান দুই পক্ষের দলভুক্ত কোনো ব্যক্তির পরিবর্তে তার স্থান গ্রহণ করে অন্য মানুষ অস্ত্রধারণ করতে পারে। আমি এখন রত্নাকর বণিকের পরিবর্তে যুদ্ধ করতে চাই। আপনি আমাকে বাধা দিতে পারেন না। তবে হ্যাঁ, রত্নাকরের যদি আপত্তি থাকে–
রত্নাকর বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে ঘটনার পরিণতি লক্ষ করছিল। এই মানুষটিকে সে ভালো ভাবেই জানে, কিন্তু হঠাৎ জল্লাদ কি কারণে তার উপর সদয় হয়েছে সেটা বুঝতে না পেরে রত্নাকর হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কারণ যাই হোক, জল্লাদের আচরণে যে তারই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা সে কথা বুঝতে তার দেরি হল না– তাই জল্লাদের মুখের কথা শেষ হতে না হতেই সোসাহে এগিয়ে এসে চিৎকার করে উঠল রত্নাকর, না, না, আমার কোনো আপত্তি নেই।
জল্লাদ হেসে কলভবর্মাকে বলল, শুনলেন তো? এখন আইন অনুসারে আপনি যুদ্ধের ব্যবস্থা করুন। আমি কিঞ্জলের পক্ষে রত্নাকর বণিকের পরিবর্তে অস্ত্রধারণ করব।
হতবুদ্ধি কলভবর্মা স্খলিতস্বরে বললেন, হ্যাঁ, আইনে একটা ওই ধরনের ব্যবস্থা আছে বটে, তবে–
তবে-টবে নয়, হিংস্র হাস্যে বিকশিত হল জল্লাদের দন্তপঙক্তি, নগরকোটাল! আপনি আইনের প্রতিনিধি; আইন মানতে আপনি বাধ্য।
.
০৬. যুদ্ধ
কিশোরের দিকে ফিরে হাঁক দিল জল্লাদ, কর্ণদেব! আমাকে চিনতে পারছ?
কিশোর নিরুত্তর। হা হা শব্দে হেসে উঠল জল্লাদ।
জয়দ্রথ সবিস্ময়ে বলল, জল্লাদ তোমাকে সম্বোধন করে কথা বলছে। তোমার নাম কর্ণদেব? তোমরা পরস্পরের পরিচিত?… জল্লাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে ওর শত্রুতা ছিল। আজ সুযোগ বুঝে সে তোমাকে বিপদে ফেলতে চায়। শান্তিপ্রিয় নাগরিকরা ওকে বাঘের মতো ভয় করে। জল্লাদ শুধু দুরাত্মা কিঞ্জলের বন্ধু নয়, জনশ্রুতি আছে ও নাকি দস্যু পরন্তপের
কিশোর শুস্বরে ধমকে উঠল, জয়দ্রথ! চুপ করো।
জল্লাদ কিঞ্জলের পাশ থেকে একটু এগিয়ে এল, তার একটি মাত্র চক্ষুর জ্বলন্ত দৃষ্টি নিবদ্ধ হল কিশোরের মুখের উপর, কর্ণদেব! তুমি নীরব কেন? আমাকে দেখে কি ভয়ে তোমার বাগরোধ হয়েছে?
কিশোর কর্ণদেব অবিচলিত স্বরে বলল, ভয় নয়, বিস্ময়। তুমি পুনর্বার আমার সামনে এসেছ দেখে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়েছি। হায় রে নির্বোধ! একটি চক্ষু বিসর্জন দিয়েও তোমার চৈতন্য হল না!
জল্লাদ ক্রুদ্ধস্বরে বলল, পামর! বৃথা গর্ব করিস না। তৃতীয় পক্ষ হস্তক্ষেপ না করলে সেইদিনই তোর প্রাণবধ করতাম। ব্যাঘ্রের আশ্রয়ে ব্যাঘ্ৰশিশুর প্রতাপ প্রকাশ পায়, একাকী ব্যাধের সম্মুখে এলে তার মৃত্যু নিশ্চিত।
কর্ণদেব হাসল, জল্লাদ! তৃতীয়পক্ষ উপস্থিত না থাকলে সেইদিনই তোমার মৃতদেহ ধরণীকে আলিঙ্গন করত… বেশ! অধিক কথায় কাজ কি? ব্যাঘ্র আজ অনুপস্থিত। এস! ব্যাঘ্ৰশিশুর দন্ত ও নখরের ধার পরীক্ষা করো। আমি তোমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছি।
কিঞ্জল এগিয়ে এসে জল্লাদের পাশে দাঁড়াল, তারপর মৃদুস্বরে ফিস ফিস করে বলল, জল্লাদ। আমি বুঝতে পারছি ওই কিশোরের সঙ্গে তোমার পূর্বশত্রুতা ছিল। তুমি দক্ষ অসিযোদ্ধা, কিন্তু কর্ণদেব নামে ওই কিশোর সাক্ষাৎ শমনের অগ্রদূত। আমি তোমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে নিষেধ করছি।
জল্লাদর ওষ্ঠাধরে ফুটল কুটিল হাসির রেখা, নতকণ্ঠে সে বলল, অবশ্যই তোমার নিষেধ আমি শুনব। কিঞ্জল! আমার মন্ত্র হচ্ছে মারি অরি, পারি যে কৌশলে। আজ কর্ণদেবের রক্ষা নেই।
কর্ণদেবের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে উচ্চৈস্বরে হাঁক দিল জল্লাদ, শোনো কর্ণদেব! তোমার প্রস্তাবে আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু বন্ধুবর কিঞ্জল ও তার সহচর নেকড়ের দল তোমার উপর প্রতিশোধ নিতে চায়। প্রতিশোধ গ্রহণের আনন্দ থেকে আমি তাদের বঞ্চিত করতে পারি না।
তিক্তস্বরে কর্ণদেব বলল, ভীরু! কাপুরুষ! তুমি ভালোভাবেই জান দ্বন্দ্বযুদ্ধে আমার বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হলে তোমার পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই দলবদ্ধ হয়ে আমাকে তুমি আক্রমণ করতে চাও। এই অসম যুদ্ধে আমার মৃত্যু নিশ্চিত। তবে তুমিও জেনে রাখো- আমার অসি আজ একাধিক শত্রুর রক্তপান করবে।
কর্ণদেবের পাশে দাঁড়িয়ে লৌহখণ্ড শূন্যে আন্দোলিত করে জয়দ্রথ তীব্রস্বরে বলে উঠল, কর্ণদেব! আমার এই লৌহদণ্ড যমদণ্ডের ন্যায় শত্রুর মস্তক চুর্ণ করবে। যুদ্ধের ফলাফল অনিশ্চিত; কিন্তু সমগ্র জনমণ্ডলী আজ আমার বাহুবল দর্শন করবে। এই পৃথিবী থেকে হয়তো আমি বিদায় গ্রহণ করতে পারি তবে তার আগে কয়েকটি মূর্তিমান পাপকে এই দণ্ডের আঘাতে যমালয়ে প্রেরণ করব।
জয়দ্রথের কথা শেষ হতে না হতেই কিঞ্জলের অনুচরবর্গের কণ্ঠে জাগল ক্রুদ্ধ রণ-হুঁঙ্কার। কিঞ্জল ও জল্লাদ সম্পূর্ণ নীরব; কেবল তাদের জ্বলন্ত চক্ষের হিংস্র দৃষ্টিতে ফুটল হত্যাকারীর নিষ্ঠুর সঙ্কল্প।
আচম্বিতে অশ্বের হ্রেষাধ্বনির মতো তীব্র তীক্ষ্ণস্বরে চিৎকার করে উঠল রত্নাকর বণিক, অনর্থক বিলম্বে কি প্রয়োজন? নগর-কোটাল অনুমতি দিলেই যুদ্ধ শুরু হতে পারে।
রত্নাকর! রুষ্টস্বরে বললেন কলভবর্মা, হত্যালীলা দেখার জন্য তুমি অধীর হয়ে পড়েছ দেখছি। অনুমতি না দিয়ে অবশ্য আমার উপায় নেই। বেশ, শুরু করো যুদ্ধ।
পলাতক মৃগের পশ্চাদ্ধাবনে উন্মুখ শৃঙ্খলাবদ্ধ কুকুরের দলকে ব্যাধ যখন শৃঙ্খলমুক্ত করে দেয়, তখন তারা যেমন হিংস্র গর্জনে উল্লাস জানিয়ে ছুটে যায় নির্দিষ্ট দিকে ঠিক তেমনি ভাবেই চিৎকার করে পাঁচটি হিংস্র মানুষ নগ্ন তরবারি নিয়ে এগিয়ে গেল– তবে দ্রুতপদে নয়, ধীরে ধীরে অতি সন্তর্পণে!
পূর্ব-অভিজ্ঞতার ফলে তারা বুঝে নিয়েছে কিশোর কর্ণদেব বড় বিপজ্জনক মানুষ; আর তার পাশে লৌহদণ্ড ধারণ করে দানবের মতো যে বিপুল বপু মল্লযোদ্ধাটি অবস্থান করছে সেও অবহেলার বস্তু নয়–অতএব তারা প্রথম থেকেই সতর্ক হল।
ডানহাতে তলোয়ার আর বাঁহাতে ছুরি ধরে অনুচ্চকণ্ঠে সঙ্গীকে উদ্দেশ করে কর্ণদেব বলল, জয়দ্রথ! ওরা আসছে। বেশি কথার সময় নেই। আমার কথা শোনো–তুমি সরে যাও। অনর্থক প্রাণবিপন্ন করে লাভ কি? যদি আমি জয়লাভ করি, তবে তুমি সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পাবে। আর যদি মৃত্যু ঘটে তাহলেও তোমার বিশেষ ক্ষতি নেই। সেক্ষেত্রে তুমি স্বর্ণমুদ্রা থেকে বঞ্চিত হবে, কিন্তু প্রাণসংশয় ঘটবে না।
জয়দ্রথ গর্জন করে উঠল, কী! আবার ওই কথা! যে আমার জন্য প্রাণ দিতে বসেছে, তাকে ফেলে আমি পলায়ন করব?
নির্নিমেষ দৃষ্টি শত্রুপক্ষের গতিবিধির দিকে নিবদ্ধ রেখে কর্ণদেব বলল, জয়দ্রথ? আমি বিনাস্বার্থে প্রাণবিপন্ন করছি না। যদি যুদ্ধে জয়লাভ করে তোমার হাতে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা তুলে দিতে পারি, তবে নিশ্চয়ই তুমি আমার প্রতি অনুরক্ত হবে। জয়দ্রথ! বহুদুর থেকে তোমার সন্ধানে আমি এসেছি, তোমার বন্ধুত্ব আমার একান্ত প্রয়োজন। ওরা আসছে; যুদ্ধে অনিচ্ছা জানিয়ে তুমি সরে যাও। যদি বেঁচে থাকি, যদি জয়লাভ করি, তাহলে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ তুমি পাবে। কথা শোনো… আচ্ছা, যদি লজ্জা পাও তবে চুপ করে থাকো, আমি তোমার নিরপেক্ষতা ঘোষণা করছি… নগরকোটাল কলভ–
বাঘের থাবার মতো প্রকাণ্ড একটা থাবা কর্ণদেবের মুখের উপর পড়ে তাকে স্তব্ধ করে দিল, পরক্ষণেই অসমাপ্ত সমোধন লুফে নিয়ে জয়দ্রথ কর্ণদেবের বাক্য সমাপ্ত করল, নগরকোটাল কলভবর্মা। আমার বন্ধু এতগুলি বীরপুরুষের সমাগমে কিঞ্চিৎ বিহ্বল হয়ে পড়েছে… তাকে কয়েকটা মুহূর্ত সময় দিন.. আচ্ছা… আশা করি এইবার সে সংবিৎ ফিয়ে পেয়েছে।
জয়দ্রথ তার হাত সরিয়ে নিল! এক মুহূর্তের জন্য তার দিকে ক্রুদ্ধ কটাক্ষপাত করে আবার শত্রুর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কর্ণদেব।
কিঞ্জলের দল কিছুক্ষণের জন্য বিমুঢ় হয়ে পড়েছিল। দলপতির নির্দেশে তারা আবার কর্ণদেব ও জয়দ্রথকে লক্ষ্য করে অগ্রসর হল।
জল্লাদ উত্তেজিত স্বরে বলল, মল্লযোদ্ধা হঠাৎ কর্ণদেবের মুখ চেপে ধরল কেন? কর্ণদেব বিহ্বল হওয়ার পাত্র নয়। নিশ্চয়ই ওদের কোনো গূঢ় অভিসন্ধি আছে! কিঞ্জল! খুব সাবধান! যেন পালাতে না পারে।
কিঞ্জল হাসল, তুমি নিশ্চিত থাকো জল্লাদ! এই মৃত্যুফাঁদ থেকে ওদের আজ নিস্তার নেই।
আচম্বিতে সকলের শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করল কলবর্মার উচ্চকণ্ঠের আদেশ, দাঁড়াও!
–কী! কী!
–নগরকোটাল কলভবর্মা! যুদ্ধ বন্ধ করার অধিকার আপনার নেই।
সমবেত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল আক্রমণোদ্যত দুবৃত্তের দল।
জনতা নীরব।
স্পষ্টই বোঝা যায় তারা এই অসম যুদ্ধের পক্ষপাতী নয়। কলভবর্মা, রত্নাকর বণিকের কর্কশ চিৎকার শোনা গেল, আপনি যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেন না। আমরা আপনার বিরুদ্ধে রাজদ্বারে অভিযোগ করব।
জল্লাদ ও কিঞ্জল সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, রাজদ্বারে অভিযোগ করলে আপনার কঠিন শাস্তি হবে। কলবর্মা! স্মরণ রাখবেন, আইনের প্রতিনিধি হয়ে আইন ভঙ্গ করলে চরমদণ্ডের বিধানও রয়েছে।
কলভবর্মা বললেন, আমি যুদ্ধ বন্ধ করার আদেশ দিচ্ছি না। সে অধিকার আমার নেই। আমি শুধু তোমাদের কাছে আবেদন জানিয়ে বলছি যে দুটি নির্দোষ মানুষকে–
চুপ করুন, তীব্রস্বরে জল্লাদ বলল, আমরা কোনো আবেদন-নিবেদন শুনতে চাই না। কিঞ্জল! তোমার সঙ্গীরা দাঁড়িয়ে আছে কেন?
জল্লাদ! জলদগম্ভীর স্বরে কলবর্মা বললেন, তোমাকে আমি আজ সতর্ক করে দিচ্ছি। তোমার বহু অন্যায় ও দুষ্কর্মের কথা আমার কানে আসে। যেদিন তোমাকে প্রমাণসহ গ্রেপ্তার করতে পারব, সেইদিন–
বাধা দিয়ে জল্লাদ বলল, সেইদিন যা খুশি করবেন। কিন্তু আজ আপনি যুদ্ধে বাধা দিচ্ছেন কেন?
তারপরই কলভবর্মাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সে কিঞ্জলের দিকে ফিরে চিৎকার করে উঠল, তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন? সবাই তরবারি হাতে অগ্রসর হও।
আরে না! না! এত ব্যস্ত হলে চলে? একটি উচ্চ কণ্ঠস্বর ভেসে এল পিছন থেকে।
উদ্যত অস্ত্র সংবরণ করে দুই পক্ষই আশ্চর্য হয়ে দেখল সহাস্যবদনে হাত তুলে চিৎকার করছে গেরুয়াধারী, এত ব্যস্ত হলে চলে? আইন অনুসারে আমারও যুদ্ধে যোগ দেওয়ার অধিকার আছে যে! রত্নাকর বণিককে শুন্যে তুলে নিক্ষেপ করার উদ্যোগ করায় আমিও কলহে লিপ্ত হয়ে পড়েছি, একথা ভুললে তো চলবে না।
বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে কলভবর্মা বলে উঠলেন, আপনি! আপনি যুদ্ধ করবেন?
অবশ্যই, গেরুয়াধারীর মুখে প্রশান্ত হাসি, আইন বলছে কলহে লিপ্ত যে কোনো ব্যক্তি এই যুদ্ধে যোগ দিতে পারে। তাই নয় কি?
কলভবর্মা এমন আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে তার মুখে কথা ফুটল না। কিন্তু দুর্বৃত্তদের কণ্ঠে জাগল প্রবল হাস্যধ্বনি।
-ওই স্থূলকায় মেদসর্বস্ব সন্ন্যাসী যুদ্ধ করবে? হাঃ! হাঃ!
হো! হো! হো
–হি! হি হি!
গেরুয়াধারী নির্বিকার মুখে বলল, আপনাদের হাস্যধ্বনি শ্রবণ করে হৃদয়ে বিমল আনন্দলাভ করলাম। কিন্তু কোতোয়াল মহোদয়– আইন অনুসারে আপনি আমাকে যুদ্ধের অনুমতি দিতে বাধ্য। কারণ, এই কলহে আমিও লিপ্ত ছিলাম।
কলভবর্মা বললেন, যোগিবর! আপনি বলবান এবং রসিক পুরুষ সন্দেহ নেই। কিন্তু কেবলমাত্র দৈহিকবল সম্বল করে শাণিত অসির সামনে রসিকতা করা যায় না। আমি আইন অনুযায়ী যুদ্ধের অনুমতি দিতে বাধ্য থাকলেও আত্মহত্যার অনুমতি দিতে বাধ্য নই। আপনি নিরস্ত্র; সশস্ত্র যোদ্ধার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হলে আপনার মৃত্যু অনিবার্য। এমন অবস্থায় আপনাকে আমি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার অনুমতি দিতে পারি না।
–অস্ত্র আমি মুহূর্তের মধ্যে সংগ্রহ করব। নগরকোটাল! আপনি আমাকে যুদ্ধের অনুমতি দিন। এই নেকড়ের দল ক্রমশ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।নগরীর বুকে ওদের অত্যাচার দিন দিন বর্ধিত হচ্ছে। ওদের কিঞ্চিৎ শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।
কিঞ্জল, জল্লাদ ও নেকড়ে-বাহিনী নামে কুখ্যাত দুর্বৃত্তদের কণ্ঠে জাগল রুষ্ট হুঙ্কারধ্বনি!
–~-কী! এত স্পর্ধা!
-ওই স্থূলকায় মেদসর্বস্ব সন্ন্যাসী আমাদের শিক্ষা দেবে!
–আজ অসির সাহায্যে ওর সর্বাঙ্গে রক্তের আলপনা রচনা করব।
অকস্মাৎ দুর্বৃত্তদের আস্ফালন-ধ্বনি ডুবিয়ে জাগ্রত হল মল্লবীর জয়দ্রথের প্রচণ্ড কণ্ঠস্বর, হে সন্ন্যাসী! আপনার সহৃদয়তা ও সাহস প্রশংসার যোগ্য। আপনি অবলীলাক্রমে স্থলোদর রত্নাকর বণিককে শূন্যে উত্তোলন করে অসাধারণ শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু অস্ত্রধারী দুৰ্বত্তের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র মহাবলীও অসহায়। অতএব আপনি ক্ষান্ত হন।
-জয়দ্রথ! আমি এখনই অস্ত্র সংগ্রহ করে যুদ্ধ করব। তোমার চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই।
–সন্ন্যাসী! নগরবাসী ওই নেকড়ের দলকে ভয় করে। তাদের মধ্যে কেউ আপনার হাতে অস্ত্র তুলে দিতে সাহস করবে না।
জয়দ্রথ! তোমার মস্তিষ্ককে অকারণে ঘর্মাক্ত কোরো না। স্তব্ধ হও।
এইবার এগিয়ে এল কর্ণদেব, মহাশয়! আপনি ক্ষান্ত হন। আমি এই নগরীতে নবাগত, কিন্তু জয়দ্রথ এই নগরের বাসিন্দা নাগরিক-চরিত্র সম্বন্ধে সে অবহিত। সে বলছে এখানে কেউ আপনার হাতে অস্ত্র তুলে দিতে সাহস করবে না। নিরস্ত্র অবস্থায় মহাশক্তিধর হলেও আপনি অস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে কি করতে পারেন?… দেখুন, সমবেত জনতার ভিতর থেকে এখন পর্যন্ত একটি মানুষও এগিয়ে এসে আপনার হাতে কোনো অস্ত্র তুলে দিল। অতএব অনুরোধ আপনি ক্ষান্ত হন।
গেরুয়াধারীর ওষ্ঠাধরে হাসির রেখা অধিকতর বিস্তৃত হল, কর্ণদেব! অনর্থক দুশ্চিন্তা ও বাক্যব্যয়ে শক্তিক্ষয় না করে আসন্ন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। আমি কারো কাছে অস্ত্র চাই না। নগরকোটাল অনুমতি দিলে এই রাজপথ থেকেই আমি অস্ত্র সংগ্রহ করব।
কলভবর্মা এতক্ষণ নীরবে কথোপকথন শুনছিলেন, এইবার তিনি মুখ খুললেন, রাজপথ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করবেন…? বুঝেছি, কিন্তু বিপণি থেকে অস্ত্র ক্রয় করার সময় আমি দিতে পারি না।
গেরুয়াধারীর কণ্ঠ অবিচলিত, আমি মুহূর্তের মধ্যে অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারি। আপনি যুদ্ধের অনুমতি দিন।
উদ্যত অসি হস্তে চিৎকার করে উঠল নেকড়ের দল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যুদ্ধের অনুমতি দিন। কলভবর্মা! আমরা অনর্থক বিলম্ব করতে রাজি নই।
কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ থেকে কলভবর্মা গম্ভীর স্বরে ঘোষণা করলেন, আমি নগরকোটাল কলভবর্মা ঘোষণা করছি-এক থেকে দশ অবধি আমি গণনা করব। ওই সময়ের মধ্যে যদি গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারে তো ভালো, নচেৎ দশ বলার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হবে… এক!
কলভবর্মা! মুহূর্তকাল মুহূর্তকাল অপেক্ষা করুন, গেরুয়াধারী হাঁক দিল, কোনো বিশেষ অস্ত্র সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা আছে কি?
-ধনুর্বাণ ছাড়া যে কোনো অস্ত্রই ব্যবহার করা চলে… দুই! গেরুয়াধারী হঠাৎ পিছন ফিরে রাজপথে দণ্ডায়মান জনতার দিকে এগিয়ে চলল।
কলভবর্মা গুনতে লাগলেন, তিন! চার! পাঁচ! ছয়! জয়দ্রথ প্রশ্ন করল, কর্ণদেব! গেরুয়াধারী রাজপথ থেকে কোন অস্ত্র সংগ্রহ করবে?
কর্ণদেবের ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা, জানি না।
-সাত! আট!
কিঞ্জল ব্যঙ্গভরে বলল, গেরুয়াধারী শুধু ভণ্ড নয়, ও বদ্ধ উন্মাদও বটে!
জল্লাদ বন্ধুর কথায় সায় দিল না, চিন্তিতভাবে বলল, কিন্তু ও কি করতে চায়?… দেখ! ওই যে বৃক্ষের তলায় দণ্ডায়মান জনতা, ওইখানেই এগিয়ে যাচ্ছে গেরুয়াধারী… আরে! ও যে দেখছি বৃক্ষ ধরে টানাটানি করছে।
-নয়। দশ।
কলভবর্মার কণ্ঠে দশ গণনা সম্পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতার কণ্ঠে জাগল কোলাহল-ধ্বনি!
রাজপথে অবস্থিত একটি গাছকে মূলশূদ্ধ টেনে তুলে ফেলেছে গেরুয়াধারী!
আপাতত এই বৃক্ষকেই আমি অস্ত্ররূপে গ্রহণ করলাম, হাত দিয়ে গাছের ডালপালা পরিষ্কার করতে করতে গেরুয়াধারী বলল।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বজ্রমুষ্টির আকর্ষণে ডালপালা আর পাতার রাশি ঝরে পড়ে উৎপাটিত বৃক্ষ এক সুবিশাল দণ্ডের আকার ধারণ করল!
সেই বৃক্ষকে মাথার উপর তুলে সবেগে দুই পাক ঘুরিয়ে গেরুয়াধারী প্রচণ্ড কণ্ঠে যুদ্ধের আহ্বান জানাল, আমি প্রস্তুত। দশ গণনাও শেষ। অতএব হে নেকড়ের দল- রণং দেহি!
কিঞ্জল এক পা পিছিয়ে বলল, জল্লাদ! আমার সঙ্গীরা পলায়ন করছে। আমরা কি করব? ওই বিশাল বৃক্ষ যদি মস্তকে পতিত হয়
জল্লাদ দুই পা পিছিয়ে বলল, তবে মৃত্যু নিশ্চিত!
গেরুয়াধারীর হস্তে বৃক্ষ যমদণ্ডের মতো আন্দোলিত হল, সে আবার হাঁকল, রণং দেহি।
প্রত্যুত্তরে আরও কয়েক পা পিছিয়ে গেল কিঞ্জল ও জল্লাদ। রত্নাকর চেঁচিয়ে উঠল, কিঞ্জল। জল্লাদ! আক্রমণ করো। তোমরা পলায়ন করলে আমাকে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দণ্ড দিতে হবে।
কর্ণদেব উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, জয়দ্রথ! আমি অসি কোষবদ্ধ করলাম। তুমিও লৌহদণ্ড নামিয়ে রাখতে পারো। বোধহয় বিনাযুদ্ধেই তুমি অর্থলাভ করবে।
জয়দ্রথ বলল, তাই তো মনে হচ্ছে। এই সন্ন্যাসী সাধারণ মানুষ নয়। বলবান বলে গর্ব ছিল, সেই গর্ব আজ চূর্ণ হয়ে গেল। সন্ন্যাসীর তুলনায় আমি নিতান্তই তুচ্ছ।
আবার জাগল রণহুঙ্কার, রণং দেহি!
রণ দেওয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ না দেখিয়ে জল্লাদ মৃদুস্বরে বলল, কিঞ্জল! আমি রত্নাকর বণিকের বেতনভোগী নই, সুতরাং পালাতে পারি। কিন্তু তোমার পলায়নের উপায় নেই। পলায়ন করলে তোমার প্রভু রত্নাকর ক্রুদ্ধ হবে। কারণ, তাহলে তাকে অর্থদণ্ড দিতে হবে।
গেরুয়াধারীর দিকে চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিঞ্জল বলল, রত্নাকর বণিকের অর্থের চাইতে আমার প্রাণের মূল্য অনেক বেশি। অন্তত আমার কাছে।
গেরুয়াধারী আর অপেক্ষা করল না।
আমি যুদ্ধ শুরু করছি, বলেই এগিয়ে এসে সেই প্রকাণ্ড বৃক্ষকে লাঠির মতো সবেগে চালনা করল শত্রুর দিকে।
–ওফ!
–হা!
চটপট লাফ মেরে আঘাত এড়িয়ে সরে গেল কিঞ্জল ও জল্লাদ। তারা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেই জায়গার উপর সশব্দে আছড়ে পড়ল গেরুয়াধারীর গাছ।
একটানে গাছকে আবার তুলে নিয়ে মাথার উপর ঘোরাতে ঘোরাতে গেরুয়াধারী বলল, দ্বিপদ নেকড়ে দেখছি চতুষ্পদের মতোই ক্ষিপ্র! কিন্তু প্রথম আঘাত এড়িয়ে গেলেও দ্বিতীয়বার আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না!… আরে! আরে! তোমরা যুদ্ধ না করেই পলায়ন করছ? ধিক! ভীরু! কাপুরুষ!
তীরবেগে ছুটতে ছুটতে পার্শ্ববর্তী সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে কিঞ্জল বলল, জল্লাদ! ভণ্ডটা আমাদের ভীরু কাপুরুষ বলছে যে!
গতিবেগ একটুও না কমিয়ে জল্লাদ বলল, বলতে দাও হে, বলতে দাও। কিঞ্জল! মন্দ লোকের কথায় কখনো কান দিতে নেই।
নগরবাসীরা জল্লাদ ও নেকড়ের-বাহিনীর বহু অত্যাচার দেখেছে, অস্ত্রচালনায় তাদের দক্ষতার কথাও তাদের অবিদিত নয়-কিন্তু তারা যে দ্রুতধাবনে বেগবান অশ্বকেও লজ্জা দিতে পারে এই সত্যটি নাগরিকের জানা ছিল না।
দেখতে দেখতে পথের মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল কিঞ্জল ও জল্লাদ। তাদের পিছনে তাড়া করে ছুটল জনতার হর্ষধ্বনি। সবাই বুঝল বেশ কিছুদিনের মধ্যে নেকড়ে-বাহিনী আর নগরীর বুকে আত্মপ্রকাশ করতে চাইবে না।
অকস্মাৎ কলভবর্মার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল রত্নাকরের দিকে গোলমালের মধ্যে জনতার ভিতর আত্মগোপন করে সে সরে পড়ার চেষ্টা করছে! তৎক্ষণাৎ ঘোড়া চার্লিয়ে কলভবর্মা তার পাশে এসে দাঁড়ালেন, তারপর কঠিন স্বরে বললেন, দাঁড়াও রত্নাকর, কোথায় যাচ্ছ? যুদ্ধে তোমার নেকড়ের দল পরাজিত। নিঃশব্দে পলায়ন করে তুমি আইনকে ফাঁকি দিতে পারবে না। মল্লযোদ্ধাকে প্রতিশ্রুত অর্থ না দিলে আমি তোমাকে গ্রেপ্তার করব। বিচারে তোমার কারাদণ্ড অনিবার্য।
তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে জয়দ্রথ বলল, কেতোয়াল মহাশয়। আপনি যদি ভেবে থাকেন রত্নাকর পলায়নের চেষ্টা করছে, তাহলে আপনি ভুল করেছেন। রত্নাকর অতি দ্রুত গৃহে গমন করছিল প্রতিশ্রুত সহস্র স্বর্ণমুদ্রা এনে আমার হাতে সমর্পণ করার জন্য তাই নয় কি রত্নাকর?
বিব্রত বণিক ব্ৰস্তস্বরে বলে উঠল, যথার্থ! যথার্থ! হাস্যসংবরণ করে কলবর্মা বললেন, বটে! বটে! তাহলে আমিও রত্নাকর আর জয়দ্রথের সঙ্গী হব। আমার সম্মুখে রত্নাকর বণিক মল্লযোদ্ধা জয়দ্রথের হাতে দুই সহস্র স্বর্ণমুদ্রা দিলে সুখী হব। রত্নাকর! এই ব্যবস্থা কেমন?
ইয়ে-হ্যাঁ-অর্থাৎ, উত্তম ব্যবস্থা।
জয়দ্রথ বলল, কোতোয়াল মহাশয়! সহস্র স্বর্ণমুদ্রার কিয়দংশ কর্ণদেব নামে এই কিশোর এবং গেরুয়াধারীর প্রাপ্য। ওরা না থাকলে আমি– আরে গেরুয়াধারী কোথায়?
জয়দ্রথ! আমি অর্থের প্রত্যাশী নই,কর্ণদেব বলে উঠল, কিন্তু গেরুয়াধারী কোথায় অদৃশ্য হলেন?
জনতার ভিতর থেকে এক বলিষ্ঠদর্শন বৃষস্কন্ধ পুরুষ আত্মপ্রকাশ করল, আমি দেখেছি উনি নগরীর পূর্বদিকে গমন করেছেন। ওইদিকেই ওঁর বাসগৃহ। খুব সম্ভব পুরস্কার গ্রহণে অনিচ্ছুক বলেই বল্লভ নিঃশব্দে স্থানত্যাগ করেছেন। বল্লভ স্বভাবত প্রচারবিমুখ।
কর্ণদেব বলল, ওঁর নাম বল্লভ? তুমি ওঁকে জানো দেখছি। আমি ওই মহাশক্তিধর সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথা বলতে চাই। কোথায় তাকে পাব?
বলিষ্ঠ ব্যক্তি বলল, বল্লভ গেরুয়াধারণ করলেও সন্ন্যাসী নন। তবে তার কিছু শিষ্য আছে। স্বল্পসংখ্যক ওই শিষ্যদের মধ্যে আমি অন্যতম। কিন্তু বল্লভের পরিচয় তার মুখ থেকেই পাওয়া ভালো। এই নগরীর পূর্বপ্রান্তে সন্ধান করলে তাকে পাবে। দ্রুত পদচালনা করলে পথেও সাক্ষাৎ হতে পারে।
বক্তার পেশিবদ্ধ বিপুল দেহ নিরীক্ষণ করে কর্ণদেব মনে মনে বলল, বল্লভ সন্ন্যাসী হয়েও কেন গৈরিকধারণ করেন জানি না, তবে তার কার্যকলাপ দেখে আর শিষ্যের বপুদংশন করে মনে হয় আত্মার উন্নতির চাইতে মাংসপেশীর উন্নতিসাধন করতেই বল্লভ সমধিক তৎপর।
সে বল্লভের নির্দেশ অনুসারে নগরীর পূর্বদিক লক্ষ্য করে পদচালনা করল।
কর্ণদেব! পিছন থেকে জয়দ্রথের আহ্বান ভেসে এল, কোথায় চললে? পুরস্কারের অর্থে তোমারও অংশ আছে যে!
কর্ণদেব দুর থেকেই চিৎকার করে বলল, জয়দ্রথ! আমি অর্থ চাই না। পুরস্কারের অর্থ তুমি একাই ভোগ করো।
দ্রুতপদে বল্লভের উদ্দেশে নির্দিষ্ট দিকে অগ্রসর হল কর্ণদেব। তার চিন্তার জগতে তখন ঝড় উঠেছে অসাধারণ মানুষ ওই গেরুয়াধারী বল্লভ। যে ভাবেই হোক আজ তাঁর সঙ্গে দেখা করতেই হবে। সময় আর বেশি নেই। কিন্তু পুরস্কারের অর্থে বল্লভের বীতস্পৃহা দেখে ভয় হচ্ছে তিনি হয়তো আমার প্রস্তাবে সম্মত হবেন না। হয়তো তিনি ধনবান, সেক্ষেত্রে তাকে আমি প্রলুব্ধ করতে পারব কি?… তবে কি আবার আমাকে ফিরে আসতে হবে জয়দ্রথের কাছে?… কিন্তু জয়দ্রথ আর বল্লভ? ফুঃ!… বল্লভের কাছে জয়দ্রথ হচ্ছে মাতঙ্গের কাছে পতঙ্গের মতোই তুচ্ছ। শাস্ত্রে অবশ্য মধুর অভাবে গুড় দেওয়ার উপদেশ প্রচলিত আছে… দেখা যাক।
.
০৭. বিপন্ন বল্লভ
নগরীর পূর্বদিকে একটি পথ ধরে এগিয়ে চলছিল বল্লভ। তার মনে তখন অজস্র প্রশ্ন- জনতার ভিতর থেকে সরে তত পড়লাম… কিন্তু কে ওই কর্ণদেব? বয়সে কিশোর, অথচ অস্ত্র চালনায় সিদ্ধহস্ত!… অপরিচিত মল্লযোদ্ধা জয়দ্রথের সন্ধান করছিল কেন ওই রহস্যময় কিশোর? কি তার উদ্দেশ্য?
আচম্বিতে তার পিছন থেকে ভেসে এল এক তীব্র কণ্ঠস্বর, বল্লভ! ওহে বল্লভ!
বল্লভ চমকে ফিরে দাঁড়াল। তাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে এল শীর্ণকায় এক খর্বাকার ব্যক্তি।
বল্লভের সামনে এসে খর্বকায় ব্যক্তি বলল, এই যে বল্লভ! কোথায় চলেছ?
–গৃহে।
-বেশ, বেশ। কিন্তু আর তিনদিন পরেই সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। আশা করি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তুমি কর্তব্য পালন করবে?
–আমি- আমি– অনুগ্রহপূর্বক আমাকে আরও পক্ষকাল সময় দিন। আমি নিশ্চয় করে বলছি–
–স্তব্ধ হও। তুমি কোনোদিনই কর্তব্য পালনে সমর্থ হবে না। নির্লজ্জ। আজ থেকে তিনদিনের মধ্যে যদি তোমার কথা না রাখতে পারো তবে তোমাকে কুকুরের ন্যায় গৃহ থেকে বিতাড়িত করবে!
সাবধান! পিছন থেকে ভেসে এল অজ্ঞাত কণ্ঠে সতর্কবাণী, বল্লভ সম্মানিত নাগরিক। তাকে পুনরায় অপমান করলে আমি তোমার জিহ্বা ছেদন করব।
খর্বাকায় ব্যক্তি সভয়ে তাকিয়ে দেখল তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে এক কিশোর। কিশোরের কটিবন্ধে তরবারি ও ছুরিকা, সায়াহ্নের অন্ধকারেও দৃষ্টিগোচর হয়।
বল্লভের ভয়ার্ত মুখে ফুটল আনন্দের আভাস, কর্ণদেব! তুমি! তুমি কি পুরস্কার গ্রহণ করতে যাওনি?
কর্ণদেব বলল, না। আমি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্যই ছুটে আসছি। লোকমুখে আপনার গন্তব্য পথের নির্দেশ গ্রহণ করে পদচালনা করেছি অতি দ্রুতবেগে। ভাগ্যক্রমে পথেই আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। নচেৎ, অনর্থক আপনার গৃহের অনুসন্ধানে বিলম্ব হতো।
খর্বাকার ব্যক্তি শ্যেন দৃষ্টিতে কর্ণদেবকে নিরীক্ষণ করছিল, এবার সে কথা বলল, বল্লভ! আজকাল বুঝি অস্ত্রধারী দুর্বত্তরা তোমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করছে?
কর্ণদেব ক্রুদ্ধস্বরে বলল, আমি অস্ত্রধারী বটে, তবে দুর্বৃত্ত নই। বল্লভের শিষ্যত্ব আমি গ্রহণ করি নি, ভবিষ্যতে তার শিষ্য হওয়ার বাসনাও নেই… কিন্তু বল্লভ! আপনার ন্যায় মহাবল পুরুষকে এই দ্বিপদ কৃকলাস অপমান করে কোন সাহসে?
বল্লভ বলল, আমার ভগ্নীর বিবাহ উপলক্ষে আমার পিতা উত্তানপাদ নামক এই কুসীদজীবীর কাছে বসতবাটী বন্ধক রেখে তিন শত স্বর্ণমুদ্রা ঋণস্বরূপ গ্রহণ করেছিলেন। পিতা ছিলেন সওদাগর। তার বাণিজ্যপোত সেই সময়ে দূর দেশে অবস্থান করছিল। হঠাৎ ভালো সম্বন্ধ স্থির হয়ে গেল বলে পিতা তৎক্ষণাৎ কন্যার বিবাহ দিলেন। ঘরে যা অর্থ ছিল তার পরিমাণ কম ছিল না, কিন্তু অত্যধিক আড়ম্বর করার জন্য সঞ্চিত অর্থে টান পড়ল। কয়েক মাসের মধ্যেই। বাণিজ্যপোতগুলি ফিরে আসার কথা তাই পিতা ঋণগ্রহণে ইতস্তত করেননি। পিতার শরীর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, মাতৃহারা কন্যার বিবাহের জন্য তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ঋণগ্রহণ করে তাড়াতাড়ি বিবাহ দেওয়ার সেটাও একটা কারণ। কিন্তু ভগ্নীর বিবাহের পরই ঘটল ভাগ্য-বিপর্যয়। কিছুদিন পরেই দুঃসংবাদ এল- ঝড়ের মুখে বাণিজ্যপোতগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে। পিতা তার সমস্ত অর্থ ওই বাণিজ্যে নিয়োগ করেছিলেন, অতএব বাণিজ্যপোতগুলি বিনষ্ট হওয়ায় আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। ভগ্নস্বাস্থ্য ও ভগ্নহৃদয় নিয়ে পিতা সেই বৎসরেই দেহত্যাগ করলেন। কিন্তু কুসীদজীবী উত্তানপাদের ঋণ রয়ে গেল। আর সেই ঋণ শোধ করার জন্য রইলাম আমি। তিনশত স্বর্ণমুদ্রা দুই বৎসরের মধ্যেই সুদে-আসলে তিনসহস্রে পরিণত হয়েছে। আগামী তিনদিনের মধ্যে ঋণ শোধ করতে না পারলে রাজদ্বারে অভিযোগ জানিয়ে উত্তানপাদ আমার পৈতৃক গৃহ অধিকার করবে। আমি অধমর্ণ– বাধ্য হয়ে উত্তমর্ণের কটুবাক্য সহ্য কবছি।
কর্ণদেব কুসীদজীবীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, উত্তানপাদ! কাল প্রভাতে বল্লভ তোমার গৃহে তিন সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পৌঁছে দেবেন এবং চুক্তিনামাটি ফিরিয়ে নেবেন। এখন তুমি অন্যত্র গমন করো।
দুজনেই স্তম্ভিত!
সহসা ব্যঙ্গভরে হেসে উঠল উত্তানপাদ, তিন সহস্র স্বর্ণমুদ্রা তুমি দেবে? হাঃহাঃহাঃ! তোমার কাছে তিনটি স্বর্ণমুদ্রাও আছে কিনা সন্দেহ!
নির্বোধ কুসীদজীবী, কর্ণদেব রূঢ়স্বরে বলল, আমার কটিবন্ধে রক্ষিত একটিমাত্র রত্নের উপযুক্ত মূল্য তোমার কোষাগারে আছে কিনা সন্দেহ!
কটিবন্ধের গোপন স্থান থেকে কর্ণদেবের ডান হাতের মুঠিতে আবির্ভূত হল একটি ক্ষুদ্র বস্তু সন্ধ্যারম্লান অন্ধকারে সেই প্রস্তরবৎ বস্তুটি অজস্র আলোক স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে জ্বল জ্বল করে উঠল!
উত্তানপাদ সাগ্রহে হাত বাড়িয়ে দিল, দেখি! দেখি! একবার আমার হাতে দাও।
–দেখ। দেখে নয়ন সার্থক করো।
এ তো দেখছি মহামূল্য বৈদূর্যমণি! এই বস্তুটি তুমি কোথায় পেলে?
অবান্তর প্রশ্ন। এখন অনুগ্রহ করে মণি আমার হাতে ফিরিয়ে দাও।
উত্তানপাদের ওষ্ঠাধরে জাগল ধূর্ত হাসির রেখা, সে মণিটি কর্ণদেবের হাতে দিয়ে বলে উঠল, মণি তুমি কোথায় পেয়েছ এই প্রশ্ন আমার মুখে নিশ্চয়ই অবান্তর! কিন্তু নগরকোটালের কাছে এক নগণ্য কিশোরের কটিবন্ধে মহামূল্য বৈদূর্যমণির অবস্থানের প্রশ্ন বোধহয় নিতান্ত অবান্তর প্রসঙ্গ বলে বিবেচিত হবে না।
কর্ণদেবের ভ্রুকুঞ্চিত হল, বটে?
–তবে কাল প্রভাতে তিন সহস্রের পরিবর্তে যদি ছয় সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পাই, তাহলে এই সংবাদ নগরকোটালের কর্ণকুহরে প্রবেশ করবে না।
-ওহে উত্তানপাদ, শ্রবণ করো। আমি যেখান থেকে এই মণি পেয়েছি, সেইখানে এইপ্রকার অজস্র মণিমাণিক্য আছে। তোমাকে সন্ধান বলে দিচ্ছি- ইচ্ছা করলে তুমি সেই গোপন স্থান থেকে ওইসব রত্ন আরোহণ করতে পারো, অথবা নগরকোটালকে ওই স্থানের সন্ধান দিতে পারো।
–এইবার তুমি সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছ। ওহে কিশোর, আমি জানি বৈধ উপায়ে এই মণি তোমার হস্তগত হয় নি। যাই হোক, আমি যদি লাভবান হই, তাহলে নগরকোটালের কাছে গিয়ে তোমাকে বিপন্ন করব না। বলো কোথায় আছে ওইসব মূল্যবান মণিমাণিক্য।
এসব গোপন কথা প্রকাশ্যে বলা চলে না। কানে কানে বলছি। শোনো।
উত্তানপাদের কানের কাছে মুখ এনে কর্ণদেব কি যেন বলল। বল্লভ কথা শুনতে পেল না, কিন্তু দেখল উত্তানপাদের সর্বাঙ্গ হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মতো শিহরিত হল!
সে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল, সেকি! কী ভয়ংকর!… না, না, না, আমি মণিমাণিক্য চাই না।
কর্ণদেবের অধরে জাগল নিষ্ঠুর হাসির রেখা, আর ছয় সহস্র স্বর্ণমুদ্রা?
–না, না। আমি তিন সহস্র পেলেই খুশি।
তিন সহস্র নয়, কর্ণদেব তীব্রস্বরে বলল, তুমি সুদ পাবে না। আসল তিনশত নিয়ে তুমি বল্লভকে নিষ্কৃতি দেবে। নচেৎ–
-ঠিক আছে। ঠিক আছে। আমি তিনশত স্বর্ণমুদ্রার বেশি দাবি করব না।
–আচ্ছা। এখন শীঘ্র এই স্থান ত্যাগ করো।
দ্রুত পদক্ষেপে অন্তর্ধান করল কুসীদজীবী উত্তানপাদ। বল্লভ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইল, তারপর বলল, ব্যাপারটা কি হল বলল তো কর্ণদেব?
-কুসীদজীবী উত্তানপাদের সুমতি হয়েছে।
–অকস্মাৎ উত্তানপাদের এমন সুবুদ্ধির উদ্রেক হল কেন? কর্ণদেব! তুমি চুপি চুপি ওর কানে কি মন্ত্র দিয়েছ?
-কিছু না। মন্দলোকের কি সুবুদ্ধি হয় না? বল্লভ! পৃথিবীর বুকে অন্ধকার নেমে আসছে। আজ রাত্রে আমি আপনার গৃহে অতিথি হতে চাই। আপত্তি নেই তো?
বিজ্ঞজন বলেন, অজ্ঞাত কুলশীলকে গৃহে স্থান দিতে নেই, কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারি। চলো।
কিছুক্ষণ দুজনেই নিঃশব্দে গন্তব্যস্থলের দিকে অগ্রসর হল। প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করল কর্ণদেব, বল্লভ! সামান্য অর্থের জন্য ঘৃণ্য কুসীদজীবী আপনাকে অপমান করতে সাহস পায়? আপনি ইচ্ছা করলেই প্রচুর অর্থের অধিকারী হতে পারেন।
প্রচুর অর্থ? না, প্রচুর অর্থ উপার্জনের যোগ্যতা আমার নেই, কর্ণদেব।
-কেন নয়? আজই তো আপনি জয়দ্রথের পুরস্কারের অর্থে আপনার প্রাপ্য না নিয়েই স্থানত্যাগ করলেন। কিন্তু কেন? আপনার তো অর্থের প্রয়োজন আছে।
-ওই অর্থে যদি ঋণ শোধ করতে পারতাম তাহলে হয়তো ইচ্ছার বিরুদ্ধে পুরস্কারের অংশগ্রহণ করতাম। কিন্তু সহস্র স্বর্ণমুদ্রা থেকে আমি কত পেতাম?… হয়তো তিনশত। তাতে আমার ঋণশোধ হত না। অবশ্য তুমি কোন মন্ত্রবলে নরপিশাচ উত্তানপাদকে বশীভূত করেছ জানি না, তবে সুদ ছেড়ে আসলের তিনশত স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে সে আমাকে অব্যাহতি দিত না কিছুতেই। তাছাড়া আমি নেকড়ে-বাহিনীর বিরোধিতা করেছিলাম একটি কিশোরকে, অর্থাৎ তোমাকে, অপঘাতে মৃত্যু থেকে বাঁচানোর জন্য সেক্ষেত্রে পুরস্কারের অর্থ গ্রহণ করলে দেশের মানুষ আমাকে লোভী মনে করত। বিশেষ করে আমার শিষ্যদের কাছে আমার ভাবমুর্তি ক্ষুণ্ণ হত। সেটা আমার পক্ষে অতিশয় বেদনাদায়ক।
-বল্লভ। আমি আপনার মতো একটি মানুষের সন্ধান করছিলাম।
বল্লভের চলার গতি মন্থর হল। সন্ধ্যার ম্লান অন্ধকার ঘনীভূত হয়ে আসন্ন রাত্রির আভাস পরিস্ফুট। অন্ধকার ভেদ করে সঙ্গীর মুখ দেখার চেষ্টা করল বল্লভ, তারপর গম্ভীর স্বরে বলল, কর্ণদেব! তুমি প্রথমে জয়দ্রথের সন্ধান করছিলে এবং তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছিলে। সে তোমার অপরিচিত, তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য তোমার এত আগ্রহ ছিল কেন? তারপর হঠাৎ তুমি জয়দ্রথ সম্পর্কে নিরুৎসুক হয়ে পড়লে। কারণ, তুমি অধিকতর বলশালী আর একটি মানুষকে অর্থাৎ আমাকে আবিষ্কার করলে। বুঝলাম, যে কারণেই হোক, তুমি অত্যন্ত বলশালী একটি মনুষ্যের সন্ধান করছিলে; বলো কর্ণদেব, আমার অনুমান যথার্থ কি না?
-যথার্থ বটে।
তারপর এখন দেখছি তোমার নিকট প্রচুর অর্থ রয়েছে। শুধু স্বর্ণমুদ্রা নয়, তোমার কাছে রয়েছে মহামূল্যবান বৈদূর্যমণি। তুমি শ্রেষ্ঠী বা সওদাগর নও। অথচ তুমি অবহেলাভরে বহন করছ রাজার ঐশ্বর্য! তোমার চালচলন রহস্যময়। এই নগরীতে তুমি নবাগত, তোমার ব্যবহারে তা প্রমাণিত হয়েছে। কেন, কোন উদ্দেশ্যে, তুমি আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চাইছ জানি না; তবে একটা কথা তোমায় জানিয়ে দিচ্ছি– যদি প্রয়োজন হয় তবে পথবাসী বা বনবাসী হতে রাজি আছি, কিন্তু কোনো কারণেই আমি পাপের পথে অগ্রসর হব না।
–বল্লভ! পাপপুণ্য নিতান্তই আপেক্ষিক শব্দ।
–বাঃ! এই বয়সেই দার্শনিক সুলভ তত্ত্বজ্ঞানের অধিকারী হয়েছে দেখছি! অস্ত্রত্যাগ করে শাস্ত্রচর্চা করলে তুমি বোধহয় লাভবান হতে পারতে- বুঝেছ কর্ণদেব?
– শাস্ত্র ও শস্ত্র দুটি বস্তুর সঙ্গেই আমার কিছু পরিচয় ঘটেছে। একসময় পুস্তক হাতে বিদ্যাভ্যাস ছিল আমার একমাত্র কর্তব্য। পরে বুঝলাম শস্ত্রের ক্ষমতা বেশি, তাই–
তাই মসি ছেড়ে অসি ধরেছে? কিন্তু এই মুহূর্তে অসিতে হাত দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ঘটে নি।
কর্ণদেব লজ্জিত হয়ে বলল, ক্ষমা করবেন। ক্ষণিকের উত্তেজনায় আত্মবিস্মৃত হয়েছিলাম। জেনে রাখবেন অসি নয়, মসিই ছিল এক সময়ে আমার প্রিয় বস্তু। আমি ব্রাহ্মণ সন্তান।
অন্ধকারে বল্লভের হাসির শব্দ শোনা গেল, তুমি দেখছি পরশুরামের নতুন সংস্করণ! কিন্তু পরশুরাম কুঠার ধরেছিলেন ধরণীকে ক্ষত্রিয়শূন্য করার জন্য তুমি ব্রাহ্মণসন্তান হয়ে অসি ধারণ করেছ কেন?
কর্ণদেব বলল, আপনার প্রশ্নের উত্তরে অনেক–কী হল?
হঠাৎ হাত বাড়িয়ে কর্ণদেবের গতিরোধ করে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বল্লভ, তারপর অন্ধকারে তীব্ৰদৃষ্টি মেলে কি যেন দেখতে লাগল।
এক নিষ্ঠুর জগতের কঠিন পাঠশালায় জীবনের পাঠ নিয়েছে কর্ণদেব মুহূর্তে সে বুঝে নিল কোনো কারণে পরিস্থিতি হঠাৎ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। আর সেইজন্যই তার সঙ্গীর এই ভাবান্তর।
চারদিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি সঞ্চালন করে কর্ণদেব দেখল একটু দূরে আবছা আলো-আঁধারির মধ্যে দেখা দিয়েছে কয়েকটা মনুষ্যমূর্তি। সন্ধ্যা তখন সবে উত্তীর্ণ, রাত্রি গভীর নয়– এসময়ে পথের উপর পথিকের আবির্ভাব নিতান্ত স্বাভাবিক। কিন্তু বল্লভের ভাবভঙ্গিতে কর্ণদেব বুঝল অদূরে দৃশ্যমান ওই মানুষগুলোর সান্নিধ্যে সে নিরাপদ মনে করছে না। কর্ণদেব মুখে কোনো কথা বলল না, কিন্তু তার সর্বশরীর ধনুকের ছিলার মতো টান হয়ে গেল, বাঁ হাতের শক্ত মুঠিতে ধরা পড়ল তলোয়ারের খাপ, আর ডানহাতের আঙুলগুলো প্রসারিত হয়ে মুহূর্তের মধ্যে অস্ত্রকে কোষমুক্ত করার জন্য প্রস্তুত হল।
সঙ্গীর দিকে না তাকিয়ে বল্লভ বলল, কর্ণদেব! তোমার তরবারিকে ব্যস্ত করার প্রয়োজন হবে না।
তারপর কয়েক পা এগিয়ে তীব্রস্বরে হাঁক দিল, বন্ধুগণ! তোমরা আড়ালে দাঁড়িয়ে কেন? সামনে এসো। আমি গেরুয়াধারী বল্লভ– তোমাদের সঙ্গে বাক্যালাপ করার জন্য উৎসুক।
কয়েকটি মুহূর্ত কাটল নিঃশব্দে। তারপরই পথের উপর জাগল ধাবমান পদশব্দ!… পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে গেল দ্রুতবেগে। কর্ণদেব তাকিয়ে দেখল পথের উপর দণ্ডায়মান মনুষ্য মূর্তিগুলো অন্তর্ধান করেছে।
সে বল্লভের দিকে ফিরে প্রশ্ন করল, কারা যেন দ্রুতবেগে পলায়ন করল। বল্লভ! আপনি ওদের জানেন?
উত্তর এল, জানি। ওরা স্থানীয় দুর্বৃত্ত। অন্ধকারে অসহায় পথিকের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে। এদিকটা নির্জন। অন্ধকারে আমাকে চিনতে না পেরে ওরা আক্রমণের উদযোগ করছিল।
কর্ণদেব বলল, এই জাতীয় জীব আমার অপরিচিত নয়। কিন্তু সন্ন্যাসী না হয়েও যিনি গৈরিক ধারণ করেন এবং যার নাম শুনেই স্থানীয় দুর্বৃত্তগণ ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করে আমি তার পরিচয় পেতে চাই।
বল্লভ বলল, ব্রাহ্মণ-সন্তান হয়েও প্রবীণ ক্ষত্রিয়-যোদ্ধার ন্যায় যে অসি চালনা করে, অতি সাধারণ বেশে সজ্জিত হলেও যার কটিবন্ধে থাকে মহামূল্য বৈদুর্যমণি- সেই রহস্যময় কিশোরকে আমি জানতে চাই।
কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলার পর কিশোর মুখ খুলল, বল্লভ! পরস্পরের পরিচয় জানতে আমরা দুজনেই উগ্রীব। কিন্তু পথে দাঁড়িয়ে বোধহয় বাক্যালাপ করা উচিত হবে না। আমার বক্তব্য অতিশয় গোপনীয়।
নিকটেই আমার গৃহ আর সামনে পড়ে আছে দীর্ঘরাত্রি। অতএব গোপনীয় বিষয় নিয়ে নির্জনে বাক্যালাপের বিশেষ অসুবিধা হবে না।… এই যে! এই কুটিরই হচ্ছে অধমের বাসস্থান।
সম্মুখে অবস্থিত প্রাসাদোপম অট্টালিকার দিকে তাকিয়ে কর্ণদেব সবিস্ময়ে বলল, এই অট্টালিকা আপনার বাসস্থান?
বল্লভ বিনীত কণ্ঠে বলল, এই কুটিরই আমার বাসস্থান।
.
০৮. ব্যাঘ্র ও হস্তী
অট্টালিকার দ্বার বাহির থেকে লৌহকীলকে আবদ্ধ ছিল। কাপড়ের ভিতর থেকে বিশেষভাবে নির্মিত একটি সুবৃহৎ লৌহশলাকা নিয়ে বল্লভ দ্বার অনর্গলমুক্ত করল, তারপর প্রবেশ করল ভিতরে।
অট্টালিকার অভ্যন্তরে ঘন অন্ধকারের গর্ভে অদৃশ্য বল্লভের গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কর্ণদেব! ক্ষণেক অপেক্ষা করো। আমি দীপ জ্বালছি।
একটু পরেই জ্বলন্ত মৃৎপ্রদীপ হস্তে দ্বারদেশে আত্মপ্রকাশ করল বল্লভ, কর্ণদেব! অনুগ্রহ করে ভিতরে এসে আমার আতিথ্য গ্রহণ করলে সুখী হব। আমার সামর্থ্য অতি সামান্য। অতএব, অতিথি সৎকারের ত্রুটি মার্জনীয়। তবে আমার সাধ্য অনুযায়ী অতিথিকে সমাদর জানাতে চেষ্টা করব এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কর্ণদেব দ্বারের ভিতর পদক্ষেপ করে হেসে উঠল, এই বিশাল অট্টালিকাকে যিনি কুটির বলে অভিহিত করেন, তার অতিথি সকারের সামান্য প্রয়াস যে অপরের কাছে অসামান্য বলে বিবেচিত হবে সে বিষয়েও আমার সন্দেহ নেই।
–ভিতরে এসো।
প্রদীপ হাতে এগিয়ে চলল বল্লভ। তাকে অনুসরণ করল কর্ণদেব। সঙ্কীর্ণ অলিন্দ এবং ক্ষুদ্র ও বৃহৎ বহু কক্ষের মধ্যবর্তী পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে কর্ণদেব বুঝল অতিশয় ধনবান না হলে এমন একটি অট্টালিকার অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। দীপের ম্লান আলোতেও সে বুঝতে পারল অত্যন্ত মূল্যবান প্রস্তর, কাষ্ঠ ও ইস্পাত সহযোগে নির্মিত হয়েছে এই বাসগৃহ। বল্লভের পিতা যে একসময় প্রচুর বিত্তের অধিকারী ছিলেন সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হল কর্ণদেব।
…বেশ কিছুক্ষণ পদচালনা করার পর বল্লভকে অনুসরণ করে কর্ণদেব এসে পড়ল একটি সুবৃহৎ কক্ষের অভ্যন্তরে। আসার পথে গৃহের মধ্যে বহু দুর্মূল্য তৈজসপত্র এবং স্ফটিক খচিত দীপাধার প্রদীপের আলোতে কর্ণদেবের দৃষ্টিগোচর হয়েছে কিন্তু এই ঘরটি সর্বপ্রকার বাহুল্য বর্জিত। ঘরের একপাশে একটি মূল্যবান পালঙ্ক রয়েছে। তবে তার উপর বিস্তৃত বস্ত্রটি খুব পরিষ্কার নয়। ঘরের মাঝখানে দারুনির্মিত দীপাধার। গৃহের অন্যান্য স্থানে প্রদীপের ম্লান আলোতেও ধুলোর আধিক্য কর্ণদেবের দৃষ্টিগোচর হয়েছে, কিন্তু এই ঘরটি বেশ পরিচ্ছন্ন।
ঘরের সামনে একটি জলপূর্ণ পাত্র ছিল। সেইদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বল্লভ বলল, তুমি হাত-মুখ পরিষ্কার করে নাও, তারপর ওই শয্যায় বিশ্রাম গ্রহণ করো। আমি এখনই আসছি।
কক্ষের মধ্যস্থলে অবস্থিত দীপাধারে রক্ষিত দীপে অগ্নিসংযোগ করে বিশাল অট্টালিকার গর্ভে হারিয়ে গেল বল্লভ। দ্বারের বাইরে চর্মপাদুকা রেখে বল্লভের পরামর্শ অনুসারে প্রক্ষালন-পর্ব শেষ করে কর্ণদেব আশ্রয় গ্রহণ করল পালঙ্কের উপর বিস্তৃত শয্যায়।
প্রচণ্ড দৈহিক পরিশ্রম আর মানসিক উত্তেজনার পর কিছুটা নিশ্চিন্ত বিশ্রামের সুযোগ পেয়ে তার ক্লান্ত দেহ শয্যার উপর এলিয়ে পড়তে চাইছিল, কিন্তু সে আত্মসংবরণ করল। অতি অল্প বয়সেই বহু তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে কিশোর কর্ণদেব! শ্বাপদের চেয়েও ভয়ংকর দ্বিপদ মানুষের পরিচয় সে পেয়েছে বারংবার। অতএব, শয্যায় শয়ন করার প্রলোভন সংযত করে সে সোজা হয়ে বসে থাকল, এমনকি কটিবন্ধে আবদ্ধ তরবারি ও ছুরিকা রইল যথাস্থানেই। বল্লভকে সে অবিশ্বাস করে নি, কিন্তু অপরিচিত স্থানে দেহ-সংলগ্ন অস্ত্র তার কাছে প্রিয়বন্ধুর সান্নিধ্যের মতোই আশ্বাসজনক- কোনো কারণেই আত্মরক্ষার উপকরণ সে দূরে রাখতে রাজি নয়।
…অকস্মাৎ তার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করল শলাকাপক্ক মাংসের লোভনীয় গন্ধ! তৎক্ষণাৎ সে অনুভব করল তার দেহের মধ্যে উদর নামে যে স্থানটি রয়েছে, সেটি একেবারেই শূন্য! এতক্ষণ ক্ষুধাতৃষ্ণার কথা তার মনেই হয় নি, কিন্তু শুল্য মাংসের ঘ্রাণ গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে হল উদরের শূন্যতাকে অবিলম্বে কিছু স্থূল বস্তুর সাহায্যে পরিপূর্ণ করার প্রয়োজন উপস্থিত হয়েছে। সেই সঙ্গে তার রসনাও হয়ে উঠল রসসিক্ত!…।
কিছুক্ষণ পরেই সহাস্যবদনে দ্বারপথে আবির্ভূত হল বল্লভ। তার দুই হাতে দুটি বৃহৎ স্থালীতে অবস্থান করছে দুটি সুবৃহৎ পাত্র। পাত্র দুটি কক্ষতলে স্থাপন করে বল্লভ বলল, এসো। গৃহে রমণী থাকলে তারা জলসিক্ত বস্ত্র ও সম্মার্জনী সহযোগে এই মণিকুটিম বিশেষ ভাবে পরিষ্কার করে আহার্য পরিবেশন করত কিন্তু আমার গৃহে নারী নেই এবং আমারও বারংবার কক্ষতল পরিষ্কার করার ধৈর্য নেই। দ্বিপ্রহরে গৃহত্যাগ করার পূর্বে এই স্থান আমি জলসিক্ত করে সম্মার্জনী সহযোগে উত্তমরূপে পরিষ্কার করেছি। পুনরায় ওই গৃহকর্মের পুনরাবৃত্তি করতে আমি অনিচ্ছুক। অবশ্য তুমি যদি প্রয়োজন মনে করো–
না, না, কর্ণদেব প্রতিবাদ করল, আমি আদৌ প্রয়োজন বোধ করছি না।… কিন্তু এই কি আপনার সামান্য সামর্থ্যের উদাহরণ?
হে, হে, বল্লভ বিনীত হাস্যে বিগলিত হল, এই যৎসামান্য উপকরণ দিয়েই তোমার দরিদ্র বন্ধু আজ অতিথি সৎকার করতে চাইছে। তুমি অনুগ্রহ করে খাদ্যগ্রহণ করলে আমি কৃতার্থ হব।
কর্ণদেব গম্ভীর স্বরে বলল, এই পর্বত প্রমাণ পিষ্টক, চাপটি আর ওই বৃহৎ পাত্রে অবস্থিত বিপুল পরিমাণ শূল্য মাংস দিয়ে তিন-চারটি বলিষ্ঠ পুরুষের ক্ষুধা-নিবারণ সম্ভব। আমি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত বটে, তবে ওই স্থালী ও পাত্রের যাবতীয় খাদ্য গ্রহণ করলে উদর বিদীর্ণ হয়ে আমার মৃত্যু সুনিশ্চিত।
বল্লভের মতামতের জন্য অপেক্ষা না করে কর্ণদেব একটি স্থালী ও পাত্র থেকে বেশ কিছু খাদ্য নিয়ে অপর স্থালীতে রাখল, তারপর লঘভার স্থালী ও পাত্র সম্মখে স্থাপন করে বলল, বল্লভ! খাদ্য নিয়ে প্রহসন স্থগিত রাখুন! এমন রাজভোগ্য খাদ্য উপভোগ করার সুযোগ আমার জীবনে কমই হয়েছে। এবার শুরু করুন। সম্মুখে ষোড়শ-উপচারে ভোজ্য রেখে খাদ্য নিয়ে বিতর্ক বাঞ্ছনীয় নয়।
কর্ণদেবের ভোজন-পাত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করে বল্লভ ক্ষুব্ধস্বরে বলল, অসিযুদ্ধকে যারা জীবিকারূপে গ্রহণ করে, তারা স্বল্পভোজী হয় বটে। তবে তোমার বয়সে এত কম খাওয়া ভালো নয়। ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দৈহিক শক্তিরও প্রয়োজন আছে একথা কিশোর অসিযোদ্ধার মনে রাখা উচিত।
কর্ণদেব হাসল, ব্যাঘ্রের পক্ষে হস্তীর সমপরিমাণ আহার্য গলাধঃকরণ করা অসম্ভব। দেহের শক্তিতেও সে হস্তীর সমকক্ষ নয়। কিন্তু বিদ্যুৎ গতিবেগ ও প্রখর নখদন্তের সহায়তায় সে কখনো কখনো তার চাইতে বহুগুণে শক্তিশালী হস্তীকেও পরাস্ত করতে সমর্থ হয় একথা কি আপনি জানেন না?
বল্লভ সহাস্যে বলল, তোমার যুক্তি অকাট্য। কিন্তু শলাকাপক্ক মাংস শতীল হলে বিস্বাদ হয়। ভোজনপর্ব শেষ হলে ব্যাঘ্র ও হস্তীর চাইতে অধিকতর প্রয়োজনীয় প্রসঙ্গ নিয়ে আমরা আলোচনা করব। এখন বাক্যালাপ স্থগিত রেখে দক্ষিণ হস্তের সদ্ব্যবহার করা যাক কী বলে?
আমি আপনার সঙ্গে একমত। শুন্য উদরে কোনো প্রসঙ্গই ভালো লাগে না।
.
০৯. বিশ্বস্ত অনুচর
দীপাধারে জ্বলছে প্রদীপ। বাতায়ন পথে তারকাখচিত অন্ধকার আকাশে দৃষ্টি প্রসারিত করে পালঙ্কের উপর উপবিষ্ট বল্লভ ও কর্ণদেব সম্পূর্ণ নির্বাক। উচ্ছিষ্ট ভোজনপাত্রগুলি একটু আগেই স্থানান্তরে রেখে এসেছে বল্লভ। তার মনে প্রশ্নের ঝড় কিন্তু আহার্য দ্রব্যে অতিথির তৃপ্তি হয়েছে জেনেই সে নীরব হয়ে গেছে, ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারণা করেনি একবারও মনোগত ইচ্ছা- অতিথির দিক থেকেই যেন আলোচনার উত্থাপন হয়।
অপর পক্ষে কর্ণদেবও মৌন। বল্লভের প্রশ্নের উত্তরে সে জানিয়েছে, এমন সুস্বাদু খাদ্য আর এমন আকণ্ঠ ভোজনের অভিজ্ঞতা তার জীবনে খুবই কম- সেই সঙ্গে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতেও ভুল হয়নি কিন্তু তারপরই সে মৌনব্রত ধারণ করেছে।
বল্লভ একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকাল অতিথির মুখের দিকে। কম্পিত দীপশিখা আর নক্ষত্রের আলোতে সেই মুখ রহস্যময়। মুখ দেখে মুখের অধিকারীর মনোভাব অনুমান করা দুঃসাধ্য। কেবল মাঝে মাঝে ম্লান দীপালোকে মসৃণ ললাটপটে কুঞ্জনরেখার ক্ষণিক আবির্ভাব এবং ওষ্ঠাধরের মৃদু কম্পনে বোঝা যায় অতিথির দেহ স্থির থাকলেও মন অস্থির হয়ে বিচরণ করছে চিন্তার জগতে।
অকস্মাৎ স্তব্ধতা ভঙ্গ করল কর্ণদেব, আপনি আমার পরিচয় জানতে উৎসুক। আমিও পরিচয় দিতে চাই এবং আপনার সম্পূর্ণ পরিচয় পেতে চাই। তবে একটা কথা–
—বলো।
আমি কি আপনার গৃহে নিরাপদ?
-অবশ্যই। বল্লভের গৃহে তার অতিথি সর্বদাই নিরাপদ। হঠাৎ নিরাপত্তার প্রশ্ন তোমার মনে এল কেন জানি না। যাই হোক, আমার মনেও কিছু প্রশ্নের উদয় হয়েছে। ধীর ভাবে আমার কথা শুনে উত্তর দাও।
–বলুন।
-একটু আগেই তুমি উত্তানপাদকে বলেছ আগামী কাল প্রত্যূষেই আমি নাকি তিনশত স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে তার গৃহে উপস্থিত হচ্ছি এবং উক্ত অর্থের বিনিময়ে ফিরিয়ে আনছি বন্ধকি ভদ্রাসনের চুক্তিপত্র। বলাই বাহুল্য, আমরা দুজনেই ধরে নিয়েছি ওই অর্থ দিচ্ছ তুমি। আমি তোমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করিনি, কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্য হয়েছি নিঃস্বার্থ ভাবে এত অর্থ কেউ অপরিচিত ব্যক্তিকে দান করে না। আমার কাছে তোমার কৃতজ্ঞ থাকার কিছু কারণ অবশ্য ঘটেছে। তবু বলব, তিনশত স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করার স্বপক্ষে কারণটা যথেষ্ট নয়। ওই অর্থের বিনিময়ে তুমি আমার কাছে কিছু চাও। কিন্তু আমার মতো দরিদ্রের কাছে তুমি কি চাইতে পারো?… আচ্ছা, এবার তাহলে কার্যকারণ বিশ্লেষণ করা যাক– কোনো অজ্ঞাত কারণে জয়দ্রথের সঙ্গে তুমি ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিলে, পরে আমার দৈহিক শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে জয়দ্রথের সাহচর্য ত্যাগ করে তুমি আমার নিকটে এসে আমার বন্ধুত্ব অর্জনের চেষ্টা করছ। দৈহিক শক্তি ছাড়া জয়দ্রথের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই এবং পূর্বোক্ত মল্লযোদ্ধার চাইতে অধিকতর শক্তিমান বলেই আমি তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি! অতএব অনুমান করছি এমন কোনো কঠিন কার্যসাধন করার জন্য তুমি আমার সাহায্য চাও, যে কাজে সাফল্য অর্জন করতে হলে অসামান্য দৈহিক শক্তির প্রয়োজন। আশা করি আমার বিশ্লেষণ ও অনুমান ভুল হয়নি?
সঠিক বিশ্লেষণ! নির্ভুল অনুমান!
-কিন্তু তোমার কার্য সাধনে আমি অসমর্থ হলে বা অনিচ্ছা প্রকাশ করলে নিশ্চয়ই ওই তিনশত স্বর্ণমুদ্রা তুমি আমাকে দিতে রাজি হবে না?
এইবার আপনার ভুল হল। প্রতিশ্রুত তিনশত স্বর্ণমদ্রার সঙ্গে আমার প্রস্তাবের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি উত্তানপাদকে কথা দিয়েছি। প্রতিশ্রুত অর্থ আপনার হাত থেকে কাল প্রভাতেই সে পাবে!
বল্লভের গলার ভিতর থেকে ঘুষ্কার-ধ্বনির ন্যায় অস্ফুট শব্দ নির্গত হল। সে কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু অক্ষম বাগযন্ত্রে কোনো বাক্য উচ্চারিত হল না।
কর্ণদেব হাসল, আপনি বিস্মিত হয়েছেন। হওয়াই স্বাভাবিক। ব্যবসাতে অর্থ লগ্নি করার নিয়ম আছে। মনে করুন, এই তিনশত স্বর্ণমুদ্রা আমি লগ্নি করছি। আপনি যদি আমার প্রস্তাবে অসম্মত হন তাহলে জানব ব্যবসাতে নেমে তিনশত স্বর্ণমুদ্রা আমি হারিয়েছি। ব্যবসাতে লাভ-ক্ষতি আছে, এইটুকু ক্ষতি আমি অনায়াসে সহ্য করতে পারব। আর যদি আমার প্রস্তাবে সম্মতি দেন, তাহলে আমরা যা লাভ করব, সেই লাভের অঙ্ক আপনার কল্পনাতীত।
বল্লভের ভ্রূ কুঞ্চিত হল, আমরা? অর্থাৎ তুমি আর আমি?… অবশ্য কাজটা যদি অন্যায় না হয়, তাহলে দুঃসাধ্য হলেও আমি তা করতে রাজি আছি। বলো– কাজটা কি?
বলব বলেই তো আজ রাত্রে আপনার গৃহে অতিথি হয়েছি। তবে তার আগে আপনার বিষয় আপনার মুখ থেকেই কয়েকটা কথা জানতে চাই। আপনার পূর্ব-ইতিহাস বা দুর্দৈব সম্পর্কে আমি এখন অবহিত, কিন্তু বর্তমান সম্পর্কে বিশেষ সচেতন নই। বিশেষত আপনার চালচলনও কিয়ৎ পরিমাণে রহস্যময়, সে বিষয়ে
বাধা দিয়ে বল্লভ বলে উঠল, আমার চালচলন রহস্যময়? কি বলছ তুমি?
-ঠিকই বলছি। আপনি সন্ন্যাসী নন, অথচ গৈরিকধারণ করেছেন এবং সন্ন্যাসী শ্রেণির ন্যায় মুস্তক মুণ্ডন করেছেন কিন্তু কেন? রাজপথে দাঁড়িয়ে লোকমুখে শুনলাম আপনার কিছু শিষ্য আছে। কুসীদজীবী উত্তানপাদের মুখেও শিষ্যদের প্রসঙ্গ শুনেছি। গৈরিকধারী গৃহীর কাছে ওই শিষ্যরা কোন ধর্মচারণের দীক্ষা গ্রহণ করতে আসে?
সশব্দ হাস্যে ফেটে পড়ল বল্লভ, হো! হো! হো! এই কথা!… হা! হা!… গৈরিকধারণের সঙ্গে সন্ন্যাস গ্রহণের সম্পর্ক থাকতেই হবে এমন কথা তোমাকে শিখিয়েছে কোন বলীর্বদ?.. আরে, শ্বেতবস্ত্র অতি শীঘ্রই মলিন হয়ে দৃষ্টিকটু হয়ে ওঠে, তাই ঘন ঘন বস্ত্র ধৌত করার প্রয়োজন হয়। অনর্থক পরিশ্রম আমি পছন্দ করি না, রজকের শরণাপন্ন হলেও অর্থব্যয় অনিবার্য অতএব শ্বেতবস্ত্রের পরিবর্তে আমি গৈরিকধারণ করেছি। লাল, নীল, সবুজ প্রভৃতি রংও সহজে মলিন হয় না। কিন্তু ওইসব রং তরলমতি তরুণ-তরুণীরা পছন্দ করে বলে উজ্জ্বল বর্ণ বর্জন করে আমি গেরুয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছি। এতে রহস্যের কি আছে বাপু?… আর শিষ্যদের কথা জিজ্ঞাসা করছ? হ্যাঁ, আমার কিছু শিষ্য আছে বটে। তারা আমার কাছে ধর্মাচরণের দীক্ষা নিতে আসে না;- আসে, মল্লযুদ্ধ শিক্ষা করতে। মল্লযুদ্ধে সুবিধা হয় বলেই আমি মস্তক মুণ্ডন করেছি। মল্লবীরদের মধ্যে কোনো কোনো ব্যক্তি যে মস্তক মুণ্ডন করে থাকে, সে কথা নিশ্চয়ই তোমার অজ্ঞাত নয়?
–আপনি কি মল্লযোদ্ধা?
–বাল্যকাল থেকেই আমি মল্লযুদ্ধের প্রতি আসক্ত। শক্তিচর্চার সঙ্গে বিদ্যাভ্যাসও করেছি নিয়মিত, তাই পিতা আমাকে শক্তিচর্চায় বাধা দেননি। আমি বলিষ্ঠ দেহ নিয়েই জন্মগ্রহণ করেছিলাম। তার উপর ধনী পিতার অর্থে যাবতীয় পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন মল্লবীরের আখড়ায় মৃত্তিকা মর্দন করে কয়েক বৎসরের মধ্যেই অমানুষিক শক্তির অধিকারী হলাম। পরে অবস্থা যখন মন্দ হল, তখন মল্লবিদ্যার সাহায্যেই গ্রাসাচ্ছাদন সংগ্রহ শুরু করলাম।
ও! আপনি এখন পেশাদার মল্লযোদ্ধা? অর্থের বিনিময়ে মল্লযুদ্ধের শিক্ষা দিয়ে থাকেন?
–না, না। আমি উচ্চবংশের সন্তান হয়ে মল্লযুদ্ধের মাটি থেকে অর্থ উপার্জন করতে পারি। তাছাড়া ওইভাবে অর্থ উপার্জনে গুরুরও নিষেধ ছিল। আমি কয়েকটি বিশিষ্ট শিষ্যকে মল্লযুদ্ধ সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে থাকি। শিষ্যরা আমাকে গুরুদক্ষিণাস্বরূপ তণ্ডুল, গোধুম, দুগ্ধ, মাংস প্রভৃতি সরবরাহ করে। শিষ্যদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ আছে। কৃষিজীবী কৃষক, দুগ্ধ ব্যবসায়ী গোপ এবং মাংস ব্যবসায়ী ব্যাধ প্রভৃতি সকল শ্রেণির মানুষই আমার শিষ্যদের মধ্যে বর্তমান।
বল্লভ মুহূর্তের জন্য থামল, তারপর বিমর্ষভাবে বলল, না, ভুল বললাম। সকল শ্রেণির মানুষ আমার শিষ্য-সমাজে নেই। আজ পর্যন্ত কোনো ধীবর আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে আসেনি। অথচ মৎস্য আমার অতিশয় প্রিয় খাদ্য। বললে বিশ্বাস করবে না বৎসরাধিকাল আমি মৎস্য থেকে বঞ্চিত। মৎস্যের স্বাদও বুঝি ভুলে গেছি।
কর্ণদেব গম্ভীর স্বরে বলল, আমার প্রস্তাবে সম্মত হলে আপনি প্রত্যহ প্রচুর পরিমাণে মৎস্য ভক্ষণ করতে পারবেন। মৎস্যের জন্য ধীবর শিষ্যের প্রয়োজন হয় না, নগদ অর্থের বিনিময়ে ধীবর পল্লির সর্বোৎকৃষ্ট মৎস্য আপনার রসনার তৃপ্তিসাধন করবে। কাল প্রভাতে আপনি ঋণমুক্ত হচ্ছেন, অতএব সে বিষয়েও আপনার দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই।
দুশ্চিন্তার অবকাশ অবশ্যই আছে, বল্লভ দৃঢ়স্বরে বলল, আমি কারও অনুগ্রহের দান গ্রহণ করিনি, করব না। এই বসতবাটি থেকে যদি ঋণের দায়ে বিতাড়িত হই, তাহলেও বিপুলা এই ধরণীতে আশ্রয়ের অভাব আমার হবে না। মল্লযুদ্ধের কল্যাণে অন্নজলের জন্য আমার দুর্ভাবনা নেই। কোনো কারণে নগদ অর্থের প্রয়োজন হলে বন থেকে আমি কুঠারের সাহায্যে কাষ্ঠ সংগ্রহ করি। আমি সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান, তাই বিপণিতে দাঁড়িয়ে সংগৃহীত কাষ্ঠ জনসমক্ষে বিক্রয় করতে পারি না। কাঠুরিয়াদের কাছে অপেক্ষাকৃত সুলভ মূল্যে ওই কাষ্ঠ বিক্রয় করে আমি প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করি। অতএব বুঝতেই পারছ গৃহহারা হওয়ার ভয়ে আমি ভীত নই। যে গৃহে আমার পিতা-মাতা দেহরক্ষা করেছেন, যে গৃহের সঙ্গে আমার স্নেহময়ী ভগ্নীর স্মৃতি জড়িত সেই গৃহ হস্তান্তরিত হয়ে অপরের বাসস্থান হবে এই চিন্তাই আমাকে কিঞ্চিৎ বিচলিত করে তুলেছে।
কর্ণদেব বলল, বিচলিত হলেই বা উপায় কি? যতদুর মনে হয় তিনসহস্র তো দূরের কথা তিনশত স্বর্ণমুদ্রা সংগ্রহ করাও আপনার সাধ্যাতীত। না হলে, ঋণশোধ করে বসতবাটী রক্ষার চেষ্টা কি আপনি করতেন না?
–চেষ্টা করেছি বৈকি। প্রায় সফলও হয়েছিলাম। কিন্তু বিধি বাম, কি করব বল?
কর্ণদেব কোনো উত্তর দিল না। কিন্তু তার ওষ্ঠাধরে যে সূক্ষ্ম ব্যঙ্গের হাসিটি দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল সেটি বল্লভের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারল না।
বল্লভ উত্তেজিত স্বরে বলল, তুমি ভাবছ আমি মিথ্যা বাগাড়ম্বর করছি। তাই না?… না, না, প্রতিবাদ করে লাভ নেই। কর্ণদেব! আমাকে নিতান্ত নির্বোধ ভাবলে তুমি ভুল করবে। আমি নিশ্চেষ্ট পুরুষ নই। ঋণশোধের জন্য আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম।
কর্ণদেব বিনীত স্বরে বলল, মার্জনা করবেন। স্বীকার করছি আপনার কথা আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। আমার বোঝা উচিত ছিল আপনার মত মানুষ মিথ্যা বাগাড়ম্বর বিস্তার করে না।
বল্লভ বলল, তবে শোনো, তোমাকে দুঃখের কাহিনি বলি। আমার পরিচিত জনৈক কাষ্ঠব্যবসায়ী আমাকে জানিয়েছে আগামী পক্ষকালের মধ্যেই মহারাজ রুদ্রদমনের এক মিত্ররাজ্যে কয়েকটি দুর্গকে দুর্ভেদ্য ও অলঙ্কৃত করার জন্য শ্রাবন্তী থেকে দুর্মূল্য প্রস্তর ও কাষ্ট প্রচুর পরিমাণে উক্ত রাজ্যে প্রেরিত হবে। ওই ব্যবসায়ী আমাকে আশ্বাসদান করে বলেছে, রাজদরবার যদি তাকে কাষ্ঠ সরবরাহের ভার দেয়, তাহলে প্রচুর পরিমাণে শাল সেগুন প্রভৃতি বৃক্ষের কাষ্ঠ সে আমার কাছেই ক্রয় করতে রাজি আছে। কিছু কিছু উৎকৃষ্ট কাষ্ঠ এর মধ্যেই আমি ওই ব্যবসায়ীকে দিচ্ছিলাম এবং মূল্য তার কাছেই জমা রাখছিলাম। তিনসহস্র স্বর্ণমুদ্রা অবশ্য সংগ্রহ করতে অনেক বিলম্ব ছিল। কারণ, দুর্গ বা প্রাসাদোপম অট্টালিকা নির্মাণের উদ্যোগ খুব কমই হয়। আর ওই ধরনের বৃহৎ কার্য না হলে আমার পক্ষে কাষ্ঠ সংগ্রহ করে এককালীন অধিক অর্থের সংস্থান করা অসম্ভব। হঠাৎ মিত্ররাজ্যে কাষ্ঠ সরবরাহের সংবাদ শুনে উৎফুল্ল হয়েছিলাম। আশা ছিল ওই সরবরাহকার্যে যে অর্থ পাব, তার সঙ্গে পূর্বে অর্জিত অর্থ একত্র করে হয়তো আমি ঋণমুক্ত হতে পারব। কিন্তু দুরাত্মা উত্তানপাদ আমাকে সেটুকু সময় দিতে সম্মত হল না। কর্ণদেব! বুঝতেই পারছ, আমি নিতান্ত নিশ্চেষ্ট নই, অক্ষমও নই– ভাগ্যের পরিহাসে আজ সর্বস্ব হারাতে বসেছি। তবে দুর্নীতি অবলম্বন করে আমি বসতবাটী মুক্ত করতে চাই না। তোমার প্রস্তাবে যেন অন্যায়ের গন্ধ আছে বলে মনে হয়। সুতরাং দুশ্চিন্তার প্রয়োজন নেই বললেই আমি দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হব না। যদি তোমার প্রস্তাব ন্যায়সঙ্গত হয় তাহলে আমি নিশ্চয়ই সানন্দে সম্মত হব। আর যদি প্রস্তাব অসঙ্গত মনে করি, তাহলে তোমার কাছ থেকে তিনশত স্বর্ণমুদ্রা দূরের কথা এক কপর্দকও গ্রহণ করব না। তাতে যদি আমার গৃহ হস্তান্তরিত হয়, তবে তাই হোক। আমি চিরকাল ন্যায়পথে থেকেছি, থাকব। এখন বলো কর্ণদেব– কি তোমার প্রস্তাব?
কর্ণদেব বলল, ন্যায়-অন্যায় নিতান্তই আপেক্ষিক শব্দ। একের কাছে যা ন্যায়, অপরের কাছে তা অন্যায় বলে বিবেচিত হতে পারে।
বল্লভ অধীর স্বরে বলল, আমি অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে আছি। এই মুহূর্তে তোমার তত্ত্বকথা আমি শুনতে চাই না, শুনতে চাই প্রস্তাব।
বল্লভের মুখের উপর কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইল কিশোরের তীব্র দৃষ্টি, তারপর সে ধীরে ধীরে বলল, আমিও আমার স্বার্থচিন্তা করে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছি। আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছা বা বিবেচনার উপর একাধিক মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। কিন্তু আমি ভাবছি কথাটা কিভাবে বলব–।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে কর্ণদেব শুস্বরে বলল, বল্লভ! অনিশ্চিত অবস্থায় আর কালক্ষেপ করা যায় না। তবে আপনাকে আমার প্রস্তাব জানানোর আগে আর একটা কথা বলতে চাই।
-বলো।
–একটু আগেই আপনার গৃহে আমার নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিলাম। আপনি হয়তো ভেবেছিলেন আমার কাছে মূল্যবান রত্ন ও প্রচুর অর্থ আছে, তাই তস্কর বা দস্যুর আকস্মিক আক্রমণের সম্ভাবনা আমাকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আপনি নিতান্ত লঘুভাবেই জানিয়েছিলেন, বল্লভের গৃহে তার অতিথি সর্বদাই নিরাপদ। কিন্তু আমি বহিরাগত দস্যু তস্করের ভয় করিনি। আপনার সান্নিধ্যে আমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে কিনা সেইটাই ছিল আমার প্রশ্ন। প্রশ্নের অর্থ আপনি সম্যক উপলব্ধি করতে পারেননি। আমি বলতে চাই
বাধা দিয়ে বল্লভ ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল, তুমি কি বলতে চাও আমি বুঝতে পেরেছি। আমার সান্নিধ্যে তোমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে কিনা এইটাই যদি তোমার প্রশ্ন হয়, তাহলে বুঝতে হবে আমার সততা সম্পর্কে তোমার সন্দেহ আছে। নির্বোধ কিশোর। আমার সততায় সন্দিহান হয়ে কোন সাহসে তুমি আমার অতিথি হলে? আমার শক্তির পরিচয় তুমি পেয়েছ। তুমি কি জানো না, ইচ্ছা করলে এক মুষ্ট্যাঘাতে তোমাকে বধ করে আমি তোমার ধনরত্ন লুণ্ঠন করতে পারি?
মুহূর্তের জন্য কর্ণদেবের চোখে-মুখে দেখা দিল আহত বিস্ময়ের চমক, পরক্ষণেই বিস্ময়ের অভিব্যক্তিকে গ্রাস করে উপস্থিত হল ক্রোধের করাল ছায়া
শ্লেষতিক্ত হাসির ফাঁকে জাগল বিদ্রূপশাণিত কণ্ঠস্বর, বল্লভ! বয়স অল্প হলেও মানব-চরিত্রে আমার কিছু অভিজ্ঞতা আছে। অর্থের লোভে যে-মানুষ নির্বিকার চিত্তে নির্দোষ ব্যক্তিকে হত্যা করতে পারে, এমন এক বিবেকহীন হন্তারকের ভূমিকায় আপনাকে আমি একবারও কল্পনা করিনি। তবে মানুষের অবচেতন মনের অন্ধকারে যে হিংস্র পশু ঘুমিয়ে থাকে, রাতের অন্ধকারে তার হঠাৎ জাগ্রত হওয়ার সম্ভাবনা আছে একথাও আমি অস্বীকার করি না। সেটুকু বিপদের ঝুঁকি আমি নিয়েছি বইকি। আপনি মহাশক্তিরধর বটে, কিন্তু আমিও নিতান্ত নিবীর্য নই। একটু আগেই ব্যাঘ্র ও হস্তীর তুলনামূলক আলোচনা আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই?…হ্যাঁ, হস্তীর পদতলে পিষ্ট ব্যাঘ্রের মৃত্যুবরণের সম্ভাবনা থাকে বটে, কিন্তু ক্ষিপ্রগামী ব্যাঘ্রের নখদন্তে বিদারিতকুম্ভ গজরাজের প্রাণত্যাগের ঘটনাও খুব বিরল নয়।
কর্ণদেবের অঙ্গুলিস্পর্শে কটিবন্ধের তরবারিতে জাগল মৃদু ঝনকার শব্দ!
তৎক্ষণাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে দাঁড়াল বল্লভ! প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জ্যামুক্ত তীরের মতো দণ্ডায়মান হল কর্ণদেব!
বল্লভের দুই চক্ষু দারুণ ক্রোধে জ্বলন্ত এবং দুই হস্ত মুষ্টিবদ্ধ!
কর্ণদেবের অধরে ক্লিষ্ট হাসির রেখা হাত কটিবন্ধের অস্ত্রে সংলগ্ন নয়, কিন্তু ডান হাতের পাঁচটি আঙুল বাজপাখির ছোঁ মামার ভঙ্গিতে স্থির হয়ে আছে তরবারির হাতল থেকে একটু দূরে!
বল্লভ সেদিকে দৃকপাত করল না, ক্রুদ্ধস্বরে গর্জন করে বলল, অতিথিকে আমাদের বংশে কেউ কোনোদিন অপমান করেনি, কিন্তু তোমার উপস্থিতি আমি সহ্য করতে পারছি না। অনুগ্রহ করে এই মুহূর্তে তুমি আমার গৃহত্যাগ করো। নচেৎ–
দারুণ ক্রোধে তার কণ্ঠরুদ্ধ হল।
কিছুক্ষণ বিমূঢ় অবস্থায় রইল কর্ণদেব, তার ওষ্ঠাধরে ক্লিষ্ট হাসির ক্ষীণ রেখাঁটি হঠাৎ উদার হাস্যে প্রশস্ত হল, পরক্ষণেই সে প্রচণ্ড অট্টহাস্যে ফেটে পড়ল, আমি যাব না। সাধ্য থাকে, বলপ্রয়োগ করে অতিথিকে গৃহ থেকে দূর করে দাও।
ক্ষিপ্রহস্তে সে খুলে ফেলল কোমরের চর্মবন্ধনী- মণিকুট্টিমের উপর নিক্ষিপ্ত হল কটিবন্ধসমেত কোষবদ্ধ ছুরিকা ও তরবারি! পাষাণ ও ইস্পাতের সংঘাতে জাগল তীব্র ঝঞ্জনা-ধ্বনি!
বল্লভ হতবুদ্ধি হয়ে গেল! এমন অদ্ভুত আচরণ তার কল্পনাতীত!
দুই বাহু বক্ষে আবদ্ধ করে কর্ণদেব গর্বিত স্বরে বলল, তোমার সততা সম্পর্কে আমি সন্দেহ প্রকাশ করিনি। কিন্তু আমার বক্তব্য পরিষ্কার করে বলার সুযোগও তুমি আমাকে দাওনি। অর্ধসমাপ্ত বাক্যের বিকৃত ব্যাখ্যা করে তুমি আমাকে অপমান করেছ। দাম্ভিক মল্ল! শক্তির দম্ভে আত্মহারা হয়ে তুমি অসিযোদ্ধার মর্যাদায় আঘাত করেছিলে– তাই তোমাকে বুঝিয়ে দিলাম তরবারির সঙ্গে যে-মানুষ বন্ধুত্ব স্থাপন করেছে, সে কখনো ব্যক্তিবিশেষের শারীরিক শক্তির কথা ভেবে ভীত হয় না। ব্যাঘ্রের নখদন্ত যেমন তার ইচ্ছায় পরিচার্লিত হয়ে তার চেয়ে বহুগুণ বলশালী গজরাজের দেহ বিদীর্ণ করতে পারে নিপুণ অসিচালকের অসিও তেমনই আজ্ঞাবাহী সহচরের ন্যায় চালকের ইচ্ছানুযায়ী চার্লিত হয়ে মহাবলবান শত্রুকে ছিন্নভিন্ন করতে পারে।
একটু থেমে উত্তেজিত কণ্ঠকে সংযত করে কর্ণদেব আবার বলতে লাগল, নিরাপত্তার প্রশ্নে তুমি উত্তেজিত হলে কেন? আমি তোমার কাছ থেকে আক্রমণের আশঙ্কা করিনি, তবে অবাঞ্ছনীয় পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিলাম বটে। প্রকৃতপক্ষে আমি বলতে চেয়েছিলাম আমার গোপন কথা তোমাকে জানানোর পর কোনো কারণে যদি তুমি আমার উপর অসন্তুষ্ট হও, তাহলে ওই গোপন কথা কি গোপনই থাকবে? যদি নিশীথে রাজপথে বিচরণরত প্রহরীদের কাছে তুমি চিৎকার করে আমার পরিচয় ঘোষণা করে দাও, তাহলে আমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমি তাই তোমার কাছে আশ্বাস চেয়েছিলাম। আমার প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলেও আমার পরিচয় তুমি জনারণ্যে প্রকাশ করবে না; ঘৃণার উদ্রেক হলে বাক্যালাপ বন্ধ করবে, কিন্তু রাজপুরুষের কাছে আমার পরিচয় দিয়ে আমাকে বিপন্ন করবে না এইটুকু আশ্বাস, এইটুকু অঙ্গীকার আমি শুনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সব কথা খুলে বলার আগেই তুমি আমাকে গৃহ হতে বহিষ্কার করতে উদ্যত হয়েছ।
বল্লভ নির্বাক। তার দৃষ্টি কক্ষতলে নিবদ্ধ। কর্ণদেবের কণ্ঠ আবার নিস্তব্ধ কক্ষে প্রতিধ্বনিত হল, আমি অস্ত্রত্যাগ করেছি। তোমার মতো মহাবলিষ্ঠ পুরুষের কাছে নিরস্ত্র অবস্থায় আমি নিতান্ত অসহায়। কিন্তু বেত্রাহত কুকুরের ন্যায় তোমার গৃহত্যাগ করতে রাজি নই, তোমার যা খুশি করতে পারো।
বল্লভ স্খলিত স্বরে বলল, আমি কোপনস্বভাব নই। কিন্তু উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় আমি বিচলিত। আর তুমিও ভালোভাবে তোমার কথা বলতে পারোনি। যাই হোক, আমার দুর্ব্যবহারের জন্য আমি লজ্জিত। আশা করি আমার মানসিক অবস্থার কথা ভেবে আমায় ক্ষমা করবে।
কর্ণদেব কথা বলল না। তার মুখের কঠিন রেখাগুলো মিলিয়ে যেতে লাগল। সে আবার পালঙ্কের উপর উপবেশন করল।
বল্লভ কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বলল, কর্ণদেব তুমি আমার কাছে কোনো প্রস্তাব করবে কি করবে না সেটা তোমার বিবেচ্য। কিন্তু আমি ভাবছি তোমার মতো সুদর্শন কিশোরের এমনকী গোপন কথা, এমনকী গোপন পরিচয় থাকতে পারে যে কথা রাজপুরুষের কানে এলে তোমার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
কর্ণদেব নীরব। কেবল তার ওষ্ঠাধরে অনুপস্থিত হাসির রেখা আবার ফিরে আসার উপক্রম করল!
বল্লভ বলল, যাই হোক, আমি শপথ করে বলছি তোমার গোপন কথা আমার গোচরে এলে সেই কথা কোনোক্রমেই তৃতীয় ব্যক্তির শ্রুতিগোচর হবে না।
-এইটুকুই শুনতে চেয়েছিলাম। এবার আমি নিশ্চিন্ত হলাম… আচ্ছা! যে প্রস্তাব করার জন্য আমি উগ্রীব আর যে প্রস্তাব শোনার জন্য তুমি উৎকণ্ঠিত– এখন সেই প্রস্তাব তোমার সম্মুখে উপস্থিত করছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা জানতে পারব মৃত্যুভয়াল এক বন্ধুর পথে আমরা পরস্পরের বন্ধু হব না, চিরকালের মতো বিচ্ছিন্ন হব।.. হ্যাঁ, আমার বক্তব্য শুনলেই তুমি বুঝবে আমার প্রস্তাবে সম্মতি না দিলে আমাদের বিচ্ছেদ অনিবার্য। এমনকী, সুদূর ভবিষ্যতে আমাদের সাক্ষাৎকার ঘটলে আমরা পরস্পরের সঙ্গে অপরিচিতের মতো ব্যবহার করব।
কর্ণদেব! বল্লভ বলল, তোমার প্রস্তাবে যদি সম্মত না হই, তাহলে আমরা পরিচয় অস্বীকার করব কেন?
–কারণ, আমার প্রস্তাবে অসম্মত হলে বুঝতে হবে আমাকে তুমি ঘৃণা করছ।
–তবে তোমার প্রস্তাব ঘৃণ্য?
–না। কিন্তু এই প্রস্তাবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়। সেই পরিচয় ব্যক্তিবিশেষের কাছে ঘৃণ্য বলে পরিগণিত হতে পারে।
কর্ণদেব! মানুষের মুখ দর্পণের মতো। তোমার মুখশ্রী সুন্দর; বাচনভঙ্গি মার্জিত; তোমার কার্যকলাপ উচ্চবংশজাত আর্যযোদ্ধার পরিচয় বহন করছে। কোনো ভদ্ৰব্যক্তির পক্ষে তোমাকে ঘৃণা করার সঙ্গত কারণ থাকতে পারে বলে মনে হয় না।
-যদি বলি আমি এক দুস্যুর অনুচর? তাহলেও কি তুমি আমাকে ঘৃণা করবে না?
-তুমি দস্যুর অনুচর? … অসম্ভব! তোমার মুখ চোখ, তোমার ব্যবহার উচ্চবংশজাত আর্যপুরুষের পরিচয় জানিয়ে দিচ্ছে…
– বল্লভ! আমিও তোমাকে জানিয়ে দিচ্ছি উচ্চবংশজাত কোনো আর্যপুরুষের পক্ষে দস্যু পরন্তপের দলে যোগ দিতে বাধা নেই।
–দস্যু পরন্তপ!
–হ্যাঁ। আমি পরন্তপের বিশেষ স্নেহের পাত্র। সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত অনুচর!